You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধ কোষ (প্রথম খণ্ড) - 405-554 - সংগ্রামের নোটবুক

মে বগুড়ায় এপিপির সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি “দুষ্কৃতকারীদের উচ্ছেদের জন্য ঐক্যবদ্ধ হবার আহবান জানান।
১ জুন রাজশাহী ও নবাবগঞ্জ সফরকালে তিনি শান্তি কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এখানে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য রাজশাহীবাসী মনে প্রাণে কাজ করে যাচ্ছে এবং সর্বত্র আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর বীরত্বপূর্ণ কার্যক্রম অভিনন্দিত হচ্ছে।’ এরপর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় শান্তি কমিটি, বিশিষ্ট নাগরিক ও বিডি সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে তিনি বলেন, ‘জনগণের সহায়তায় সশস্ত্র বাহিনী ভেড়ামারায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে এনেছে বলে আমি জানতে পেরেছি।’ এসময় তিনি দৌলতপুর ও মিরপুর থানার অন্তর্ভুক্ত এলাকাসমূহ সফর করেন। এ এন এম ইউসুফ স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত এভাবে শান্তি কমিটির সাংগঠনিক সফর করে বেরিয়েছেন অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সর্বত্র।
বর্তমানে মুসলিম লীগের একটি অংশ মহাসচিব আব্দুল মতিনও শান্তিকমিটি গঠনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। ১০ মে ঢাকা বেতারে প্রচারিত এক কথিকায় আব্দুল মতিন বলেন,’ ভারত অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে। ভারতের এ জঘন্য দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করতে পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক জনগণ কিছুতেই পিছপা হবেনা।’
২৫ জুনের পূর্বদেশ পত্রিকার একটি সংবাদে বলা হয়, ‘বগুড়া জেলার জয়পুরহাট মহকুমায় জনাব আব্বাস আলীর নেতৃত্বে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট মহকুমা শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছে। এছাড়া মহকুমার সকল ইউনিয়নে অনুরূপ শান্তি কমিটি রয়েছে বলে কেন্দ্রীয় শান্তিকমিটির এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সদস্য জনাব আব্দুল মতিন মহকুমার বিভিন্ন স্থানে সফর শেষে ঢাকা ফিরে জানিয়েছেন যে, গত ২৬ এপ্রিল থেকে উক্ত এলাকা রাষ্ট্রদ্রোহী এবং ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের কবলমুক্ত হয়েছে। শান্তিকমিটিগুলো সেনাবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করছে। জয়পুরহাটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আগমনের পর ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা ও রাষ্ট্রদ্রোহীরা পালিয়ে যায় এবং তাদের মধ্যে কয়েকজন নিহত হয়। বর্তমানে এলাকায় পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে।
পরদিন ২৬ জুন তারিখের খবরে বলা হয়, ‘আজ ঢাকা জেলা পরিষদ হলে ঢাকা সদর দক্ষিণ শান্তিকমিটির এক বৈঠক হয়েছে। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সভাপতি জনাব এম এ মতিন এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভাপতির ভাষণে তিনি সমাজবিরোধীদের নির্মূলে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য সবাইকে আহবান জানান।’
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পাকবাহিনীর গনহত্যায় সহায়তাকারী প্রথম

৪০৫

সারির নেতাদের নাম করতে হলে কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি এ এস এম সোলায়মানের নাম আসবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের নয় মাস তার কার্যকলাপের পরিচয় দিতে সে সময় তার দেওয়া অসংখ্য বিবৃতির কয়েকটি এখানে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা হছে।
৮ এপ্রিল প্রদত্ত বিবৃতিতে সোলায়মান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধীদের নির্মূল করে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার কাজে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার আহবান জানান।
৭ মে বৈদ্যের বাজারে শান্তি কমিটির সভায় ‘সকল সমাজবিরোধী ও রাষ্ট্রদ্রোহী ব্যক্তিকে ভালভাবে পরীক্ষা করার’ আহবান জানান।
মালেক মন্ত্রীসভার সদস্য হবার পরে ১৯ সেপ্টেম্বর এক সভায় তিনি বলেন, ‘যারা পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল, তাদেরই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।’
১৫ নভেম্বর করাচিতে তিনি বলেন, ‘রাজাকাররা অত্যন্ত প্রশংসামূলক কাজ করছে এবং তাদের জাতীয় বীর বলা উচিত।’ তিনি পশ্চিমাঞ্চলের দলগুলোকে পূর্বাঞ্চলে রাজাকার জোয়ান পাঠাবার আহবান জানান।
৮ ডিসেম্বর এ এস এম সোলায়মান শ্রম, সমাজকল্যান ও পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের মন্ত্রী ও জেলা সমন্বয় কমিটির সভাপতি হিসেবে ঢাকা ডেপুটি কমিশনার অফিসে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, পুলিশ অফিসার ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় আইন ও শৃংখলা বজায় রাখার ব্যাপারে দৃঢ় হওয়ার সংকল্প ঘোষণা করে কতিপয় সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়।
এ এস এম সোলায়মান আজ যে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের পুরাতন কর্মীদের বেশিরভাগই শান্তি কমিটি ও রাজাকারের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
[৬৭] সংকলন

মুক্তিযুদ্ধ ও খেলাফত আন্দোলন
বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের চতুর্থ প্লাটফর্মটি হচ্ছে হাফেজ্জি হুজুর নামে পরিচিত মওলানা মোহাম্মদ উল্লাহর [মরহুম] নেতৃত্বাধীন খেলাফত আন্দোলন। এই দলের বয়োজ্যেষ্ঠ কর্মীদের প্রায় সকলেই হয় শান্তি কমিটির সদস্য নতুবা রাজাকার। স্বাধীনতার পর অন্য দালালদের মতই হাফেজ্জীও একাত্তরে নিজের ভূমিকা ঢেকে ফেলতে তৎপর হয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও পাক সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞে মদদ জুগিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ৩ জুন আরো কয়েকজন ওলামার সঙ্গে দেওয়া এক বিবৃতিতে হাফেজ্জী “পাকিস্তানের বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামপ্রিয় লোকদের সামরিক ট্রেনিং দানের ব্যাবস্থা করার জন্য” সামরিক সরকারের প্রতি আবেদন জানান। বিবৃতিতে বলা হয়, “যাতে ভারতীয় হামলা

৪০৬

মোকাবেলা করা যায়, সেজন্য সরকারের উচিত তার অনুগত নাগরিকদের মুজাহিদ হিসেবে গড়ে তোলা।” এই যুক্ত বিবৃতি প্রকাশের কিছু দিনের মধ্যেই রাজাকার বাহিনী আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে।
খেলাফত আন্দোলনের বর্তমান ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রায় সকলেই স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত দুজন হচ্ছে তোয়াহা বিন হাবিবেবং আখতার ফারুক। দুজনেই কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। টিক্কা খানের ঘনিষ্টতম দোসরদের অন্যতম ছিলেন্তোয়াহা বিন হাবিব। এমনকি টিক্কা খানের গাড়িতে তাকে সেসময় চলাফেরা করতে দেখা যেত। ১৬ ডিসেম্বরের বন্দি পাক সেনাদের সাথে বন্দি হয়ে তোয়াহা হাবিব ভারতে যায়। ভারত থেকে পাক যুদ্ধবন্দিরা মুক্তি পেলে সেও তাদের সঙ্গে পাকিস্তান চলে যায়। সেখান থেকে সৌদি আরব গিয়ে সৌদি রাজপরিবারের আশ্রয়ে বসবাস করতে থাকে ৮ বছর সৌদি থাকার পর কোটিপতি হয়ে দেশে ফিরে আসে। বর্তমানে সে বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনীলোকদের একজন; গুলশানে তার প্রাসাদোপম বাড়িতে ২৪ ঘন্টা সশস্ত্র প্রহরা থাকে।
আখতার ফারুক স্বাধীনতার সময় ছিল জামায়াতে ইসলামীর মজলিশে শুরার সদস্য এবং দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার সম্পাদক। সে সময় ‘দৈনিক সংগ্রাম’এ গণহত্যার সমর্থনে তার লেখা অসংখ্য সম্পাদকীয় এবং নিবন্ধের মধ্যে একটি প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখিত হতে পারে। হানাদার এবং দালালদের ‘পাকিস্তান ও ইসলাম বিরোধী চর’ ঢালাও নির্মূল অভিযানের ইঙ্গিত দিয়ে ‘ইত্তেফাক’এ শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় নামে একটি নিবন্ধ লেখেন। এর প্রত্যুত্তরে আখতা ফারুক ১৬ সেপ্টেম্বর ‘সংগ্রাম’ এর প্রথম পাতায় ‘অতএব ঠগ বাছিওনা’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ নিবন্ধ লিখে স্বাধীনতামনা বুদ্ধিজীবীদের নির্মূলের জন্য খোলাখুলিভাবে আহবান জানায়।
[৬৭] সংকলন

মুক্তিযুদ্ধ ও চীন
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের যেসব শক্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল, চীন তাদের অন্যতম। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে চীনের সরকারি অবস্থান ছিল পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতমূলক। বাংলাদেশের সংকট নিয়ে চীনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয় ১১ এপ্রিল ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট ইয়াখানের প্রতি চৌ এন লাইয়ের এর চিঠির মাধ্যমে। ওই চিঠিতে চৌ এন লাই পাকিস্তানের ঘটনাবলীকে সে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে জানান এবং জনগণ বিদেশি হস্তক্ষেপ ছাড়াই তা সমাধান করবে বলে উল্লেখ করেন। এমনকি পাকিস্তানের জাতীয় স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় চীনের

৪০৭

দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কথাও তিনি জানিয়েছিলেন। অবশ্য চিঠিতে তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোন বক্তব্য রাখেননি। তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন চীন বাঙালির সংগ্রাম ও নির্যাতনের প্রতিও কোন সহানুভূতি দেখায়নি। বরং পাক সামরিক চক্রের প্রতি জানিয়েছিল অকুন্ঠ সমর্থন। এমনকি চীনপন্থী রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত মওলানা ভাসানীর আকুল আবেদন সত্ত্বেও চীনা নীতিতে কোন পরিবর্তন আসেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন নয়মাসে চীনের নীতি ও কার্যক্রম দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১. মুক্তিযুদ্ধের শুরু হতে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্তঃ
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাক ভারত যুদ্ধ শুরুর পূর্ব পর্যন্ত চীন পাকিস্তানপন্থী থাকলেও মোটামুটিভাবে বাঙালির সংগ্রামবিরোধী কোন মন্তব্য করেনি। এমনকি এপ্রিল হতে অক্টোবর পর্যন্ত চীন প্রকাশ্যে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেনি। তবে গপনে সে পাকিস্তানের সামরিক চক্রকে নৈতিক শক্তি ও সাহস যুগিয়েছিল এবং সরাসরি সামরিক উপকরণ সরবরাহ করেছিল। ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট ভারত সোভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষরের পর চীনের পাকিস্তানপন্থী নীতি আরো প্রকট হয়ে ওঠে। সেপ্টেম্বর মাসে চীন পাকিস্তানকে এই বলে আশ্বস্ত করে যে, জাতীয় স্বার্থরক্ষায় চীন পাকিস্তানকে সাহায্য করবে। তখন পর্যন্তও চীনের বক্তব্যে বাঙালী বিরোধী তেমন বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। এজন্য প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার অনেক সময় আশা করতেন যে, শেষ পর্যন্ত হয়ত চীন সংগ্রামী বাঙালির পক্ষে দাঁড়াবে। কিন্তু সে আশা সফল হয়নি। ৫ নভেম্বর চীনাদের আস্থাভাজন ভুট্টোর নেতৃত্বে একটি পাক প্রতিনিধিদল চীন সফরে যায় চীন থেকে অতিরিক্ত অঙ্গীকার বা সাহায্য পাওয়ার আশায়। কিন্তু চীনের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেঙ ফি পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার একটি ন্যায়সঙ্গত সমাধান খুঁজে বের করার জন্য আহবান জানিয়েছিলেন। বাঙালিবিরোধী বক্তব্য না রাখলেও পশ্চিম পাকিস্তানে সীমান্ত দিয়ে চীন নিয়মিতভাবে পাকিস্তানে সমরাস্ত্র পাঠাত। এছাড়া গেরিলাযুদ্ধে প্রশিক্ষণদানের জনয চীন অক্টোবর মাসে ঢাকায় ২০০ সামতিক বিশেষজ্ঞ পাঠিয়েছিল। উল্লেখ্য, ১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধের পর হতে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান মোট ২০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের চীনা সামরিক উপকরণ সাহায্য হিসেবে পেয়েছে। যার মধ্যে ১৯৭১ সালেই সরবরাহ করেছিল ৪৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র। আর চীনের রাইফেল ও অন্যান্য উন্নত সমরাস্ত্র দিয়েই পাক বাহিনী নির্বিচারে হত্যা করেছে বাঙালিকে।
২. ৩ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১:
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের পূর্বাঞ্চলে সামরিক হামলা করলে শুরু হয় সরাসরি পাক ভারত যুদ্ধ। এ সময় হতে চীন জাতিসংঘে সরাসরি বাঙালিবিরোধী ভূমিকা পালন করতে শুরু করে।পাক-ভারত যুদ্ধের জন্য চীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে দায়ী করে।

৪০৮

যুদ্ধবিরিতির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা এবং পাকবাহিনীর বর্বরতার ফলে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করার লক্ষ্যে ৫ ও ৭ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে দুইটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। কিন্তু প্রস্তাব দুটোর বিপক্ষে চীন প্রথন ভেটো প্রয়োগ করে এবং চীনের নিজস্ব প্রস্তাবে ভারতকে আগ্রাসী পক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, চীন জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের মাত্র ৪০ দিনের মাথায় নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী আসন লাভের পর প্রথম প্রস্তাবেই ভেটো প্রয়োগ করেছিল। যাহোক ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে চীন এক বিবৃতিতে তথাকথিত বাংলাদেশের সৃষ্টির জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের তীব্র সমালোচনে করে। স্বাধীন বাংলাদেশকে তথাকথিত বাংলাদেশ বলে অভিহিত করা বাঙালির স্বাধীন অস্তিত্বের প্রতি ছিল চরম গৃণা ও অবহেলার সামিল। এমনকি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চীন বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়নি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীনের বিরোধীতার কারণঃ
চীনের যুদ্ধবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী নীতি গ্রহনের কারনগুলোকে নিম্নোক্তভাবে চিহ্নিত করা যায়।
চীন নিজেই একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র। চীনা মঙ্গল, তিব্বতি, তুর্কি ইত্যাদি জনগোষ্ঠী নিয়ে গড়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় সত্ত্বা। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রশ্নে চীনা জনগোষ্ঠীর মধ্যে তখনই অনেক সমস্যা বিদ্যমান। তাই একাধিক জাতি অধ্যুষিত পার্শ্ববর্তী কোন দেশে সংগ্রামরত কোন জনগোষ্ঠীকে সমর্থন করলে ভবিষ্যতে তা তার অভ্যন্তরীণ সংহতির প্রতি হুমকি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
চীন নিজেই তাইওয়ানকে মূল ভূখন্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করতে সচেষ্ট ছিল। তাই পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান হতে স্বাধীন হবার সংগ্রামে সমর্থন দিলে তা হত চীনের দ্বিমুখী নীতিরই পরিচায়ক।
চীনের বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধ স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম ছিলনা। এবং সত্যিকার অর্থে এটা কৃষক, শ্রমিক, জনতার সমর্থনপুষ্ট একটি গণযুদ্ধ ছিলনা। বরং ভারত ও সোভিয়েত সমর্থনপুষ্ট হয়ে কিছু বিভ্রান্ত বুর্জোয়া বাঙাকি নেতা পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্টের সংগ্রামে লিপ্ত বলে চীন মনে করেছিল।
ভারতে আওয়ামী নেতৃবৃন্দের প্রকাশ্য কর্মকান্ড থেকে চীন যথার্থই অনুধাবন করেছিল যে, বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলে তা হবে ভারতের প্রভাবাধীন একটি রাষ্ট্র এবং চূড়ান্ত বিচারে চীনের দক্ষিণ সীমান্ত এলাকায় এই রাষ্ট্রটি রুশ ভারত আঁতাতের একটি তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হবে- যা হবে চীনের জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও চীন-সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্ক ছিল শত্রুতার। তাই দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাক সম্প্রসারণ

৪০৯

মোকাবেলায় পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সহযোগিতা করা প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পর চীন শংকিত হয়ে পড়ে যে, পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়েইপাকিস্তান দুর্বল হয়ে পড়লে ভারতের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।
পাকিস্তান ছিল চীনের ঘনিষ্ট মিত্র। তাই সঙ্কটকালে চীন যদি পাকিস্তানকে সমর্থন না করে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে তবে অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্রের মধ্যে চীনের বন্ধুত্ব নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হবে।
সুতরাং নিজস্ব সুবিধা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির সবকিছু বিবেচনা করেই চীন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অবস্থান নিয়েছিল।
মো. আব্দুল কুদ্দুস শিকদার

মুক্তিযুদ্ধ ও জাতিসংঘ
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক সংস্থা হল জাতিসংঘ। বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এই সংস্থার মূল দ্বায়িত্ব। শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় এই সংস্থা যে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে তাও নয়। ভেটো ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্রসমূহ তথা পরাশক্তিসমূহের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করতে হয় এই সংস্থাকে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বৈশ্বিক রাজনীতিতে বিভিন্নমুখী অভিঘাতের সৃষ্টি করেছিল। বিশেষত সত্তরের দশকের স্নায়ুযুদ্ধকালীন পর্বে বহুধাবিভক্ত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কিত প্রশ্নে সিধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পরাশক্তিসহ বিশ্বের রাষ্ট্র সমূহকে স্পষ্ট বা অস্পষ্ট নানা অবস্থান নিতে হয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘ ভেটো ক্ষমতার অধিকারি তিন রাষ্ট্র যথা- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়ে যায়। বলা বাহুল্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতীত অন্য রাষ্ট্রদ্বয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে সক্রিয়ভাবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে জাতিসংঘে ন্যায়বিচারের স্বার্থে কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হবার সম্ভাবনা ছিলনা। কারণ পরাশক্তি সমূহের সম্পৃক্ততার কারনে তাদের পরস্পরবিরোধী স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কোন সিদ্ধান্ত গ্রহন কার্যত সম্ভব ছিলনা।
জাতিসংঘের সকল সিদ্ধান্ত রাজনীতি প্রভাবিত সিদ্ধান্ত, তথাপি জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রম কে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। জাতিসংঘের বিকল্প কোন বিশ্ব সংস্থাও নেই মানবজাতির জন্য, শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে জাতিসংঘের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যবহ।
২৫ মার্চ থেকে বাংলাদেশে পাকবাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, গণহত্যার

৪১০

সংবাদ বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় গুরুত্বের সঙ্গে। এপ্রিল মাসে মুজিবনগর সরকারও প্রতিষ্ঠিত হয়। তথাপি জাতিসংঘ এই অঞ্চলে পাকবাহিনীর গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনবন্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহনের প্রয়োজন অনুভব করেনি।
পাকবাহিনীর বর্বর অত্যাচার, নির্যাতন থেকে রক্ষা পাবার উদ্দেশ্যে অগণিত নারী পুরুষ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় গ্রহন শুরু করে। জুন-জুলাই মাসের মধ্যে বাঙালি শরনার্থী স্রোত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়। জুন মাসের শেষ দিকে এসে জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএনএইচসিআর শরনার্থীদের ত্রাণ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হয়। এর পূর্বে মে মাসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার অর্থনৈতিক উপদেষ্ঠা জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সাহায্যের আবেদন জানান। এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ ভারতে ও পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। সামরিক জান্তার হস্তক্ষেপের কারণে পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘের ত্রাণসামগ্রী সাধারণ জনগণের হাতে খুব একটা পৌঁছায়নি। ১৮ নভেম্বর ১৯৭১ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খান উল্লেখ করেন যে, খাদ্য সাহায্য দেয়া হয় ৬২৬৭১ টন, যানবাহনের সংখ্যা ১৫০০ এর অধিক, পলিথিন শিট ৩০ লক্ষ শরণার্থীর জন্য, ঔষধ ৭০০ টন প্রদান করা হয়। ইউএনএইচসিআর হাইকমিশনার ত্রাণসামগ্রী বহনকে “One of the longest humanitarian airlifts” হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

শরনার্থী সমস্যার রাজনৈতিক দিকটিকে জাতিসংঘ খুব একটা বিবেচনায় নেয়নি। শরণার্থীদের জন্য যতটা পারা যায় ত্রাণসামগ্রীর ব্যবস্থা করতে তারা আগ্রহী ও আন্তরিক ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি স্বীকার করেনি। একটা সময় পর্যন্ত জাতিসংঘ মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখে। পরবর্তীতে তা অবশ্য ভারত পাকিস্তানের বিষয়ে পরিণত হয়। কিন্তু কখনো বাংলাদেশের কোন পক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি।
শরণার্থী প্রত্যাবর্তনকে সামনে রেখে জাতিসংঘ মহাসচিব আপাত দৃষ্টিতে একটি নির্দোষ প্রস্তাব করেন। তা হল, ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা। পর্যবেক্ষকদের কাজ হবে শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের বিষয় দেখা। পাকিস্তান সরকার এই প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করলেও ভারত সরকার এর বিরোধিতা করে। মুজিবনগর সরকারও জাতিসংঘের এই প্রস্তাব গ্রহন করেনি। ভারতের গণমাধ্যমে জাতিসংঘের মানবিক প্রস্তাবের আড়ালে চীন-মার্কিন-পাকিস্তানের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল বলে সমালোচনা করা হয়। মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র/প্রচারপত্রেও এই প্রস্তাবের নিন্দা জানানো হয়। জাতিসংঘের পক্ষে এই প্রস্তাব কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

৪১১
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের উদ্যোগ বহুমাত্রিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় মুজিবনগর সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে শেখ মুজিবের বিচারের উদ্যোগে সৃষ্ট উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘকেও কিছুটা সক্রিয় হতে হয় বাধ্য হয়ে।
জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে ‘সেভ বাংলাদেশ কমিটি’এর উদ্যোগে ১৪ জুন আয়োজিত সমাবেশে সর্ভোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ন বলেন, ইসলামাবাদে সবরকমের সাহায্য বন্ধের পাশাপাশি বিশ্বের উচিত ইয়াহিয়ার উপর চাপ প্রয়োগ করা যাতে এখনি সংঘাত বন্ধ করে রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমান সহ সব রাজনৈতিক ব্যক্তিকে মুক্তি দেয়।
ভারতের সংসদের উভয় কক্ষের প্রায় ৫০০ সদস্য জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে ৭ আগস্ট এক স্মারকপত্রে শেখ মুজিবের বিচারের প্রহসন বন্ধ করে তাঁর নিঃশর্ত মুক্তির জন্য সম্ভাব্য সকল রকম ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী জানান। পরের দিন বিহার বিধানসভার সংযুক্ত সোস্যালিস্ট পার্টির ৫১ জন সদস্য জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আবেদন জানান। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী শরণসিং মহাসচিবকে পাঠানো এক বার্তায় উল্লেখ করেন যে, আমাদের জনগণ, সংবাদপত্র, সংসদ এবং সরকার সবাই এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করে যে, পূর্ববাংলার পাকিস্তানি কর্মকান্ডের ফলে আমাদের জন্য যে সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছে, তা দশগুণ বৃদ্ধি পাবে যদি পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবের জীবন সম্পর্কে কোন হঠকারী বা চরম পদক্ষেপ নেয়।
এমনি চাপের মুখে জাতিসংঘ মহাসচিব উথান্ট এক বিবৃতিতে বলেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্যে যা ঘটবে তা অবধারিতভাবেই পাকিস্তানের সীমানার বাইরেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে বলে তিনি সহমত পোষণ করেন। কেবল রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াও মানবিক দৃষ্টিকোন থেকেও মুজিবের বিচার নানামহলে অসামান্য আগ্রহ এবং শংকার জন্ম দিয়েছে। উপমহাদেশে পরিস্থিতি আরো অবনতি রোধের জন্য বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষায় সোভিয়েত ও মার্কিন সরকার একমত পোষণ করে। সে কারণে জাতিসংঘও পাকিস্তানের উপর এক ধরনের চাপ প্রয়োগের চেষ্টা চালায়।

জাতিসংঘের ২৬ তম অধিবেশনকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কূটনৈতিক তৎপরতা তুঙ্গে ওঠে। কলকাতায় মার্কিন কনস্যুলেটের কর্মকর্তা জর্জ গ্রিফিন ইতিমধ্যে মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে গোপন যোগাযোগের ভিত্তিতে একটা সমঝোতায় উপনীত হন। এই পরিপ্রেক্ষজিতে মোশতাক “হয় মুজিব, নয় স্বাধীনতা” এই নীতি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ফাটল ধরাবার ব্যর্থ চেষ্টা করেন।

৪১২

মুজিবনগর সরকারের উচ্চ পর্যায়ে খন্দকার মোশতাকের তৎপরতার প্রকৃত লক্ষ্য বেরিয়ে গেলে , মুজিবনগর সরকার খন্দকার মোশতাকের পরিবর্তে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের প্রধান করে ১৬ সদস্যের নাম ঘোষণা করে।
জাতিসংঘে সদস্যরাষ্ট্র ব্যতীত অন্যদের প্রতিনিধিত্ব করার অফিসিয়াল বিধান নেই। অর্থাৎ মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধিদল জাতিসংঘ কর্তৃপক্ষের নিকট অফিসিয়াল প্রতিনিধিদল হিসেবে স্বীকৃত হয়নি। এর বিপরীতে পাকিস্তান একদিকে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরাষ্ট্র, পাশাপাশি চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ট বন্ধু ও তার পেছনে মুসলিম বিশ্বের রয়েছে একচ্ছত্র সমর্থন। এমনি প্রতিকূল পরিবেশে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল তৎকালীন জাতিসংঘ সাংবাদিক সমিতির সভাপতি ড. যোগেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর সহযোগিতায় প্রবেশের অনুমতি পেয়েছে। প্রতিনিধি দলের সদস্যবৃন্দ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদল, দূতাবাসসমূহ ছাড়াও নানাজনের সঙ্গে দেখা করে প্রতিদিন সকাল থেকে সারাদিন ধরে বাঙালির সংগ্রামের যৌক্তিকতা ও পাক বাহিনীর বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেছেন অক্লান্ত পরিশ্রমে।
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান প্রত্যক্ষভাবে ভারত আক্রমন করলে, পরবর্তীতে ভারত বাংলাদেশের উদ্যোগে যৌথ কমান্ড গঠিত হয়। বাংলাদেশ ভারতের যৌথ বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানের সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়। উপমহাদেশ পরিস্থিতির উদ্বেগজনক অবনতিতে নিরাপত্তা পরিষদ ৪ ডিসেম্বর এক জরুরী অধিবেশনে মিলিত হয়। সভা শুরুর পূর্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে বক্তব্য উপস্থাপনের অনুমতি প্রার্থনা করেন। বিচারপতি চৌধুরীর প্রেরিত পত্র অফিসিয়াল ডকুমেন্ট হিসেবে নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত হয়, কিন্তু তিনি বক্তব্য প্রদানের সুযোগ পাননি।
উপমহাদেশের চরম উত্তেজক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষদ তিনদিন ধরে সভা করে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহনে ব্যর্থ হয়। পাকিস্তানের ভারত আক্রমনের দুইদিন পরেই ভারত সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করে। ভারতের লোকসভায় ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। শান্তিপূর্ণ সমাধানের আকাঙ্খার কোন গুরুত্ব নেই। আমি আনন্দের সঙ্গে এই সংসদকে অবহিত করতে চাই যে, “বিদ্যমান পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশ সরকারের বারবার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার অত্যন্ত সতর্ক বিবেচনার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে।” এমনি আবেগময় ভাষায় লোকসভায় রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে প্রত্যেকের হর্ষধ্বনির মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ স্বীকৃতি অর্জন করে। নিরাপত্তা পরিষদ তথা জাতিসংঘে এই ঘটনা উপমহাদেশ পরিস্থিতিকে আরো উত্তেজক ও জটিল করে তোলে। এমনি উদ্বেগ আর উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্তহীন নিরাপত্তা

৪১৩

পরিষদ একটি সিদ্ধান্ত নেয় যে, এ বিষয়ে আলোচনার জন্য সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশন আহবান করতে হবে।
নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে উপমহাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে মিলিত হয়। বিশেষ অধিবেশনে ১৩১ টি সদস্যরাষ্ট্র অংশগ্রহন করে। উপমহাদেশের যুদ্ধাবস্থা যে বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সাধারণ পরিষদে তিনটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। যথা- তেরটি দেশের প্রস্তাব, চৌত্রিশটি দেশের প্রস্তাব ও সোভিয়েত রাশিয়ার প্রস্তাব। এই তিনটি প্রস্তাবের মধ্যে শেষ পর্যন্ত “চৌত্রিশটি দেশের প্রস্তাব” এর উপর সদস্য রাষ্ট্র সমূহ ভোট প্রদান করে। এই প্রস্তাবের পক্ষে ১০৪ টি, বিপক্ষে ১১ টি ও ভোটদানে বিরত থাকে ১৬ টি রাষ্ট্র।
সাধারণ পরিষদের বিপুল ভোটের ব্যবধানে গৃহীত এই সিদ্ধান্তও বাস্তবায়িত হয়নি। অবশ্য এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন বাঙালির স্বার্থের পরিপন্থী ছিল। এই প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতির পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়। এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অখন্ডতার নীতির প্রতি সমর্থন জানানো হয়। এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষদ পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১২ ডিসেম্বর থেকে টানা ১০ দিন নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক চলে। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের ঘন্টা চারেক পূর্বে নিরাপত্তা পরিষদ বৈঠকে বসে। অধিবেশন শুরু হবার কিছুক্ষণের মধ্যে ঢাকায় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পন এবং পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতের একতরফা যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিবৃতি নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে পাঠ করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং। তথাপি নিরাপত্তা পরিষদ তাদের সভা ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত রাখে। ভারত এককভাবে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও নিরাপত্তা পরিষদ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তার কারণ বাংলাদেশের অভ্যুদয়। মার্কিন-চীন প্রভাবিত নিরাপত্তা পরিষদ সহজে এটা মেনে নিতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ২১ ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতি পালন ও জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আচরণ করার আহবান জানিয়ে অধিবেশন শেষ হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ড ভোটদানে বিরত থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ ১৩ টি সদস্যরাষ্ট্র পক্ষে ভোট দেয়। এমনি পরিস্থিতিতে সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশনও অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাতিসংঘের ভূমিকার সামগ্রিক মূল্যায়নে দেখা যায় এই সংস্থার কর্মকান্ড বিতর্কের উর্ধ্বে ছিলনা। মুক্তিযুদ্ধে জাতিসংঘ মহাসচিবের দপ্তর, নিরাপত্তা পরিষদ, সাধারণ পরিষদ ও শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়। মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে শরণার্থী সমস্যার সঙ্গে জাতিসংঘ সম্পৃক্ত হয়ে যায়। শরণার্থীদের দুর্দশা লাঘবের চেষ্টা করেছে ইউএনএইচসিআর

৪১৪

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে ও ভারতে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর চাহিদা তুলনায় জাতিসংঘ সরবরাহ সন্তোষজনক ছিলনা। কেননা লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকি বাহিনীর নারী নির্যাতন, অত্যাচার, গণহত্যা বিষয়ে জাতিসংঘের কোন এজেন্সি কোন আগ্রহ দেখায়নি। শরনার্থী সমস্যার রাজনৈতিক দিক সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে জাতিসংঘ।
ভারতের সরকার, জনগন ও গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর বিচার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে মৈত্রী চুক্তির প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও শেখ মুজিবের জীবন রক্ষায় তৎপর হয়ে ওঠে। জাতিসংঘের মহাসচিবও এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। কিন্তু আর বিশেষ কোন উদ্যোগ নেওয়া থেকে বিরত থাকেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতার অধিকারী সদস্যদের তিনভাগে ভাগ করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন, বিপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। কিছুটা নিরিপেক্ষ ভূমিকায় ব্রিটেন ও ফ্রান্স। বাস্তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবনহ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপরীত অবস্থানের কারনে নিরাপত্তা পরিষদের কোন কার্যকর ভূমিকা পালন করা সম্ভব ছিলনা। তবে ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রয়োগ ও কালক্ষেপণের কৌশল গ্রহন করে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভোটের ফলাফলে দেখা যায় বিরাট সংখ্যক সদস্যরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। একে মার্কিন-চীন-পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক হিসেবে ধরা যায়। পাশাপাশি এটা ছিল একটা সদস্য রাষ্ট্রের ভূখন্ডগত অখন্ডতা নীতির প্রতি জোরালো সমর্থন।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাতিসংঘ তার ন্যায়সঙ্গত ভূমিকা রাখেনি। অবশ্য এজন্য জাতিসংঘকে খুব বেশি সমালোচনের সুযোগ হয়ত নেই। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী এই বিশ্ব সংস্থাকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয় এবং মুক্তিযুদ্ধেও জাতিসংঘ সংবিধি অনুযায়ী দ্বায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছে।
[১১, ৭৩, ৮০] মোহাম্মদ সেলিম

মুক্তিযুদ্ধ ও জাপান
এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে এ কথা আজ বেশ জোর দিয়েই বলা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাপানের শিক্ষক, ছাত্র, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী তথা সাধারণ মানুষ সহায়তা প্রদানে এগিয়ে এসেছিলেন। এই সহায়তা ব্যক্তি পর্যায়ে যেমন দেওয়া হয়েছে তেমনি বেশ কিছু সংগঠনের

৪১৫

মাধ্যমেও করা হয়েছে। জাপানের বুদ্ধিজীবীগণ মূলত দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন। এক. ‘Nippon-Bengaru-kai’ বা Japan Bangladesh Friendship association এবং দুই. ‘Bangladesh Solidarity Front’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তা প্রদানের জন্য আরো একটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল, যে সংগঠনের সঙ্গে অনেক বুদ্ধিজীবী-ছাত্র সম্পৃক্ত ছিলেন। সংগঠনটির নাম ছিল ‘Fratecan Agon por Logantoj en Orienta Bengalio’ বা সংক্ষেপে F.A.L.O.B. ।
আগস্ট মাসে ওসাকা শহরে কানসাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক Setsurei Tsurushima এর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘Bangladesh Solidarity Front’ । কেবল জাপানি নয়, এই সংগঠনের সংগে অনেক বাঙালিও জড়িত ছিলেন। প্রফেসর Tsurushima আজীবন বিশ্বের নির্যাতিত জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সঙ্গত কারনেই নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর পাকিস্তান সেনাবাহিনির নির্মম, বর্বর হামলা এবং লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর অবর্ণনীয় দুঃখ-কশঠের সংবাদে বিচলিত প্রফেসর Tsurushima বাঙালিদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এই সংগঠন প্রথমে ওসাকায় এবং পরে টোকিওতে গঠিত হয়। ওসাকায় ফ্রন্টের আরেকজন নেতা ছিলেন Momoyama Gakuin বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর Hajime Katsube । টোকিওতে ফ্রন্টের নেতৃত্ব দেন টোকিও Edogawa Ward পারিষদ সদস্য Hideo Takano । টোকিওর বিখ্যাত Waseda বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রনেতা Ken Arimits ছিলেন এই ফ্রন্টের সম্পাদক। এদের প্রচেষ্টা ও নেতৃত্ব ‘Bangladesh Solidarity Front’ ‘৭১ এ বাংলাদেশ এর স্বাধীনতা সংগ্রামকে জাপানে একটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিনত করতে সমর্থ হয়েছিল। এ সময় প্রফেসর Tsurushima ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করতে ভারতেও গিয়েছিলেন। এই সংগঠন জাপানি ভাষায় ‘Bangladesh News’ নামে একটি সাময়িকীও প্রকাশ করে। সাময়িকী প্রকাশে প্রফেসর Tsurushima একটি অর্থনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্মী Mimoru Kiryu এবং জালাল আহমেদ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৫ নভেম্বর ‘৭১ এ প্রকাশিত পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় যে লেখাগুলো ছিল সেগুলোর শিরোনামে ইংরেজি দাঁড়ায় এরকম-
‘For Indepence of Bangladesh’, ‘Bengali defected diplomats expresed their loyalty to Bangladesh Government’, ‘Declaration of Independence of Bangladesh’, ‘Role of Liberation Forces’, ‘Secret Trial, of Mujibur Rahman by Pakistan Government’, ‘Bangladesh’s foreign Minister’s message to the Japanese nation’ etc.

৪১৬

‘F. A. L. O. B.’ বা ‘Fratecan Agon por Logantoj en Orienta Bengali’ অর্থ হল- ‘Lets act as Brothers and Sisters of the people in East Bangla’, এই সংগঠন সম্পর্কে প্রফেসর Tsuyoshi Nara জানিয়েছেনঃ
The members Of this Association headed by Toshihiro Kataoka are all lovers of Esperanto language in Janan. They sent letters of appeal to the Japanese Government, Liberal Democratic Party, Japan Socialist Party and Japan Communist Party, They visited Pakistan Embassy ti the Ambassador and also met M.S. Maswood, defunct diplomat of Pakistan Embassy in Tokyo. They published some booklets also.’
জাপানে জনমত গঠনে এবং শরণার্থীদের সহায়তায় যে সংগঠনটি সর্বাধুনিক ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করেছিল সেটি হচ্ছে Japan-Bangla Friendship Association. এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন প্রফেসর সুয়োশি নারা। প্রফেসর নারা এ সময় টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেন স্টাডিজের অন্তর্গত ‘Institute for the Study of Languages and Cultures of Asia and Africa’- তে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেছিলেন। কার্যিনির্বাহি পরিষদের অপর সদস্যরা ছিলেন কোমাযাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর Yasuaki Nara, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের হেইজি নাকামুরা , অপর সহযোগী অধ্যাপক তাদালিকো হারা, টোকিও ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক Yasuhi Chiba, টোকিওর সানিকো কোম্পানী লিমিটেডের সম্পাদক Shooichi Sooma । এই সংগঠনের সদস্যসংখ্যা ছিল ১৩৯ জন। এর মধ্যে ৫০ জন ই ছিলেন মহিলা সদস্য।
সংগঠনের সভাপতি প্রফেসর নারা ৩০ এপ্রিল জাপানের জনগণ তথা বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে এক আবেদনে জানানঃ
The Bengali populace of East Pakistan are one of the most unfortunate people of the world judging from the fact that they have been the victims of two of the greatest disasters of history within a short period of only six months.

Last November, yjey lost about 5,00,000 lives to the cruelty of nature by way of cyclone. Hardly could they try up their tears when a new calamity befell upon them. This time they lost several hundred thousand lives to the cruelty of men-the massacre civilians by a well armed military since last month . . . it leaves no doubt that there has been a systematic massacre of innumerable unarmed civilians who wanted along with their kiths and kins to live a peaceful and democratic life in their own land.

But why this indiscriminate genocide-style killing? . . . We cannot

৪১৭

accept it as a simple problem arising in a particular country called Pakistan, but we surely take it as a great challenge to the lovers of democracy, justice and humanitarianism all over the world. It is clearly evident in the past history that peoples heart cannot be won by military force. . .

we, as members of peace loving and democratic society, strongly condemn this want on massacre of the bengali people by the Pakistani government force and appeal to sense of humanity, justice and moral conscience of the world to take effective steps to put pressure on the Pakistani government so as to stop further killings and to return the people’s democratic rights.
We are not after politics, nor we advocate middling in the internal politics of another country. But an indiscriminate killing anywhere in the world is more than internal affairs of a particular country. It involves the humanity as a whole and it is responsibility of all humanity to raise voice against a genocide perpetrated by someone with the objective of annihilating democracy . . . We earnestly appeal to the people of the world over, specially to the Japanese people to join with us in our appeal as follows:

1. We appeal to the Japanese Red Cross society to take up the case in cooperation with the international Red Cross for humanitarian services to the Bengali victims of East Pakistan as well as the 7,00,000 or more East Pakistani refugees who have taken shelter in India to escape repression.
2. We appeal to the international press to explore possibilities to enter East Pakistan so that the newsmen may give a vivid picture of the East Bengal scene.
3. We appeal to the United Nations Organization to take effective steps to restore democracy in Pakistan.
4. We appeal to the Japanese people to help the Bengali victims and refugees with similar warmth as they did to them during the last cyclone devastation. . .

এই সংগঠন জাপানে জনমত গঠনে যেমন তৎপর ছিল- তেমনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। শরণার্থীদের দুরবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য সমিতির সদস্যবৃন্দ ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্প যেমন পরিদর্শণ করেছেন- তেমনি বাংলাদেশ প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও অংশ নিয়েছেন। সমিতির সভাপতি প্রফেসর নারা নতুন দিল্লীতে ১০ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের উপর আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নংশগ্রহন করেছিলেন। ‘গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত এই সম্মেলনে প্রফেসর নারা এক পর্যায়ে বলেছিলেন, ‘I

৪১৮

think I have already succeeded in focusing Japans attention on this conferende because the Pakistan Embassy in Tokyo has protested to the Japanese government regarding my coming here’ এই সংবাদ জাপান বেশ গুরুত্ব দিয়েই প্রকাশ করে। সমিতির সদস্যবৃন্দ শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড’ এ অংশগ্রহনের কথাও ঘোষণা করে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত পাওয়া যায় জাপানের সমকালীন পত্রিকায়।
এ কথা সত্যি যে ‘জাপান বাংলা ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন’এর অধিকাংশ সদস্য দিনরাত শ্রম এবং সময় ব্যয় করেছেন। এমনকি অনেকে আকর্ষনীয় চাকরিটি পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। এমন একজন জাপানি ছিলেন তাকামাশা সুজুকি। রেডিও, টড়লিভিশন এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণহত্যা, অত্যাচার এবং শরণার্থীদের করুন কাহিনি জেনে মনস্থির করলেন বাংলাদেশের মানুষের জন্য কাজ করবেন। সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরুও করলেন। সুজুকি সার্বক্ষণিক কাজ করার জন্য এক পর্যায়ে কম্পিউটার কোম্পানির চাকরিটিও ছেড়ে দিলেন। চাকরি ছাড়ার ফলে কোম্পানী থেকে এককালীন যে অর্থ পেলেন তাই দিয়ে একটি মটরগাড়ি কিনলেঙ্গাড়িতে মাইক লাগালেন। সেই সঙ্গে জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ মাই বাংলাদেশ’ গানটি বাজানো শুরু করলেন। তাকামাসা সুজুকি তাঁর এই গাড়ি নিয়ে টোকিও তথা জাপানের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বাঙালিদের উপর পাকিস্তানের নির্মম নির্যাতন, হত্যা আর শরণার্থীদের করুন কাহিনী জনগণের কাছে তুলে ধরেন। শরনার্থীদের সাহায্যের জন্য সংগ্রহ করলেন অর্থ আর সাহায্যসামগ্রী। শরণার্থীদের প্রকৃত অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য এক পর্যায়ে ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরও পরিদর্শন করেন তিনি। সুজুকি জাপানে ফিরে শরণার্থীদের করুন কাহিনীর সচিত্র প্রতিবেদন জাপানের জনগণের কাছে তুলে ধরেন। জাপানের জনমত গঠনে তাকামাসা সুজুকি এর ভূমিকা ছিল অনন্য। এমনকি এই তরুন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অনাথ শিশুদের লালন পালনে দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন স্বাধীন বাংলার মাটিতে’৭১ এ জাপান প্রবাসী বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আনোয়ারুল করিম তাকামাসা সুজুকি সম্পর্কে যথার্থই বলেছেনঃ বাঙালি হয়ে নিজের দেশের জন্য আমরা যা করতে পারিনি, সুজুকিসান তাই করেছেন। এমন মহৎ মানবিক লোক সরসরি আমি খুব কমই দেখেছি।’
সুজুকির মত এমন অনেক জাপানিই সেদিন বাঙালিদের জন্য, বাংলাদেশের জন্য কাজ করেছিলেন। আমরা প্রফেসর Yasushi Chiba, Tomio Jijokami, জাপান শোসালিস্ট পার্টির সক্রিয় মহিলা কর্মী Tatsuko Ikeda, এমপিকে নিশিমুরাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
সেদিন অসংখ্য ছাত্র ছাত্রীও বাংলাদেশের জন্য কাজ করেছিলেন।

৪১৯

সেদিনের ছাত্র আজকের অর্থনীতির অধ্যাপক Shinkichi Taniguchi এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেনঃ I with several other students who attended the beginners course of Bengali language organized by the institute of language and cultures. . . went to shijuka station asked for the passengers to make small donations. We also published a series of small pamphlets under the name of ‘Friends of Bangladesh’ in Japan. We translated relevent news from Inidian and European Sources into Japanese and publishesd them in these leaflets.’

এই প্রসঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর সহযোগী লে. জেনারেল ফুজিয়ারার অবদানের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। জেনারেল ফুজিয়ারা জাপানে জনমত গঠন তথা বাংলাদেশ বিষয়কে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করে জাপান সরকারের সমর্থন আদায়ে তৎপর ছিলেন।
এ সময়ের জাপানের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পার্লামেন্ট সদস্য হায়াকাওয়ার ভূমিকাও ছিল ইতিবাচক। বিশেষত টোকিওতে পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগকারী দুজন কূটনীতিকের আশ্রয়দান জাপানী জনমনে সবিশেষ প্রভাব রেখেছিল। দুই দেশের মধ্যে সেতুবন্ধনে হায়াকাওয়ার অবদান অনস্বীকার্য। জাপানের রাজনৈতিক দলগুলোও বাঙালিদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। এ সময়ের ক্ষমতাশীল দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির ৪ জন ডায়েট (পার্লামেন্ট) সদস্য ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। জাপান শোসালিস্ট পার্টি, জাপান কমিউনিস্ট পার্টিসহ অন্যন্য দল, নানা সামাজিক সংগঠন ও সাহায্য সংস্থা মানবিক সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিল। এন এইচ কে রেডিও টেলিভিশন এর ভূমিকাও ছিল ইতিবাচক।
এভাবে জাপানের বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, সাধারণ চাকরিজীবী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান- এককথায় জাপানের মানুষের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা প্রদানের জন্য বাঙালি জাতির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
[১৩৯] সুকুমার বিশ্বাস

মুক্তিযুদ্ধ ও জামায়াতে ইসলামী
আজকের জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগের বিভিন্ন অংশ, খেলাফত আন্দোলন, আইডিএল নেজামে ইসলামী প্রভৃতি দলের নেতৃবৃন্দের প্রায় সবাই একাত্তরের মুখ্য দালাল। এছাড়া জাতীয় পার্টি, বিএনপির বিভিন্ন অংশ এবং ডানপন্থী অন্যান্য দলেও ঘটেছে কুখ্যাত দালালদের সমাবেশ। এখানে একে একে প্রধান দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পুনর্বাসিত কয়েকজন মুখ্য দালালের পরিচয় দেওয়া হল।
স্বাধীন বাংলাদেশে পুনর্বাসিত মানবেতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের হোতা বিশ্বাসঘাতক দালালদের মধ্যে অনিবার্যভাবে সবচেয়ে ঘৃণার্হ ব্যক্তিটি হচ্ছে

৪২০

জামায়াত্র ইসলামীর প্রাক্তন আমীর পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযম। হত্যাযজ্ঞের সেই ভয়াবহ ২৬৬ দিনে সে বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের উভয় অংশে ছুটে বেড়িয়ে অসংখ্যবার যে সমস্ত বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছে তার পূর্ণ বর্ণনা দিতে হলে একটি বৃহদাকার গ্রন্থ রচনা করতে হবে। স্বীয় নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রসংঘ ছাড়াও স্বাধীনতা বিরোধী খুনীদের সে যেভাবে বাঙালি নিধনের কাজে সুসংগঠিত করেছিলেন যোগ্য হাতে, তার সাহসী ও সুচারু গবেষণা হওয়া উচিত আমাদের জাতীয় স্বার্থেই। এখানে ‘৭১ এ তার কর্মকান্ড ও বক্তৃতা বিবৃতির উল্লেখযোগ্য দু একটি অংশ উদ্ধৃত করা হবে।
৮ এপ্রিল ১৯৭১ জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক মওলানা নুরুজ্জামান এবং জামায়াতের অপর নেতা গোলাম সারওয়ারের সাথে প্রদত্ত এক যুক্ত বিবৃতিতে সে বলে, ‘ভারত পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে। ভারতীয় বা পাকিস্তানবিরোধী এজেন্টদের বা অনুপ্রবেশকারীদের যেখানেই দেখা যাবে, সেখানেই পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিকরা তাদের নির্মুল করবে।’
৯ এপ্রিল রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রদত্ত বেতার ভাষণে সে স্বীয় প্রচেষ্টায় নিজেদের ভাগ্য প্রণয়নের জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানাইয়। এটি সহজবোধ্য ব্যাপার যে, ভাগ্য প্রণয়ন বলতে বাঙালিদের সম্পত্তি লুট করাকেই বুঝিয়েছে সে। শান্তিকমিটির অন্যতম প্রধান কাজ ছিল বাঙালিদের হত্যা করে তাদের সম্পত্তি দালালদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া। ৫, এলফ্যান্ট রোড থেকে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির অফিস ২২ এপ্রিল তারিখে সংকীর্ণ গলির মধ্যে গোলাম আযমের বাড়ির দুটি বাড়ি পরে তার চাচত ভাই এ কিউ এম শফিকুল ইসলামের বাড়িতে সরিয়ে আনা হয়। সেই থেকে আজও এই গলিটি বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্রান্তের প্রধান ঘাঁটি। এখানে অফিস সরিয়ে আনার পর কমিটির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘ইতিপূর্বেকার বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী প্রত্যেকদিনই সকাল ৮ টা থেকে ১২ টা এবং বিকেল ৩ টা থেকে ৬ টা পর্যন্ত অফিস চলাকালীন অফিস থেকে দোকান ও গৃহ বরাদ্দের জন্য ফর্ম বিলি ও দরখাস্ত গ্রহন চলবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আগামী ১৫ জুন দরখাস্ত পেশের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।’
ভারতীয় লোকসভায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যদান সংক্রান্ত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা প্রসঙ্গে সে বেতার ভাষণে বলে ,’ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মত দ্বায়িত্বশীল ব্যক্তি পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি যে সমর্থন ও সমবেদনা জানিয়েছেন, তাতে আমি বিস্মিত হয়েছি।’
মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে সে বলে, ‘ পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে ভারত প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশপ্রেমের মূলে আঘাত হেনেছে। এ ধরনের

৪২১

অনুপ্রবেশ এ দেশের মুসলমানদের কোন কাজেই আসবেনা।’
১৭ জুন তারিখে রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়া খানের সভাপতিত্বে পাকিস্তানের গভর্ণর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯ জুন টিক্কা খান ঢাকা ফিরে আসার আগে গোলাম আযম ঐদিন সকালে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ইতিপূর্বে ১৮ জুন টিক্কা খান ঢাকা ফিরে আসার আগে গোলাম আযম ওই দিন সকালে ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাৎ করে। ইতিপূর্বে ১৮ জুন লাহোর বিমানবন্দরে অবতরণের পর সাংবাদিকদের সে বলে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থার আরো উন্নতির জন্য সে প্রেসিডেন্টের কাছে আরো কতকগুলো পরামর্শ পেশ করবে, তা উল্লেখ করতে সে অস্বীকৃতি জানায়। এখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে সে বলে, ‘দুষ্কৃতকারীরা এখনো ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত রয়েছে। ত্রাস সৃষ্টি এবং বিশৃংখলাপূর্ণ পরিস্থিতি অব্যাহত রাখাই তাদের উদ্দেশ্য। দুষ্কৃতকারীরা নকশালপন্থী ও বামপন্থীদের দ্বারা পরিচাকিত হচ্ছে।’
সে আরো বলে, ‘জনগণ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনিকে পূর্ণ সাহায্য ও সহযোগিতা দিতে ইচ্ছুক, কিন্তু জীবননাশের জন্য দুষ্কৃতকারীরা হুমকি দেয়ায় তারা এ ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতা করতে পারছে না। প্রকৃত অপরাধীকে ধরতে পারলেই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ করায়ত্ত করা সম্ভব হত।’
ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাতের পর ২০ জুন লাহোর জামায়াতে ইসলামীর অফিসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে সে বলে, ‘দুষ্কৃতকারীরা এখনো পূর্ব পাকিস্তানে তৎপর রয়েছে এবং তাদের মোকাবেলা করার জন্য জনগণকে অস্ত্র দেওয়া উচিত।’
সাংবাদিক সম্মেলনের আগে জামায়াত কর্মীদের সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে সে বলে, ‘দেশকে খন্ড বিখন্ড হওয়ার হাত থেকে রক্ষা হওয়ার হাত থেকে জন্য সামরিক ব্যবস্থা গ্রহন ছাড়া আর কোন বিকল্প ব্যাবস্থা ছিলনা।’ সে বলে, ‘ পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রতিক গোলযোগ ১৮৫৭ সালে বাংলায় বিদ্রোহী আন্দোলনের চেয়ে দশ গুন বেশি শক্তিশালী ছিল।’

টিক্কা খান ঘোষিত কুখ্যাত পাঠ্যসূচি সংস্কারের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়ে ৩০ জুলাই প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ মনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রতি ইঙ্গিত করে সে বলে, ‘শিক্ষকদের উপরেই সঠিক শিক্ষাদান নির্ভর করছে। শিক্ষকরা পাকিস্তানের আদর্শের খাঁটি বিশ্বাসী না হলে তাঁদের কাছ থেকে গঠনমূলক কিছুই আশা করা যায়না।’
১৪ আগস্ট ‘আজাদী দিবস’ উপলক্ষে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে গোলাম আযম বলে, ‘ আমাদের আদর্শের প্রতি অপরাধীমূলক চরম বিশ্বাসঘাতকতাই আজকের জাতীয় সংকটাবস্থার আসল কারণ।’ পাকিস্তানকে রক্ষার আহবান জানিয়ে সে বলে, ‘এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে আমরা ধ্বংস্প্রাপ্ত হব এবং যতদিন আমরা বাঁচব, পঙ্গু জাতি হিসেবে বেঁচে থাকব।’

৪২২

ওইদিন কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি আয়োজিত কার্জন হলের সভায় গোলাম আযমের বক্তব্য ছিল, আল্লাহ না করুন, যদি পাকিস্তান না থাকে, তা হলে বাঙালি মুসলমানদের অপমানে মৃত্যু বরণ করতে হবে।’ এই সভায় সে ‘পাকিস্তানের দুশমন্দের’ মহল্লায় মহল্লায় তন্ন তন্ন করে খুঁজে তাদের অস্তিত্ব বিলোপ করার জন্য দেশপ্রেমিক নাগরিকদের শান্তি কমিটির সাথে সহযোগিতা করার জন্য উদাত্ত আহবা জানায়। সবশেষে সে শান্তি কমিটির নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শক্রমেই সরকারের দেশের সংহতির খাতিরে পদক্ষেপ গ্রহন করা উচিত বলে বক্তৃতা শেষ করে।

এই দিন জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার ইসলামিক একাডেমি হলের সভায় সে বলে, ‘বাংলাদেশ বাঙালিদের দ্বারা শাসিত হবে এই মতবাদ শেখ মুজিব বা শ্রী তাজুদ্দিনের। এজন্যেই তথাকথিত বাঙালি বীরেরা পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে বাংলাদেশ কায়েম করেছে। কিন্তু মুসলমান আল্লাহর হুকুম পালন করার সুযোগ লাভকেই সত্যিকারের আজাদী মনে করে। এ ভিত্তিতে শাসক নিজের দেশের হোক বা বিদেশী হোক তা মোটেও লক্ষনীয় নয়।’

২৩ আগস্ট লাহোরে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সম্মেলন উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় গোলাম আযম বলে, ‘জামায়াতে ইসলামীকে যারা অদেশপ্রেমিক দল হিসেবে আখ্যায়িত করেন, তারা হয় এ সত্য জানেন না বা স্বীকার করার মত সৎ সাহস নেই যে, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিষদাঁত ও নখ ভেঙে দেওয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের বহুসংখ্যক কর্মী দুষ্কৃতকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন।’
২৬ আগস্ট পেশোয়ারে সাংবাদিক সম্মেলনে সে বলে, ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের মীরজাফরী ও ভারতের দুরভিসন্ধি হতে সশস্ত্র বাহিনী দেশকে রক্ষা করেছে। দুষ্কৃতকারী ও অনুপ্রবেশকারীদের ধ্বংস করার কাজে পূর্ব পাকিস্তানে জনগণ সেনাবাহিনিকে পূর্ণ সহযোগিতা করছে।’
২৯ আগস্ট করাচিতে সাংবাদিকদের সে বলে, ‘পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের মনে আস্থার ভাব সৃষ্টি করার জন্য আরো পদক্ষেপ নেয়া দরকার।’
এই সফরের সময় লাহোরের সাপ্তাহিক জিন্দেগীতে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে সে প্রশ্ন করে, ‘২৫ মার্চের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে পদক্ষেপ গ্রহন করে তা ছিল এদেশের মাটি রক্ষা করার জন্য, এর আগেই অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহন করা প্রয়োজন ছিল না কি?’ জামায়াত প্রার্থীদের উপনির্বাচনে অংশগ্রহনের ব্যাপারে এই সাক্ষাৎকারে সে বলে, ‘আমি আশংকা করছি, যেখানে সেনাবাহিনী ও রাজাকার বাহিনী নেই, সেখানে অংশগ্রহঙ্কারীদের দুষ্কৃতকারীরা হত্যা করবে। তাদের বাড়িঘর লুট করবে ও জ্বাকিয়ে পুড়িয়ে দেবে। এ পরিস্থিতি থেকে উপকৃত হলে তারা আবার বলতে শুরু করেছে যে, তথাকথিত ‘বাংলাদেশ’ নাকি শিগগিরই একটি বাস্তব সত্যে পরিণত হবে। ‘

৪২৩

জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতা সম্পর্কে প্রশ্নকর্তাকে সে বলে, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জামায়াতকে মনে করত পয়লা নম্বরের দুশমন। তারা তালিকা তৈরি করেছে এবং জামায়াতের লোকদের বেছে বেছে হত্যা করেছে। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং এখনো দিচ্ছে। এতদসত্তেও জামাতকর্মীরা রাজাকারের দলে ভর্তি হয়ে দেশের প্রতিরক্ষায় বাধ্য, কারন তারা জানে ‘বাংলাদেশে’ ইসলাম ও মুসলমানের কোন জায়গা হতে পারেনা। জামায়াত কর্মীরা শহীদ হতে পারে, কিন্তু পরিবর্তিত হতে পারেনা। আপনি জেনে বিস্মিত হবেন, শান্তিকমিটি সমূহে যোগদানকারী অন্যান্য দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলের নেতৃস্থানীয় লোকদেরই শুধু হত্যার লক্ষ্য হিসেবে গ্রহন করা হয়, কিন্তু জামায়াতের সাধারণ কর্মীদেরও ক্ষমা করা হয়না। । । ।
‘আমি চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া প্রভৃতি স্থানে সফর করেছি। আল্লাহর অপার মহিমায় জামায়াত কর্মীদের মনোবল অটুট রয়েছে। দুষ্কৃতকারীদের তৎপরতাও অব্যাহত রয়েছে।
১১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুবার্ষিকী উপলিক্ষ্যে কার্জন হলে ইসলামী ছাত্রসংঘের স্মৃতি প্রদর্শনীতে ইসলামী ছাত্র সংঘকে অভিনন্দন জানিয়ে সে বলে, ‘পাকিস্তান আন্দোলনের সময়ের মত আজকে আবার পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য নতুন বাহিনীর প্রয়োজন। ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মী বাহিনীই কায়েদে আযমের মহাদান পাকিস্তানকে চিরস্থায়ী করতে সক্ষম হবে।’
ইতিপূর্বে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সফর শেষে ‘দৈনিক সংগ্রাম’এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে ৪ মাসের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর সংক্রান্ত ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা প্রসঙ্গে সে মন্তব্য করে, ‘অক্টোবরের শেষে বন্যার পানি চলে যাবার পরপরই গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে দুষ্কৃতকারীদের দমন করার কাজ শুরু হবে। তাদের পরিপূর্ণভাবে নির্মুল করার পরই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। দুষ্কৃতকারী সম্পূর্ণভাবে নির্মুল না হলে নির্বাচন অনুষ্ঠান অসুবিধা বৈকি। কারণ দুষ্কৃতকারীদের সম্পূর্ণ নির্মুল না করা পর্যন্ত গনগণ নিরাপদ বোধ করবেনা এবং প্রার্থীদেরও নিরাপত্তা সম্ভব নয়।
এর আগে ১৭ সেপ্টেম্বর গোলাম আযম জামায়াতের শ্রম ও জনকল্যান সম্পাদক শফিকুল্লাহ ও তেজগাঁঅ থানা ও শান্তিকমিটির লিয়াঁজো অফিসার মাহবুবুর রহমান গুরহা এবং রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ মোহাম্মদ ইউনুস সহ ঢাকার মোহাম্মাদপুরে ফিজিক্যাল ট্রেইনিং কলেজের আলবদর হেডকোয়ার্টার এবং রাজাকার বাহিনীর প্রশিক্ষণ শিবির পরিদর্শন করে। প্রশিক্ষণ গ্রহনরত রাজাকার এবং আলবদরদের উদ্দেশ্যে ভাষণদান প্রসঙ্গে সে বলে, ‘ইসলাম ও পাকিস্তানের দুশমনরা আলেম ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের ব্যাপকভাবে হত্যা করে এ কথাই প্রমাণ করেছে যে, এসব

৪২৪

লোককে খতম করলেই পাকিস্তানকে ধ্বংস করা যাবে। আলেম ও দ্বীনদারদের উপর এই হামলা আল্লাহরই রহমত। কারণ, এই হামলা না হলে তারা আত্মরক্ষা ও পাকিস্তানের হেফাজতের জন্য রাজাকার, আলবদর, আল শামস, মুজাহিদ ও পুলিশ বাহিনীতে ভর্তি হবার প্রয়োজন বোধ করত না।’
প্রশিক্ষণরত রাজাকারদের লক্ষ্য করে সে বলে, ‘রাজাকার বাহিনী কোন দলের নয়। তারা পাকিস্তানে বিশ্বাসী সকল দলের সম্পদ। কোন দলের লোক কম বা কোন দলের বেশি লোক রাজাকার বাহিনীতে থাকতে পারে, কিন্তু তোমরা দল মতের উর্ধ্বে উঠে পাকিস্তানে বিশ্বাসী সকল দলকে আপন মনে করবে। ইসলামী দলসমূহের মধ্যে যে ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে তাও আল্লাহরই রহমত। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামীর মধ্যে কোন পার্থক্য দেখেনি, বরং তারা ঢালাওভাবে আলেম ও ইসলামী দলের লোকদের খতম করেছে। সুতরাং আমরা নিজেরা চেষ্টা করে এক না হলেও দুশমনরা সমানভাবে আঘাত হেনে আমাদের এক হতে বাধ্য করেছে। এরপরেও যদি কেউ বিভিন্নতা সৃষ্টির পূর্বের অভ্যাস ত্যাগ না করে তবে আল্লাহ স্বয়ং তাদের মেরামত করবেন, তোমরা তাদের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করোনা।
স্বাধীনতামনা বাঙালিদের প্রসঙ্গে সে বলে, ‘বাইরের শত্রুর চেয়ে ঘরের শত্রু বেশি ক্ষতিকর। আমাদের ঘরেই এখন অসংখ্য শত্রু তৈরি হয়েছে। এই শ্ত্রু সৃষ্টীর কারণ যাই হোক্সেদিকে এখন নজর দেবার সুযোগ নেই। এখন ঘরে আগুণ লেগেছে, কাজেই আগুণ নেভানোই তোমাদের প্রথম দ্বায়িত্ব। এ ব্যাপারে সেনাবাহিনী পদক্ষেপ গ্রহন করেছে এবং রাজাকাররাও তাদের পিছনে এগিয়ে এসেছে।’
স্বেচ্ছাপ্রনোদিত হয়ে পাকিস্তানের খাতিরে এগিয়ে আসার জন্য রাজাকারদের ভূয়সী প্রশংসা করে সে বলে, ‘বিপদের মধ্যেও আমাদের দৃঢ় শপথে অটল থাকতে হবে, তাহলেই আল্লাহর কাছে সত্যিকারের মুজাহিদের মর্যাদা লাভ সম্ভব হবে।’
রাজাকারদের ভালোভাবে ট্রেনিং গ্রহন করে যত শিগগির সম্ভব অভ্যন্তরীণ শত্রুকে দমন করার কাজে যত তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসতে পারবে, ততই তাড়াতাড়ি সেনাবাহিনী দেশকে শত্রুমুক্ত করার কাজে ফিরে যেতে পারবে।’
উল্লেখ্য, গোলাম আযমের সাথে এই সভায় উপস্থিত রাজাকার প্রধান মোহাম্মদ ইউনুস আজ জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য, কোটিপতি ব্যবসায়ী এবং ইসলামী ব্যাংকের অন্যতম পরিচালক, শান্তিকমিটির লিয়াঁজো অফিসার মাহবুবুর রহমান গুরহা জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতা এবং পৌরসভার

৪২৫

প্রাক্তন স্থানীয় ওয়ার্ড চেয়ারম্যান। ১৮ সেপ্টেম্বর গভর্নর মালেক মন্ত্রীসভার সদস্যদের অভিনন্দন জানিয়ে গোলাম আযম বলে, সশস্ত্র বাহিনী অভিযানের পর থ্রক্রি কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় শান্তি কমিটিগুলো স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। শান্তিকমিটি এতদিনে এ ব্যাপারে যা করতে পেরেছে মন্ত্রীগণ তার চেয়ে অধিক কাজ করতে পারেন বলে আমি আশা করি।’
২ অক্টোবর ঢাকায় প্রাদেশিক জামায়াতের মজলিশে শুরার বৈঠক উদ্বোধনকালে সে বলে, ‘খোদা না খাস্তা, পাকিস্তানকে রক্ষা করতে আমরা যদি ব্যর্থ হই, তবে আমরা আমাদের নিজেদের এবং আমাদের আদর্শকেও রক্ষা করতে পারবনা। দেশের প্রতিরক্ষায় জামায়াত কর্মী এবং সমর্থকদের অংশগ্রহনের পিছনে এই বিশ্বাস ই চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে। এ কারণেই দেশের শত্রুরা জামায়াত কর্মীদের তাদের শিকারে পরিণত করেছে। কারণ তারা উপলব্ধি করেছে জামায়াত কর্মীরাই তাদের পথের সবচেয়ে বড়ো বাধা। এসব জামায়াত কর্মীকে খতম করা ব্যতীত তাদের (দুশমন্দের) হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবেনা। ‘
১৬ অক্টোবর বায়তুল মোকাররমে জামায়াতে ইসলামীর জনসভায় সে বলে, ‘জামায়াতে ইসলামী গোটা দেশে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য নিরিলস ভাবে শান্তি কমিটির মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে।’
ইতিমধ্যে বাংলাদেশের রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের মুখ্য নেতৃবৃন্দ পিপিপি এর মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরি, মাওলানা কাওসার নিয়াজী, মুফতি মাহমুদ প্রমুখ বিবৃতি দিয়েছিলেন। এই সমস্ত বাহিনীকে সন্ত্রাসবাদী দল হিসেবে উল্লেখ করে তাঁরা অবিলম্বে এগুলো বিলুপ্ত করার দাবী জানান।
১২ নভেম্বর এক বিবৃতিতে গোলাম এ প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে সাহায্য করার জন্য বামপন্থী দল্গুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ খন্ডন না করে বরং তারই (গোলাম আযম) বিরুদ্ধে আল বদর সম্পর্কে বিবৃতি দেয়ায় মাহমুদ আলী কাসুরীর সমালোচনা করে।
এরপর মুক্তিযোদ্ধারা যখন ঢাকার উপকন্ঠে এসে পৌঁছেছে, গোলাম আযম এবং জামায়াতের অন্যরা বুঝতে পারে পলায়নের সময় হয়েছে। যে নজিরবিহীন নৃশংসতা তারা এতদিন পরিচালনা করে এসেছে, তার জন্য তারা যে কখনোই ক্ষমে পেতে পারেনা, এই বোধ তাদের ছিল। ‘পাকিস্তান রক্ষায়’ রাজাকার, আলবদর, আল শামস দের যখন তাদের নেতৃত্বে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তখন এদের ফেলে তারা প্রাণ নিয়ে পাকিস্তানে চলে যায়। জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক কমিটি বৈঠকে যোগদানের নামে জামায়াতের সহকারী প্রধান মওলানা আব্দুর রহিম এবং প্রাদেশিক রাজস্বমন্ত্রী একেএম ইউসুফ কে নিয়ে এসময় সে

৪২৬

পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। পাকিস্তানে যাবার পর গোলাম আযম সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকে।
এক সমুদ্র রক্তস্নাত হয়ে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্য উদয় হতে আর কয়েকদিন মাত্র বাকি, পাক বাহিনী ও দালালরা যখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আঘাতে বেসামাল, ইয়াহিয়া খান তখন সারাদেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে ১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর। এই ঘোষণার পরে লাহোরে সাংবাদিকদের গোলাম আযম বলে, ‘বর্তমান মূহুর্তে সর্বাধিক আক্রমনাত্মক ভূমিকা পালন করাই হবে দেশের জন্য আত্মরক্ষার সর্বোত্তম ব্যবস্থা।’
‘পূর্ব পাকিস্তানে’ শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে সকল দেশপ্রেমিক, শান্তি কমিটির সদস্য, রাজাকার এবং আলবদর ও আল শামস দের উন্নতমানের ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত করার জন্য গোলাম আযম জোর দাবী জানায়।
২৭ নভেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে এক সমাবেশে বলে, ‘কোন জাতি যুদ্ধকালে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা ছাড়াই টিকতে পেরেছে এমন কোন নজির ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আত্মরক্ষা নয়, আক্রমণই এখন সর্বোত্তম পন্থা।’
করুনতম অধ্যায়, বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডেও সে তার নিজের ভূমিকা টুকু পালন করে যায়। গোলাম আযমের কর্মকান্ডের এই অংশটুকুর পরিচয় দেবার জন্য ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র ১৭ এপ্রিল ৮১ সংখ্যার ‘একাত্তরে ভুল করিনি’-গোলাম আযম ও জামায়াতের রাজনীতি’ শীর্ষক আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রচ্ছদ কাহিনীর অংশবিশেষ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে- “অধ্যাপক গোলাম আযম বুদ্ধিজীবী হত্যারও অন্যতম নায়ক। ৭১ এর সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে রাও ফরমান আলীর সাথে এক বৈঠকে অধ্যাপক আযম বুদ্ধিজীবী নিধনের একটা নীলনকশা পেশ করে। সে নীল নকশা অনুযায়ী পরবর্তীকালে ডিসেম্বর মাসে বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। নীলনকশা প্রণয়নে আব্দুল খালেক, ব্যারিস্টার কোরবান আলী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, আব্বাস আলী খান প্রভৃতি জামায়াত নেতা জড়িত ছিল। স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবী হত্যাসংক্রান্ত যে দলিলপত্র পাওয়া যায় তাতে স্পষ্ট করে নির্দেশ ছিলঃ
পূর্ব পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখা হয়ত সম্ভব হবেনা। তবে একটা কাজ করতে হবে। এখানকার বুদ্ধিজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, ডাক্তারকে চিরতরে ‘শেষ’ করে দিতে হবে। যাতে পাকিস্তান হারালেও তারা দেশ না চালাতে পারে। অধ্যাপক আযম এই নীল নকশা বাস্তবায়ন করার জন্য তার দলীয় ক্যাডার অর্থাৎ আলবদর ও আল শামস কে নির্দেশ দেয়। এলাকাও ভাগ করে দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসে যে কয়জন আলবদর নেতাকে গ্রেফতার করা হয় তাদের কাছ থেকে নীলনকশার বেশকিছু দলিল-পত্র উদ্ধার করা হয়। সে দলিলের একটা অংশ নিম্নরূপ-
‘নিম্নলিখিত ব্যাক্তিদের ধরে এনে হত্যা করতে হবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। যদি

৪২৭

কেউ আত্মগোপন করে থাকে তাহলে তাঁর পরিবারের কাউকে ধরে এনে এমন অত্যাচার চালাতে হবে যাতে করে পলাতক ব্যক্তির সন্ধান মেলে।’
আরবিতে লেখা একটা নির্দেশনামায় ছিলঃ ‘মনে রাখবেন দুষ্কৃতকারী যদি দেশে ঢুকে পড়ে তাহলে রেহাই প[আবেননা। তাই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য জীবন বাজি রেখে লড়াই চালিয়ে যান।’ নভেম্বর মাসে জামায়াতের পক্ষ থেকে এক প্রচারপত্রে বলা হয়েছিলঃ ‘শত্রু আশেপাশেই রয়েছে, তাই খুব সতর্কতার সাথে কাজ চালাতে হবে।’ আলবদরের এক সমাবেশে জনৈক জামায়াত নেতা বলে, ‘আপনারা পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার জন্যেই কেবল যুদ্ধ করছেন না- এ যুদ্ধ ইসলামের । নমরুদদের হাত থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য আমাদের আমিরের (গোলাম আযম) নির্দেশ পালন করুন।’
বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডে গোলাম আযমের নেতৃত্বাধীন জামায়াত ও আলবদর তথা ইসলামী ছাত্র সংঘের ভূমিকার যদিও এটি অত্যন্ত আবছা বর্ণনা তবুও এর কোন জবাব প্রতিবেদনের প্রতিবাদলিপিতে জামায়াত নেতারা দিতে পারেনি। সেপ্টেম্বরে নীলনকশা পেশের পরপরই গোলাম আযম মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজে আল বদর হেড কোয়ার্টার এবং বুদ্ধিজীবীদের বন্দি ও নির্যাতন কেন্দ্রে আল বদর ও রাজাকারদের প্রশিক্ষণ শিবির পরিদর্শন করে সদলবলে। প্রশিক্ষণরত এই সব আল বদর ও বাছাই করা রাজাকাররাই পরবর্তীতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। ইতিপূর্বে বহুবার গোলাম আযম বাংলাদেশমনা বুদ্ধিজীবীদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল।
জামায়াতের প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত আমির মাওলান আব্বাস আলী খান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মূলত রাকাজার বাহিনীর কর্মকান্ডই পরিচালনা করত। ১৪ আগস্ট ‘আজাদী দিবস’এ জয়পুরহাটে রাজাকার ও পুলিশ বাহিনীর সম্মিলিত কুচকাওয়াজে সভাপতির ভাষণে সে বলে, ‘রাজাকাররা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমূলে ধ্বংস করে দিতে জান কোরবান করতে বদ্ধপরিকর।’
২২ সেপ্টেম্বর, মালেক মন্ত্রীসভার জামায়াতি সদস্যদের দেয়া আলীয়া মাদ্রাসার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সে বলে, ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমন হবে যা বিজ্ঞানী, দার্শনিক, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, অর্থনীতিবিদ ও একইসাথে খাঁটি মুসলমান তৈরি করবে, এর অন্যথা আমরা মেনে নেব না।’
২৪ সেপ্টেম্বর তেজগাঁ থানা শান্তি কমিটি প্রদত্ত সংবর্ধনা সভায় থানা শান্তি কমিটি প্রধান মাহবুবুর রহমান গুরহা পঠিত মানপত্রের জবাবে বক্তৃতা প্রসঙ্গে সে বলে, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের শ্লোগানে বাঙালিদের কি ফায়দা হয়েছে? পাকিস্তানকে অস্ত্রবলে ধ্বংস করার সকল চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ভারত এর আদর্শিক মূলে আঘাত হেনেছে। তাদের ঘৃণ্য চরদের মধ্যে আঞ্চলিক ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার শ্লোগান তুলেছে। এই সংকট মুহুর্তে প্রত্যেকটি পাকিস্তানি নাগরিককে

৪২৮
পাকিস্তানি ও মুসলমান হিসেবে চিন্তা করতে হবে।’ স্বাধীনতামনা বুদ্ধিজীবীদের প্রতি ইঙ্গিত করে এই সভায় সে বলে। ‘সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আবাসিক পুনর্বাসনের যেমন প্রয়োজন রয়েছে তেমনি আজ প্রয়োজন মানসিক পুনর্বাসনের ।’

২৫ সেপ্টেম্বরে ঢাকার হোটেল এম্পায়ারে ঢাকা শহর জামায়াত প্রদত্ত সংবর্ধনা সভায় গোলাম আযম বলে, ‘দেশের সাম্প্রতিক সংকট ও দুষ্কৃতিকারীদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের ফলে যেসব পাকিস্তানি প্রাণ হারিয়েছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোকই জামায়াতে ইসলামীর সাথে জড়িত। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান ও ইসলামকে এক ও অভিন্ন মনে করে। পাকিস্তান সারা বিশ্ব মুসলিমের ঘর। কাজেই পাকিস্তান যদি না থাকে, তাহলে জামায়াত কর্মীরা দুনিয়ায় বেঁচে থাকার কোন সার্থকতা দেখেনা। তাই জামায়াতের কর্মীরা জীবন বিপন্ন করে পাকিস্তানের অস্তিত্ব ও অখন্ডতা রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। শান্তি কমিটির মাধ্যমে রাজাকার ও আল বদরে লোক পাঠিয়ে এবং অন্যান্য উপায়ে জনসাধারণের মনে আস্থা ও নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টির কাজ করে যাচ্ছে এবং একই উদ্দেশ্যে দুজন সিনিয়র নেতাকে মন্ত্রিত্ব গ্রহনে বাধ্য করেছে।ইএই মন্ত্রিরা যেন জনগণের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সবকিছু করেন।’ প্রত্যুত্তরে আব্বাস আলী খান দলীয় প্রধানের নির্দেশ মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, ‘প্রতিটি কারবালার পরেই ইসলাম জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমাদের সামনে আরো কারবালা আছে। তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এই অগ্নীপরীক্ষায় দমে না গিয়ে নতুন করে উদ্দীপনা নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তি ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করতে হবে।’

১০ অক্টোবর বগুড়া জেলা শান্তিকমিটি ও জামায়াতে ইসলামী প্রদত্ত সংবর্ধনার জবাবে আব্বাস আলী ‘পাকিস্তানের মাটি থেকে দুষ্কৃতকারী ও ভারতীয় চরদের সম্পূর্ণভাবে উৎখাতের কাজে সহযোগিতা করার জন্য’ সমবেত রাজাকারদের আহবান জানায়।
১১ অক্টোবর ঢাকা বেতারে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে সে বলে, ‘পাঠাভ্যাসের সাথে সাথে তোমাদের এ চেতনাটি সদা জাগ্রত রাখতে হবে যে, যে কোন অবস্থায় তোমরা পূর্বসূরি ছাত্রদের আমানত এ পাকিস্তানের হেফাজত করবে এবং কিছুতেই তার খেয়ানত হতে দেবেনা।’
৮ নভেম্বর লাহোরে সে জামায়াতে ইসলামীর সংবর্ধনা সভায় বলে, ‘ভারত যদি আমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় তবে আমরা কলকাতা ও দিল্লীতে ঈদের নামায পড়ব। পূর্ব পাকিস্তানের রাজাকার বাহিনী ও আল্বদর বাহিনী প্রমাণ করে দিয়েছে যে মুসলমান মৃত্যুকে ভয় করেনা বরং আল্লাহকে ভয় করে।’
১৬ নভেম্বর চাঁদপুরের শান্তিকমিটির সভায় আব্বাস আলী খান শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের ভূয়সী প্রশংসা করে বলে, ‘পাকিস্তান চিরকাল অক্ষয় হয়ে টিকে থাকবেই। এর শত্রুদের সমূলে চিরতরে বিধ্বংস করা আপনাদের দ্বায়িত্ব।’

৪২৯

পাকবাহিনীর চূড়ান্ত পরাজিয়ের প্রাকলগ্নে ২৫ নভেম্বর এক বিবৃতিতে সে বলে, ‘এতে কোন সন্দেহ নেই যে তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর ছদ্মাবরণে পূর্ব পাকিস্তান কে গ্রাস করার হীন মতলবে ভারতীয় সেনাবাহিনী কয়েকটি ফ্রন্টে নির্লজ্জ হামলা শুরু করেছে। সশস্ত্র বাহিনী একাই কোন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারেনা। প্রিয় পাকিস্তানের মর্যাদা রক্ষার জন্য আমাদের জওয়ানদের হাতকে শক্তিশালী করা এ সময়ে প্রতিটি নাগরিকের দ্বায়িত্ব।’ স্বাধীনতামনা বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে বিবৃতিতে সে বলে, ‘রাষ্ট্রবিরোধী ও ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের কার্যকলাপের ব্যাপারে আপনাদের সতর্ক থাকতে হবে। এদের নির্মুল করার ব্যাপারে আপনারা সেনাবাহিনী ও শান্তিকমিটিকে সহায়তা করুন।’
বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু হবার মাত্র ৪ দিন আগে ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে এক ভাষণে আব্বাস আলী খান বলে, ‘বদরের যুদ্ধে মুসলিম সৈন্য সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন। বিপক্ষ কুরাইশদের সংখ্যা ছিল এক হাজার। . . . তেরো কোটি মানুষ এই পুন্যভূমি রক্ষার জন্য প্রতি মূহুর্তে প্রস্তুত আছে।’ … ‘গুজব রটনাকারী, বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী, হিন্দুস্থান অথবা কল্পনারাজ্যের তথাকথিত বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণাকারীরা আমাদের দুশমন। তাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখুন। প্রথম সুযোগেই তাদের ভেঙে দিন। আমাদের রাজাকার, বদর, শামস প্রভৃতি বাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশরক্ষার কাজে নেমে পড়ুন। . . . আল্লাহ তাআলা আমাদের মদদ করুন। আমিন। আল্লাহু আকবার। পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ।’
জামায়াতের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক একেএএম ইউসুফের সবচেয়ে বড় পরিচয় সে রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা। ‘৭১ এর মে মাসে খুলনার খান জাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে (ভূতের বাড়ি) ৯৬ জন জামায়াতকর্মী সমন্বয়ে সে সর্বপ্রথম রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলে। এই বাহিনীর নামকরণও করেছিল সে।
মালেক মন্ত্রীসভায় সদস্যপদ লাভের পর আলীয়া মাদ্রাসার সংবর্ধনা সভায় সে বলে, ‘আমাদের শত্রুরা আমাদের সকল ভাষাভাষী ও সকল অঞ্চলের মুসলমানদের এক জাতি মনে করেই আঘাত হানে। আর শত্রুদেরও আমরা যতই বন্ধু মনে করিনা কেনশত্রুরা আমাদের শত্রুই মনে করে।
১০ অক্টোবর খুলনার জনসভায় ভাষণদানকালে শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের ভূয়সী প্রশংসা করে সে বলে, ‘প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফর করে জনগণকে ভারত কর্তৃক সৃষ্ট তথাকথিত ‘বাংলাদেশ’ এর অসারতা বোঝাতে হবে। বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতকারী এবং নকশালীরা দেশের এই অংশে বিপর্যয় সৃষ্টিতে তৎপর রয়েছে, আপনাদের তাদের সমূলে উৎখাত করতে হবে।’
১২ অক্টোবর খুলনায় শান্তিও চাষী কল্যান সমিতির সংবর্ধনা সভায় সে

৪৩০

বলে, নদীপথে চলাচল নির্বিঘ্ন করার জন্য রাজাকার নিয়োগের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন রয়েছে।’ কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে সে বলে, ‘যারা মানুষের শান্তির ব্যাঘাত ঘটায় আল্লাহ তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন।’

২৬ অক্টোবর সিলেটের জনসভায় মওলানা ইউসুফ বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ আমাদের কিছুসংখ্যক তরুন ভারতীয় মিথ্যা প্রচারনায় বিভ্রান্ত হয়ে ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে ওপার গিয়েছে এবং ভারতীয় চরদের যোগসাজশে আমাদের ভূখন্ডের অভ্যন্তরে ঘৃন্য নাশকতামূলক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব নাশকতা মূলক কার্যকলাপ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে আমদের ভূখন্ড থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সমূলে উৎখাত করতে আপনারা গ্রাম-গঞ্জে আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ুন।’ মিত্রবাহিনিকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে মওলানা ইউসুফ বলে, ‘আমাদের উপর যদি কোন যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে বীর সেনাবাহিনী ও বীর রাজাকাররা অবশ্যই তার পাল্টা আঘাত করবে।’
৯ নভেম্বর ঝিনাইদহতে আলবদরদের সভায় ভাষণদান প্রসঙ্গে সে আলবদরদের, ‘ঘরের শত্রু সম্পর্কে সাবধান’ করে দেয়।
১২ নভেম্বর সাতক্ষীরার রাজাকার শিবির পরিদর্শনকালে এ কে এম ইউসুফ ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মুল করার কাজে সাতক্ষীরার রাজাকাররা মূল্যবান ভূমিকা পালন করেছে’ বলে উল্লেখ করে সে আশ্বাস দেয় যে রাজাকারদের চাকরীর ব্যবস্থা করা হবে।
২৮ নভেম্বর করাচিতে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে এ কে এম ইউসুফ বলে, ‘রাজাকাররা আমাদের বীর সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় হামলার মোকাবেলা করছেন।’ সে দুষ্কৃতকারীদের দমনের জন্য রাজাকারদের হাতে আরো আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দেবার দাবী জানায়। সে বলে, ‘বর্তমানে আলবদর ও আলসামস বাহিনীর সদস্যসংখ্যা প্রায় এক লাখে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া মুজাহিদ বাহিনীওতো রয়েছে। এরা সকলেই আমাদের সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সীমান্ত রক্ষার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। দুষ্কৃতকারী দমনে রাজাকাররা বিশেষ সাফল্যের পরিচয় দিচ্ছে এবং এ জন্যেই বর্তমানে দুষ্কৃতকারীদের কার্যকলাপে ভাটা পড়েছে।’
৪ ডিসেম্বর মওলানা ইউসুফ ঢাকায় বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর সাথে জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা অপরিহার্য। আমাদের রক্তের বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে হবে।’
৯ ডিসেম্বর ঢাকা কালেক্টরেট বিল্ডিংয়ে ঢাকা শহর শান্তি কমিটির সদস্য ও কর্মচারীদের এক সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে এ কে এম ইউসুফ ‘গুজব ও গুজব রটনাকারীদের কথায় বিশ্বাস না করে মাতৃভূমিকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে সকলকে

৪৩১

ঐক্যবদ্ধ হওয়ার’ আবেদন জানায়। সে আরো বলে, বর্তমানে আমাদের সকল বিভেদ ভূলে গিয়ে শত্রুকে বিধ্বংস করে দেবার জন্য এক কাতারে দাঁড়াতে হবে।’ বিমান আক্রমনের সময় ঢাকা শহরের জনগণ যে অসম সাহসিকতা প্রদর্শন করেছেন তার জন্য সে তাদের ভূয়সী প্রশংসা করে এবং শান্তি ও শৃংখলা রক্ষার জন্য তাদের স্থানীয় প্রশাসনের সাথে পূর্ণ সহযোগিতার আহবান জানায়।’
বিমান আক্রমনের অযুহাতে ঢাকায় বেলা দুইটা থেকে সারারাত কার্ফু জারি করে এবং ব্ল্যাকআউট করে যখন মানবজাতির লিখিত ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য হত্যাকান্ডের জন্য জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রসংঘের আলবদর নামধারী উন্মাদরা দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন তাদের প্রশংসা করে মওলানা ইউসুফ পৃষ্ঠ প্রদর্শনের প্রস্তুতি নেয়। ১১ ডিসেম্বর মালেক সরকার নিজেদের গা বাঁচানোর জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এবং হলিফ্যামিলি হাসপাতালকে নিরাপদ জোন হিসেবে ঘোষণা করে এখানে আশ্রয় গ্রহনকারী লোকদের অনিষ্ট করা জেনেভা কনভেনশন পরিপন্থী হবে বলে যুদ্ধরত উভয় পক্ষ কে স্মরণ করিয়ে দেয়। ‘বীর রাজাকার’, ‘বীর আলবদর’, ‘বীর আলশামস’ দের নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে ছেড়ে দিয়ে ১৪ তারিখ মালেক মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করে। এবং এই দুই নিরপেক্ষ জোনে আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে হোটেল ইন্টারকন কর্তৃপক্ষ এই বীর দল্পতিদের বিরুদ্ধে হোটেলের বিল পরিশোধ না করার জন্য মামলা দায়ের করার উদ্যোগ নিয়েছিল।
গোলাম আযম ও মওলানা আব্দুর রহিমসহ জামায়াতে ইসলামীর যে সমস্ত নেতা ১৬ ডিসেম্বরের আগেই দেশ ছেড়ে পালাতে পেরেছিল, তারা প্রথমত পাকিস্তানে গিয়ে মিলিত হয়। সেখানে প্রথমে গোলাম আযমের নেতৃত্বে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুওনরুদ্ধার সপ্তাহ’ পালন করা হয়। বাংলাদেশে পাকবাহিনির শোচনীয় পরাজয়ে পাকিস্তানে সেসময় ব্যাপক গণ অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। গোলাম আযমদের কার্যকলাপ তখন সেখানে প্রচন্ড প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

এসময় জামায়াতে ইসলামী দলের মূল নেতা মওলানা মওদুদী, গোলাম আযম, আব্দুর রহিম প্রমুখকে হজ প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে সৌদি আরবে পাঠাবার ব্যবস্থা করে। বিমানে আরোহন করার আগে মওলানা কাওসার নিয়াজী, মিয়া মমতাজ দৌলতানা প্রমুখ পাকিস্তানি নেতা গণহত্যার নায়ক এই সমস্ত ব্যক্তির পালিয়ে যাওয়ায় বাধ সাধেন। করাচি বিমানবন্দরে এদের বিমান থেকে নামিয়ে আটক করা হয়। মওলানা মওদুদীর হস্তক্ষেপে এদের পরে সৌদি আরব যাবার অনুমতি দেওয়া হয়।
গোলাম আযম কতিপয় অনুসারীকে নিয়ে সৌদি আরব যাবার পর মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে বিজ্ঞাপন দেয়। এই বিজ্ঞাপনে ‘পূর্ব পাকিস্তানে মসজিদ জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে’, ‘হিন্দুরা মুসলমানদের হত্যা করে

৪৩২

বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে’ ইত্যাদি ধরনের বক্তব্য উপস্থাপন করে ইসলাম রক্ষার জন্য অর্থ সাহায্য প্রদানের আহবান জানানো হয়। এ সময় জামায়াতীরা বিপুল অর্থ সংগ্রহ করে। আজও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য জাতীয় তহবিল সংগ্রহ কমিটি রয়েছে। গোলাম আযম অর্থ সংগ্রহ এবং বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণার জন্য এ সময় দুবাই, আবুধাবি, কুয়েত, বৈরুত সফর শেষে ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে লন্ডনে চলে যায়।
[৬৭] সংকলন

মুক্তিযুদ্ধ ও নেপাল
মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের মত জনমত গঠনের জন্য মুজিবনগর সরকার নেপালেও একটি প্রতিনিধি দল পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয়। আব্দুল মালেক উকিলের নেতৃত্বে দলের অন্য সদস্যগণ ছিলেন শ্রী সুবোধ চন্দ্র মিত্র ও আব্দুল মতিন তালুকদার এম এন এ। এ সময় নেপালের পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত দুজন বাঙালি কূটনীতিক মোস্তাফিজুর রহমান সিএসপি ও মোখলেস উদ্দীন সিএসপি গোপনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলকে সাহায্য করেন। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল নেপালের প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ঋষিকেশ সাহা ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রী থাপার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এছাড়া অনেক বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীর সাথে তাঁরা যোগাযোগ করেন। এসব পেশাজীবী বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি গঠন করে এর ব্যানারে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন করেন। নেপালের বেশ কয়েকটি সমাবেশে মালেক উকীলের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ আন্দোলনের পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। ঋষিকেশ সাহার মাধ্যমে প্রবাসী সরকারের কাগজপত্র, ছবি ও বিভিন্ন প্রচারপত্র নেপালের রাজদরবারে পৌঁছে দেওয়া হয়।
[৯৬] মো. ফায়েক উজ্জামান

মুক্তিযুদ্ধ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সম্পূর্ণ দর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ভৌগলিক দিক থেকে সম্পূর্ণ অবাস্তব একটি ধারনার উপর ভিত্তি করে এই সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে শুরু থেকে প্রগতিশীল ও সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিবর্গ বিশেষত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে একে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে মুসলিম শব্দটি তুলে দেওয়া হয়। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে

৪৩৩

আওয়ামী লীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুরু থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি।
১৯৫৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি পাকিস্তানের প্রধানম্নত্রী নিযুক্ত হন। পাকিস্তান গণ পরিষদের ৮০ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র ১৩ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের সদস্য। রিপাবলিকান দলের সমর্থন নিয়ে সোহরাওয়ার্দি সরকার গঠন করেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অংশের সঙ্গে বিশেষত মওলানা ভাসানীর সঙ্গে তার মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৯৫৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কাগমারীতে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন আহবান করেন। এই সম্মেলনে পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সোহরাওয়ার্দির দ্বিমত দেখা দেয়।

১৯৫৭ সালের ২৫ ও ২৬ জুলাই মওলানা ভাসানী নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন আহবান করেন ঢাকার সদরঘাটস্থ ‘রূপমহল’ সিনেমাহলে। নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক সম্মেলনে কর্মী সম্মেলনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপই পাকিস্তানের বৃহত্তম অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল।

বৃহত্তম অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট প্রথা বাতিল, পূর্ব পাকিস্তানে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দান, জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং পঞ্চসালা নীতির ভিত্তিতে স্বাধীন জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি কায়েমের লক্ষ্যে দুর্বার গণ আন্দোলনের ডাক দেয়। এই অবস্থায় ১৯৫৮ সালে সমগ্র পাকিস্তানে শামরিক শাসন জারি হয়। সামরিক সরকার রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণার পাশাপাশি ন্যাপ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালায়। ফলে অধ্যাপক মুজাফফরসহ জনপ্রিয় ন্যাপ নেতৃবৃন্দকে আত্মগোপন করতে হয়। শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে প্রচন্ড ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার লক্ষ্যে ন্যাপ, আওয়ামী লীগ সহ সমমনা দলগুলোর সমন্বয়ে ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট সংক্ষেপে এনডিএল গঠিত হল। ১৯৬৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধী দল আইয়ুব খানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্যে মিস ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে প্রচারণা চালায়।
১৯৬৬ সালের ৪, ৫, ৬, ও ৭ জুনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় ন্যাপ ১৪ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করে। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ ছয়দফা কর্মসূচী ঘোষণা করলে ন্যাপ আওয়ামী লীগের ছয়দফা কর্মসূচি সমর্থন করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানান।

৪৩৪

সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের আদর্শগত মতপার্থক্য প্রকাশ্য রূপ নিলে ১৯৬৭ সালে ন্যাপ ভাঙন ধরে। ন্যাপের বৃহত্তর অংশ ওয়ালী খানের নেতৃত্বে রিকুইজিশন নোটিশ দিয়ে ৬ দফার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। অন্যদিকে মওলানা ভাসানী ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর রংপুরের জনসভায় প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচীর বিরোধীতা করেন। ফলে ন্যাপের ভাঙন চূড়ান্ত রূপ নেয়।
১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারী পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা প্রকাশ করে। ন্যাপ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার তীব্র বিরোধীতা করে এবং তা প্রত্যাহারের দাবী জানায়।
১৯৬৯ সালের জানুয়ারী মাসে ন্যাপসহ ৮টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয়। এই সময় সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা কর্মসীচিতে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ২৯ জানুয়ারী পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মুজাফফর আহমদকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ আইয়ুব খানের পতনের পর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহন করে।
১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ ইয়াহিয়া খান লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার জারি করলে ন্যাপ তা প্রত্যাখান করে। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে নির্বাচন শুরু হলে সে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ন্যাপ সমগ্র পাকিস্তানে ৭ টি আসনে বিজয়ী হয় এবং প্রাদেশিক নির্বাচনে বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হবার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্টের অধিবেশন স্থগিত রাখায় ন্যাপ এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
৭ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হোসেন স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ১৭ দফা প্রস্তাব পেশ করা হয়।
১৪ মার্চ পাকিস্তান ন্যাপ সভাপতি খান আব্দুল ওয়ালী খান ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করেন। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর ও অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবানের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিকট দাবি জানান।
২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী রাতের আঁধারে নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালি জাতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ সহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ আত্মগোপন করে। পরবর্তী দুইদিন কারফিউ থাকায় তারা একত্রিত হতে পারেননি। ২৮ মার্চ কারফিউ প্রত্যাহার হলে ন্যাপ ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে ডেমরায় সমবেত হন। পরবর্তীতে তারা নিজেদের

৪৩৫

আরো সংগঠিত করার জন্য আরও পিছু হটে নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জে চলে আসেন। ১ এপ্রিল তারা আসেন শিবিপুরে। শিবিপুরে থাকাকালীন মাধবদিতে তাদের সঙ্গে পাকবাহিনির একটি মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে পাক বাহিনির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত শিবপুরে অবস্থান কালে ন্যাপ নেতৃবৃন্দ দুবলার চরে দুটি প্রশিক্ষণ শিবির চালু করে। ১৭ এপ্রিল তারা আখাউড়ার দিকে চলে আসেন এবং পরবর্তীতে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন।
পরবর্তীতে ন্যাপের উদ্যোগে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে একটি পৃথক গেরিলা বাহিনী গড়ে ওঠে, যার অন্যতম নেতা ছিলেন ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ ভট্টাচার্য। ভারতের আসামের তেজপুর ক্যাম্পে এই গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। এই গেরিলা বাহিনী দেশের অভ্যন্তরে অনেকগুলো সফল অপারেশন পরিচালনা করে। এই বাহিনীর অসংখ্য সফল অপারেশনের একটি ‘বেতিয়ারা অপারেশন’, সীমান্ত এলাকায় ক্যাম্প স্থাপনের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরেও ন্যাপ নেতাকর্মীরা পৃথক বাহিনী গঠন করে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি টেকেরহাটে ক্যাম্প স্থাপন করে আলাদাভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।

ন্যাপ সভাপতি মুজাফফর আহমদ এবং অন্যান্য ন্যাপ নেতা বিভিন্ন সময় সোভিয়ের ইউনিয়নসহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশ সফর করেন। এছাড়া ন্যাপ সভাপতি ও কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাফফর আহমদ ও মণি সিংহ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ভারতের সাহায্য দানে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা লাভের জন্য উদ্যোগী হতে মিসেস গান্ধীকে উৎসাহিত করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য মুজিবনগর থেকে ন্যাপ সাপ্তাহিক ‘নতুন বাংলা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে। ভারতের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর সমর্থন আদায়ে ন্যাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঐ বছর বুদাপেস্টে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলনে ন্যাপ প্রতিনিধি দেওয়ান মাহবুব আলী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মনোযোগ আকর্ষণ করে জোরালো বক্তব্য প্রদান করেন।
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের অন্যতম নেতা হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেন অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ।
বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম আরো সংহত ও শক্তিশালী করা ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১২ সেপ্টেম্বর মুজিবনগর সরকারের একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। যার অন্যতম সদস্য ছিলেন ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ। এভাবেই ন্যাপ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী প্রধান দল আওয়ামী লীগের পাশাপাশি থেকে মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম সহায়ক দল হিসেবে

৪৩৬

কাজ করেছে।
[৫৮৮] মো. সালেহ আতাহার খান

মুক্তিযুদ্ধ ও পশ্চিমা সংবাদপত্র
১৯৬৯ এবং ১৯৭০ বাংলাদেশের জন্য একটা তোলপাড় করা সময়। তারপর ১৯৭১ এর জানুয়ারি থেকে মার্চের রাজনীতি ক্লাইমেক্সে চড়ে যাওয়া, মার্চের শেষ দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ ও ডিসেম্বরের বিজয় থেকে ‘৭২ এর ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ঘটনাবহুল সময়। এই পুরো সময়টার একটা পূর্ণাঙ্গ ছবি ফুটে ওঠে পশ্চিমা সাংবাদিকদের লেখা ‘টাইমস’, ‘গার্ডিয়ান’, ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ” এবং অন্যান্য পত্রিকার ফিচারগুলোতে। সে সময় সংবাদপত্রে প্রকাশিত লেখাগুলোর একটি বিশেষত্ব আছে। আধুনিক জগতের পটভূমিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মত অশিক্ষিত অনুন্নত গরীব দেশে যেখানে বাৎসরিক একটা সাইক্লোন বা বন্যা ছাড়া আর বিশেষ কিছু ঘটে না- সেখানে রাজনীতির খেলায় কে জিতল বা হারল আর কাকে বেধড়ক মার দিল, এসব নিয়ে বিশ্ব জনগণের বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হবার কথা নয়। বরং গরীব কোন অনাত্মীয়ের বাড়িতে অসুখ হলে যেমন সামান্য আহা উহু করে লোকে পার করে দেয়, বিশ্ব জনমত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিপদে তেমনটা করলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু ছিলনা। কিন্তু তা না করে বিশ্ব জনমত পাকি কসাইগিরির বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ জানিয়েছে। বেশ কিছু পশ্চিমা সরকার পাকিস্তানকে সাহায্য সহযোগিতা দেওয়া বন্ধ করেছে। বাংলাদেশের অত্যাচারিত জনগনকে দু হাতে সাহায্য করেছে। আর এসব যে সম্ভব হয়েছিল তার প্রধান কারণ হচ্ছে পশ্চিমা সংবাদপত্র ও পত্রিকা। কিছু আত্মনিবেদিত সাংবাদিক এখানকার আসল খবরগুলো এত পরিপূর্ণভাবে এত পরিপূর্ণভাবে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিল যে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিলনা। সামগ্রিকভাবে লেখাগুলো পড়ার সুযোগ সে সময় কম লোকেরই হয়ে থাকবে। পরবর্তীকালে সে সম্ভাবনা আর ছিলনা বললেই চলে।

নিজেকে জানা বা নিজের সম্পর্কে জানা একটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। নিজের চোখ, কান, স্পর্শ দিয়ে বাইরের দুনিয়াটা জানা যায়। নিজেকে জানতে হলে দুনিয়ার চোখ দিয়ে দেখতে হবে। বাংলাদেশে মুক্তিসংগ্রাম, ১৯৭১ এর যুদ্ধে দৈনন্দিন ঘটনাপ্রবাহ এই সময়ের দুনিয়ার চোখ দিয়ে দেখা প্রয়োজন। এর মধ্য দিয়ে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সময়কালের ঘটনাশ্রয় ইতিহাসে ধরা দেবে। এই সময় বহির্বিশ্বে প্রকাশিত রিপোর্ট গুলোর প্রায় সবগুলো প্রখ্যাত সাংবাদিক, চিত্রগ্রাহক ও রাজনৈতিক কলামিস্ট দ্বারা রচিত। এরা তৎকালীন পাকিস্তানে কোন রাজনৈতিক গোষ্ঠীভুক্ত বা নির্দিষ্ট মতাবলম্বী ছিলনা। কাজেই তাদের রিপোর্টগুলো সম্পূর্ণভাবে নৈর্ব্যক্তিক ও নিরপেক্ষ বলা যেতে পারে। কালিক ধারাবাহিকতার ফলে একটি

৪৩৭

ঐতিহাসিক পারম্পর্য লক্ষ করা যাবে।
১৯৬৯-১৯৭০
রেহমান সোবহান ২৪ অক্টোবর ১৯৬৯ সালে ‘নিউ স্টেটসম্যান’ এ প্রকাশিত ‘পাকিস্তান ঢাকনির নিচে ফুটছে’ প্রবন্ধে অনেকটা ভবিষ্যদ্বানীর মত বলেছেন, ‘নির্বাচন হওয়ামাত্র স্বায়ত্তশাসন নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম (পাকিস্তান) এর মধ্যে মেরুকরণ দেখা দেবে।’
‘৬৯ এর ৭ ডিসেম্বর ডেভড ম্যাক্সওয়েল ‘সানডে টাইমস’ এ লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা বলে আসছেন যে সাধারণ নির্বাচন হলে সমস্যা শেষ হবে। ইয়াহিয়া খান এখন নেতাদের সে সুযোগ দিয়ে দেখতে চাচ্ছেন; ওষুধে কতোটা কাজ করে। এ মাসে পূর্ব পাকিস্তানে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার কারনে সেনাবাহিনীকে বর্তমানে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি বাঙালী জাতীয়তাবাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। এবার জনতার আক্রোশের মুখে পড়েছে বিহারিরা, (ভারত) হিন্দুদের কচুকাটা হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় খুঁজছিল। এবার অবশ্য তারা মার খাচ্ছে তাদের ভাষা (উর্দু) এবং জন্মস্থান (বিহার) ভিন্ন জায়গায় বলে। মুসলমান পরিচয় এবার তাদের বাঁচাতে পারেনি।’ ‘৬৯ থেকে ৭০ এর লেখাগুলোতে ইয়াহিয়া খানের প্রশংসা করতে দেখা যায় কিছু বিদেশী সাংবাদিককে। ১০ জানুয়ারি ‘৭০ সালে ডেভিড লোসাক ‘ডেইলী টেলিগ্রাফ’ এ লিখেছেন ‘সংসদীয় গণতন্ত্র দেয়ার পথে’ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিরল সাহস ও সততার পরিচয় দিয়েছেন। যদিও তের কোটি পাকিস্তানী ও বিদেশী পর্যবেক্ষক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কথায় বিশ্বাস করেছিলেন কিনা সন্দেহ, কিন্তু এখনতো পুরো ইলেকশনের টাইমটেবিল পর্যন্ত দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাথাপিছু এক ভোট পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম হবে। নিঃসন্দেহে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সদিচ্ছার অভাব নেই । তবে পাকিস্তানের রাজনীতিকরা এই বিরল সুযোগ যে খুব একটা কাজে লাগাতে পারবেন তাদের কাজে কর্মে তা মনে হয়না। তারা নিজেদের ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে কামড়াকামড়ি করছে। অথবা আঞ্চলিক ব্যাপারগুলো নিয়েই মত্ত আছে। জাতীয় স্বার্থ গুলো নিয়ে কেউ ভাবছে না। বেসামরিক সরকার শেষ পর্যন্ত হলে প্রধানমন্ত্রী হবার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা পূর্ব পাকিস্তানের দল আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের। কিন্তু তার লক্ষ্য পূর্ব পাকিস্তানের জন্য অটোনমি।’

‘দেশের দুই অংশের ভিতর মিলের চেয়ে প্রভেদটাই বেশি। দুই অংশের মাঝখানে মারমুখী ভারত। পূর্বকে এতদিন বঞ্চনা করা হয়েছে। এখন দাবী আসছে পুরো অটোনমির। কেন্দ্রের হাতে শুধু থাকবে পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা। ২৮ নভেম্বর জেনারেল ইয়াহিয়া মেনে নিয়েছিল যে, দেশের দুই অংশ নিজেরাই নিজেদের উন্নতির নিয়ন্ত্রক হতে পারে। শুধু নিশ্চিত হতে হবে যেন কেন্দ্রীয় সরকারের কাজে

৪৩৮

বাধা না আসে। . . . ‘তবে পাকিস্তান সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে পা বাড়ালেও ওটা করতে একজন শক্ত মানুষের প্রয়োজন হয়েছে। … হয়ত দেখা যাবে শেষ পর্যন্ত এই শক্ত মানুষের প্রয়োজন দেশ চালাবার জন্য থেকেই যাবে।’

২০ ফেব্রুয়ারি ‘৭০ এ রেহমান সোবহান ‘নিউ স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় লিখেছেন, ‘পূর্বাঞ্চলের প্রত্যেকটি নেতা আজ নিজের নিজের প্রতিশ্রুতিতে বন্দী। ১৯৭১ সালে কি হবে এ নিয়ে কেউ আর কোন কথা বলতে চাচ্ছেননা।’

৭ এপ্রিল ‘৭০ এ ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ এ গোলাম মালিকের ভাষ্য, ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহয়ার গত এক বছরের রেকর্ড সব ব্যাপারেই লক্ষ্য করার মত। তিনি জাতিকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি গুলো একে একে পূরণ করে চলেছেন।’ গত ডিসেম্বর, ১৯৭০ এর নির্বাচনের ঠিক আগ মুহুর্তে গ্যাভিন ইয়ং ‘অবজারভার’ পত্রিকায় লিখেছেন, ‘নির্বাচনে জেতা মুজিবের জন্য কোন সমস্যা নয়। তার সমস্যা জিতে তারপর কি করবে। বহু প্রতীক্ষিত রাজনৈতিক স্বাধীনতায় নেতারা হয়ত আলাদা হয়ে যাওয়া বা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া অথবা এ দুটোই বেছে নিতে পারে।’ ‘নির্বাচনে তিনশ সিটের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২ সিটের ভিতর ১৬০ সিটে জিতে আওয়ামী লিগ পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩৮ সিটের একটাও না জিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেল। অর্থাৎ সসদে সরকার গঠন করবে তারা।’

জানুয়ারি-জুন, ১৯৭১
এই পটভূমিতে ২৩ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটা অস্থির সময়। এই সময়ের মধ্যে ঘটনার তীব্রতা পাকিস্তানকে ভেঙে যাওয়ার মত অবস্থায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে ফিরে আসা আর কারো পক্ষে সম্ভব ছিলনা। এ সময়ের প্রধান চরিত্র গুলো ছিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া, সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, এবং দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। এদের কার্যকলাপ এবং অপ্রতিরোধ্য গতিতে ঘটনাপ্রবাহের চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে অর্থাৎ পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিপত্তি ও বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রমের বিবরণ পাওয়া যায় এই সময়কার লেখা প্রবন্ধগুলোতে।
২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ তারিখে ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় এস আর ঘোরি লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের যাতে কলোনী হয়ে বেঁচে থাকতে না হয়, যাতে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হয়ে মানসম্মান ও স্বাধীনতা নিয়ে তারা বেঁচে থাকতে পারে সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনে পূর্ব পাকিস্তানিরা জীবন দেবে।” “East Pakistanis, he said, would lay down their lives so that our future generations do not have to live in a colony but can live in freedom and dignity as free citizens of a free country.”

১০ মার্চ ‘দি টাইমস’ এ জেড এইচ যাইদি লিখেছেন, “There are certain similarities between the pre-1947 Pakistan movement and East

৪৩৯

Pakistan’s demands. Let us not forget that in 1947 the Constituent Assembly had also been boycotted by the Muslim League- a party which spearheaded the Pakistan movement. Will history repeat itself?”
১২ মার্চ ‘দি স্টেটম্যান’ এ ফ্রানসিস হোপ লিখেছেন, “Yahia Khan will find he has more than East Pakistan’s original six points to consider.”
পিটার হ্যাজেলহার্স্ট ২১ মার্চ ‘দি টাইমস’ এ লিখেছেন, ১৯৬৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথমবারের মত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান রাজনীতিবিদদের বিশেষ করে শেখ মুজিবের উপর ক্ষেপে উঠেছিলেন। ‘আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, যা কিছুই ঘটুক না কেন, আমি যতক্ষণ পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং রাষ্ট্রপ্রধান আছি, আমি নিশ্চিত করব যেন পাকিস্তান সম্পূর্ণ এবং নিশ্চিত ভাবে অটুট থাকে। দেশকে অক্ষত থাকার ব্যাপারে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের লাখ লাখ মানুষের কাছে আমি দায়বদ্ধ। দুয়েকজন লোক লক্ষকোটি নিরপরাধ পাকিস্তানির আবাসভূমি পাকিস্তানকে ধ্বংস করে দেবে সেটা হতে দেবনা।’
২২ মার্চ ‘দি টাইমস’এ পিটার হ্যাজেলহার্টস লিখেছেন, ‘ভুট্টোর কারজাসিতে ২৩ মার্চ সংসদ হবার কথা ছিল, সেটা পন্ড হয়ে যাওয়ার পর ভুট্টোর লিফট (ঢাকাস্থ ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে) আটকে গিয়েছিল। ক্রোধান্বিত জনতা রাজনৈতিক জারজ লেখা পোস্টার দেখাচ্ছিল।” ২৫ মার্চ তারিখে পল মার্টিন লিখেছেন ‘দি টাইমসে’-এ “ঢাকা বিশ্ববিদযালয়ে চরমপন্থী ছাত্ররা রাইফেল ট্রেনিং নিচ্ছে। পরে জানা যায় এগুলো সব UOTC র ডামি রাইফেল। ল্যাবরেটরি থেকে চুরি করা কেমিক্যাল দিয়ে ছাত্ররা ঘরে তৈরি বোমা, পেট্রোল বোমা ব্যাবহার করছে। সে সময় যে কোন বাঞালির সাথে কথা বলতে গেলে তাদের ‘স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ প্রসঙ্গ’ এসে পড়ত। মোটামুটি মধ্যপন্থী বাংলা ভাষাভাষীরাও স্বাধীনতার কথা ভাবছিল, রাজনৈতিক ফয়সালার মাধ্যমে না হলে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে।”

মার্টিন অ্যাডনি ২৬ তারিখে ‘দি গার্ডিয়ান’এ লিখেছেন, ‘Bengali spring ended at 11.30 on Thursday night-বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে এগারোটায় বাংলা বসন্তকাল শেষ হয়ে গেছে। এ সংবাদ মার্টিন অ্যাডনি শুক্রবার (২৬ মার্চ) লিখে দেশের বাইরে থেকে কেবল করে পাঠিয়েছিলেন ২৭ মার্চ। ২৫ মার্চের কাল রাতে পাকিস্তান আর্মি ঠিক কি করেছিল এ ব্যাপারে তাতক্ষণিকভাবে সংবাদমাধ্যম গুলোতে বিভ্রান্তি ছিল। অ্যাডনি বলেছেন, ‘আর্মির তিনটি মেইন টার্গেট ছিলঃ ছাত্র, প্যারামিলিটারি ও বুদ্ধিজীবী। যশোর আওয়ামী লীগের এক এমপি ছাড়া আর কোন আওয়ামী লীগ নেতা ধরা পড়েনি বা মারা যায়নি।’
২৬ তারিখে পাকিস্তানিরা বিদেশী সাংবাদিক সাইমন ড্রিং কে ঢাকা থেকে বহিষ্কার করে। তিনি আড়ালে চলে যেতে পেরেছিলেন এবং অনেক ঘটনা নিজে

৪৪০

প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘রাত একটার কিছু আগে শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। রাত ১.১০ মিনিটে আর্মড কার আর ট্রাকের বহর মুজিবকে উঠিয়ে নিয়েছে, সঙ্গে নেয় তিনজন চাকর, একজন সহকারী ও একজন দেহরক্ষী।” ২৭ মার্চ ‘দি টাইমস’ অনুযায়ী বেতারে “শেখ মুজিবুর রহমান আজ রাতে (২৬ মার্চ) পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা করেন।’ -রয়টার্স ইউপিআই এবং এপি দেয় এই তথ্য। অর্থাৎ তথ্যদাতারা ২৬ মার্চ মধ্যরাতে এই তথ্য ল্যাভ করেন। বিবৃতি সম্বন্ধে বলা হয়, “The Broadcast was not made by the Sheikh himself but by an unidentified announcer. The broadcast said that troops of the East Bengal Regiment the East Pakistan Rifles, and the entire police force had surrounded West Pakistan troops in Chittagong, Comilla, Sylhet, Jessore, Barisal and Khulna and that heavy fighting was continuing.”

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মুজিব ও তার দল সম্পর্কে বলে, “They want EP to break awaycompletely from Pakistan.” ২৭ মার্চেই ‘টাইমস’এ পল মার্টিন লিখেছেন, “Sheikh Mujibur Rahman voices the people of Bengal. “Let the army come and take me to prison.” He scoffed in a recent interview with me at his home in Dacca. “Look for yourself. I have nobody guarding me. Indeed, they can kill my family, but let them know that they cannot kill the spirit of 76 million have shown it. Guns will never silence the voice of the people of Bengal.”

২৯ মার্চ নর্দান ‘ইকো’ বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে ২৬ মার্চ মধ্যরাতের কথা লিখেছে, “At one a.m. a phone call to Sheikh Mujibur’s home established he was there but half an hour later the line was dead.”
Liberation Force মুক্তিবাহিনীর উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় পিটার হ্যাজেলহার্স্ট এর ৫ এপ্রিলের লেখায় ‘দি টাইমস’এ। আবার ৬ এপ্রিল হ্যাজেলহার্স্ট লিখেছেন বাঙালি রিফিউজিদের কথা, “Thousand of helpless Muslim refugees who settled in Bengal at the of partition are reported to have been massacared by angry Bengalis in East Pakistan during the past week.”

১ মে ‘দি গার্ডিয়ান’এ বেরোয় মার্টিন উলাকোট এর লেখা, চুয়াডাঙা, কুষ্টিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিবরণ। সেখানে লিখেছেন, পাকিস্তানিরা হয়ত সেনানিবাসগুলো ধরে রাখতে পারবে যদিও মনের জোরের সমস্যা বাড়ছে। তবে ছোট ছোট শহর ধরে রাখতে চেষ্টা করলে কুষ্টিয়ার মত পরাজয়ের সংখ্যা বাড়বে।”
পিটার হ্যাজেলহার্স্ট ‘দি টাইমস’এ ত্রিপুরা ঘুরে মুক্তিযুদ্ধ যে চলছে তা অনুভব করেছেন। যদিও বিদেশীদের যুদ্ধ অঞ্চলে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ১৯ মে তিনি

৪৪১

লিখেছেন, “However army despatch riders were seen passing through the town and reliable Indian journalists chain that Indian troops are training member of the East Bengali Liberation Front in camps nearby. The border situation on the Tripura side of East Bengal is far more tense than at the western end.”

অনেকের মতে মুক্তিযুদ্ধ যে হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল অনেকটা চাপিয়ে দেবার মত সে কথা লিখেছে ‘ইকোনোমিস্ট’ ১২ জুন, “But there was no planned uprising. Many of the troops and police were caught, disarmed and shot before they knew what was going on.”

এরপর অ্যান্থনী মাস্কারানহাস তাঁর দেখা পাকিস্তানি বর্বরতার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা লেখেন, ‘জেনোসাইড’ শিরোনামে ১৩ জুন ‘সানডে টাইমস’এ পাকিস্তানি জেনারেল শওকত রেজা দম্ভ করে বলেছে, “আমরা একটা কাজ হাতে নিয়েছি এবং শেষ করে ছাড়ব। শেষ যখন করব তারপর আর কোনদিন এমন অপারেশন প্রয়োজন হবেনা।” এই বিশেষ রিপোর্টটি সমস্ত বিশ্ববিবেক কে প্রচন্ডভাবে নাড়া দেয়। এ কারনে এই রিপোর্ট টি বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। মাসকারানহাস বলেন, “আর্মি (পাক আর্মি) প্রচন্ড মার খেয়েছে। শোনা যাচ্ছে যে ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে যত না সেনা মারা গিয়েছিল, তার চেয়ে বেশি সৈন্য ইতিমধ্যেই মারা পড়েছে।” “The army has already taken a terrible role in dead and injured. It was privately said in Dacca that more officers have been killed and that the casualty list in East Bengal already exceeds the losses in the India-Pakistan war of September, 1965.”

এই রিপোর্টের গুরুত্বের কারণে এর থেকে কিছু বিবরণ এখানে তুলে ধরা হলঃ
আমি মানুষের আর্তনাদ শুনেছি যাদের লাঠিপেটা করে হত্যা করা হয়। আমি দেখেছি ট্রাকভর্তি শিকার মানুষ এবং তাদের সাহায্য করতে যারা এগিয়ে এসেছিল তাদের ধরতে কিভাবে কারফিউ এর অন্ধকারের মধ্যে চিরতরে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। আমি সে নৃশংসতার সাক্ষ্য বহন করছি যাতে সেনাদল আরো জ্বালাও অভিযানে বিদোহীদের বিতাড়নের পর শহর ও গ্রামাঞ্চলে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকে লুন্ঠন ও নিধন করেছে। আমি দেখেছি গ্রামাঞ্চলে শাস্তি পেতে ও দন্ডভোগে বিধ্বস্ত হতে। রাতে অফিসার্স মেসে আমি শুনে বিস্মিত হয়েছি যে সাহসী শিকারিরা যেরূপ গর্বভরে দিনের শিকার সম্পর্কে আলোচনা করে সেভাবেই তারা আলাপ করছে ‘তুমি কতজন পেলে?’ উত্তরগুলো আমার স্মৃতিতে আজও গভীর আঘাত হানে।”
“অথবা ধরুন মেজর বশিরের কথা। সে নিম্ন র‍্যাংক থেকে উপরে উঠেছেন। সে কুমিল্লায় নবম ডিভিশনের এস এস ও। গর্ব করার মত তার

৪৪২

বডিকাউন্ট ২৮। যা ঘটেছে তার জন্য তার নিজের যুক্তি রয়েছে। সে এক কাপ সবুজ চা পানরত অবস্থায় আমাকে জানালো, ‘এটা হচ্ছে শুদ্ধ এবং অশুদ্ধের ভিতর যুদ্ধ।এখানকার লোকজনের মুসলমান নাম থাকতে পারে, তারা তাদের মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিতেও পারে কিন্তু তারা আসলে মনে প্রাণে হিন্দু। তুমি এটা বিশ্বাসই করতে পারবেনা যে, ক্যান্টনমেন্ট মসজিদের ঈমাম শুক্রবার প্রার্থনায় ফতোয়া দিয়েছে যে, পাশ্চিম পাকিস্তানিদের হত্যা করলে জান্নাতবাস হবে। আমরা এ সমস্ত জারজকে পৃথক করে ফেলেছি এবং বাকিদেরও পৃথক করছি। এরপর যারা থাকবে তারাই হবে খাঁটি মুসলিম। এমনকি আমরা তাদের উর্দুও শেখাব।”

“আমরা রাস্তার এক কোনে এসে থামলাম এবং দেখলাম এক কনভয় ট্রাক একটি মসজিদের বহিরাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আছে। আমি গুনে দেখলাম যুদ্ধের পোষাক পরা জওয়ান ভর্তি ৭ ট্রাক। এদের সম্মুখভাগে একটি জীপ। রাস্তার ধারে লাইন করা শতাধিক দোকানের বন্ধ দরজা দুজন লোক ভাঙার চেষ্টা করছে। তৃতীয়জন তাদের কাজের তদারক করছে। দুটি কুড়ালের আঘাতে কাঠের দরজা ভেঙে পড়তে শুরু করেছে এমন সময় মেজর রাঠোরের টয়োটা গাড়ি সেখানে এসে থামল। ‘তোমরা এসব কি করছ?’
তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা জন যে ভাঙার কাজ তদারক করছিল ঘুরে আমাদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল ‘আরে মোটা নাকি?’ আমরা, ‘তুমি কি মনে করেছ?’ বলায় গলার স্বর চিনতে পেরে রাঠোর তরমুজ হাসি হাসল। সে আমাকে বলল, এ হচ্ছে তার পুরনো বন্ধু ইফতি। ১২ তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রাইফেলের মেজর ইফতিখার।
রাঠোরঃ ‘আমি মনে করেছি কারা হয়ত লুটতরাজ করছে।’
ইফতিখারঃ ‘লুটতরাজ না, আমরা কেবল হত্যা করছি এবং সব জ্বালিয়ে দিচ্ছি।
সে হাত উঠিয়ে দোকানে ঢুকতে ঢুকতে বলল- তারা এসব মালপত্র ধ্বংস করে দেবে।
রাঠোরঃ তুমি কতজন পেয়েছ?
ইফতিখারঃ একটু লাজুকভাবে হাসল।
রাঠোরঃ বল, কতজন পেয়েছ?
ইফতিখারঃ মাত্র ১২ জন। আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদের ভাগ্য ভাল যার জন্য তাদের পেয়ে গেছি। আমরা তাদের ধরতেই পারতাম না, যদি আমি আমার লকদের পিছন দিক দিয়ে পাঠিয়ে না দিতাম।’
ইফতিখার তাড়াতাড়ি আগুণ জ্বালিয়ে দিল। জ্বলন্ত চটের থলিগুলো দোকানের এক কোনে ছুড়ে দিল, তারপর কাপড়ের স্তুপেও কিছু কিছু ছুড়ে দিল। দোকানটি জ্বলতে শুরু করল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা লক্ষ্য করলাম, আগুন দরজার দিকে এগিয়ে এসে পাশের তেলের দোকানে লেগে তা চতুর্দিকে ছড়িয়ে

৪৪৩

পড়ল। অন্ধকার হয়ে আসছে বলে রাঠোর কে একটু চিন্তিত মনে হল। তারপর আমরা গাড়ি চালিয়ে অগ্রসর হলাম। পরদিন যখন মেজর ইফতিখারের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হলসে উল্লাস ভরে বলল “আমি মাত্র ৬০ টি দোকাম জ্বালিয়েছি। ওইসময় বৃষ্টি না এলে আমরা সবগুলোই জ্বালিয়ে দিতে পারতাম।”
“১৭ এপ্রিল চাঁদপুর একেবারে বিরাণ মরুভূমি। কোন লোক নাই, কোন নৌকা নেই। সর্ব সাকুল্যে এক শতাংশ লোক রয়ে গেছে। বাদবাকি সকলেই বিশেষ করে হিন্দুরা যারা জনসংখ্যায় প্রায় অর্ধেক, পালিয়ে গেছে। তারা বাড়িতে, দোকানে, ছাদে পাকিস্তানি ফ্ল্যাগ রেখেই চলে গেছে। দেখে মনে হচ্ছিল যেন লোকজন ছাড়াই কোন জাতীয় দিবস উদযাপন চলছে। এটা উড়ানো হয়েছে শিকারির দৃষ্টিকে নিবদ্ধ রাখার জন্য। কেবল সামান্যতম নিরাপত্তার জন্য ঐ পতাকাকে ব্যবহার করা হয়। যে কনভাবেই হোক, এমন একটি কথা রটে গিয়েছিল যে, আর্মিরা কোন বাড়ি বা স্থাপনাতে পাকিস্তানি ফ্ল্যাগ না দেখলে সেটাকে বৈরি বলে মনে করে এবং তা ধ্বংস করে দেয়।

“চাঁদপুরের মত অবস্থার পুনরাবৃত্তি হাজীগঞ্জ, মুদাফফরগঞ্জ, কসবা এবং ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়াতে ভুতুড়ে শহরগুলোতে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে।”
‘লাকসামে অনুরূপ প্রতিক্রিয়ার উদাহরণ তা হল হীনভাবে বশ্যতা স্বীকার। ওই স্থানের দ্বায়িত্বে থাকা মেজর থানাতে ক্যাম্প করেছে এবং সেখানেই মেজর রাঠোর আমাদের নিয়ে গেল। আমার সহকর্মী একজন পাকিস্তানি টিভি ক্যামেরাম্যান। ‘লাকসামে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে’ এই মর্মে একটি প্রচারমূলক ফিল্ম তৈরি করবে এবং সবসময় তা টিভিতে প্রচার করে দেখানো হবে মিছিলকে অভ্যর্থনা জানানো হচ্ছে এবং শান্তি সভা হচ্ছে। আমি নির্বাক হয়ে গেলাম, সে কিভাবে এ ছবি তুলবে। কিন্তু মেজর আমাকে বলল, এজন্য গলদ্ঘর্ম হবার দরকার নেই, এ ধরনের অনেক বেজন্মা আছে , তাদের ধরে এনে এটি করা যায়। আমাকে ২০ মিনিট সময় দেন। ৩৯ তম বালুচের লেফটেন্যান্ট জাভ্রদ কে লোক জড়ো করার দ্বায়িত্ব দেওয়া হল। এদের মধ্যে থেকে একজন দাড়িশোভিত লোককে প্রশ্ন করার জন্য ডাকা হল। লোকটি তার নাম বলল মৌলানা সাইদ মোহাম্মাদ সাইদুল হক। সে বলল, সে একজন কঠোর মুসলিম লীগার এবং আওয়ামী লীগের সমর্থক নয়। সে সবসময় আর্মিদের খুশি করতে প্রস্তুত। সে জাভেদ কে বল, “আমি নিশ্চিতভাবে ৬০ জন লোককে ২০ মিনিটের ভিতর নিয়ে আসতে পারব। কিন্তু আপনি আমাকে দুই ঘন্টা দেন আমি ২০০ নিয়ে আসতে পারব।”
মৌলানা সাইদুল হক কাজে যেমন কথায়ও তেমনি ভাল। মেজর কর্তৃক আমাদের সরবরাহ করা সুস্বাদু টাটকা নারকেলের দুধ প্রায় চুমুক দিয়ে শেষ করেছি এমন সময় দূরে উচ্চস্বরে চিৎকার শোনা যেতে লাগল, ‘পাকিস্তান

৪৪৪

জিন্দাবাদ। পাকিস্তান আর্মি জিন্দাবাদ। মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের দেখা গেল, প্রায় ৫০ জন বৃদ্ধ এবং তাদের হাঁটু সমান শিশুরা পাকিস্তানি ফ্ল্যাগ নিয়ে খুব উচ্চস্বরে চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছে। লেফটেন্যামট জাভেদ আমার দিকে পিটপিট করে তাকাল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মিছিলিটি একটি জনসভার দর্শক শ্রোতায় পরিণত হয়ে অস্থায়ী বক্তৃতা মঞ্চ প্রস্তুত হয়ে যায়। মি. মাহবুবুর রহমানকে আর্মিকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখার জন্য পাঠানো হল। সে নিজেকে এনএফ কলেজের ইংরেজি ও আরবি ভাষার অধ্যাপক হিসেবে পরিচয় দিল। সে নাকি ইতিহাস পড়ার জন্য চেষ্টা করেছিল এবং সে মহান মুসলিম লীগের আজীবন সদস্য। পরিচিতির পর মাহবুবুর রহমান উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘পাঞ্জাবি এবং বাঙালি পাকিস্তানের জন্য একতাবদ্ধ হয়েছে। আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি রয়েছে। কিন্তু আমরা হিন্দু এবং আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসে বিপথগামী হচ্ছিলাম। এখন খোদাকে অশেষ ধন্যবাদ পাঞ্জাবি সেনারা আমাদের রক্ষা করেছে। তারা পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা সৈন্য এবং মানবতার নায়ক। আমরা আমাদের অন্তরের তলদেশ থেকে তাদের ভালোবাসি এবং শ্রদ্ধা করি।’ এমনভাবে আরো অনেককিছু বৃথাই বলে চলল। মিটিং এর পরে আমি মেজরকে জিজ্ঞেস করলাম তার বক্তৃতা সম্পর্কে সে কি মনে করে? সে বল, ‘এতে কাজ হবে কিন্তু আমি ঐ বেজন্মাকে বিশ্বাস করিনা। আমি তাকে আমার তালিকাভুক্ত করব।’
মিলিটারি সরকারের পূর্ব পাকিস্তান নীতি দৃশ্যতই এতোই পরস্পরবিরোধী এবং নিজেদের জন্য ক্ষতিকারক যে, যে ব্যক্তিই পাকিস্তান শাসন করে কোন বিষয়ে মনস্থির করতে পারেনা। বল প্রয়োগ করার মত প্রারম্ভিক ভুল করার পরে সরকার এখন অনমনীয়। মূর্খের মত আচরণ করছে; সাধারণ ভাবে এ চিন্তায় যুক্তি থাকতে পারে। একদিকে এটা সত্যি যে সন্ত্রাসের রাজত্বে সন্তাস কমানোর নীতি গ্রহন করা যায়। পূর্ববাংলাকে অধীন করে রাখার নীতি খুব সক্রিয়ভাবে পালন করা হচ্ছে।”

“এ সমস্ত কিছুই প্রতিদিন সরকারের হাজার শত্রু সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে কোন সরকারেরই এটা অজানা নেই যে, এরূপ নীতি অবশ্যই ব্যর্থ হবে। এ সমস্ত কিছু দেখে মনে হবে পাকিস্তানের মিলিটারি সরকার দেশের ২৪ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সমস্যার মোকাবেলায় কখনো দোদুল্যমান অবস্থায় বা কখনো বিপরীত দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এটা একটা বহুল প্রচলিত ধারনা। যদিও কিছুটা যুক্তিপূর্ণ কিন্তু এটা কি সঠিক? আমার নিজের মতে, এটা সঠিক নয়। আমার খুব দুঃখজনক সুযোগ হয়েছিল প্রথমদিকে পাকিস্তানের নেতারা পশ্চিম পাকিস্তানে কি বলেছিল এবং পরে পূর্ব অংশে তারা কি করেছে তা দেখার। আমার মনে হয় প্রকৃতপক্ষে পূর্ব বাংলা সম্পর্কিত নীতিতে সরকারের কোন

৪৪৫

পরস্পরবিরোধিতা ছিলনা। আসলে পূর্ব বাংলাকে তারা একটি কলোনিতে পরিণত করতে চেয়েছিল। এটা আমার হঠাৎ দেখা কোন মতামত নয়। ঘটনাসমূহই তার সাক্ষ্য দেবে।”
“ঢাকার ইস্টার্ণ কমান্ডের হেড কোয়ার্টারে সরকারের নীতি আমার কাছে বর্ণনা করা হয়েছে।
১। বাঙালিরা নিজেদের অবিশ্বাসী হিসেবে প্রমাণ করেছে তাই তাদের পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা শাসিত হতে হবে।
২। বাঙালিদের ইসলামিক লাইনে পূর্ণ শিক্ষিত করতে হবে।
৩। হিন্দুরা যেহেতু হত্যা ও পালিয়ে যাবার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন হয়েছে সেহেতু তাদের সম্পত্তি সোনালি গাজর হিসেবে গন্য করে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মন জয় করার জন্য তাদের মধ্যে বিলি করে দিতে হবে। এ কাজ ভবিষ্যৎ প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর ভিত্তিভূমি হিসেবে গন্য হবে।
খুব হৈ চৈ করে এ নীতির প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিদ্রোহের কারণে অফিসিয়ালি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বর্তমানে বাঙালিদের আর সামরিক বাহিনিতে রিক্রুট করা হবেনা। সিনিয়র এয়ারফোর্স এবং নেভি অফিসার যারা কোনভাবেই জড়িত নয় তাদের সাবধানতার কারনে কম গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে দেয়া হয়েছে। বাঙালি ফাইটার পাইলট যাদের মধ্যে কেউ বিমানবাহিনিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাদের গ্রাউন্ডেড করে ননফ্লাইং কাজে দেবার মত অপমান সহ্য করতে হয়েছে।”
পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস যা একসময় সম্পূর্ণ বাঙালি সমন্বয়ে গঠিত প্যারামিলিটারি ফোর্স তা বিদ্রোহ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে অস্তিত্বহীন হয়। সিভিল ডিফেন্স ফোর্স নামে একটি বাহিনী বিহারি এবং পশ্চিম পকিস্তানি স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে গঠিত হয়। বাঙালিদের পরিবর্তে বিহারিরা পুলিশ বাহিনীর মুখ্য হিসেবে ব্যবহৃত হত। তাদের সুপারভাইজ করার জন্য আর্মির সম্মতিতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অফিসার পাঠানো হয়। চাঁদপুরের সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ এপ্রিলের শেষেও মিলিটারি পুলিশ মেজর ছিল। শতাধিক পশ্চিম পাকিস্তানি সিভিল সার্ভেন্ট, ডাক্টার এবং রেডিও টেকনিশিয়ান, টিভি, টেলিগ্রাফ এবং টেলিফোন সার্ভিসে কাজ করা লোকজন পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হত। অধিকাংশকে এক ও দুই ধাপ প্রমোশন দেবার কথা বলে তাদের আগ্রহী করে তোলা হয়। ট্রান্সফার করা হলে তা তাদের মানাটা বাধ্যতামূলক ছিলনা। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অতি সম্প্রতি সিভিল সার্ভেন্টদের পাকিস্তানের যে কোন স্থানে ট্রান্সফার করার জন্য একটি আদেশ জারি করেছে।”
২০ জুন ‘দ্য সানডে টাইমস’ ‘পোগ্রাম ইন পাকিস্তান’ এ অনেক ছোট ছোট

৪৪৬

ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। কে লিখেছে তা কিছু না বলে বলা হচ্ছে সূত্র নির্ভরযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য যে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। মেজর খালেদ মোশাররফের স্ত্রী এবং সন্তানদের ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সঠিক তথ্য রয়েছে এখানে।

জুলাই-ডিসেম্বর, ১৯৭১
ক্রমশ মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের বিদেশী সংবাদ মাধ্যমগুলো সিরিয়াসলি নিতে আরম্ভ করে। গোড়ার দিকে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে পাকিস্তান আর্মির কাছে এসব মুক্তিযুদ্ধ কিছু নয়। স্টিম রোলার চালিয়ে সব সমান করে ফেলা পাক আর্মির জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র। পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, ইয়াহিয়ার মাথা খারাপ। সে এখনো বুঝছে না আর্মি কি করেছে, ও মনে করে ওরা কয়েক লাখ লোক মেরে ফেলে দেবে, মুজিব কে দেশদ্রোহী বলে বিচার করবে, সবাইকে ফিরে আসার হুকুম দেবে, আর সবাই সব ভুলে যাবে। এটা একটা আস্ত পাগলামি। এরা ভুলবেনা।
১২ জুলাই ‘৭১ ‘দি টাইমস’ যখন ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রি কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেণ্ট (IBRD) এর সদস্য হেনরিক হেইফডেন এর প্রতিবেদন সংক্ষেপে প্রকাশ করে তখন ওপরের তথ্যের সত্যতা মেলে। যেমন, ভাষ্য অনুযায়ীঃ “আমি চালনা বন্দর এবং পার্শ্ববর্তী চাকরিজীবীদের শহর মংলাতে যাই। যশোরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় আমার নিকট পরিষ্কার হয়ে গেল যে, এ এলাকায় সেনা কর্তৃক কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। আকাশ থেকে গ্রামগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে তা পরিষ্কার দৃশ্যমান। একটি দালান এখনো জ্বলছে। বিমানবন্দরের রানওয়ের পূর্বদিক এবং অনেক বাড়িঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
যশোরের প্রায় ২০,০০০ হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে। শহরের কেন্দ্রস্থল এবং আশেপাশের এলাকাও পরর্তীতে ধ্বংস করা হয়। বাস্তবে বৃহত্তর খুলনার জনসংখ্যা ৪,০০,০০০ থেকে ১,৪০,০০০ ৩ নেমে এসেছে। এটা যশোরের মতোই পুরুষদের একটি শহরে পরিণত হয়েছে। রাত নামার পরে কেউ বাইরে বের হয়না।
মংলা বন্দরের শহর যেখানে চালনা বন্দরের শ্রমিকরা বাস করে, তারা নৌবাহিনির গোলাবর্ষণে প্রকৃত অর্থে নিশ্চিহ্ন হয়েছে , ফলে জনসংখ্যা ২২,০০০ থেকে ১,০০০ এ নেমে এসেছে। ক্ষয়ক্ষতি বিশাল।

৪৪৭

আমার ভ্রমনের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হবে খুলনা জেলার ফুলতলা থানা। এ থানার ৫০ শতাংশ অধিবাসী পালিয়ে গেছে। (৪২,০০০ এর মধ্যে প্রায় ২০,০০০) এদের অধিকাংশই হিন্দু যারা তাদের জমিজমা, বাড়িঘরসব ফেলে রেখে চলে গেছে। এখানকার সবকিছুই চূর্ণবিচূর্ণ করা হয়েছে।”
“১৫ এপ্রলে (ঢাকা শহরে সেনারা ঢোকার ২০ দিন পর) সেনারা ঝিনাইদহের উত্তর দিক থেকে কুষ্টিয়াতে ঢোকে। ঢোকার মুখে তারা খুব শক্ত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। তারপর বিদ্রোহী অস্ত্রধারীরা চলে যাওয়ার পর সেনারা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া শুরু করে। এটা চলে ১২ দিন পর্যন্ত এবং কুষ্টিয়াকে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে বিরাণ মরুভূমিতে পরিণত করা হয়। এর জনসংখ্যা ৪০,০০০ থেকে ৫,০০০ এ নেমে আসে। নব্বই ভাগ বাড়িঘর, দোকান, ব্যাংক এবং অন্যান্য বিল্ডিং সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়। শহরটিকে মনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন একটি জার্মান শহরের মত, যাতে দক্ষ সেনাদের দ্বারা বোমা আক্রমণ চালানো হয়েছে। লোকজন হতবুদ্ধি হয়ে গোলাকার হয়ে বসে আছে। আমরা যখন সেখানে গেলাম সকলেই পালিয়ে গেল। এটা পারমানবিক বোমা আক্রমনের পর একটি সকালের মত মনে হচ্ছে। আমি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করলাম, তারা সকলেই মর্মাহত এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমি তাদের বললাম, খাবার পাওয়া যায় এমন একটি দোকান আমাদের দেখিয়ে দিন। পরবর্তী ৯০ মিনিটের মধ্যেও এমন একটি দোকান পাওয়া গেলনা। কুষ্টিয়া সম্পর্কে কয়েকজন আমাকে বলেছেন- এটা পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা সৃষ্টি করা অপর একটি মাইলাই।”
“আগস্ট সেপ্টেম্বর বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমগুলোতে মুক্তিফৌজের কথা প্রায়ই থাকে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক গঠন প্রক্রিয়ার সময়টা ছিল এপ্রিল ও মে মাস। এবং সেটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে কঠিন ও ক্রুশিয়াল সময়। শুধুমাত্র ভারতীয় কিছু সংবাদমাধ্যমে ঐ সময়কার সত্য ঘটনাগুলো এবং মুক্তিবাহিনির গঠন প্রক্রিয়া এসেছে। তবে ঐ সময়ে বিশ্বব্যাপী ঘটনাগুলো অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিয়েছিল এখন প্রায়ই মুক্তিবাহিনি এবং তার সেনানায়কদের নিয়ে অনেক লেখা আসছে। তুলনামূলকভাবে মুজিবনগর সরকারেবং বাংলাদেশ আন্দোলন পরিচালনার সংবাদ তেমন একটা চোখে পড়েনা। একটা জিনিস লক্ষনীয় যে, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বিদেশী সাংবাদিকদের লেখায় মুক্তিবাহিনির হাতে পাকবাহিনির নাজেহাল হবার খবর প্রাধান্য বিস্তার করেছিল । একদিন যে মুক্তিবাহিনির হাতে পাক পরাক্রমশালী সৈন্যরা পরাস্ত হবে সেই ধরনের একটা ধারনা জমাট বাঁধছিল। তখন পর্যন্ত ভারতীয় সৈন্যরা সামনে আসেনি। ১৩ আগস্ট ‘নিউ স্টেটসম্যান’ লিখেছে…

More recently the occasional set-price battle, as at belonia on the east or near Satkhira on the West, has shown the Pakistan army that the

৪৪৮

Mukti Fouj can, when they chose, stand and fight. At Belonia they killed 450 Pakistan soldiers at the cost of 70 dead. At Satkhira Pakistan army left 300 dead against a toll of about 20 Mukti Fouj…”

ওখানে আরো লিখেছে, “মর্টার ও কিছু কাতিউশা রকেট মুক্তিযোদ্ধারা পেলে পাকি আর্মি আর ছয়মাস টিকবে কিনা সন্দেহ। মুক্তিবাহিনির র-মেটেরিয়ালের কোন অভাব নেই। ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোতে কম বয়সো তরুনেরা উপচে পড়ছে।’
এ পর্যন্ত পাক বাহিনির মৃতের সংখ্যা অস্বাভাবিক রকম বেশি। এক হিসেব মতে, মৃতের সংখ্যা ১৮ হাজার হবে এবং এর অনেকেই অফিসার র‍্যাংকের। তুলনামূলকভাবে মুক্তিফৌজের ঘায়েল সংখ্যা কম। সম্ভবত ১০ টা পাকিস্তানির বদলে একটা বাঙালি মরে। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ইয়াহিয়া এদেশকে ঠান্ডা করতে চেয়েছিল। অথচ দেখা গেল, যত ত্রাস বাড়ে তত মুক্তিযুদ্ধের রিক্রুট বাড়ে। পলিটিক্সের এই মারাত্মক ভুলের কারনে মরণ ফাঁদের হাত থেকে রেহাই পেতে ইয়াহিয়া সম্ভবত একটা বৃহত্তর যুদ্ধ কামনা করতে পারে।”
এই ভবিষ্যদ্বানীর মধ্যেই সম্ভবত উত্তর রয়েছে কেন পাকিরা পরবর্তীতে প্রায় বিনাযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনির কাছে আত্মসমর্পন করেছিল এবং আগস্টের মধ্যেই তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
১০ অক্টোবর ‘সানডে টাইমসে’ অ্যান্থনী মাস্কারানহাস আবার লিখেছেন, ‘ইকবাল হলের চৌকিদার কোরআন ছুঁইয়ে হলফ করে বলতে রাজি যে সেদিন যখন পাক আর্মি ইকবাল হলে হত্যাযজ্ঞ চালায় ছাত্ররা কেন গুলি করেনি। করবে কেমন করে? তাদের সব রাইফেল ছিল ডামি রাইফেল।’
৩১ অক্টোবর ‘সানডে টাইমস’ ‘প্রায় ৮০০ মুক্তিবাহিনিঈ এখন ঢাকায়’ শিরোনামে বিভিন্ন জায়গায় বোমা মারার বর্ণনা দেয়। পাকিস্তান আর্মির রোজকার মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২৯।’ ‘১৫ আগস্ট ৮০ জন মুক্তিবাহিনী পাক আর্মির হাতে ধরা পড়ার পর আবার সদলবলে ফিরে আসছে। তারা এখন আরো বেপরোয়া।’
‘ঢাকায় পাওয়া খবর অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের এখন এক লক্ষ মুক্তিফৌজ নিয়োজিত আছে’ (৩১ অক্টোবর ‘সানডে টাইমস)। ২ নভেম্বর জিম হোগল্যান্ড “দি টাইমস’এ লিখেছেন, ‘আহত মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নেয়।’ ‘পাকিস্তান থেকে আসা পুলিশবাহিনী একদিন স্ট্রাইক করেছিল তাদের পূর্ব পাকিস্তানে মারতে আনা হয়েছে বলে। মনোবলের এই অবস্থা। পাকিস্তানী ফৌজের মরাল এই পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল নভেম্বরের আগেই।’
এরপর আস্তে আস্তে বেজে ওঠে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দামামা। রাজনৈতিক ক্রমবিকাশ আর যুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি। ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর ভারত

৪৪৯

বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ।
[৭৫] কে. মওদুদ এলাহী

মুক্তিযুদ্ধ ও বিহারি সম্প্রদায়
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়লাভ পশ্চিম পাকিস্তানিদের মতো পূর্ব পাকিস্তানের উর্দুভাষীরাও মেনে নিতে পারেনি। উর্দুভাষী শিল্পপতি, ব্যবসায়ীরা এতে শঙ্কিত হয় এবং তারা প্রবল আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। এ জন্য নির্বাচনের পর পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসির ফলে বাঙালির যত ক্ষোভ তা তাদের এদেশীয় পাকিস্তানীদের সমর্থক উর্দুভাষীদের উপরও গিয়ে পড়ে।
পূর্ব পাকিস্তানের উত্তপ্ত রাজনৈতিক আবহাওয়ায় পুনরায় বাঙালি ও উর্দুভাষীদের সম্পর্কে চরম অবনতি ঘটে। উর্দুভাষী মোহাজেরদের পাকিস্তানি শাসকচক্রের প্রতি অত্যধিক মোহ বাঙালি মাত্রেই তাদের প্রতি বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯৭১ সালের প্রথম থেকেই পাকিস্তানি শামরিক শাসকদের প্রতি বাঙালির ঘৃণার সিংহভাগ গিয়ে পড়ে উর্দুভাষী মোহাজেরদের উপর। অন্যদিকে সামরিক প্রশাসনের ছত্রছায়ায় অবাঙালিরা ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে বাঙালির মিছিল, সভা কিংবা স্বাধীনতাকামীদের উপর আক্রমণ চালায়। জেনারেল ইয়াহিয়া খন ১৯৭১ সালের ১ মার্চ, ৩ মার্চ আসন্ন জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে পূর্ব পাকিস্তানে সহিংসতা শুরু হয়। শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ জেলা পর্যায়ে উর্দুভাষীদের দোকান, প্রতিষ্ঠান বাঙালি বিক্ষোভকারীদের শিকার হয়। কোথাও কোথাও বিহারি কলোনী আক্রান্ত হয়। যে সকল এলাকায় অবাঙালিদের প্রাধান্য ছিল তারা বাঙালিদের উপর অনুরূপ আক্রমণ চালায়। যেমন ঢাকার মিরপুর এবং সৈয়দপুর কিংবা চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকায় বাঙালিরা আক্রান্ত হয় এবং বাঙালির বিক্ষোভ মিছিলের উপরও সশস্ত্র হামলা চালায়। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছিল চট্টগ্রামে। ২-৪ মার্চ চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, ফিরোজশাহ কলোনি, ওয়্যারলেস কলোনি, খুলনা কলোনির অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় বাঙালিরা আক্রান্ত হয়। এতে উভয় পক্ষের মোট একশ বিশ জন নিহত হয়। ৫ মার্চ এ সংখ্যা ১৩৮ এ পৌঁছে। অবশ্য এর মধ্যে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিতেও মারা যায় অনেকে। খুলনায় এসময় বাঙালি অবাঙালি দাঙা দেখা দেয়। সেনাবাহিনী, পুলিশের ব্যাপক অভিযান ও গুলিবর্ষণে এবং বাঙালি বিহারি দাঙায় ১-৬ মার্চের মধ্যে বেসরকারী হিসেবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ১০০০ জনের প্রাণহানি এবং সরকারি হিসেবে ১৭২ জনের প্রানহানী ঘটে। এর মধ্যে কতোজন বাঙালি কিংবা বিহারি দাঙ্গায় মারা গিয়েছে তার হিসেব

৪৫০

পাওয়া না গেলেও ২৫ মার্চ পাকবাহিনি ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা শুরু করলে বরাবরের মত নিজেদের আক্রমনের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে বাঙালি কর্তৃক বিহারিদের ব্যাপক হত্যাকান্ডকে দায়ী করা হয়। নেতৃবৃন্দ বি২৩ মার্চ সন্ধ্যায় অবাঙালিদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সৈন্যরা
ভিন্ন বক্তৃতা, সরকারি দলিলপত্রে এবং একাত্তরের ৫ আগস্ট পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ঘোষিত শ্বেতপত্রে বাঙালিদের আক্রোশ থেকে অবাঙালিদের রক্ষার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। এ কারনে বিহারিদের মৃতের সংখ্যা অত্যধিক বাড়িয়ে প্রচার করা হয়, যা অবিশ্বাস্য বলে প্রমাণিত হয়। অথচ বাঙালি নেতৃবৃন্দ মার্চ মাসের প্রথম থেকে দাঙা বন্ধের আহবান জানান। ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগের জনসভায় সাম্প্রদায়িক দাঙা বন্ধ এবং বিহারি ও বাঙালিদের মধ্যে সুসম্পর্কের আহবান জানানো হয়। ঐদিন ছাত্রলীগের স্বাধীনতার ইশতেহারে ৫ টি কর্মপন্থার দুটিতে বলা হয়- ১. হিন্দু মুসলমান, বাঙালি অবাঙালি সাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রত্যাহার করতে হবে। ২. লুটতরাজসহ সকল প্রকার সমাজবিরোধী ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে। মোহাম্মাদপুরে এক বক্তৃতায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী মোহাজেরদের উদ্দেশ্যে ৯ মার্চ বলেনঃ
মনে রাখবেন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা আপনাদের নিরাপত্তার ব্যাবস্থা করতে পারবেনা। বাংলার মানুষই আপনাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারে। পশ্চিমা শাসককুল কর্তৃক বাংলাদেশ হতে লুন্ঠিত সম্পদের হিস্যা কি আমাদের দেওয়া হয়? অপর পক্ষে বাংলার সম্পদ বাংলায় থাকলে বাংলার সম অধিকার সম্পন্ন নাগরিক হিসেবে সে সম্পদের সুফল পেয়ে আপনারাও কি সুখী হবেন না?
শেখ মুজিবুর রহমান স্পষ্টভাবে অবাঙালিদের ‘এ ভূমির সন্তান’ ঘোষণা করে তাদের সংগে স্থানীয়দের সুসম্পর্কের আহবান জানান। এই বক্তৃতার পর ৭-২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন চললেও বাঙালি বিহারি সহিংসতা অনেক কমে আসে। যদিও বিহারি অধ্যুষিত সৈয়দপুর ২৩ মার্চ সন্ধ্যায় অবাঙালিদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সৈন্যরা শহরের বিভিন্ন বাঙালি বসতির উপর হামলা চালায়, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ও গুলিবর্ষণের মাধ্যমে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। পরেরদিন সেনাবাহিনির গুলিতে সৈয়দপুরে প্রায় ১০০ জন নিহত হয়। সেনাবাহিনী অবাঙালিদের সহযোগিতায় বোতলাগাড়ি, গোলাহাটি ও কুন্দল গ্রাম ঘেরাও করে নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করে, ঘরে আগুণ দেয়। ঢাকার মিরপুরে অবাঙালিরা ২৪ মার্চ পাকিবাহিনীর সহযোগিতায় জোরপূর্বক বাঙালিদের বাড়িঘরের শীর্ষ থেকে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলে। রাতে বিহারিরা বাঙালিদের বাড়িতে আগুণ ধরিয়ে দেয়। তাদের ছুরিকাঘাত ও গুলিতে বেশ কয়েকজন বাঙালি আহত হয়। । বাঙালিরা

৪৫১

অনেকে সেদিন মিরপুর ত্যাগে বাধ্য হয়।
২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক আক্রমনের সূচনা করলে আবার দাঙা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ৭-২৫ মার্চের মধ্যে যে সাময়িক সৌহার্দ্য গড়ে উঠেছিল তা ভেঙে যায়। এবার আওয়ামী লীগ ও বাঙালিরা তাদের টার্গেট হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর ছত্রছায়ায় উর্দুভাষী বিহারিরা বাঙালিদের উপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। মার্চ মাস থেকে পরবর্তী সময়ে ৯ মাস পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে তারা গণহত্যায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এপ্রিল মাসে রাজাকার, পরবর্তীকালে মিলিশিয়া, আলবদর, আলশামস নামে ঘাতক বাহিনী গঠিত হলে বিহারিরা তাতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। ঠিক কতজন এসব বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল তার হিসেব না থাকলেও বিহারি নেতা নাসিম খানের মতে, বিহারিদের ৫ লক্ষ লোক পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে। রাজাকার বাহিনীর শতকরা ৬০-৮০ ভাগ ছিল বিহারী। এদের মধ্যে ২০,০০০ বিহারি শুধু সিভিল আর্মস ফোর্সে যোগ দেয়। এছাড়া চট্টগ্রাম রেলওয়েতে সদর দপ্তর করে গঠিত হয় ‘সিভিল পাইওনিয়র ফোর্স’। এর শাখা সৈয়দপুর, সান্তাহার ও অন্যান্য রেলকেন্দ্রে স্থাপিত হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই রেলওয়ে সেক্টরে অবাঙালিদের প্রাধান্য থাকায় এ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ রেলওয়ে কেন্দ্রিক করা হয়। রেলওয়ে কর্মচারীদের ভিতর থেকে ৪০ বছর বয়সের নিচে বিভিন্ন শ্রেনীর সমন্বয়ে এটি গঠিত ছিল। কিছু বাঙালির সঙ্গে এর যোগসূত্র থাকলেও এর বেশিরভাগ সদস্য ছিল অবাঙালি ও বিহারি কর্মচারী। ১৯৭২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায় এই ফোর্সের একাত্তরের কর্মকান্ড সম্পর্কে দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়ঃ
চট্টগ্রাম থেকে পাইয়নিয়র বাহিনীর সদস্যরা দস্যু বাহিনীর সহযোগিতায় যে সমস্ত বধ্যভূমি সৃষ্টি করেছিল, তন্মধ্যে পাহাড়তলী এলাকার বনাঞ্চলে, ফয়স লেক, ঝাউতলা ইত্যাদি ছিল প্রধান। এছাড়া পাইয়নিয়র বাহিনীর সদস্যরা নিয়মিতভাবে ট্রেনে চলাচল করত। পথে তারা মানুষের ধনসম্পদ ও টাকাপয়সা ছিনিয়ে নিয়ে যেত এবং রাস্তাঘাটে তারা মানুষকে মেরে ফেলত।
রেলওয়ে পাইয়নিয়র বাহিনীর জল্লাদরা শুধু রেলওয়ের ১৮ জন অফিসারসহ ১৩ শতাধিক বাঙালি কর্মচারীকে হত্যা করেনি, তারা সীতাকুন্ডের শিবনাথ পাহাড়ে এবং মিরিসরাই থানার নরহত্যার কেন্দ্রগুলোতে হাজার হাজার বাঙালিকে হত্যা করেছে।
রাজাকার বাহিনী গঠনের আগেই মোহাজেরদের বড় সংগঠন আঞ্জুমানে মহাজেরিন মাসরেকি পাকিস্তানের সভাপতি দেওয়ান ওয়ারেসাত হোসাইন ৭ এপ্রিল জেনারেল ইয়াহিয়াকে পাকিস্তানের অখন্ডতা ও সংহতি রক্ষায় মোহাজেরদের যে কোন ত্যাগ স্বীকারের প্রতিশ্রুতি দেন। ১৭ সেপ্টেম্বর করাচিতে আহমদ ই এইচ জাফরের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান মোহাজের কমিটির

৪৫২

১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাত করে একই প্রতিশ্রুতি দেন। পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের সরাসরি অস্ত্র প্রদান ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধকালে ৫৩৪৭ টি পিস্তল, ১১৫৯ টি ২২ বোর রাইফেল, ১৫৩৩ টি বন্দুকের লাইসেন্স ইস্যু করে। এ অস্ত্রের সিংহভাগ অবাঙালিদের দেওয়া হয়।

বাঙালি নিধনে সার্টিফিকেট পেয়ে উর্দুভাষীরা বাঙালিদের হত্যা ও লুটপাট করতে থাকে। তারা কৌশলগত স্থান যেমন-যেমন শিল্পকেন্দ্র, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর রক্ষার দ্বায়িত্ব পায়। নিরাপত্তা বাহিনী, পুলিশেও তাদের নিয়োগ করা হয়। এসব পদের চাকরিরত বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের শূন্য জায়গায়। বিহারি তরুন ও যুবকদের অধিকাংশ বিভিন্নভাবে বাঙালিদের উপর সহিংস ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাদের অনেকে বাঙালী বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের সাথেও জড়িত ছিল। প্রবাসী সরকার বারবার বিহারিদের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের আহবান জানায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পৃথক উর্দু অনুষ্ঠান প্রচার করে এবং অবাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের আহবান জানালেও এ আহবান তাদের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারেনি।
মুক্তিযুদ্ধ কালীন অবাঙালিদের নৃশংসতা ঢাকার জন্য ‘বহির্বিশ্বে সমালোচনা’ সামাল দিতে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সামরিক হস্তক্ষেপের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পাকিস্তান সরকার ভিবিন্ন প্রচারণা চালায়। পাকিস্তান সরকারের অতিরঞ্জিত মৃত্যুর সংখ্যা থেকে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন বিদেশী গণমাধ্যমকেও ব্যবহার করে। ৫ আগস্ট পাকিস্তান সরকার যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে তাতে বাঙালিদের হাতে মোট নিহত বিহারির সংখ্যা প্রায় ৬০,০০০ বলে উল্লেখ করা হয়।
পাকিস্তান সরকারের মতে এই হত্যাকান্ড ঘটেছিল শুধু ২৫ মার্চ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এপ্রিলে রাজাকার বাহিনী গঠনের পর রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন এলাকায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে। শ্বেতপত্রে দাবী করা হয়, এ হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী মূলত আওয়ামী লীগ, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের বাঙালি সদস্যরা। যদিও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এই শ্বেতপত্রকে ‘বাঞ্চ অফ হোয়াইট লাইস’ বলে আখ্যায়িত করে।
অবশ্য পাকিস্তানি লেখক ও জেনারেলদের লেখনীতে এই হত্যাকান্ড সম্পর্কে যে কাহিনীর অবতারণা করা হয় তা শ্বেতপত্রের হিসেবকেও হার মানায়। পাকিস্তানি লেখক কলিম সিদ্দিকী শুধু ২৫ মার্চের আগেই বাঙালি কর্তৃক এক লক্ষ অবাঙালি হত্যার উল্লেখ করে। অথচ ২৫ মার্চের আগে মোট এক হাজার লোকের মৃত্যু সম্পর্কে পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের সিংহভাগ পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর গুলিতে মারা যায়। মাইকেল হর্নবি (Michal Hornsby) পূর্ব

৪৫৩

পাকিস্তানে সরেজমিনে অনুসন্ধনের পর ১৯৭১ সালের ১৫ জুলাই ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় এক রিপোর্টে কলিম সিদ্দিকীর বক্তব্যকে মিথ্যা বলে উল্লেখ করেন। অপর পাকিস্তানি লেখক মাসওয়ানি শুধু চট্টগ্রামে ১২,০০০ অবাঙালি নিহত হয়েছেন বলে মন্তব্য করেন। শ্বেতপত্রেও এ হিসেবের কাছাকাছি বিহারি হত্যাকান্ডের কথা উল্লেখ করা হয়। এ দুজন পাকিস্তানি লেখকের মন্তব্য পাকিস্তানি জেলারেল রাও ফরমান আলী খানের বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই ভ্রান্ত প্রমাণ হয়। জেনারেল রাও এর মতে, চট্টগ্রামে ২ ও ৩ মার্চ ১০০ নিহত ও ৩০০ আহত হয়। এদের মধ্যে কতজন অবাঙালি তা অবশ্য রাও উল্লেখ করেনি। দিনাজপুরের বিহারি হত্যাকান্ড সম্পর্কে আকাশকুসুম সংখ্যা উল্লেখ করেছে আঞ্জুমানে মোহাজেরিনের সভাপতি দেওয়ান ওয়াসেরাত হোসাইন। তিনি ১৯৭১ সালের ২০ জুন বলেন, দিনাজপুরে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত ৫০,০০০ বিহারি হত্যার শিকার হয়। অথচ স্বেতপত্রে বৃহত্তর দিনাজপুরের মৃতের সংখ্যা ১৩,০০০ উল্লেখ করা হয়। লন্ডনের ‘দি টাইমস’ এর মন্তব্য হচ্ছে, দিনাজপুরে ১০০ বিহারি মারা গিয়েছে। দিনাজপুরে যে পরিমান বিহারি হত্যাকান্ডের কথা বলা হয়েছে সে পরিমাণ বিহারি তখন সেখানে ছিলইনা। মোট কতজন অবাঙালি নিহত হয়েছিল সেদিন, তাই তার কোন সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। বেশ কিছু পশ্চিমা গণমাধ্যম ও প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে হিসাব প্রদান করে। লন্ডনভিত্তিক মাইনরিটি রাইটস গ্রুপ এর রিপোর্ট অনুযায়ী চট্টগ্রামে উগ্রপন্থীদের আক্রমণে মার্চের শুরুতে ৩০০ বিহারি মারা যায়। এই তান্ডব যশোর, খুলনা, রংপুর, সৈয়দপুর, ও ময়মনসিংহেও চলে। বিহারিদের হিসাবমতে, ২৫ মার্চ সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপের আগে বাঙালিরা কয়েক হাজার বিহারি হত্যা করে। এখানে প্রকৃতপক্ষে কত হাজার তা উল্লেখ করা হয়নি। অন্যদিকে মার্চ-ডিসেম্বর কতোজন বাঙালি বিহারিদের হাতে মারা গেছে তার হিসেবও নেই। অ্যান্থনী মাসকারেনহাস মনে করেন খুলনা, যশোরে মধ্য জুন পর্যন্ত ২০ হাজার অবাঙালির লাশ পাওয়া গিয়েছে। অবশ্য তিনি স্বীকার করেছেন পাকিস্তানের সামরিক সরকার তাকে এ খবরটি প্রচারে অনুমতি দিলেও কতজনকে বাঞালিকে তারা হত্যা করেছে সে খবর প্রকাশ করতে দেয়নি। তাই এই হিসেবও গ্রহনযোগ্য নয়। বাঙালি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিল্লুর আর খান মনে করেন, একাত্তরে বিহারিদের মৃত্যুর সংখ্যা ৫০০ এর বেশি হবেনা। পাকিস্তানি সামরিক সরকার বিহারি হত্যাকান্ডকে ফলাও করে প্রচার করলেও শ্বেতপত্রে কতজন বাঙালি পাক সেনাবাহিনীর ছত্র ছায়ায় অবাঙালিদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিল তার উল্লেখ করেনি। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ ১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর এক রিপোর্টে উল্লেখ করে, বিহারিরা শুধু আদমজি জুটমিলে প্রায় ৩০,০০০ বাঙালিকে হত্যা করে। কয়েকজন বাঙালি লেখক, মুক্তিযোদ্ধা, ও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে এ সম্পর্কে কিছু চিত্র পাওয়া যাবে। মুক্তিযুদ্ধকালে ইপিআর এর ক্যাপ্টেন রফিকুল

৪৫৪

ইসলাম (পরবর্তীতে মেজর) বলেনঃ
৩ মার্চ সকালে বাঙালিদের একটি মিছিল চট্টগ্রাম শহরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় অবাঙালি অধ্যুষিত ওয়্যারলেস কলোনির কাছে কতিপয় অজ্ঞাত পরিচয় লোক মিছিলের উপর রাইফেলের গুলি চালায়। এতে কয়েকজন আহত ও নিহত হয়। পার্শ্ববর্তী বাঙালি বস্তিগুলোতে এ সময় আগুণ ধরিয়ে দিলে বেশ কয়েকজন জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেল নিহত ও আহত বাঙালি সকলেই বুলেটে আঘাত প্রাপ্ত। বলাবাহুল্য সেসময় বেসামরিক লোকদের রাইফেল রাখার অধিকার ছিলনা। ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা সাধারণ নাগরিকের পোষাকে অবাঙালিদের সঙ্গে বসবাস করছে বলে আমরা আগেই সংবাদ পেয়েছিলাম। আরো জানা যায় যে, ছদ্মবেশী সৈন্যরা সকলেই রাইফেল সজ্জিত। ৩ মার্চের ঘটনা সেসব সত্যতাই প্রমাণ করে।
সৈয়দপুরে বিহারিদের নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরেছেন সৈয়দপুরের তৎকালীন পুলিশ অফিসার মো. আব্দুল হামিদ। তিনি বলেনঃ
১৫ এপ্রিল প্রকাশ্যে অবাঙালিরা রেলওয়ে কারখানার শত শত বাঙালিকে কারখানার মধ্যে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে জ্বলন্ত বয়লারে ফেলে দিল। তাদের দেহ পুড়ে ছাই হয়ে গেল। অবাঙালিরা বাঙালিদের বাড়ি বাড়ি ঢুকে আবাল বৃদ্ধ বনিতা যাকেই পেল তাকেই গরু ছাগলের মত হত্যা করে তাদের দেহ খন্ড বিখন্ড করে কূপে অথবা গর্তে ফেলে দিয়ে মাটিচাপা দিল।”
অপর প্রত্যক্ষদর্শী সৈয়দপুরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আফসার আলী আহমদ বলেন, সৈয়দপুরে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় দেড় হাজার বাঙালি বিহারিদের হতযাযজ্ঞের শিকার হয়। চট্টগ্রামে বিহারিরা বহু বাঙালি রেল অফিসার ও কর্মচারীকে হত্যা করে। ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রামের রেলওয়ের অবাঙালি অফিসাররা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে ২৪ টি দাবী সংবলিত যে চিঠি দেয় সেটি থেকে তাদের বাঙালি বিরোধী মানসিকতার প্রতিফলন ঘটে। এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দাবী যেমন ছিলঃ
১. উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, ২. যেসব সরকারি সামরিক বেসামরিক কর্মচারী আওয়ামী লীগের সাথে সহযোগিতা করছে তাদের অপসারণ করতে হবে, ৩. যে সব রেলওয়ে অফিসার বিভিন্নভাবে পাকবাহিনীকে অসহযোগিতা করছে তাদের বড় ধরনের সাজা দিতে হবে ৪. পুলিশ অফিসার যারা পূর্বে আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করেছে তাদেরও বড় ধরনের শাস্তি দিতে হবে ৫. আওয়ামী লীগের সকল সদস্যকে গুলি করে মারতে হবে ৬. সব ছাত্র নেতাকে গুলি করতে হবে ৭. বেতারের যেসব লোক জয়বাংলার গান পরিবেশন করত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। ৮. বাঙালিদের আর চাকরীতে নেওয়া যাবেনা বিশেষত

৪৫৫

সশস্ত্র বাহিনী ও রেলওয়েতে। ৯. প্রথম শ্রেনীর বাঙালি অফিসারদের পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করে পশ্চিম পাকিস্তানে যত এ জাতীয় অফিসার আছে তাদের এখানে নিয়োগ করতে হবে। ১০. সেক্রেটারী পর্যায়ে বাঙালি চাকরিজীবীদের পশ্চিমে বদল করতে হবে। ১১. গোয়েন্দা বিভাগের বাঙালি অফিসারদের চরম সাজা দিতে হবে। ১২. পূর্ব ও পশ্চিমের জন্য এক ভাষা সৃষ্টি করতে হবে। ১৩. শিক্ষাব্যবস্থায় এমন পরিবর্তন আনতে হবে যে, বাঙালিরা এক পাকিস্তানের ভক্ত হয়। ১৪. মোহাজের ও পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের বিনা পয়সায় লাইসেন্স সহ অস্ত্র দিতে হবে। ১৬. পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি মোহাজেরদের হাতে দিতে হবে।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানও উল্লেখ করেন২৮ এপ্রিল ঢাকা আরিচা রোডের কয়েকটি বাস আটক করে বিহারিরা ৫০০ লোককে হত্যা করে। উত্তরবঙ্গের গোপালপুর সুগারমিলের বিহারি কর্মচারীদের যোগসাজশে ৫ মে পাকবাহিনী মিলের জেনারেল ম্যানেজার আনোয়ারুল আজিমসহ ৩০০ কর্মচারীকে হত্যা করে। জেনারেল ম্যানেজারের বিধবা স্ত্রী মিসেস আজিম বলেন, “২৫ মার্চের কাল রাতের পর থেকেই এখানে অবাঙালিদের উতপাত বেড়ে গিয়েছিল। তারা হিন্দুদের ও দেশপ্রেমিক অধিকারসচেতন মানুষের বাড়িঘর দখল করত, লুটপাট করত বিষয়সম্পত্তি। কিছু বলার উপায় ছিলনা। কারণ তখন তারাই সর্বেসর্বা। কিছু বলতে গেলে বলত, ‘ইয়ে চিজ কা উপর হামলোগোকা হক হ্যায়।’ অবাঙালি কর্মচারীদের মধ্যে ইক্ষু সংগ্রহকারী অফিসার মাসাদ্দি, সহকারী কৃষি কেমিস্ট জামিল সিদ্দিকী, ফোরম্যান কাজী আসগর আলী, সহকারী ইঞ্জিনিয়ার আনসারীর কথা মনে পড়ছে।”

নওগাঁয় বিহারি ব্যবসায়ী ইদ্রিসের নৃশংসতা হিটলারকেও হার মানায়। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ প্রকাশ করে তার নৃশংসতার কাহিনী। ‘নরপশুরা বাঙালির রক্তে দরজায় আলপনা আঁকত’ শিরোনামে এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়ঃ
বিহারি ব্যবসায়ী ইদ্রিস খান সেনাদের সহযোগিতায় যেসব বাঙালিকে ধরে এনে জবাই করত, তাদের রক্তে তার অপবিত্র হস্ত রঞ্জিত করে তা দিয়ে তার ঘরের দরজা জানালা রাঙিয়ে নিত। এ নারকীয় দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। আর খান সেনারা তখন উল্লাসে মেতে উঠত। শুধু কি তাই, ইদ্রিসের বাড়ির ভিতর কাঁচা কূপটি মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। কূপটিতে বহু অচেনা বাঙালির লাশ চাপা রয়েছে। আর এর পাশেই দেখা যায় প্রচুর রক্তের দাগ।
স্থানীয় বিহারীদের সহযোগিতায় পাকসেনারা কত বাঙালির জীবন প্রদীপ নির্মম ভাবে নির্বাপিত করেছে, এই ক্ষুদ্র নওগাঁ শহরে তারই একটি ক্ষুদ্র অথচ প্রামাণ্যচিত্র তুলে ধরা হলো।
৪৫৬
কুষ্টিয়ায় গণহত্যায় বিহারিদের ভূমিকা সম্পর্কে ড. আব্দুল আহসান চৌধুরী বলেনঃ
পুলিশ লাইন ছিল পাকসেনাদের ঘাঁটি। বিহারি ও রাজাকারদের সহায়তায় সন্দেহভাজন বাঙালিদের এখানে ধরে আনা হত। চলত অকথ্য নির্যাতন। যাদের নাম ‘খরচের খাতায়’ লেখা হত, তাদের হস্তান্তর করা হত রাজাকার ও বিহারিদের কাছে। হতভাগ্য এই মানুষগুলোকে নিয়ে যাওয়া হত পার্শ্ববর্তী রেললাইনের নির্জন স্থানে। তারপর গুলি চালিয়ে কিংবা জবাই করে হত্যা করা হত। রক্সি সিনেমা হল ছিল শান্তি কমিটি ও বিহারি রাজাকারদের প্রধান আস্তানা। শোনা যায়, শহরের হত্যা তালিকা এখানেই প্রণীত এবং কার্যকর হয়। বিহারিরা পাশেই গড়াই নদীর চরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে লাশ চরে পুঁতে ফেলত। আবার কখনো কখনো নদীর জলে ভাসিয়ে দিত রক্তাক্ত লাশ।
কুষ্টিয়া শহরতলির বিহারি অধ্যুষিত হাউজিং এস্টেট ছিল আর এক বধ্যভূমি। শহর থেকে ধরে এনে এখানে হত্যা করা হত। লাশ কখনো পায়খানার ট্যাংক, কখনো পাশের ক্যানেলে ফেলে দেওয়া হত।
বাঙালি ও বিহারিদের সমর্থিত উৎসগুলোতে স্ব স্ব পক্ষে অতিরঞ্জিত ভাষণ থাকলেও মার্চের অসহযোগ আন্দোলন এবং এপ্রিলে পাক বাহিনীর আধিপত্য বিস্তারের আগে পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন দাঙ্গায় বেশ কিছুসংখ্যক বিহারি মারা যায়। যদিও বিহারি সমর্থিত উৎসের আকাশপাতাল হেরফেরের কারণে তা প্রমাণ করা যায়না। বরং বাঙালির উপর গণহত্যার বৈধতা দেওয়ার জন্য বাঙালি কর্তৃক বিহারি হত্যাকান্ডের নাটক তৈরি করা হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর বক্তব্য থেকেও এটি প্রমাণিত হয়। সে বিহারিদের ওপর বাঙালিদের হত্যাকান্ডে বিহারিদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বলেঃ
নিজেদের সঙ্গীদের ছিন্ন ভিন্ন দেহ দেখে ভাবাবেগের কাছে তারা (বিহারি) পরাভূত হয়ে পড়ে। এর সদস্যদের কেউ কেউ তাদের কর্তৃত্বের সীমা অতিক্রম করে এবং যথাযথ বিচার ছাড়াই অসংখ্য অসামরিক ও পুলিশ অফিসারকে হত্যা করে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো মুক্ত করার পর বিহারিরা যখন প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছিল, আর্মি তখন তাদের নিয়ন্ত্রন করতে সমর্থ হয়নি।
জেনারেল রাও এর এই স্বীকারোক্তি থেকে বিহারিদের বাঙালি হত্যা ও এর পেছনে যুক্তি তৈরি করা হয়েছে। যে সকল এলাকায় বিহারিদের আবাস ছিল সেখানে একাত্তরে গণহত্যা হয়েছে বেশি। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরুতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ছত্রছায়ায় বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকান্ডেও বিহারিরা অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে বিহারি অধ্যুষিত জেলা ও ঢাকার মোহাম্মাদপুর, মিরপুরে এই ধরনের হত্যাকান্ড বেশি ঘটে। এভাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিহারিরা পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে ব্যাপক গণহত্যা ও

৪৫৭

ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে। ডিসেম্বরে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলে বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাক বাহিনী পরাজিত হতে থাকে। বিভিন্ন জায়গায় তারা আত্মসমর্পন করলেও বহু বিহারি অস্ত্রসহ আত্মগোপন করে থাকে। উত্তরবঙ্গে পরাজিত বিহারিরা জড়ো হয় ঈশ্বরদীতে। ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি এখান থেকে ১৭০০ বিহারিকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং ৬০০ অস্ত্র উদ্ধার করে। ঢাকার মোহাম্মাদপুর ও মিরপুরে আশ্রয় নেয় অন্যান্য অঞ্চলে পরাজিত বিহারিরা। এমনকি স্বাধীনতার পরপর বাংলাদেশ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে অস্ত্রধারী বিহারি ও দালালদের সংঘর্ষ পর্যন্ত হয়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রকাশ্যে বিহারিদের পাকিস্তান বাহিনির সঙ্গে গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞে অংশগ্রহন পাকিস্তানি শাসকদের মত তাদেরও বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত জনগোষ্ঠিতে পরিণত করে। বিহারিরা হারায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা, পরিচিত হয় নাগরিকত্বহীন ‘আটকেপড়া পাকিস্তানি’ হিসেবে। যদিও কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারের আন্তরিকতা এবং ভারতীয় সৈন্যদের হস্তক্ষেপে ব্যাপক বিহারি হত্যাযজ্ঞ ঘটেনি। বাংলাদেশ দরকার ৬৬ টি শিবিরে এদের আশ্রয় দেবার ব্যবস্থা করে।
[১৮৯] আবু মো. দেলোয়ার হোসেন

মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হয়েছিল এ কথা যেমন সত্যি, একই ভাবে একথাও সত্যি যে, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তান পরাজিত হলেও তাদের ভাবধারার অনুসারী ব্যক্তিরা এদেশে কম ছিলনা যারা এই পরাজয় মেনে নেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী প্রভৃতি দলের ৩৭ হাজার নেতা ও কর্মীকে দালালির অভিযোগে গ্রেফতার করা হলেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুযোগে এদের দুই তৃতীয়াংশেরও অধিক কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছিল। তখন থেকেই এরা পাকিস্তানের পক্ষে এবং ভারতের বিপক্ষে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রচারণায় লিপ্ত হয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলেও এদের প্রতিনিধি ছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর অনেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখেছেন। অধিকাংশ লেখাই লেখকের নিজস্ব মতাদর্শের আলোকে রচিত হয়েছে, যা মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাংগ ইতিহাস হয়ে ওঠেনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে যাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাঁরা যতটা আগ্রহী, প্রকৃত আগ্রহীরা এ বিষয়ে খুব কমই আগ্রহ দেখিয়েছেন। এসব গ্রন্থে পাকিস্তানি

৪৫৮

হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিবরণ আছে, মুক্তিবাহিনীর সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরোধ যুদ্ধের বিবরণ আছে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দালালদের কার্যকলাপের কথাও আছে, কিন্তু দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা সর্বত্র দুর্ভাগ্যজনক ভাবে অনুল্লেখিত থেকেছে। এর ঠিক বিপরীত চিত্র পাওয়া যায় ভারতে। সেখানে অধিকাংশ লেখকের রচনায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রসংগটি যথাযথ ভাবে আসেনি। কোন কোন ভারতীয় লেখক বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে মনে করেন একাত্তরের পাক ভারত যুদ্ধের ফসল। অথচ এই দুই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিই একদেশদর্শী এবং সাম্প্রদায়িকতা ও জাত্যাভিমান প্রসূত।
ভারতের অবদানের কথা উল্লেখ না করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস কখনো লেখা যাবেনা। অথচ দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, গত ২৫ বছরে এ বিষয়ে ভারত বা বাংলাদেশে প্রামাণ্য কোন গ্রন্থ রচিত হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে কোথাও ভারতের সামরিক শায্যের বকথা বলা হয়েছে, কোথাও রাজনৈতিক সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে, কোথাওবা এই সহযোগিতার পেছনে ভারতের নানাবিধ দুরভিসন্ধি আবিষ্কারের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু ভারতের সাহায্যের সামগ্রিক দিক কখনো আলোচিত হয়নি। না হওয়ার কারণ সরকারের ভারতবিদ্বেষী মনোভাব এবং শিক্ষিত মধ্যশ্রেনীর একটি বড় অংশের সাম্প্রদায়িক মনোভাব। সাতচল্লিশ এর পর থেকে আমলা ও সামরিক বাহিনীকে গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে মৌলবাদী ভাবধারায়, সাম্প্রদায়িক চেতনা তাদের চেতনায় বহুদূর অবধি তাদের শেকড় বিস্তার করেছে। যে কারণে সামরিক বাহিনীর অনেক সদস্য এবং সরকারি আমলা ও রাজনৈতিক নেতাদের অনেকে ঘটনাচক্রে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত হলেও তাদের চেতনা থেকে পাকিস্তানি ভাবধারা নয়মাস পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরেও দূর হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তারা ভারতীয় সাহায্যের ভিতর স্বীকৃতি দিতে কেন বিলম্ব করছে- এ নিয়ে অনেক সমালোচনা করেছে। এবং স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে ভারতবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক প্রচারণায় অংশ নিয়েছে। এসব কারণেও মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা অনালোচিত রয়ে গেছে।
১৯৯৫ সালে সারা ইউরোপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছে। এর প্রস্তুতি ৯৪ সাল থেকেই চলছিল। মিত্রবাহিনীর যোদ্ধাদের সারা পৃথিবী থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। তাঁদের সংবর্ধিত করা হয়েছে সাড়ম্বরে, টেলিভিশনে তাঁদের স্মৃতিচারণের পাশাপাশি ৫০ বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সাফল্যের প্রামান্যচিত্র সমূহ প্রদর্শিত হয়েছে। ৫০ বছর পরেও মিত্রবাহিনীর বীর যোদ্ধা এবং নিহতদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছে নাৎসি ও ফ্যাসিস্ট বাহিনী কবলিত, পূর্ব-পশ্চিম ইউরোপ ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলো।

৪৫৯

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রজতজয়ন্তী উদযাপন করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি নিয়েছে। সরকারিভাবে সামরিক মহড়া, কুচকাওয়াজ, জেলখানা, হাসপাতাল ও এতিমখানায় উন্নতমানের খাবার পরিবেশনের কর্মসূচি নিয়েছে। সরকারি বা বেসরকারি কোন উদ্যোগের ভিতর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে যে দেশটি সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে, যাদের সাহায্য ছাড়া বিজয় অর্জন ছিল সুদূরপরাহত, তাদের অবদান স্মরণ করার কোন কর্মসূচি স্থান পায়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারতীয় সামরিক বাহিনীর যেসব সদস্য শহীদ হয়েছেন তাদের অবদানও গত ২৫ বছরে সরকারিভাবে স্বীকার করা হয়নি। যদিও ব্যক্তিগত আলোচনায় বহু মুক্তিযোধা যাদের ভিতর সামরিক বেসামরিক উভয় গোত্রের ব্যক্তি রয়েছেন, তাঁরা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান অস্বীকার করাটা হবে চরম অকৃতজ্ঞতার পরিচায়ক।

ভারতীয় সাহায্যের রাজনৈতিক ও মানবিক প্রসঙ্গ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্যের প্রধান বিবেচনা ছিল রাজনৈতিক। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অনেকে বলে থাকেন ভারত তার জন্মশত্রু পাকিস্তানকে দুইপাশে রেখে প্রথম থেকেই খুবই অস্বস্তিতে ছিল। কারণ দুই সীমান্তে প্রতিরক্ষার জন্য ভারতকে বিপুল ব্যয়ভার বহন করতে হচ্ছিল। যখন পাকিস্তানকে ভাঙার সুযোগ পাওয়া গেছে ভারত সঙ্গে সঙ্গে তা লুফে নিয়েছে। পাকিস্তানি গবেষক ও ঐতিহাসিকদের মত এ দ্ধরনের মত বাংলাদেশের একাধিক লেখকও পোষণ করেন। বিশেষ করে যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই পাকিস্তানকে অখন্ড দেখতে চেয়েছে। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী সরদার আব্দুল কাইয়ুম খান গত ৭ জানুয়ারি ৯৬ তারিখে ভারতের এক বেসরকারি টেলিভিশন নেটওয়র্কে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে ভারতের সৃষ্টি।
ভারতে একধরণের বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধী ক্রমবর্ধমান নকশাল আন্দোলনকে দমন করার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। তারা আরো বলে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ইন্দিরার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতের এসব মতের লেখক গবেষকদের বক্তব্যে কিছুটা সত্যতা রয়েছে বটে কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে – সাংবিধানিকভাবে ভারত হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ আর পাকিস্তান একটি ধর্মভিত্তিক দেশ যা অধিকাংশ সময় শাসিত হয়েছে প্রত্যক্ষ সামরিক শাসনের অধীনে। পাকিস্তান প্রথম থেকেই যেমন ভারতের জন্য সামরিক হুমকি ছিল, একই সঙ্গে ভারতের সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাজনীতিরও বিরোধী ছিল। পাকিস্তানের বিবেচনায় ভারত একটি হিন্দু

৪৬০

রাষ্ট্র এবং হিন্দুরা হচ্ছে মুসলমানের শত্রু। পাকিস্তানের এই বিবেচনা ভারতের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিলনা। ।৭০ এর নিরবাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের বিজয়ে ভারত আশাবাদী হয়েছিল এ কারণে যে, এর ফলে পাকিস্তানে গণোতন্ত্র ফিরে আসবে এবং সামরিক উন্মাদনা কম্বে। যেহেতু বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক দর্শন, এর ধর্ম নিরপেক্ষ ছরিত্রও ভারতের জন্য ছিল স্বস্তিদায়ক। এ কারণে ভারত চেয়েছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসুক।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান যখন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি করে, তখন স্বাভাবিক কারণেই ভারত উদ্বিগ্ন হয়েছিল। ২৫ মার্চে বাংলাদেশের নিওরস্ত্র জনসাধারণের উপর পাকিস্তানের নজিরবিহীন আক্রমণ, ২৬ মার্চ বেতারে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ইয়াহিয়ার ভাষণে শেখ মুজিবকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা ভারতকে প্রচন্ডভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। ২৫ মার্চ থেকে ভারতীয় হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে যে নৃশংস গণহত্যা, নির্যাতন ও লুন্ঠন শুরু করেছিল, যেভাবে লক্ষ লক্ষ সহায় সম্বলহীন মানুষ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছিল, যেভাবে ভারতের পূর্বাঞ্চলের বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্যগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করার জন্য দিল্লির উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করছিল, সেসব ঘটনা বিশ্লেষণ করলে একথাই বলতে হয় বাংলাদেশকে তখন সাহায্য করা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জন্য নৈতিক কর্তব্য শুধু নয়, রাজনৈতিক দ্বায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভারতের তৎকালীন নীতিনির্ধারকরা এ কথাও দ্বিধাহীন কন্ঠে স্বীকার করেছেন, পূর্বাঞ্চলের বাংলাভাষী রাজ্যগুলোতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের পক্ষে যে প্রচন্ড জনমত গড়ে উঠেছিল সেটা যদি দিল্লী উপেক্ষা করত তাহলে পশ্চিমবঙ্গই ভারতের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারত।
১৯৪৭ সালে ধর্মীয় দ্বি জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত বিশাল ভারত দ্বারা বিচ্ছিন্ন বারোশ মেইল দূরত্বের দুটো ভূখন্ডকে পাকিস্তান হিসেবে আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্র গঠনের গোড়াতেই গলদ ছিল। ‘৪৮ সালে পাকিস্তানের আইনপরিষদে যখন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবী জানান, পাকিস্তানের প্রধানম্নত্রী তখন ভারতীয় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়ে সেই দাবি মানতে অস্বীকার করেন এবং তখন এই কৃত্রিম রাষ্ট্রের মৃত্যুঘন্টা বেজেছিল। ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪ এর নির্বাচনে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে যুক্তফ্রন্টের বিজয় এবং মুসলিম লীগের ভরাডুবি, ‘৬২ এর ছাত্র আন্দোলন, ‘৬৬ সালের ৬ দফার আন্দোলন, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচনে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত নির্মাণ করেছে। ৫৭ সালে

৪৬১

কাগমারী সম্মেলনে মাওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম জানিয়ে কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন- ‘লাকুম দ্বীঙ্কুম ওলিয়া দ্বীন’ (তোমরা তোমাদের পথে থাক, আমরা আমাদের পথে থাকব)। এসবই বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছে। মওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা বলেন, কাগমারী সম্মেলনের পর তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আলোচনের জন্য। নেহরু নাকি তখন বলেছিলেন, এখনো সময় হয়নি। শেখ মুজিব ৬ দফা ঘোষণার অনেক আগে ‘৬২ সালেই যে গোপনে বাংলাদেশ মুক্তিফ্রন্ট গঠন করেছিলেন, এ বিষয়ে ততকালীন ছাত্রলীগ নেতাদের কয়েকজন তখন থেকেই জানতেন।
যে বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচিত হওয়া দরকার ‘৭১ এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার আগে ভারত এ বিষয়ে কিছু জানত কিনা। পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সরকার যদিও ৪৮ সাল থেকেই বাঙালির প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ভারতের এবং কমিউনিস্টদের ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ কে ফজলুল হক ও মওলানা ভাসানীকে ভারতের দালাল বলেছে এবং ছয়দফা ঘোষণার পর শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেছে- তারপরও এটা জানা প্রয়োজন ভারত কি ২৬ মার্চের আগে কিছুই জানত না?
সরকারিভাবে ভারত অবশ্য সবসময় বলে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার আগে তারা এ বিষয়ে কিছু জানত না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন, ‘শেখ মুজিব কিংবা পূর্ববাংলায় তাঁর পার্টির সঙ্গে তখন আমাদের কোন যোগাযোগই ছিলনা। আমরা জানতাম না সেখানে কি ঘটছে। আমরা পত্রিকায় পড়েছি সমঝোতার জন্য আলোচনা চলছে। পরে, অনেক পরে এখানে আসার মাত্র এক সপ্তাহ আগে, এই আলোচনায় ছিলেন এমন একজন আমাকে বলেছেন, ২৪ তারিখেও (মার্চ ১৯৭১) তাঁরা ভেবেছিলেন আলোচনা পুরোপুরি সন্তোষজনক না হলেও একটা সমাধানে আসা যাবে। কিন্তু এ সময়টা তারা (সামরিক জান্তা) ব্যবহার করেছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনার জন্য’। (নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ভাষণ, ৬ নভেম্বর ‘৭১, বাংলাদেশ ডকুমেন্টস দ্বিতীয় খন্ড পৃ. ২৭৩, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ভারত।
২৫ মার্চের পর থেকে পাকিস্তান সরকার যেভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারতের চক্রান্ত’ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ‘ভারতের এজেন্ট’ বলছিল তখন যৌক্তিক কারনেই ভারতকে বলতে হয়েছিল এ বিষয়ে তারা কিছুই জানত না। কিন্তু শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ মুক্তিফ্রন্ট গঠনের পর থেকেই ভারত এ ব্যাপারে জানত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শেখ মুজিবুর রহমানের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী

৪৬২

জানিয়েছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারত সহযোগিতা করবে এ প্রতিশ্রুতি ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়েই বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া হয়েছিল। ষাটের দশকে ছাত্রলীগের একজন নেতা, যিনি তৎকালীন আওয়ামী লীগের গোপন সংগঠন বাংলাদেশ মুক্তিফ্রন্টের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন, তিনি আরো স্পষ্ট ভাবে বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রস্তুতি বঙ্গবন্ধু ষাটের দশকের শুরু থেকেই নিচ্ছিলেন। ভারতের সঙ্গে তখন থেকেই তার যোগাযোগ ছিল। তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা, বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, একাত্তরে মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পাকিস্তানীদের একটি সাজানো মামলা হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রস্তুতি বঙ্গবন্ধু একাত্তরের অনেক আগে থেকে নিচ্ছিলেন এবং ভারত সরকার এ বিষয়ে শুধু অবগতই ছিলনা, সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
মুজিব বাহিনীর তৎকালীন নেতা, এক সময়ের কাজী আরেফ আহমেদ এই বক্তব্য সমর্থন করে বলেছেন ‘এই সত্য যদি অস্বীকার করা হয় তাহলে ধরে নিতে হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘ক্রাক ডাউন’ এর জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা কিন্তু আগে থেকেই জানতাম বঙ্গবন্ধু সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আমাদের ছেলেদের গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ কিভাবে হবে, অস্ত্র কিভাবে আসবে, এসব ই আগে থেকে ঠিক করা ছিল। মুজিব বাহিনী গঠন সম্পর্কে এর নেতারা বলেন, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে নেতৃত্ব যেন কমিউনিস্ট বা চরমপন্থীদের হাতে চলে না যায় সেজন্য বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শে সজ্জিত একটি বাহিনী দরকার ছিল। প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতাদের ভিতর এ বিষয়ে যিনি সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী ছিলেন যাকে বঙ্গবন্ধু সত্তরের ফেব্রুয়ারীতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে স্বাধীনতা সম্পর্কে আলোচনার জন্য ভারতে পাঠিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, খন্দকার মোশতাক ছাড়াও মুজিবনগর সরকারের ভেতর বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন, যাঁরা জুলাই থেকে আমেরিকা ও ইরানের মাধ্যমে পাকিস্তানের দাবী প্রত্যাহার করে সত্তরের নিরবাচনের মূল দাবী ছয়দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের ব্যাপারে তাদের উদ্যোগ অনেকদূর এগিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের মাঝপথে যাতে আওয়ামী লীগের কোন নেতা বা সরকারের কেউ আপসের চেষ্টা না করতে পারে সেজন্য মুজিব বাহিনী গঠন জরুরী হয়ে পড়েছিল।

মুজিব বাহিনী গঠন ঠিক ছিল কি ভুল ছিল এ বিতর্কে না গিয়ে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় এক্ষেত্রে ভারতের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং তাঁর উপদেষ্টাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে ইন্দিরা গান্ধী খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শুধু এ ক্ষেত্রে নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন

৪৬৩

করতে গিয়ে তিনি বহু রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন যেখানে তিনি ‘বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন’ জানিয়েছিলেন। ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার যে ঘোষণা প্রদান করেন সেখানে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি দানের আবেদন ছিল। ভারতীয় বেতার আকাশবানী থেকেও এই স্বীকৃতি প্রদানের আবেদন প্রচার করা হয়েছে। মার্চের ৩০ ও ৩১ তারিখে কলকাতার কংগ্রেস, সিপিআই, সিপিএম, ফরোয়ার্ড ব্লক প্রভৃতি দলের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতি’, ‘বাংলাদেশ সংহতি ও সাহায্য কমিটি’ গঠন করা হয়। আনন্দবাজারে ২ এপ্রিল তারিখে প্রকাশিত ‘মুক্তিসংগ্রামীদের সাহায্য দানে সংস্থা গঠন’ শিরোনামের এক সংবাদে এসব কমিটি গঠনের খবর ছাপা হয়েছে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির সভাপতি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়। কার্যকরী সভাপতি ছিলেন উপ-মুখ্যমন্ত্রী বিজয় সিং নাহার এবং সহসভাপতি ছিলেন অধ্যাপক সমর গুহ এম পি। সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সংহতি ও সাহায্য কমিটির সভাপতি ছিলেন জ্যোতিবসু, সাধারণ সম্পাদক সুধীন কুমার এবং কোষাধ্যক্ষ ছিলেন কৃষ্ণপদ ঘোষ। ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতি’ গঠিত হয় সিপিআইয়ের উদ্যোগে। এসকল সংস্থা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকম সাহায্য প্রদানের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেবার জন্য কেন্দ্রের প্রতি আহবান জানায়। এ ছাড়া বিশিষ্ট শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরাও মার্চের ৩০ তারিখ থেকে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে অনুরূপ দাবি জানান।

স্বীকৃতির বিষয়টি কৌশলগত কারণে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রথম দিকে এড়িয়ে গেছেন কিন্তু অন্যান্য সহযোগিতার বিষয়ে তিনি প্রথম থেকেই পরিষ্কার বক্তব্য রেখেছেন। এবং সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করেছেন। ১ এপ্রিল ৭১ তারিখে ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভারতের জনগণ পূর্ব বাংলার পাশেঃ সংসদে প্রস্তাব’ শিরোনামে এক সংবাদে বলা হয়-
‘ভারতের জনগন পূর্ববাংলার পাশে আছে। বুধবার সংসদে সর্বসম্মত এক প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে ওদের সংগ্রাম, ওদের আত্মবিসর্জন ব্যররথ হবেনা, ভারতের সর্বান্তঃকরণ সহানুভূতি এবং সাহায্য ওরা পাবেন।’ এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সংসদের উভয় কক্ষে তুমুল হর্ষধ্বনি ওঠে, উল্লাস বয়ে যায়।
‘দুই পৃষ্ঠা ব্যাপী প্রস্তাব উত্থাপন করলেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। তাতে পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানকে অভিনন্দিত করা

৪৬৪

তো হলোই, উপরন্তু অভিব্যক্ত হল তাঁরা যে জয়যুক্ত হবেন এই দৃঢ় বিশ্বাস ও আশা।
আমাদের নয়াদিল্লীর বিশেষ সংবাদ দাতা জানাচ্ছেনঃ
সংসদের দুই সভাতেই প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন এবং বিনা আলোচনায় সর্বসম্মতিক্রমে সেটি গৃহীত হয়। লোকসভায় প্রস্তাবটি গৃহীত হবার পর রাজ্যসভার অনুমোদন লাভের জন্য শ্রীমতি গান্ধী প্রস্তাবটি নিয়ে যান।
সভায় তখন বিরাজ করছিল থমথমে নীরবতা। সংসদের দৃঢ় বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রীর উদাত্ত কন্ঠে ভাষা পায়ঃ পূর্ববাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের ‘জয় হবেই’।
শ্রীমতি গান্ধী যখন বাংলাদেশের মানুষের এই সংগ্রাম ও আত্মোৎসর্গে ভারতের জনগণের সর্বান্তঃকরণ সহানুভূতি ও সমর্থনের আশ্বাস দেন। উভয় সভাই তখন দীর্ঘস্থায়ী করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, পূর্ববাংলার জনগণের নির্বাচনে জয়ের পরই আমাদের বীর প্রতিবেশীদের যে মর্মান্তিক দুঃসময় এসেছে, তা তাদের দুঃখ দুর্দশার সঙ্গে আমাদেরও একাত্ম করেছে। তাদের সুন্দর দেশের উপর যে ধ্বংসলঈলা চলছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন।
প্রধানমন্ত্রী জানান, বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর এই প্রস্তাবটি প্রণয়ন করা হয়েছে এবং তাদের সর্বসম্মত অনুমোদন পেয়েছে। সভার সকল অংশের হর্ষধ্বনির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিবৃতি দিতে ওঠেন।
প্রস্তাবটি উত্থাপন করী প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে ভারতের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
প্রস্তাবে যা হয়েছে, পূর্ববঙ্গের সমগ্র জনগনের আশা আকাংখাকে দমনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি করা সশস্ত্র বাহিনীকে সেখানে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে সেখানকার জনগণ নির্ভুলভাবে যে বাসনা ব্যক্ত করেছেন, পাকিস্তান সরকার তা মেনে না নিয়ে জনগণের সেই রায়কে অমান্য করার নীতি বেছে নিয়েছে।
পাকিস্তান সরকার আইনসম্মতভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে শুধু অস্বীকারই করেনি, উপরন্তু জাতীয় পরিষদকে তাদের ন্যায্য ও সার্বভৌম ভূমিকা নিতে একতরফাভাবে বাধা দিয়েছে। বন্দুক, কামান, ট্যাংক, বিমান ও গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে নগ্ন বল প্রয়োগের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের কন্ঠরোধ করা হচ্ছে।

ভারত সরকার ও ভারতের জনগন সবসময়ই পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ, স্বাভাবিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করে এসেছে। একই উপমহাদেশের অধিবাসী হিসেবে ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও

৪৬৫
ঐতিহ্যের দিক দিয়ে তাদের বন্ধন যুগ যুগ পুরাতন। এই অবস্থায় আমাদের সীমান্তের এত নিকটে যে মর্মান্তিক হত্যালীলা চলছে তাতে সভা উদাসীন থাকতে পারেনা। নির্দোষ, নিরীহ মানুষের উপর এই যে অভূতপূর্ব, ভয়াবহ অত্যাচার চলছে আমাদের দেশের সব অঞ্চলের মানুষ স্বার্থহীন ও দ্বিধাহীন ভাষায় তার নিন্দা করেছেন।
প্রস্তাবে আরো বলা হয়, শান্তি ও মানবিক অধিকারের প্রতি ভারতের যে আস্থা আছে, তার কথা স্মরণ করে সভা অবিলম্বে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের উপরবল প্রয়োগ বন্ধের দাবি জানাচ্ছে।’
৪ এপ্রিল নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে তার উদ্বেগের কথা আবারও ব্যক্ত করেন। ‘বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত নীরব দর্শক থাকতে পারেনা-প্রধানমন্ত্রীশিরোনামের সংবাদে ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার খবরটি ছিল নিম্নরূপঃ
‘প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আজ এখানে নিখিল ভারতীয় কংগেস কমিটির অধিবেশনে ঘোষণা করেনঃ ভারতের সীমান্তের ওপারে পূর্ববাংলায় যা ঘটছে, তাতে ভারতের পক্ষে নীরব দর্শক হয়ে থাকা সম্ভব নয়-বাঞ্ছনীয়ও নয়। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সমাপ্তি ভাষণে এই মন্তব্য করায় সদস্যরা বিপুল হর্ষধ্বনি করে ওঠেন।
শ্রীমতি গান্ধী বলেন, ভারত কোন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোনদিন নাক গলায় নি। সেই সঙ্গে বিশ্বের কোন অংশে উৎপীড়ন বা অন্যায় ঘটলে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানাতে ভারত কোনদিন কার্পণ্য করেনি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা মোটেই স্বাভাবিক নয়। সারা পৃথিবীতে এতে প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে।
শ্রীমতী গান্ধী বলেন, এই মূহুর্তে আমরা পূর্ববাংলার জনগণকে কী ধরনের সাহায্য করতে পারি তা মাথা ঠান্ডা করে আমাদের ভেবে দেখতে হবে। তিনি আরো বলেন, পূর্ববাংলার পরিস্থিতিতে যে এ দেশের লোকজন কতোটা উদ্বিগ্ন, তা এখন সুবিদিত।এ ব্যাপারে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ দেখে তিনি খুশি।
বাংলাদেশকে সাহায্য প্রদানে আগ্রহী জনমত ইন্দিরা গান্ধীর এই উদ্বেগ এবং সাহায্যের প্রতিশ্রুতিকে পর্যাপ্ত মনে করেনি। প্রায় প্রতিদিন পত্রিকায় কোন না কোন সংগঠন সংবাদ, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিবৃতি কিংবা লেখা ছাপা হয়েছে যেখানে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবি জানানো হচ্ছিল।
১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রদানের অনুষ্ঠানে শতাধিক বিদেশী সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, তাঁদের ভাষণে বারবার বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতি আবেদন জানিয়েছেনঃ আপনারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন।

৪৬৬
আপনারা আমাদের সংগ্রামে সাহায্য করুন। আপনারা ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করুন, যাতে সে তার হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়।’ (আনন্দবাজার পত্রিকা- ১৮ এপ্রিল ‘৭১)
প্রখ্যাত কথা শিল্পী এবং আনন্দবাজার পত্রিকার তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক সন্তোষ্কুমার ঘোষ ৩০ এপ্রিল আনন্দবাজারের উপসম্পাদকীয় পাতায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিকট একে মর্মস্পর্শী চিঠি লেখেন। ‘প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বরাবরেষু’ শিরোনামের খোলা চিঠিতে এই খ্যাতিমান কথাশিল্পী লিখেছেন-
‘প্রধানমন্ত্রী আপনি বাংলাদেশকে এখনো স্বীকৃতি দেননি। জানিনা অন্য কোন সাহায্য দিয়েছেন কিনা। সীমান্তের কয়েকটি অংগনে ঘুরে কোন প্রকার সাহায্যের বিশেষ কিছু চিহ্ন চোখে পড়েনি। সম্ভবত কূটনৈতিক কান্ডজ্ঞান এখনো আপনার হাত বেঁধে রেখেছে। এই সংকোচের মানে বুঝি। কিন্তু দুনিয়ার বাকি সকলে? তারাও বোঝেতো? যতদূর টের পাচ্ছি, সবাই ধরে নিয়েছে, আমরা এর মধ্যে আছি। সেটা যদি রটেই থাকে, তবে আর অহেতুক লজ্জায় কাজ কি? জানি না, আমরা কখনো কোন ভরষা ওপারের মুক্তিকামীদের দিয়েছিলাম কিনা। হয়ত দিইনি। দিয়ে থাকলে কিন্তু আজ পশ্চাদপসরণের কোন অর্থ নেই, কোন ক্ষমা নেই। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর একটি দুটির সক্রিয় হস্তক্ষেপের অপেক্ষা করছেন? যথা, আমেরিকা? আজ স্বতঃই ধারণা করা হয়, আওয়ামী নেতাদের বুঝিবা প্রতারিত করেছে আমেরিকাও। পিন্ডির স্থায়িত্বেই সম্ভবত ভূমন্ডলের এই ভাগে মার্কিন মন আর স্বার্থ আবদ্ধ। অন্যদের কথা না বলাই ভাল। আওয়ামী লীগ চরিত্রগত ভাবে বস্তুত এদেশের প্রাক স্বাধীনতা কালের কংগ্রেস। জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া দলের মাধ্যমে এতবড় জাগরণ ঘটেছে, এটা কোন বামপন্থী দলের বিশ্বাসই হয়না। এদেশেও এই সত্যটা মেনে নিতে প্রগতিবাদীদের খারাপ লাগে। নানা খুঁত তারা বের করেন আওয়ামী নেতৃত্বের। দলীয় অপ্রস্তুতির, শেখ সাহেবের অন্তর্ধানের।
‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ত্রুটি ছিলনা, এ কথা বলছিনা। দুরদৃষ্টির অবশ্যই অভাব দেখা গেছে। অভাব দেখা গেছে সংগঠনেরও তবু সব সত্ত্বেও যা ঘটেছে, আজও ঘটছে, তা অবিশ্বাস্য অলৌকিক। ভাষাকে ‘মা’ বলা, সেই মায়ের ভিতর দিয়ে দেশকে মাতৃরূপে গ্রহন করা – এসব সহজ ধারনার অতীত। পৃথিবীতে মানুষ এ যাবত করেছে নিজের জিগীষা মেটাতে, করেছে নারীর জন্য। অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধেও করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংগ্রাম এতো শুধু অর্থনীতির জন্য নয়। এ যে সংস্কৃতির জন্য! সাহিত্য আর সংস্কৃতির কি এতোই শক্তি। আমরা যারা সাহিত্য সংস্কৃতি ভাঙিয়ে খাই, তারাও এতোটা জানিনি। না আমাদের মধ্যে, না অন্যত্র এর পরিচয় পাইনি। ‘
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ভারতের বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা তখন

৪৬৭

সামগ্রিক পরিস্থিতি কিভাবে মূল্যায়ন করেছেন এটি হচ্ছে তার সাধারণ চিত্র। এই লেখায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের চাপও স্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিষয়টি সরকারিভাবে ভারতের বিবেচনায় ছিলনা। বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হচ্ছিল এভাবে যে, ভারত বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চায়। ইয়াহিয়ার উচিত নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ভারত গণহত্যার নিন্দা জানিয়েছে কঠোর ভাষায়। বাংলাদেশের সহায় সম্বল ছাড়া মানুষদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছে, মুক্তি সংগ্রামীদের সাহায্য করছে কিন্তু স্বীকৃতি দানের বিষয়টি সেই মূহুর্তে ভারতের জন্য খুবই স্পর্শকাতর ছিল। কারণ ২৬ মার্চের পর থেকেই পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো এবং গণচীন বাংলাদেশের সমস্যাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা মনে করেছে এবং ভারতের ‘উস্কানিমূলক’ আচরণের সমালোচনা করেছে।
৪ এপ্রিল যুগোস্লাভ সংবাদ সংস্থা তানযুগ এর সংবাদদাতা পিকিং থেকে জানাচ্ছেন, ‘চীনা পত্রিকাগুলো এই প্রথম বাংলাদেশ সম্পর্কে খবর দিয়েছে। তারা কোন মন্তব্য করেনি, কিন্তু এমনভাবে তথ্য প্রকাশ করেছে, যা থেকে মনে হয় যে, সেখানকার (বাংলাদেশের) পরিস্থিতি গুরুতর ও জটিল। ভারত পাকিস্তানের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে -পাকিস্তানের এই অভিযোগ চীনা পত্রিকাগুলো ফলাও করে ছেপেছে।’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ এপ্রিল ‘৭১)

ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও শ্রমিক দলের এমপি পিটার শোর যখন বাংলাদেশের মানুষের উপর ইয়াহিয়া খান সরকারের বর্বর অত্যাচারের প্রতিবাদ জানান এবং এ ব্যাপারে অনেক ইংল্যান্ডবাসীর ক্ষোভের কথা পাকিস্তানকে জানানোর জন্য পররাষ্ট্র সচিব স্যার আলেক ডগলাস হিউম কে অনুরোধ করেন, তখন স্যার আলেক গণহত্যার ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করলেও এ কথা তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ‘পাকিস্তান একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। পাকিস্তান সরকারের রাজনৈতিক ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাইনা।’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ এপ্রিল ‘৭১)
একই ধরণের মত মার্কিন সরকারও তখন পোষণ করত। ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শদাতারা জানিয়েছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ছাড়া যেহেতু বিশ্বের সকল গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র মার্কিন প্রচারণার প্রভাবে এটা বিশ্বাস করত যে, ভারত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গোলযোগ সৃষ্টি করছে সেজন্য তাদের ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান বিলম্বিত করেছে।
ইন্দিরা গান্ধীর এই মনোভাবকে কোন কোন বিরোধী রাজনৈতিক দল

৪৬৮

কিংবা পত্রিকার কলাম লেখক সুনজরে দেখেননি। সন্তোষকুমার ঘোষের মত কংগ্রেস সমর্থকও যেমন তির্যক মন্তব্য করেছেন। ইন্দিরা গান্ধীর এক্ষেত্রে করার কিছু ছিলনা। পরে প্রমাণিত হয়েছে তিনি তড়িঘড়ি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে পরিস্থিতি খুবই জটিল হতে পারত, যা সামাল দেওয়া ভারতের পক্ষে খুবই কঠিন হত।
বাংলাদেশ সরকারও স্বীকৃতিদানের জন্য প্রথম থেকে ভারতের উপর চাপ দিচ্ছিল। ৬ মে স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচার করা হয়, ‘ভারত এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে।’ এর আগে বাংলাদেশ সরকারের এক মুখপাত্র ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার প্রতিনিধিকে জানিয়েছিলেন,
‘আগামী সাত দিনের মধ্যেই অন্তত চারটি দেশ নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। এই রাষ্ট্রগুলো হলঃ এশিয়ার সিঙ্গাপুর ও বার্মা এবং ইউরোপে ফ্রান্স ও যুগোস্লাভিয়া। ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার স্বীকৃতিও মন্ত্রীসভা আশা করছেন।’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ এপ্রিল ‘৭১)
৭ মে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য কেন্দ্রের প্রতি আহবান জানিয়ে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। একই দিন নয়াদিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য এক বৈঠকে বসেছিলেন। ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার এতদসংক্রান্ত সংবাদের শিরোনাম ছিল-‘এখনই ভারতের স্বীকৃতি বাংলাদেশের অনুকূল হবেনা/ তবে মুক্তি আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন দেয়া হবে- প্রধানম্নত্রী। নয়াদিল্লী থেকে বিশেষ সংবাদ দাতা প্রেরিত এই সংবাদে বলা হয়-
আজ সকালে বিরোধী নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বৈঠকে বসেছিলেন। প্রায় সকলেই বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেবার দাবী জানান। (ব্যতিক্রমঃ বিকানীরের মহারাজা ড. করণ সিং এবং মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ ইসমাইল। দুজনের বক্তব্যে অবশ্য কিছু পার্থক্য ছিল।) সকলের কথা শোনার পর প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তার মর্ম এইরকমঃ বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের প্রতি ভারত পূর্ণ সমর্থন জানাবে কিন্তু বাংলাদেশকে এখনই কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া ঐ দেশেরই স্বার্থের পরিপন্থী হবে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি প্রচুর সহানুভূতি থাকলেও স্বীকৃতির ব্যাপারে ভাবনা চিন্তা চলছে। তবে তাজউদ্দীন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হবেনা – এমন কথা তিনি বলেননি বা সরকার এ ব্যাপারে ঠিক কি করবেন তার কোন আভাস দেননি। শুধু স্পষ্টভাবে তিনি বলেন যে, কোন অবস্থাতেই ভারত ভীত নয়।
ইন্দিরাজি বলেন যে, পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে নানা উস্কানিমূলক কাজ করছে। ভারতকে নানা ভাবে বাংলাদেশের ব্যাপারে জড়াতে চাইছে। যাই হোক,

৪৬৯

ভারত যা ঠিক মনে করবে তা করতে ভীত নয়।
দুই ব্যতিক্রম। অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবীর বিরোধীতা করেন বিকানীরের মহারাজা ড. করণ সিং। তিনি লোকসভার কয়েকটি চোট গোষ্ঠী ও কয়েকজন নির্দল সদস্যের নেতা। সেই গোষ্ঠী ও ব্যক্তিরা অবশ্য আগেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার দাবি জানিয়েছেন।
ড. করণ সিং এর বক্তব্যঃ বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন আসলে ‘বাঙালিদের বিদ্রোহ’। ভারতে এ ধরনের ব্যাপার ঘটলে সরকার কী করতেন? কাশ্মীরের কথাও ভাবা দরকার।
ইন্দিরাজি তাঁকে বলেনঃ কাশ্মীরে যারা হাঙ্গামা বাঁধাতে চায় তারা জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীদের পেছনে বিপুল গরিষ্ঠ সমর্থন রয়েছে। বাংলাদেশে গরিষ্ঠ অভিমত পাকিস্তান দাবিয়ে রাখতে চাইছে।

মুসলিম লীগ নেতা মহম্মদ ইসমাইল যা বলেন তার মর্মঃ এমন কিছু করা ঠিক হবেনা যাতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে বা কোন সংকট সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে ঐধরনের সংকট দেখা দিতে পারে। তবে সরকার এ ব্যাপারে যেকোন ব্যবস্থাই নিক না কেন তার প্রতি তার দলের সমর্থন থাকবে।
ইন্দিরা গান্ধী বলেন যে, বাংলাদেশের ব্যাপারকে কেন্দ্র করে কিছু লোক সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চাইছে। সকলকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
স্বীকৃতির সপক্ষে জোর দাবি। অধিকাংশ বিরোধী নেতা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য জোর দাবী জানান। পরিস্থিতি সম্পর্কে ইন্দিরাজির বিশ্লেষণ তারা মেনে নেননি। তাঁরা বলেন যে, বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। স্বীকৃতি দিয়ে সরকার শুধু সেই বাস্তব সত্যকেই মেনে নেবেন আর তাতে সেখানকার আন্দোলন জোরদার হবে। ভারত এ বিষয়ে দেরি করলে তাতে ভারতেরই ক্ষতি হতে পারে।
এই দাবি জানান – সিপিএম, সিপিআই, ডিএমকে, গনসংঘ, আদি কংগ্রেস, পিএপি, এসএসপি, ফঃ -বঃ, আরএসপি। শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত (সিপিআই) তাঁর দলের পশ্চিমবঙ্গ কমিটির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে একটি স্মারকলিপি দেন। শ্রী এ কে গোপালন (সিপিএম) বলেন যে, পাকিস্তানকে ভয় না করে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সবরকম সাহায্য দেয়া হোক, শ্রী কে মনোহরণ (ডিএমকে), শ্রী অটলবিহারি বাজপেয়ী (জঃ সঃ), শ্রী চিত্ত বসু (ফ. ব.), শ্রী ত্রিদিব চৌধুরী (আর এস পি), শ্রী এন জি গোরে (পি এস পি) ও শ্রী এল এন মিশ্র (আদি কং) একই দাবী তোলেন। বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দানের জন্য ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের গুরুত্বপূর্ণ

৪৭০

সদস্যরাও ইন্দিরা গান্ধীর উপর ক্রমশ চাপ বৃদ্ধি করছিলেন। এর সংগে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিল বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আগমন। জুলাইয়ের শেষের দিকে শরণার্থীর সংখ্যা ৬০ লক্ষ অতিক্রম করে। যার শতকরা ৭০ ভাগই ছিল পশ্চিমবঙ্গে। শরনার্থীদের প্রচন্ড চাপে তীব্র আর্থিক সংকটের পাশাপাশি আইনশৃংখলা ও যোগাযোগ পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেন্দ্রের উপর উপুর্যুপুরি চাপ দেওয়া হচ্ছিল শরনার্থীদের বোঝা বিভিন্ন রাজ্যের ভিতর ভাগ করে দেবার জন্য। সমস্যা বাধাল শরনার্থীরা। তারা পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাইল না। পশ্চিমবঙ্গে অজয় মুখার্জীর মন্ত্রীসভাকে প্রধানত আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি এবং শরণার্থীদের চাপে রাজ্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হওয়ায় পদত্যাগ করতে হয়। ২৫ জুন থেকে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হয়। কেন্দ্রের দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে পশ্চিমবঙ্গের গভর্নরের উপদেষ্টা বানিয়ে পাঠানো হয় মূলত বাংলাদেশের বিষয়ে তদারকি করার জন্য।
জুলাইয়ের শেষের দিকে বিশ্বের রাজনীতিতে একটা নাটকীয় ঘটনা ঘটল, যা ভারতের জন্য ছিল খুবই উদ্বেগজনক। পাকিস্তানের মধ্যস্ততায়, কিসিঞ্জারের দূতিয়ালিতে আমেরিকার সঙ্গে চীনের বরফশীতল সম্পর্কের অবসান ঘটল। এই ঐতিহাসিক ঘটনায় মধ্যস্ততার সুযোগ পেয়ে পাকিস্তান দুই বৃহৎ শক্তির প্রিয়পাত্রে পরিণত হল। ভারতের উপর আরো চাপ সৃষ্টির জন্য নতুন শক্তিতে বলীয়ান পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ২ আগস্ট ঘোষণা করল, ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে’ কারাগারে আটক শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করবে তারা। ভারতের সর্বস্তরের জনসাধারণ ইয়াহিয়া সরকারের এই ন্যক্কারজনক ঘোষণার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। দিল্লী, কোলকাতা, বোম্বে প্রভৃতি বড় বড় শহরে শেখ মুজিবের বিচারের উদ্যোগের প্রতিবাদ জানিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেছিল। ইন্দিরা গান্ধী সুস্পষ্ট ভাষায় পাকিস্তানকে জানিয়ে দিলেন শেখ মুজিবের বিচারের আয়োজন করা হলে এর পরিণতি ভাল হবেনা। তিনি এই বিচার প্রহসন বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে চিঠি লিখলেন। ৪ আগস্ট সংসদের সরকার ও বিরোধীদলের সদস্যরা এ সুযোগে আবারও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের কথা বললেন।
ঠিক যেরকম নাটকীয়ভাবে চীন মার্কিন সম্পর্ক ঘটেছিল একইভাবে ৯ আগস্ট ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। নয়াদিল্লীতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী শরণ সিং এবং সফররত সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রী আঁদ্রে গ্রোমিকো বিশ

৪৭১

বছর মেয়াদি এই মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ অংশ ছিল চুক্তিকারী দুটি দেশের কোনটি যদি তৃতীয় কোন রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হয়, অপর দেশ তার মিত্রের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। ভারত আক্রান্ত হলে সোভিয়েত এবং সোভিয়েত আক্রান্ত হলে ভারত তাকে সবরকম সাহায্য করবে। বিশ্বরাজনীতির নতুন মেরুকরণ প্রবাহে, পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশে গণহত্যা চালানো এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারতের সমর্থন দানের পটভূমিতে এই চুক্তি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, যা বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনসাধারণের মনোবল যেমন বাড়িয়েছে তেমনি ভারতের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিকেও উৎসাহিত করেছে। চুক্তির পরই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সামরিক সাহায্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায় এবং ভারত আরো দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশকে সাহায্যের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।
ভারতের উগ্র বাম কিংবা কিংবা দক্ষিণপন্থী দলগুলো অবশ্য ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তিকে সুনজরে দেখেনি। অতি বামরা সমালোচনা করেছে এই বলে যে, এর দ্বারা ভারত ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী’ সোভিয়েত ইউনিয়নের উপনিবেশে পরিণত হবে। দক্ষিণপন্থীরা বলেছে, এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ভারত তার জোটনিরপেক্ষ চরিত্র চরিত্র জলাঞ্জলী দিয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করার বিষয়ে ভারতের ডান, বাম ও মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো সোচ্চার হলেও প্রত্যেকটি দলেরই এ বিষয়ে নিজস্ব মূল্যায়ন ছিল। ভারতের সিপিআই (এমএল) এবং মুসলিম লীগ ছাড়া জনসংঘের (এই দলটি বিজেপি বা ভারতীয় জনতা পার্টি নামে পরিচিত) মত কট্টোর দক্ষিণপন্থী দলগুলোও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছে। আর চীনের বিরোধীতা সত্ত্বেও চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত সিপিআই (এম) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছে। সিপিআই (এম) এর সমর্থনের বিষয়ে এক ধরনের সতর্কতা ছিল। কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রী দলগুলোর ভিতর (সিপিআই) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থনের ক্ষেত্রে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে।

দেশের ভিতর বিরোধী দলগুলোকে বুঝিয়ে স্বমতে এনে কিংবা অতিবিরোধীদের শক্তহাতে দমন করে ইন্দিরা গান্ধী অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে নিরাপদ হলেও পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী আমেরিকা এবং পশ্চিমা শক্তি সমূহের চাপ তাঁর জন্য ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। মুসলিম বিশ্ব এবং পশ্চিমা শক্তিবর্গকে পাকিস্তানের পর্যায়ক্রমিক অপপ্রচারে বিরুদ্ধাচরণ করা এবং ব্বাংলাদেশের বাস্তবতা তুলে ধরার ক্ষেত্রে ভারতের সরকার ও বিরোধী দলের নেতারা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। প্রথমে দিল্লীতে অবস্থানরত রাষ্ট্রদূতদের বোঝানো, তারপর বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানের কাছে মন্ত্রী পর্যায়ের দূত পাঠানো এবং পরবর্তী পর্যায়ে

৪৭২

যুক্তরাষ্ট্র সহ ৮ টি দেশ সফর করার মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধী যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য দেশগুলোকে তাঁর অবস্থান আংশিকভাবে হলেও বোঝাতে পেরেছিলেন। তবে পশ্চিমের সরকারসমূহ বোধগম্য কারণে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের পক্ষে ছিল।
বিশ্ব জনমত গঠনের ক্ষেত্রে ভারতের সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যম যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, একইভাবে বিদেশী গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের শরণার্থীদের দুর্দশা, মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের নিদর্শন সমূহ দেখানোর ব্যবস্থাও ভারতকে করতে হয়েছিল। আমন্ত্রণ জানাতে হয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সদস্য এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের। বাংলাদেশের পক্ষে মার্কিন জনমত সংগঠনের ক্ষেত্রে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির ভারত সফর খুবই ফলপ্রসূ হয়েছিল।
এসব সফর এবং কূটনৈতিক তৎপরতা যে শুধু সরকারী পর্যায়ে হয়েছিল তা নয়, বাংলাদেশের বাস্তবতা সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহের কাছে তুলে ধরার জন্য সিপিআই নেতৃবৃন্দকে সেসব দেশে যেতে হয়েছিল। সেপ্টেম্বরে দিল্লীতে সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। প্রখ্যাত ফরাসি বুদ্ধিজীবী আঁদ্রে মারলো, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছিলে, বলেছিলেন- বাংলাদেশ যদি মুক্তিযুদ্ধের জন্য আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গ্রহনের সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সবার আগে তিনি সেই ব্রিগেডে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করবেন।
দেশের বাইরেও প্রখ্যাত ভারতীয়রা বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। ভারতের শীর্ষস্থানীয় সংগীতজ্ঞ পন্ডিত রবিশংকর তখন আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলসে ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ কনসার্টের আয়োজন করে দশ লক্ষ ডলার তুলে ইউনিসেফকে দিয়েছিলেন শরণার্থী শিবিরের শিশুদের জন্য।
মকবুল ফিদা হোসেনের মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর ছবি এঁকে বোম্বের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য। বিকাশ ভট্টাচার্য, প্রকাশ কর্মকার, শ্যামল দত্ত রায় আর গণেশ পাইনের মত খ্যাতিমান শিল্পী ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মাসের পর মাস বাংলাদেশের উপর ছবি এঁকে বিক্রি করেছেন এবং ছবি বিক্রির টাকা শরণার্থী শিবিরে পৌঁছে দিয়েছেন। শিল্পী বাঁধন দাস ছবি আঁকা ছেড়ে শরনার্থী শিবিরে গিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্র খুলেছিলেন তার এক ডাক্তার বন্ধুকে নিয়ে। অন্নদা শংকর রায়, মৈত্রেয়ী দেবী, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিময় রায়, সুভাষ

৪৭৩

মুখোপাধ্যায়, প্রণব রঞ্জন রায়, তরুন সান্যাল, অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী, নির্মল চক্রবর্তী, ড. ফুলরেণু গুহ, গৌরী আইয়ুব, দিলীপ বসু, ইলা মিত্র, রমেন মিত্র, আব্দুর রহমান, ডা. গণি, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মত খ্যাতিমান কবি সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী বাড়ি বাড়ি ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। দিল্লীর শিল্পী নরেণ সেনগুপ্ত, ধীরাজ চৌধুরী, জগদীশ দে আর বিমল দাশগুপ্তের মত শিল্পীরা দিল্লী বোম্বে আর কলকাতায় প্রদর্শনী করে ছবি বিক্রির টাকা তুলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ তহবিলে। শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন, গাইয়েরা বাংলাদেশের উপর বাংলাদেশের জন্য গান গেয়েছেন, নাট্যকর্মীরা নাটক করেছেন, ঋত্বিক ঘটক, শুকদেব আর গীতা মেহতারা চলচ্ছিত্র নির্মাণ করেছেন। সব মিলিয়ে ভারতের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের ভিতর এমন ব্যক্তি খুবই কম পাওয়া যাবে যাঁরা কোন না কোন ভাবে তখন বাঙ্গালদেশকে সাহায্য করেনি।
সচেতন ও খ্যাতিমানদের পাশাপাশি ভারতের সাধারণ মানুষ যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং এবং শরণার্থীদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছিল পৃথিবীর দ্বিতীয় কোন দেশে এ রকম নজির নেই। এ লেখকের নিজের চোখে দেখা হাজারো ঘটনার একটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। বহরমপুর সীমান্তের কাছে বাংলাদেশ থেকে আসা একটি মুসলমান কৃষক পরিবার, স্বামী স্ত্রী ও একটি শিশু আশ্রয় নিয়েছে গ্রামের এক হিন্দু কৃষক পরিবারের বাড়িতে। আশ্রয়দাতার বাড়িতে দুটিমাত্র ঘর, একটি রান্নার আর একটি শোয়ার। আশ্রয়দাতা শোয়ার ঘরটি ছেড়ে দিয়েছে আশ্রিতকে, নিজেরা থেকেছে রান্নাঘরে। দুমাস পর এই মুসলমান পরিবারটি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহন করে। দুই থেকে তিন লক্ষ শরণার্থী চেনা অচেনা সাধারণ মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের আর্থিক সচ্ছলতা না থাকলেও হৃদয়ের বিশালতা ছিল অন্তহীন।
সাংবাদিক দিলীপ চক্রবর্তী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির বিবরণ দিতে গিয়ে একটি মর্মস্পর্শী ঘটনার উল্লেখ করেছেন তাঁর এ লেখায়-
‘চার যুগ ধরে বসবাস করা সত্ত্বেও ‘উদ্বাস্তু’ তকমাটা দেওয়াই আছে। কলকাতার উপকন্ঠে বেশকিছু অঞ্চল এখনো ‘উদ্বাস্তু অঞ্চল’ বলেই পরিচিত। এখানকার অধিবাসীরা সেই কবে ১৯৪৯-৫০ সালে পূর্ববাংলা থেকে এসে স্থায়ীভাবে ঘর বেঁধেছেন। ভারতের নাগরিকত্বও পেয়েছেন। তাদের পুত্র কন্যা কলকাতার জলবায়ুতেই জন্মগ্রহন করেছে – বড় হয়েছে তবু উদ্বাস্তু কথাটা অঞ্চলের সঙ্গে লেপ্টেই আছে। কলকাতার উপকন্ঠে দমদমে এমনি এক উদ্বাস্তু অঞ্চলে আমাদের বাড়ি। আমাদের প্রতিবেশী গোঁড়া ধর্মপ্রাণ এক ব্রাক্ষ্মণ পরিবার। এই পরিবারে ওদের জন্ম, ১৯৭১ সালে। ওরা যমজ ভাই-বোন, এদের আমি ভাল করেই জানি। জন্মের পর পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী ওদের আত্মীয়রা

৪৭৪

যমজ ভাইবোনের নামকরণ করল নারায়ণ আর লক্ষ্মী। কিন্তু কি আশ্চর্য! পরিবারের কর্তা, যাঁকে আমি রক্ষণশীল বলেই জানতাম সে কিন্তু ওদের নাম রাখল ‘মুজিবর’ আর ‘মুক্তি’। মুজিবুর থেকে সংক্ষেপে মুজিব। ওরা এখন বড় হয়েছে। এই যমজ ভাইবোন এখন পূর্ণ যৌবনে। ১৯৭১ এ জন্ম হলেও একাত্তরের দিনগুলি জানার কিংবা অভিজ্ঞতার সুযোগ এদের নেই।’
‘কালান্তর’এর সাংবাদিক দিলীপ চক্রবর্তী একই লেখার আরেক জায়গায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের আগ্রহের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন-
‘চিত্তদা আর আমি রমেনদার (মিত্র) বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। দরজা খুলতেই দেখি ওখানে আমাদের পত্রিকার অন্যতম কর্ণধার অনিল ভঞ্জ, আমার সহকর্মী দীপ্তেন্দু এবং আরো অনেকে উপস্থিত। রমেনদা বললেন, এসেছিস ভালোই হয়েছে। ওখানেও আলোচনা হচ্ছে পূর্ব বাংলার সংগ্রাম। মানুষ লড়ছেন, কোথায় কি খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা, রমেনদা এবং ইলাদি (নাচোল কৃষক আন্দোলনের সংগ্রামী নেত্রী ইলা মিত্র- লেখক) দুজনেই মনে হয় ‘টেনশনে’ আছেন। স্বভাব শান্ত রমেনদার টেনশন অনেক সময় বাইরে থেকে হয়ত বোঝা যায়না। তার ঘন ঘন সিগারেট জ্বালানো থেকে এটা আমাদের কাছে ধরা পড়ছিল। ইলাদি আর রমেনদার রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে পূর্ববাংলায়। পাক পুলিশের চোখে ধুলা দিয়ে আত্মগোপন করে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন রমেনদা। আর ইলাদি? উভয় বাংলার সংগ্রামী মানুষের কাছে তিনি তো এখনো কিংবদন্তির নায়িকা। পাক শাসক চক্রের সমস্ত জঘন্য অপরাধের জীবন্ত প্রতিবাদ তিনি। উভয়েরই চোখে তখন হয়ত রাজশাহী আর নাচোলের সংগ্রামী মানুষের কথা ভেসে উঠেছিল, ভেসে উঠেছিল সংগ্রামী সহকর্মীদের কথা। তাঁরা কোথায় কে জানে? আর এই আবেগ থেকেই রমেনদা আর ইলাদি পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাদেরই একজন হয়ে উঠেছিলেন। পার্ক সার্কাসের সিআইটি রোডে তাঁদের বাসাটি মুক্তিযোদ্ধাদেরই একটি অস্থায়ী শিবিরে রূপান্তরিত হয়েছিল।

হঠাৎ হাতের সিগারেটের শেষ টান দিয়ে, রমেনদা আমাদের আলোচনা আর গবেষণায় ছেদ টেনে বললেন, স্বাধীকার না স্বাধীনতা এটা ঠিক করছে বাংলাদেশের মানুষ, আর ঠিক হবে ভবিষ্যতে। এখন পাক জঙ্গিচক্রের বিরুদ্ধে লড়াকু মানুষের পাশে দাঁড়ানো আর আর্তমানুষের পাশে দাঁড়ানোই কাজ। খোঁজ করতে হবে বন্ধুদেরও, তারা কে কোথায়। সমস্ত যোগাযোগ তো বিচ্ছিন্ন। আজই তার ব্যবস্থা করতে হবে। কাল আমরা পূর্ববাংলায় যাব।’ এরপর যাওয়ার ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা।
‘কালান্তর’এর কম্পোজিটর আনোয়ার খাঁর বাড়ি হাকিমপুরের একেবারে সীমান্তে, নদীর পাড়ে। ইছামতীর ঐ শাখা পেরোলেই ওপারে পূর্ববাংলা, বাস

৪৭৫

রাস্তা আছে যশোর সাতক্ষীরা সর্বত্রই যাওয়া যায়। আনোয়ারকে দপ্তর থেকে ছুটি করে নেওয়া হবে। এরপর গাড়ি নিয়ে আমরা যাব। রমেনদা নিজেই থাকবেন আমাদের সঙ্গে। অনিলদাই এর ব্যবস্থা করবেন। চিত্তদা, দীপ্তেন্দু এবং আমি। তিনজনেরই যাওয়ার ইচ্ছা। কিন্তু আমাকে দেওয়া আগের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে চিত্তদা বললেন , তাহলে দিলীপ ই যাক। বন্ধু দীপ্তেন্দু ইচ্ছেটা মনে রেখে মলিন হেসে বলল, নে তুই ই যা। বিষয়টা চিত্তদার চোখ এড়াল না। তিনি বললেন, এরপরে তুমিও সুযোগ পাবে। চিত্তদা নিজের ইচ্ছেটা গোপনেই রাখলেন। এর কয়েকদিনের মধ্যে শুধু দীপ্তেনদু, চিত্তদা কিংবা আমি নই, আমাদের অনেককেই হতে হয়েছিল রণাঙ্গনের রিপোর্টার।

২৮ শে মার্চ আমরা চলেছি। মানিকতলায় সিপিআই নেতা প্রতুলদা, অর্থাৎ প্রতুল লাহিড়ী। আমদের সময়ের ছাত্র আন্দোলনের নায়ক। হাতে থলে নিয়ে বাজারে যাচ্ছেন। বশিরহাটে প্রতুলদার অনেক পরিচিতি। গাড়ি থামিয়ে রমেনদা ঠাট্টা করে বললেন, ‘প্রতুল, যুদ্ধ লেগে গেছে, ঘরের পাশে মুক্তিযুদ্ধ। আর তুই বাজার করছিস? আমরা যাচ্ছি।’ প্রতুলদা কোন কথা না বলে থলে হাতে নিয়েই গাড়িতে উঠলেন। আরেকজনকে বলে দিলেন, ‘ঘরে বলে দিও-ফিরতে কয়দিন দেরি হবে।’ (একাত্তরের রাত দিন, সপ্তাহ ১৮ আগস্ট ‘৯৫, কলকাতা)
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকাকে অনেকে অনেকভাবে বিশ্লেষণ করেন। ইতির পরিবর্তে নেতি অনুসন্ধানের চেষ্টাই আমাদের লেখক গবেষকদের একটি বড় অংশ সবসময় করেছেন। তাঁরা ব্যাখ্যা দিতে পারবেন না, বহরমপুরের দরিদ্র কৃষক, সাধারণ মধ্যবিত্ত, খ্যাত-অখ্যাত অগণিত মানুষ কেন একাত্তরে বাংলাদেশের বিপন্ন মানুষদের সাহায্য করার জন্য এতটা ব্যাকুল হয়েছিল।
৭২ এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে দিল্লীতে কয়েক ঘন্টার জন্য যাত্রা বিরতি করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করার জনয এবং তার মুক্তির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি ও জনমত গঠনের জন্য তিনি শ্রীমতি গান্ধীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সম্মানে আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে ভারতের জনগণের উদ্দেশ্যে শ্রীমতি গান্ধী বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন্স্বাধীনতার এবং তিনি তা দিয়েছেন। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম বাংলাদেশের শরণার্থীদের সসম্মানে দেশে ফেরত পাঠাব, মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকম সাহায্য করব এবং বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করে আনব। আমিও আমার

৪৭৬

প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি।
ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফরের সময় বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় ব্যাখ্যা অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ‘৭২ এর ১৯ মার্চে। বঙ্গবন্ধু ভারতকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বন্ধুত্বের। সেই প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশ পালন করেনি।
একাত্তরের নয় মাসে ভারত বাংলাদেশের জন্য কর টাকা ব্যয় করেছিল?
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ ভারতে গিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। ২৬ মার্চ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন ২০ থেকে ৪৫ হাজার ভীতসন্ত্রস্ত অসহায় বাঙালি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে গিয়েছিল যাদের ভিতর হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান, বৌদ্ধ- সব ধর্মের অনুসারীই ছিল। অথচ পাকিস্তান সবসময় বলেছে শরণার্থীর সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি হবেনা। পাকিস্তান কি উদ্দেশ্যে প্রকৃত সত্য গোপন করেছিল সেটি জানা যাবে ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য থেকে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী জার্মানী সফরকালে ১১ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে ‘জার্মান সোসাইটি ফর ফরেন পলিসি’র দফতরে কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে বলেন, ‘শরণার্থীদের সংখ্যা সম্পর্কে আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা বলেন ৯৭ লাখ। প্রকৃত সংখ্যা দুই তিন লাখ বেশি হবে। শরণার্থীদের অনেকে ক্যাম্পে থাকার পরিবর্তে পরিচিতজনদের সাথে রয়েছে। ক্যাম্পে যারা থাকে তাদের প্রত্যেকের রেশন কার্ড আছে। রেশন কার্ড ছাড়া কাউকে খাবার দেওয়া হয়না। ফলে আমাদের বিলক্ষণ জানা আছে শরণার্থীর সংখ্যা কত। আমাদের হিসেবে ৩০ লাখ মুসলমান শরনার্থী আছে। পাকিস্তানিরা যে হিসাব দিচ্ছে সেখানে তারা হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধদের বাদ দিয়ে গুনেছে। আমরা তা করতে পারিনা। আন্তর্জাতিক মহলের অভিমত যা ই হোক, আমি দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলতে চাই, আমরা এই শরণার্থীদের ভারতে থাকতে দেব না। এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত এবং আমার দেশও তাই। আমরা এক বিশাল বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি অথচ বাইরে থেকে কোনরকম সাহায্য পাচ্ছিনা বললেই চলে। যখন আমরা জাতিসংঘকে এ বিষয়ে জানিয়েছি তারা বলেছে এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। আমরা এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারিনা। ওদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি, অথচ জাতিসংঘ বলছে, আমরা খুবই দুঃখিত। পাকিস্তানে যদি লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়, আমাদের কিছু করার নেই। এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’ (বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৯১, প্রাগুক্ত)

এক কোটি শরনার্থীর ভার বহন করতে ভারতকে এক বিশাল অংকের অর্থ বহন করতে হয়েছিল। বিভিন্ন দেশ শরণার্থীদের জন্য ভারত ও বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে যে অর্থ সাহায্য করেছে তার পরিমাণ ভারতীয় টাকায় মাত্র ৫০

৪৭৭

কোটি। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারতকে ব্যয় করতে হয়েছে ২৬০ কোটি টাকা। মোট ব্যয়ের হিসেব ধরা হয়েছিল ৫৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। (জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনকে দেয়া ভারতের পুনর্বাসন সচিব জি এস কাহলন এর বিবৃতি, বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৯৩, প্রাগুক্ত)
শরনার্থীদের জন্য ব্যয়ের হিসেব বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া গেলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সামরিক সাহায্যের পরিমাণ টাকার অংকে কত ছিল এ তথ্য কেউ দিতে পারেননি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা বলেছেন, আমরা যদি টাকা ফেরত চাইতাম তাহলে সাহায্যের টাকার অংক লিখে রাখতাম। ভারতীয়রা লিখে না রাখলেও বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের নাগরিকদের জানা দরকার শুধু শরণার্থীদের জন্য ভারত ‘৭১ সালে ব্যয় করেছিল টাকার বর্তমান মানে ২৩১০ কোটি টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, লক্ষাধিক মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও অন্যান্য রসদ সরবরাহ সহ সামরিক খাতে এর ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি। টাকার অংকে যা হিসেব করা যাবেনা তা হছে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য ভারতের প্রায় চার হাজার অফিসার ও জওয়ান শহীদ হয়েছেন। টাকার অংকে হিসাব করা যাবেনা সাধারণ মানুষের ভালবাসা ও সহমর্মিতা।
বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে পাওনা ১২,০০০ কোটি টাকা আদায়ের কোন পদক্ষেপ গ্রহন করেনি। এর বিপরীতে একাত্তরের নয় মাসে বাংলাদেশের শরণার্থীদের এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভারত যে ৭০০০ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করেছে সেটা ফেরত দেওয়ার কথা কখনো মুখেও আনেনি। পক্ষান্তরে ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তির বিরোধীতা করে পাকিস্তানের প্রেমের পারাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছে।
[১২৬] শাহরিয়ার কবির

মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতীয় বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়
এ কথা সত্য যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের জনগণ, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিক তথা সরকার সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। সেদিন ভারতের সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিকামী বাঙালির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এক কোটি বামহালিকে আশ্রয় আহার দিয়েছিলেন; সোচ্চার হয়েছিলেন গণহত্যার বিরুদ্ধে। কিন্তু দীর্ঘ ২৭ বছরেও ভারতীয় জনগণের সেই অবদান , আত্মত্যাগকে আমরা তেমন বিবেচনায় আনিনি। জানতে চেষ্টা করিনি ইতিহাসের অনালোকিত এই অধ্যায়টিকে।
আমরা কি জানি চলচ্চিত্র শিল্পী মহানায়ক উত্তমকুমার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এগিয়ে এসেছিলেন; সত্যি এই যে, পশ্চিমবঙ্গের যাত্রা, রঙ্গমঞ্চ, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত ও

৪৭৮

নৃত্যশিল্পীদের সংগঠন ‘শিল্পী সংসদ’ ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল উত্তমকুমার এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায়. . . নিরস্ত্র বাংলাদেশ বাসীর উপর পাক সরকারের অমানুষিক ও বর্বরোচিত দমন নীতির তীব্র নিন্দা করা হয়। প্রস্তাবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি ও সকল রকমের সাহায্যেরও দাবি জানানো হয়।
এদিকে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, শিক্ষাকর্মী, ও শিক্ষাবিদগণ ৩ এপ্রিল এক সভায় মিলিত হয়ে কাল্বিলম্ব না করে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও স্বাধীন বাংলাদেশকে সব রকমের সাহায্য দেয়ার জন্য ভারত সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়। এই মর্মে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, এ ব্যাপারে অনুমাত্র বিলম্বও ইসলামাবাদের পশু শক্তির এই হত্যালীলায় শক্তি যোগাবে। সমগ্র পৃথিবীর ধিক্কারের সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে প্রস্তাবে স্বৈরাচারী সামরিক দম্ভকে এই বলে সতর্ক করে দেওয়া হয় যে, দানবের মূঢ়তা ইতিহাসে কখনো শাশ্বত অধ্যায় রচনা করতে পারেনা। প্রস্তাবে পৃথিবীর প্রধান রাষ্ট্রসমূহ ও রাষ্ট্রপুঞ্জের নীরব দর্শকের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো ভাইস চ্যান্সেলর (অ্যাকাডেমিক) ড. পিকে বসু। এই সভায় বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি নামে একটি সংগঠন করা হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সত্যেন সেন কে সমিতির সভাপতি, প্রো ভাইস চ্যান্সেলর, (অ্যাকাডেমিক) ড. পিকে বসুকে কার্যকরী সভাপতি, প্রো ভাইস চ্যান্সেলর (ফিন্যান্স) শ্রী হীরেন্দ্রমোহন মজুমদারকে কোষাধ্যক্ষ এবং অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তীকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়। এছাড়া ছাত্র সংসদ, কর্মচারী সমিতি, অধ্যাপক সমিতি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদেরও সমিতিতে নেওয়া হয়। আমরা জানি, ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়তা সমিতি’ ভারতে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। কেবল জনমত গঠনেই নয়, বাংলাদেশের সকল স্তরের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী তথা মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করেছিল এই সংগঠন।

মার্চ মাসেই পশ্চিম বঙ্গের বিশিষ্ট লেখক বুদ্ধিজীবী তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, মৈত্রেয়ী দেবী, আবু সায়ীদ আইয়ুব, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, শম্ভু মিত্র, সুশোভন সরকার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তৃপ্তি মিত্র, প্রবোধ চন্দ্র সেন, তারাপদ মুখোপাধ্যায়, অম্লান দত্ত, গৌর কিশোর ঘোষ, সন্তোষ কুমার ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ এর উন্নত শির নাগরিকগণ এবং তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ইতিমধ্যে আমাদের হৃদয় জয় করেছেন। এই মুহুর্তে বাংলাদেশ আক্রান্ত হয়েছে সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানের ৭০ হাজার যুদ্ধপটু সৈনিক দ্বারা। আমরা পশ্চিমবঙ্গের

৪৭৯

সংস্কৃতিকর্মীরা বিশেষ করে আবেদন জানাই, পৃথিবীর সব দেশের শিল্পস্রষ্টা ও জ্ঞানতপসীদের কাছে। আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্রে বীভতস, বিরাট নরহত্যার সংবাদ তারা পেয়েছেন নিশ্চয়? তাঁদের সকলের তীব্র প্রতিবাদ ঘোষিত হোক, তাদের সরকারকে তারা উদ্বুদ্ধ করুন এই অর্থহীন নৃশংসতার নিন্দা করতে , প্রতিরোধ করতে. . .। এদিকে বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে কলকাতায় এক বিশাল নাগরিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত এ সভায় বিজয়সিংহ নাহার বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে পশ্চিমবঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলুন। আমরা ওদের পাশে গিয়ে লড়তে চাই।’ দলমত নির্বিশেষে এ সমাবেশে অজয় মুখোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন- ‘আমরা নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারিনা।’ একই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এবং পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গণহত্যার প্রতিবাদে যুব কংগ্রেসের আহবানে ১০ থেকে ১৪ বছরের বালকেরা অনশনে অংশ নেয়। ছাত্রপরিষদ কর্নীগণ ও ডা. সুন্দরীমোহন এভিনিউ ও হাতিবাগান রোডের মোড়ে দিনব্যাপী অনশন ধর্মঘট করেন। ২৯ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির আহবানে শহীদ মিনার ময়দানে এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শ্রী জ্যোতি বসু ভারত সরকারকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতিদানের এবং অস্ত্রসস্ত্র সরবরাহের দাবি জানান। জ্যোতিবসু বলেন, ‘আমরা ওদের পাশে আছি। পূর্ব বাংলার লড়াই, আমাদেরও লড়াই, ওদের পরাজয় আমাদেরও পরাজয়। আমার বিশ্বাস, আমরা ওদের সাহায্য করতে পারব। সমস্ত বাধা অতিক্রম করে কংগ্রেস সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।’ সভায় হরেকৃষ্ণ কোঙার, জ্যোতি ভট্টাচার্য, নেপাল ভট্টাচার্য, রাম চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বক্তৃতা করেন।

৩১ মার্চ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের সমর্থনে হরতাল পালিত হয়। এ হরতাল ছিল অভূতপূর্ব। ‘দৈনিক যুগান্তর’ হরতালের বর্ণনা দিয়েছে এভাবেঃ
বাংলা বিভক্ত হবার পর এই প্রথম এ বাংলার মানুষ ও বাঙলার বাঙালিদের প্রতি প্রকাশ্যে এবং সোচ্চারে সহানুভূতি ও সমর্থন জানালেন। দোকান পাট, বাজারহাট, কল কারখানা বন্ধ রেখে, যানবাহন তুলে রেখে, সমস্ত আনন্দানুষ্ঠান বাতিল করে দিয়ে এ বাঙলার বাঙালি তার একান্ত আপনজন ও বাঙলার বাঙালি বীর শহীদদের প্রতি অন্তরের শ্রদ্ধার নিদর্শনরূপে আজ ‘শোক দিবস’ পালন করে বর্বরতার বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার ও ঘৃণা প্রকাশ করেছে। পরম আত্মীয়ের বিয়োগ ব্যথায় মহানগরীর সর্বত্র আজ কালো পতাকা। পথের মোড়ে মোড়ে শহীদ বেদী। স্বেত শুভ্র শহীদ বেদীগুলো ধুপ ধুনা আর ফুলে ফুলে সাজানো। শহীদ বেদির পাশে অর্ধনমিত জাতীয় পতাকা। আর কালো পতাকা। নাগরিকদের বুকে কালো ব্যাজ। এই কালিমা একাধারে প্রতিবাদ, অন্যদিকে ধিক্কার। স্বাধীকার আন্দোলনে নিহত সৈনিকদের জন্য শোকের ছায়া সর্বত্র পরিব্যপ্ত।

৪৮০

বাঙালির বাঁচার দাবির সমর্থনে এই শহরে সকালে এবং বিকেলে অনেক গুলো প্রতিবাদ মিছিলও বের হয়। মিছিলের আওয়াজ বাঙালির জয়ধ্বনি। উদ্যোক্তা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
বিনা হাঙ্গামায় এমন এমন সর্বাত্মক ধর্মঘট কলকাতা ইতিপূর্বে খুব কমই প্রত্যক্ষ করেছে। দোকান পাট বন্ধের জন্য এদিওন কাউকে শাসাতে হয়নি। রেললাইন অবরোধ করার আগেই ট্রেন বন্ধ। লোকাল ট্রেন তো চলেইনি, দূরপাল্লার ট্রেনগুলো পর্যন্ত আজ এ রাজ্যে ঢোকেনি। হাওড়া-শিয়ালদা খাঁ খাঁ করছে। স্ট্যান্ডে রিকশা আছে কিন্তু চালক নেই। বন্দরেও একই দৃশ্য। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো যে কর্মবহুল বন্দর বাঁচিয়ে রেখেছে সেই কোলাহল মুখর কলকাতা বন্দরেও আজ কোন সাড়াশব্দ নেই। সারি সারি জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে, কোন কাজ হয়নি। শ্রমিকরা কাজ করেনি। বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর জঙ্গীশাহীর বর্বরতার প্রতিবাদে বৈমানিকরা আজ বিমান চালায়নি। আনন্দানুষ্ঠান, সিনেমা, থিয়েটারগুলোও আজ পুরোপুরি বন্ধ ছিল।
বাংলাদেশের সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্রকে অবিলম্বে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেবার দাবিতে এবং বাংলাদেশের বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের উপর জঙ্গিশাহীর বর্বর আক্রমনের প্রতিবাদে আজ পশ্চিম বাংলায়েই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলো, বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন এবং ছাত্র সংগঠন গুলো।
এদিন সকাল থেকেই দফায় দফায় ছাত্ররা যুবকরা শেখ মুজিবুরের জয়ধ্বনি দিতে দিতে পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশন অফিসে এসে জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানান। একদল যুবক এবং ছাত্র ১২ ঘন্টার জন্য অনশন ধর্মঘট শুরু করেছেন এই অফিসের সামনে।
উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে সর্বত্র ঘুরেছি। আজকের ধর্মঘট নিয়ে কোথাও কোন হামলার খবর পাইনি। বেলেঘাটা, শোভাবাজার, দমদম, জোড়াবাগান, বরানগর ইত্যাদি অশান্ত এলাকাও বাংলাদেশের স্বাধীকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের সমর্থনে এদিন শান্ত ছিল। দক্ষিণের কয়েকটি স্থানে দেখলাম শহীদ বেদির সামনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি।
কেবল কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মানুষও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিল। ৫ এপ্রিল দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্রী স্বরূপ সিং, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্রী জী পার্থসারথী এবং বিশিষ্ট নাট্যকার আলকাজির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল দিল্লীস্থ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার এবং দেশের জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে সক্রিয় সাহায্য দেবার দাবী জানান।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ৪ এপ্রিল নিখিল ভারত কংগ্রেস

৪৮১

কমিটির অধিবেশনে ঘোষণা করলেন, ভারতের সীমান্তের ঐপারে পূর্ব বাংলায় যা ঘটছে, তাতে ভারতের পক্ষে নীরব দর্শক থাকা সম্ভব নয়। বাঞ্ছনীয়ও নয়। এই মুহুর্তে আমরা পূর্ব বাংলার জনগণকে কি সাহায্য করতে পারি তা মাথা ঠান্ডা করে আমাদের ভেবে দেখতে হবে। তিনি আরো বলেন, পূর্ব বাংলার পরিস্থিতিতে এদ্বশের জনগণ যে কতোটা উদ্বিগ্ন তা এখন সুবিদিত। এ ব্যাপারে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ দেখে আমি খুশি।

ভারতের মত একটি উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশে এক কোটি শরণার্থীর আশ্রয় গ্রহন ভারতকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতে ফেলেছিল। শরণার্থীদের সাহায্যে বিশ্ব সম্প্রদায়ও সেদিন সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে তেমনভাবে এগিয়ে আসেনি। রাষ্ট্রসংঘ সহ সমগ্র বিশ্ব যে সাহায্য সেদিন করেছিল, তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগন্য। সেদিন ভারতীয় জনগণকেই এই বিশাল ভার বহন করতে হয়েছে। তাদের একের পর এক ট্যাংকের বোঝা বইতে হয়েছে। কিন্তু তারপরেও ভারতের হাজার হাজার মানুষ শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন, সহযোগিতা করেছিলেন নানাভাবে। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলার কিছু তথ্য তুলে ধরতে চাই।
বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার বিপরীতে পশ্চিমবঙ্গের মূর্শিদাবাদ জেলা। এই মুর্শিদাবাদ জেলায় এপ্রিল মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সাত লক্ষাধিক শরণার্থী আশ্রয় গ্রহন করেছিল। এসব শরণার্থী এবং মুক্তিযোদ্ধাকে সহায়তার জন্য ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন বহরমপুর শাখা, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সহায়ক মহিলা সমিতি, গার্লস কলেজ, মুর্শিদাবাদ ইনিস্টিটিউট অফ টেকনোলজিমার্স কলেজ, কৃষ্ণ নাথ কলেজ, সরকারি কর্মচারি সমিতি, জিয়াগঞ্জ কলেজ প্রভৃতি সংগঠন সেদিন এগিয়ে এসেছিল।
মুর্শিদাবাদ জেলার বিস্তীর্ণ সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে ১৩ এপ্রিল থেকে হাজার হাজার আহত ও দুর্গত শরনার্থী এই জেলায় প্রবেশ শুরু করে। জেলা প্রশাসক শ্রী অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায় রাজ্য রিলিফ কমিশনারের কাছে তাবু আর ত্রিপল চেয়ে জরুরী তারবার্তা পাঠালেন। জেলা প্রশাসক রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম এবং ভারত সেবাশ্রম সংঘকেও ত্রাণশিবির খোলার আবেদন জানালেন। জেলা কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক ভাবে সাগরপাড়া ও শেখ পাড়ায় দুটি আশ্রয় শিবির খোলেন। এ সময় বহরমপুর সদর হাসপাতাল রাজশাহী রণাঙ্গণে আহত নাগরিকে পূর্ণ হয়ে ওঠে। জেলা সীমান্তবর্তী বামনাবাদ, সাগরপাড়া, সাদিখাঁর দেয়াড় প্রভৃতি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রও আহত নরনারীতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রধানত চারটি থানা লালগোলা, ভগবান গোলা, রানী নগর এবং জঙ্গলী দিয়েই রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রবেশ করেন।

শরণার্থীর ভিড় ক্রমশই বাড়তে থাকে। ২০ এপ্রিল পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ জেলায়

৪৮২

শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৫ হাজার। এসব শরণার্থীর ৯০ ভাগই রাজশাহী জেলার এবং অবশিষ্ট পাবনা জেলার বলে জানা গেছে। জেলা কর্তৃপক্ষ এ সময় ১৪ টি ত্রাণ শিবির খোলে। সরকারি ত্রাণ শিবির হিসেবে সাদিখাঁর দেয়াড়, জলঙ্গী, ঘোষ্পাড়া, নরসিংহপুর, সাগরপাড়া এবং ধনিরামপুর গ্রামের প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুল গুলোকে বেছে নেওয়া হয়। এসব ত্রাণ শিবির ছাড়াও বিপুল সংখ্যক শরণার্থী আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিত জনদের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহন করে।
৩০ এপ্রিলের মধ্যে জেলার শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় দেড়লক্ষ। এই জেলার রানীনগর, জলঙ্গী, লালগোলা এবং ভগবানগোলা থানার প্রায় সবকটি স্কুলই শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়। এছাড়া ডোমকল, বহরম্পুর, দৌলাতাবাদ এবং রঘুনাথগঞ্জ জঙ্গীপুরে ত্রাণশিবির খোলা হয়।
১০ জুনের মধ্যে মুর্শিদাবাদ জেলার শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লক্ষাধিক। জেলার ত্রাণসম্পর্কিত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ সম্পর্কে জানান, এই শরণার্থীদের মধ্যে দুই লক্ষ বহরামপুর সদর, লালবাগ এবং জঙ্গীপুর মহকুমার ১৫০ টি সরকারি শিবিরে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ‘
তিনি জানান, ‘প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ হাজার শরণার্থী এ জেলাতে আসছে। মুর্শিদাবাদ জেলার সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘জনমত’ ২৩ অক্টোবর সংখ্যায় জানায়, মুর্শিদাবাদ জেলায়বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আগমন অব্যাহত আছে। । প্রধানতঃ জলঙ্গী থানা দিয়ে বাংলাদেশের রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, বরিশাল, ফরিদপুর জেলা থেকে হাজার হাজার শরণার্থী জেলায় আসছে। ২০ অক্টোবর পর্যন্ত জেলায় শরণার্থী দাঁড়াল ১ লক্ষ ১১ হাজার ৯৪০ টি পরিবারে ৭০ লক্ষ ২০ জন। আগস্ট মাসে এই সংখ্যা ছিলসাড়ে ৫ লক্ষের মত। শরণার্থীদের কাছে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে জানা যায় যে, বাংলাদেশের ভিতরে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা তৎপরতা খুব বেশি বেড়ে যাওয়াতে খান সেনাদের নির্মমতা চরমে উঠেছে।’
নভেম্বর মাসেও এই জেলায় শরণার্থী আসা অব্যাহত ছিল। প্রতিদিন গড়ে এক হাজার শরণার্থী কেবল জলঙ্গী ও তার আশপাশ দিয়ে প্রবেশ করে। ‘জনমত’ প্রতিনিধি জলঙ্গীতে দলে দলে শরণার্থী আসতে দেখতে পান। এই শরনার্থীদের শতকরা ৯৮ ভাগই মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত। প্রধানত, পাবনা, রাজশাহী, কুমিল্লা, জেলা এবং কিছু কিছু ফরিদপুর জেলা থেকে এরা ভারতে প্রবেশ করেছে। পদ্মা নদীতে বিস্তীর্ণ এলাকা চর। শরণার্থীরা তাই পায়ে হেঁটে জলঙ্গীতে প্রবেশ করছে।
স্বল্প পরিসরে শরণার্থী সম্পর্কিত একটি জেলার এসব তথ্য থেকেও বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে ভারতের জনগণ কী ঐকান্তিকতা, নিষ্ঠা আর ত্যাগের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। মুর্শিদাবাদ জেলায় বাংলাদেশের মানুষের জন্য যে সংগঠন টি অধিক সক্রিয় ছিলসেটি হল, ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক মহিলা সমিতি’। এই সংগঠনের সভানেত্রী ছিলেন

৪৮৩

অধ্যক্ষ প্রীতি গুপ্ত এবং সাধারণ সম্পাদিকা ইপ্সিতা গুপ্ত। এই মহিলা সংগঠনের সকল সদস্য দিন রাত কাজ করেছেন। তারা লালগোলা পাহাড়পুরে মুক্তিযুদ্ধে আহত যোদ্ধাদের জন্য আহত ৬ শয্যার একটি ফিল্ড হাসপাতালও গড়ে তুলেছিলেন- যেখানে অস্ত্রপচারেরও ব্যবস্থা ছিল।
[১৩৯] সুকুমার বিশ্বাস

মুক্তিযুদ্ধ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনের পাকিস্তানের দিকে পক্ষপাত মূলক অবস্থান সর্বজন বিদিত। কিন্তু সরকারের অন্যন্য অঙ্গ এবং বিভিন্ন স্তরে কিন্তু অবস্থাটি এইরকম ছিলনা। কংগ্রেসে বাংলাদেশের জন্য সমর্থন ছিল শক্তিশালী। প্রশাসনে সর্বোচ্চ স্তরের নিচেই ভিন্ন মত ছিল। পত্রপত্রিকা ও প্রচারমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন ছিল প্রশ্নাতীত। আমেরিকার বাঙালি মহল সর্বতভাবে মুক্তিযুদ্ধের মুক্তিযুদ্ধে নানা ধরনের সহযোগিতা করেন। এক পর্যায়ে পাকিস্তানের কূটনৈতিক মিশনগুলোতে কর্মরত সব বাঙালি বাংলাদেশের পক্ষে তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করেন। দেশের সর্বোত্র আমেরিকানরা বাঙালিদের বন্ধু অথবা সাহায্য সমিতি প্রতিষ্ঠা করে জনমত গঠন করে এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এবং শরনার্থী কেন্দ্রে বাঙালিদের নানা ধরনের সাহায্য প্রদান করেন।
মার্কিন মুলুকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণকালে সমসাময়িক মানসিকতা ও প্রেক্ষিত বিবেচনা করা দরকার। মানবাধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ তখন তেমন দানা বাঁধেনি। ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট কার্টার যখন এদিকে নজর আকর্ষণ করেন তখন তা ছিল অভিনব এবং বিশ্ব কূটনৈতিক সম্পর্কে এক নতুন মাত্রা। মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত নানা গোষ্ঠিকে তখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেবার রেওয়াজ প্রচলিত হয়নি। বরং তখন তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বা বিদ্রোহী গোষ্ঠী হিসেবে অবজ্ঞা করা হত। স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে ধারণা ছিল খুবই ট্রাডিষনাল। একটি দেশের এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীর উপর গণহত্যা শুরু করলেও তাকে মনে করা হত এ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এবং তাই এ নিয়ে অন্য কারো উচ্চবাচ্চ্যের অধিকার স্বীকৃত হত না। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সবদেশই মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সমর্থন দিতে ইতস্তত করে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় আমেরিকার বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন মাত্রায়। আমেরিকার বাঙালি সমাজ, ভারতীয় গোষ্ঠী, পাকিস্তানি মহল, মার্কিন বুদ্ধিজীবী মহল বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গণ, মার্কিন মানবিক সাহায্য সংস্থা গোষ্ঠী যার একটি বড় অংশ হচ্ছে বিভিন্ন ধর্মীয় বা গীর্জাভিত্তিক প্রিতিষ্ঠান, মার্কিন আইন পরিষদ, সিনেট ও প্রতিনিধি হাউস, প্রশাসনের নানা স্তরের আমলা মহল এবং নীতি নির্ধারনের উচ্চতর স্তর অর্থাৎ নিক্সন কিসিঞ্জার রোজার্স মহল সবাই

৪৮৪

মুক্তিযুদ্ধে কোন না কোন ভাবে আন্দোলিত এবং প্রভাবিত হয়। জাতিসংঘের সদর দফতর আমেরিকায় অবস্থিত এবং পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি দূতাবাস ওয়াশিংটনে আছে বলে বৈদেশিক কূটনৈতিক মহলেও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। শুধু দুটি নির্দিষ্ট মহল ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের পৈশাচিক হামলা এবং বর্বর কর্মকান্ডের কোন সমর্থন কখনো দেখা যায়নি। এই দুটি নির্দিষ্ট মহল ছিল মার্কিন মুলুকের বৃহত্তর পাকিস্তানি গোষ্ঠী এবং নির্বাহী বিভাগের নীতিনির্ধারক উচ্চতম মহল – প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রী গোত্রীয় নেতৃবর্গ। মূলত নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি।
বাঙালি মহলে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বেই উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল তুঙ্গে। নিউইয়র্কে বাঙালিদের দলে ভারি বলেই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি সংগঠিত ছিল। অবশ্যি ২৫ বছর আগে সারা আমেরিকায় সম্ভবত হাজার দুই থেকে পাঁচের মধ্যে ছিল বাঙালি জনগোষ্ঠী। ওয়াশিংটন বাল্টিমোর মিলে সর্বমোট বাঙালি পরিবার সম্ভবত ৫০ এর কাছে ছিল। নিউইয়র্কে বাঙালিরাই (মূলত সিলেটের লোকেরা) ছিল পাকিস্তানী লীগ অফ আমেরিকার সদস্য ও পরিচালক। তাঁরা জোরেশোরে আওয়ামী লীগের ছয়দফা দাবী সমুন্নত রাখেন।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে উপদ্রুত উপকূলীয় এলাকায় ত্রাণকার্যেপাকিস্তান সরকারের অবহেলা তাদের খুবই ক্ষুব্ধ করে এবং তারা তখনই স্বাধীকারের দাবী উত্থাপন করেন। তাঁরা পাকিস্তান লীগের নাম পরিবর্তন করে তাকে পূর্ব পাকিস্তান লীগে পরিণত করেন। তিন মাস পরে একাত্তরের মার্চ মাসে আর এক দফা পরিবর্তন করে এই সমিতির নাম হয় বাংলাদেশ লীগ। এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন একটি রেস্তোরাঁর মালিক হবিগঞ্জ জেলার কাজী শামসুদ্দীন আহমদ এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ফয়জুর রহমান। নভেম্বর মাস থেকেই এই সমিতির উপদেষ্টার ভূমিকা নেন ড. খন্দকার মোহাম্মদ আলমগীর এবং ভাইস কনসাল আবুল হাসান মাহমুদ আলী। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এই লীগ মতামত প্রকাশ করে এবং স্বাধীন বাংলার পক্ষে জনমত গড়ে তুলে তারা জাতিসংঘের সামনে র‍্যালি করে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করে, পাকিস্তান মিশনে প্রতিবাদ করে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে উপদেশ দেয় এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে বাংলাদেশে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাহায্যের আবেদন জানায়।
২৫ মার্চের ভয়াবহ সামরিক আক্রমণ ছিল নিতান্তই অপ্রত্যাশিত। প্রচার মাধ্যম খুব করে সমঝোতার সম্ভাবনাকেই ফলাও করে প্রচার করে। বঙ্গবন্ধু খুব সতর্কতার সঙ্গে সরাসরি সংঘাত পরিহার করে চলছিলেন। এই খবর পাওয়া গেল প্রায় এক দিন পরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ২৬ মার্চের ঘোষণা থেকে। আমেরিকার বাঙালি মহল ইয়াহিয়ার এই ঘোষণাকে পাকিস্তানের মৃত্যু বলেই স্থির করল। ওয়াশিংটন

৪৮৫

পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত বাঙালিদের উদ্যোগে ২৯ তারিখ সোমবার অনুষ্ঠিত হল কংগ্রেসে সামনের এক বিক্ষোভ মিছিল। টেলিফোনে যোগাযোগ করে, একে অন্যের মুখে শুনে আমেরিকার দূর দূরান্ত থেকে বাঙালিরা সমবেত হলেন ওয়াশিংটনে। তাদের কেউ কেউ হাজার আটশ মাইল সারারাত গাড়ি চালিয়ে এলেন তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে। নিউইয়র্ক, বোস্টন, ফিলাডেলফিয়া থেকে তো তারা এলেনই; অধিকন্তু ডেট্রয়েট, শিকাগো,ওহিয়ো থেকেও অনেকে এলেন। কংগ্রেসের সিঁড়িতে হল মূল বিক্ষোভ প্রায় শ’তিনেক লোক। স্টেট ডিপার্টমেন্ট, বিশ্বব্যাংক ও মুদ্রা তহবিলের সামনেও র‍্যালি হল। বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রত্যাহার, বাঙলাকিদের স্বাধীকার আর পাকিস্তানের নিন্দার দাবী উঠল এই বিক্ষোভ মিছিলে। এতে অংশ নেন বাঙালি ছাত্র, যুবক, পেশাজীবী, শ্রমিক, প্রশিক্ষনে লিপ্ত বাঙালি সরকারী কর্মচারি এবং তাদের গুটিকয়েক মার্কিন সমর্থক ও বন্ধুবান্ধব। এইদিন থেকে প্রবাসী বাঙালি সর্বত্র বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা গড়ে তুলতে থাকেন এবং পাকিস্তানী নাগরিকত্ব বর্জন করতে থাকেন। এপ্রিল মাসের মধ্যেই ওয়াশিংটন, লস অ্যাঞ্জেলেস ও বোস্টনে বাঙালি সংগঠন গড়ে ওঠে। ওয়াশিংটনে এই সমিতির সভাপতি হন এনায়েতুর রহিম এবং এখনো তিনি ওখানে আছেন। লস অ্যাঞ্জেলেসের সভাপতি সামসুদ্দোহা ইন্তেকাল করেছেন এবং বোস্টনের খোরশেদ আলম এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর। সেপ্টেম্বরের এক হিসেবে প্রকাশ পায় যে, উত্তর আমেরিকায় এরকম সমিতি তিরিশেরও বেশি ছিল।
ওয়াশিংটন থেকে ১৩ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকে কর্মরত হারুনুর রশীদ কলকাতা গেলেন সরেজমিনে অবস্থা দেখে ও বুঝে আসতে। স্বাধীনতা ঘোষণা ২৮ মার্চ খবরের কাগজেই জানা গেল, কিন্তু তারপর কি হচ্ছে, কি পরিকল্পনা, কি বৃত্তান্ত তা তখনো খুব অস্পষ্ট। হারুন কলকাতায় থাকাকালে মুজিবনগরে বাংলাদেশসরকার শপথ নিল১৭ এপ্রিলে এবং হোসেন আলীর নেতৃত্বে কলকাতার পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশন ১৮ তারিখে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘোষণা দিল। হারুন যখন ২৬ তারিখ ওয়াশিংটন ফিরলেন্তখন মুক্তিযুদ্ধকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার এবং তার রাজনৈতিক ভিত্তি প্রদানের ব্যবস্থা মোটামুটিভাবে সুসম্পাদিত। নিউইয়র্ক ও কলকাতায় তাদের দূত পাঠাল ফারুকুল ইসলাম এবং মাহবুব। ফারুক নিউইয়র্কেই রয়েছেন আর মাহবুব এখনো ঢাকায় ব্যবসায় লিপ্ত। নিউইয়র্কে পাকিস্তানি কনসুলেট জেনারেল ভাইস কনসাল মাহমুদ আলীভারতের বাইরে প্রথম বাঙালি কূটনীতিবিদ হিসেবে আনুগত্য পরিবর্তন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি শরিক হলেন। তিনি মে মাসেই নিউইয়র্কে একটি বাংলাদেশ মিশন খুলে

৪৮৬
বসলেন। এপ্রিলেই ঢাকা থেকে যেসব মার্কিন নাগরিককে বের করে নিয়ে আসা হয় তাদের অনেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তারা বাংলাদেশের সপক্ষে এবং পাকিস্তানী সমরিক শক্তির বর্বরতার বিরুদ্ধে জনমত গঠনে লেগে যান। বাল্টমোরে পাকিস্তানের নোঙর করা জাহাজ ময়নামতি ও শালিমারে কয়েকজন বাঙালি নাবিক ছিলেন, তাদের মধ্যে তরুন কজন উদ্যোগী অফিসারও ছিলেন। ৮ এপ্রিল আব্দুল আউয়াল মিন্টুর (বর্তমানে লব্ধ প্রতিষ্ঠ ব্যবসায়ী) নেতৃত্বে ৬ জন নাবিক জাহাজ ছেড়ে আসেন। পাকিস্তানি জাহাজ থেকে বাঙালি নাবিকদের এককভাবে অথবা দলবেঁধে পরিত্যাগের এই হয় সূচনা এবং নানা দেশে নানা সময়ে এর পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। পাকিস্তানিদের বাঙালি নিষ্পেষণ শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ ছিলনা, তাঁরা যেখানে যেভাবে পেরেছেসেখানেই বাঞালিদের উপর আঘাত হানে। সামরিক বর্বরতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে পাকিস্তানি দূতাবাসের স্থানীয় কর্মচারী গাউসুদ্দিন আহমদ যোগ দিয়েছিলেন। তাকে পয়লা এপ্রিল বরখাস্ত করা হয়। গাউসুদ্দিন খুব সাহসী যুবক। তিনি কোন ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত ছিলেন না বরং প্রকাশ্যে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকায় আগুণ লাগিয়ে লংকাকান্ড বাধিয়ে দেন।
মার্কিন কংগ্রেস সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর পার্লামেন্ট। প্রেসিডেন্ট যেসব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যথা মন্ত্রী বা মন্ত্রীগোত্রীয় প্রশাসক, বিচারপতি ও রাষ্ট্রদূতদের নিয়োগ দেন তাদের অনুমোদন করে সিনেট। বাজেটের উপর সম্পূর্ণ অধিকার কংগ্রেসের এবং তারা অনেক সময়ই সাময়িক ভাবে অচল করে দেয়। কংগ্রেসের দুই কক্ষের কমিটিগুলো শুধু আইন খতিয়ে দেখেনা তারা কঠোরভাবে নির্বাহি বিভাগের কর্মকান্ড তদারকি করে, পর্যালোচনা করে এবং প্রয়োজনে দিক নির্দেশনা দেয়। কংগ্রেসের শুনানি হয় প্রকাশ্যে এবং নির্বাহি বিভাগ বস্তুতই থাকে তটস্থ। জনপ্রতিনিধিরা নিরবাহি বিভাগ থেকে যে কোন তথ্য দাবি করতে পারেন এবং তাদের প্রশ্ন খুব যত্নের সঙ্গে এবং দ্রুতগতিতে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭১ সালে যদিও প্রেসিডেন্ট নিক্সন ছিলেন রিপাবলিকান দলের কিন্তু কংগ্রেসের দুই কক্ষেই ডেমোক্রেটিক দলের সদস্যরা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। সবগুলো কংগ্রেশনাল কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ডেমোক্রেটিক দলের। এপ্রিলের প্রথম দিনেই দুজন সিনেটর ম্যাসাচুসেটসের এডওয়ার্ড কেনেডি এবং ওকলাহোমার ফ্রেড হ্যারিস বাংলাদেশের সমস্যার উপর বক্তব্য রাখেন। রক্তপাত বন্ধ করা এবং দুস্থদের সাহায্য করা ছিল তাদের দাবী। এই দুই সিনেটরই ছিলেন ডেমোক্রাট। প্রতিনিধি পরিষদে প্রথম বক্তব্য রাখেন নিউইয়র্কের রিপাবলিকান সদস্য সেমুর হেলপার্ন। ৭ এপ্রিলে তিনি বক্তৃতার সঙ্গে হার্ভাডের তিন অধ্যাপকের একটি প্রতিবেদনও পেশ করেন। হার্ভাডের ডিন এডওয়ার্ড মেশন, অধ্যাপক রবার্ট ডর্ফম্যান এবং অধ্যাপক স্টিফেন মার্গলিন পূর্ব

৪৮৭

পাকিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। হার্ভাডে তখন ছাত্র ড. আলমগীর মুহিউদ্দীন (পরবর্তীতে ইফাদ খ্যাত) ছিলেন এই কাজের উদ্যোক্তা। এসব গুনী অভিমত দেন যে, পাকিস্তানে সামরিক নিষ্পেষণ বন্ধ করতে মার্কিন অপরিহার্য এক নৈতিক দ্বায়িত্ব এবং পাকিস্তানের সবরকম সাহায্য ত্বরিত স্থগিত রাখা উচিত। তাদের মতে দিক্ষিণ এশিয়া সংকটের একমাত্র সুষ্ঠু সমাধান হল স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুত্থান। তাদের মতে, বাংলাদেশ হতে পশ্চিমি প্রভাব বলয়ে বন্ধুভাবাপন্ন, সম্ভাবনাময় একটি উন্নয়নশীল দেশ। একই সঙ্গে রিপাব্লিকান দলে চিন্তাকোষ রিপন সোসাইটিও এমনি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এটির রচয়িতা ছিলেন সোসাইটির সভাপতি লি আউসপিজ আর হার্ভার্ডের দুজন অধ্যাপক স্টিফেন মার্গালিন আর গুস্তাভ পাপানেক। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রোনাল্ড ইন্ডেনেবং এডওয়ার্ড ডিমকের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় আর একটি প্রতিবেদন। সেখানে বলা হয় যে, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বিবেচনায়ও স্বাধীন বাংলাদেশ একটি উত্তম এবং অবশ্যম্ভাবী সমাধান। এইসব প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচার করেই বুদ্ধিজীবীরা চুপ থাকলেন না। ২৯ জন প্রখ্যাত পন্ডিত ১৪ এপ্রিলে ওয়াশিংটন পোষ্ট কাগজে পুরো পৃষ্ঠা নিয়ে একটি আবেদন ছাপালেন। তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে গনণহতযা বন্ধ করতে বললেন। কংগ্রেসে শুধু বক্তৃতাই চলল না, বরং ১৫ এপ্রিলে নিউ জার্সির রিপাবলিকান সিনেটর ক্লিফোর্ড কেইসেবং মিনেসোটার ডেমোক্রেটিক সিনেটর ওয়াল্টার মল্ডেইল যৌথভাবে একটি প্রস্তাব পেশ করলেন। তাদের প্রস্তাবের বিষয় ছিল পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য ও সরবরাহ তৎক্ষণাৎ বন্ধ করা। সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটি এই প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাশ করে মে মাসের ৬ তারিখ।

বোস্টনে একজন উৎসাহী ও নিবেদিত বাঙালি যুবক তখন ইলেক্ট্রনিক্সে উচ্চশিক্ষায় রত ছিলেন। রেজাউল হাসান ফিরোজের মনে হল যে মুক্তিবাহিনী তততা সংহত নয় এবং তাদের কোন অভ্যন্তরীণ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলনা। তিনি ঠিক করলেন যে, কিছু টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতি এদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। এ ব্যাপারে তার গুরু রবার্ট রাইনের সহযোগিতায় তিনি অতি সহজে নানা যন্ত্রপাতি স্বল্প খরচে যোগাড় করেন। এগুলোকে কলকাতায় পাঠাবার ব্যবস্থা আমাকে করতে হয় এবং আমরা ভারতীয় সরবরাহ মিশনের মিনিস্টার সুশীতল ব্যানার্জীর সহায়তা লাভ করি। জুন মাসে প্রায় ৪ টন যন্ত্রপাতি কলকাতায় পাঠানো হয়। এর জন্য প্রায় হাজার বিশেক ডলার লাগে এবং বোস্টনের ডা. রেজাউর রহমান, শিকাগোর ড. এফ আর খান, নিউ ইংল্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন, লস অ্যাঞ্জেলেস লীগ, মিডওয়েস্ট লীগ, নিউইয়র্ক লীগ, এবং মানিটোবা অ্যাসোসিয়েশন সে খরচ যোগাড় করে। জুলাই মাসে বোস্টন

৪৮৮

থেকে প্রাক্তন কূটনীতিবিদ তৈয়ব মাহতাব (বর্তমানে সান ডিয়াগোতে ব্যবসা করেন) এবং আগস্টে ওহায়ো থেকে অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম (এখনো ওখানে আছেন) মুজিবনগরে এই টেলিযোগাযোগ যন্ত্র প্রশিক্ষণ দিতে যান। তৈয়ব মাহতাব সেই যে গেলেন আর বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বোস্টনে ফিরলেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ততদিন কাজ করেন। নিউইয়র্ক এবং নিউজার্সি লীগ মুজিব নগরে একটি রেডিও ট্রান্সমিটার পাঠাবার ব্যবস্থা করে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আমেরিকার বাঙালিরা সর্বত্র সংগঠিত হতে থাকে এবং মার্কিন বন্ধু ও সমর্থকদেরও সংগঠিত করে। যেখানেই কিছু বাংলাদেশী বসবাস করতেন সেখানেই বাংলাদেশ লীগ গড়ে ওঠে। অনেক গুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এরকম সমিতি গড়ে ওঠে। অন্যত্র পেশাজীবীরা এই উদ্যোগ নেন। প্রথম থেকেই সমস্যা হয় কেন্দ্রীয় সমন্বয়ের। নিউইয়র্ক লীগ পুরানো প্রতিষ্ঠান বলে স্বাভাবিকভাবে তাদের উপর এই দ্বায়িত্ব অনেকটা ন্যস্ত হয়। অনেকে আশা করেছিলেন যে, ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি গোষ্ঠী এই সমন্বয়ের ভার নেবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হলনা। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ মিশনে প্রতিষ্ঠা পেতে জুলাই চলে গেল অথচ এতদিন তো অপেক্ষা করে বসে থাকা যায়না।
শিকাগোর বিখ্যাত স্থপতি স্কিডমোর ওয়িংস এবং মেরিল কোম্পানীর ফজলুর রহমান খান বাঙালিদের সংগঠনে বিশেষ অবদান রাখেন। মে মাসের শেষ দিকে তার উদ্যোগে স্থাপিত হয় শিকাগোর বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ। একই সঙ্গে তিনি চাঁদা আদায়ের জন্য বাংলাদেশ ইমার্জেন্সী ওয়েলফেয়ার লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। জুন মাসে এই সমিতি শিকাগোতে অন্যান্য এলাকার সমিতিদের আহবান করে একটি সমন্বয় ব্যবস্থা চালু করে। ঐমাসেই নিউইয়র্কে আরেকটি সম্মেলনে আর একটি সমন্বয় ব্যবস্থা চালু হয়। মোটাউটিভাবে প্রায় ৩০ টি বাঙালি সমিতির প্রায় অর্ধেকের বেশি নিউইয়র্কের ছায়াতলে এবং বাকিগুলো শিকাগোর ছায়াতলে অবস্থান নেয়। বাঙালিদের সমিতি অনেকখানে দস্তখত অভিযান দিয়ে কাজ শুরু করে, অন্যত্র বুলেটিন বা ইশতেহার বিলি করে বিচারকার্য চালায়। তাদের প্রভাব বিস্তারের একটি প্রধান উপায় ছিল নির্বাহী ও সংসদীয় দুই বিভাগেই চিঠি এবং সরাসরি যোগাযোগ করে বাংলাদেশের জন্য সমর্থনের দাবী পেশ করা। তারা বাংলাদেশকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে এবং শরণার্থীদের ত্রাণকাজের জন্য তহবিল আদায়েরও ব্যবস্থা নেয়। কোন কোন জায়গায় এসব সমিতির উদ্যোগে মার্কিন সমর্থকদের সহায়ক বা বন্ধু সমিতি স্থাপিত হয়। আবার অন্যত্র বাংলাদেশ সম্বন্ধে অবহিত মার্কিন উদ্যোগীরা নিজেরাই এসব সহায়ক সমিতি গঠন করে। এসব সমিতি বাঙালি বা মার্কিন গোষ্ঠির সংগঠন

৪৮৯

নানাভাবে বাংলাদেশের জন্য প্রচার চালাতে এবং জনমত গড়ে তুলতে অবদান রাখে। এজন্য তারা সভা সমিতি করে, র‍্যালি করে, গানবাজনার আসর জমায়। পড়াশোনার ক্লাস চালায়, টিচ ইন প্রোগ্রাম করে, ভোজসভার আয়োজন করে, কবিতা পাঠের আসর ডাকে। রেডিও, টেলিভিশনে, ইলেক্ট্রনিক ও মুদ্রনমাধ্যমে, শুধু বড় শহরে নয়, ছোট ছোট এলাকায়ও বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার চলে। অনেকগুলো বাংলাদেশ সমিতি বা সহায়ক সমিতিও নিয়মিত ভাবে সংবাদ বুলেটিন প্রকাশ করে। নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস, ফিলাডেলফিয়া, কুইবেক ও ওয়াশিংটন এই ব্যাপারে অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। তবে এই ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ অবদান ছিল শিকাগো ডিফেন্স লীগের। ১৭ মে থেকে শুরু করে ৭২ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত তারা মোট সতেরোটি পাক্ষিক নিউজলেটার প্রকাশ করেন। প্রথম কয়েকটি সংখ্যার সম্পাদনা করেন বর্তমানে জাতিসংঘে শরনার্থী কমিশনের কর্মকর্তা শামসুল বারী এবং বাকি সবগুলা সম্পাদনা করেন বর্তমানে গ্রামীন ব্যাংক খ্যাত মুহাম্মদ ইউনুস।
ভারতীয় সংগঠিত গোষ্ঠী এবং মার্কিন সুশীল সমাজের নানা প্রতিষ্ঠান পাকিস্তানি বর্বরতায় প্রথমে হতবাক ও পরে ক্রুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আওয়াজ তোলেন। তারা ভারতে বামহালি শরণার্থীদের জন্যেও সোচ্চার ও সচেষ্ট হন। নানা জায়গায় ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ছাড়াও নিউইয়র্কে একটি ইন্ডিয়ান কেন্দ্রীয় কমিটি মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে নানা উদ্যোগ নেয়। জোয়ান বায়েজের বাংলাদেশের সমর্থনে প্রথম কনসার্ট হয়জুলাইয়ের ২৪ তারিখ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে স্টানফোর্ড ক্যাম্পাসে। ওস্তাদ রবিশংকর এবং আলী আকবর খানও কনসার্ট অনুষ্ঠান করেন বাংলাদেশের সমর্থনে। ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ জুন মাসে ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্ক র‍্যালিতে যোগ দেন এবং সভা সমিতিতে বক্তৃতা করেন। নানা ক্যাম্পাসে বাঙালিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারতীয়রা স্বাক্ষর অভিযান চালান, টিটইন প্রোগ্রাম করেন ও আলোচনা সভার আয়োজন করেন। ভারতের প্রধানম্নত্রী সরদার শরণ সিং দুবার এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একবার আমেরিকা সফর করেন।
মার্কিন শিক্ষাবিদ, উন্নয়ন কর্মী, ব্যবসায়ী, ধর্মীয় গোষ্ঠী, গবেষক, বুদ্ধিজীবী যাদেরই বাংলাদেশ বা উপমহাদেশ সম্বন্ধে জ্ঞানথবা উৎসাহ অথবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল, তারাই মুক্তিযুদ্ধে আগ্রহী হন। বাংলাদেশ থেকে এপ্রিলের শুরুতে যেসব মার্কিন নাগরিককে উদ্বাসন করা হয় তারা প্রত্যেকেই হন বাংলাদেশের বিশেষ রাষ্ট্রদূত। এরা সবাই নানা এলাকায় বাংলাদেশ বন্ধু সমিতি গড়ে তোলেন ও চাঁদা সংগ্রহ করেন। চিঠি লিখে, বক্তৃতা দিয়ে, সংবাদ সম্মেলন করে, তারা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে তদবির করেন এবং জনমত গড়ে তোলেন। অনেক সংগঠিত প্রচেষ্টার মধ্যে নাম করা যায় ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ

৪৯০

ইনফরমেশন সেন্টার, ফিলাডেলফিয়ার ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গল, ডেন্ডারবিল্টের ফ্রেন্ডস অফ বাংলাদেশ, মিশিগানের ইস্ট বেঞগল ইমার্জেন্সি রিলিফ ফান্ড এবং নিউইয়র্কের দুটি প্রতিষ্ঠান- আমেরিকান ফ্রেন্ডস ফর বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ অ্যাকশন কোয়ালিশন।
ওয়াশিংটনে ইনফরমেশন সেন্টার স্থাপনে মূলত উদ্যোগী হন বাল্টিমোর, ওয়াশিংটন এবং বোস্টনে কর্মরত একদল ডাক্তার যারা ঢাকার সিয়াতো কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে (সিআরএল) কোন না কোন সময়ে কাজ করতেন। এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৯ সালে আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্রে (আই সি ডি ডি আর বি) পরিণত হয়। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. উইলিয়াম গ্রিনো, বোস্টনের ডা. জেমস, এবং আনা টেইলর, এবং ডা. ডেভিড ন্যালিন ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথের ডা. রবার্ট নর্থরূপ এবং ডা. নর্বার্ট হার্সহর্ন এবং ঢাকা থেকে উদ্বাসিত ডা. জন ও করনেলিয়া রোডি ডা. লিংকন ও মাটি চেন এবং ডা. রিচার্ড ক্যাশ। এবং আরো অনেকে ছিলেন এই নিবেদিত দলের সদস্য। এদের সঙ্গে হাত মেলান শিকাগোর শিক্ষাবিদ ড. এডওয়ার্ড ডিমক এবং ড. রোলান্ড ইন্ডেন এবং ওয়াশিংটনের এনায়েত রহিম, আব্দুর রাজ্জাক খান, মহসিন সিদ্দিক, চার্লস এশটন; জোন ডাইন এবং ফরহাদ ফয়সাল। মে মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে এই কেন্দ্রের সূচনা হয় এবং জুনে কংগ্রেসের নিকট আনিষ্ঠানিকভাবে এই কেন্দ্র চালু করা হয়। ডা. গ্রিনো ছিলেন এই কেন্দ্রের সভাপতি। এই কেন্দ্রটি হয় একটি উত্তম লবিস্ট সংস্থা এবং কংগ্রেসে নানা উদ্যোগে বিশেষ করে পাকিস্তানকে মার্কিন সাহায্য থেকে বঞ্চিত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কংগ্রেসে পাকিস্তানকে মার্কিন সাহায্য বন্ধ করার জন্য সিনেটে স্যাক্সবি চার্চ এবং হাউসে গালাকসির সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এই সংশোধনীর পক্ষে তদবির করা ছিল সেন্টারের প্রধান কাজ। সেপ্টেম্বরে সেন্টারে দুজন সার্বক্ষণিক পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। তাদের একজন ছিলেন বর্তমানে চেইস মানহাটান ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেভিড ওয়াইজব্রড এবং অন্যজন ছিলেন আজারবাইজান জাতিসংঘ শরণার্থী কমিশনের বর্তমান প্রতিনিধি কায়সর জামান কচি। বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর ১৯৭২ সালের ২৩ মে এই সেন্টার অবলুপ্ত হয়। ইনফরমেশন সেন্টার সি আর এল গোষ্ঠীর প্রচেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত করা হত। ফিলাডেলফিয়ার ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গল স্থাপনে উদ্যোগ নেন পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক, বিশেষ করে ড. রিচার্ড কান এবং ড. ক্লাউস ক্রিপেনডর্ফ, ডেলাওয়ার উপত্যকার বাঙালি নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে নিউজার্সির (বর্তমানে ওয়াশিংটনে পেন্টাগনে কর্মরত) এ এম মজহারুল হক টুনু এবং তার স্ত্রী ফরিদা হক এবং ফিলাডেলফিয়ার কোয়েকার গোষ্ঠীর ফ্রেন্ডস সোসাইটি,

৪৯১

বিশেষ করে রিচার্ড টেইলর। এই সমিতি বাংলাদেশের জন্য জোর প্রচার চালায়। এবং নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ও বাল্টিমোরে নানা র‍্যালির আয়োজন করে। বাল্টিমোর ও ফিলাডেলফিয়ায় অবরোধ করে তারা পাকিস্তানের জন্য কোন জাহাজে সমরাস্ত্র সরবরাহ করা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। তারা পিকেট করে, ডিঙ্গি নিয়ে জাহাজ অবরোধ করে এবং পরিশেষে লংশোর ম্যানদের কনভেনশনে তদবির করে, পাকিস্তানের জন্য সমরাস্ত্র জাহাজে তোলা নিষিদ্ধ করে দেয়। ফিলাডেলফিয়ায় তারা আলোচনা সভা, বক্তৃতা, টিচইন অথবা ভোজসভার অনেক আয়োজন করেন।

মূলত এই গোষ্ঠীর উদ্যোগে এবং ওয়াশিংটন ইনফরমেশন সেন্টারের সহযোগিতায় অক্টোবরে ওয়াশিংটনে এবং নভেম্বরে নিউইয়র্কে একটি ভিন্নধর্মী বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। ভারতে প্রচুর শরণার্থী দমদমের অদূরে পরিকল্পিত সল্টলেক সিটিতে আশ্রয় নেয়। ওখানে নতুন শহর গড়ে তোলার জন্য অনেক কংক্রিট পাইপ সংগ্রহ করা হয়েছিল। এসব সিউয়ার পাইপেই শরণার্থীরা আশ্রয় নেয়। ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউজের সামনে লাফায়েত পার্কে এইরকম নকল শরণার্থী আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। সেখানে স্বেচ্ছাসেবীরা শরণার্থীদের মত কাপড় চোপড় পরে, শাড়ি লুঙ্গি গায়ে দিয়ে, ডালভাত বা খিঁচুড়ি খেয়ে সিউয়ারি পাইপে এক নাগাড়ে দশদিন অবস্থান করে। এই র‍্যালিতে গন্যমান্য ব্যক্তিরা যোগ দেন। সিনেটর কেনেডি, বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী এবং আরো অনেকে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলাপ করেন। তাদের সঙ্গ দেন ও তাদের সঙ্গে প্রার্থনায় সামিল হন। নভেম্বরে এই র‍্যালিই নিউইয়র্কে দাগ হামারশোল্ড প্লাজায় ৭ দিন ধরে চলে এবং সেখানেও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা হাজিরা দেন; কবি এলেন গিন্সবার্গ তাদের মধ্যে একজন ছিলেন। এই বিক্ষোভের উদ্দেশ্য ছিল শরণার্থীদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা এবং পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন সরকারের সমর্থন প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দেওয়া।
নিউইয়র্কে ড. হোমার জ্যাকের ওয়ারলড কনফারেন্স ওফ রিলিজিয়ন ফর পিস, ড. জয়ন্ত ভট্টাচার্যের জাতিসংঘে করেসপন্ডেন্টস এসোসিয়েশন এবং জন সালজবুর্গের ইন্টারন্যাশনাল কমিশন ওফ জুরিস্টস হয় বাংলাদেশের বিশেষ বন্ধু। ড. হোমার জ্যাক এবং ড. জয়ন্ত ভট্টাচার্যের দপ্তর হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের আড্ডাখানা। বিচারপতি চৌধুরী নিউইয়র্কে এলে ড. জয়ন্ত ভট্টাচার্য তার স্নগবাদ সম্মেলনের ব্যবস্থা করে দিতেন। ড. হোমার জ্যাক নভেম্বর মাসে ওয়াশিংটনে স্বেচ্ছাসেবী ও সাহায্য সংস্থাদের এক সম্মেলনের আয়োজন করেন। ১০ থেকে ১২ নভেম্বর এই সম্মেলন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সংকটে আমেরিকান প্রতিক্রিয়ার বিশ্লেষণ নিয়ে আর এতে সভাপতিত্ব করেন ড. হোমার জ্যাক। এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন সিনেটর কেনেডি। এতে বক্তব্য রাখেন নিউজার্সির রিপাবলিকান

৪৯২

কংগ্রেসম্যান পিটার ফ্রিলিং হায়সেন, শিকাগোর অধ্যাপক এডওয়ার্ড ডিমক, স্টেট ডিপার্টমেন্টের ব্রুস লেইনগেন এবং বাংলাদেশ মিশনের এনায়েত করিম। পাকিস্তান প্রতিবাদ করে এতে অংশ নিতে বিরত থাকে। এই ৩ জন নিবেদিত মুক্তিযুদ্ধ সমর্থক নিউইয়র্কে বাঙালিদের সবরকম সহায়তা করেন। মার্চ-এপ্রিলেই মাহমুদ আলীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয় আর তখন থেকেই তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।
ইন্টারন্যাশনাল রেস্ক্যু কমিটি (আইআরসি) ভারত এবং আমেরিকায় বাঙালিদের নানাভাবে সাহায্য করে। আমেরিকায় অবস্থানকারী বাঙালি শিক্ষাবিদ বা ছাত্রদের দুর্দিনে সাহায্য করার জন্য হার্ভার্ড ও শিকাগোর শিক্ষক সম্প্রদায় সচেষ্ট হন। আই আর সি এর অর্থানুকুল্যে তারা একটি ডিসপ্লেসড স্কলার্স তহবিল প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতেও শরণার্থী বাঙালি শিক্ষকদের জন্য আইআরসি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করে। নিউইয়র্কের জামশেদ রেজা খান আই আর সি এর হয়ে যোগাযোগ রাখতেন।
শিক্ষাঙ্গনে মার্কিন পন্ডিত ব্যক্তির মধ্যে পাকিস্তানের সমর্থক পাওয়া দুষ্কর ছিল। তারা একযোগে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। হার্ভাড ও শিকাগোর অধ্যাপকবৃন্দ বাংলাদেশ সম্বন্ধে অত্যন্ত ইতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন সে সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিল্লুর রহমান খান এপ্রিল মাসে তার মার্কিন স্ত্রীর সঙ্গে ঢাকা তযাগ করে আমেরিকায় যান। তিনি তখন উইস্কনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওস্কস ক্যাম্পাসে অধ্যাপনা করেন। তিনি ঢাকায় গণহত্যা আর বিশেষ করে ছাত্র ও শিক্ষক হত্যার ওপর মার্কিন শিক্ষাবিদদের কাছে একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। ২২ এপ্রিল ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ ইউনিভার্সিটি ইমার্জেন্সি (আইসিইইউ) শিক্ষক ও ছাত্র হত্যার উপর একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। এতে অনেক নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত পন্ডিতকে নিয়ে বিশ্বের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষাবিদ দস্তখত করেন। ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ল সম্মেলনে এপ্রিল মাসেই নিউইয়র্কে অধ্যাপক গিডন গডলিয়ের মত প্রকাশ করলেন যে, বাংলাদেশে গণহত্যা চলছে এবং পাকিস্তানকে নিবৃত করা আমেরিকার কর্তব্য। বেঙ্গল স্টাডিজ কনফারেন্স, কমিটি অফ কনসার্নড এশিয়ান স্কলার্স, বেঙ্গল ক্রাইসিস কমিটি, আমেরিকান এনথ্রোপলজিক্যাল সোসাইটি, স্টুডেন্ট ওয়ার্ল্ড কনসার্ন- এই ধরনের আরো অনেক বুদ্ধিজীবী সমিতি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আওয়াজ তোলে।
নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ কনসার্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নিউইয়র্কে মেডিসিন স্কয়ার গার্ডেনে এই কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয় পয়লা আগস্টে। এবং দুইবারে চল্লিশ হাজার শ্রোতা এতে উপস্থিত থাকেন। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন পন্ডিত রবি শংকর। তারই অনুরোধে মাত্র চার পাঁচ সপ্তাহের

৪৯৩

প্রস্তুতিতে এই অনুষ্ঠান হয়। বিটলস ম্যানেজার এলেন ক্লাইন এর সমুদয় খরচ বহন করেন এবং কনসার্ট পরবর্তী রেকর্ডের সব আয় বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ব্যয় করা হয়। কিছু বাড়তি তহবিল বাংলাদেশ উন্নয়ন কার্যক্রমে ১৯৮৯-৮০ সালে ব্যবহৃত হয়। এই কনসার্টে অংশ নেন জর্জ হ্যারিসন, রিংগো স্টার, লিয়ন রাসেল, বিলি প্রেস্টন এবং উদীয়মান গায়ক বব ডিলান। উস্তাদ রবিশংকর এবং আলী আকবর খানও এতে অংশ নেন।

আমেরিকার পাকিস্তানী কূটনৈতিক মিশনে নিযুক্ত বাঙালি কর্মচারিরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। ওয়াশিংটনে গাউসুদ্দিন আহমদ তো পয়লা এপ্রিলেই বরখাস্ত হন। নিউইয়র্কে ২৬ এপ্রিল মাহমুদ আলী আনুগত্য পরিবর্তন করেন। ওয়াশিংটনে সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক খান কংগ্রেসে বাংলাদেশের ওপর শুনানিতে হাজির হন ১১ মে। তাকে ১৭ তারিখে এর জন্য বরখাস্ত করা হয়। তার বরখাস্তের প্রতিবাদ করেন তিনজন কর্মচারী ফজলুল বারী, মুহিদ আহমদ চৌধুরী আর মোশতাক আহমেদ। প্রথম ধাপে বারীকে বরখাস্ত করা হয়। এবং তারপর মুহিদকে। মোশতাক দূতাবাস কে কোন সুযোগ না দিয়ে ৪ আগস্টে নিজেই আনুগত্য পরিবর্তন করেন। নিউইয়র্কে দুজন কর্মচারী মোহাম্মদ গোফরান এবং জাকিউল হক চৌধুরীকে জুন মাসে কোন না কোন অজুহাতে বিতাড়ন করা হয়। মাহমুদ আলী ছাড়া অন্য কোন কূটনীতিবিদ সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষে অনেকদিন না আসায় বাঙালি মহলে যথেষ্ট অসন্তোষ গড়ে ওঠে। শিকাগোর ফজলুর রহমান খান এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দূত রেহমান সোবহানও বাঙালি কূটনীতিবিদদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যান। ৩০ জুন আমি ওয়াশিংটন দূতাবাস ছাড়ি এবং ২১ জুলাইতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে আমার পদত্যাগপত্র পাঠাই। অবশেষে মুজিবনগর সরকার ৫ জুলাই তারিখে বাঙালি কূটনীতিবিদদের তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করতে নির্দেশ দেন। এই নির্দেশনামা সবখানেই পাঠানো হয়। তবে অনেকক্ষেত্রে কূটনৈতিক সার্ভিসের সদস্য ছাড়া অন্য কারো কাছে পৌঁছেনি। ওয়াশিংটন নিউইয়র্কের কূটনীতিবিদরা মুজিবনগর সরকারের প্রথম ডাকেই সাড়া দিয়ে ৪ আগস্ট সবাই মিলে আনুগত্য পরিবর্তন করে। ওয়াশিটন তখন খুব ই উত্তপ্ত। ১৫ জুলাই সান ডিয়াগো থেকে নিক্সন কিসিঞ্জারের চীনা অভিযান প্রকাশ করেন এবং শীর্ষ বৈঠকে চীন যাবার ঘোষণা দেন। ৩ আগস্ট কংগ্রেসে প্রতিনিধি পরিষদ ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স বিলে পাকিস্তান ও গ্রিসকে সবরকম সাহায্য বন্ধ করতে সংশোধনী এঁটে দেয়। পয়লা আগস্ট এড হিউম্যানের জাতীয় প্রোগ্রামে এনবিসি টেলিভিশন আমার বক্তব্য ‘কেন পাকিস্তান ছাড়লাম’ প্রচার করে এবং পরদিন পিবিএসএ আগ্রোনস্কি শো তে আর একটি বিবৃতি প্রচার করে। ২ আগস্ট ‘টাইম’ এবং ‘নিউজউইক’ বাংলাদেশের উপর প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘টাইম’ এর কাহিনীর শিরোনাম ছিল “পাকিস্তানঃ তীব্র যন্ত্রণা; সোনার

৪৯৪

বাংলার বলাতকার” আর ‘নিউজউইক’ বলে “বাংলাঃ একটি জাতির হত্যা”। এর মধ্যে ৪ আগস্ট ন্যাশনাল প্রেসক্লাবে আমি একটি সংবাদ সম্মেলন আহবান করি। এই সম্মেলনে আমি কূটনৈতিক মিশনে আমার সহকর্মীদের উপস্থাপন করি। এই দলে ছিলেন মোট ১৪ জন বাঙালি। ছয়জন কূটনৈতিক কর্মকর্তা ছিলেন- নিউইয়র্কের জাতিসংঘ মিশনের স্থায়ী উপপ্রতিনিধি সৈয়দ আনওয়ারুল করিম (পরবর্তীতে পররাষ্ট্র সচিব ও জাতিসংঘের রাষ্ট্রদূত) ওয়াশিংটনের দ্বিতীয় ব্যক্তি এনায়েত করিম (পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে পরলোকগত) , কাউন্সিলর শাহ এম এম শামসুল কিবরিয়া শিক্ষা কাউন্সেলর সৈয়দ আবু রুশদ মতিন উদ্দিন (প্রসিদ্ধ কথাসাহিত্যিক এবং শিক্ষা পরিদপ্তরের পরিচালক) , দ্বিতীয় সচিব ও হিসেব রক্ষক আতাউর রহমান চৌধুরী (পরবর্থীতে সামরিক প্রধান হিসেব রক্ষক এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কার্যক্রমে কর্মলিপ্ত) এবং সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী (প্রাক্তন সচিব)। এনায়েত করিম এই সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারেননি কারণ তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সিবলি হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পাকিস্তান মিশন দুটির সমুদয় বাঙালি চাকুরে ঐদিন বাংলাদেশের উপর আনুগত্য প্রকাশ করেন। আমাদের সংবাদ সম্মেলনে আনোয়ারুল করিম যখন বিবৃতি দিচ্ছিলেন ঠিক সেই সময় রাস্তার ওপারে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট নিক্সনও একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি চীন উদ্যোগ নিয়েই মূল আলোচনা করেন। তবে শুরুতেই বাংলাদেশ সংকট নিয়ে বক্তব্য রাখেন। তিনি প্রতিনিধি পরিষদের সংশোধনীর বিরুদ্ধে মন্তব্য করেন। ত্রাণকার্যে মার্কিন ভূমিকা তিনি তুলে ধরেন এবং অনিচ্ছাকৃত হলেও একটি অত্যন্ত সত্য কথা বলেন। তিনি বলেন, “আমাদের গঠনমূলক ভূমিকা হবে পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য অব্যাহত রাখা।” আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের উপর ঢাকঢোল পিটিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে চাইনা কারণ এতে কোন ফায়দা হবেনা।আমরা বরং একান্ত সূত্রে আলোচনা চালিয়ে যাব।
আমেরিকায় একযোগে সব কূটনীতিবিদের আনুগত্য পরিবর্তন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এ নিয়ে মার্কিন পত্রপত্রিকা এবং সংবাদ মাধ্যমে হৈ চৈ হয়, কংগ্রেসে বিবৃতি হয় এবং দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে একটি ছোটখাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ৯ আগস্টে ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান এ বিষয়ে সম্পাদকীয় মন্তব্য করে যে এটি একটি নাটকীয় ঘটনা এবং প্রতিবাদের একটি বলিষ্ঠ উদাহরণ। মুজিবনগর সরকার চট্টগ্রামের সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকীকে (পরবর্তীতে বানিজ্যমন্ত্রী) উত্তর আমেরিকায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠান। তিনি ৫ আগস্টে ওয়াশিংটন পৌঁছেন এবং আগস্টের শেষেই ১২২৩ কানেকটিকাট এভিনিউতে বাংলাদেশ মিশন স্থাপিত হয়। মার্কিন আইন অনুযায়ী এটি হয় একটি নিবন্ধিত বিদেশী এজেন্ট। এই মিশনের প্রধান কাজ হয় মুজিবনগরের সঙ্গে যোগাযোগ। আমেরিকায় বাঙালি ও অন্যান্য বন্ধু গোষ্ঠিকে উৎসাহ প্রদান, বাংলাদেশ সম্বন্ধে তথ্য সরবরাহ, প্রচার ও জনমত

৪৯৫

গঠন এবং বিশেষ করে কংগ্রেস উত্থাপিত সংশোধনী বা প্রস্তাবাবলির জন্য তদবির করা। ৩ সেপ্টেম্বর থেকে মিশন একটি সাপ্তাহিক সংবাদ বুলেটিন প্রকাশ করতে থাকে। জানুয়ারীতে এই বুলেটিন পাক্ষিকে পরিণত হয়। এবং বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশন প্রতিষ্ঠার পর এর প্রকাশনা বন্ধ হয়। এই প্রকাশনার দ্বায়িত্বে ছিলেন আবু রুশদ এবং তার সহকারী প্রয়াত শেখ রুস্তম আলী। বাংলাদেশ মিশনের সদস্যরা আমেরিকার সর্বত্র আলোচনা সভা, সংবাদ সম্মেলন, টেলিভিশন প্রোগ্রাম, র‍্যালি, টিচ ইন এসব কার্যক্রমে লিপ্ত থাকেন। তবে অন্যতম প্রধান কাজ ছিল কংগ্রেস ও ওয়াশিংটনে নানা মহলে লবি করা।
মার্কিন প্রকাশনা ও প্রচার (মুদ্রন ও ইলেক্ট্রনিক্স) মাধ্যমে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধকে শুরু থেকেই সুনজরে দেখেন। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস নানাভাবে বাংলাদেশ সম্বন্ধে মার্কিন উৎসাহ ও আগ্রহ তারা অটুট রাখেন। নিউইয়র্কের প্রচ্ছদে বাংলাদেশ সংকট ৩ বার স্থান পায়। ৫ এপ্রিল, ২ আগস্ট এবং ৬ ডিসেম্বর। তাইমসে এই সুযোগ হয় ২ বার। ২ আগস্ট এবং ৬ ডিসেম্বর। জাতীয় সংবাদপত্রের কয়েকজন রিপোর্টার এবং বিশ্লেষক সারা বছর ধরেই বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ এ ছিলেন সিডনি শ্যানবার্গ, ম্যালকন ব্রাঊন, অ্যান্টনি লুইস, বেঞ্জামিন ওয়েলস ও টেড গুলজ। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এ ছিলেন, ডোলিগ হ্যারিসন, স্ট্যানলি কারনো, জিম হোগল্যান্ড, রনাল্ড কোডেন, লি লেস্কাজ, লুইস সিমনস, এবং টেরেন্স স্মিথ। ‘ওয়াশিংটন ইভনিং স্টার’এ ছিলেন হেনরী ব্যাশডার, জর্জ শারমান, এবং ক্রসবি নোয়েস। ‘বাল্টিমোর সান’ এ ছিলেন এডমি ক্লইমার, ফিলিপ পটার, এবং জন উডরাফ। ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ এ ছিলেন পিটার ক্যান এবং রবার্ট কাটলি। ‘ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর’এ ছিলেন হেনরি হেওয়ার্ড, লুসিয়া মুয়াট এবং ডেনিয়েল সাদারল্যান্ড। কলাম লেখকদের মধ্যে বোধ হয় শুধু জোসেফ আলসপ নিক্সন পাকিস্তানের পক্ষে কলম ধরেন। জাতীয় সংবাদপত্র ছাড়াও মফস্বলের সংবাদমাধ্যমেওবাংলাদেশ সংকট হরহামেশা স্থান পেত। পাবলিক ব্রডকাস্টিং এর (পিবিএস) প্রোগ্রাম ওয়াশিংটনে নিউজ কনফারেন্স, আগ্রানস্কি শো এবং এডভোকেটে বারবার বাংলাদেশ আলোচিত হয়।
বাংলাদেশের তরফ থেকে অধ্যাপক রেহমান সোবহান ছিলেন আমেরিকায় প্রথম মুখপত্র। মে মাসে ওয়াশিংটন নিউজ কনফারেন্সে তিনি বক্তব্য রাখেন, আবার অক্টোবরে বোস্টন থেকে জাতীয় প্রোগ্রাম অ্যাডভোকেটেও হাজির থাকেন। ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং (এনবিসি) এর কমেন্টস এবং ক্রনোলগ প্রোগ্রামে বাংলাদেশের বিশেষ প্রচার হয়। কমেন্টসএ আমি বক্তব্য রাখি এবং ক্রনোলগ ছিল ২৮ নভেম্বরে বাংলাদেশ সংকটের দুই ঘন্টা ব্যাপী একটি ব্যাপক প্রোগ্রাম। আমেরিকান ব্রডকাস্টিং (এনবিসি) এর ট্রেড কোপের ছিলেন বাংলাদেশ বিষয়ে একরকম সার্বক্ষণিক রিপোর্টার। তাদের ইস্যুজ এন আনসার প্রোগ্রামে অনেক

৪৯৬

বিতর্ক হয়, যার একটিতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত লক্ষীকান্ত ঝা আর পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগা হিলালী মুখোমুখি হন। আগা হিলালী আর লক্ষীকান্ত ব্যক্তি জীবনে বন্ধু ছিলেন। তারা দুজনেই ১৯৩৬ সালে আইসিএস এ যোগ দেন। তবে দেশ বিভাগের পর ওয়াশিংটনেই একসঙ্গে নিযুক্ত ছিলেন। ফক্স টেলিভিশনের ওয়াশিংটন পেনোরমা প্রোগ্রামে আধা ঘন্টা ধরে লম্বা আলোচনা চলত। এই প্রোগ্রামে একদিন পাকিস্তানের তরফ থেকে বক্তব্য রাখেন আগা হিলালী আর ঈকদিন সমান সময়ের দাবিতে আমি হাজির হই সেই প্রোগ্রামে। মফস্বলের রেডিও ও টেলিভিশনও কম যেত না। সংবাদমাধ্যম বস্তুতই ছিল বাংলাদেশের পরম বন্ধু।
বাংলাদেশের প্রথম প্রতিনিধি হিসেবে আমেরিকায় আসেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি ওয়াশিংটনে পৌঁছান। প্রথমবারেই তিনি প্রচারমাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি কংগ্রেসে আনাগোনা করেন। রিপাবলিকান সিনেটর ওহায়োর উইলিয়াম সাক্সবি তার জন্য একটি মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করেন। বিশ্বব্যাংকে দক্ষিণ এশিয়ার ডাইরেক্টর পীটার কারগিল। বিশেষ প্রকল্পের ডাইরেক্টর রবার্ট সেডোভ এবং প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারার সঙ্গে তার মোলাকাত হয়। তিনি সফল সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি যখন ওয়াশিংটনে পৌঁছেন সেই সময়ে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মীর্জা মোজাফফর আহমদও সেখানে আসেন, রেহমান ওয়াশিংটনের বাইরেও বাঙালি ও মার্কিন শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। রেহমান দ্বিতীয়বার আমেরিকায় আসেন সেপ্টেম্বরে এবং নভেম্বর পর্যন্ত অবস্থান করেন। এবারে তিনি কংগ্রেসে লবি করেন, বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় তদবির করেন, নানা জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান এবং বাংলাদেশের জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলে যোগ দেন। মে মাসে মুজিবনগর সরকারের তরফ থেকে দ্বিতীয় এক প্রতিনিধির আগমন হয়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ২৪ মে নিউইয়র্কে আসেন। তিনি জাতিসংঘে যোগাযোগ করেন ও বাঙালি গোষ্ঠীকে উদ্বদ্ধ করেন। তাঁর দ্বিতীয় আগমন হয় অক্টোবরে জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে। তিনিও নানা জায়গায় সভা সমিতি করেন।
জুন মাসে বিশ্বব্যাংক থেকে একটি মিশন বাংলাদেশে যায় সেখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। এই মিশন একটি বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন প্রণয়ন করে। মিশনের নেতা পিটার কারগিল ২৯ জুনে প্যারিসে পাকিস্তান দাতাগোষ্ঠির সভায় তার মতামত ব্যক্ত করেন। ভীতি ও ধ্বংসের দেশ বাংলাদেশে কোন রকম অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার সুযোগ নেই বলেই ছিল মিশনের অভিমত। দাতাগোষ্ঠী পাকিস্তানকে নতুন সাহায্যদানে বিরত থাকে এবং ঋণ বেয়াতি দিতেও আপত্তি জানায়। শুধু আমেরিকা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে রাজি ছিলনা। ১২ জুলাই বিশ্বব্যাংকের খসড়া প্রতিবেদন ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ এ প্রকাশিত হয়। এই খবরটি ছিল

৪৯৭

পাকিস্তানের জন্য মারাত্মক। এতে বলা হয় বাংলাদেশে ভীতি ও সন্ত্রাসের রাজত্ব বহাল। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির এবং সর্বত্র ধ্বংসলীলা পরিলক্ষিত হয়। কুষ্টিয়া সম্বন্ধে একটি মন্তব্য ছিল ‘শহরটিকে মনে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরিত্যক্ত বোমাবর্ষণে বিধ্বস্ত একটি জার্মান শহর। মানুষ হতবুদ্ধি, আমরা ঘুরতে গেলে সবাই পালিয়ে যায়। এটা যেন ছিল আণবিক আক্রমনের পরবর্তী সকাল।”
ওয়াশিংটনে শেরাটন পার্ক হোটেলে ২৬ সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংক ও অর্থ তহবিলের বার্ষিক সভা শুরু হয়। সেখানে বাংলাদেশের তরফ থেকে রেহমান সোবহান এবং আমি অনেক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মোলাকাত করি। ড. নুরুল ইসলামও (পরবর্তীতে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান) একদিন আমাদের সঙ্গ দেন। বাঙালিরা ২৮ তারিখ হোটেলের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ২ অক্টোবরে পাকিস্তান দাতাগোষ্ঠীর একটি সভা বসে। এবারেও পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদান স্থগিত থাকে। নভেম্বরে এ বিষয়ে আর একবার উদ্যোগ নেবার কথা ছিল, কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি।
আগস্ট মাসে কানাডায় টরেন্টো শহরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় বাংলাদেশ সংকট নিয়ে ১৯ আগস্ট এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিবিদ ও জাতিসংঘের একজন আন্ডার সেক্রেটারী জেনারেল স্যার হিউ কিনরি সাইড (তখনো তিনি নাইট উপাধিতে ভূষিত হননি)। এই সম্মেলনে সারা পৃথিবী থেকে অনেক গন্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। ব্রিটিশ সাংসদ জুডিথ হার্ট, কানাডীয় সাংসদ এনড্রু ব্রুইন, ভারতীয় রাজ্যসভা সদস্য অধ্যাপক নূরুল হাসান, আইরিশ আইনবিদ নীল ম্যাকডারমট, অধ্যাপক গুস্তাব এবং হানা পাপানেক, অধ্যাপক স্টানলি ওলপার্ট (ভুট্টো ও জিন্নাহর জীবনী লেখক) ড. হোমার জ্যাক, ড.জন এবং করনোলিয়া রোডি, ভারতীয় জেনারেল জয়ন্ত চৌধুরী, সাংবাদিক অজিত ভট্টাচার্য, মার্কিন কংগ্রেসের স্টাফ টম ডাইন ও মাইক গার্টনার ও আরো অনেক ব্যক্তি। বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছিলাম মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী এবং আমি। দুই দিনের এই সম্মেলনে টরেন্টো ডিক্লারেশন অফ কনসার্ণ ঘোষণা করে। এই ঘোষণায় পাকিস্তানে সবরকম সাহায্য বন্ধ রাখার আবেদন করা হয়। , সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান দাবি করা হয় এবং শেখ মুজিবের মুক্তি এবং জীবনের নিশ্চয়তা চাওয়া হয়।
মার্কিন মুলুকে বসবাসকারী একটি পাকিস্তানি বিশেষ মহল প্রগতিশীল বামপন্থীরা বাংলাদেশকে সমর্থন করে। পাকিস্তান স্টুডেন্টস নামে একটি ছাত্র সমিতির মুখপত্র এপ্রিল মাসে সামরিক শাসনের অবসান ও বাংলাদেশের দাবী মানার আহবান জানায়। কওসার সিদ্দিকী ছিলেন এই কাগজের সম্পাদক। পাকিস্তান ফোরাম ছিল বামপন্থীদের মুখপত্র। এই দলের ফিরোজ আহমেদ, পেন্টাগণ পেপার্সখ্যাত ইকবাল আহমদ এবং আয়জাজ আহমদ বাংলাদেশকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সমর্থন করে যান। একসময় লন্ডনের তারেক আলীও ওয়াশিংটনে এসে

৪৯৮

বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। এরা নানা র‍্যালি, সভা সমিতি বা টিচ ইনে অংশগ্রহন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংগে তাদের একাত্মতা ঘোষণা করেন। ডিসেম্বরে সরাসরি যুদ্ধ বাধলে তাদের অবস্থা বড় নাজুক হয়ে দাঁড়ায় এবং তাদের প্রায় চুপ করে যেতে হয়। তাঁরা আশা করেছিলেন যে, দুই দেশের মধ্যে একটি ভদ্র পরিবেশে বিচ্ছেদ সম্পাদিত হবে যেমন হয়েছিল এই শতাব্দীর শুরুতে সুইডেন ও নরওয়ের মধ্যে।
১৯৭১ সালের জাতিসংঘের সাধারন অধিবেশনে বাংলাদেশ একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ষোল সদস্যের এই দলে ছিলেন রাজনীতিবিদ, শিক্ষক ও কুটনীতিবিদ। আব্দুস সামাদ আজাদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, সৈয়দ আব্দুস সামাদ , ফণীভূষণ মজুমদার, সিরাজুল হক, ফকির শাহাবুদ্দিন আহমদ, ড. মফিজ চৌধুরী, ডা. আসাবুল হক, ড. এ আর মল্লিক, রাষ্ট্রদূত খুররম খান পন্নী, রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ, প্রতিনিধি এম আর সিদ্দিকী, সৈয়দ আনওয়ারুল করিম এবং আব্দুল মাল আবুল মুহিত ছিলেন এই দলের সদস্য। আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে বিচারপতির সুপারিশে তার একান্ত সচিব হিসেবে দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাঁরা নানা দলের সঙ্গে দেখা করে সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টা চালান। সদস্যরা আমেরিকার সর্বত্র সভা সমিতিতে বক্তৃতা দেন। ষোল থেকে বিশ অক্টোবর প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটনে যান এবং সেখানে জনপ্রতিনিধি দলের সঙ্গে মোলাকাত করেন। সিনেটর কেনেডি, সিনেটর পার্সি, এবং কংগ্রেস ম্যান গালাগারের সঙ্গে তাদের মোলাকাত হয়। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৪৭ টি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে বক্তব্য রাখে । তবে এইসব বক্তব্য ছিল রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আবেদন এবং মানবিক সাহায্য বিষয়ে সচেষ্ট হবার ঘোষণায় সীমাবদ্ধ। প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রামকে মূল্য দিতে কোন দেশেরই আগ্রহ ছিলনা। গণহত্যা বা আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার কোন মুখ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়নি । মানবাধিকার নিয়েও এখনকার মত কোন চেতনা তখন ছিলনা। মুক্তিযুদ্ধকালে জাতিসংঘের সমুদয় উদ্যোগ ছিল দুটি কাজে সীমাবদ্ধ।
ভারতে শরণার্থীদের সাহায্যদানে শরণার্থী কমিশন ও শিশু তহবিল বিশ্ব খাদ্য কার্যক্রম ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিছু তৎপর ছিল। আর্থিক সাহায্য ছিল অতি সামান্য। সাকল্যে মাত্র ২১৫ মিলিয়ন ডলার। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি ত্রাণ কার্যক্রম নেওয়া হয় কিন্তু সেই কার্যক্রম মোটেই কার্যকরী ছিলনা। কিভাবে ত্রাণ কার্য চলবে ও খাদ্য সরবরাহ করা হবে, কারা তা পর্যবেক্ষণ করবে কার কি দ্বায়িত্ব হবে এই নিয়ে মাত্র নভেম্বর মাসে জাতিসংঘ এবং পাকিস্তানের মধ্যে স্মারক চুক্তি সম্পন্ন হয়। তাই ত্রাণ কাজ শুরু হবার আগেই তা বন্ধ হয়ে যায়। আমেরিকা বেশ খাদ্য সাহায্য প্রদান করে কিন্তু তার অতি সামান্য অংশই বাংলাদেশে পৌঁছানো সম্ভব হয়। মার্কিন সাহায্যের ১০৯

৪৯৯

মিলিয়ন ডলারের মধ্যে প্রায় ৭৫ মিলিয়ন ডলারই ব্যবহারের সুযোগ হয়নি। তবে যুদ্ধ শেষে ত্রানকার্য পরিচালনার জন্য একটি কাঠামো ও সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। সবচেয়ে কৌতুকের বিষয় ছিল, পাকিস্তানের জাতিসংঘ প্রতিনিধি দল। ১৫ সদস্যের নেতা ছিলেন একজন বাঙালি রাজনীতিবিদ মাহমুদ আলী। শাহ আজিজুর রহমান (পরবর্তীকালে জেনারেল জিয়ার প্রধানমন্ত্রী), রাজিয়া ফয়েজ (পরবর্তীতে সাংসদ), জুলমত আলী (পরবর্তীতে বেগম জিয়ার রাষ্ট্রদূত), এ টি সাদী এবং ড. ফাতেমা সাদেক ছিলেন এই দলের অন্যান্য সদস্য। সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে ছিলেন বাঙালি ইউসুফ জামিল আহমেদ। পাকিস্তানের ইতিহাসে এত বাঙালি কোন প্রতিনিধিদলে ছিলেন না। তবে এসব প্রতিনিধি ছিল সব কুইসলিং এবং রাজাকার।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ওয়াশিংটনে এসে পৌঁছালেন ৪ নভেম্বরে। তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে দেখা করলেন। কংগ্রেসে আলোচনা করলেন এবং বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মোলাকাত করলেন। ওয়াশিংটনে তিনি একটি সংবাদ সম্মেলন করলেন ৫ নভেম্বর। নিউইয়র্কে তিনি সভা সমিতি করলেন ও অনেক বক্তব্য রাখলেন। এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল বিনা যুদ্ধে সমঝোতার শেষ সুযোগ পরখ করে দেখা। তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সংলাপে তার কোন আপত্তি নেই। তবে হাত মুষ্টিবদ্ধ থাকলে হাত মেলানো যায়না।’ অথবা ‘একজন অনির্বাচিত ব্যক্তি যিনি সামরিক স্বৈরশাসকও বটে তাকে সমর্থন করে পাকিস্তানকে রক্ষা করা যাবেনা।
” নিক্সন-কিসিঞ্জার বস্তুতই বাংলাদেশ সংকটকে মোটেই পাত্তা দেন বলে মনে হয়না। তাই শ্রীমরি ইন্দিরা গান্ধী কোন আশা নিয়ে তাঁর সফর সমাপ্ত করতে পারলেন না। তিনি প্রত্যাবর্তন করার পর কিসিঞ্জার পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব সুলতান মোহাম্মদ খানের সঙ্গে সমঝোতার বিষয় উত্থাপন করেন। অবস্থা গুরুতর হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের উত্তর ছিল যে ঐ চিন্তা ডিসেম্বরের শেষে তথাকথিত বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার পর বিবেচনা করা যাবে। ভারত যখন এক কোটি শরণার্থীর ভারে জর্জরিত, বাংলাদেশ যখন গেরিলা যুদ্ধে সর্বত্র সফল তখন মার্কিন সরকার আর পাকিস্তান একটি পুতুল সরকার গঠনের প্রস্তুতিতে নিমগ্ন। এই ক্ষেত্রে সমাধানের কোন উপায়ই ছিলনা।
৩ ডিসেম্বর পাক ভারত যুদ্ধ শুরু হল। ৬ ডিসেম্বরে এই যুদ্ধ ভারত বাংলাদেশের যৌথ শক্তির বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধে রুপান্তরিত হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটনাবলী ছিল চমকপ্রদ। এত দ্রুতগতিতে একটি বাহিনী আর একটি বাহিনীকে পরাস্ত করে এগিয়ে যাচ্ছে। এত সহজে আকাশ এত মুক্ত। যুদ্ধক্ষেত্রের এ সঠিক এবং খুঁটিনাটি খবরাখবর সব আগুয়ান বাহিনির নখাগ্রে। কিন্তু আমেরিকায় এই সময়ে অভিনীত হয় একটি অনবদ্য প্রহসন আর সেই নাট্যশালা ছিল জাতিসংঘের

৫০০

সম্মেলন কক্ষ। ৪ ডিসেম্বরেই মার্কিন অনুরোধে যুদ্ধের বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত হল। মার্কিন প্রচেষ্টা হল, কোনমতে পাকিস্তানকে পরাজয়ের হাত থেকে রক্কা করা। তাই একের পর আরেক যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পেশ করা হল। ৪ তারিখে রাশিয়া প্রথম ভেটো প্রয়োগ করল। তারপর ৫ তারিখে আবার। এবার পটপরিবর্তন করে বিষয়টি গেল সাধারণ পরিষদে, সেখানে অকার্যকর প্রস্তাবও পাশ হয়ে গেল ৭ ডিসেম্বরে। ১০ তারিখে কানাঘুষায় প্রকাশ পেল যে, পাকিস্তানের পূর্ব কমান্ডের জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পন করবে এবং এই বিষয়ে জাতিসংঘের মধ্যস্ততা চান।
এই আবেদন কিসিঞ্জার সাহেবের কৌশলের শিকার বলে সব ভেস্তে গেল। ১৫ ডিসেম্বরে নিরাপত্তা পরিষদ আবার বসল পাকিস্তানের মনোনীত ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর আহবানে। সেখানে কাগজপত্র তছনছ করে, চোখে পানি এনে ভুট্টো একটি চমৎকার নাটক করে রেগেমেগে সম্মেলন কক্ষ ছেড়ে গেলেন। তারপর নিরাপত্তা পরিষদ ছাড়াই ১৬ তারিখে ঢাকায় আত্মসমর্পন হল। ভারত যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একদিন পরে তা মেনেও নিলেন। ভুট্টো দেশের পথে পাড়ি দিলেন। বেশ কদিন পরে ২১ তারিখে নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পেশ করল। প্রহসন আর কাকে বলে।
মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ সংকট সারা বছর প্রাধান্য পায়। সেই পয়লা এপ্রিলেই এই বিষয়ে প্রথম আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই বিষয়ে ২১০ টি বিবৃতি কংগ্রেসের দুই কক্ষে প্রদত্ত ৪৫ জন সিনেটর আর ৩৬ প্রতিনিধি এই বক্তৃতা গুলো দেন। বিবৃতি তো খালি বিবৃতি নয়। প্রায়ই সংযোজিত হয় অনেক সংবাদ, অনেক প্রতিবেদন এবং অনেক অভিমত। সিনেটর চার্চ এক বক্তৃতা শেষে ৬৮ পৃষ্ঠার সংযোজনী লিপিবদ্ধ করান। এইসব বিবৃতিতে দেখা যায়, বাংলাদেশের জন্য গভীর দরদ ও সহানুভূতি এবং সরকারি নীতির তীব্র সমালোচনা। দুই দলের সদস্যরা মার্কিন পাকিস্তান ঘেঁষা নীতির সমালোচনায় ছিলেন মুখর। কংগ্রেসের কার্যাবলী বিশ্লেষণ করলে আমেরিকায় কিভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিবেচিত হয় অথবা অথবা প্রভাব বিস্তার করে তা সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলাদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবির সমর্থনে কংগ্রেস ছিল সোচ্চার এবং এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সমাধান তারা দাবি করেন। সামরিক সরকারকে তারা এ ব্যাপারে দুভাবে অভিযুক্ত করেন। গণহত্যা ও নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকারের নীরবতায় তাঁরা ক্ষুব্ধ হন এবং এটা বন্ধ করার জন্য তাঁরা মার্কিন প্রভাবের বলিষ্ঠ প্রয়োগ দাবি করেন। ভারতে বাঙালি উদ্বাস্তুদের ত্রাণকাজে শক্তিশালী ভূমিকা রাখার জন্য কংগ্রেস আহবান জানায়।
সামরিক সাহায্য স্থগিত করা এবং যেসব সমরাস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছিল তা বন্ধ করা হল কংগ্রেসের প্রথম দাবি। এই বিষয়ে কংগ্রেসে মোট পাঁচটি প্রস্তাব পেশ করা হয়। ১৫ এপ্রিলে প্রথম প্রস্তাব করেন সিনেটর কেইস এবং মন্ডেইল।

৫০১

প্রতিনিধি পরিষদে এই প্রস্তাবেরই অনুরূপ দুটি প্রস্তাব পেশ হয়। একমাস পরে একটি পেশ করেন কংগ্রেসম্যান গ্রস আর অন্যটি কংগ্রেসম্যান হেলপার্ন। কিছুদিন পর আবার পয়লা জুলাই তারিখে এই রকম প্রস্তাব দুটি কক্ষেই দেওয়া হয়। সিনেটে প্রস্তাব দিলেন ম্যারিল্যান্ডের রিপাবলিকান সিনেটর রবার্ট মেথিয়াস এবং হাউসে ম্যাসাচুসেটসের রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ব্র্যাডফোর্ড মোর্স। মার্কিন প্রশাসন এপ্রিল মাসেই ঘোষণা দেন যে, পাকিস্তানে কোন সামরিক সাহায্য দেওয়া হবেনা। এবং সব সরবরাহ বন্ধ করা হছে। বারবার এই ঘোষণা সবাইকে জানানো হয় বিশেষ করে জনপ্রতিনিধিদের। কিন্তু ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ ২২ জুন সচিত্র খবরে প্রকাশ করল যে পাকিস্তানে মার্কিন সমরাস্ত্র বা সামরিক সামগ্রী সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। এতে কংগ্রেসে বিরিক্তি ও ক্ষোভ চরমে পৌঁছে। এবং এ প্রেক্ষিতে জুলাই মাসে প্রস্তাবটি আবার পেশ করা হয়। সামরিক সাহায্য বন্ধ করতে নিক্সন সরকার মোটেই উৎসুক ছিলনা এবং নানা ছুতোয় এই সাহায্য বহাল থাকে। সাহাযের কলেবর বড় না হলেও তাকে অব্যাহত রাখা ছিল পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন প্রকাশের একটি নির্দেশক। অবশেষে কংগ্রেসের নিরবচ্ছিন্ন চাপে ৮ নভেম্বর সামরিক সাহায্য ও সরবরাহ বন্ধ করা হয়। এই খবরটিও কংগ্রেসের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সিনেটর কেনেডি তার বক্তৃতায় এই তথ্য প্রকাশ করেন। নানা হিসেবে ধারনা করা হয় যে, সামরিক সাহায্যের পরিমান ছিল ৫ মিলিয়ন ডলারের মত। কিন্তু এ ব্যাপারেই নির্বাহী বিভাগ সবচেয়ে বেশি সমালোচনার সম্মুখীন হয়। এবং এই বিষয় নিয়েই হয় ভারতের সঙ্গে সবচেয়ে কঠোর মনোমালিন্য।
একেবারে শুরুতেই বাংলাদেশে ত্রাণকার্যের প্রতি কংগ্রেস আগ্রহ প্রকাশ করে। সিনেটর হ্যারিস ১৯ এপ্রিলে একটি ব্যাপক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বাংলাদেশে পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রমকে প্রাধান্য দেয়া হয়। তিনি সামরিক সাহায্য বন্ধের আবেদন করেন। অর্থনৈতিক সাহায্যকে একটি আবদ্ধ তহবিলে জমা দিতে বলেন। যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক মধ্যস্ততার প্রস্তাব দেন্সর্বোপরি মানবিক সাহায্য ও ত্রাণকার্য চালিয়ে যেতে বলেন। এবং আবদ্ধ তহবিলকে শান্তি প্রতিষ্ঠার পর ব্যবহারের সুপারিশ করেন। ২১ তারিখ কংগ্রেসম্যান শিউর বাংলাদেশ রেডক্রসকে ত্রাণকাজ পরিচালনার জন্য অবাধ অধিকার দাবি করে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ, খাদ্য সরবরাহ, যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণকাজ এসব নিয়ে অনেক বক্তব্য প্রদত্ত হয়। সিনেটর কেনেডির শরণার্থী সাব কমিটির শুনানিতেও এই বিষয় প্রাধান্য পায়। এই সাব কমিটির তিনটি শুনানির একটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ত্রাণকার্য ও মানবিক সাহায্য নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
যে বিষয় সর্বক্ষণের জন্য কংগ্রেসেরে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হচ্ছে ভারতের শরণার্থী সমস্যা। সিনেটর কেনেডির শরনার্থী সাব কমিটি এই বিষয়ে তিনটি

৫০২

শুনানির ব্যবস্থা করে। প্রথম শুনানি হয় ২৮ জুন, আর এতে অব্যাহত সামরিক সরবরাহ হয়ে ওঠে আলোচনার সবচেয়ে উত্তপ্ত বিষয়। সিনেটর কেনেডি গালাগার কমিটির শুনানিতে সাক্ষ্য দেন ১১ মে। সেখানেই তিনি শরণার্থীদের সমস্যা ও মানবিক সাহায্যের বিষয় তুলে ধরেন। কেনেডি কমিটির দ্বিতীয় শুনানি হয় ২২ জুলাই। এই শুনানিতে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা হয় আলোচনার মূল বিষয়। ত্রাণকাজ এবং খাদ্য সরবরাহ যে সামরিক বিজয়ের কৌশল হতে পারে, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। জাতিসংঘের ছত্রছায়ায় কি করে ত্রাণকাজ মানুষের মঙ্গলে নিয়োজিত হতে পারে এই বিবেচনা সব সময়েই গুরুত্ব পায়। পর্যবেক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা না হওয়ার ফলে বস্তুতই জাতিসংঘ ত্রাণ কার্যক্রম দারুনভাবে বিঘ্নিত হয়। আগস্ট মাসে সিনেটর কেনেডি তার কমিটির স্টাফ ডেল ডিহান আর জেরি স্পিকার এবং দুজন বিশেষজ্ঞ ডিন জন লুইস (কার্টার আমলে ওইসিডিতে রাষ্ট্রদূত ও বর্তমানে প্রিন্সটনে অধ্যাপক) এবং ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউটের অধ্যাপকপুষ্টিবিশারদ নেভিন স্ক্রিমশো ভারপ্তে শরণার্থী কেন্দ্র পরিদর্শনে যান। তাদের পূর্ব পাকিস্তানেও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তা বানচাল করে দেয়। সিনেটর ওয়াশিওংটনে ফিরে ২৬ আগস্ট একটি সংবাদ সম্মেলনে এই পরিদর্শনের উপর বক্তব্য রাখেন। এই প্রথম তিনি পাকিস্তানে শুধু সামরিক সাহায্য নয়, অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের দাবি সমর্থন করেন। শরণার্থী কেন্দ্রের বিরাট খরচ নিয়েও তিনি মন্তব্য করেন এবং এ ব্যাপারে উন্নত দেশগুলোকে আরো উদার হতে আহবান করেন। সর্বোপরি তিনি শরনার্থী সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশে সামরিক আগ্রাসন থামানোর ব্যবস্থা নিতে বলেন। মার্কিন সাহায্য যাতে পর্যাপ্ত হয় সেজন্য ২৩ সেপ্টেম্বর সিনেটর কেনেডি ত্রাণকাজের জন্য ৪০০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দের জন্য একটি বিল উত্থাপন করেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ২৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ চেয়ে বিল পেশ করেন। শেষ পর্যন্ত এই বরাদ্দই বহাল থাকে। কেনেডি কমিটির তৃতীয় শুনানি হয় দুইদিন ব্যাপী ৩০ অক্টোবর ও ৪ নভেম্বরে। এবার ডিন লুইস, অধ্যাপক স্ক্রিমশো এবং আরো অনেকে সাক্ষ্য প্রদান করেন। এই শুনানির প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় পয়লা নভেম্বরে আর তাতে যা প্রাধান্য পায় তা হল সংকট সমাধানের রাজনৈতিক উদ্যোগ এবং ভারত মার্কিন সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন। দক্ষিণ এশিয়া সংকটের সামগ্রিক বিশ্লেষনের জন্য আরো কজন সিনেটর ও কংগ্রেস ম্যান ভারত ও পাকিস্তান সফর করেন। কংগ্রেসম্যান গালাগার ছিলেন প্রথম পরিদর্শক। তিনি জুন মাসে ভারতে যান এবং বাংলাদেশ সীমান্তেও হাজির হন। সিনেটর পার্সি যান আগস্ট সেপ্টেম্বর মাসে। কংগ্রেসম্যান ফিলিং হাউসেন যান সেপ্টেম্বর অক্টোবরে। সিনেটর স্যাক্সবি ও চার্চ যান নভেম্বরে এবং যুদ্ধের পূর্বক্ষণে রণাঙ্গন ত্যাগ করেন। গালাগার এবং চার্চ ছাড়া বাকি সবাই পাকিস্তানেও সফর করেন। এসব প্রতিনিধি বিশেষ করে শরণার্থীদের অবস্থা

৫০৩

সরেজমিনে পরিদর্শন করেন এবং শরণার্থীদের দুরবস্থা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নিক্সন সরকার মানবিক সাহায্য প্রদানে দরাজহস্তই ছিল, তবে তাদের আগ্রহ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে অধিকতর সাহায্য প্রদান। শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য মার্কিন সাহায্য বরাদ্দ করা হয়। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানে সাহায্য ব্যবহারের উপায় বিশেষ ছিলনা বলে বরাদ্দকৃত বা অংশীদারকৃত সাহায্য খুব কমই ব্যবহার হয়। শরণার্থীদের জন্য সাহায্যও তত বেশি না হলেও অঙ্গীকার ছিল উদারতার। নির্বাহী বিভাগ ভেবেছিল যে, মানবিক সাহায্যে কার্পণ্য না করলে তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে ও বিনা বাধায় পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ও সামরিক সাহায্য সমর্থন দিয়ে পার পেয়ে যাবে। কেনেডি কমিটি বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আর একটি শুনানির ব্যবস্থা করে। এটি ছিল ২ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ সালে আর এর বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশ ও ভারতে ত্রাণকাজ এবং শরণার্থী পুনর্বাসন।
যে বিষয়টি কংগ্রেসে সবচেয়ে বেশি আগ্রহের সঞ্চার করে আর যে বিষয়ে দুমাস ধরে অনবরত তদবির হয় তা ছিল বৈদেশিক সাহায্য আইনের সংশোধন। পাকিস্তানে সবরকম সাহায্য রহিত করার জন্য ফরেন অ্যাসিসট্যান্স আইনে একটি সংশোধনী উত্থাপন করা হয়। এই সংশোধনী নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয় এপ্রিল মে মাসে। আইন করে নির্বাহী বিভাগের হাত বেঁধে না দিলে নিক্সন কিসিঞ্জার জুটিকে পাকিস্তানের সমর্থন থেকে বিরত করা যাবে বলে মনে হয়নি। এই সংশোধনীর জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে সি আর এল গোষ্ঠী, ইনফরমেশন সেন্টার এবং বাংলাদেশ মিশন। প্রতিনিধি পরিষদে গালাগার আর সিনেটে স্যাক্সবি এবং চার্চ এই উদ্যোগে সাড়া দেন। তাদের সহকারী চার্লস উইটার, মাইক গার্টনার এবং টম ডাইন এই উদ্যোগে বিনিশ্চায়ক ভূমিকা পালন করেন। তারাই সি আর এল গোষ্ঠী, ইনফরমেশন সেন্টার এবং বাংলাদেশ মিশনকে বুদ্ধি দেন, কৌশল প্রনয়ণে সাহায্য করেন এবং গোটা লবিংকে যথাপথে পরিচালিত করেন। সি আর এল এর ডাক্তার জন রোডি এবং তাঁর স্ত্রী কর্নেলিয়া রোডি এবং জনস হপকিনসের উইলিয়াম গ্রিনোর অবদান চিরস্মরনীয়। ১০ জুনে স্যাক্সবি এবং চার্চ সিনেটে এই সংশোধনী পেশ করেন; ১৫ জুনে গালাগার সমতুল্য সংশোধনী প্রতিনিধি পরিষদে পেশ করে। যত দিন না অবস্থা এমন হয় যে, শরণার্থীরা নিরাপদে দেশে ফিরতে শুরু করবে ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোনরকম মার্কিন সাহায্য দেয়া যাবেনা। এই সংশোধনীর জন্য বাঙালি ও আমেরিকানরা নানা অঙ্গরাজ্য থেকে তাদের প্রতিনিধিদের কাছে তদবির করেন, ওয়াশিংটনে এসে কংগ্রেসের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ান, কাগজপত্র দিয়ে প্রতিনিধি এবং তাদের সহকারীদের ব্যতিব্যস্ত রাখেন। বলা হয় যে, এত সার্থক এবং এত ব্যাপক লবিং এর আগে আর হয়নি। ৩ আগস্ট প্রতিনিধি পরিষদ বৈদেশিক সাহায্য বিল বিবেচিত হয়। গালাগার সংশোধনীর পক্ষে ভোট হয় ২০০

৫০৪

এবং বিপক্ষে ১৯২। প্রতিনিধি পরিষদে সচরাচর পররাষ্ট্র বিষয়ে নির্বাহী বিভাগের সুপারিশ পাশ হত। সেই হিসেবে এই সিদ্ধান্ত ছিল নিতান্তই যুগান্তকারী, ইন্ডিয়ানার অধ্যাপক ফজলে বারী মালিক (বর্তমানে কার্বনডেলে আছেন) প্রতিনিধি পরিষদে সংশোধনীর জন্য খুব খাটেন ও তদবির করেন। তাঁর মতে এর আগে পররাষ্ট্র বিষয়ে প্রতিনিধি পরিষদ কখনো নির্বাহি বিভাগের বিপক্ষে যায়নি।
সিনেটে সংশোধনী বিবেচিত হয় ২৬ থেকে ২৯ অক্টোবর। বৈদেশিক সাহায্য বিষয়ে সিনেট অনেক বেশি সচেতন ও সক্রিয়। এতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী ছিল। পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ, গ্রীসে সাহায্য বন্ধ, আর কম্বোডিয়ায় কড়া তদারকিতে সাহায্য প্রদান, কেউ হয়ত পাকিস্তান সংশোধনী পছন্দ করেন কিন্তু গ্রীস সংশোধনী চাননা। অনেক সিনেটর একেবারেই বৈদেশিক সাহায্য পছন্দ করেননা। অনেকে সামরিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক সাহায্য একপাল্লায় বিচার করতে রাজি নন। তবে আলোচনায় যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেতা হল জাতিসংঘে চীনের অন্তর্ভুক্তি। মার্কিন সরকার বা কংগ্রেস চীনের অন্তর্ভুক্তি চায় তবে তাদের তাইওয়ানের জন্যেও দরদ ছিল। জাতিসংঘে তৃতীয় বিশ্বের সদস্যরা তাইওয়ানকে বিতাড়নে উৎসাহী ছিল এবং চীনের অন্তর্ভুক্তিতে তারা অহেতুক উল্লাস প্রকাশ করে এবং আমেরিকার শ্রাদ্ধ করে। কংগ্রেস ঠিক করল যে, অকৃতজ্ঞ তৃতীয় বিশ্বকে শাস্তি দিতে হবে। তাই শেষ ভোটে সারাটি ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স আইন ৪১-২৭ ভোটে পাস হলোনা। এই ভোটে অনেকেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই প্রায় এক তৃতীয়াংশ সিনেটর ভোট দিতেই বিরত থাকেন। অবশ্য বিষয়টি এখানেই শেষ হলনা। ৯ থেকে ১১ নভেম্বর আবার সিনেট দুটো বৈদেশিক সাহায্য আইন বিবেচনা করল। একটি হল সামাজিক ও নিরাপত্তা সাহায্য বিষয়ক আর অন্যটি অর্থনৈতিক ও মানবিক সাহায্য বিষয়ক। এবারে স্যাক্সবি চার্চ সংশোধনী সহ আইন পাশ হল ১০ নভেম্বরে। প্রতিনিধি পরিষডে বিল পাশ হয়েছে একটি, সিনেটে হল দুটি। তাদের মধ্যে অনেক সামঞ্জস্যের প্রয়োজন। তাই বিল তিনটি গেল একটি যৌথ কমিটিতে। সিনেটে এবার ফেরত এল একটি বিল এবং ১৭ ডিসেম্বরে তা পাশ হল। এতে স্যাক্সবি চার্চ সংশোধনী এবং ২৫০ মিলিয়নের ত্রাণ সাহায্য স্থান পেল। তাই এক হিসেবে বলা যায় যে, মার্কিন কংগ্রেস শুধু নির্বাহি বিভাগের বিরোধিতাই করেনি বরং বাংলাদেশ সংকটে বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়েছে।

পাকিস্তানের পক্ষে দু একটি দুর্বল আওয়াজ যে ওঠেনি তা নয়। মোট ষোলটি বিবৃতিতে নির্বাহি বিভাগের নীটিমালা সমর্থিত হয় অথবা ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদগার হয়। এর মধ্যে নয়টি বক্তৃতা প্রদত্ত হয় পাক ভারত যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এবং পাঁচটি বক্তৃতা করেন ফ্লোরিডার রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান রবার্ট সাইকস আর তিনটি নিউজার্সির রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান পিটার ফিলিং হাউসেন। এসব

৫০৫

বিবৃতিতে বক্তারা খুব সযত্নে আত্মরক্ষা করেন, সরাসরি পাকিস্তানের প্রশংসা বা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা এড়িয়ে যান। শুধু কানসাসের রিপাবলিকান সিনেটর রবার্ট ডোল ১২ অক্টোবরে নির্বাহী বিভাগের কর্মকান্ড ও নীতিমালা সমর্থন করে একটি বিস্তৃত বক্তৃতা দেন। বাংলাদেশ মুক্ত হবার প্রাক্কালে নিউজার্সির কংগ্রেসম্যান হেনরি হেলস্টোস্কি ৯ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বীকৃতি বিষয়ে একটি প্রস্তাব পেশ করে। সিনেটে এই বিষয়ে শুনানি হয় পয়লা ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ সালে এবং সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রস্তাব পাশ হয়। কিন্তু নিক্সন সরকার অবশেষে স্বীকৃতি প্রদান করে ৪ এপ্রিলে।
বাংলাদেশ সংকটের সমাধানের জন্য প্রথম প্রস্তাব রাখেন সিনেটর হ্যারিস ১৯ এপ্রিলে। তিনি মধ্যস্ততার ব্যবস্থা করতে বলেন। জুলাইয়ের ৩০ তারিখ মিনেসোটার সিনেটর মন্ডেইল এবং প্রতিনিধি ডোনাল্ড ফ্রেজার একটি যৌথ প্রস্তাবে রাশিয়া, চীন ও আমেরিকাকে সংকট সমাধানের জন্য একটি সম্মেলনে বসতে আহবান করেন। সিনেটর কেনেডি এইরকম একটি আবেদন করেন নভেম্বরের শুরুতে। ৫ নভেম্বরে সিনেটর হ্যারিস নিরাপত্তা পরিষদের একটি বিশেষ অধিবেশনে বাংলাদেশ সংকট সমাধান বিবেচনার জন্য প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাব টিকেই তিনি ৪ ডিসেম্বরে আবার পেশ করেন এবং এতে তার সঙ্গে যোগ দেন আরো অনেক বিখ্যাত সিনেটর। এই প্রস্তাবে শুধু একটি নতুন কথার অবতারণা করা হয়। বলা হয় যে, নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে বাংলাদেশকে আহবান করতে হবে

পাক ভারত যুদ্ধ শুরু হবার পর কংগ্রেস একটি মূল্যবান ভূমিকা পালন করে। নির্বাহি বিভাগ ঢালাওভাবে ভারতকে যুদ্ধবাজ আখ্যা দিয়ে নিন্দা করলে কংগ্রেস এর প্রতিবাদে রীতিমত ঝড় তুলে। বেগতিক দেখে নিরাপত্তা উপদেষ্টা হনরি কিসিঞ্জার এক সংবাদ সম্মেলনে এই বিষয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যা প্রদান করলেন। সেখানে তিনি বলতে চাইলেন যে, নির্বাহি বিভাগ সংকট সমাধানের অনেকটা প্রচেষ্টা চালিয়েছে। নিরপেক্ষ ভাবে বিষয়টির মোকাবেলা করেছে। তবে ভারত মোটেই নমনীয় ছিলনা। এটা নিয়েও তর্ক বিতর্ক চলল। পরে জ্যাক এন্ডারসন যখন যখন গোপন তথ্য ফাঁস করতে লাগলেন তখন দেখা গেল যে, কিসিঞ্জারের বক্তব্য ছিল সত্যের অপলাপ।
কংগ্রেস আরো নানারকম গোপনীয় তথ্য প্রায়ই ফাঁস করতে লাগল। মার্কিন নিরপেক্ষতার দাবি নাকচ করে দিলেন সিনেটর আদলাই স্টিভেনসন (৩য়)। ১৩ ডিসেম্বরে তিনি জানালেন যে, আমেরিকা নামমাত্র ভাড়ায় পাকিস্তানকে যুদ্ধজাহাজ ইজারা দিয়েছে। ১৫ তারিখে সিনেটর টমাস হগলটন প্রশ্ন করলেন যে, কেন মার্কিন আণবিক জাহাজ এন্টারপ্রাইজ বঙ্গোপসাগরে আছে। তিনি আরো বুঝিয়ে দিলেন যে এন্টারপ্রাইজ বিদেশী নাগরিকদের উদ্বাসনে কোন কাজেই আসবে না। কংগ্রেস সতর্ক ছিল বলেই নিক্সন কিসিঞ্জার নিজেদের ইচ্ছামত

৫০৬

জটিলতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি।
কংগ্রেস বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবন রক্ষায়ও কিছুটা ভূমিকা পালন করে। ২৭ জুলাইতে কংগ্রেসম্যান ব্যান্ডফোর্ড মোর্সের উদ্যোগে মোট ৫৫ জন কংগ্রেসম্যান প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে একটি চিঠি লিখেন। শেখ মুজিবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং প্রহসনের বিচার বন্ধ করতে তাঁরা আহবান জানান। আগস্টের শুরুতে ১১ জন সিনেটর প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে আবেদন করেন। প্রতিনিধিরা তাদের বিভিন্ন বক্তৃতায় শেখ মুজিবের নিরাপত্তা নিয়ে তাদের উদ্বেগ ও আগ্রহ ব্যক্ত করেন। সিনেটর পার্সি এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছ থেকে কথা আদায় করেন। সিনেটর স্যাক্সবি পাকিস্তানে গেলে শেখ সাহেবের সঙ্গে মোলাকাতের জন্য আবেদন করেন, অবশ্য তা অগ্রাহ্য করা হয়। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েই মার্কিন কংগ্রেস আলোচনা করে এবং দ্ব্যর্থহীন ভাবে বাংলাদেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে প্রয়াস পায়।

মার্কিন প্রসাশনের অন্দরমহলেও কিন্তু বাংলাদেশের জন্য সমর্থনের অভাব ছিলনা। সরকারি নীতির বিরোধিতা আইনমাফিক করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ঢাকার সব মার্কিন কূটনীতিবিদ সরকারি নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড সকলের পক্ষে ভিন্নমত জানিয়ে দেন। গণহত্যার বিরুদ্ধে আওয়াজ না তোলার জন্য তাঁরা সরকারের নিন্দা করেন। তাঁরা অভিমত প্রকাশ করেন যে সরকারি নীতি শুধু নৈতিকভাবেই অগ্রহনযোগ্য নয়বরং মার্কিন স্বার্থেরও পরিপন্থীমুক্তিযুদ্ধকালে স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ইউএসএআইডি এবং কৃষি ডিপার্টমেন্টের অনেক কর্মকর্তা সরকারি নীতির সমালোচনা করেন। তাদের অনেক সুপারিশ উচ্চতর মহলে বাতিল করে দেওয়া হয় বা গ্রহন করা হয়না। কংগ্রেস, সুশীল সমাজ ও প্রচারমাধ্যমের মনোভাব ও সতর্কতা এবং প্রসাশনের অভ্যন্তরীন চাপের মুখে নিক্সন কিসিঞ্জার পাকিস্তানকে যতটা সমর্থন করতে চান ঠিক্ততটা করতে সক্ষম হননি। সবটা সংকট নিক্সন কিসিঞ্জার নিতান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিবেচনা করেন এবং সরকারি নীতি একান্তই তারা দুজনে প্রণয়ন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে কিছু বাঙালি আমেরিকায় প্রচারকাজে যায়। তারা সর্বত্র বাঙালিদের দ্বারা পরিত্যক্ত হয় এবং কোথাও লাঞ্ছিতও হয়। তাদের বিরুদ্ধে আমেরিকানরাও কোথাও কোথাও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। জুলাই মাসের শুরুতে এলেন রাজশাহীর উপাচার্য প্রয়াত সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন এবং রেডক্রসের সভাপতি বিচারপতি নূরুল ইসলাম (পরবর্তীতে এরশাদের উপরাষ্ট্রপতি)। এ ছাড়া আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহর আলী এবং অনারারী অধ্যাপক কাজী দীন মোহাম্মদ। তারপর এলেন ভারী ওজনের মরহুম হামিদুল হক চোউধুরী এবং মাহমুদ আলী। এদের আগমনে পাকিস্তানের ইমেজের

৫০৭

তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। মাহমুদ আলী পরবর্তীতে পাকিস্তানের জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলে নেতা হিসেবে আবার যান। আরো দুয়েকজন বাঙালি সরকারি কর্মচারি পাকিস্তানি দলের সদস্য হয়ে যান তবে তাদের সঙ্গে বাঙালিদের যোগাযোগ মোটেই হয়নি। পাকিস্তানিরা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কন্যা বেগম আখতার সোলায়মানকেও আমেরিকায় পাঠায়। তার কিছুদিন পরেই তার ভাই সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক রাশেদ সোহরাওয়ার্দী একটি বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশের সমর্থন করেন। পাকিস্তানের এই ধরনের উদ্যোগ ছিল নিতান্তই উদ্ভট। উন্মাদ সামরিক জান্তার মুক্ত সংবাদমাধ্যম এবং স্বাধীন চিন্তাধারা সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিলনা। মার্কিন মুলুকে সার্বিক পরিবেশ পাকিস্তানের জন্য কি রকম প্রতিকূল যে ছিল সে সম্বন্ধে ইসলামাবাদের মদমত্ত ‘জানোয়ার’ মোটেই অবহিত ছিলনা।

আমেরিকায় মুক্তিযুদ্ধ পূর্ণ সমর্থন লাভ করলেও মার্কিন সরকার পশ্চিম ঘেঁষা নীতি অনুসরণ করে। এই নীতি সর্বতভাবেই নিক্সন কিসিঞ্জার জুটির নীতি ছিল। তারা বলে যে, পাকিস্তান পুরনো বন্ধু, সিটো-সেন্টোর সদস্য (SEATO-CENTO) সামতিক চুক্তিতে আবদ্ধ, তদুপরি পাকিস্তান ছিল চীনের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক স্থাপনে দূতিয়াল। প্রধানম্নত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি এই জুটির বৈরি ভাবকে কেউ কেউ তাদের পাকিস্তান ঘেঁষা নীতির অজুহাত বলে মনে করেন। কিসিঞ্জার দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে তার নিজস্ব বিচারকেই প্রাধান্য দেন। তার হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় উত্তরণের প্রক্রিয়া চলতে পারত। তাই এই সুচিন্তিত ছকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতের সহায়তা তাকে খুবই ক্ষুব্ধ করে। তার ক্ষোভের নিদর্শন মেলে তার পরবর্তী ব্যবহারে। ১৯৭৩ সালে তিনি হন মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট। ঠিক তখন মরহুম হোসেন আলী বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত হয়ে আমেরিকায় যান। এই নতুন দেশের প্রথম রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার প্রায় দুবছর মোলাকাতের জন্য কোন সময় দিতে ব্যর্থ হন। ১৯৯৫ সালে ভারত ভ্রমন কালে তিনি ‘ইন্ডিয়া টু ডে’তে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তার অনুসৃত নীতিকে যুক্তিযুক্ত বলে দাবী করেছেন। তার বই ‘হোয়াইট হাউস ইয়ারস’ এ ৭৬ পৃষ্ঠা ধরে তিনি তার নীতির যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন। এবং তার স্বভাবসিদ্ধ ধারায় ইতিহাসের পুনির্বিবেচনা (বা সোজা কথা বিকৃতি) করেছেন।
নিক্সন কিসিঞ্জার জুটি দাবি করেন, বাংলাদেশ সংকটে তাদের অনুসৃত নীতির কৃতিত্ব ছিল নিম্নোক্ত বিষয়ে, যদিও সবখানেই প্রমাণের নিদারুন অভাব পরিলক্ষিত হয়।
প্রথমঃ তারা দুস্থদের সাহায্য করেন। ভারতে ও পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের সাহায্য দিয়েছেন। এই দাবিতে সততা রয়েছে।
দ্বিতীয়ঃ বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে ত্রাণ কাজ ও খাদ্য বিতরণের ব্যবস্থা তাদেরই প্রভাবে সম্ভব হয়। কিন্তু এর জন্য চুক্তি স্বাক্ষরে এত দেরি হয় যে
৫০৮

বস্তুতপক্ষে কোন ত্রাণকাজে হাতই দেওয়া যায়নি।
তৃতীয়ঃ বাংলাদেশ বেসামরিক প্রশাসন তারা প্রতিষ্ঠা করে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করে। ডা. মালিকের গভর্ণর নিযুক্তিতে অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়েছিল বলে কেউ সাক্ষ্য দেয়না।
চতুর্থঃ তাদের হস্তক্ষেপে শেখ মিজিবের জোবন রক্ষা পায়। টেন কাউলের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, অক্টোবরে নিক্সন জানতেনই না যে শেখ মুজিব বেঁচে আছেন কি নেই।
পঞ্চমঃ পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য তারা একটি ব্যবস্থা করেন। খন্দকার মোশতাকের বেঈমানি সত্ত্বেও নভেম্বরেও পাকিস্তান এ ব্যাপারে কোন অঙ্গীকার করতে রাজি ছিলনা। কাউলের সাক্ষাৎকারে আরো প্রতীয়মান হয় যে, নিক্সন তিন চার বছরে বাংলাদেশে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্রতী ছিলেন।
ষষ্ঠঃ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিম পাকিস্তান কে ধ্বংস করতে উদ্যোগী হন। এবং আমেরিকা তাকে ভয় দেখিয়ে নিবৃত করে। পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধ করার কোন পরিকল্পনা ভারতের ছিলনা। এবং ঐফ্রন্টে যুদ্ধ শুরু করে পাকিস্তান।

সপ্তমঃ সপ্তম নৌবহর এবং এন্টারপ্রাইজ বঙ্গোপসাগরে পাঠানো হয় মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধারের জন্য। অথচ তখন চট্টগ্রামে নোঙর করার কোন সুযোগ ছিলনা। এবং কোন মার্কিন নাগরিক উদ্বাসনের জন্য তৈরি ছিলেন না।
বাংলাদেশ বিরোধী মার্কিন নীতি ছিল একান্তই হোয়াইট হাউসের স্রেফ নিক্সন কিসিঞ্জারের অত্যন্ত ব্যক্তিগত নীতি। তাদের নীতি নির্ধারণের রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক যুক্তি মোটেই ছিলনা। তবে কংগ্রেস ও প্রচারমাধ্যম সজাগ ও সরব না থাকলে এই জুটি বিশ্বশান্তি ব্যাহত করতে দ্বিধা করত না। পাকিস্তান প্রীতি ছাড়া তাদের নীতির অন্য কোন ভিত্তি ছিলনা। নিজেদের নীতিকে জয়যুক্ত করার উদ্দেশ্যে তারা মিথ্যা অজুহাত সৃষ্টি করেন। জেদ বহাল রাখার জন্য তারা বিশ্বযুদ্ধ ও আণবিক বিকল্পও বিবেচনা করেন। তাদের নীতির পূর্ণ বিশ্লেষণ করে ১৯৮০ সালে ক্রিস্টোফার ভান হোলেন নিম্নোক্ত মন্তব্য করেন।
ক্রিস ১৯৭১ সালে স্টেট ডিপার্টমেন্টে দক্ষিণ এশিয়া বিভাগে ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ছিলেন।
“এই প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য হচ্ছে কিসিঞ্জারের অনুমান, পূর্বধারণা এবং সিদ্ধান্ত সবই ভুল ছিল। প্রেসিডেন্টের চীন ভ্রমনের সুযোগ নেবার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানি নিষ্পেষণ ও অত্যাচার সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকার কোন কারন ছিলনা। পূর্ব পাকিস্তানে অধিকতর রাজনোইতিক সুবিধাদানের জন্য ওয়াশিংটন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে আরো অনেক বেশি চাপ দিতে পারত। পশ্চিম পাকিস্তানকে ভেঙে দেবার কোন মহা নীলনকশা ভারতের ছিলনা। এবং এই ব্যাপারে সোভিয়েত রাশিয়াও তেমন কোন উৎসাহ দিচ্ছিল না। বাংলাদেশ সমস্যাকে কিসিঞ্জার যেভাবে আন্তর্জাতিক দাবা খেলাইয় পরিণত করেন তার কোন প্রয়োজন

৫০৯

ছিলনা বা তাতে কোন বুদ্ধিমত্তা ছিলনা। সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে এবং বঙ্গোপসাগরে সপ্তম বহর মোতায়েন করতে নিক্সন যে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করেন এবং বিশ্ব শান্তি বহাল রাখেন- এই রকম ধরনের কিসিঞ্জারের দাবি নিতান্তই অন্তঃসারশূন্য এবং ভ্রান্ত। এক কথায় হোয়াইট হাউসের নীতিমালা ছিল ভুল এবং কিসিঞ্জার যত জোরেশোরে তার যৌক্তিকতা দেখান না কেন এই নীতিমালা মার্কিন স্বার্থের মোটেই অনুকূলে ছিলনা।” (Asian Survey Atom 1980)
আমেরিকায় মিক্তিযুদ্ধ চলাকালে শুধু একটি মহলেই পাকিস্তান প্রীতি পরিলক্ষিত হয়। সে সম্বন্ধে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকায় ৭ ডিসেম্বরে একটি যথার্থ এবং অতি উত্তম মন্তব্য করা হয়।
“মনে করুন প্রেসিডেন্ট নিক্সন চেয়েছিলেন দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনা বাড়াতে, তিনি চেয়েছিলেন সর্বগৃণিত একটি সামরিক জান্তার সঙ্গে একাত্মতা, তিনি চেয়েছিলেন গণতান্ত্রিক ও বন্ধু দেশ এবং ঐ সকলের সবচেয়ে বড় ও ক্ষমতাশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বিনষ্ট করতে এবং তাকে সোভিয়েত কোলে ঠেলে দিতে এবং তিনি আরো চেয়েছিলেন রাজনৈতিক সমঝোতার সব আশা মুছে দিতে এবং সুস্থ্য মধ্যপন্থীদের খামোশ করতে। গত আটমাসে দক্ষিণ এশিয়া সংকটে তিনি অন্য কি করতে পারতেন। আমাদের মতে অন্য কিছুই না।”
[১২৬] আবুল মাল আব্দুল মুহিত

মুক্তিযুদ্ধ ও লেবানন সিরিয়া
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক ধারণা প্রদান ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সমূহের সরকার ও জনগণের সহযোগিতা লাভের জন্য মুজিবনগর সরকার মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। মুসলিম দেশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়। কারন বাংলাদেশের জনগণকে হিন্দু ও অমুসলিম বলে পাকিস্তান মুসলিম দেশগুলোতে প্রচারণা চালায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে মোল্লা জালাল উদ্দীন এমপি এর নেতৃত্বে একটি দল সিরিয়া লেবাননে প্রেরিত হয়। এ প্রতিনিধি দলের অপর সদস্য ছিলেন ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী। আগস্ট মাসে এ প্রতিনিধিদল লেবানন গিয়ে পৌঁছে। এখান থেকে সিরিয়া ও মিশরে তারা যোগাযোগের চেষ্টা চালান। লেবাননে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এ কে ধর বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন। লেবাননের দুটি প্রভাবশালী সংবাদপত্র ‘আল হিউম’ ও ‘আল নাহার’ এর সাথে সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও পাকিস্তানিদের বর্বর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়। লেবাননের রাজনৈতিক নেতা কামাল জুমনবালাত, মারুফছার, রশিদ কারামি প্রমুখের সাথে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের ফলপ্রসূ আলোচনা হয়।

৫১০

খ্রিস্টান সাংবাদিক খায়রুল্লাহ ও বিশিষ্ট মহিলা চিকিৎসক হিতাব আব্দেল ছামাদ বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে সাহায্য করেন। ভারতে লেবাননের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ওমর আবু রিশের সহযোগিতায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধি দল সিরিয়া গমন করেন। দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর এবং এবং আইনিজীবী সমিতির প্রধানের সাথে বাংলাদেশ প্রতিনিধিগণ বৈঠক করেন। সিরিয়া সফরকালে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের সাথে আলোচনায় প্রাক্তন ফরাসি কনসাল লুই সেকুতুবিচও সংযুক্ত হন। তিনি ইতিপূর্বে ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। আলেপ্পোর রাজনৈতিক নেতা তাকিয়া দিনসলের সাথে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎ হলে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে তাদের সরকারের উপর প্রভাব খাটাবেন বলে আশ্বাস দেন। এভাবে সিরিয়া লেবাননে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে মুজিবনগর সরকারের কর্মকান্ড পরিচালিত হয়।
[৯৬] মো. ফায়েক-উজ্জামান

মুক্তিযুদ্ধ ও শ্রীলংকা থাইল্যান্ড
১৯৭১ সালের ৭ আগস্ট অ্যাডভোকেট ফকির শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে একটি কূটনৈতিক মিশন শ্রীলংকা সফরে যায়। এ মিশনটিও বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বির্ণনা করে। তিনি শ্রীলংকা গমনের সময় বাংলাদেশের একটি মানচিত্র, গণহত্যার উপর রচিত কয়েকটা বই ও কিছু আলোকচিত্র সঙ্গে করে নিয়ে যান। শ্রীলংকার পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের গণহত্যার খবর বিশদভাবে প্রকাশিত হয়। ফকির শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কূটনৈতিক মিশন থাইল্যান্ড এবং জাপানও সফর করেন। থাইল্যান্ডে অবস্থান কালে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে থাইল্যান্ডের অবস্থান সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি লেখেন। এতে প্রতিনিধিদলের সদস্য জ্যোতিপাল মহাথেরোর সাথে থাইল্যান্ডের অনেক প্রভাবশালী বৌদ্ধ নেতা ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক আছে। এই সূত্রে বাংলাদেশ সরকারকে থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ নেতাদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অনুরোধ করেন। বাঙালিদের উপর পাকিস্তানের বর্বরতা তুলে ধরার ও থাইল্যান্ডের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহবানের কথাও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
[৯৬] মো. ফায়েক -উজ্জামান

মুক্তিযুদ্ধ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন
ভৌগলিক দিক দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন দক্ষিণ এশিয়ার নিকটবর্তী একটি পরাশক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হতেই ইউরোপীয় পরিমন্ডল ছাড়িয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং

৫১১

একটি নতুন পরাশক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। মধ্য ষাটের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেকে একইসঙ্গে ইউরোপীয় ও এশীয় শক্তি হিসেবে দাবি করে। তবে ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধের সময় মধ্যস্ততাকারী রাষ্ট্রের ভূমিকা পালন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম দক্ষিণ এশীয় ভূ খন্ডে বিশেষ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই কূটনৈতিক প্রয়াসের পিছনে মৌল ভিত্তি এই ছিল যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বাইরের পৃথিবীকে জানাতে চেয়েছিল যে ভৌগলিক নৈকট্যের কারণে দক্ষিণ এশিয়া তার প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত এলাকা। অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাধান্য স্থাপনের প্রচেষ্টার পিছনে আর একটি কারণ ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ। ষাটের দশকে যতই আমেরিকা ভিয়েতনাম সমস্যাইয় গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ততই দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সত্তর দশকের শুরুতে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এই দুই পরাশক্তির মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের তীব্রতা যেমন হ্রাস পেতে থাকে, তেমনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মধ্যে সম্পর্কেরও চরম অবনতি ঘটে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির এমন প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এ যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। উল্লেখ্য পরাশক্তিগুলোর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নই প্রথম বাঙালি গণহত্যাকে নিন্দা জানিয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে খুব সুদৃঢ় ভূমিকা পালন করেছিল। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই মনে করা হয় যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন আগাগোড়াই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রেখেছিল।
বরাবরই সোভিয়েত ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় সত্ত্বার স্বপক্ষে। তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথমে সতর্কতামূলক এবং পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনমূলক ভূমিকা পালন করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থনের পিছনে নিম্নলিখিত ২ টি কারণ চিহ্নিত করা যায়-
ভারতের পূর্ব প্রান্তে বিপ্লবী চেতনার প্রসার রোধ করাঃ বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্রমে তা গণযুদ্ধে রূপ নেবার সম্ভাবনা ছিল। আর তা হলে আসাম সহ ভারতের পূর্ব প্রান্ত বিপ্লবী চেতনা ও ও বিদ্রোহে উদ্বদ্ধ হত, যা ভারতের জন্য হত বিরাট বিপদের কারণ। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের লক্ষ্য ছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুক্তিযুদ্ধের অবসান এবং সম্ভব হলে অখন্ড পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগকে স্থাপন করে সমস্যার সমাধান। আর এজন্যেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভের পর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসাতে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে সভিয়েত ইউনিয়ন তৎপর হয়ে উঠেছিল।
রুশ-চীন বিরোধঃ সমাজতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক ছিল চরম বৈরীতার। অবস্থাটা এমন ছিল যে, কোন একটি

৫১২

দেশ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র হলে সে দেশটি চীনের শত্রুতে পরিণত হবে। আর এ কারণেই চীন পাকিস্তান মৈত্রী সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন বেকায়দায় পড়ে যায় এবং বাধ্য হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করতে। সুতরাং দেখা যায় যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বাঙালির প্রতি মমত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে নয়, বরং নিজস্ব স্বার্থ সংশ্লিষ্ট চিন্তাভাবনা ও প্রভাব বলয় সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল।
সভিয়েত নীতির প্রথম পর্যায় (মার্চ-জুন)
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নীতির প্রথম পর্যায়ে সতর্কতা ও সুবিধাবাদ লক্ষ্য করা যায়। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ কমিউনিস্ট পার্টির ২৪ তম কংগ্রেসে ব্রেজনেভ যে ভাষণ দেন সেখানে জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের ভিত্তিতে সব শ্রেনীর সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ আছে। তাই বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা পরে ক্রেমলিন চায়নি যে পাকিস্তান ভেঙে যাক কিংবা বাংলাদেশের মত যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের জন্ম হোক। কারণ এমনি দরিদ্র দেশ অনতিকালের মধ্যেই পুঁজিবাদী শক্তিসমূহের কুক্ষিগত হবে। আর এ বিবেচনা থেকে প্রেসিডেন্ট পদগর্নি ২ এপ্রিল ইয়াহিয়াকে একটি পত্র লেখেন এবং জরুরী ভিত্তিতে রক্তপাত ও নির্যাতন বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার জন্য পাকিস্তানকে আহবান জানান। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই সুবিধাবাদী নীতির কারণে ১৯৭১ সালের এপ্রিল হতে আগস্ট পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে প্রচুর পরিমাণ আর্থিক ও কারিগরি সাহায্য দিয়েছে।

সোভিয়েত নীতির দ্বিতীয় পর্যায় (জুলাই-আগস্ট)
মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত নীতির দ্বিতীয় পর্যায়কে অধিকতর সতর্কতার নীতি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের এশীয় নীতির ক্রান্তিকাল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। জুলাই মাসে আমেরিকান পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার পিকিং থেকে ফিরেই ওয়াশিংটনে ভারতের রাষ্ট্রদূতকে বলেন , ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করলে চীন হস্তক্ষেপ করবে এবং আমেরিকা ভারতের সাহায্যে নাও এগিয়ে আসতে পারে। এমতাবস্থায় অর্থাৎ চীন-মার্কিন আঁতাতের জবাবে এবং ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পারস্পরিক নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট স্বাক্ষরিত হল ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি। কিন্তু ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পরেও সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজস্ব বিবেচনার দ্বারাই প্রধানত পরিচালিত হতে থাকে। আর এ কারণেই মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের এক সপ্তাহ পরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোষণা করে যে, পাকিস্তানের জন্য তাদের আর্থিক ও কারিগরি সাহায্য অব্যাহত থাকবে।
তবে সোভিয়েত নীতির দ্বিতীয় পর্যায়ে বাঙালিবিরোধী কোন আন্তর্জাতিক সমাধানের বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নও তৎপর হয়ে ওঠে। অবশ্য সহমর্মিতার কারণ হচ্ছে ভারত ও সোভিয়েত উভয়ই চেয়েছিল মস্কো ও দিল্লী বন্ধুভাবাপন্ন সরকার পাকিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোক।

৫১৩

সোভিয়েত নীতির তৃতীয় পর্যায় (সেপ্টেম্বর-নভেম্বর)
সভিয়েত নীতির তৃতীয় পর্যায়ে তিনটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। যাথা-
১। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের এই নীতি গ্রহন করে য, বাংলাদেশের সমস্যার মধ্যে যেহেতু আন্তর্জাতিক সংকটের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান নেই কাজেই বিষয়টি জাতিসংঘের এখতিয়ার ভুক্ত নয়।
২। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়।
৩। সোভিয়েত ইউনিয়ন চেষ্টা করে যেন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পূর্নাংগ যুদ্ধ না বাধে। তৃতীয় বৈশিষ্ট্যকে অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করেছিল। কিন্তু পাক ভারত যুদ্ধ শুরুর মধ্যে দিয়ে এ ধরনের কূটনীতির ব্যররথতা প্রমাণিত হয়।
সোভিয়েত নীতির শেষ পর্যায় (৩ ডিসেম্বর-স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত)
পাকিস্তান ন্যায়সঙ্গত ও শান্তিপূর্ণ ভাবে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানে ব্যররথ হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এ পর্যায়ে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের দৃষ্টিতে এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হল শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট রাজনৈতিক ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া । আর এ কারনেই যুক্তরাষ্ট্র বা চীন উত্থাপিত যে কোন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দিতে শুরু করে। অবশ্য ৬ ও ৭ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন দুইটা প্রস্তাব উত্থাপন করে, যেখানে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রেখে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ন্যায়সঙ্গত রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হলেও পরিস্থিতির কারণে এসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষ ভারতীয় বিজয়ের মধ্যে দিয়ে তাদের লক্ষ্য অর্জিত হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। ফলে যুদ্ধবিরতির যেকোন আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ কে প্রতিহত করা সোভিয়েত নীতির লক্ষ্যে পরিণত হয়। তাই নিরাপত্তা পরিষদের পরিবর্তে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৭ ডিসেম্বর একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপিত হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তৃতীয় বারের মত ভেটো প্রয়োগ করে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ঢাকার পতন যখন আসন্ন হয়ে উঠেছিল তখনই ১২ ডিসেম্বর দিল্লী আসেন সোভিয়েত ইউনিয়নের উপপ্রধানমন্ত্রী ভাসিলি কাজনেতসব। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি দিল্লী অবস্থান করেন। এ সফরে তার উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত দুটি। যথা-
১। বাংলাদেশ সরকারের প্রকৃতি সহ অন্যান্য নীতিগত প্রশ্নে ভারত সরকারের সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করা।
২। পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে চূড়ান্ত আঘাত করা থেকে বিরত থাকা। এক্ষেত্রে অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্য দুটি পরাশক্তির সঙ্গে একত্রে ভূমিকা পালন করেছিল।

৫১৪

সুতরাং দেখা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পরাশক্তির যে দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। সে দ্বন্দ্বে দক্ষিণ এশীয় ভূখন্ডে সোভিয়েত ইউনিয়নের কৌশল ও কূটনীতির জয় হয়।

মুক্তিযুদ্ধ ও সৌদি আরব
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই সৌদি আরব বাস্তব অবস্থার মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণ না করেই একতরফাভাবে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। সৌদি প্রসাশন ও গণমাধ্যম পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দেয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার এক সপ্তাহের মধ্যেই সৌদি পত্রিকা গুলোতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যাকে ‘বিধিসম্মত ও প্রয়োজনীয়’ বলে উল্লেখ করে সংবাদ পরিবেশন করে। সৌদি আরবের দুটো প্রভাবশালী পত্রিকা জেদ্দা থেকে প্রকাশিত ‘আল মদিনা’ এবং ‘আল বেলাদ’ এপ্রিলের প্রথম দিকে এক রিপোর্টে উল্লেখ করে পাকিস্তানের আইন শৃংখলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ঐক্য ও অখন্ডতা বজায় রাখার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ২৬ মার্চ সামরিক ব্যবস্থা গ্রহনে বাধ্য হয়েছেন। ৮ এপ্রিল আল মদিনা প্রকাশ করে ‘এ সল্যুশন টু পাকিস্তান’ নামে শিরোনামে একটি প্রবন্ধ। পত্রিকার নির্বাহি সম্পাদক মোহাম্মদ সালেহ উদ্দিন বলেনঃ
“Mujib behaved laki a gambling thoughtless person, who is thirsty for power, even though this may be at the expense of his nation and people.”
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার সত্য ঘটনাবলী ‘আল মদিনা’এর এই বক্তব্যে অনুপস্থিত। বরং শেখ মুজিব কে দায়ী করা হয়েছে সুকৌশলে। অবশ্য সৌদি সরকারের মনোভাব প্রথম প্রকাশিত হয় এপ্রিলের শেষ দিকে। ২৮ এপ্রিল সৌদি উপপররাষ্ট্র মন্ত্রী সৈয়দ ওমর সাকাফ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের আঞ্চলিক অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায়’ সৌদি সরকারের পূর্ণ এবং অকুন্ঠ সমর্থনের কথা ঘোষণা করেন। মন্ত্রীর এই বিবৃতি সৌদি আরব রেডিও থেকে প্রচারিত হয়। মন্ত্রী বিবৃতিতে বলেনঃ
সৌদি আরব ও পাকিস্তান পরস্পর শক্তিশালী ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। দুই দেশের পারস্পরিক ধর্মীয় বন্ধন ধর্ম দ্বারা আবদ্ধ। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা হুমকির সম্মুখীন হলে সৌদি আরব নীরব থাকবেনা।
সৌদি আরব সরকার এই মনোভাবের মাধ্যমে ভারতকে পরোক্ষভাবে হুমকি দিয়েছে। কারণ তেল ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত সৌদি আরব সহ অন্যান্য তেলসমৃদ্ধ আরব দেশের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। অন্যদিকে তারা বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। পাকিস্তান

৫১৫

সরকার সৌদি সরকারের এ বিবৃতিকে ২৯ এপ্রিল, ‘দৈনিক পাকিস্তান’, ‘আজাদ’, ‘দি পাকিস্তান টাইমস’, ‘পূর্বদেশ’ সহ অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সকল পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করে। এই বিবৃতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রিয় মুসলমানদের স্বভাবতই সৌদি আরবের তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের প্রতি ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এপ্রিল মাসের মধ্যেই সৌদি আরব পাকিস্তানকে সমর্থনের পাশাপাশি নগদ ১০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয় বলে ভারতীয় সরকারি সূত্র উল্লেখ করে। পাকিস্তান সরকার এ তথ্যটি স্বীকার না করলেও ১১ মে করাচিতে প্রকাশিত পাকিস্তান সরকারের এক তথ্য বিবরণীতে জানা যায় পাকিস্তান সরকার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ১০০-১২০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য লাভের চেষ্টা করছে। মূলত বিদেশী ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য এ অর্থ দরকার হবে। অবশ্য পাকিস্তান সরকারের অন্য এক সূত্রে বলা হয় সৌদি আরবকুয়েতসহ উপসাগরীয় দেশগুলো পাকিস্তানকে ৫০-৬০- মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই তথ্যটি ভারতীয় সূত্রে পরিবেশিত তথ্যের সমর্থন দেয়। অন্যদিকে ২০ মে পাকিস্তানের নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত আব্দুল্লাহ আল মোতালিকের সাংবাদিকিদের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সৌদি সাহায্যের ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, তার দেশ চাওয়া মাত্র পাকিস্তানকে বিনাশর্তে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সাহায্য দেবে। করাচিতে পরিবেশিত সরকারি সূত্রের ১১ মে তারিখের তথ্যের পরিপরেক্ষিতে তিনি এ মন্তব্য করেন। সৌদি সাহায্য প্রাপ্তির এ বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু পরবর্তীতে প্রকাশিত না হলেও এ অর্থের লেনদেন যে হয়েছিল তা এসব তথ্য থেকে পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
মে মাসে সৌদি আরব সহ বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ পাকিস্তানের পক্ষে পূর্বের চেয়েও উদ্যোগী হয়ে ওঠে। ১ মে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি, ২ মে পাকিস্তানে নিযুক্ত আলজেরিয়ার রাষ্ট্রদূত সৌদ বিন আব্দুল রহমান, ৬ মে জর্ডানের বাদশাহ হোসেন, ২৮ মে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও ঐক্যের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন। আরব লীগও পিছিয়ে ছিলনা। তারা এ মাসেই বাংলাদেশের ঘটনার জন্য শেখ মুজিবকে দায়ী করে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করে বিবৃতি দেয়। সৌদি পত্রিকাগুলোও এ মাসে পাকিস্তানের পক্ষে এবং বাঙালিদের বিপক্ষে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ অব্যাহত রাখে। ‘আল বেলাদ’ দীর্ঘ রিপোর্টিং এ মন্তব্য করেঃ

পাকিস্তান ভারতের হস্তক্ষেপের স্বীকার হয়েছে। পাকিস্তান সৌদি আরবের সর্বাধিক ঘনষ্ঠতম। কারণ পাকিস্তান একটি মুসলিম দেশ এবং এ দেশটি আরব স্বার্থের ব্যাপারে সর্বাধিক সমর্থন জ্ঞাপনে কখনোই কোন দ্বিধা প্রকাশ করেনি। পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলীর জন্য রাষ্ট্রবিরোধী ব্যক্তিরা সার্বিকভাবে দায়ী। রাষ্ট্রবিরোধী ব্যক্তিদের নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ কার্যকলাপের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়ী করা মোটেই উচিত নয়।

৫১৬

‘আল বেলাদ’ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামীদের রাষ্ট্রবিরোধী আখ্যা দিয়ে মূলত পাকিস্তানের লাইনেই কাজ করেছে। পাশাপাশি পাকিস্তান সরকার ও সামরিক বাহিনীর কার্যকলাপের পক্ষে সাফাই গেয়ে, বাঙালি হত্যার সার্টিফিকেট দিয়েছে। গণহত্যার পক্ষে সৌদি সরকারি বক্তব্য পাওয়া যায় ৭ সেপ্টেম্বর। ঐদিন পাকিস্তানে নিযুক্ত সৌদি কনসাল পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানে’বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ বিরুদ্ধে বীরত্বের প্রশংসা করেন এবং আশা প্রকাশ করেন পাকিস্তান সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা রক্ষার জন্য অতীতের বীরত্বপূর্ণ ঐতিহ্য বজায় রাখতে সক্ষম হবে। আগস্ট পর্যন্ত সৌদি আরব সহ কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্র বিবৃতি, অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করার কথা বললেও সেপ্টেরম্বরের শেষে এবং অক্টোবরের প্রথম থেকে পাকিস্তানকে অস্ত্র সহযোগিতা দেয়ার উদ্যোগ নেয়। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ঘটনা এর পিছনে কাজ করে।
প্রথমতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ নিষিদ্ধ করলে নিক্সন প্রশাসন গোপনে ইরান, তুরস্ক, জর্ডান, লিবিয়া ও সৌদি আরবের মাধ্যমে অস্ত্র সরবরাহের কথা চিন্তা করেন।
দ্বিতোয়তঃ ১৯৭১ সালে ইরানসহ পাঁচটি মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্র গণচীনের সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং পাঁচটি রাষ্ট্র কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এর ফলে মুসলিম বিশ্বের কয়েকটি দেশ চীনের মিত্রে পরিণত হয়, যা যুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ করে। সেপ্টেম্বরে ইয়াহিয়া খান ইরান সফর করেন। এ সফরে ইরানের শাহ জেনারেল ইয়াহিয়ার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি প্যারিসের Le Figuro পত্রিকায় ২৮ সেপ্টেম্বরে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পূর্ববঙ্গের সঙ্কটে ইরান একশোভাগ পাকিস্তানের পক্ষে রয়েছে। আর এটাই স্বাভাবিক। আমরা দুজন (শাহ ও ইয়াহিয়া) খুবই ঘনিষ্ঠ এবং উৎপত্তিগতভাবে উভয় দেশের অধিবাসীরা আর্য বংশোদ্ভুত। ইসলাম ধর্মও আমাদের একত্রিত করে।’
শাহের এই বক্তব্যের গুরুত্ব অনুধাবিত হয়েছিল পরের মাসে অর্থাৎ অক্টোবরে। এ মাসেই ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ৫২ টি ফ্যান্টম বিমান পাকিস্তানকে বৈমানিকসহ প্রদান করে। অক্টোবরে ভুট্টোর মিশর সফরের ফলে মিসরও পাকিস্তানের পক্ষে জাতিসংঘে বিবৃতি দেয়। ১০ অক্টোবর মিশর, তুরস্ক ও জর্ডান জাতিসংঘে পাকিস্তানের ব্যাপারে কোন মীমাংসা ‘ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের’ কাঠামোর মধ্যে হওয়া উচিত বলে জোর দাবি জানায়। অক্টোবরের মধ্যেই লিবিয়া পাকিস্তানকে বৈমানিকসহ এফ-৫ জেট বিমান প্রদান করে যেগুলো ছিল আমেরিকার তৈরি। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’এর সংবাদদাতা ম্যালকম ডব্লিউ ব্রাঊন ১৯৭২ এর ২৯ মার্চ এক রিপোর্টে বলেন, এসব জেট এখনো পাকিস্তানে রয়েছে। এগুলোর মার্কিন চিহ্ন মুছে ফেলা হয়েছে এবং পাকিস্তানি বৈমানিকরা এগুলো ব্যবহার করছে। অক্টোবরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের মাধ্যমেও পাকিস্তানকে ৭৫ টি জঙ্গি বিমান সরবরাহ করে। মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত ‘জয়বাংলা’

৫১৭

পত্রিকার ২৯ অক্টোবরের এক রিপোর্টে বলা হয়, বিমানগুলো ইতিমধ্যে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের বিমানবন্দরে পৌঁছে গিয়েছে। ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি মার্কিন কলামিস্ট জ্যাক অ্যান্ডারসন১৯৭১ সালের যুদ্ধে মার্কিন সরকারের ভূমিকার মূল্যায়ন প্রসঙ্গে ইরান, সৌদি আরব, জর্ডানের মাধ্যমে প্রেরিত মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের গোপন তথ্যটি ফাঁস করে দেন। অস্ত্র সরবরাহের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরান, লিবিয়া, সৌদি আরব, জর্ডানকে বেছে নেয়ার কারণ হচ্ছে ১৯৬৭ সালের আরব ইসরাইল যুদ্ধের পরই ঐ সকল দেশের নিরাপত্তা ও সামরিক ব্যবস্থাকে জোরদার করারআজন্য সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়। পাকিস্তান এসব দেশের সামরিক ব্যবস্থা আধুনিকীকরণের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়ার দ্বায়িত্ব লাভ করে। মূলত মার্কিন বিমানগুলো ঐসব দেশ থেকে প্রশিক্ষণদানকারী পাকিস্তানি বৈমানিকরাই পাকিস্তানে নিয়ে আসে। ৩ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে স্থল ও বিমানপথে যুদ্ধ শুরু হলে এ বিমানগুলো পাকিস্তান ব্যবহার করে।

নভেম্বর থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গণে পাকিস্তানি বাহিনী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় এবং বিভিন্ন এলাকা শত্রুমুক্ত হতে থাকে। সৌদি আরব এ সময়েও পাকিস্তানকে সহায়তা অব্যাহত রাখে। নভেম্বরে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে মক্কা ও মদিনার মসজিদে ঈদের নামাযের মোনাজাতে পাকিস্তানের আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও সংহতির জন্য বিশেষ দোয়া করা হয়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই সৌদি আরবের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সৌদি আরবের প্রসিদ্ধ পত্রিকা ‘আল মদিনা’ এর নির্বাহি সম্পাদক মোহাম্মদ সালেহ উদ্দীন পাকিস্তান সফরে আসেন। পাক-ভারত যুদ্ধ যখন অত্যাসন্ন এ সময় তার সফর কে নিছক ব্যক্তিগত সফর বলা চলে না। সঊদি সরকারি মহলে তার ছিল ব্যাপক প্রভাব। পা-ভারত যুদ্ধ বেধে গেলে সৌদি আরব সরাসরি পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানকে সহযোগিতা করতে পারে এমন সম্ভাবনা পাকিস্তানে ছিল। সালেহউদ্দিনের আগমন এমন কোন মিশনের অংশ বলে বিভিন্ন সূত্রে তথ্য পরিবেশিত হয়। পাকিস্তানে তার দেয়া বিবৃতি থেকে এ তথ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি বলেনঃ
হিন্দুস্তানের এ কথা স্মরণ করা উচিত যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমন গোটা মুসলিম জাহানের বিরুদ্ধে আক্রমন স্বরূপ। সৌদি আরবের জনসাধারণ ও সরকার পূর্ব পাকিস্তান সমস্যাকে শুধু পূর্ব পাকিস্তানের নয় বরং সমগ্র দুনিয়ার মুসলমানদের সমস্যা বলে মনে করে।
সালেহউদ্দিন এই বক্তব্য দ্বারা ভারতকে হুমকি প্রদান এবং পাক ভারত যুদ্ধকে একটি ধর্ম যুদ্ধ বা জেহাদের আবরণ দেয়ার চেষ্টা চালায়। ৬ ডিসেম্বর সৌদি মন্ত্রীসভার এক বৈঠকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় আগ্রাসনের নিন্দা করে

৫১৮

যুদ্ধ বন্ধ করতে জাতিসংঘের প্রতি উদ্যোগ গ্রহনের দাবী জানানো হয়। ৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানে সৌদি দূতাবাসের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ভারতীয় হামলাকে আন্তর্জাতিক সনদ ও মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে আরো উল্লেখ করা হয়, পাকিস্তানের আঞ্চলিক অখন্ডতা ও ইসলামী আদর্শ ধ্বংস করাই ভারতের উদ্দেশ্য। জাতিসংঘে নিযুক্ত সৌদি স্থায়ী প্রতিনিধি জামিল বারুদি সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানের ওপর ভারতীয় হামলার নিন্দা করেন।
সরকারের পাশাপাশি সৌদি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গুলোও পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। ১৬ ডিসেম্বর মক্কা ভিত্তিক সংগঠন রাবেতা আল আলম ইসলামী মিশন ভারতের বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’ ঘোষণা এবং পাকিস্তানে যোদ্ধা ও অস্ত্র প্রেরণের জন্য মুসলিম দেশগুলোর প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। অবশ্য ঐদিনই পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পন করায় রাবেতার আহবানে সাড়া দেওয়ার সুযোগ সৌদি আরব সহ মুসলিম দেশগুলো পায়নি।
এভাবে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস সৌদি আরব পাকিস্তানের পক্ষে এবং বাঙালির বিরুদ্ধে ভূমিকা রেখেছে। এক কোটি বাঙালির শরণার্থী হিসেবে যে ভারতে আছে তাদের দুঃখ দুর্দশাও রেখাপাত করেনি। তবে নিজেদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও সৌদি আরবে আরবভাষী বাঙালি ও প্রবাসী বাঙালিদের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিক্ষাকেন্দ্র (সৌদি আরব) বাংলাদেশ সরকারকে ৪০০২.৩৭ পাউন্ড দান করেছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের মহাসচিবের আহবানে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘের ৬৮ টি দেশ সম্মিলিতভাবে শরণার্থীদের জন্য ভারত সরকারকে ৫ লক্ষ ৭৪ হাজার ১৬২ ডলার সাহায্য দেয়। এসব দেশের মধ্যে ইরাক, ইরান, লিবিয়া, মিসর, ওমানও ছিল।

মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যয়
আজ ৩ দশক পরেও, কোন না কোন ভাবে মুক্তিযুদ্ধ রয়ে গেছে বাংলাদেশের কেন্দ্রে। বাংলাদেশের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সবকিছুর পর্যালোচনা করতে গেলে কোন না কোন সময় নিরিখটা হয়ে দাঁড়ায় মুক্তিযুদ্ধ। তাহলে কি মুক্তিযুদ্ধে যে আশা ছিল তা এখনো অপূর্ণ, নয়ত ঘুরে ফিরে কেন নিরিখটা দাঁড়াবে মুক্তিযুদ্ধ? সে জন্যেই শুরুতে বললাম, মুক্তিযুদ্ধ আছে এখনো বাঙ্গালাদেশের কেন্দ্রে।
মুক্তিযুদ্ধকে অনেকে বলেন স্বাধীনতা যুদ্ধও। আপাত দৃষ্টিতে অনেকের কাছে শব্দ দুটি সমার্থক মনে হলেও তফাৎ আছে প্রত্যয় দুটিতে। তফাৎ টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে এ কারণে যে, শেষোক্ত শব্দটিই সরকারিভাবে ব্যবহার করা শুরু হয় সামরিক শাসনামলে, গণপ্রতিনিধিত্ব মূলক শাসনে নয়। সে কারণে মুক্তিযুদ্ধ

৫১৯

শব্দটির দ্যোতনা প্রাক ১৯৭১ প্রজন্মের কাছে যতটা ব্যঞ্জনাময়, স্বাধীনতা যুদ্ধ ততটা নয়।
মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি ব্যাপক, অর্থেও। অন্যদিকে স্বাধীনতার বিষয়টি সংকির্ণ, অর্থেও। মুক্তিযুদ্ধ বলতে বোঝায় (বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে) বাঙালির সার্বিক মুক্তি, সব অর্থে। এখানেই বিভক্ত হয়ে যায় জনপ্রতিনিধি আর সামরিক শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গী। রাজনীতিবিদরা যেহেতু সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে উঠে এসেছেন, ছিলেন তাদের প্রতিনিধি, তাই ১৯৭১ সালে তারা অনুধাবন করেছেন মুক্তি কেন ছিল প্রধান প্রশ্ন। আর সামরিক সমাজের প্রতিনিধির কাছে আশু ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে নির্দিষ্ট ভূখন্ডের ভৌগলিক মুক্তি। এই যে বিভাজনের সৃষ্টি, তা এখনো অব্যাহত। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এর সময়টুকুতেও দ্বন্দ্ব ছিল এ নিয়ে এবং এই যুদ্ধের নিরসন না হওয়ায়, এ পার্থক্য পরবর্তীকালে দ্বিখন্ডিত করেছে সমাজ, রাজনীতি সব।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, শিক্ষিত ও এলিট মহলে শব্দ দুটির দ্যোতনা দুই রকম হতে পারেঃ কিন্তু একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে মুক্তি, স্বাধীনতা শব্দগুলোর পার্থক্য বিশেষ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেনা। তাদের অনেকের কাছে ৭১ সালতো গন্ডগোলের বছরও। তার অর্থ কি এই যে, তারা মুক্তি বা স্বাধীনতা চায়নি? তা নয়। তার প্রকাশভঙ্গিই এরকম। তার কাছে ১৯৭১ এ কারণে গন্ডগোলের কারণ যে, এর আগে সে অর্থাৎ বাঙালি এরকম সংঘাতের মুখোমুখি হয়নি। প্রকাশভঙ্গী যেরকমই হোক, তাকে যদি শব্দ তিনটির মধ্যে কোনটি বেশি অর্থবহ চিহ্নিত করতে বলা হয় , তাহলে সে অবশ্যই ১৯৭১ সালকে চিহ্নিত করবে মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে।
মুক্তি এবং তারপর মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি যে হঠাৎ করে আমাদের শব্দাবলীতে চলে এসেছে তা নয়। সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে মুক্তিযুদ্ধও হঠাত করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শুরু হয়নি। বহু দিনের পুঞ্জীভূত বঞ্চনা, নিপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চেয়েছে সর্বতোভাবে। এই অনুভূতিই সৃষ্টি করেছে মুক্তিযুদ্ধ শব্দটির, একেবারে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এবং যে প্রত্যক্ষ সমরে অংশগ্রহন করেছে সে মুক্তিযোদ্ধা। সুতরাং এই শব্দটির (যা হয়ে ওঠে একটি প্রত্যয়) অন্তর্নিহিত অর্থ দাঁড়ায় সর্বক্ষেত্রে মানুষের বা বাঙালির মুক্তি।
১৯৭৭ সালে এক সামরিক ফরমান জারি করে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লে. যে. জিয়াউর রহমান বাঙালির আবেগমাখা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এর পরিবর্তন করেন। তার ফরমান অনুযায়ী সংবিধানে প্রস্তাবের শুরুতে ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’ এর পরিবর্তে যুক্ত হলো ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ”এর।

৫২০

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ রাজনৈতিক সাধারণ কোন শ্লোগান মাত্র নয়। সাম্প্রতিক কালে রাজনৈতিক অঙ্গনে অহরহ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ উচ্চারিত হতে দেখে অনেকেই বক্তব্য ও বিষয়ের সর্বব্যাপী বিস্তৃতিকে উপলব্ধি না করেই এটিকে একটি সস্তা রাজনৈতিক শ্লোগানে পরিণত করেছেন কিংবা ভাবতে বসেছেন। আসলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে কি বোঝায় তা ব্যাখ্যা করে বলতে অনেকেই গৎ বাঁধা কতগুলো কথার বাইরে যেন কিছুই বলতে পারছেন না, বলা যেন তাদের পক্ষে সম্ভবও হচ্ছেনা। কেননা সাধারণ ভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা উচ্চারিত হলেও এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা সবার পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে বিষয়টি সকলেই বোঝেন, কেননা বিষয়টি সকলেরই খুব পরিচিত কাছের, একেবারেই মনে হচ্ছে জানার মধ্যে কিন্তু এ সম্পর্কে গভীর কোন ব্যাখ্যায় যাওয়া, অন্যকে বুঝিয়ে সন্তুষ্ট করার মত করে কিছু বলা অনেকের পক্ষেই যেন সম্ভব হচ্ছেনা। পৃথিবীর সব জ্ঞান সম্পর্কেই যে সবাই বুঝিয়ে বলতে পারবেন, এমন ভাবার কোন কারণ নেই। কিন্তু যা সকলেরই জীবন ও চিন্তাভাবনা এবং মনন কে জুড়ে আছে সারাক্ষণ, যা আমাদের দেশের রাজনীতিতে এখন খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে, যার ভিত্তিতে এ দেশটির জন্ম হয়েছে বলে অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, এমন একটি ব্যাপক ভাবে সমাদৃত বিষয় সম্পর্কে মোটামুটি গ্রহনযোগ্য এক বা একাধিক ব্যাখ্যা জানা থাকা তো প্রয়োজন। অধিকসংখ্যক মানুষ এ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পোষণ করবেন, এটাইতো প্রত্যাশিত হবার কথা। কিন্তু যে বিষয়টি সকলেরই বোঝার মত, কিন্তু ঠিক ভালোভাবে বোঝানো যাচ্ছেনা, তা কিভাবে বোধগম্য করা যাবে। কেন তা বোঝানো যাচ্ছেনা, তা ভাবতে হবে গভীরভাবে। আসলে এ ধরণের অস্পষ্ট ধারণাকে জ্ঞানজগতের অপেক্ষাকৃত কাছে নিয়ে যেতে হয়, সেখানে অপেক্ষাকৃত তত্ত্ব ও তথ্যে সমৃদ্ধ করতে হয় সেই কম জানা বিষয়টিকেই, তবেই জ্ঞান হবে সুস্পষ্ট, ব্যাখ্যা হবে যুক্তিনির্ভর এবং বিষয়ভিত্তিক। আমাদের দেশকে নিয়ে যারা গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করেন, মানুষের কল্যান কামনায় যারা আন্তরিক তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মত একটি গভীর জাতীয় আদর্শবাদী ধারণা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানার্জন করতেই হবে। এটিকে নেহাত কোন রাজনৈতিক শ্লোগানে ফেলে রাখজা চলবে না। বরং একটি জ্ঞানতত্ত্বীয় ধারণা হিসেবেই দেখতে হবে, বুঝতে হবে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ একটি জ্ঞানতত্ত্বীয় (Epistemological) ধারণা, ইংরেজিতে যানে Concept বলা হয়। কোন কনসেপ্ট এমনি কোন ধারণা হয়না। ধারণা কোন না কোন বাস্তবতাকে ধারণ করেই গড়ে ওঠে, বিকশিত কিংবা প্রতিষ্ঠিত হয়। যে কোন সত্ত্বার সুনির্দিষ্ট বাস্তবতাকে যে জ্ঞান প্রতিবিম্বিত করে, তাকেই আমরা সেই সত্ত্বাসম্পর্কীয় ধারণা বা কনসেপ্ট বলতে পারি। মুক্তিযুদ্ধও একটি বাস্তবতা। বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে

৫২১

আপন ইতিহাসের এমন এক কঠিন সময়ে অবতীর্ণ হয়, যখন সে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে তার পরাধীনতাকে এবং স্বাধীনতার জন্য সে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যখন সে তার প্রায় আড়াই দশকের বিশ্বাসকে পরিত্যাগ করে, একটি নতুন বিশ্বাসে বাঙালি সহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী বলীয়ান ওঠে। আমাদের জনগণের শৌর্য-বীর্যে গড়ে উঠেছিল গৌরবময় এই অধ্যায়টি। রাজনীতির সেই উত্থানে জাতিগতভাবে বাঙালি দেশপ্রেমের যে শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তাতে সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সম্পৃক্তি ঘটেছিল। মৃত্যু, ধ্বংস ও যুদ্ধের মধ্যেও বেঁচে থাকার প্রচন্ড বিশ্বাস নিয়ে দুর্বার এক মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেছিল এ দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। অংশগ্রহন করেছিল কৃষক, শমিক, বাঙালি, পুলিশ-সামরিক বাহিনী, বুদ্ধিজীবী সহ সমাজের সকল স্তর ও শ্রেনীর মানুষ। আবার কতিপয় বর্বর, সাম্প্রদাইয়িক শক্তি, ও ব্যক্তি ঐ চরম নিপীড়নের কালে পাক বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগী-শক্তি হিসেবে আপন দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহন করেছিল। এই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এদেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আত্ম অন্বেষণের এক রাজনৈতিক বিশ্বাস অর্জন করতে থাকে ১৯৭১ সালে। বলা সঙ্গত বাঙালির এই আত্মপলব্ধি পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই অর্জিত হয়েছে। ফলে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইয়াহয়ার নরপিশাচ বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি জনসাধারণের উপর সকল সামরিক মরনাস্ত্র এবং নিষ্ঠুর বর্বরতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেও বাঙালি তাতে ভীত হয়নি, দমেও যায়নি, বরং তাৎক্ষণিকভাবেই প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। এই প্রতিরোধের শক্তি শহর থেকে গ্রাম এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্রে বাঙালিই সৃষ্টি করেছিল। কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব বাণালির বিশ্বাসে স্থান পায়নি। স্বাধীনতা অর্জনে সে ছিল সংকল্পবদ্ধ এবং সন্দেহমুক্ত। স্বাধীনতার প্রশ্নে বাঙালি মৃত্যুকে অবধারিত করেছিল বলেই পেছনে ফেরার অবকাশ ছিলনা তার, উপরন্তু পাকিস্তানে বসবাসের চিন্তা সে আর করতে পারেনি। ‘হয় স্বাধীনতা, নতুবা মৃত্যু’ মুক্তিযুদ্ধকালের এক সাহসী শ্লোগানের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করার যে মনোবল সেদিন অর্জনের মাধ্যমে প্রদর্শন করল, তা বাঙালি সহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির জীবনবোধ, বিশ্বাস ও রাজনৈতিক আস্থার এক নতুন রূপান্তর। এই উত্থান ছিল মূলত দেশপ্রেম নির্ভর, কল্যানকামী, সর্বতোভাবে আত্মত্যাগ ও বীরর্বের এক আপসহীন অগ্রসর সংগ্রামী প্রতিবাদী চেতনা। এই চেতনার লক্ষ্য ছিল একটি সম্পূর্ণ জাতি এবং অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ইতিহাসের বাস্তব সত্য হচ্ছে, যখন সেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়াতে হল বাঙালিকে তখন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইস্পাত কঠিন ঐক্যে বলীয়ান হল। অপরপক্ষে যাদের মানসিকতা ছিল এক বর্বর পাকিস্তান রাষ্ট্রের মোহে আচ্ছন্ন, দাস দাসীর মতো নিঃশর্ত আত্মসমর্পনী, জীবন যাদের পশ্চাৎমুখীন, লোভ লালসা, অজ্ঞতা ও প্রতিহিংসায় ভরপুর বিবেক যাদের লোপ পেয়েছিল অন্ধত্বের কাছে,

৫২২

মানবতার আবেদনে যাদের আত্মা কখনো সিক্ত হবার দীক্ষা লাভ করেনি, সেই প্রতিক্রিয়াশীল এদেশীয় বর্বর গোষ্ঠী, নরাধম পশুশক্তি পাকবাহিনীর দোসরে পরিণত হল। এ শক্তি আমাদের জাতির একটি ন্যায়যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহন করল। কত ভন্ড, প্রতারক, স্বার্থবাদী এবং ফ্যাসিবাদী চরিত্রের মানুষকে ১৯৭১ এর নয় মাস গ্রামে গঞ্জে, শহর বন্দরে, মুক্তিকামী মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল। এই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঞ্চিত না হলে বাঙালির বিশ্বাসের জগতে লুকিয়ে থাকা পশুশক্তির ধারণা স্পষ্ট হতনা। ধর্মের নামে কিভাবে জাতীয় স্বার্থকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হল অন্ধত্ব আর প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে, আপন মাটি ও মানুষের বিরুদ্ধে গণহত্যার রাজত্ব কায়েমের মাধ্যমে কিভাবে উল্লাস প্রকাশ করা হল, তাও এক মস্ত বড় অভিজ্ঞতা। আর এসব কিছুকে ইসলাম রক্ষার নামে জায়েজ করার ফতোয়া দেয়া হল। এই নিষ্ঠুর, নির্মম ও প্রতারণার এক দুঃসহ প্রতিকূল পরিস্থিতিকে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী, বিভিন্ন উপজাতি সমূহ নিজেদের দৃঢ়চেতা ও আপসহীন ভূমিকায় পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিহত করেছে। এই অভিজ্ঞতা বাঙালির রাষ্ট্র ও রাজনীতির চিন্তায় নবতর ভাবনার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে দৃঢ়ীকরণ করেছে যেখানেঃ পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, জাতিগত নিপীড়ন, অর্থনৈতিক শোষণ- বৈষম্য তথা অধিকার হীনতা থাকবে না। এমনই একটি রাষ্ট্রের আকাঙ্খা তখন ছিল শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে বিবেকবান বাঙালি ও উপজাতি সমূহের নিকট একান্তভাবে কাম্য। এসব বোধ আর বিশ্বাস, অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধিই হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংক্ষিপ্তসার। এই চেতনা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংহত হলেও এর অনেকগুলো ধারণাই পূর্বাপরের সামগ্রিক ইতিহাস নিঃসৃত। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে শুধু একাত্তর সালে সংগঠিত ঘটনাবলীর ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবেনা, বরং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে উচ্চারিত আদর্শ, রাজনৈতিক বোধ ও বিশ্বাসের অতীত ঐতিহাসিকতা, আত্মউপলব্ধির তথা আত্ম সচেতনতার সত্তাগত অবস্থিতির ও বিকাশের মধ্যেই খুঁজে বের করতে হবে। সংক্ষেপে বলা যায়, ঐসকল চিন্তা একাত্তরেই সৃষ্টি হয়নি নতুন করে, বরং তা ছিল আমাদের জাতিসত্ত্বার অভ্যন্তরে লালিত এবং লুক্কায়িত সম্ভার। ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে এগুলোর চূড়ান্ত বিস্ফোরণ এবং বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

মুক্তি যুদ্ধের পটভূমি
বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। কারণ একটি জাতির জীবনে স্বাধীনতার চেয়ে মহৎ কিছু হতে পারেনা। মুক্তিযুদ্ধের পিছনে রয়েছে বাঙালির দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম আর ত্যাগের ইতিহাস। ১৯৪৭ সালে

৫২৩

ইংরেজরা ভারত উপমহাদেশ ছেড়ে যাবার সময় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের মূল কথা হল- ভারতে বসবাসকারী হিন্দু ও মুসলমান পৃথিক জাতি সুতরাং তাদের জন্য পৃথক দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রায় ১২০০ মাইলের ব্যবধানে স্বাধীন ভারতের পশ্চিমে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান মিলে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা ও জাতিগতভাবে বাঙালি ছিল প্রধান জাতি। এছাড়া চাকমা, গারো, সাঁওতাল প্রভৃতি ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাও বিদ্যমান ছিল। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে বেলুচ, সিন্ধি, পাঞ্জাবি, এবং কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। পুরো পাকিস্তানেই ধীরে ধীরে পাঞ্জাবিদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও পাকিস্তানের ৫৬% অধিবাসী পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করে। সেই হিসেবে বাঙালিরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ তথাপি শুরু থেকেই ন্যায্য দাবি দাওয়ার ক্ষেত্রে ক্কেত্রে বঞ্চিত হতে থাকে পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে রাজধানী না হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে রাজধানী স্থাপিত হয় এবং পরে তা ইসলামাবাদে স্থানান্তরিত হয়।
পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র সাত মাসের মাথায় রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে দুই অংশের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। পাকিস্তানের জাতির জনক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঘোষণা করেন যে, ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ জিন্নাহর এই অগণতান্ত্রিক এবং স্বেচ্ছাচারমূলক ঘোষণা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মেনে নেয়নি। তীব্র প্রতিবাদ এল প্রথমে ছাত্রদের কাছ থেকে, পরে তা ভাষা আন্দোলনে রূপ নেয়। সাধারণ মানুষও যোগ দেয় এই আন্দোলনে ব্যাপক হারে। আন্দোলঙ্কারীদের দাবী ছিল যে, উরদু ও বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে। কারণ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মুখের ভাষা বাংলা। বাঙালিরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার দাবী তোলেনি। উর্দু ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করার দাবী তুলেছিল মাত্র। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক বর্গের কাছে বাঙালির কোন দাবীই গ্রহনযোগ্য ছিলনা। ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে যে ফাটিল দেখা দেয়, তা পর্যায়ক্রমে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙনের মধ্যে দিয়ে যথার্থ পরিণতি পায়। ভাষার দাবী প্রতিষ্ঠা করতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে অনেক অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এমনকি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকার রাজপথে জীবন দিতে হয়েছে অনেককে। ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই আব্দুল জব্বার ও রফিকউদ্দিন শহীদ হন। আর ১৭ জন গুরুতর আহত হন। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। তাদের মধ্যে রাত আটটার সময় আবুল বরকত শহীদ হন। গুলি চালানোর সংবাদ

৫২৪

দাবানলের মত শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। অফিস আদালত, সচিবালয়, বেতারকেন্দ্র থেকে কর্মকর্তা, কর্মচারীরা অফিস বর্জন করে রাজপথে নেমে আসে। অবশেষে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক তাৎপর্যময় ঘটনা। এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪, এই সাত বছর পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতায় ছিল মুসলিম লীগের সরকার। দুই অঞ্চলের মধ্যে নানারকম বৈষম্যের বীজ এই সময়ে অংকুরিত হয়ে মহীরুহে রূপ লাভ করে। প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে , সামরিক বাহিনীতে, শিক্ষাসহ দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য ক্রমে বাড়তে থাকে। ১৯৪৭-৪৮ থেকে ১৯৫৪-৫৫ সময়কালে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করেছে ৪২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই সময় পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ব্যয় হয় ৭৯০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
১৯৫১ সালে পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের জন্য শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল নিম্নরূপঃ

প্রদেশের নাম বরাদ্দের পরিমাণ মাথাপিছু হার
করাচি ৪০ লাখ ১৪ হাজার ৪ টাকা ৩ আনা ৩ পাই
সিন্ধু ১০ লাখ টাকা ৩ আনা ৬ পাই
সীমান্ত প্রদেশ ১১ লাখ ৩ আনা ৩ পাই
পূর্ববঙ্গ ৭১ হাজার ১ পাইয়ের ৩ ভাগের ১ ভাগ

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতেও বাঙালিরা বৈষম্যের শিকার হয়। সেনা, নৌ ও বিমান তিন বাহিনীরই সদর দপ্তর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সেনাবাহিনীতে বাংলাদেশের অংশগ্রহন ছিল নিম্নরূপঃ

পদ পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান
জেনারেল ১ ০
লে. জেনারেল ৩ ০
মেজর জেনারেল ২০ ১
ব্রিগেডিয়ার ৩৫ ০
কর্ণেল ৫০ ০
লে. কর্নেল ১৯৮ ২
মেজর ৫৯০ ১০

৫২৫

এমনি নানা বৈষম্য আর বঞ্চনার কারণে এই অঞ্চলের মানুষের মনে হতাশা ও ক্ষোভের অন্ত ছিলনা। এই পরিস্থিতিতে ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা জনগণের সরকার বিরোধী তথা মুসলিম লীগ বিরোধী মনোভাবকে আরো চাঙ্গা করে তোলে। নির্বাচনকে সামনে রেখে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো মুসলিম লীগের পরাজয় নিশ্চিত করতে জোট গঠন করে। এই উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি ও নেজামে ইসলামী একত্রিত হয়ে নির্বাচনী জোট গঠন করে। নাম দেয় যুক্তফ্রন্ট। সে কারণে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন নামেও বিশেষ পরিচিতেই জট গঠনের ক্ষেত্রে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে ২১ দফা দাবী পেশ করা হয়। এই দফা সমূহের প্রধান দিক হলো-
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করা, পাকিস্তানের পূর্ব অংশের জন্য আরো অধিক স্বায়ত্ত্বশাসন ও প্রশাসনে বাঙালির অধিক সংখ্যক নিয়োগের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি ছিল অন্যতম। উল্লেখ্য যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক ছিল নৌকা। আমাদের স্বাধীকার আদায়ের সংগ্রামে এই নির্বাচনের তাৎপর্য ছিল অপরিসীম। প্রাদেশিক পরিষদের মোট আসন সংখ্যা ৩০৯ টির মধ্যে মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯ টি। নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় বাঙালির হতাশা আর বঞ্চনার মূর্ত প্রতীক হয়ে রইল। মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন এবং চারজন মন্ত্রী সহ কমপক্ষে ৫০ জন মুসলিম লীগ দলীয় প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। নুরুল আমিন নিজ আসনে খালেক নেওয়াজ খান নামক ২৫ বছরের যুবক আইনের ছাত্রের নিকট প্রায় ৭০০০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ফকির আব্দুল মান্নান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র তাজউদ্দীন আহমদের নিকট প্রায় ১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। মুসলিম লীগের এ রকম ভয়াবহ পরাজয় প্রত্যাশিত ছিল না। কারণ তাদের গণবিরোধী শাসন এ দেশের মানুষকে চরমভাবে হতাশ করেছিল। কিন্তু নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়কে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গ সহজে মেনে নিতে পারেনি। তারা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার পতনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এই চক্র বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে বাঙালি অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গায় ইন্ধন যোগায়। পরবর্তীতে আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতির অযুহাতে ৯২-ক ধারা জারি করে হক মন্ত্রীসভাকে পদচ্যুত করা হয়।
পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির কারণে বড় ধরনের আঘাত আসে। এর পূর্বে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৫৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী দেশে সাধারণ নির্বাচনের চূড়ান্ত তারিখ ঘোষণা করেছিল। ঘোষিত নির্বাচনের অল্প ক-দিন আগে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ১৯৫৮ সালে ৮ অক্টোবর

৫২৬

সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। তিনি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। শাসনতন্ত্র বাতিল এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। ২৭ অক্টোবর, ১৯৫৮ জেনারেল আইয়ুব খান সরাসরি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পদ দখল করে নেন। দীর্ঘ এক দশক আইয়ুব খান তার স্বৈরশাসনকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
ছয়দফা আন্দোলন সম্ভবত পাকিস্তানের রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনে। ১৯৬৬ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য লাহোরে ‘নিখিল পাকিস্তান জাতীয় কনফারেন্স’ আহবান করেন। শেখ মুজিবুর রহমান এই সম্মেলনে ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবি পেশ করেন। ছয়দফার প্রধান বৈশিষ্ট্য সমূহ ছিলঃ
১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান কে একটি সত্যিকারের ফেডারেল রাষ্ট্ররূপে গঠন করতে হবে।
২. কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে মাত্র দুটি বিষয় থাকবে- প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সমস্ত বিষয় প্রদেশের হাতে থাকবে।
৩. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করতে হবে।
৪. সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে।
৫. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আদায়ের পৃথক হিসাব রাখতে হবে।
৬. পূর্ব পাকিস্তানের জন্য মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারি রক্ষীবাহিনী গঠন করতে হবে।

শেখ মুজিবের ছয়দফা ছিল পাকিস্তান আমলের দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের ন্যায্য অধিকার আদায়ের দলিল। লাহোর কনভেনশনে উপস্থিত পাশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের নিকট ছয়দফা মোটেই গ্রহনযোগ্য ছিলনা। কনভেনশনে উপস্থিত ৭৪০ জন প্রতিনিধির মধ্যে ৭৩৫ জন তাৎক্ষণিক ভাবে ছয়দফা কর্মসূচী নাকচ করে দেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে ‘বাঁচার দাবি ছয়দফা’ হিসেবে তা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকে। সরকার ছয়দফা আন্দোলন দমনে অত্যাচার নির্যাতনের পথ বেছে নেয়। এরই অংশ হিসেবে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করা হয়। এই মামলার প্রধান আসামী করা হয় শেখ মুজিবকে।
১৯৬৮ সালের শেষের দিকে জেনারেল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের উভয় অংশে আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী

৫২৭

আন্দোলন ক্রমে ছাত্রদের হাতে চলে যায়। বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন মিলিত হয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। আওয়ামী লীগের ছয়দফা ও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার ভিত্তিতে ছাত্র জনতার প্রবল আন্দোলন গণ অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আন্দোলনের ভয়ংকর অবস্থা দেখে আইয়ুব খান আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করলেন ও ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেন। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী স্পিকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা ছেড়ে বিদায় নেন।
ক্ষমতা ছাড়ার পর জেনারেল ইয়াহয়া খান ঘোষণা দেন যে, তিনি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেবেন এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্যারাকে ফিরে যাবেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল যুক্ত পাকিস্তানের প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচন। ৭ ডিসেম্বর শান্তিপূর্নভাবে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনকে ছয়দফার পক্ষে জনগণের ম্যান্ডেট হিসেবে গ্রহন করে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি লাভ করে আওয়ামী লীগ। এদেশের স্বাধীকার আদায়ের আন্দোলনে এ বিজয় ছিল খুব তাৎপর্যময়। ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তান শাসকবর্গকে নির্বাচনী ফলাফল হতবাক করে দেয়। আবার তারা ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। যে কোন মূল্যে বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবেনা। এই ষড়যন্ত্রে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং পাকি সেনাবাহিনী সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
নির্বাচনের পর শেখ মুজিব ও ভুট্টোর মধ্যে অনেক আলাপ আলোচনা হয়। ছয়দফার প্রশ্নে মুজিব কোন ছাড় দেবেন না জানিয়ে দিলে আলোচনা থমকে যায়। এই পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেন। পুরো ফেব্রুয়ারি মাস ধরে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছিল। ইয়াহিয়া খান ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১ মার্চের বেতার ঘোষণায় ৩ মার্চের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানি জনগণ গর্জে ওঠে। বাঙালির অবসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যত কোন অস্তিত্ব ছিলনা। মূলত শেখ মুজিবের নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি অফিস আদালত চলতে থাকে। অভূতপূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্ম হয়। ইতিমধ্যে স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিত্যক্ত হয়েছে, বাঙালি এখন পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ। উত্তাল মার্চের ৭ তারিখে ১০ লক্ষাধিক শ্রোতার বিশাল সমাবেশে রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। তিনিন ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে

৫২৮

সমঝোতার চেষ্টা চলতে থাকে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নির্দেশমতো জেনারেল টিক্কা খানের পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে হঠাৎ ঢাকা শহরে হত্যালীলায় মেতে ওঠে। ইপিআর ব্যারাক, রাজারবাগ পুলিশ লাইন সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক হত্যাকান্ড ঘটায় সেনাবাহিনী। ২৫ মার্চ গভীর রাতে শেখ মুজিব কে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হবার পূর্বেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এই পটভূমি রচিত হয়েছে এ দেশের আপামর জনতার সীমাহীন ত্যাগ আর আন্দোলন সংগ্রামের ফলে।

মুক্তিযোদ্ধা
দেশ ও জাতির মুক্তিসংগ্রামে যাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা। নিপীড়িত ও শৃংখলিত জাতিকে পরাধীনতা মুক্ত করতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুধে বাঙালির যে সূর্য সৈনিকগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই মুক্তিযোদ্ধারা মূলত সংগঠিত হয় সাবেক পূর্ব পাকিস্তান এবং ভারতের সীমান্ত অঞ্চলে। তবে কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা সংগঠিত হন আবার দেশের অভ্যন্তরেও।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সবাই ছিলেন ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক অর্থাৎ শহর ও গ্রামাঞ্চলের সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ। বিভিন্ন পেশা ও চাকরি থেকে উঠে আসা মানুষও যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। সেদিনকার ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, বা ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের বেশির ভাগই মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছেন। সাধারণ মানুষ এবং প্রশিক্ষিত বাঙালি সৈনিকদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনীই পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের দেশীয় অনুচরদের পরাস্ত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। জাতির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এঁদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
বলাই বাহুল্য, দেশের অভ্যন্তরে যারা শত বিপদ তুচ্ছ করে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছিলেন তাদেরও এই অভিধার বাইরে রাখা যাবেনা। বযাপক অর্থে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যাঁরাই মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা করেছে তারাই মুক্তিযোদ্ধা।

মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করুন/এরা আপনাদের সন্তান
৫১x৩৬ সেন্টিমিটার পরিমাপের এই পোস্টারটি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ

৫২৯

সরকারের তথ্য ও প্রচার দপ্তর থেকে প্রকাশিত। এই পোস্টারটি বাঙালির আত্মত্যাগ, সংগ্রামের প্রতিভূরূপে ফুটে উঠেছে। মুক্তিযোদ্ধারা বাঙালির সন্তান অর্থাৎ পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুরতে, বর্বরতা, গণহত্যার প্রতিবাদে বাংলার দামাল ছেলেমেয়েরা মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। দেশ মাতৃকার জন্য ওরা জীবন বানি রেখে যুদ্ধ করেছে। সমস্ত দেশবাসী সহ বহির্বিশ্বে এই কথাটি প্রচারের জন্য এই পোস্টারটি প্রকাশ করা হয়। বাংলার জনসাধারণ কে সকল ভয় ভীতি দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভুলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধু করতে এই পোস্টারটি ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদেরই সন্তান, আমাদের মুক্তির জন্যেই তারা লড়াই করছে, যুদ্ধকালীন এই সময়ে এই কথাটা জনগণকে বোঝাতে পোস্টারটি ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল।
এই পোস্টারটিতে লাল, সাদা ও কাল রঙের ব্যবহার দেখা যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা মুক্তিযুদ্ধেরই অংশ। এই কারণে সংগ্রামের প্রতিভূ হিসেবে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ লেখাটিতে লাল রঙের ব্যবহার দেখা যায়। মুক্তিযোদ্ধারা আজ দুঃখ কষ্টে নিপতিত এই কথা বোঝাতে ‘এদের সাহায্য করুন’ কথাটিতে কালো রঙের ব্যবহার করা হয়েছে। এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে বিজয় অর্জিত হবে, এই বিজয়ের মাধ্যমেই শান্তি আসবে এই কথা বোঝাতে বাকি অংশে সাদা রঙের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।

মুছুয়া
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের মুছুয়া বলেও অভিহিত করা হত। এর একটি প্রধান কারণ ছিল যে, বহু সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্যের বিশেষত সাধারণ পর্যায়ের জোয়ানদের দীর্ঘ গোঁফ বা মোছ ছিল। পাকিস্তানিদের প্রতি তীব্র তিরস্কার বা ঘৃণা থেকেই মুছুয়া শব্দটি বহুল প্রচলিত হয়েছিল।

মুজিবনগর ঘোষণা (১০ এপ্রিল)
১৯৭১ সালে তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত সরকার ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে শপথ গ্রহন করে। এর আগে ১০ এপ্রিল মুজিবনগর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়, যা মুজিবনগর ঘোষণা নামেই সমধিক পরিচিত।
মুজিবনগর ঘোষণাটি গুরুত্বপূর্ণ এ কারনে যে, একটি সরকার এ ঘোষণা দিয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধ সেই সরকারের কর্তৃত্বেই পরিচালিত হয়েছে। ঘোষণাটি ২৪ অনুচ্ছেদের। ঘোষণায় মূলত যে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছিল, তা হলঃ ১৯৭০ সালের যুক্ত নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়েছিলেন দেশের শাসনতন্ত্র

৫৩০

প্রণয়নের জন্য। ১৬৯ জনের মধ্যে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যসংখ্যা ছিল ১৬৭। এ কারণে জেনারেল ইয়াহিয়া ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেছিলেন। কিন্তু পরে বেআইনি ও একতরফা ভাবে তা স্থগিত করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণ দেন। এবং বাংলাদেশের মানুষকে বাংলাদেশের সম্মান ও সংহতি রক্ষার আহবান জানান। এ পটভূমিকায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণা কে অনুমোদন করছে।
ঘোষণাটি আইনের ভাষায় রচিত এবং তা রচনা করেছিলেন ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম। এ ঘোষণায় গুরুত্বপূর্ণ দুটি বাক্য হচ্ছে-
১. “বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করে আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি এবং এতদ্বারা পূর্বাহ্নে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি।”
২. বাংলাদেশের মানুষের শৃংখলা পূর্ণ ও ন্যায়মূলক সরকার প্রদানের জন্য যা যা করা দরকার তা করবেন।

এ ঘোষণায়ই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবদের তারিখ ঘোষিত হয় যা নিয়ে এখনো হাস্যকর সব বিতর্ক হয়। মুজিবনগর ঘোষণায় পরিষ্কারভাবে লেখা আছে-
“আমরা আরো সিদ্ধান্ত গ্রহন করছি যে, আমাদের স্বাধীনতার এ ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকরী বলে গণ্য হবে।”
এই তারিখে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ‘অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আইন বলবৎ করণ আদেশ জারি’ করেন। এ আদেশের বলে বাংলাদেশের উপর অস্থায়ী সরকারের আইনগত কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। শেষ হয় মুজিবনগর সরকার গঠনের প্রথম পর্যায়। এর পরের পর্যায় হল সরকার গঠন, শপথ ও কার্যক্রম পরিচালনা।
তবে মুজিবনগর ঘোষণার একটি বৈশিষ্ট্য লক্ষনীয়। স্বাধীনতা ঘোষণা ও তাজউদ্দিনের বক্তব্যে একটি সুর লক্ষ করা যায়। তা হল- বাঙালি এ যুদ্ধে যেতে চায়নি। সে স্বাধীকার চেয়েছে। সেই ন্যায্য দাবি না মেনে তাকে দমনের জন্য গণহত্যা চালানো হয়েছিল এবং সে কারণে সে বাধ্য হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে। সে সব সময় রাজনৈতিক সমাধান চেয়েছে। তাজউদ্দিন বলেছেন, ‘ইয়ায়াহিয়া আশা করেছিল ৭ মার্চ শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন।’ এরপর তাজউদ্দিন কিন্তু নীরব। সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নেতৃবর্গ এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, শত প্ররোচণা সত্ত্বেও শেখ মুজিব রাজনৈতিক সমাধান চেয়েছিলেন। তার বদলে তাঁকে উপহার দেওয়া হয় গণহত্যা। সে কারণে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ডাক দেওয়া ছাড়া

৫৩১

উপায় ছিলনা। এ কারণে ২৬ মার্চই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস।

মুজিববাহিনী
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন মুজিববাহিনী। মুজিব বাহিনী মুক্তিবাহিনীরই অংগ। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বাছাউ করা তরুন ও শিক্ষিত কর্মীদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই বাহিনী। যাঁরা এই বাহিনী গঠনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন, তাঁরা হলেন, সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদ।
‘৭১ এর গণ অভ্যুত্থান কালে অর্থাৎ শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলনের সময়েই জন্ম হয়েছিল এই বাহিনীর। মার্চ ‘৭১ এর মাঝামাঝি সময়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সামগ্রিক শাসন নিজ হাতে তুলে নিয়েছিলেন এবং ৩৫ টি নির্দেশ জারি করেছিলেন। এসব নির্দেশ বাস্তবায়ন এবং দেশের আইনশৃংখলার নিশ্চয়তা বিধানের দ্বায়িত্বে এগিয়ে এসেছিলেন আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের যুব স্বচ্ছাসেবী কর্মীগণ। মার্চ ‘৭১ এর শেষ প্রান্তে যখন পাকিস্তানি সামরিক চক্রের অশুভ উদ্দেশ্য অনেকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন এসব স্বেচ্ছাসেবকই প্রথম প্রতিরোধ আন্দোলন সংগঠনের দ্বায়িত্ব গ্রহন করেছিলেন এবং শুরু করেছিলেন সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহন। ২৩ মার্চ ‘৭১ সালে ঢাকার আউটার স্টেডিয়ামে এই ছাত্র যুব নেতারাই বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং যুব সেনাদের সামরিক অভিবাদন গ্রহন করেন। মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করা ছাড়াও এই যুদ্ধের নেতৃত্ব যাতে কোন উগ্র, চরমপন্থী দলের হাতে চলে না যায়, সেটাও মুজিব বাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য ছিল।
সাধারণভাবে জনসাধারণের মন থেকে হতাশা দূর করা এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য স্থির থাকে, এই উদ্দেশ্য নিয়ে মুজিব বাহিনী গঠিত হলেও পরবর্তীকালে এই বাহিনী প্রয়োজনীয় প্রশিখণ নিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়। ডিসেম্বর ‘৭১ এ মুজিব বাহিনীর প্রায় ৫ হাজার তরুন বিশেষ ধরণের গেরিলা যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষ করেন। এদের কারো বয়স একুশের বেশি ছিলনা।

মেজর জিয়াউর রহমান কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ
তারিখ ২৭ মার্চ ১৯৭১ ।
DECLARATION OF INDEPENDENCE
Major Zia, Provisional Commander in chief of the Bangladesh

৫৩২

Liberation Army, hereby proclaims, on behalf of Sheikh Mujibur Rahman, the independence of Bangladesh.
I also declare, we have already framed a sovereign, legal Government under Sheikh Mujibur Rahman which pledges to function as per law and the constitution. The new democratic Government is committed to a policy of nonalignment in international relations. It will seek friendship with all nations and strive for international peace. I appeal to all Government under Sheikh Mujibur Rahman is sovereign legal Government of Bangladesh and is entitled to recognition from all democratic nations of the world.

মোদের গরব মোদের আশা/আ-মরি বাংলা ভাষা
৫০x৩৮ সেন্টিমিটার পরিমাপের পোস্টারটি বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতরের পক্ষ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিসংগ্রামে বাঙালি জাতিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে এই পোস্টারের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। প্রকৃতপক্ষে ৪৭ পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতির জীবনে ভাষা আন্দোলন হল সকল আন্দোলনের ম্যাগনাকার্টা। এই আন্দোলনের পথ বেয়ে পরবর্তীতে সকল আন্দোলন পরিচালিত হতে থাকে। এই জন্য ভাষা আন্দোলন আমাদের গর্ব ও আশার ধনে পরিণত হয়। ‘৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে বাঙালি মনে সাহস ও উৎসাহ যোগানোর ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলন ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়। এই পোস্টারটি আমাদের সেই কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ‘৫২ এর শত্রু আজ ‘৭১ এ আবার জন্মভূমির উপর জেঁকে বসেছে। তাকে উৎখাত করতে হবে। তাই বজ্র কঠিন শপথ গ্রহন করতে হবে। ভাষা আন্দোলনের চেতনাশ্রয়ী এই পোস্টারটি আমাদের চিরায়ত সংগ্রামের প্রতিভূ। পোস্টারটির লাল ও সবুজ রং এর ব্যবহার আমাদের জাতীয় পতাকার রং এর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে করা হয়েছে।

মোল্লা জালালুদ্দীন আহমদ (১৯২৬-১৯৭৯)
মোল্লা জালালুদ্দিন আহমদ ১৯২৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারী গোপালগঞ্জের বরফা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। করটিয়া সাদত কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন এবং ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এ এবং ১৯৫৩ সালে

৫৩৩

এল এল বি পাশ করেন। পরে ঢাকা বারে আইন ব্যবসা শুরু করেন। এবং কালক্রমে হাইকোর্টের একজন বিশিষ্ট আইনজীবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ছাত্রজীবনেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪৮ এ ছাত্রলীগ এবং ১৯৪৯ এ প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৬ সালে ছয়দফা আন্দোলনে সক্রিয় হলে গ্রেফতার হন। ১৯৬৮ সালে মুক্তি পান। ‘৬৯ এর গণ আন্দোলন চলাকালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আহূত রাওয়াল পিন্ডির গোলটেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭০ এ ফরিদপুর এলাকা থেকে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ এ মুজিবনগর সরকারের দূত হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্য সফর করেন। এ সময়ে বৈরুতে স্থাপিত বাংলাদেশ মিশনের প্রধান ছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের অন্যতম কৌঁসুলি ছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের ডাক, তার ও টেলিফোন মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৩ এ ফরিদপুর ১১ থেকে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচইত হন। এবং বন, মৎস, পশুপালন, ভূমি রাজস্ব ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রীর দ্বায়িত্ব পান। ১৯৭৫ এ বাকশাল এ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৭৯ তে ৩য় বার গোপালগঞ্জ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠায় তার বিশেষ ভূমিকা আছে। ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মোহাম্মদ আলম (-২০০৮)
ফতোসাংবাদিক মোহাম্মদ আলমের জন্ম কুমিল্লা জেলার হোমনা থানায়। ‘দৈনিক আজাদ’এ ১৯৬৫ সালে ফটোসাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু।
একাত্তর সালে মেজর ডালিমের নেতৃত্বে নয় নম্বর সেক্টর থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। মুজিবনগর সরকারের তথ্য অধিদফতরের নিয়োগপ্রাপ্ত সমর ফটোগ্রাফ ছিলেন। যে কারণে অস্ত্র আর ক্যামেরা দুটোই চালিয়েছেন সমানভাবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন সেক্টরের যুদ্ধদিনের ছবি তুলেছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর তোলা অনেক ছবি বিশ্বের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠনে তাঁর ছবির গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফার পদে যোগ দেন। পরবর্তীতে ‘দৈনিক সংবাদ’ এবং ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ এ প্রধান ফটোসাংবাদিকের দ্বায়িত্ব পালন করেন। পেশাগত সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি কয়েকটি জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত হন। বীর মুক্তিযোদ্ধা এই কৃতী ফটোসাংবাদিক ২০০৮ সালের ১০

৫৩৪

জানুয়ারি পরলোকগমন করেন।

মোহাম্মদ বায়তুল্লাহ (১৯২৭-১৯৮৭)
মোহাম্মদ বায়তুল্লাহ ১৯২৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর নওগাঁ জেলার সালেমাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। ১৯৪৯ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এ এবং ১৯৫৩ তে এল এল বি পাস করেন। ১৯৪৮ এ মার্চে এবং ১৯৫২ এর ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৩ সালে নওগাঁ আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। এবং সেই বছরই আওয়ামী লীগ এ যোগ দেন। দীর্ঘকাল রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও নওগাঁ মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে রাজশাহী-৩ আসন থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। পরবর্তীতে স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে গণপরিষদের ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। পরবর্তীতে স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে গণপরিষদের ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৩ এ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ঐ বছরই এপ্রিলে জাতীয় সংসদের প্রথম ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন এবং তিন বছর দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারীতে বাকশাল গঠিত হলে এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৭৯ এ সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী ৯ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাজিত হন। তবে ১৯৮৬ সালে নওগাঁ-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হিসেবে ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। ১৯৮৭ সালের ৯ মে নওগাঁতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মোহাম্মদ ফরহাদ (১৯৩৮-১৯৮৭)
মোহাম্মদ ফরহাদ জন্মগ্রহন করেন ১৯৩৮ সালে পাবনায়। পিতা আহমেদ সাদাকাতুল বারী ছিলেন সরকারী স্কুলের শিক্ষক। ১৯৫৩ সালে দিনাজপুর জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৫৭ সালে দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে আইএ এবং একই কলেজ থেকে ১৯৫৯ সালে বিএ পাশ করেন। এই কলেজেরই ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ১৯৫৭ সালে। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এ পাশ করেন। ১৯৬২ তে কিছুকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়েন। ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলনে দিনাজপুরে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৩ সালে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। এবং সেই থেকে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নেতাদের একজন। ১৯৭১ সালে

৫৩৫

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত গেরিলা বাহিনীর প্রধান সংগঠক ও অধিনায়ক ছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে ১ম বার, ১৯৮০ সালে ২য় বার এবং ১৯৮৭ সালে ৩য় বার কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ এ বাকশাল গঠিত হলে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। ১৯৭৭ এ সেনা বিদ্রোহে জড়িত থাকার অভিযোগে জিয়া সরকার তাকে গ্রেফতার করে। এবং ১৯৭৮ এ হাইকোর্টে রিট করে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৮০ তে আবার গ্রেফতার হন। স্বৈরাচারী এরশাদ পতনের আন্দোলনে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৬ সালে ১৫ দলীয় জোটের হয়ে পঞ্চগড়-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নিষ্ঠাবান কমিউনিস্ট নেতা যিনি কৃষক শ্রমিকের অর্থনৈতিক মুক্তি ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সারাজীবন আন্দোলন করেছেন। পরবর্তীতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৭ সালের ১০ আগস্ট রাশিয়ার মস্কোতে পরলোক গমন করেন।

যুব ও অভ্যর্থনা শিবির পরিচালনার নির্দেশাবলি
GENERAL GUIDANCE FOR ADMINISTRATION OF YOUTH RECEPTION OF AMP.
ADVISORY COMMITTEE:
1. Each reception Camp will have an Advisory Committee as approved by the Board of Control, Youth Camp. Its function will be to provide an overall supervision of the Camp and maintain proper management and discipline. The Committee will have a minimum of 3 Honourary Members from amongst such MNA/MPAs and other political leaders and workers who are interested in the running of the Camp and are resident, for the time being, within the close vicinity of the camp. For Camps which are already functioning, an Advisory committee along these guidelines, will be formed, if not formed already, for further development and progress of the camps and also a review/regularisation of the camp staff. In such cases, the acting camp in charge will convene a meeting of above category persons to form an Advisory Committee.
The Committee will have a chairman from amongst the members and a secretary from amongst the members. A list containing the name of Chairman and other members. Secretary shall be submitted to Chairman, Board of Control, for approval, within 15/9/71. The Advisory Committee will appoint the Camp in charge.

৫৩৬

The Camp in charge will be a whole time functionery and an ex officio member of the advisory committee. While an advisory committee will provide guidence. the camp in charge will be responsible for the day to day running of the camp. The proceedings of the meeting of advisory committee should be recorded and copy to be forwarded to the chairman, Board of control and director of the Zone concerned. The camp in charge will be responsible for maintaining a proper account of the camp expenses.
The minimum strength needed for the recognition of camp will be 250.
STAFF
All functionary staff of the camp including the Camp in charge will be residents of the camp.
2. The camp in charge, subject to approval of the advisory committee, will also select and appoint.
(a) One accountant: responsible for maintaining all accounts in the camp including stores and catering as per standard accounts procedures. The books of accounts woll be audited at regular intervals.
(b) One deputy camp in charge cum supervisor in charge: of accomodation, bedding, tents, sanitation arrangements,…… general cleanliness of the camp, i. e., he will also maintain inventry of the equipments.
(c) One catering supervisor: He will be responsible for the marketing of kitchen, cooking arrangements, plated, drinking water and fuel etc. He will submit his daily accounts to the accountant.
(d) One medical officer.
(e) One compounder .
(f) One general assistant
(g) Four instructors: (for a camp of 500 boys)

3. INSTRUCTORS
a. Motivational instructor- One for each 250 youths.
b. Physical instructor- One for each 250 youths. Other training may be included from time to time and suitable instructions will then be appointed-instructions in the matter will follow in due course, if necessary.

4. THE DEPUTY CAMP IN CHARGE WILL be assist the camp in charge in all matters and in the absence of camp in charge will held charge of the camp and act as the ex officio member of the advisory committee.

৫৩৭

5. BOARD/LODGE FOR STAFF: POCKET ALLOWANCE
The following staff will get free board and lodge in the camp. They will receive no salary. However, they will be paid a pocket allowance of Rs. 50/- per month, for the time being.
a. Camp in charge.
b. Dy. camp in charge (Supervisor)
c. Accountant
d. Store supervisor
e. Catering supervisor
f-i. Four instructor
j. Medical officer
k. compounder
l. General assistant (for cooking supervision etc. and other duties as may be assigned by the Camp in charge)

6. COOCKS AND OTHER STUFF
The camp will also engage necessary service staff, such as coock, cook assistant etc. from amongst the volunteers and youths and they will be designated as helpers. The number nature of service staff required will be determined by the advisory committee.
All such staff will be provided with free board and lodge in the camp and pocket allowance of Rs. 50.00 (L. S.) per month will be paid for the party.

7. FUNCTIONAL INSTRUCTIONS
The advisory committee, through the camp in charge, will maintain liaison with the Zonal Director for Camp requirements and will submit fortnightly reports on camp activities and account etc. One copy should be sent directly to the chairman, Board of control and another copy to their respective Director.
All payments will be subject to ……………… where bank facility is available, the account will be operated jointly by any two of the followings:-

a. chairman
Camp in charge
c. Accountant
Copies of the daily return of the number of youth present in the camp at the begging and end of each day must be intimated/posted to the chairman, advisory committee and the zonal Directors office.
proforma for submission of other reports and accounts will be despatched later on. In the meantime, such reports will be sent on blank sheets.

8. PHYSICAL TRAINING
The physical training syllabus should be such that in the shortest

৫৩৮

possible time the youth can acquire maximum stamina and highest degree of physical fitness for most abnormal operational tasks. This syllabus should include cross country running and walking as well, The detailed syllabus should include cross country running and walking as well, The detailed syllabus should be worked out by the instructors concerned. There should be no drill.

9. ADMISSION
Admission to the camp will be made under supervision of the camp in charge who will be guided in the matter by the advisory committee itself or any other body to be formed by the advisory committee for that purpose.
A body admitted to the camp will have to be a national of Bangladesh and identified by the MNA/MPA of the area of his domicile in Bangladesh, who will issue a written certificate to the effect. In the absence of the MNA/MPA concerned, the decision will be with the advisory committee or the body, formed by the advisory committee.
The boy will be medically examined and must fulfill other requirments of admission.
He should have unquestionable faith and belief in the freedom of Bangladesh. He must have no past criminal record. He must not have any extra-territorial loyalty.
Admission will be open to all eligible youths irrespective of religion, caste, creed etc., place of birth and domicile, and on secular basis strictly.
A boy admitted to reception camp but subsequently having failed to pass the scrutiny for admission to youth camp on the first and the second time, will automatically cease to be on inmate of the camp.

10. AUDIT TEAM
An audit team composed of one accountant and an accounts assistant and any other necessary staff to be deputed by director, camps of the zone concerned, will visit the reception camp periodically, for audit of accounts and payment of advance subject to pre audit adjustments. The team will submit to the chairman…
SECRET
GOVT. OF THE PEOPLE’S REPUBLIC OF BANGLADESH PFFICE OF THE DIRECTOR GENERAL, YOUTH CAMPS.
List of strength in youth camps during week ending 6-11-71 with week ending sent out for higher training received from Brig. Master Office.

৫৩৯

Name of camp. Strength of youth sent New arrival on Strenght of week
out for higher training week ending ending.
on week 6-11-71 6-11-71 6-11-71

1. Pita – 145 900
2. Barrackpore
(Sreepalli) – 645 800
3. Jomshedpur – 38 800
4. Datal 300 – 600
5. Chapra
(Bangal Jee) 297 – 665
6. Poriple – – 800
7. Gourbagan 910 68 390
8. Pattrum – 57 760
9. Dhansarigaon 310 – 920
10. Tapurhat 67 – 693
11. Gokulnagar-1 – 254 1180
12. Gokulnagar-2 – 273 1200
13. Charilam-1 – 133 1000
14. Charilam-2 – 308 1200
15. Katheliachara – 150 1000
16. Menu 152 – 720
17. Bageta – 105 1000
18. Kailashahar
(Kalaynagar) – 300 1000
19. Hassoin – 51 421
20. Labow 140 – 960
21. Solin 285 – 1730
22. Dalu 101 – 1970
23. Cloverhouse – – 295
Total of week
ending 6-11-71: 2,571 2530 20,9664

যুবশিবির
মন্ত্রী পরিষদে যুব শিবির সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ৯ আগস্ট তারিখে গৃহীত হয়।
১। যুবশিবিরঃ অভ্যর্থনা শিবিরগুলো বাংলাদেশ দেখাশোনা করবে।
যেহেতু পূর্বাঞ্চলেই যুব শিবিরের সূচনা এবং ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম এবং সিলেট থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক যুবশ্রেনী সমবেত হচ্ছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যে, সেজন্যে প্রথম কয়টি মাস এখানকার শিবিরগুলো বেশি তৎপর ছিল। এর ওপর ত্রিপুরা রাজ্যে বড় সমাবেশ ঘটেছিল উপরোক্ত জেলাগুলোর নেতৃবৃন্দের। ঐসময়কার কয়েকটি প্রতিবেদন, চিঠিপত্র ইত্যাদি দেখলেই বোজা যাবে কত

৫৪০

গুরুত্বের সাথে যুবশিবিরগুলো পরিচালিত হত।
প্রাথমিক পর্যায়ে পূর্বাঞ্চলে সংগঠিত যুবশিবিরগুলো কোথায়, কিভাবে কার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে তুলে ধরা হলঃ
২৩ আগস্ট মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের একটি সিদ্ধান্তে যুব শিবির সম্বন্ধে বলা হয় যে, দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধিবৃন্দ সঠিকভাবে কাজ না করায় শিবিরগুলোতে বিশৃংখলা দেখা দিয়েছে।
২৮ মে তারিখে মাহবুব আলম সাহেব (ডিরেক্টর, ইয়ুথ ক্যাম্প-এই পরিচয়ে) ‘গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন’ এর সচিবকে একটি চিঠি লেখেন। এতে দেখা যায় যে, গ্রাম ভিত্তিক সংগঠন করার জন্য পূর্বাঞ্চলে যুবশিবির স্থাপিত হচ্ছে। পশ্চিম অঞ্চলে ইতিমধ্যেই ‘গান্ধী শান্তি পরিষদ’ এইরকম কাজে সাহায্য করেছিল বিধায়েকই পাঠ্যক্রম এবং যোগ্যতাসম্পন্ন প্রশিক্ষক দিয়ে স্থানীয়ভাবে শিবির পরিচালনা করে যাবার প্রস্তাব রাখা হয়। এক মাস ব্যাপী প্রশিক্ষণে মাথাপিছু ২০০ রুপি চাওয়া হয় (প্রতি শিবিরে ১০০ জন হিসেবে)।
এর পরের মেমোটি ছিল এম আর সিদ্দিকী সাহেবের দস্তখতে, (মেম্বার ইন চার্জ, ফিনান্স)। বিষয়বস্তু দেখে অনুমান করা যায় এটি পূর্বাঞ্চলের যুবশিবির প্রধানকে লেখা। এতে অনুরোধ করা হয়েছে যে, শিবিরগুলো পরিদর্শনকালে ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যেন নির্ধারিত ছকে কতগুলো তথ্য সরবরাহ করেন। এতে আমরা পূর্বাঞ্চলের যুব শিবিরগুলোর একটি সম্পূর্ণ চিত্র পাই।
জুন মাসে মোট ১৭ টি শিবিরে ভারপ্রাপ্ত সবাই ছিলেন জাতীয় অথবা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, দু একজন ব্যতীত (একজন এম এ হান্নান, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং আরেকজন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন)। শিবিরগুলোতে সদস্য ছিলেন ৪৮৫০ জন, ৮ টি জেলা থেকে আগত। নির্ধারিত ছকে একটি শিবিরের কর্মকর্তাদের বিবরণ পাওয়া যায়। তাঁরা শিবিরগুলোতে অবস্থান করতেন। ১৯-৬-৭১ তারিখে পূরণকৃত একটি ছকে দেখা যায় যে, সেখানকার শিবির প্রধান ছিলেন এম এ হান্নান এবং তাঁর সহকারী ছিলেন এম এ মান্নান, ক্যাম্প সুপারভাইজার ছিলেন জিএ প্রসাদনাথ (মন্টো), রাজনৈতিক প্রশিক্ষক আজিজুল হক (অ্যাডভোকেট), প্রফেসর নূরুল আবসার ও প্রফেসর নূর মোহাম্মদ, ছাত্র প্রতিনিধি এম এ হাশেম আর ডাক্তার ছিলেন ডা. রেজা।
পূর্বাঞ্চলের প্রশাসকরূপে ২৫-৬-৭১ তারিখে আমি একটি মেমো জারি করি। এতে দেখা যায় অর্থমন্ত্রী একটি প্রশাসনিক কাঠামো অনুমোদন করেন। এতে আঞ্চলিক প্রশাসন ছাড়াও যুবশিবির ব্যবস্থাপনাও অনুমোদন দেওয়া হয়। যুবশিবির কমিটি কাউন্সিলের সাথেই কাজ করত এবং এদের ব্যবস্থাপনা ও কর্মকান্ড

৫৪১

আঞ্চলিক পরিষদ সমন্বয় করত।
এই সময় অর্থাৎ জুনে যুবশিবির পরিচালনায় ছিলেন নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গঃ
১. প্রফেসর নূরুল ইসলাম চৌধুরী, এম এন এ, ডিরেক্টর, প্রশাসন।
২. ড. আবু ইউসুফ, ডিরেক্টর, সিলেবাস ও কর্মসূচি।
৩. জনাব মির্জা আবু মনসুর, এম পি এ, উপ পরিচালক, সরবরাহ।
৪. জনাব বজলুর রহমান, উপপরিচালক, চলাচল।
৫. জনাব ফারুকী, এম পি এ, উপ পরিচালক, প্রশাসন।
এছাড়া আরো কর্মকর্তা ছিলেন। পূর্ব অঞ্চলের প্রধান হিসাব রক্ষক এ কে চৌধুরী। ২৫-৭-৭১ তারিখের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যায় যে, জুলাই মাসে ঐ অঞ্চলে যুবশিবিরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৩ এ উপনীত হয়েছে। তালিকা নিচে দেওয়া হলঃ
যুবশিবিরের তালিকাঃ জুলাই ১৯৭১
১. বক্সনগর
২. বেলতলী
৩. চারিপাড়া
৪. কংগ্রেস ভবন
৫. চোটাখোলা
৬. ধর্মনগর
৭. দুর্গা চৌধুরীপাড়া-বিজনা
৮. ঐ-গোমতী
৯. ঐ-ইছামতী
১০. গোকুলনগর
১১. ঐ-মেঘনা
১২. ঐ-পদ্মা
১৩. হরিণা
১৪. হাতিমারা
১৫. হাপানিয়া
১৬. ঐ- ব্রক্ষ্মপুত্র
১৭. ঐ-গোমতী
১৮. ঐ-যমুনা
১৯. হাপানিয়া – তিতাস
২০. জয়নগর
২১. কাঁঠালিয়া (বড়মুরা)
২২. কৈলাশহর

৫৪২

২৩. খোয়াই
২৪. মেলাঘর
২৫. মোহনপুর
২৬. মোতিনগর
২৭. পালাটোনা
২৮. পাথেরকান্দী
২৯. রাজনগর (রাধানগর)
৩০. শিলাছড়া
৩১. শ্রীনগর
৩২. উদয়পুর
ইতিমধ্যে এই অঞ্চলের যুব শিবির পরিচালনা বোর্ডও সম্প্রসারিত হয়েছিল নিম্নলিখিত ভাবে।
১. কেন্দ্রীয় প্রশাসন
প্রফেসর নূরুল ইসলাম, এম পি এ
২. প্রশিক্ষণ এবং সমন্বয়
ড. আবু ইউসুফ (জিওলজি- পি এইচ ডি)
৩. কেন্দ্রীয় সরবরাহ
জনাব মির্জা আবু মনসুর, এম পি এ
৪. চলাচল/তৎপরতা
বজলুর রহমান
৫. মেডিকেল
ড. এম এ মান্নান, এম পি এ
৬. নতুন ভর্তি
জনাব আ স ম আব্দুর রব
৭. ছাত্রদের বিষয়াবলী
জনাব আব্দুল কুদ্দুস মাখন
৮. কর্নেল চৌমুহনী অফিস
জনাব আব্দুল লতিফ খান
(আগরতলা শহর)
জুলাইয়ের শেষভাগে চার শ্রেনীর শিবির স্থাপিত ও পরিচালিত হচ্ছিল। যেমনঃ
ক. অভ্যর্থনা খ. উদ্বুদ্ধুকরন গ. প্রশিক্ষণ এবং ঘ. নিয়মিত বাহিনীর সাথে।

৫৪৩

যৌথ কমান্ড
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকার ‘যৌথ কমান্ড’ গঠন করে। বাংলাদেশ ও ভারতের সামরিক বাহিনী এই কমান্ডের অধীনে পূর্ব রণাঙ্গনে (বাংলাদেশে) পাকিস্তান বাহিনীর বিপক্ষে যুদ্ধ পরিচালনা করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে ভারত নানাভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা দেয়। শরনার্থীদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র দেয়। তারপরও ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি।
কিন্তু পাকিস্তান ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ভারতীয় ভূখন্ডে আক্রমণ চালালে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়। ভারতও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের লোকসভায় বাংলাদেশের স্বীকৃতির ঘোষণা দেন। বাংলাদেশ ও ভারতের সরকার একমত হন যে, তাদের উভয়ের শত্রু পাকিস্তানের সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করা উচিত। এভাবেই বাংলাদেশের মিক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়ে ‘যৌথ কমান্ড’ গঠন করা হয়।

দুই দেশের সৈনিকদের মিলিত আক্রমনে পরাজিত হয় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী। ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আত্মসমর্পন করে যৌথ কমান্ডের কাছে। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) আত্মসমর্পন দলিলে পাক বাহিনীর পক্ষে স্বাক্ষর করে জেনারেল নিয়াজী আর যৌথ কমান্ডের পক্ষে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।

রক্তের ঋণ রক্তে শুধব/দেশকে এবার মুক্ত করব
৭১x৪৬ সেন্টিমিটার পরিমাপের এই পোস্টারটি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতর থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। পোস্টারটি অংকন করেন শিল্পী প্রাণেশ কুমার মন্ডল। এটি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বহন করে। পৃথিবীতে বাঙালি একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছে এবং জীবন দিয়েছে। ১৯৪৭ সালে ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে হাজার মেইল ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও পূর্ব বাংলাকে শোষণ করা, বাংলার কৃষ্টি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য ভাষার উপরেই প্রথম আঘাত হানা হয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, উর্দু উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। বাংলার সংগ্রামী ছাত্র জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে মিছিল

৫৪৪

করলে নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর পুলিশ গুলি চালিয়ে কয়েকজন ছাত্রকে হত্যা করে। এই হত্যার প্রতিবাদে গোতা বাংলায় পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। মূলত ভাষা আন্দীলনই আমাদের মুক্তি সংগ্রামের মূল সোপান। এই ভাষার দাবি নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যেও দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। এই দ্বন্দ্বের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পটভূমির ফল ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। এই পোস্টারটি ভাষা আন্দোলনের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য বাঙালির মধ্যে নব জাসগরণের সৃষ্টি করেছিল। এই পোস্টারটির মূল বক্তব্য ছিল ‘৫২ ও ‘৭১ এর মূল শত্রু একই। ভাষা কৃষ্টির মত তাদের হাতে আমাদের দেশ জাতি কিছুই নিরাপদ নয়। তাই আমাদের ৫২ এর চেতনায় এদের বিরুদ্ধে নুক্তিযুদ্ধ করতে হবে। যেভাবে বাঙালিরা শত্রুর হাত থেকে ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা করেছে তেমনি হানাদারের কবল থেকে এই দেশকে মুক্ত করতে হবে।
পোস্টারটিতে লাল ও সবুজ রঙের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের জাতীয় পতাকার রঙের সাথে সাদৃশ্য রেখে এই রঙ নির্বাচন করা হয়েছে। জাতীয় পতাকার মত বাংলা অক্ষরও আমাদের সার্বভৌত্বের প্রতীক। তারই প্রতিফলন ঘটেছে এই পোস্টারটিতে।

রণাঙ্গন (১)
‘রণাঙ্গন’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন রণদূত এবং ছদ্মনামে এর সম্পাদকের নাম প্রকাশিত হত। সহযোগী সম্পাদনার দ্বায়িত্বে ফারুক আহমদ ছিলেন। আর এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। পত্রিকার নামের নিচে ‘মুক্তিফৌজের সাপ্তাহিক মুখপত্র’ কিংবা ‘মুক্তিবাহিনীর সাপ্তাহিক মুখপত্র’ এভাবে লেখা রয়েছে। হাতে লেখা সাইক্লোস্টাইলে করা ছোট আয়তনের এই পত্রিকার প্রথম প্রকাশ ঘটে ১১ জুলাই, ১৯৭১। এটি টাঙ্গাইল জেলা মুক্তিফৌজের বেসামরিক দপ্তর থেকে প্রকাশিত হত। প্রীতি মূল্য ৫০ পয়সা। এবং পৃষ্ঠা সংখ্যা চার ছিল। বিভিন্ন রণাঙ্গনের খবর এবং কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীর বীরত্বের সংবাদ এতে প্রাধান্য পেত বেশি। পত্রিকাটির ১১ জুলাই সংখ্যার সম্পাদকীয়র শেষোক্ত উচ্চারণ ছিল এরূপ- ‘আমরা শান্তি চাই। কিন্তু কবরের শান্তি চাইনা। এবার আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠা করব- আঘাতের পর আঘাত হেনে দস্যু হানাদারদের খতম করব। জয় বাংলা।’

রণাঙ্গন (২)
সাপ্তাহিক ‘রণাঙ্গন’ সম্পাদক মুস্তাফা করিম কর্তৃক পত্রিকাটি বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল

৫৪৫

পাটগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়। পত্রিকার নামের উপরে ‘মুক্তিকামী জনতার মুখপত্র’ কথাটি লেখা হত। বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত রেজিস্টার্ড নং ২১ ছিল। পত্রিকাটির কলামসংখ্যা ৩-৪ এবং মূল্য ১৫ পয়সা ছিল। প্রধান উপদেষ্টা মতিয়র রহমান এমএনএ, প্রধান পৃষ্ঠপোষক করিম উদ্দীন আহমেদ এমপিএ, যুগ্ম সম্পাদক এমএ সালেহ ও সুভাষচন্দ্র নন্দী এবং সার্কুলেশন ম্যানেজার এমএ করিম ছিলেন। ১৯৭১, ২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সংখ্যার প্রথম পাতার প্রধান শিরোনাম ‘ডিসেম্বরে বাংলা মুক্ত’, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মহিলা গেরিলা বাহিনী’ এবং সম্পাদকীয় ‘ইয়াহিয়ার রণ উন্মাদনা’ ছিল। পত্রিকাটির শুরু কবে এবং কবে শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল জানা যায়নি।

রণাঙ্গন (৩)
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রংপুর থেকে ‘রণাঙ্গন’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হত। প্রকৃতপক্ষে ভারতে এটির মুদ্রণকাজ সম্পন্ন হত এবং বিভিন্ন পথে মাঝেমধ্যেই রংপুরে এর কপি পাঠানো হত এখানকার মানুষের মনোবল অটুট রাখার উদ্দেশ্যে। এর সম্পাদক ছিলেন খন্দকার গোলাম মোস্তফা বাটুল।

রিকগনাইজ, রিকগনাইজ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ
RECOGNISE, RECOGNIZE BANGLADESH, BANGLADESH
এই শ্লোগানটি প্রবাসী বাঙালিদের প্রাণের দাবিরূপে তাদের নানা সমাবেশ মিছিলে ব্যাপক শোনা যেত। প্রবাসী বাঞালিদের এই শ্লোগানটি সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন আদায়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন দানকারী বিভিন্ন বিদেশী নাগরিক ও সংগঠনও এই শ্লোগানটি ব্যাপক ব্যবহার করত। পরবর্তীতে ভারতের ও ব্রিটেনের সংসদেও এই শ্লোগানটি দাবিরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। লকডনের হাইড পার্কে ১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই আবু সাঈদ চৌধুরী এই শ্লোগানটি দেন এবং তাঁর সাথে সমবেত সবাই এই শ্লোগান টি দিতে থাকেন। পরবর্থীতে প্রবাসীদের প্রতিটি আন্দোলনে এই শ্লোগানটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

৫৪৬

রিলিফ ক্যাম্প
১৯৭১ সালে সীমান্তবর্তী প্রতিটি ভারতীয় রাজ্যে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী শরণার্থী জায়গা করে নিয়েছিল। নারী, শিশু ও বৃদ্ধের এই দেশত্যাগী জনস্রোত শুরু হয় ২৫ মার্চ থেকে যখন পাকিস্তান হানাদার বাহিনী সারাদেশে নির্বিচার গণহত্যা শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের নির্দেশে ভারত মানবিক কারণে সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। আশ্রয় দিয়েছিল ভাগ্য বিড়ম্বিত লক্ষ লক্ষ মানুষকে। এইসব শরণার্থীর আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল মূলত সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে রিলিফ ক্যাম্প খুলে। সেখানে তাদের আশ্রয়, খাবার ও নিরাপত্তা দেওয়া হত। এই রিলিফ ক্যাম্প গুলোকে বৃদ্ধ, শিশু ও নারীরা তাদের অস্থায়ী ঠিকানা করে নিয়েছিল। এমনি হাজার হাজার ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল ভারতীয় অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে। সাময়িক প্রয়োজন মেটাতে বাঁশ, কাঠ, বেত ও টিন দিয়ে এই সমস্ত ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল। ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তা প্রহরী বসানো হয়েছিল। বসানো হয়েছিল পুলিশ চৌকি। সীমান্তের ওপার থেকে পাকিস্তানিরা যাতে ক্যাম্পগুলোতে আক্রমন করতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই শরণার্থী শিবির গুলোকেই প্রচলিত ভাবে বলা হত রিলিফ ক্যাম্প।

রুহুল কুদ্দুস (১৯২৪-১৯৯১)
রুহুল কুদ্দুস জন্মগ্রহন করেন ১৯২৪ সালে খুলনা জেলার সাতক্ষীরার পাঁচরিখি গ্রামে। তাঁর পিতা রইসউদ্দিন আহমেদ। ১৯৪৮ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে এম এ ডিগ্রী লাভ করেন। এবং ঐ বছরই ঢাকা কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৯ এ পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। পঞ্চাশ ও ষাট এর দশকে চাকরিতে নিয়োজিত থাকাকালে গোপনে পূর্ব বাংলার স্বাধীকার ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে নানাভাবে যুক্ত থেকে দেশাত্মবোধের পরিচয় দেন। ছয়দফা দাবির অন্যতম প্রণেতা ছিলেন বলে অনুমান করা হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার (১৯৬৮) অন্যতম আসামী ছিলেন তিনি। ৬ জানুয়ারি ১৯৬৮ তে গ্রেফতার হন। এ মামলার ৩৫ জন আসামির মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ১ এবং রুহুল কুদ্দুস ছিলেন ১১ নম্বর আসামি। ১৯৬৯ এর গণ আন্দোলনের চাপে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে মামলা প্রত্যাহার করে নিলে মুক্তি লাভ করেন। এরপর সক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকারের মুখ্য সচিব ছিলেন। দেশ স্বাধীন হলে পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারেরও মুখ্য সচিব নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সামরিক বাহিনীর কিছু সংখ্যক সদস্যের হাতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর

৫৪৭

রহমান নিহত হলে পদচ্যুত হন। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক এবং ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। ১৯৯১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

লং লাইভ, লং লাইভ লিবারেশন আর্মি, লিবারেশন আর্মি
LONG LIVE, LONG LIVE LIBERATION ARMY, LIBERATION ARMY
এই শ্লোগানটি একটি শুভ কামনা মূলক শ্লোগান। ‘৭১ সালের ২৫ মার্চের পর বর্বর পাকিস্তানিরা সমস্ত বাংলা জুড়ে বর্বরতা চালাতে থাকে। এই বর্বরতা প্রতিরোধের জন্য সেই সময় মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। মুক্তিবাহিনী অত্যাচারিত বাঙালির কাছে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় পক্ষান্তরে পাকিস্তানিরা মুক্তিবাহিনীকে দুষ্কৃতকারী বলে অভিহিত করত। এই মুক্তিবাহিনীর প্রতি নৈতিক সমর্থন দান, সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ কামনা ও দেশে বিদেশে সমর্থন বৃদ্ধির জন্য প্রবাসীদের বিভিন্ন মিছিল ও সমাবেশে এই শ্লোগানটি ব্যাপক প্রচলিত ছিল।

লং লিভ, লং লিভ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ
LONG LIVE, LONG LIVE BANGLADESH, BANGLADESH
এটি একটি শুভ কামনা মূলক শ্লোগান। বিশ্ববাসীর নিকট সদ্য ১০ এপ্রিল স্বাধীনতা ঘোষিত বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশকে পরিচিত করা, এর প্রতি প্রবাসীদের সমর্থন দান, সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ কামনা ও দেশে বিদেশে সমর্থন বৃদ্ধির জন্য প্রবাসীদের বিভিন্ন মিছিল ও সমাবেশে এই শ্লোগানটি ব্যাপক প্রচলিত ছিল। বাঙালি ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেক বিদেশীকেও তাদের বিভিন্ন পোস্টারে এই শ্লোগানটি ব্যবহার করতে দেখা যায়। ১৯৭১ সালে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল।

লড়াই
‘লড়াই’ পত্রিকাটি মুক্তাঞ্চল থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। সম্পাদক, প্রকাশক কিংবা প্রকাশনার কোন তারিখ সংগৃহীত পত্রিকাটিতে উল্লেখ নেই। পত্রিকাটির নামের নিচে ‘পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধ বুলেটিন ১’ লিখিত এবং ডান পাশের একটি বক্সে ‘ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কর-

৫৪৮

বঙ্গবন্ধু’ এইন অমোঘ বানীটি লিপিবদ্ধ ছিল। এটি একটি অনিয়মিত পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধ বুলেটিন। চার কলাম বিশিষ্ট এ পত্রিকার মূল্য দশ পয়সা। পত্রিকাটিতে যুদ্ধ, যুদ্ধের সাফল্য, অগ্রগতি ও রাজাকার সম্পর্কেই লেখা বেশি ছাপা হয়েছে। ‘বুলেটিন ১’ এর সম্পাদকীয় লেখা হয়’অস্ত্রেই আমাদের অস্তিত্ব’ নিয়ে। প্রথম পাতার শিরোনাম ‘এবার মুক্তিবাহিনী হানাদার শত্রুর উপর বিমান ও নৌ আক্রমন চালাবে’, ‘কসবায় তুমুল সংঘর্ষ’, ‘মুজিবের কিছু হলে স্বাধীনতার পরেও আমাদের যুদ্ধ চলবে’, ‘২৫০ জন খানসেনা খতম’ ছিল। ‘পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধ বুলেটিন ২’ এর প্রধান সংবাদ শিরোনাম ‘নিয়াজীর গোপন রিপোর্ট- পাক সৈন্যরা একেবারে ভেঙে পড়েছে’ ছিল।

লিবারেশন ফাইটার্স
আলমগীর কবিরের চিত্রনাট্য, রচনা ও পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ইংরেজী ভাষায় নির্মিত হয় স্বল্পদৈর্ঘের চলচ্চিত্র লিবারেশন ফাইটার্স। মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় ডকুমেন্টারিটি, মুক্তিযোদ্ধাদের শপথ গ্রহনের দৃশ্য দেখানোর মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রটির সূচনা। চলচ্চিত্রটির ব্যাপ্তি ছিল ১৯ মিনিট।

শরণার্থী
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক কর্মকান্ডকে পরিচালনা করেছে এমনি একটি ইস্যু হল শরণার্থী সমস্যা। এই শরণার্থী সমস্যার সঙ্গে ক্রমান্বয়ে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো, ভারতের রাজনৈতিক সলসমূহ, ভারত সরকার এবং এর জনগণ জড়িয়ে যায়। বিশ্বের ছোট বড় রাষ্ট্র গুলোর সরকার, জনগণ সর্বোপরি জাতিসংঘ সহ বিশ্বের বহু আন্তর্জাতিক সংগঠন নানা পর্যায়ে নানাভাবে এ সমস্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়।

বাঙালির স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি দমন করতে গিয়ে পাকিস্তানি চক্র নির্বিচারে গণহত্যা ও গণধর্ষণ বেছে নেয়। ফলে নিরীহ মানুষ নিরাপত্তা ও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত পেরিয়ে সাশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। বিশেষ করে সীমান্ত সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে। ভারত সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশ

৫৪৯

থেকে আগত শরণার্থীর সংখ্যা ৯৮,৯৯,৩০৫ জন। প্রাথমিক পর্যায়ে মানবতাবোধে তাড়িত হয়েই সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নানা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার ত্রাণসামগ্রী, অর্থ সংগ্রহ ও জনমত তৈরিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। কিন্তু ক্রম বর্ধমান শরণার্থীর স্রোত ভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
কেন্দ্রীয় উদ্বাস্তু দফতরের অতিরিক্ত সচিব কর্ণেল লুথরা ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এক সাংবাদিক সম্মেলনে উল্লেখ করেন যে, মাথাপিছু ব্যয় দৈনিক দুই টাকা করে ধরা হলে ভারতকে তাদের জন্য দৈনিক দুই কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। এসব উদ্বাস্তুর ভারে ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। তাছাড়া সাধারণ একটি সমস্যা হল বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর চাপে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়।
শরণার্থী সমস্যা যে শুধু অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করেছে তা নয়, আইনশৃংখলা পরিস্থিতি এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাও হুমকির সম্মুখীন হয়। এছাড়া সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে।
শরণার্থী শিবিরে ত্রাণসামগ্রীর অপ্রতুলতার পাশাপাশি মানবেতর জীবনযাপনের ফলে কলেরাসহ বিভিন্ন রোগ মহামারী আকার ধারণ করে। স্বাস্থ্য পরিকল্পনা মন্ত্রী উমাশংকর দীক্ষিত বলেন, ‘৪ জুন পর্যন্ত কলেরা আক্রান্তের সংখ্যা হল ৯৫০০, এরমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে ১২৫০ জন।’ অগণিত লোক স্বল্প সময়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বিশেষ করে শিশুদের অবস্থা হয়ে ওঠে অত্যন্ত হৃদয় বিদারক।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারত সরকার জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে শরণার্থীদের জন্য মানবিক সাহায্য এবং এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশ্যে আলাপ আলোচনা অব্যাহত রাখে। কেননা ভারতের মত দরিদ্র রাষ্টের পক্ষে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর প্রত্যেকের জন্য উপযুক্ত খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দুরূহ হয়ে পড়ে। ১ এপ্রিল জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন আনুষ্ঠানিকভাবে শরণার্থী বিষয়ে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলকে অবহিত করেন। এছাড়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিভিন্ন প্রতিনিধি এবং বিদেশে ভারতের দূতাবাস গুলো শরণার্থী বিষয়ে বিশ্ব জনমত প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৯ মাস ধরে ধরে পশ্চিমা পত্র পত্রিকায় শরণার্থী শিবির সম্পর্কে অনেক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।
ব্যাপক শরণার্থী ইতিমধ্যে জনবহুল ভারতে অর্থনৈতিক সমস্যা বা জাতীয় উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও উদ্বেগজনক অবস্থা সৃষ্টি করে। সীমান্তবর্তী কোন কোন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশংকা দেখা দেয়। ফলে শরণার্থী সমস্যা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য

৫৫০

হুমকি সৃষ্টি করে।
কিন্তু শরণার্থী সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য পূর্ববঙ্গে ভারতের প্রত্যাশিত ‘রাজনৈতিক সমাধান’ অর্জনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে উল্লেখযোগ্য সমর্থন পাওয়া যায়নি। এ উদ্দেশ্যে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ২২৫ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানকে সাহায্য দেয় এবং পাকিস্তান সরকারের উপর রাজনৈতিক প্রভাব আছে এমন রাষ্ট্রগুলো (বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানি) সফর করেন। কিন্তু এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা শরণার্থী বিষয়ে পশ্চিমা সরকার গুলোর দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি।
একদিকে প্রতিকূল আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে শরণার্থী সমস্যার কারণে সৃষ্ট নানা সমস্যার আশু সমাধানের ক্ষেত্রে নভেম্বর মাসে এসে ভারতের হাতে কোন বিকল্প থাকেনা, যার পরিণতি বাংলাদেশ-ভারত বনাম পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ যুদ্ধ। একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জয়লাভের পর স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে নিরাপদে, সম্মানে আর গৌরবের সঙ্গে উদ্বাস্তু জীবন ছেড়ে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পনের দুই মাসের মধ্যে ৯.৮৯ মিলিয়ন শরণার্থীর মধ্যে ৮.৭ মিলিয়ন শরণার্থী প্রত্যাবর্তন করে দেশে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সমস্ত শরণার্থীই দেশে ফিরে আসে।

৫৫১