কালীবাড়ি নির্যাতন কেন্দ্র, নাটোর
নাটোরের কালীবাড়ি ও ফুলবাগানে হানাদার বাহিনী কীভাবে অত্যাচার করত তার বর্ণনা দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা মো মোসলেম উদ্দিন।
২৪ এপ্রিল আমার বাড়িতে জনৈক পাকবাহিনীর সহযোগী একদল পাক সৈন্য নিয়ে এসে ঘরের দরজা ভেঙ্গে আমাকে লাথি মারতে মারতে স্থানীয় কালীবাড়িতে নিয়ে যায়-বলা প্রয়োজন এখানে অত্যাচারের কেন্দ্রভূমি ছিল।তারা সেখানে আমার হাত,পা বেঁধে পা উপরের দিকে তুলে লটকিয়ে অত্যাচার করে।
সে অত্যাচারের ভেতর ছিলো বেত দিয়ে প্রহার, চাকু দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থান কাটা।শরীর কেটে তার আনন্দ পেতো।তারা জানতে চাচ্ছিলো যে চট্টগ্রামে আমি কতজন পাঞ্জাবিকে হত্যা করেছি, কতটি রাইফেল কোথায় কিভাবে লুকিয়ে রেখেছি,বাংলাদেশ সম্পর্কে কী কী তথ্য আমি জানি?
আমার কাছ থেকে কোনো তথ্য উদ্ঘাটন করতে ব্যর্থ হলে তারা আমাকে কালীবাড়ি থেকে নাটোরের ফুল বাগানে অপারেশন ক্যাম্পে নিয়ে যায়।সেখানে বৈদ্যুতিক শক আমার গলায় দেয়া হয়।হাত-পা বেঁধে ডেকচির মধ্যে করে পানির হাউজে নিক্ষেপ করে।১০-১২ মিনিট সেখানে রাখার পর অর্ধমৃট অবস্থায় সেখান থেকে আবার তুলে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।আমার হাত পেছনে বাঁধা ছিল।কিছু আগেই আমার সাক্ষাতে চারজন লোককে গুলি করে হত্যা করা হয়।কৌশলে হাতের বাঁধন খুলার চেষ্টা করছিলাম।এক সময় আমি আমার হাতের বাঁধন তাদের অগোচরেই খুলতে সমর্থ হই।ফুলবাগানের মধ্যস্থ পুকুরের চারিদিকে মিলিটারিরা তখন সশস্ত্র পাহারায় ছিল।হাতের বাঁধন খুলেই ঘুরে সঙ্গিন উঁচানো সিপাইয়ের হাতের রাইফেল কেড়ে পুকুরে ফেলে দেই এবং বক্সিং মেরে তাকে ধরাশায়ী করি।তারপর পুকুরে ঝাপ দেই।ইতিমধ্যে অবশিষ্ট সৈন্যরা পুকুরের চারিদিকে সচেষ্ট হয়ে ওঠে এবং আমাকে লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলি চালানো শুরু করে।যখন পুকুরের পাড়ে উঠেছিলাম ঠিক সে সময় একটি গুলি আমার কানে কানে আঘাত করে।সাথে সাথে আর একটি গুলিও আমার বাম বাহুর নিচে লাগে।এতে আমি অবশ্য খুব বেশি আহত হইনি।তাদের সকলের সব রকমের অপচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে বর্বরদের ব্যূহ ভেদ করে পালিয়ে আখের জমির ভেতর দিয়ে ক্রলিং করে নাটোর পৌছাই।শরীর থেকে তখন অনবরত ধারায় রক্তপাত হচ্ছিল।উলঙ্গ অবস্থায় যখন নাটোরের সিনেমা হলের মোড়ে পৌঁছাই তখন একদল বিহারি আবার আমাকে ধরে ফেলে।সেখানেও তারা বেদম প্রহার করতে শুরু করে।পূর্বোক্ত বক্সিং প্রক্রিয়ার বদৌলতে তাদের হাত থেকেও রেহাই পাই এবং শহরের মাঝখানে মামার বাড়িতে প্রথমে আশ্রয় নেই।কিছুক্ষণ পর আমার শ্বশুড় ডাক্তার আবদুল লতিফের কাছে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নেই।সেখান থেকে ঐ রাতেই মেয়ের পোশাকে এক গ্রামে আশ্রয় নিই।তারপর পরবর্তী ১০ দিন পর ভারতে আশ্রয় নিই।এবং সেখানে সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেই।
ফুলবাগান থেকে উধাও হবার পর পাক পশুরা আমার বাড়ি ঘেরাও করে এবং আমার বৃদ্ধ বাবা এবং মাকে মারধোর করে এবং বলে যে তোমার ছেলেকে বের করে দাও, তাকে চাকরি দেবো এবং তোমার মেয়েকে আমার সাথে (জনৈক সুবেদার) বিয়ে দাও।পরবর্তী সময়ে তারা আমার বাড়ি স্বেচ্ছাচারিতভাবে লুটপাট করে।আমার মতে ফুলবাগানে নয় মাসে অন্তত ১৫-১৬ হাজার লোককে পাক পশুরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
[৫৮২] মো. মোসলেম উদ্দিন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত