খাদিমনগর তিন নম্বর বস্তি গণহত্যা, সিলেট
১৯৭১ সালের ২৮ মার্চের ভোর। অধিকাংশ মানুষ ঘুমের গভীরে অচেতন। ঠিক এমনি মুহূর্তে ভোরের নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে সামনের দিকে এগিয়ে চলল। জলাপাই রঙের জিপটি, সিলেট শহর থেকে বের হয়ে সোজা পূবমুখো ছুটল মিনিট পাঁচেক। তারপর গতি পরিবর্তন করে হাতের বাঁদিকে একটি সরু রাস্তায় প্রবেশ করে। মুরারীচাদ মহাবিদ্যালয়কে পেছনে রেখে অগ্রসর হতে থাকে একটি চা বাগানের দিকে।
খাদিমনগর চা বাগানের তিন নম্বর বস্তির বাসিন্দারা হঠাত করে জিপগাড়ির শব্দে একটু আশ্চর্যই হলো। এ সময় বড় সাহেবের গাড়ি আসার কথা নয়। পাক সামরিক বাহিনীর জীপ। আরোহীদের চারজনই জলপাই রঙের উর্দি পরা। হাতে তাঁদের আমেরিকান ও চীনা আগ্নেয়াস্ত্র, ঠোটে ক্রূর হাসি। বস্তির মধ্যবর্তী এক জায়গায় এসে দাড়াল গাড়িটি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে গাড়ি থেকে নেমেই চারজন সেনা সদস্য টহল দিতে লাগল বস্তিময়। ঘুম ভাঙাল সমগ্র বস্তিবাসীর। সদ্য জাগ্রত শ্রমিকরা কিছু আচ করার আগেই জারি ছলো ফরমান – সবাইকে ঘর থেকে বের হতে হবে। কেন বের হতে হবে, কোথায় যেতে হবে, কী প্রয়োজন ইত্যাদি প্রশ্ন করা অবান্তর। ছেলে-বুড়া, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি প্রানীই বেরিয়ে এলো বাইরে, ছুটল পাকসেনাদের নির্দেশিত পথে। অবশেষে বস্তির মধ্যবর্তী জায়গায় সবাইকে জড়ো করা হলো। তারপরই নারী-শিশু ও পুরুষদের দুভাগে বিভক্ত করা হলো। সেনারাও দুভাগে বিভক্ত হয়ে দু গ্রুপের দায়িত্ব গ্রহণ করল। মহিলা ও শিশু-কিশোরদের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলো একজন সেনা সদস্য, দলনেতাদের কাছে থেকে নির্দেশ এলো এঁদের পুড়িয়ে মারা হোক। নির্দেশ মতো তাঁদের বিশ্বহরির ঘরে আবদ্ধ করে দরজা –জানালা বাইরে থেকে বন্ধ করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো। এবার পাকসেনাদের দ্বিতীয় গ্রুপটি বন্দিদের নিয়ে যায় একটি নির্দিষ্ট স্থানে। এই অবস্থাত মুখে বন্দীরা নিজেদের প্রাণ রক্ষার্থে মরিয়া হয়ে ওঠে। পালাবার চেষ্টা করে অনেকেই। প্রাণ বাঁচানোর এই শেষ চেষতায় যারা সফল হতে পারেনি তাঁদের সবাইকে বস্তির পূর্ব পাশে একটি ছোট্ট নালার ধারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয়। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল নতুন রিক্রুট করা সৈন্যদের একটি দলকে প্রশিক্ষক দিচ্ছে একদল সৈন্য। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তো তা নয়। একটুক্ষণ পর্যবেক্ষণের পর অধিনায়কের দুই ঠোটের ফাঁক দিয়ে বের হলো একটি মাত্র শব্দ, ‘ফায়ার’। লুটিয়ে পড়লো ধৃত শ্রমিকদের অনেকেই।
অপারেশন সকল হওয়ার আনন্দে গাড়ির দিকে অগ্রসর হতে লাগলো দ্বিতীয় গ্রুপের তিনজন পাকসেনা। অন্যদিকে বিশ্বহরির ঘরে আবদ্ধ অগণিত নারী আর শিশু দগ্ধ হতে হতে আর্ত চিৎকারে আকাশ-বাতাশ প্রকম্পিত করে তুলছিল। একস্ময় তাঁদের সেই গগনবিদারী কান্না দায়িত্ব প্রাপ্ত সেনাটির পাষাণ হৃদয়ে দয়ার উদ্রেক করে। বিশ্বহরির ঘরের পেছন দিয়ে একটি দরজা চুপিসারে খুলে দিয়ে তাঁদের বেত করে দেয়। তারপর ঘরতি পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়। আর ওই পাকসেনাটি অন্য সাথীদের সঙ্গে চেপে বসে গাড়িতে। এবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো মহিলা শ্রমিকদের ওপর। ঝাঁপিয়ে পড়ল তারা তাঁদের ওপর এক পাশবিক উন্মত্ততায়। ধর্ষণে ধর্ষণে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলল অসহায় স্বামী পুত্রহারা এসব শ্রমজীবী মহিলার দেহগুলো। পাশবিক লালসা চরিতার্থ করার পর এবার তারা রওয়ানা হলো সিলেট শহর অভিমুখে।
দিনের আলো প্রস্ফুটিত হওয়ার সাথে সাথে চারপাশের মানুষেরা শুনলেন আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন এবং আত্মমানবতার ক্রন্দন। ছুটে এলেন কেউ কেউ গুলির শব্দ লক্ষ্য করে। আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে ছিলেন কেউ কেউ। পাক সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর দূর থেকে দেখা গেল অসংখ্য লাশের রক্তস্রোতে ভাসছে বিভিন্ন লোকের লাশ। সেই মুহূর্তে লাশগুলো ওঠানো, সৎকার করা বা তাঁদের আত্মীয়স্বজনের কাছে পৌছানোর মতো সাহস, ধৈর্য বা সময় কারোর ছিল না।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত