গোয়ালাবাজার গণহত্যা, সিলেট
সিলেটের বিশ্বনাথ থানার গোয়ালাবাজার গ্রামে একদিন হানা দেয় পাক পশুরা। বাড়ি থেকে আটক করে আবদুল মান্নান চৌধুরীকে। একইভাবে পাকসেনারা আটক করে গদিয়ার চর গ্রামের আবদুল মনাফ ও মোড়লদাশ গ্রামের তোতা মিয়াকে। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাঁদের সবাইকে। গোয়ালাবাজারের পূর্ব দিকের হাওরে হত্যা করে তারা অজ্ঞাতপরিচয় দুজনকে। নিজেদের হাত পাকা করার জন্যেই নাকি পাকবাহিনী গুলি করেছিল কাশিপাড়া গ্রামের নয়ান শুক্লা বৈদ্যকে লক্ষ্য করে।
পাকসেনারা ৬ মে লালকৈলাশে নারী নির্যাতন শেষে গুপ্তপাড়া গ্রামে আসে। সেখানে তারা হত্যা করে গোপেশ পালকে। তারপর অভিযান চালায় পুরকায়স্থ পাড়ায়। তাদের আগমন সংবাদে ভীতসন্ত্রস্ত লোকজন তখন পলায়নরত। এ অবস্থাতেই সেনাদের নির্বিচার গুলিতে নিহত হন গৌরীচরণ দেব, শুরুচরণ দেব ও মথুরা চরণ দেব। গুরুতর আহত হন সুরেন্দ্র মালাকার। তারপর একে একে হত্যা করে তারা দাশপাড়ার গৌরীচরণ গুপ্ত, জিয়াপক গ্রামের ময়না মিয়া ও মছদ্দর আলী, বরায়া গ্রামের আবদুল মতিন এবং মোবারকপুরের বিনোদ দাশকে।
তারপরের ঘটনা আরও বীভৎস, আরও মর্মান্তিক। পাকবাহিনী ধরে আনে ওমরপুরের ওজীব উল্লাহ্ টেন্ডল, মদরিছ আলী, ইজলশাহের শফিকুর রহমান, ইসবপুরের প্রমোদ মালাকার, গুপ্তপাড়ার ভূতন মালাকার এবং পুরকায়স্থ পাড়ার রবীন্দ্র কুমার ধরকে। শেষোক্ত তিনজনই ছিলেন দিনমজুর। তাঁরা সারাদিন ধরে বাজারে কাজকর্ম করার পর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেন। হাতে থাকত একসের চাল ও কিছু লবণ, কেরোসিন। সেদিনও রবীন্দ্রকুমার ধর তাড়াহুড়ো করে ফিরছিলেন। গামছায় বাঁধা একসের চাল। তাঁর তিন ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী সকাল থেকেই উপবাসী। তাই তিনি ছুটছিলেন ত্রস্তপদে। সহসা তাঁর যাত্রাপথ রোধ করে দাঁড়ায় বন্দুকধারী পাক দস্যুরা। তিনি কোনো কিছু আঁচ করে ওঠার আগেই তাঁকে তারা বেঁধে ফেলে। তারপর জোর করে তুলে নেয় তাদের গাড়িতে। অভুক্ত শিশুদের জন্যে কেনা একসের চাল বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য হায়েনাদের পায়ে ধরে সময় প্রার্থনা করতে গিয়ে বিনিময়ে পেলেন তিনি বেয়নেটের খোঁচা আর এ দেশীয় দোসরদের চোখ-রাঙানো শাসানি। গাড়ি ছুটে চলল দক্ষিণ দিকে। এক সময় এসে থামে তা শেরপুর ফেরিঘাটে। এখানে এসেই ছজন বন্দিকে গাড়ি থেকে নামিয়ে শক্ত করে তাঁদের হাত-পা বেঁধে নিক্ষেপ করে তারা কুশিয়ারার খরস্রোতে। অগাধ জলে ডুবে প্রাণ হারান সৃষ্টির সেরা ছয়জন জীব। আর এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সাহায্য করল ইসলামের রক্ষক দাবিদার পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর লেলিয়ে দেয়া পাকসেনারা।
জুন মাসের কোনো একদিন পাকবাহিনী মগবেলপুর গ্রামের বিশিষ্ট আইনজীবী মনোরঞ্জন দাসকে তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে আটক করে। নিয়ে আসে তাঁকে বুরুঙ্গাবাজারে। সাথে রাকেশ রঞ্জন দেবরায়কে। তাঁদের ধরার ব্যাপারে নির্দেশ ছিল শান্তি কমিটির আহ্বায়ক সাইফউদ্দিন আহমদের। পরে দুই হাজার টাকার বিনিময়ে তাঁরা ছাড়া পান।
মশাখলা ও গলমুকাপন থেকে হাজীপুর গ্রামে বেড়াতে আসেন দুজন তাঁদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। ওই গ্রামের দালাল আবদুল খালেক ও তার ছেলে তাঁদের ধরে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। আর সাথে সাথে শেরপুরে নিয়ে গিয়ে তাঁদের হত্যা করে পাকসেনারা। এই অঞ্চলের আরেক কুখ্যাত দালাল গৌছুর রহমান এবং আবদুল মজিদ তাদের সাঙ্গপাঙ্গসহ রাত নয়টার সময় বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় মনমোহন দাশকে। একই গ্রামের সফর আলীর বাড়িতে তাঁকে নিয়ে গিয়ে মৃত্যুপণ হিসেবে তাঁর কাছে ১০ ভরি সোনা এবং মনমোহন দাশের বাড়িতে আশ্রিত চার যুবতী মেয়েকে দাবি করে। দাবি পূরণে রাজি হন তিনি। কিন্তু সোনা ও মেয়ে হস্তান্তরের জন্যে বাড়ি যাওয়ার পথে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে তিনি পালিয়ে যেতে সমর্থ হন।
এর আগে ১০ এপ্রিল ইসাগড়াইয়ের এক দালাল ১০ জন পাকসেনা নিয়ে হাজির হয় পশ্চিম সিরাজনগরে। গ্রামে প্রবেশ করেই তারা গুলি করে হত্যা করে পরেশ চন্দ্র দেব ও নন্দলাল পালকে। সেই সাথে আগুন লাগিয়ে ছাই করে দেয় উমেশ দত্তের বাড়িটি।
[ ৪৬ ] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত