খাদিমনগর চা বাগান গনহত্যা, সিলেট
বাগানের টিলা ম্যানেজারের বাংলোয় আস্তানা করেছিল পাকবাহিনীর এক কর্মকর্তা। বাংলোয় অবস্থানরত ছিল রাম পিরিত রবিদাস নামের একজন সুদর্শন কিশোর। হানাদার বাহিনীর দোসর ২৩ মার্চ প্রকাশ্যে ওই কিশোরের সাথে সমকামে লিপ্ত হয়। কিশোরটি এই জঘন্যতম কাছে বাঁধা দিলে তাকে অমানবিকভাবে প্রহার করে টিলার নিচে ফেলে দেয়া হয়। সৌভাগ্যক্রমে কিশোরটির প্রানরক্ষা প্রায়। বাগানের শ্রমিকরা এহেন মধ্যযুগীয় বর্বরতার প্রতিবাদ করে। ফলে, হানাদার সেনাটি বাগান থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয়। কিন্তু যাওয়ার সময় সে বহু লোককে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে যায়। শ্রমিকদের ওপর তাঁদের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। সমুচিত শিক্ষা দেয়র সুযোগ খুজতে থাকে তারা এরই মধ্যে ২৫ মার্চের সেই কালরাত্রি এগিয়ে এলো, সমগ্র বাংলায় নিরীহ নিরপরাধ জনগণের ওপর ছুড়ল তারা ট্যাংক-মর্টার আর কামানের গোলা। হত্যা করল কয়েক লক্ষ লোককে। তারপর ছড়িয়ে পড়ল তারা গ্রামে গঞ্জে। শিবির স্থাপন করল খাদিমনগরেও। ২৬ মার্চে একদল হানাদার বাগানে প্রবেশ করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। শিশু বৃদ্ধ নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙালিকে নির্বিচারে নির্যাতন করে। শ্রমিকদের ঘরগুলোও ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়। তাঁদের অমানুষিক অত্যাচারে দুই হাজার শ্রমিক বাগান ছেড়ে এক বস্ত্রে পালিয়ে যায়। অতি অল্প লোকই এরপর বাগানে অবস্থান করে। বাগানও কার্যত তখন বন্ধ। পশ্চিমা ব্যাবস্থাপকও চলে গেছেন। ব্যবস্থাপকের বাঙ্গালোয় আস্তানা গেড়েছে তখন পাকবাহিনীর আরেক কর্মকর্তা।
সেই কুখ্যাত কর্মকর্তার নির্দেশে ১৯ এপ্রিল বাগানে অবস্থানরত সকল শ্রমিককে ডাকা হলো। উদ্দেশ্য শ্রমিকদের কাজ ও রেশন প্রদান করা। অভুক্ত শ্রমিকরা পেটের জ্বালায় সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে সমবেত হলো ব্যবস্থাপকের বানগ্লোর পেছনে। তারপর সেখানকার একটি শ্রমিক কোয়ার্টারে ঢোকানো হলো সবাইকে। বলা হলো, ওই ঘরে ঢুকলেই তাঁদের নাম তালিকাভুক্ত করে রেশন দেয়া হবে। হ্যা, ঘরের ভেতরে তাঁদের নামও লেখা হয়েছিল। তারপরই বন্ধ হয়ে গেল ঘরের দরজা। হানাদাররা ছোট্ট একটি জানালা দিয়ে ছুড়ে মারল টিয়ার গ্যাসের সেল। একবার নয়, দুবার নয়, অসংখ্যবার নিক্ষেপ করা হলো এই রকম অসংখ্য সেল। ফলে গ্যাসে দম বন্ধ হয়ে ছটফট করতে লাগল ৪৬ জন শ্রমিক। এক চিলতে ঘরের মধ্যে যন্ত্রণায় যখন তারা লাফালাফি, দাপাদাপি করছিল ঠিক সেই সময় সেই জানালা দিয়েই পাষণ্ডরা সমানে গুলি চালাতে লাগল। গ্যাস আর গুলিতে ঘরের ভেতরের তীব্র যন্ত্রণার্ত মানুষগুলোর মর্মভেদী সেই হাহাকার পাক পাষণ্ডদের কঠিন হৃদয়ে এতটুকু টলাতে পারেনি। নির্বিচার গুলি বর্ষণে প্রাণ বিসর্জন দেন এখানে ৪৪ জন শ্রমিক। মৃত্যুর সাথে লড়ে আহত হয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন শ্রমিকদের দুজন এঁরা গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মরার ভান করে পরেছিলেন।
এই হত্যাকাণ্ডের পর একজন খ্রিস্টান ছেলে ধরে এনে তাকে দিয়ে ঐ ঘরের বামপাশে একটি গর্ত করে সবকটি লাশ মাটিচাপা দেয়া হয়। সেই গর্তে আজও শুয়ে আছেন ৪৪ জন জানা-অজানা শ্রমিক। কিন্তু সেই গর্তটির ওপর দিয়ে আজ নির্মিত হয়েছে পানি নিষ্কাশনের একটি কাঁচা নালা। গনকবরের কোনো চিহ্নই আর নেই।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত