You dont have javascript enabled! Please enable it! গোলারটেক বধ্যভূমি | ঢাকা - সংগ্রামের নোটবুক

গোলারটেক বধ্যভূমি, ঢাকা

রাজধানী ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের ঠিক পেছনের এলাকাটির নাম গোলারটেক। শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের ঠিক উত্তর দিকে যে গণকবরটি রয়েছে সেখানে ১৮টি শহীদের লাশ একসাথে কবর দেয়া হয় এবং স্মৃতিসৌধের জায়গাটি আব্দুল মান্নান খান সাহেবের পুরানো বাড়ি হিসেবে পরিচিত। ‘৭১-এ যেখানে ছিল শত শত শহীদের লাশের স্তূপ। শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের পশ্চিমে এখন যে মাঠটি ‘গোলারটেক ঈদগাহ মাঠ’ নামে পরিচিত তার দক্ষিণ দিকে একটি কুয়া ছিল। কুয়াটি পরিপূর্ণ ছিল শহীদের লাশে। এছাড়া দক্ষিণ পাশে আমগাছের পেছনের জায়গাটি ছিল ডোবা। ডোবাটি ভর্তি ছিল শহীদের লাশে। ১ম, ২য় ও ৩য় কলোনি পুরোটিই বিহারি অধ্যুষিত এলাকা ছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও বিহারদের নারকীয় হত্যাকাণ্ড নাৎসি বাহিনীর বর্বরতাকেও হার মানায়। স্বল্প সময়ে এমন বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর আর কোথাও হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
গোলারটেক বধ্যভূমি সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস সালাম (৬০) চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। তিনি জানান, ‘৭১-এ তিনি সড়ক ও জনপথ বিভাগে চাকরিরত ছিলেন। ‘৭১-এর ২০ এপ্রিল মিরপুর মাজার শরিফের কাছ থেকে বিহারিরা তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে সেকেন্ড কলোনি (বর্তমান ১০ নং ওয়ার্ড কমিউনিটি সেন্টারের দক্ষিণ দিকের রাস্তায়) নিয়ে গিয়ে নির্যাতনের পর তার পেটে ছুরি চালায়। প্রচুর রক্ত দেখে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। বিহারিরা তাকে মৃত ভেবে গোলারটেক মাঠের দক্ষিণে অবস্থিত কুয়ায় ফেলে দেয়। জ্ঞান ফিরলে তিনি চিৎকার করে মানুষের সাহায্য চাইতে থাকেন। তখন টের পান অসংখ্য লাশের ওপর তিনি পড়ে আছেন। তার দেহের নিচে পড়ে থাকা মানুষটি তখনও মরেনি। ঐ ব্যক্তি অস্ফুট কণ্ঠে গোঙ্গাচ্ছিলেন। কোনো কথা বলতে পারেননি। কারণ তাকে জবাই করা হয়েছিল। আব্দুস সালামের চোখের সামনেই মারা যান ঐ ব্যক্তি। তখন আব্দুস সালাম শরীরের শার্ট খুলে পেট বেঁধে ফেলেন এবং চিৎকার করে সাহায্য চাইতে থাকেন। এক সময় চিৎকার শুনে স্থানীয় মানুষ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। মূলত কুয়াটি শহীদদের লাশে বোঝাই না হলে এত গভীর কুয়া থেকে তাকে উদ্ধার করা কঠিন হতো। যখন তাকে কুয়ায় ফেলা হয় তখন কুয়ার মুখের উচ্চতা আনুমানিক ৭-৮ হাত উঁচুতে ছিল। অর্থাৎ পুরো কুয়াটিই ভরে গিয়েছিল শহীদদের লাশে অথচ কুয়াটির গভীরতা আনুমানিক ৬০-৭০ ফুট গভীর ছিল। কুয়ার ভেতর প্রচণ্ড দুর্গন্ধ পান আব্দুস সালাম। অর্থাৎ ভেতরে ফেলা শহীদদের লাশগুলো পচে গিয়েছিল।
গোলারটেক বধ্যভূমি সম্পর্কে আরও জানান সাংবাদিক মকবুল হোসেনের স্ত্রী শামসুন নাহার (৬৫)। তিনি জানান, ‘৭১-এ এই এলাকাটি (গোলারটেক) মূলত ছিল হিন্দুপাড়া। পুরো এলাকাজুড়েই হিন্দু পালেরা বসবাস করত। তাই এই এলাকায় ব্যাপক হত্যা সংঘটিত হয়। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও বিহারিরা তিন দিক দিয়ে আক্রমণ করে এবং হত্যাসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। প্রচুর বাড়ি লুট করে পুড়িয়ে দেয় বিহারিরা। বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু হয়। আবালবৃদ্ধবনিতা সকলে জীবনের ভয়ে দিগ্‌বিদিগ্‌ জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাতে শুরু করে। গোলারটেক ঈদগাহ মাঠের দক্ষিণ পাশের কুয়াটি শহীদদের লাশে ভর্তি ছিল। এছাড়া পুরো মাঠজুড়েই ছিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শহীদের লাশ। মাঠের উত্তর পাশের নিচু ভূমিতে প্রচুর লাশ ছিল। সব দেহাবশেষ একসাথে করে গণকবরে কবর দেয়া হয়। এছাড়া শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধের উত্তরে অবস্থিত চিহ্নিত গণকবরে একসাথে ১৮টি লাশ কবর দেয়া হয়।
[৬৬] মিরাজ মিজু

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত