You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.03.14 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | অনেক তো হোলো, এবার একটা কিছু করুন | লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হোক—এটাই আমাদের কাম্য | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৪ই মার্চ, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৪, ৩০শে ফাল্গুন, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

অনেক তো হোলো, এবার একটা কিছু করুন

কী মর্মান্তিক দৃশ্য! জীবন ও মৃত্যুর নাগরদোলায় এক ঝাঁক মুমূর্ষু প্রাণের সে কী করুণ আর্ত চিৎকার। কী স্বপ্নালু চোখ আর মায়া ভরা পরম প্রশান্তি নিয়েই না ওরা ঘুমিয়েছিল—ঘুমিয়েছিল আপন প্রতীক্ষিত স্টেশনটি এলে নিঃশব্দে নেমে যাবে বলে।
ওদেরও চোখে মুখে, প্রতি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসেই ছিল কত না প্রিয়জনের হৃদয় নিংড়ানো হাতছানি, প্রীতি ও শ্রদ্ধার এক অব্যক্ত কোমল পরশ। ওদেরও ললাটে ছিল কত না মধুর শুভাশীষ, কত না চুমুর কোমল স্পর্শ।
ওরা মরতে চায়নি। ওদেরও কন্ঠে ছিল বাঁচার দুর্দম বাসনার দুরন্ত বজ্র নির্ঘোষ। কিন্তু না, নিষ্ঠুর নিয়তি ওদের সে দাবীর ন্যূনতম মর্যাদাটুকুও দিল না।
এক পলকের এক বিকট দানবীয় শব্দ—দ্রুম দ্রুম। কুয়াশাঘন আকাশের অন্ধকার তমসা ভেদ করে সে শব্দে আকাশ-প্রকৃতিও থর থর কেঁপে উঠেছিল। তারপর কয়েকটি দারুণ নারকীয় দৃশ্য। থেতলানো মৃতদেহ, অগণিত আহত প্রাণ, করুণ আর্ত চিৎকার, দুর্বৃত্তের উন্মত্ত লুন্ঠন, পুলিশের গোলাগুলি ক্ষেতমাঝের বগীর বিক্ষিপ্ত ছড়াছড়ি আরো ছিল কালো ও কুয়াশার চাপা হাসির উন্মত্ত প্রহসন।
বলার অপেক্ষা রাখেনা, এ আবার সেই দুঃসহ ট্রেন দুর্ঘটনা। শুধু অকুস্থল অন্য। এবারের দুর্ঘটনা ঘটেছে গত মঙ্গলবার ভোর রাত্রে। কুমিল্লা থেকে প্রায় ছ’মাইল দূরে ময়নামতি ও লালমাইয়ের মধ্যবর্তী বিজয়পুর গ্রামে। ভোর তখন ৪টা বেজে ৪৫ মিনিট। এবারের শিকার ঢাকা-চট্টগ্রামগামী দু’নম্বর ডাউন মেল।
দশটি প্রাণের মর্মান্তিক পরিসমাপ্তি আর শতাধিক আহত যাত্রীর করুণ আর্তনাদ। বিধ্বস্ত হয়েছে ইঞ্জিন আর ছ’টি বগী।
দেশ স্বাধীন হবার পর এ নিয়ে প্রায় বিশটি ট্রেন দুর্ঘটনা সংঘটিত হলো। তবে, এটিই হচ্ছে বিগত কয়েক দিনের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা। আর এমন উপর্যুপরি ট্রেন দুর্ঘটনা বিশ্বের আর কোনো একক দেশে কোনো নজির আছে বলে আমাদের জানা নেই। সুতরাং, ট্রেন দুর্ঘটনার এমন বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করে আমরা আবার প্রমাণ করেছি ‘সাবাস বাংলাদেশ।’
এমন উপর্যুপরি ট্রেন দুর্ঘটনার ফলে আমরা মূল্যবান প্রাণ হারিয়েছি শতাধিক আর রেলওয়ের ক্ষতি হয়েছে কয়েক কোটি টাকার। এছাড়া, রেল চলাচল বিঘ্নিত হয়ে পরিবহন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমেছে বারে বারে। নিহতদের জন্য এ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে প্রায় ৬৭ হাজার টাকা এবং যারা দুর্ঘটনায় কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়েছেন বা অকেজো হয়ে পড়েছেন, এমন লোকদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে প্রায় বারো হাজার টাকা। আবার, রেল দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের জন্যে ক্ষতিপূরণ হিসেবে যে অর্থের পরিমাণ ঘোষণা করা হয়েছে তাও বিপুল।
আরো আশ্চর্য ব্যাপার, যেদিন কুমিল্লায় ট্রেন দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়, সেদিন আরো তিন জায়গাতেও ট্রেন দুর্ঘটনা হয়েছে। এর একটি ময়মনসিংহ আসার পথে গৌরীপুর স্টেশনে, একটি কুষ্টিয়ার পোড়াদহে ও একটি টঙ্গী ও ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে। এ চারটি নিয়ে এ মাসে গত ১২ দিনে মোট ৭টি রেল দুর্ঘটনা ঘটলো। তার মধ্যে ৪টিই যাত্রীবাহী ট্রেন। আগের দুর্ঘটনাগুলোর একটি ঘটে ৪ঠা মার্চ ভেড়ামারায়, একটি ৭ই মার্চ সিলেটের মাইজগাঁওতে এবং একটি ৯ই মার্চ ময়মনসিংহ স্টেশনে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ সহ বিভিন্ন বিভাগের লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে যে, এসব দুর্ঘটনার জন্যে প্রধানতঃ নিম্নোক্ত কারণগুলোই দায়ী :
প্রথমতঃ, স্টেশন মাস্টার, পয়েন্টসম্যান, ইঞ্জিন ড্রাইভার এবং অন্যান্য রেল কর্মচারীদের কর্তব্যে অবহেলা।
দ্বিতীয়তঃ, শ্রমিক সংস্থার দৌরাত্ম্যে অদক্ষ কর্মচারীদের নিয়োগ বা দক্ষ কর্মীদের বদলীর হিড়িক।
তৃতীয়তঃ, কাজের সময়ে দলীয় কোন্দলে সময়ের অপচয় ও কর্তব্য অবহেলা ইত্যাদি।
স্বাধীনতার পর গত ২৭ মাসে যে ২০টি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে ৩টি দুর্ঘটনাই হচ্ছে ভুল পয়েন্টে ট্রেনকে ক্লিয়ারেন্স দেবার জন্য, ২টি ইঞ্জিন ড্রাইভারের সিগন্যাল লংঘনের জন্য, ১টি ইঞ্জিন ড্রাইভার সিগন্যাল না পাওয়ার জন্য এবং আর ১টি ঘটেছে লাইনচ্যুত বগী সময় মতো সরিয়ে না নেবার জন্য। ৯টি দুর্ঘটনায় তদন্ত এখনো চলছে।
আর এবারের ভয়াবহ দুর্ঘটনার জন্য বলা হচ্ছে সুপরিকল্পিত নাশকতামূলক কাজের জন্য। যাত্রীদের মতে, ট্রেনে হেডলাইট বা বিভিন্ন কামরায় বাতিও ছিলনা। সুতরাং ইঞ্জিন দোষে হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়।
যাহোক, এভাবে দেশে একটার পর একটা ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে, প্রাণ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, একটার পর একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে আর কর্মচারীদের সাসপেন্ড করা হচ্ছে, কিন্তু গড়ে গিয়ে কোনোই লাভ হচ্ছেনা। দারুণ মর্মবেদনা আর বিস্ময়-অবাক দৃষ্টি নিয়ে দেশের মানুষ একটার পর একটা ট্রেন দুর্ঘটনা অবলোকন করে চলেছে। সবাই যেন একে অপরের ঘাড়ে দোষ বর্তাতে পারলেই নিজের দায়মুক্তি হোলো ভাবছে।
কিন্তু দেশের মানুষের জানমাল আর জাতীয় সম্পদ নিয়ে এভাবে আর কিছুতেই প্রসহন চলতে দেয়া যেতে পারেনা। একে যে কোনো মূল্যে প্রতিরোধ করতেই হবে।
আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, এসব ন্যক্কারজনক দুর্ঘটনার পেছনে বিভাগীয় কর্মচারীদেরও নানা রকমের স্বার্থ ও অর্থ লিপ্সার দিকও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আছে। এসব তদন্ত করে অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। আর উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে নয়, আর শোকবাণী কিম্বা তদন্ত কমিটি গঠন নয়, আর ক্ষতিপূরণ দানের বিপুল আগ্রহ নয়, আর কোনো এটা ওটা অজুহাত নয়, সোজা কথা—যেকোনো মূল্যে এ স্যাবোটাজ বন্ধ করতে হবে এবং দেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, এ স্যাবোটাজ শুধুমাত্র বাইরের শত্রুদের একক অপকর্ম নয়, এর পেছনে ঘরের বিভীষণেরও যথেষ্ট অবদান আছে। ওদের চিহ্নিত করে, নিশ্চিহ্ন করে বাংলার পূণ্য পবিত্র মাটি থেকে ‘দুর্ঘটনা’ শব্দটি চিরতরে মুছে ফেলতে হবে। যারা কুমিল্লায় ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রিয়জন হারিয়েছেন বা যারা আহতাবস্থায় বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন তাদের সবার প্রতিই আমরা জানাই আমাদের আন্তরিক সমবেদনা।

লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হোক—এটাই আমাদের কাম্য

আমাদের পাটমন্ত্রী জনাব শামসুল হক এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ঘোষণা করেছেন যে, পাট রপ্তানীর লক্ষ্যমাত্রা নাকি এবার ছাড়িয়ে যাবে। গত কয়েক মাস ধরে নাকি কাঁচা পাট এবং পাটজাত দ্রব্যের রপ্তানী দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আশা করা যাচ্ছে যে, পাট রপ্তানীর লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। আর এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হলে বাংলাদেশ চলতি অর্থ বছরে পাট থেকে দুই শত পঁচাত্তর কোটি টাকারও বেশী বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে। এ প্রসঙ্গে পাটমন্ত্রী আরো বলেছেন যে—পাট রপ্তানীর ব্যাপারে যে দুইটি বিষয় অত্যন্ত সহায়ক হয়েছে তাহলো—বিদেশে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং পরিবহন সুবিধা ও জাহাজে অধিক স্থান সংকুলান। পাটমন্ত্রী একটি পরিসংখ্যান দিয়ে জানিয়েছেন, গত তিন মাসে বিদেশী ক্রেতাদের কাছে বাইশ লাখ গাঁট পাট বিক্রি করা হয়েছে। শুধু গত মাসেই ষোলো লাখ তিন হাজার গাঁট পাট জাহাজযোগে রপ্তানী করা হয়েছে। গত জুলাই মাস থেকে এ পর্যন্ত যে পরিমাণ পাট বিদেশে বিক্রি হয়েছে তাহলো—সাতাশ লাখ ছয় হাজার আট শত নয় গাঁট পাট। এর থেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে তাহলো একশত দশ কোটি টাকা। গত বছর বাংলাদেশ পাটজাত দ্রব্য রপ্তানী করেছিল চার লাখ এগারো হাজার টন এবং তার থেকে একশত চুয়ান্ন কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছিল। এবার অর্থাৎ চলতি বছরে পাটজাত দ্রব্য রপ্তানী বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে একশত ষাট কোটি টাকার। যে সময় এখনো হাতে রয়েছে তাতে অবশিষ্ট পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানী করা সম্ভব হবে বলে মন্ত্রী আশাবাদ প্রকাশ করেছেন।
‘পাট রপ্তানী লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে’ মন্ত্রী মহোদয়ের এই আশাবাদ প্রকাশে আমরাও অত্যন্ত আনন্দিত। গত মৌসুমে যেখানে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি সেখানে যদি এবার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যায় তাহলে নিঃসন্দেহে তা গৌরবের কথা। কেননা, আমরা জানি পাটই আমাদের একমাত্র সম্পদ যারা দ্বারা প্রায় অধিকাংশ বৈদেশিক মুদ্রাই অর্জিত হয়ে থাকে। গত বছর যখন আমরা জানতে পারলাম যে, প্রায় বাইশ লাখ গাঁট পাট রপ্তানী করা সম্ভব হয়নি তখন পাট রপ্তানী সংস্থার যোগ্যতা সম্পর্কে প্রমাদ গুনেছিলাম। এবার যখন আমরা পাট রপ্তানীর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে এমন আশার কথা শুনেছি তখন নিঃসন্দেহে খুশী হতে পারি। তবে ইতিপূর্বেও আমরা বিভিন্ন নেতাদের মুখে বিভিন্ন প্রকার আশাবাদের কথা শুনেছি কিন্তু তার বাস্তবতা পরে আমরা আর দেখতে পাইনি। যেমন ইতিপূর্বে আমরা বহু নেতার মুখেই শুনেছি যে, ধান সংগ্রহের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু ধান আর লক্ষ্যমাত্রা কেন চার লক্ষ টনের স্থলে এক লক্ষ টনও সংগৃহীত হয়নি। অতএব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন যদি এমনিভাবে হয় তাহলে তা নৈরাশ্যজনক ছাড়া আর কিছুই নয়। এ পর্যন্ত পাট নিয়ে আমরা বহু কথা বলেছি। পাটের মূল্য নির্ধারণের বিষয়টিতেও আমরা আমাদের মতামত ব্যক্ত করেছি। দেশের বহু পাট পুড়ে গেছে এবং তার কোনো বাস্তব প্রতিকারও হয়নি। একদিকে পাট পুড়ছে অন্যদিকে সরকার ইনসিওরেন্সের টাকা দিয়ে চলেছেন। জানা গেছে, এ পর্যন্ত নাকি চৌদ্দ কোটি টাকার পাট পুড়েছে। অতএব, বাংলাদেশ চৌদ্দ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে আর সক্ষম হচ্ছেনা। কর্তৃপক্ষ এ বছর যথাযথভাবে পাট রপ্তানী করে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে সক্ষম হোক এটাই আমরা কামনা করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন