You dont have javascript enabled! Please enable it! কালাপানি বধ্যভূমি | ঢাকা - সংগ্রামের নোটবুক

কালাপানি বধ্যভূমি, ঢাকা

ঢাকার মিরপুর ১২নং সেকশনের সিরামিক ফ্যাক্টরের পাশ দিয়ে বর্তমানে সাগুফতা হাউজিং যেতে যে সড়কটি ব্যবহার করা হয় তারই মাঝামাঝি বঙ্গবন্ধু কলেজের পূর্বপাশে ‘কালাপানি বধ্যভূমি’ অবস্থিত। যা বর্তমানে শহীদবাগ নামে পরিচিত। মিরপুরে অবস্থিত যতগুলো বধ্যভূমি আছে তাঁর মধ্যে ব্যাপক সংখ্যক শহিদের লাশ পাওয়া যায় এই ‘কালাপানি বধ্যভূমি’ থেকে।
স্থানীয় বাসিন্দা প্রত্যক্ষদর্শী মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন ভূঁইয়া প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিবরণ থেকে জানা অনেক ইতিহাস। তিনি বলেন, একাত্তরের ২৫ মার্চ গণ্ডগোল শুরু হলে ২৬ মার্চ সকালেই পালিয়ে উত্তরা থানাধীন মাউসাউদ গ্রামে চলে যান। ফিরে আসেন স্বাধীনতার পর। বালুঘাট দিয়ে কালাপানি আসার সময় সাঁকোর কাছে দেখা হয় অভিনেত্রী ববিতা ও সুচন্দার সাথে। তারা নিখোঁজ জহির রায়হানকে খুজতে এসেছিলেন। সাঁকোটি গাজী মাতাব্বর ও এসহাক মাতব্বরের বাড়ির মাঝখানে ছিল। কালাপানি তখন বিরানভূমি। চারদিকে ফাঁকা থাকায় এখানে তেমন লোকজনের চলাচল ছিল না। উত্তর কালসী বুড়িরট্যাক থেকে একটি রাস্তা কালাপানি জামে মসজিদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বর্তমানে রাস্তাটি আর নেই। এই রাস্তার দু পাশে প্রচুর লাশ দেখতে পান। নিচু ভূমি হওয়ার পর ৩০ জানুয়ারি পুলিশ ও বিডিআর-এর একটি দল আসে অস্ত্র উদ্ধারের জন্য। তখন বিহারিরা অতর্কিত হামলা চালায়। বিহারিদের হামলার ধরন দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় বিহারিদের সাথে আত্মপরিচয় গোপন রেকেহ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও ছিল সেখানে এবং সেই যুদ্ধে আনুমানিক কয়েকশ’ পুলিশ সদস্য, সেনা সদস্য ও সাধারণ মানুষ শহীদ হন।
এছাড়া হাজীদের বহনকারী বি.আর.টি.সির লাল মাইক্রোবাসগুলো টেকনিক্যালের কাছ থেকে নিয়ে এসে হাজীদের হত্যা করা হয় কালাপানি বধ্যভূমিতে। বেশিরভাগ মানুষকেই জবাই করে হত্যা করা হতো। আমার পরিবারের দুজন শহীদ হন ’৭১-এর যুদ্ধে। আমার চাচা আব্দুল হাই ভুঁইয়া ও ফুফা জয়নাল উদ্দিন ভূঁইয়াকে হত্যা করা হয় এখানেই। ধারণা করা হয় তাঁদের লাশও ‘কালাপানি বধ্যভূমি’তে ফেলা হয়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন জায়গা থেকে লাশ এনে ‘কালাপানি বধ্যভুমি’তে ফেলা হতো।
১৯৭২ সালে ডা. মোশারফ হোসেন (এমসিএ), ফকির শরিফ উদ্দিন (তৎকালীন বৃহত্তর মিরপুর ও হরিরামপুরের চেয়ারম্যান), ইকবাল (তৎকালীন মিরপুর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা), আব্দুল মালেক (বর্তমান ২ নং ওয়ার্ড), তৎকালীন ৭নং ওয়ার্ডের রিলিফ কমিটির কনভেনর), হারুন মোল্লা, ডা. মনসুর, রায়হান সাহেব, মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিনের উপস্থিতিতে ৮১ বস্তা দেহাবশেষ উদ্ধার করে বি.আর.টি.সির গেটের সামনে জড়ো করা হয়।
পুরো কালাপানিতেই মানুষের লাশ পাওয়া যেত। ১২ নং পানির ট্যাংকির কাছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশের সাথে বিহারিদের যে যুদ্ধ হয় সে যুদ্ধে শহীদ হওয়া সৈনিকদের লাশ ফেলা হয় ১২ নং সেকশনের ডি-ব্লকের ৬ নং লাইনের পশ্চিম পাশের নিচু ভূমিতে ও আশেপাশের বাড়ির কুয়ার। ধারণা করা হয়, চলচ্চিত্র নির্মাতা লেখক সাংবাদিক জহির রায়হানের লাশও ওখানেই ফেলা হয়। এছাড়া ডি-ব্লক, ২২ নং লাইনের মোতালেবের বাড়ির কাছেও কিছু লাশ ফেলা হয়।
‘কালাপানি বধ্যভূমি’ সম্পর্কে আব্দুল মালেক বলেন – ’৭১ এ বাঙালিরা ছিল বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং বিহারিরা ছিল জামায়াতে ইসলামের সমর্থক ও কর্মী। কালাপানির নাম ছিল কালসীগ্রাম। বিহারিরা ১৯৬৪ সালে এই গ্রামে আসে।
‘কালাপানি বধ্যভূমি’ নিচু ও নির্জন জায়গা হওয়ায় আখতার গুন্ডার নেতৃত্বে বিহারিরা বহুসংখ্যক মুক্তিকামী বাঙালিকে হত্যা করে ‘কালাপানি বধ্যভূমি’তে ফেলে দেয়। কেবল ‘কালাপানি বধ্যভূমি’ থেকেই উদ্ধার করা হয় ৮১ বস্তা লাশ। বর্তমানে যেখানে বিসিকের বিল্ডিংটি অবস্থিত সেখানে একটি মাঠ ছিল। এই মাঠ থেকে উদ্ধার করা হয় ৭০টি, কালাপানি এভিনিউয়ের ঢাল থেকে ১৭টি, ডি-ব্লক ২২ নং রোডের মোতালেবের বাড়ির সামনে থেকে ১৩টি (যাদের গায়ে বাঙালি আর্মির পোশাক ছিল), ডি-ব্লক উত্তর পার্শ্ব থেকে ১৫টি, কালসি কবরস্থানের পাশ থেকে ৭৬টি লাশ উদ্ধার করা হয়।
শহীদ পরিবারের সদস্যা স্থানীয় বাসিন্দা মোমেনা বেগম জানান-’৭১-এ আমার পরিবারের মোট ৬ জন মারা যায়। বাবা-মা, তিন বোন ও এক ভাই হারাই। আমার চোখের সামনেই ওদের হত্যা করা হয়। প্রথমে হত্যা করা হয় আমার মাকে। তিনি তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। আমি ও আমার বোন আমেনা আমরা পানির ড্রামের পেছনে লুকাই। আমার বয়স তখন ১৪ এবং আমেনার ১৩ বছর। একে একে সবাইকে চোখের সামনে হত্যা হতে দেখি। পরে আমি দেয়াল টপকে ড্রেনে নেমে পড়ি।
বিহারিরা আমার বোন আমেনাকে ড্রামের পেছন থেকে টেনে বের করে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। আমার বোন চিৎকার করে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করে, পরে তাঁর দেহটি হঠাত নিথর হয়ে পড়ে (অজ্ঞান হয়ে যায়। সেই নিথর দেহের ওপর চলে পালাক্রমে ধর্ষণ)। ধর্ষণ শেষ হলে মাটিতে পড়ে থাকা দেহটিতে পরপর তিনটি গুলি করে। বর্ণনা দিতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যান মোমেনা বেগম। স্বামী হাবিবুর রহমান বাঁধা দিয়ে বলেন, আপনারা এখন যান পুরনো কথা আর মনে করিয়ে দেবেন না। কিছুদিন আগেও সে ভারসাম্যহীন ছিল। শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হতো। কিন্তু মোমেনা বেগম হাটের ইশারায় তাঁর স্বামীকে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। প্রায় ২ ঘন্টা পর স্বাভাবিক হলে তিনি আরও জানান, লাশগুলো মিলিটারিরা ও বিহারিরা টেনেহিচড়ে গাড়িতে তোলে। গাড়ি ‘কালাপানি বধ্যভুমি’র দিকে যায়। পরে আমি পালিয়ে গাবতলি আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যাই। প্রায় ২ মাস পর লুকিয়ে পরিবারের লাশের সন্ধানে ‘কালাপানি বধ্যভুমি’তে যাই। গিয়ে দেখি যেন একটা মৃত্যুপুরি। অসংখ্য মানুষের ছড়ানো-ছিটানো লাশ আর লাশ। কিছু কিছু লাশ মাটিচাপা দেয়া, কারও হাত, কারও পা, কারও বা চুল বের হয়ে আছে।
এখন সেই নিচু ভূমি ভরাট হয়েছে। মাটির রাস্তা পাকা হয়েছে, ধূ ধূ মাঠে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন।
[৬৬] মিরাজ মিজু

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত