You dont have javascript enabled! Please enable it! কপিলমুনি ক্যাম্পের রাজাকারদের অত্যাচার | খুলনা - সংগ্রামের নোটবুক

কপিলমুনি ক্যাম্পের রাজাকারদের অত্যাচার, খুলনা

ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজাকাররা এই এলাকায় শুরু করে অত্যাচারের তাণ্ডবলীলা। প্রথমেই তারা ডা. ফণিভূষণ নাথ, উমাপদ দে ও চৈতন্য মল্লিককে ধরে এনে কপিলমুনি বাজারের ফুলতলা নামক স্থানে, কপোতাক্ষ নদের ঘাটে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। তারা স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক গবাদিপশুসহ ধন-সম্পদ নিয়ে আসত। প্রতি হাটবারে তারা ১০-১২টি গরু ও ১৫-২০টি খাসি আদায় করত। তারা। হিন্দুদের ওপর গণহারে অত্যাচার চালাতে থাকে। তারা জোরপূর্বক কপিলমুনির মণি সিং, জ্ঞঅন সিং, নরেন সিং, কানু পোদ্দার, ডা> তারাপদ, জিতেন্দ্রনাথ সিং, শান্তিরাম সাধু প্রমুখকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে। মুসলিম লীগ-জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের দেয়া তালিকা মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে সদস্যদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাতে থাকে। তাঁদের নির্যাতনের আর একটা দিক ছিল নারী ধর্ষণ। পাইকগাছার মুক্তিযোদ্ধা ও বর্তমান পাইকগাছা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বিলাল উদ্দিন বিলুর দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, এলাকার সুন্দরী মেয়ে ও গৃহবধূদের ধরে এনে রাজাকার, পিস কমিটি এবং স্থানীয় মুসলিম লীগ ও জামায়াতের লোকজন দিনের পর দিন আটকিয়ে রেখে ধর্ষণ করত। এ জন্যে ক্যাম্পের ৬টি রুম নির্ধারিত ছিল। সকালে এ সকল রমনীকে আত্মীয়রা টাকার বিনিময়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যেত। যাদের আত্মীয়স্বজন আসত না তাঁদের হত্যা করে পেট কেটে কপোতাক্ষের বুকে ভাসিয়ে দিত। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে রত্না নামের এক সুন্দরী হিন্দু বালিকাকে রতভর ধর্ষণ করলে সে মারা যায় এবং পেট কেটে কপোতাক্ষের বুকে ভাসিয়ে দিত। তাঁর ভাসমান লাশ এলাকার সকল স্তরের মানুষকে ভারাক্রান্ত করে। মুক্তিযুদ্ধের পর রাজাকারদের নিকট থেকে পাওয়া কয়েকটি ডায়েরি, মুক্তি পাওয়া নির্যাতিত রমণীদের জবানবন্দি এবং স্থানীয় ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে নারী নির্যাতনের অনেক লোমহর্ষক বিবরণ প্রকাশিত হয়। সাধন চন্দ্র সাধুর হিসেব মতে, এখানে ১৬১০ জনকে হত্যা করা হয়। স.ম. বাবর আলির মতে, ১৬০১ জনকে রাজাকাররা হত্যা ক্রে এবং আরও ১০০০ জনকে হত্যা করার পরিকল্পনা সম্বলিত একটি তালিকা রাজাকারদের কাছে পাওয়া যায়। এ থেকে মনে হয় যে, একটা ব্যাপক গণহত্যার পরিকল্পনা নিয়েই এ ক্যাম্পটি স্থাপিত হয় এবং পরিকল্পনা মোতাবেক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়।
রাজাকাররা কপিলমুনি এলাকার বাইরেও হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালায়। এখানে থেকে তারা পাইকগাছায় প্রথম অভিযান পরিচালনা করে ২৭ জুলাই। এঁদের নেতৃত্বে ছিল শাহজাহান চেয়ারম্যান। রাজাকাররা স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় এদিন সকাল থেকেই পাইকগাছা বাজারে বিভিন্ন অলি-গলি ঘুরে ফিরে দেখতে থাকে। তাঁদের এ বিচরণ স্থানীয় মানুষের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। ফলে মাহতাব উদ্দীন মনি মিয়া, মো. রইস উদ্দীন মিস্ত্রী, গাজী শামসুর রহমান প্রমুখ নেতা গোপনে বৈঠক করে অচিরেই তারা নিরাপদ আশ্রয়ে অন্যত্র চলে যাবার, প্রয়োজনে ভারতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু ঐ দিনই আক্রমণ করায় তারা আত্মরক্ষার্থে পালাতে পারেনি। এ দিন গভীর রাতে রাজাকাররা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে একযোগে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাসায় হানা দেয় এবং শেখ মাহাতাবউদ্দিন, মনি মিয়া, গাজী শামসুর রহমান, মঠবাটির মনোহর ও নন বৈরাগী, জেলা পরিষদের ওভারশিয়ারের পুত্র ছাত্রলীগ কর্মী মিজানুরকে ধরে নিয়ে যায়। রাজাকাররা এঁদের প্রত্যেকের বাড়িতে লুটতরাজ করে। মনি মিয়ার পরিবার –পরিজন প্রচুর অর্থের বিনিময়ে মনি মিয়ার জীবন ভিক্ষা চেয়েও ব্যর্থ হয়। এরপর তারা টেলিফোনের মাধ্যমে খুলনা জেলার রাজাকার বাহিনীর প্রধান মাওলানা শামসুর রহানের সাথে কথা বলে। মওলানা সাহেব তাঁদের মনি মিয়ার জীবন রক্ষার ব্যাপারে আশ্বস্ত করলে তারা ঘরে ফিরে আসে এবং তাঁর ফিরে আসার জন্য বিনিদ্র রাত কাটিয়ে অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু সকালবেলা মনি মিয়াসহ ধৃত অন্যদের লাশ আঘড়ঘাটাপর নিকট শিলেমানপুরের ঘাটে পড়ে থাকার খবর পাওয়ার পর তাঁদের প্রতীক্ষার পালা শেষ হয়।
[৯২] মোল্লা আমীর হোসেন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত