শাহ আবদুল হামিদ
শাহ আবদুল হামিদ রংপুর জেলার গোবিন্দগঞ্জ গ্রামে ১৯০০ সালে জন্মগ্রহন করেন। ১৯২০ সালে বিএ পাশ করেন রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ তে ভর্তি হন। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এর আহবানে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। ১৯২৭ এ ওকালতি পাস করে গাইবান্ধা বার-এ যোগ দেন। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহন করেন। এরপর ১৯৩৬ সালে মুসলীম লীগে যোগ দেন। ১৯৪২ সালে রংপুর জেলা বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, ১৯৪৩-১৯৫৪ পর্যন্ত রংপুর স্কুল বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। ১৯৪৫ এ ভারতীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫১-১৯৫৫ পর্যন্ত সাবেক ন্যাশনাল ব্যাংকের কেন্দ্রীয় বোর্ডের ডিরেক্টর ছিলেন। ১৯৫৬ তে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৫৭-১৯৬৬ পর্যন্ত রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন, ১৯৬৬ সালে ছয়দফা আন্দোলনে এবং ১৯৬৯ এর গণ আন্দোলনে রংপুরে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৭০ এর নির্বাচনে রংপুর জেলা গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ি নির্বাচনী এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এর এক মাস পরেই ১ মে ১৯৭২ সালে গাইবান্ধায় মৃত্যুবরণ করেন।
শেখ মুজিবস ট্রায়াল
এই পোস্টারটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে মুজিবনগর থেকে নুরুল ইসলাম প্রকাশ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুকে যখন বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে ফাঁসির প্রস্তুতি গ্রহন করে তখন হানাদারদের এই আচরনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বিশ্বজনমত গঠনের উদ্দেশ্যে এই পোস্টারটি প্রচার করা হয়। এই পোস্টারের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান ও বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থনদানের জন্য উৎসাহিত করা হয়। এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে হবে- এই চেতনায় বলীয়ান হয়ে বাংলার বীর মুক্তিবাহিনী বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে। পোস্টারটি পাকিস্তানের কবল থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার আন্দোলন ও এই আন্দোলনের প্রতি বিশ্ব জনমত সংগঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। মূল পোস্টারটি সংগৃহীত অবস্থায় না পাওয়াতে এর আকার, রঙ নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব হলনা।
৫৬৪
শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু (১৯২০-১৯৭৫)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্মোহনী নেতা, জাতির জনক, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য (১৯৪৮)। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক (১৯৪৯), আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (১৯৫৩-১৯৬৬), সভাপতি (১৯৬৬-১৯৭৪), বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি (তাঁর অনুপস্থিতিতেই ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত), বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী (১৯৭২-১৯৭৫) এবং পুনরায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি (২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত)।
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৪ মার্চ, ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুংগীপাড়া গ্রামে। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন গোপালগঞ্জ জেলা আদালতের একজন সেরেস্তাদার। মাতা মোসাম্মাত সায়রা খাতুন। ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ম্যাট্রিক পাশ করেন। তিনি ১৯৪৪ সালে কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থীক আইএ এবং ১৯৪৭ সালে একই কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। মুজিব ১৯৪৬ সালে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তরুন বয়সেই তিনি প্রাদেশিক বেঙ্গল মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন এবং ১৯৪৩ সাল থেকেই তিনি সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপের সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। মুসলিম লীগ তাঁকে ফরিদপুর জেলায় নির্বাচনী প্রচারণা প্রধান নিযুক্ত করে।
১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠায় শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর তিনি আইন বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার প্রতি কর্তৃপক্ষের বৈষম্য মূলক আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। ফলে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়ন শেষ হয়ে ওঠেনি।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাকালে এর অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে শেখ মুজিবের দলীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের সূচনা ঘটে। একজন রাজবন্দি হিসেবে তখন তিনি ফরিদপুর জেলে অন্তরীণ ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে দলের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার আগে পর্যন্ত
৫৬৫
তিনি একই পদে বহাল ছিলেন। তঁর রাজনোইতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো মুজিবও পার্টির সংগঠন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অনুধাবন করতেন। দলকে সুসংগঠিত ও সুসংহত করার লক্ষ্যে তিনি ১৯৫৭ সালে আতাউর রহমান খানের মন্ত্রীসভা (১৯৫৬-১৯৫৮) থেকে পদত্যাগ করেন। এবং তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। একজন সংগঠক হিসেবে মুজিব দলের উপর এতোটাই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন যে, সোহরাওয়ার্দীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার এক সাহসী পদক্ষেপ গ্রহন করে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়েছিলেন। উল্লেখ্য সোহরাওয়ার্দী তখনো রাজনৈতিক দলসমূহ পুনরুজ্জীবনের পক্ষে ছিলেন না। তাঁর অবস্থান ছিল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টভুক্ত হয়ে একযোগে সকলের কাজ করা।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে পূর্ববাংলা আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটে। তিনি পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংবিধান সভা -কাম-আইন্সভার সদস্য ছিলেনশেখ মুজিব ছিলেন একজন বাস্তববাদী রাজনীতিক। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকেই তাঁকে বাঙালিদের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে এক অকুতোভয় সেনানীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। ভাষা আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দিদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ১৯৬০ এর দশকের প্রথম ভাগে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। উপদলীয় কোন্দল বা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে আওয়ামী লীগে ভাঙন সৃষ্টি কিংবা নেতৃস্থানীয় কারো কারো দলত্যাগ সত্ত্বেও নিজস্ব সাংগঠনিক দক্ষতার গুণে তিনি এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। তিনি আওয়ামী লীগকে মজবুত ভিত্তির উপর পুনর্গঠিত করে রাজনৈতিকভাবে একে একটি দক্ষ প্রতিষ্ঠানে রূপ দেন। ১৯৬৬ সালে তিনি তাঁর বিখ্যাত ছয়দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন। ছয়দফাকে আখ্যায়িত করা হয়েছিল আমাদের ‘বাঁচার দাবি’ হিসেবে, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের স্ব-শাসন প্রতিষ্ঠাকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ধরা হয়েছিল। ছয়দফা কর্মসূচি পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের মর্মমূলে সুনির্দিষ্ট আঘাত হানতে পারায় তা অতি দ্রুত গোটা জাতির মনোযোগ আকর্ষণ করে। ছয়দফা কর্মসূচির ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর রক্ষণশীল অংশের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ছড়িয়ে পড়লেও এদেশের তরুন প্রজন্ম বিশেষ করে ছাত্র, যুবক এবং শ্রমিক জনগোষ্ঠী এটিকে তাৎক্ষণিক ভাবে গ্রহন করে জাগ্রত হতে থাকে।
শেখ মুজিবের বৈপ্লবিক রাজনৈতিক অবস্থানে ভীত সন্ত্রস্ত আইয়ুব সরকার তাঁকে কারারুদ্ধ করে রাখার নীতি গ্রহন করে। ১৯৬৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে একটি রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করা হয়। আইয়ুব শাসনামলের অধিকাংশ সময়ই (প্রথমে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত
৫৬৬
এবং পরে ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত) মুজিব কারারুদ্ধ ছিলেন। দ্বিতীয় দফায় অন্তরীণ থাকা অবস্থায় মুজিবের জনপ্রিয়তা ও সম্মোহনী নেতৃত্ব এতোটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে, ১৯৬৯ সালের প্রথম ভাগে এক প্রবল বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে এবং ‘৬৯ এর ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব সরকার তাঁকে বিনাশর্তে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তাঁর কারামুক্তির পরের দিন সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ রমনা রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে মুজিবের সম্মানে ছাত্র জনতা এক বিশাল সংবর্ধনার আয়োজন করে এবং উক্ত সমাবেশে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ (বাংলা বা বাঙালির বন্ধু” খেতাবে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ভিতরে তারা এক অবিসংবাদী নেতৃত্ব খুঁজে পান যিনি পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলের মধ্যে প্রায় ১২ বছর সময়কাল কারাযন্ত্রণ ভোগ করেন। ১২ বছরের কারাজীবন ও ১০ বছর ধরে নিরাপত্তারক্ষীদের শ্যেনদৃষ্টির মধ্যে মুজিবের জন্য পাকিস্তান মুক্ত রাষ্ট্র নয়, বরং ছিল একটি বিশাল বন্দিশালা।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান মুখপাত্রের স্বীকৃতি লাভ করে। তঁর ঘোষিত ছয়দফা দাবির পক্ষে জনগণ নিরংকুশ রায় দেয়। এরপর ছিল ছয়দফা দাবি বাস্তবায়নের পালা। চয়দপফা দাবি আদায়ের ব্যাপারে মুজিব এতোটাই দৃঢ় সংকল্প ছিলেন যে, ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সকল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের রমনা রেসকোর্স ময়দানে একটি ভাবগম্ভীর পরিবেশে এই মর্মে দৃঢ় শপথবাক্য পাঠ করান যে, পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে কোনমতেই ৬ দফা দাবির বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবেনা। ছয়দফা কর্মসূচির ব্যাপারে মুজিবের আপসহীন ও অনড় অবস্থানের কারনে জুলফিকার আকলি ভুট্টো এবং ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা কঠোর মনোভাব গ্রহন করে। বঙ্গবন্ধু সরকার গঠনের সুযোগ দানের পরিবর্তে তারা জনগণের রায়কে পদদলিত করার দৃঢ় সংকল্প নেয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফা বাতিল করে দেয়। এর মধ্যে দিয়েই পাকিস্তানের মৃত্যু ঘন্টা বেজে ওঠে। পুরো প্রদেশ বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে (২-২৫ মার্চ, ১৯৭১) পূর্ব পাকিস্তানের সকল স্তরের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এবং তিনিই পরিণত হন সরকারের কার্যত প্রধানে।
এই সময়ে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার এক সুবিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধু মুজিব তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যা বাঙালি জাতির ইতিহাস পঞ্জিতে এক যুগান্তকারী অধ্যায় হয়ে আছে। শাএখ মুজিব তাঁর এই ভাষণে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে ব্যর্থতার জন্য সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করেন। ভাষণের শেষাংশে তিনি উদাত্ত আহবান জানান, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই
৫৬৭
নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে . . . মনে রাখবা আমরা অনেক রক্ত দিয়েছি, প্রয়োজন হলে আরো রক্ত দেব, তবু এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। . . . এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বধীনতার সংগ্রাম।’
ইতিমধ্যে ৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতাকে সাথে নিয়ে শেখ মুজিব ও তাঁর দলের সাথে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। পরের দিন থেকে আলোচনা শুরু হয় এবং তা বিরামহীন ভাবে ২৪ মার্চ সকাল পর্যন্ত চলতে থাকে। এ সময়ে অসহযোগ আন্দোলন এবং জনগণের সর্বাত্মক স্বতঃস্ফূর্ত হরতালের কর্মসূচি কঠোরভাবে অব্যাহত থাকে। ছাত্ররা এবং বিভিওন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ২ মার্চ থেকে স্বধীনতা ঘোষণা করার কথা ব্যক্ত করতে থাকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় তাদের বর্বরোচিত হামলা চালায়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে রাখা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি হবার পূর্বে বঙ্গবন্ধু সরাসরি পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, যা ওয়্যারলেস ও অন্যান্য মাধ্যমযোগে সারাদেশে পৌঁছে দেওয়া হয়। তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং জনগণকে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়।
২৫ মার্চের পর থেকে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি ছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে গঠিত মুজিবনগর সরকারে তাঁকেই প্রেসিডেন্ট ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও নেতৃত্বদানের লক্ষ্যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঐস সরকার গঠিত হয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি)। পুরো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শেখ মুজিবের সম্মোহনী নেতৃত্ব জাতীয় ঐক্য, সংহতি, এবং শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করেছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিউ দখলদারিত্ব থেকে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পান এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি লন্ডন হয়ে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন।
স্বাধীনতা উত্তর কালে বঙ্গবন্ধু প্রায় সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশ সরকারের প্রধান হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সরকারকে অত্যন্ত প্রতিকূল এবং বিধ্বস্ত অবস্থার মধ্যে কাজ করতে হয়। কোটি কোটি জন অধ্যুষিত যুদ্ধবিধ্বস্ত বিশৃংখল একটি দেশের অসংখ্য সমস্যা নিয়ে তাঁকে শূন্য হাতে দেশ পরিচালনার কাজ শুরু করতে হয়েছিল। তাঁর সরকারকে আইনশৃংখলা ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনির্বাসন এবং তাঁদের জন্য দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি,
৫৬৮
বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন, জনগণের রুদ্র রোষ থেকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের জীবন রক্ষা, উগ্র বামপন্থী শক্তির সমস্ত তৎপরতা মোকাবেলা এবং অসংখ্য অনাহারি ক্ষুধার্ত মানুষের অন্ন যোগানো সহ অন্যান্য কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তিনি আইনশৃংখলা ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দেশজুড়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের লক্ষ্যে রক্ষীবাহিনী গঠন করেছিলেন। তঁর এই পদক্ষেপ কার্যত ব্যররথ হয়, সর্বত্র দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছিল। এর উপর দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ, যাতে বহুসংখ্যক লোক মারা যায়। দ্বিধাগ্রস্ত এবং বিচলিত মুজিব তাঁর সম্মোহনী নেতৃত্বের উপর ভরসা করে একদলীয় ব্যবস্থা ‘বাকশাল’ গতঠনের মাধ্যমে তাঁর ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ এর কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং স্থানীয় প্রসাশনে জেলা গভর্ণরব্যবস্থা চালু করেন। কিন্তু তাঁর এসব পদক্ষেপ তাঁকে জনগণ এবং তাঁর নিজের দল থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এই দ্বিধান্বিত অবস্থা ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী সদস্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে। অবসান ঘটে জাতির জনকের সুদীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য সংগ্রামী এক রাজনৈতিক জীবনের।
শেখ মুজিবের বিচার, বঙ্গবন্ধু
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার এর উদ্যোগ নানামুখী ঘাত প্রতিঘাতের জন্ম দেয়। তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় মুজিবনগর সরকার, ভারত সরকার ও সমকালীন বৈশ্বিক রাজনীতিতে। শেখ মুজিব তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহুবছর কারান্তরালে কাটিয়েছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামী হিসেবে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু একাত্তরের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন, নানা শর্তসাপেক্ষে শেখ মুজিবের বিচারের আয়োজনে জেনারেল ইয়াহিয়া তার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যটি আড়াল করতে পারেননি। তথাকথিত প্রহসনের বিচারের অন্তিম লক্ষ্য ছিল একটি আইনি আবরণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূর্ত প্রতীক, প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার মনে তীব্র দেশপ্রেম আর পাকবাহিনীর প্রতি জিঘাংসা-সঞ্চারকারী নেতা মুজিবকে হত্যা করা।
জেনারেল ইয়াহিয়া আগস্ট মাসের শুরুর দিকে পাকিস্তান টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিশিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, পাকিস্তানের আইন অনুযায়ী পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে তাঁর বিচার করা হবে। ৯ আগস্ট প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের হেডকোয়ার্টার থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং অন্যান্য অপরাধের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের
৫৬৯
প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। ১১ আগস্ট বিচার শুরু হবে এবং কার্যবিবরণী গোপন রাখা হবে।
পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী ১১ আগস্ট রাওয়াল পিন্ডি থেকে ২৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম পাঞ্জাবের শিল্পনগরী লায়ালপুরের শহরতলির এক জেলে বিচার বসে। ঐদিনই মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের পরামর্শে বিচার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। মূলত ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের প্রেক্ষাপটে সংকটের রাজনৈতিক সমাধান অনুসন্ধানের লক্ষ্যে মার্কিন সরকার মুজিবের বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলে।
প্রায় সপ্তাহ চারেক মুলতবি রাখার পর ৭ সেপ্টেম্বর গোপন সামরিক আদালতে আবার বিচার শুরু হয়। পাকিস্তানের সাবেক আইনমন্ত্রী একে ব্রোহীসহ তিনজনকে বঙ্গবন্ধুর কৌঁসুলি হিসেবে পাকিস্তান সরকার নিয়োগ করে। মামলা চলাকালে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার উদ্দেশ্যে সরকার পক্ষে ১০৫ জন সাক্ষীর তালিকা জমা দেয়। ঢাকা থেকে ৭ জন বাঙালি ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে আসা হয়।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র, পাকিস্তানের সশস্ত্র ফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এমনি অস্পষ্ট, অনির্দিষ্ট অভিযোগ গুলো বারোটি ভাগে বিভিক্ত ছিল। এর মধ্যে ছয়টির শাস্তি ফাঁসি অথবা ফায়ারিং স্কোয়াডে প্রেরণ।
প্রায় চারমাস বিচারকার্য চলার পর ৩ ডিসেম্বর আদালতের কার্যক্রম শেষে শেখ মুজিব কে মৃত্যুদন্ড প্রদান করে সামরিক ট্রাইব্যুনাল, ইয়াহিয়ার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ভারত সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা ও মার্কিন বাধার কারণে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে না পারার ব্যর্থতা নিয়েই তাকে পরাজয়ের গ্লানিসহ ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে লন্ডন, নয়াদিল্লী হয়ে স্বাধীন মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন মুক্ত মুজিব, বাংলাদেশের স্থপতি।
শেখ মুজিবের, শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, মুক্তি চাই
বাংলার মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বন্দী হন। পশ্চিম পাকিস্তানের অন্ধ কারাগারে তাঁকে বন্দি রাখা হয়। এরই মধ্যে তাঁর বিচারের নামে প্রহসন শুরু হয়। বাঙালির গণমানুষের নেতা শেখ মুজিবকে মৃত্যুদন্ড দেবার পাঁয়তারা করা হয়। সংগ্রামী বাঙালিরা এর বিরুদ্ধে ফুঁসে
৫৭০
ওঠে। তারা ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। তাদের শোভাযাত্রা ও সমাবেশে এই শ্লোগানটি ব্যাপক ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এর ফলে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবির প্রতি বিদেশীদের ব্যাপক মসমর্থন পাওয়া সহজ হয়।
শ্বেতপত্র
[৫ আগস্ট, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রকাশিত]
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ব মূহুর্তের ঘটনাবলী এবং যুদ্ধমধ্যকার ঘটনাবলী সম্বন্ধে পাকিস্তান সরকার ৫ নাগস্ট ১৯৭১ এ একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল। এই শ্বেতপত্রে একপক্ষে পাকিস্তান রাষ্ট্র তার হত্যা এবং অপরাধের যুক্তি তৈরি করার চেষ্টা করেছে এবং অন্যপক্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধের কেন্দ্রে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অবস্থান এবং বাঙালি জনসাধারনের প্রধান পুরুষ শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা স্বীকার করেছে। প্রথমটি হচ্ছে গণহত্যার সাফাই এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধ যে আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে এবং এই কেন্দ্রের ভিত্তিমূল যে শেখ মুজিবুর রহমান তার স্বীকৃতি। সেজন্য এই শ্বেতপত্রটি হচ্ছে এক অর্থে মিথ্যা ও ঘটনা বিকৃতির দলিল, অন্য অর্থে মিথ্যা ও বিকৃতির মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনার অবদমন সত্ত্বেও সত্যের বিস্ফোরণ। সত্য ফিরে আসে ইতিহাসে এভাবে এবং এই পথ ধরে স্বাধীনতার ইতিহাসের ভিন্ন নির্মান সম্ভব। হত্যাকারীদের দরকার পাকিস্তান সরকারের এই শ্বেতপত্র তাদের অপরাধের সাফাইয়ের জন্য, আর হত্যার যারা বিরোধী, আমাদের দরকার বেঁচে থাকার জন্য সত্যি ইতিহাস। এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের ক্ষেত্রে কোন আপস নেই।
ভূমিকা
এই শ্বেতপত্র পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সংকটের ঘটনবাবলীর সর্বপ্রথম পূর্ণ বিবরণ। আওয়ামী লীগ নেতাদের মনোভাবের দরুন নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা একটি ফেডারেল শাসনতন্ত্রের মূল বিষয়সমূহের ব্যাপারে একটি মতৈক্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে এই সংকটের উদ্ভব হয়। আওয়ামী লীগ নেতারা স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে জনগণের রায়কে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে পরিবর্তিত করার প্রয়াস পান। এসব ঘটনার প্রতি বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। অবশ্য এ পর্যন্ত বিশ্বকে অসম্পূর্ণ এবং পক্ষপাতদুষ্ট তথ্যই সরবরাহ করা হয়েছে। এই শ্বেতপত্রে সেইসব ঘটনার বিস্তারিত পটভূমিকা দেওয়া হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকে খন্ড বিখন্ড করার উদ্দেশ্যে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহের রূপ নেয়।
পূর্ব পাকিস্তান সংকট হৃদয়াঙ্গম করার জন্য অপরিহার্য মূল বিষয় গুলো হচ্ছেঃ
১. ১৯৭০ সালের আইন কাঠামো আদেশের ভিত্তিতেই পাকিস্তানের সাম্প্রতিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ সহ সব রাজনৈতিক দলই এই
৫৭১
আইন কাঠামো আদেশ গ্রহন করেছিলেন। এই আদেশ থেকে সন্দেহাতীত ভাবে বোঝা যায় যে, পাকিস্তানের সংহতি ও অখন্ডতা হচ্ছে যেকোন ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৌলিক পূর্বশর্ত।
২. ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ফেডারেল সরকার যে ব্যবস্থা শুরু করেন তার লক্ষ্য ছিল আইনশৃংখলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, কারণ আওয়ামী লীগের ‘অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময় আইনশৃংখলা কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছিল। এই সময়ে যে গোলযোগ এবং নৃশংস কার্যকলাপ চালানো হয়েই শ্বেতপত্রে তা বিবৃত করা হয়েছে।
৩. হিন্দুস্তান হস্তক্ষেপ না করলে এবং প্ররোচণা না যোগালে পরিস্থিতি বেশ শিগগিরই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেত।
ষোল ডিসেম্বর
ষোল ডিসেম্বর বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বাংলাদেশ ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পন করে। বাংলাদেশের মাটিতে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পনের এই দিনিটিকে ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (পূর্বতন রমনা রেসকোর্স) পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পনের এই অনুষ্ঠান ঘটে। আত্মসমর্পনের দলিলে স্বাক্ষর করেন পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের লে. জে. আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী। বিজয়ী যৌথ বাহিনীর পক্ষে দলিলে স্বাক্ষর করেন ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক ও যৌথ বাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন পরাজিত পাকিস্তান বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল জামশেদ সহ আরো অনেকে।
বিকেল ৫ টা ৫ মিনিটে (১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানিদের ঐতিহাসিক পরাজয়ের দলিলে তার স্বাক্ষর দান করেন পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজী। সমাপ্তি ঘটে পাকিস্তানি বর্বরতার একটি অধ্যায়ের। গোটা বাংলাদেশ আনন্দে ফেটে পড়ে। ঢাকাসহ দেশের প্রতি অঞ্চলে বিজয় মিছিল শুরু হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারপাশে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়ে ‘জয়বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে বাতাস উদ্বেলিত করে তোলে।
আত্মসমর্পনের ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন
৫৭২
সেদিনকার এয়ার কমোডর এবং মুক্তিবাহিনীর সহ অধিনায়ক এ কে খন্দকার। আরো উপস্থিত ছিলেন কাদেস্রিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম, মেজর হায়দার এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আবু ইউসুফ খান, বীর বিক্রম। আত্মসমর্পনের দলিলে নিয়াজীর স্বাক্ষর দানের পর ১০০ জন পাকিস্তানি অফিসার ও বিভিন্ন স্তরের সৈনিক পরাজয়ের প্রতীক হিসেবে তাদের অস্ত্র মাটিতে নামিয়ে রাখে। ঐতিহাসিক এই অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন। ভারতীয় মিত্র বাহিনীর মেজর জেনারেল স্বগত সিং, মেজর জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার সান সিং এবং ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার।
ষোড়শ বাহিনী
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বাংলাদেশ ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে। এই ঐতিহাসিক আত্মসমর্পনের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের সামরিক তৎপরতা। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর ১০৭১ এর পর হঠাৎ করেই মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়, বিশেষত ঢাকাসহ নানা শহরাঞ্চলে রাতারাতি কিছু উচ্ছৃংখল যুবকের আবির্ভাব ঘটে। এরা মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সাধারণ মানুষকে নির্যাতন করতে থাকে, সামাজিক অস্থিরতা ও নানাবিধ বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে থাকে। এই নব্য মুক্তিযোদ্ধা বা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করা হয় ‘সিক্সটিন্থ ডিভিশন’ বা ‘ষোড়ষ বাহিনী’ হিসেবে। এই ‘ষোড়ষ বাহিনী’র সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালে জীবন বাজি রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের সুনাম বিনষ্ট করতে তৎপর হয়। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি ও নিজেদের লাভের জন্য প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ভাঙিয়ে এরা নানা সামাজিক অনাচারের কারণ হয়। অনেকে সন্দেহ করে থাকেন, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি সুকৌশলে এক শ্রেনীর যুবককে এই ‘ষোড়শ বাহিনী’তে অন্তর্ভুক্ত করেছিল।
সংগ্রামী বাংলা (১)
‘সংগ্রামী বাংলা পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন। প্রধান সম্পাদক আব্দুর রহমান সিদ্দিক এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ আব্দুল মতিন ছিলেন। পত্রিকাটি বাংলাদেশের মুখপত্র ছিল বলে পত্রিকায় উল্লেখ করা হয় এবং এটি সংগ্রামী বাংলাদেশ প্রেস ঢাকা হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হত। প্রকাশ ও মুদ্রণে ছিল আব্দুর রহমান সিদ্দিক। পত্রিকাটির রেজিস্ট্রেশন নং- ২২
৫৭৩
কলামসংখ্যা ৩, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৪ এবং বিক্রয়মূল্য ২০ পয়সা ছিল। ১৮ অক্টোবর, ১৯৭১ (৩১ আশ্বিন ১৩৭৮, সোমবার) বিপ্লবী আলী আসাদ সংখ্যা হিসেবে পত্রিকাটি প্রকাশ পায়। আলী আসাদ ১৯৫৯ সালের দিকে গঠিত পূর্ববাংলা লিবারেশন ফ্রন্টের নেতৃস্থানীয় কর্মী ছিলেন এবং তার নামেই পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা উৎসর্গ করা হয়। ঈদ বিশেষ সংখ্যা ২৩ নভেম্বর, ১৯৭১ এবং বিপ্লবী ফজলুর রহমান সংখ্যা ২৭ নভেম্বর ১৯৭১ (৯ অঘ্রাণ ১৩৭৮, শনিবার) বের হয়। অনিয়মিত হলেও পত্রিকাটির বেশ কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিবন্ধাদি প্রকাশ করে।
সংগ্রামী বাংলা (২) মুক্তিযুদ্ধের খবর জনগণের কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্যে অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম, এমপির উপদেশ ও পৃষ্ঠপোষকতায় এ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। সম্পাদক ছিলেন মোহাম্মদ ইমদাদুল হক। সংগ্রামী বাংলা প্রেস তেঁতুলিয়া হতে এমদাদুল হক কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত। পত্রিকার বিনিময় মূল্য ১০ পয়সা, পৃষ্ঠাসংখ্যা ২ এবং কলামসংখ্যা চার এবং ছাপা ঝকঝকে ছিল। প্রথম প্রকাশ ও শেষ সংখ্যা কবে প্রকাশিত হয়, জানা যায়নি। তবে বিশেষ ঈদ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হয় ‘এবারের ঈদকে আমরা বরণ করেছি ঈদ মোবারক হিসেবে নয় বরং সংগ্রামী ঈদ হিসেবে। … বাংলার বুকে ঈদগাহে আজ মানুষ নেই কারণ পশুর সাথে মানুষেরা একত্রে নামায পড়তে পারিনা।’ ৮ম সংখ্যা, ৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ প্রকাশিত প্রথম পাতার প্রধান সংবাদ শিরোনাম ‘বিভিন্ন এলাকা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশের স্বীকৃতি ঐ নতুনের কেতন ওড়ে’ এবং সম্পাদকীয় ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি’ লেখা প্রকাশ পায়।
সদাজাগ্রত/বাংলার/মুক্তিবাহিনী
৭৫x৫০ সেন্টিমিটার পরিমাপের পোস্টারটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতরের পক্ষ থেকে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়। পোস্টারটির অংকন শিল্পী ছিলেন নিতিন কুন্ডু। প্রতিরোধের দীপ্ত চেতনায় উদ্ভাসিত, সদা-সতর্কদৃষ্টি, বেয়নেট সহ রাইফেল উঁচিয়ে আবক্ষ এক মুক্তিযোদ্ধার ছবি এই পোস্টারে দৃশ্যমান। ‘৭১ এর মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় কিন্তু এই সময় বাঙালিদের যুদ্ধ করার মত তেমন কোন প্রস্তুতি ছিলনা। ফলে যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে শত্রুর আক্রমনের বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুললেও মে মাসের পর থেকে মুক্তিবাহিনী কিছুটা পশ্চাদপসরণ করে। সেই সময় হানাদার বাহিনীর সাথে তাদের
৫৭৪
তাঁবেদার রাজাকার, আলবদর, আল শামস সহ সকল স্বাধীনতা বিরোধী বাঙালিদের ওপর অত্যাচার বাড়িয়ে দেয়। অবরুদ্ধ বাংলায় তখন এক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। মনে হচ্ছিল মুক্তি বাহিনী বোধ হয় হানাদার বাহিনীর কাছে পরাজিত হতে চলেছে এবং এই বিষয়ে তারা মিথ্যা প্রচারণারও আশ্রয় নেয়। এই সময় প্রকাশিত এই পোস্টারটি বাঙালির মনে আশার সঞ্চার করে। বাঙালি বুঝতে পারে মুক্তিবাহিনী তাদের পাশেই আছে। এই দেশকে, বাঙালিকে, পাকিস্তানিদের হাত থেকে উদ্ধারের জন্য বাংলার মুক্তিবাহিনী সদা জাগ্রত, সচেষ্ট। এই পোস্টারটিতে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে দাঁড়ায় তা হল বাংলার স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে মুক্তিবাহিনীর সর্বদা অকুতোভয় অজেয়, অতএব বাঙালিরা নিশ্চিন্তে, নির্ভয়ে থাকতে পারে। পোস্টারটিতে মূলত মনস্তাত্ত্বিক শক্তি বৃদ্ধির প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। এই পোস্টারটিতে সাদা, কালো ও কমলা রঙের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। মুক্তিবাহিনী হল দুঃখের অমানিশায় শান্তির বানী নিয়ে ভোরের সূর্যের মতোই। শান্তি বোঝাতে সাদা, অমানিশা ও ভোরের সূর্য বোঝাতে কালো ও কমলা রঙের ব্যবহার হয়েছে।
৭ মার্চ, ১৯৭১
৭ মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসের মাইলফলক। এক অর্থে বলা যেতে পারে, সেদিনই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা [দ্র. ৭ মার্চের ভাষণ] দিয়েছিলেন, বাংলাদেশে আর কোন জনসভায় এত মানুষ হয়নি। তাঁর কোন বক্তৃতা শোনার জন্য এত মানুষ উন্মুখ হয়ে থাকেনি। সেদিন যেন পুরো ঢাকা শহর জমায়েত হয়েছে রেসকোর্সে। রেসকোর্সের একদিকে শ্লোগান- ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, তো অন্যদিকে- ‘পাঞ্জাব না বাংলা- বাংলা বাংলা’ হয়ত মাঝখানে ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা’ তো অন্য কোথাও- ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’। মঞ্চের সামনে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাঙালেধ স্বাধীন করো’। কিন্তু যখনই কেউ বলে ওঠে, ‘জয়বাংলা’ তখনি নদীর ঢেউয়ের মত সেই ধ্বনি ছড়িয়ে যেতে থাকে আর চারদিকে কাঁপিয়ে সেই অমোঘ শব্দটি উচ্চারিত হয়- ‘জয়বাংলা’।
দুপুর তিনটার মধ্যে লোকে লোকারণ্য। রেডিও পাকিস্তান ও পাকিস্তান টেলিভিশন এখনকার মত তখনো ছিল সরকারি। শেখ মুজিব জেনেশুনেই বলেছিলেন’মনে রাখবেন, রেডিও টেলিভিশনের কর্মচারিরা যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনেন তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেননা।’
রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র ৭ মার্চের ভাষণ প্রচারের বন্দোবস্ত করল। পাকিস্তানি সেনা অফিসার সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, ‘রেডিওর ঘোষকরা আগে
৫৭৫
থেকেই রেসকোর্স থেকে ইস্পাতদৃঢ় লক্ষ দর্শকের নজিরবিহীন উদ্দীপনার কথা প্রচার করতে শুরু করল’। সালিক আরো লিখেছেন, ‘এই ব্যাপারে সামরিক আইন প্রশাসকের দফতর হস্তক্ষেপ করে এই বাজে ব্যাপারটি বন্ধের নির্দেশ দিল। সালিকও তা রেডিও কর্তৃপক্ষকে জানালেন। আদেশটি শুনে টেলিফোনের অপর প্রান্তে বাঙালি অফিসারটি বললেন, ‘আমরা যদি সাড়ে সাত কোটি জনগণের কন্ঠ প্রচার করতে না পারি তাহলে আমরা কাজই করব না।’ এই কথার সাথে সাথে বেতার কেন্দ্র নীরব হয়ে গেল। বাঙালি সেসময় এধরনের সাহস দেখানোর ক্ষমতা দেখিয়েছিল। কারণ তারা শেখ মুজিবের উপর এই বিশ্বাস স্থাপন করেছিল যে তিনি বিশ্বাস ভঙ্গ করবেন না। রেডিওতে ভাষণটি অবশেষে প্রচারিত হয়েছিল।
শেখ মুজিব এসে মঞ্চে উঠলেন। সারা রেসকোর্স কাঁপিয়ে ঝড়ো হাওয়ার মত সেই শব্দটি বয়ে গেল- ‘জয়বাংলা!’
মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীরোত্তম লিখেছেন, ‘কি যে মধুমাখা ছিল এই শ্লোগানে! এই ঐন্দ্রজালিক শক্তির পরিধি নিরূপনের ক্ষমতা বুঝি কারো নেই।’ গণ অভ্যুত্থানের সময় এবং যুদ্ধকালে এ শ্লোগান বাঙালি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। জীবন বাজি রেখে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে এই উক্তি যে উদ্দীপনা যোগাত তার তুলনা নেই। তাই ‘জয়বাংলা’ জয়ধ্বনি আমাদের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ঐ দিনের রেসকোর্সের জনসভার একটি চিত্র ও মানুষের আবেগের পরিচয় পাওয়া যায় রশীদ হায়দারের একটি বিবরণে। বিবরণটি খানিকটা দীর্ঘ কিন্তু যারা ৭ মার্চ দেখেনি তাদের বোঝার জন্যে এটি প্রয়োজন।
“লাল সূর্যের মধ্যে বাংলাদেশের মানচিত্র সংবলিত গাঢ় সবুজ রঙের পতাকা হাতে হাতে উড়ছে হাজারে হাজারে, বড় পতাকাটি উড়ছে বঙ্গবন্ধু যেখানে ভাষণ দেবেন ঠিক তার উপরে।
এই সভায় অসংখ্য মহিলা এসেছেন হাতে বাঁশের লাঠি নিয়ে। বহু লোক এসেছেন তীর ধনুক নিয়ে। যেন যুদ্ধ আসন্ন। মানুষ কতোটা মরিয়া হয়ে উঠেছে এই দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যাবে- সে সময় প্ল্যান্ট প্রটেকশনের একটি বিমান জনসভার বেশ ওপর দিয়ে উড়ে যায়। লোক ঐটাতেই শত্রু সৈন্য আছে ভেবে কেউ কেউ লাঠি ছুড়ে মারে, কারো কারো অনুমান ওটাতে টিক্কা খান আছে।
দেখা গেল মেয়েদের ভিড়ে একজন অশিক্ষিত মেয়ে মনোয়ারা বিবি নিজের রচিত গান গাইছেঃ ‘মরি, হায়রে হায়। দুঃখের সীমা নাই। সোবার বাংলা শ্মশান হইল পরান ফাইডা যায়’; দেশাত্মবোধক ভাটিয়ালি গানও শোনায় মনোয়ারা বিবি, দেখা যায় গত কয়েকদিনের দুঃখজনক ঘটনাসংবলিত হাতে লেখা পত্রিকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কলেজের ছাত্রসৈয়দ আজিজুল হক, দেখা গেল বাপের কাঁধে দুই-
৫৭৬
তিন বছরের শিশু বিশাল জনসমাবেশ দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।
বঙ্গবন্ধু মঞ্চে ওঠেন। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি আর কালো মুজিব কোট পরনে। আমরা যারা টিএসসির মোড়ে তারা দূর থেকে ঝাপসা একটা অবয়ব দেখি। সভায় কোন আনুষ্ঠানিকতা নেই। কালো ভারি ফ্রেমের চশমাটি খুলে রাখলেন ঢালু টেবিলের উপরে। শান্ত গম্ভীর কন্ঠে বললেন, “ভায়েরা আমার! আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন, সবই বোঝেন।”
উনিশ মিনিটের ভাষণ, লিখিত নয়। কিন্তু একবারো থমকাতে হয়নি। পরে বিবিসির ভিডিওতে ক্লোজআপে দেখেছি আবেগে কাঁপছে তাঁর মুখ, কিন্তু সমস্ত অবয়বে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ। বোঝা যায় তিনি পিছোবেন না।
৭ মার্চ যিনি রেসকোর্সে ছিলেন না, তাকে বোঝানো যাবেনা ৭ মার্চ কী ছিল বাংলাদেশের জন্য। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ বাঙালি মাত্রই জানেন। এই ভাষণের প্রতিটি উক্তিই উদ্ধৃতিযোগ্য। কিন্তু, মূল বক্তব্যটি ছিল- “আর তোমরা গুলি করবার চেষ্টা করোনা, সাতকোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবানা। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।” সবশেষে বললেন, যা শোনার জন্য উন্মুখ ছিল বাংলাদেশ- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
কঠিন সংকটে এত ভারসাম্যপূর্ণ অথচ আবেগময় বক্তৃতার সংখ্যা বিরল। কীভাবে তিনি তা পেরেছিলেন আজ ভাবলে অবাক লাগে। পাকিস্তানি সৈনিক সিদ্দিক সালিক লিখেছেন-
“বক্তৃতার শেষ দিকে তিনি জনগণকে শান্ত এবং অহিংস থাকার উপদেশ দিলেন। যে জনতা সাগরের ঢেউয়ের মত প্রচন্ড আবেগ নিয়ে রেসকোর্সে ভেঙে পড়েছিল, ভাটার টান ধরা জোয়ারের মত তারা ঘরে ফিরে চলল। তাদের ধর্মীয় কোন জনসমাবেশ তথা মসজিদ কিংবা গীর্জা থেকে ফিরে আসা জনতার ঢলের মতোই দেখাচ্ছিল এবং ফিরে আসছে তারা সন্তুষ্ট চিত্তে-ঐশীবানী বুকে ধরে। তাদের বুকের ভিতরকার সেই আগুণ যেন থিতিয়ে গেছে। ইচ্ছা করলে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমনের উদ্দেশ্যে সেই আগুণকে ধাবিত করা যেত। আমাদের অনেকেরই আশংকা এরকমই ছিল। এই বক্তৃতা সামরিক আইন সদর দফতরে স্বস্তির বাতাস বইয়ে দিল। সদর দফতর থেকে টেলিফোনে কথোপকথন কালে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান যে, এখন সামরিক আইন প্রশাসক বলেছেন, এই পরিস্থিতিতে এটাই সবচেয়ে উত্তম ভাষণ।”
অনেকে হতাশও হয়েছিলেন। যেমন, তৎকালীন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটির সদস্য রাশেদ খান মেনন ড. মোহাম্মদ হান্নান কে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আন্ডারগ্রাউন্ড অবস্থায় থেকেও আমরা এদিন রেসকোর্সের জনসভায়
৫৭৭
শেখ মুজিবের ভাষণ শুনতে গিয়েছিলাম। সারা শহরে রটে গিয়েছিল যে, শেখ মুজিব আজ স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন এবং বড় ধরনের একটা ঘটনা আজ ঘটবে। কিন্তু আমরা হতাশ হয়ে ফিরে আসি।”
তবে, এ ধরনের হতাশ হওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল কম। কম-বেশি সবাই খুশি হয়েছিলেন। ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছিল এরকম- সামরিক জান্তা যদি দাবি মেনে নেয় ভালো। নাহলে আমরা স্বাধীন হয়ে যাব। এর কোন বিকল্প নেই। মানসিকভাবে স্বাধীনতার জন্য মানুষ প্রস্তুত হবার সময় পেয়েছিল। চারিদিকে প্রস্তুতিমূলক তৎপরতা শুরু হয়েছিল। আন্দোলনে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি এবং এই ভাষণ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছিল।
বিএনপির স্বপ্নদ্রষ্টা জিয়াউর রহমান লিখেছিলেন, “৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক ‘গ্রিন সিগন্যাল’ বলে মনে হল। আমরা আমদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোন ব্যক্তিকে তা জানালাম না। বাঙালি ও পাকিস্তানি সৈনিকদের মাঝে উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠেছিল।”
মইদুল হাসান লিখেছেন, “সম্ভবত তিন সপ্তাহাধিক কালের অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ারে বাংলার সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনায় এমন এক মৌল রূপান্তর ঘটে যে পাকিস্তানিদের নৃশংস গণহত্যা শুরুর সাথে সাথে বাংলার স্বাধীনতাই তাদের জন্য হয়ে ওঠে অভিন্ন ও একমাত্র লক্ষ্য। পাকিস্তানি আক্রমনের সাথে সাথে অধিকাংশ মানুষের কাছে শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ঘোষণা হয়ে ওঠে এক অভ্রান্ত পদনির্দেশ।”
এ ভাষণের পর শুধু ঢাকা শহর নয়, পুরো দেশটি বদলে যায়। বাষ্পেভরা পাত্রের মত টগবগ করতে থাকে ৭ কোটি মানুষ। জোরদার হয়ে ওঠে অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়। শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশই হয়ে ওঠে সরকারি নির্দেশ। মানুষ তা মানতে থাকে। এমনকি সরকারি প্রশাসনও। লিখেছেন ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, “১৯৭১ এর মার্চ মাসের অসহযোগ প্রতিরোধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি হয়েছে। অসহযোগ আন্দোলনের লক্ষ্য পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামো প্রত্যাখান। পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামো প্রত্যাখানের মধ্যে দিয়ে এই প্রতিরোধের সূত্রপাত। শেখ মুজিবুর রহমান একটি সামগ্রিক রাজনৈতিক কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে এই প্রতিরোধকে একটি রাষ্ট্র গঠনে বদলে দেন। একপক্ষে অসহযোগের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামো প্রত্যাখ্যান অন্যপক্ষে অসহযোগের মাধ্যমে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রবর্তনের সম্ভবনা জনমনে সত্য করে তোলা এই রণকৌশল শেখ মুজিবুর রহমান ৩৫ টি নির্দেশের মধ্যে দিয়ে বাস্তব করে তোলেন।” তিনি আরো লিখেছেন- “এই বিভিন্ন নির্দেশের মধ্যে দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবের ভিত্তি তৈরি করে দেন এবং
৫৭৮
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বেই স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় নীতিমালার নির্দেশ দেন। এই রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে জনসাধারণ, এই কর্তৃত্বের স্বরূপ সিভিল এবং সিভিল কর্তৃত্বের অন্তর্গত পুলিশ এবং মিলিটারি। শেখ মুজিবুর রহমান এভাবেই বঙ্গবন্ধু এবং জাতির জনকে পরিণত হয়ে যান। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা এ ক্ষেত্রেই।’
এভাবেই সৃষ্টি হয় একটি সমান্তরাল রাষ্ট্রের। সেদিক বিচার করলে ২৫ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল একটি ফরমাল ডিক্লারেশন মাত্র। আসলে সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের পত্তন হয় ৭ মার্চ। মহাত্মা গান্ধীও এত স্বল্প সময়ে এত পরিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন করতে পারেননি। যারা পিছিয়ে ছিল এতোদিন, ভুগছিল দোদুল্যময়তায়, তারাও এগিয়ে আসতে থাকে। কি জানি কাঁরাভা যদি তাদের ফেলে এগিয়ে যায়। এভাবেই বাংলাদেশ এগুতে থাকে ২৫ মার্চের দিকে। ঐ যে সেদিন শেখ মুজিব আঙুল তুলে নির্দেশ দিয়েছিলেন, বাঙালি তা মেনে চলে গিয়েছিল। পরাধীন পাকিস্তানে আর তারা ফিরে আসেনি।
৭ মার্চের ভাষণ
ভাইয়েরা আমার,
আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।
কি অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলী বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলব, এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বৎসরের করুন ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস, মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস।
বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সনে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সনে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারিনাই। ১৯৫৮ সনে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে দশ বৎসর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছিল। ১৯৬৬ সনে ছয় দফার আন্দোলনে, ৭ ই জুনে আমাদের ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালের
৫৭৯
আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হবার পরে যখন এহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হল। আমি প্রেসিডেন্ট এহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে অনুরোধ করলাম ১৫ ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না। তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে এসেম্বলী হবে। আমরা বললাম ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসব।
আমি বললাম এসেম্বলীর মধ্যে আলোচনা করব, এমনকি আমি এও পর্যন্ত বললাম যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজন যদিও হয় আমরা তার ন্যায্য কথা মেনে নেব। জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন , আলোচনা করলেন , বলে গেলেন যে, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, ওদের সঙ্গে আলাপ করলামঃ
আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলী। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেওয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলীতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলী চলবে। তারপর হঠাৎ এক তারিখে এসেম্বলী বন্ধ করে দেওয়া হল। এহিয়া খানসাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেম্বলী ডেকেছিলেন, আমি বললাম যে, আমি যাব। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। পঁয়ত্রিশ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসেন। তারপরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হল। দোষ দেওয়া হল বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হল আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পর এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল। আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সবকিছুই বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল।
কি পেলাম আমরা? আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব দুঃখী আর্ত মানুষের মধ্যে। তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ, আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি, তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম, জনাব এহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার
৫৮০
গরীবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের উপরে গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি না কি স্বীকার করেছি যে, ১০ ই তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমিতো অনেক আগেই বলেছি, কিসের আর টি সি? কার সঙ্গে বসব? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসব? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘন্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার উপরে দিয়েছেন। বাংলার মানুষের উপর দিয়েছেন।
ভাইয়েরা আমার,
পঁচিশ তারিখে এসেম্বলী কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখ বলে দিয়েছি যে, ঐ শহীদের রক্তের উপর দিয়ে, পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারেনা। এসেম্বলী কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে প্রথম। সামরিক আইন মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপরে বিবেচনা করে দেখব আমরা এসেম্বলীতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে এসেম্বলীতে বসতে আমরা পারিনা। আমি, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাইনা। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট, কাচারি, আদালত, ফঊজদারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলো হরতাল কাল থেকে চলবেনা। রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে, শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জর্জকোর্ট, সেমি গভর্ন্মেন্ট দফতরগুলো, ওয়াপদা কোনকিছুই চলবেনা। ২৮ তারিখে কর্মচারিরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এর পরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইলঃ প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।
আমরা ভাতে মারব। আমরা পানিতে মারব। তোমরা আমার ভাই- তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ তোমাদের কিছু বলবেনা। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করোনা। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।
৫৮১
আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যতদূর পারি ওদের সাহায্য করতে চেষ্টা করব। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা পয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই সাতদিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছিয়ে দেবেন। সরকারি কর্মচারিদের বলিঃ আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হল। কেউ দেবেনা। শোনেন, মনে রাখবেন শত্রু বাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাঙলায় হিন্দু মুসলমান, বাঙালি, নন-বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দ্বায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন রেডিও টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশনে আমাদের নিউজ না দেয় কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। দুই ঘন্টা ব্যাংক খোলা থাকবে- যাতে মানুষ তাদের মায়নাপত্র নেবার পারে। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবেনা। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এদেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে, শুনে কাজ করবেন।
প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব-এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ।
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
জয় বাংলা।
[জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট কর্তৃক প্রকাশিত ‘জাতির জনক’ অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত]
সাপ্তাহিক বাংলা
মাইকেল দত্তের সম্পাদনায় বাংলাদেশের মুজিবনগর ও সিলেট থেকে একযোগে প্রকাশিত হয় ‘সাপ্তাহিক বাংলা’। পত্রিকার নামের নিচে লেখা থাকত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কন্ঠস্বর। এই পত্রিকাটি রুপসী বাংলা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স এর
৫৮২
পক্ষে বিজয় কুমার দত্ত কর্তৃক মুদ্রিত। পত্রিকার নামের দুই পাশে বক্স করে বিভিন্ন কবিতার ৩/৪ টি লাইন প্রকাশিত হয়। কবিতার প্রকাশ ছিল উদ্দীপনা, দেশপ্রেম, ভালোবাসা ইত্যাদি। এর প্রথম প্রকাশকাল ইংরেজী ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ এবং বাংলায় ৩০ ভাদ্র, ১৩৭৮, বৃহস্পতিবার। প্রকাশিত হতো দামি কাগজে, ছাপা ঝকঝকে ও পরিচ্ছন্ন আর মূল্য ছিল ৩৫ পয়সা। আলোকচিত্র সংবলিত এই পত্রিকার পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮ ও কলামসংখ্যা ৬ ছিল। বিদেশস্থ যোগাযোগের ঠিকানা ছিল কলকাতা ৩ রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট, কোলকাতা-৯। আগরতলা ৮/১ রামনগর সেকেন্ড রোড, আগরতলা। করিমগঞ্জঃ ওল্ড স্টেশন রোড, করিমগঞ্জ, কাছাড়। লন্ডনঃ মি. নিজামুদ্দিন, ৩৫ আফার রোড, লন্ডন এন/১। কোলকাতায় সাপ্তাহিক বাংলার একমাত্র পরিবেশক ছিল হরিলাল অ্যান্ড কোম্পানি, ঠিকানা ছিল ৫ ধর্মতলা স্ট্রিট, কলকাতা। পত্রিকাটির সাতটি সংখ্যার সন্ধান পাওয়া যায়। ১৬ সেপ্টেম্বর প্রথম সম্পাদকীয় ‘যাত্রা হল শুরু’, ‘কালপেঁচার আর্তনাদ’ এবং প্রধান সংবাদ শিরোনাম ‘কূটনীতির পথে নয়, রণনীতির মধ্যেই বাংলার মুক্তি’ বলে প্রকাশ পায়। পত্রিকাটি সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার ওপর জোর দিয়ে লেখা হত। ২৬ সেপ্টেম্বরের সংখ্যায় সঞ্জীব চৌধুরী ‘স্বাধীনতাঃ ভিক্ষায়ং নৈব নৈব চ’ এই শিরোনামে এক প্রতিবেদনে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে পাকিস্তান দু ভাগ হয়ে গেলে যে টাকা পাকিস্তানকে ধার দিয়েছে তা ফেরত পাবেনা। বাংলাদেশ ক্রমশ বামপন্থী রাস্তা ধরবে। চীন মনে করে স্বাধীন হলে জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায় আসবে। ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়বে। তারচেয়ে যদি পাকিস্তান টিকে থাকে এবং চীন পাকিস্তান বন্ধুত্বের সুযোগে চীনপন্থীরা বাংলাদেশে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায়, মন্দ কি?’ ‘রাশিয়ার বাংলাদেশের ব্যাপারে সহানূভূতি দেখানো আর সক্রিয় সমর্থন করা এক নয়। রাশিয়ার বর্তমান স্ট্র্যাটেজিই হল কারো সাথে প্রত্যক্ষ সংঘাত এড়িয়ে চলা।’ বিশ্বের ইতিহাস প্রমাণ করেছে ভিক্ষার মাধ্যমে কোন জাতির কোন ন্যায্য দাবি আদায় হয়নি। সার্বিক মুক্তির জন্য প্রয়োজন সর্বান্তিক সংগ্রাম।’
সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড
৯০x২৭.৫ সেন্টিমিটার পরিমাপের এই পোস্টারটি অশোক সাহেইন কর্তৃক ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়। পোস্টারটি নকশা করেন আ কে ষোশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কবি অ্যালেন গিনসবার্গ ১৯৭১ এর নভেম্বর মাসের কলকাতার নিকট শরনার্থী শিবির পরিদর্শনে এসে শরনার্থী শিবিরে বাঙালিদের দুরবস্থা দেখে খুব ব্যথিত হন। তখন তিনি বাঙালিদের দুর্দশার কথা সমস্ত বিশ্ববাসীকে জানানোর জন্য এই কবিতাটি লিখেছিলেন। কবিতাটির শেষ চারটি
৫৮৩
চরণ থেকেই পুরো বাংলাদেশের সার্বিক চিত্র ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশের শরনার্থীদের আর্থিক সাহায্যদানের অনুরোধ জানিয়ে এই পোস্টারের বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে শরনার্থীদের সাহায্য করার জন্য এই পোস্টারটি প্রকাশিত হয়। পোস্টারটিতে সাদা জমিনের উপর কালো রঙের লেখা। তবে প্রথম লাইনে যশোর শব্দের ০ টিকে একটি লাল সূর্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে। এটা স্বাধীন বাংলার রক্তিম সূর্য বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।
সৈয়দ আব্দুস সুলতান (১৯১৭-১৯৯১)
সৈয়দ আব্দুস সুলতান ১৯১৭ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার শেরপুরের রৌহা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। ১৯৩৬ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে বি.এ. এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৮ সালে এলএলবি ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর সরকারের সমবায় বিভাগে চাকরি নিয়ে প্রায় ১১ বছর কর্মরত ছিলেন। ১৯৪৫ সালে ময়মনসিংহ জেলা আদালত এবং ১৯৫৬ তে ঢাকা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় যোগ দেন। ১৯৬২ তে মনমনসিংহ-৫ নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৬২-১৯৬৫ পর্যন্ত জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলের উপনেতা ছিলেন। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান বার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিন বছর দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ এ আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এবং ডিসেম্বরে ময়মনসিংহ-৯ আসন থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল বলিষ্ঠ, মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডা সফর করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত দ্বায়িত্ব পালন করেন। রম্য সাহিত্য, ভ্রমন কাহিনী ও জীবনী গ্রন্থ রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৯১ সালের ১১ ডিসেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম (১৯২৫-১৯৭৫)
আইনজীবী, রাজনীতিবিদ এবং মুজিবনগরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। ১৯২৫ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার যশোদল দামপাড়ায় তাঁর জন্ম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৭ সালে এম এ (ইতিহাস) এবং ১৯৫৩ সালে এলএলবি ডিগ্রী লাভ করেন। ছাত্রজীবন্ম থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৬-৪৭ সালে তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ইউনিয়নের সহসভাপতি ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ভাষা
৫৮৪
আন্দোলঙ্কালে গঠিত সর্ব্দলীয় অ্যাকশন কমিটির সদস্য হিসেবে ভাষা আন্দলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৪৯ সালে পাকিস্তান সেন্ট্রাল পাকিস্তান সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কর বিভাগে অফিসার পদ লাভ করেন। ১৯৫১ সালে সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে ময়মনসিং আনন্দমোহন কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি ময়মনসিংহে আইনব্যবসায় শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি ময়মনসিং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এবং ১৯৭২ সাল পর্যন্ত উক্ত পদে সমাসীন ছিলেন। ১৯৬৬ সাল থেকে ৬ দফা আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকলে আইয়ুব সরকার আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিব সহ বহুসংখ্যক নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করে। সেই সংকটময় সময়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দ্বায়িত্ব পালন করেন (১৯৬৬-১৯৬৯)।
১৯৬৯ সালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ‘ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি’ নামে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করে এবং এর অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে তিনি আইয়ুব বিরোধী গণ আন্দোলনে (জানুয়ারি-মার্চ, ১৯৬৯) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিরসনের লক্ষ্যে রাওয়ালপিন্ডিতে সরকারের সাথে বিরোধী দলগুলোর গোলটেবিল বৈঠকে (২৬ ফেব্রুয়ারি, ১০-১৩ মার্চ, ১৯৬৯) তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের সদস্য ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৭ নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনি গণ পরিষদের সদস্য এবং আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের উপনেতা নির্বাচিত হন। ১৯৭১ এর অসহযোগ আন্দোলনে তাঁ ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ও ইয়াহিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে (১৯ মার্চ, ১৯৭১) সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সঙ্গী। ২৫ মার্চ, ১৯৭১ শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। নবগঠিত এই সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় তাঁর অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত হিসেবে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। স্বাধীনতার পরে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের নতুন মন্ত্রী পরিষদে সঈয়দ নজরুল ইসলামকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রির দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি এই দ্বায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠনে তিনি নিরলস কাজ করেছেন। ১৯৭২ সালে তিনি আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে সাধারণ নির্বাচনে
৫৮৫
ময়মনসিং-২৮ নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। এবং মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দ্বায়িত্ব লাভ করেন। তিনি দ্বিতীয়বারের মত জাতীয় সংসদে দলের উপনেতা নির্বাচিত হন। তিনি শিল্পমন্ত্রী থাকাকালীন শিল্প কারখানা জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৭৫ সালে সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ রাষ্ট্রপতি হন। ঐবছর বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠিত হলে তিনি এর সহসভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় সদস্য কর্তৃক সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। এরপর দেশে সামরিক আইন জারি করা হয় এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হয়ে পুরনো সহকর্মীদের কয়েকজনকে তাঁর মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু সৈয়দ নজরুল ইসলাম সহ চার নেতা (তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান) উক্ত মন্ত্রী সভায় যোগদানে অস্বীকৃতি জানালে ২৩ আগস্ট গ্রেফতার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি হন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ চারনেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাঁকে বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে।
সোনার বাংলা
‘সোনার বাংলা’ বাংলাদেশের সাপ্তাহিক মুখপত্র। প্রথম প্রকাশ (উদ্বোধনী সংখ্যা) ১৪ আগস্ট ১৯৭১। দ্বিতীয় সংখ্যা ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ থেকে পত্রিকার নাম ‘সোনার বাংলা’ রাখা হয় এবং পরিচালনায় দেখা যায় এর ব্যাপক রদবদল। সম্পাদক ওবায়দুর রহমান ও সহযোগী সম্পাদক মজিবুর রহমান। উপদেষ্টা পরিষদ ছাড়া মুহাম্মদ আলাউদ্দিন (এমপিএ), রাজশাহী। সহ সভাপতি মুহ. আব্দুল হাদী এমপিএ রাজশাহী। সভ্যবৃন্দ ছিলেন আব্দুল্লাহিল বাকী, এম এ সোবহান, আব্দুস সামাদ, মুহ. মহসীন। ‘অবকাশ’ মুক্তনগর রাজশাহী, বাংলাদেশ থেকে প্রচারিত ও প্রকাশিত। বিনিময় মূল্য কমপক্ষে ৩০ পয়সা, ছাপা ঝকঝকে, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৬, কলামসংখ্যা ৪ ছিল। পত্রিকার ফুটে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ (১ সংখ্যা) লেখা আছে। প্রথম সম্পাদকীয় লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধ কি, কেন’। বঙ্গবন্ধুর বানী। সংবাদ শিরোনাম গুলো ছিল এরূপ ‘শেখ মুজিবের বিচার? খুনী এহিয়ার ধৃষ্টতা’, ‘বাংলাদেশের ডাকটিকিট’, ‘পনেরজন উচ্চপদস্থ কূটনীতিকের বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকার’ ইত্যাদি ছাড়াও বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়।
৫৮৬
সোনার বাংলা
‘সোনার বাংলা’ সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন সরকার কবীর খান। প্রধান উপদেষ্টা মতিউর রহমান এবং কে জি মোস্তফা কর্তৃক সোনার বাংলা প্রেস থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হত। ১২ জুন শনিবার, ১৯৭১ এ উদ্বোধনী সংখ্যা প্রকাশ পায়। পত্রিকাটির রেজিস্ট্রেশন নং ৩, মূল্য ১৫ পয়সা এবং ভারতে ২০ পয়সা ছিল। এটি মুক্তিবাহিনীর মুখপত্র হিসেবে পরিচয় দেয়। সোনার বাংলা পত্রিকার বিশেষ লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের এপারে ওপারে, মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাকে সদাজাগ্রত রাখতে যথাসাধ্য সাহায্য করা। কর্মাধ্যক্ষের পক্ষ থেকে পাঠকদের কাছে আবেদন ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এই পত্রিকা বিনামূল্যে পৌঁছে দেওয়া এবং প্রচার করতেন ‘আপনি এক কপি কিনলে তাঁরা এক কপি পান। সুতরাং আপনার সহায়তা আমরা প্রার্থনা করছি।’ পত্রিকাটির চতুর্থ সংখ্যার সংবাদ শিরোনাম ছিল ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া মুক্তিবাহিনী জয়মাল্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে।’ এর ষষ্ঠ সংখ্যার সম্পাদকীয় শিরোনাম ছিল ‘মুক্তিযোদ্ধা লহ সালাম’। সংবাদ ছাপানো ছাড়াও পত্রিকাটিতে বিভিন্ন ফিচার, চিঠিপত্রও প্রকাশিত হত। ৮ম ও ৯ম সংখ্যা প্রকাশনার তারিখ ৩১ অক্টবর ১৯৭১ ছিল। শেষ সংখ্যা ও প্রকাশনার তারিখ পাওয়া যায়নি। অলিউর রহমান তাঁর প্রবন্ধে স্বাধীনতার প্রশ্নে পত্রিকাটি আপসহীন ভূমিকা পালন করে বলে উল্লেখ করেন।
সোনার বাংলা (২)
‘সোনার বাংলা’ মূলত সাপ্তাহিকী হলেও শেষ দিকে প্রতিদিন এর সান্ধ্য সংস্করণ বের হত। প্রধান সম্পাদক ছিলেন এম এ শাহ (শাহ মোদাব্বির আলী), ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এবি জালাল উদ্দিন। প্রকাশনাস্থল তামাবিল, সিলেট লেখা থাকত।
স্টপ জেনোসাইড
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গণহত্যার বিরুদ্ধে জহির রায়হান নির্মাণ করেন ইংরেজিতে স্বপ দৈর্ঘের চলচ্চিত্র স্টপ জেনোসাইড। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নির্মিত পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রের মধ্যমে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, প্রশংসিত ও আলোচিত আলোচিত জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড।
মূলত গণহত্যা বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের সপক্ষে জনমত গড়ে তুলতেই স্টপ জেনোসাইড নির্মিত হয়।
ছবিটি শুরু হয় মহামতি লেনিনের কয়েকটি মহান বাণী দিয়ে। শুরুতে গ্রামীণ পটভূমিতে চিত্রায়িত এ ছবিতে দেখা যায় একজন কৃষ্ণকায় কিশোরী ঢেঁকিতে ধান
৫৮৭
ভানছে। ছন্দের তালে তালে সে ঢেঁকিতে পার দিয়ে চলেছে। গ্রাম্য সহজ সরল এই কিশোরীর কোন কষ্ট নেই, কোন যন্ত্রণা নেই, নেই কোন উদ্বেগ এবং উতকন্ঠা। কিশোরীর মুখাবয়বে সরল হাসি। নিরুদ্বিগ্নভাবে সে ধান ভেঙে চলেছে। দৃশ্য পরিবর্তন হতেই সহজ সরল গ্রাম্য সেই সরল কিশোরীর হাসির রেশ মিলিয়ে যায়, ভেসে আসে কাকের কা কা ডাক, গুলি, ব্রাশফায়ার, বুলেটের শব্দ, গগণবদারী আর্তচিৎকার ধ্বনি। মুহুর্তে অন্ধকারে চারদিক ছেয়ে যায় পর্দায় ভেসে ওঠে নারকীয় দৃশ্য লাশ, লাশ আর লাশ। যেদিকে তাকানো যায় শুধু লাশ। সামনে, পিছনে, ডানে, বামে লাশের স্তুপ, গলিত লাশ, বুলেটবিদ্ধ লাশ। চোখ ওপড়ানো, মাথার খুলি ওপড়ানো লাশ এবং মগজ বেরিয়ে যাওয়া লাশ। সাউন্ড ট্র্যাকে কখনো ব্রাশফায়ারের প্রচন্ড শব্দ আশেপাশের বাতাসকে ভারি করে রাখে। এরপরে আমরা দেখতে পাই বার্লিনের একটি প্রাচীর গৃহ আসতে আসতে ধ্বসে পড়েছে। পর্দায় আসতে আসতে ভেসে ওঠে ‘স্টপ জেনোসাইড’ শব্দ দুটি। এ ছবির মধ্যে দিয়ে জহির রায়হান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সামনে রেখে গোটা বিশ্বের মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টি চমৎকার ভাবে নিয়ে এসেছেন। তিনটি দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে তিনি এই অসাধারণ কাজটি করেছেন। প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতর। সেখানে চমৎকার চমৎকার কিছু কথা বলা হচ্ছে। ঠিক এর পরের দৃশ্যেই দেখা যায় ভিয়েতনামে বি-৫২ বোমারু বিমানের ধ্বংসযজ্ঞ, মার্কিনি কর্তৃক নারী পুরুষ শিশুদের গণহত্যা। ছবিতে আমরা আরো দেখতে পাই, ভিয়েতনামের যুদ্ধাপরাধে বিচারাধীন জনৈক মার্কিন লেফটেন্যান্টের পক্ষে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাফাই গাওয়ার দৃশ্য। এ দৃশ্য দেখাতে দেখাতে তিনি ভিয়েতনাম থেকে চলে আসেন বাংলাদেশে। ‘৭১ এর সেই বাংলাদেশ মুহুর্তে পর্দায় ভেসে ওঠে। পর্দায় ভেসে ওঠে বুড়িগংগা নদীর তীর, গ্রাম জনপদ। ভেসে ওঠে লাশ, হত্যাযজ্ঞের সব দৃশ্য। দূরে কোথাও কাকের কা কা ডাক শোনা যায়। এ সময় নেপথ্যে শোনা যায়- জাতিসংঘের মানবাধিকার লংঘনের ঘোষণা- তবে কি কেবল পরিহাস?
এভাবে বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা, পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থী হত্যাকান্ডের প্রতিরোধে স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর জনতার ইস্পাতকঠিন প্রতিজ্ঞা ও প্রতিরোধের তেজোদীপ্ত স্পৃহার উপর ভিত্তি করে নির্মিত ‘স্টপ জেনোসাইড’ নির্মাণ করে পরিচালক সফল হন, কারণ Stop Genocide সমগ্র বিশ্ববিবেকের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরেছে। তুলে ধরেছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি। ফলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গড়ে ওঠে বিশ্ব জনমত। ছবিটি সম্পর্কে আলমগীর কবির বলেন, হানাদার বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের জনসাধারণের হত্যাযজ্ঞে চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রমাণাদির স্বল্পতা সত্ত্বেও নির্ভেজাল শৈল্পিক দূরদর্শিতায় জহির রায়হান একটি দুর্লভ ও রাজনৈতিক মহিমান্বিত কর্ম সমাধা করেছেন।
৫৮৮
স্বল্পদৈর্ঘ্যের আঙ্গিকে নির্মিত স্টপ জেনোসাইডের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন জহির রায়হান ও আলমগীর কবির। ইংরেজি ধারাবিবরণী লেখেন এবং তাতে কন্ঠ দেন আলমগীর কবির। চিত্র গ্রাহক ছিলেন অরুণ রায়। জহির রায়হানের এই ছবিটি স্বাধীনতার পর তাসখন্দ সহ বিদেশের একাধিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত ও প্রশংসিত হয়েছে। চলচ্চিত্রটির সময় ছিল ১৯ মিনিট।
স্টপ স্টপ
জেনোসাইড জেনোসাইড
STOP STOP
GENOCIDE GENOCIDE
২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তানিরা প্রথমে ঢাকায় অবস্থানকারী নিরীহ বাঙালির উপর আক্রমণ করার পাশাপাশি সমগ্র দেশব্যাপী গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন চালাতে থাকে। এই অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে প্রদাসী বাঙালিরা ব্যাপক প্রতিবাদ সভা, মিছিল ও আন্দোলন গড়ে তোলে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে গ্রেট ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরের সমাবেশ ও মিছিলে প্রবাসী বাঙালিদের কন্ঠে গণহত্যার বিরুদ্ধে এই শ্লোগানটি উচ্চারিত হত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে। তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন পোস্টার প্ল্যাকার্ডেও এই শ্লোগানটির ব্যাপক ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান, গণহত্যা বন্ধ করায়বিদেশে জনমত গঠনে এই শ্লোগানটি ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
স্বদেশ
‘স্বদেশ’ পত্রিকাটি জাতীয়তাবাদী বাংলার সাপ্তাহিক মুখপত্র হিসেবে পরিচয় দেয়। পত্রিকাটি সম্পাদক গোলাম সাবদার সিদ্দিকী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত এবং তৎকর্তৃকতবর্ণালী প্রেস বাংলাদেশ (খুলনা) থেকে মুদ্রিত। প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৬ জুন, বুধবার ১৯৭১এবং সংখ্যার শেষ পাতার নিচে প্রকাশনার স্থানে ইংরেজিতে ‘The Swadesh: Voice of National Bangladesh’ লেখা ছিল। পত্রিকাটির পৃষ্ঠা ৪, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদেয় রেজিস্ট্রেশন নং- ৪ এবং মূল্য ২০ পয়সা ছিল। প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয় শিরোনাম ‘আমাদের লক্ষ্য মৃত্যু অথবা জয়লাভ’ এবং সংবাদ শিরোনাম ছিল ‘বিদায় ইয়াহিয়া বিদায়’। ১৪ ডিসেম্বর এই পত্রিকার সম্পাদকীয় শিরোনাম ছিল ‘আসন্ন যুদ্ধের জন্য ঘরে ঘরে প্রস্তুত হউন’। স্বদেশে আরো ছাপা হয়েছে ‘নিউজউইক’এর লেখার অনুবাদ, কিছু শ্লোগান ‘কলেরার
৫৮৯
টিকা নিন’, ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনুন’, ‘গ্রামে গ্রামে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন’, ‘গুজব ছড়াবেন না’ ইত্যাদি। তাছাড়া ব্যক্তিগত নিবন্ধে কোন শহীদ সহকর্মী বা বন্ধুর কথা, মুক্তাঞ্চলের খবর, যুদ্ধ বা এধরনের নানা খবর।
স্বাধীন বাংলা (১)
‘স্বাধীন বাংলা’ পত্রিকাটি ছিল কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত। দাম ১০ পয়সা, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪ এবং কলামসংখ্যা ৪ ছিল। প্রথম কবে প্রকাশিত হয় জানা যায়নি। সংগৃহীত ৩য় সংখ্যা ১ নভেম্বর, সোমবার, ১৯৭১ আর বাংলায় ১৪ কার্তিক, ১৩৭৮ এ প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যার পত্রিকার নামের বামপার্শ্বে বক্সের ভিতর ‘আমাদের সামনে হাজার হাজার শহীদ বীরিত্বের সঙ্গে জনগণের স্বার্থে প্রাণ বলি দিয়াছেন। তাহাদের সেই পতাকা উর্ধ্বে তুলিয়া আসুন আমরা আগাইয়া চলি তাহাদের সেই রক্ত চিহ্ন ধরিয়া’ লেখা ছিল। এই সংখ্যার সম্পাদকীয় ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আকাশে অশুভ কালো মেঘের ছায়া! মুক্তিযোদ্ধারা হুঁশিয়ার’ ও প্রধান সংবাদ শিরোনাম যেমন ‘মাঠে মাঠে এত রক্তের ঢেউ কি দামে ভাই কসম বন্ধু, খুনিদের কাছে জবাব চাই’, ‘আমেরিকান চক্রান্ত পরাজিতঃ জাতিসংঘে চীনের আসন দখল’ ইত্যাদি সংবাদ প্রতিবেদন ছাড়াও অন্যান্য আরও অনেক খবর প্রকাশিত হয়।
স্বাধীন বাংলা (২)
সরকার কবীর খান কর্তৃক বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল হতে সম্পাদিত ও প্রকাশিত ‘স্বাধীন বাংলা’ মুক্তিবাহিনীর সাপ্তাহিক মুখপাত্র ছিল। ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংস্থা (উত্তর-পূর্ব এলাকা) কর্তৃক অনুমোদিত’ এ লাইনটি পত্রিকার শেষ পাতার নিচে লেখা ছিল। সংগৃহীত পত্রিকাটির প্রকাশ তারিখ ও এ সংক্রান্ত অন্যকিছু জানা জায়নি। তবে মূল্য লেখা ছিল ১০ পয়সা আর এর কলাম সংখ্যা ছিল ২। পত্রিকার নামের সাথে ডানদিকে ছোট করে ‘মেহনতি মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম জয়যুক্ত হতে বাধ্য’ লেখা ছিল। সম্পাদকীয়তে লেখা হয় ‘রক্ত আখরে লেখা একটি নাম- স্বাধীন বাংলাদেশ’। শেষ পাতায় ‘রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নে সৈয়দ নজরুলের চার দফা’ শীর্ষক স্বাদীন বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম চারটি শর্ত আরোপ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যে ভাষণ দান করেন তা ছাপানো হয়। শর্তগুলো ছিলঃ
৫৯০
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের বিনাশর্তে মুক্তি দিতে হবে।
বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তানি সেনা প্রত্যাহার করতে হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
আড়াই মাস ধরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণের ফলে বাংলাদেশের জনসাধারণের যে ক্ষতি হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
স্বাধীন বাংলা (৩)
‘স্বাধীন বাংলা’ বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের সাপ্তাহিক মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয়। সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি খোন্দকার শামসুল আলম দুদু কর্তৃক মুজিবনগর হতে প্রকাশিত ও স্বাধীন বাংলা প্রেস হতে মুদ্রিত। পত্রিকাটির মূল্য ১৫ পয়সা। ৩য় সংখ্যা প্রকাশিত হয় মুজিবনগর থেকে ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮, শনিবার এবং এর সম্পাদকীয় ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ও ‘প্রত্যেক গেরিলা যোদ্ধাই সমাজ সংস্কারক’ এবং প্রধান সংবাদ শিরোনাম ‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়ঃ জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’ ছাড়াও নানাবিধ খবর প্রকাশ পায়। প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি সিঙ্গেল শিটে (২ পৃষ্ঠায়) প্রকাশিত হলেও পত্রিকার চতুর্থ সংখ্যাটি আবার চার পাতায় প্রকাশ পায় শনিবার ১০ জুন, ১৯৭১ এবং যার মূল্য রাখা হয়েছিল ১৫ পয়সা। এ সংখ্যায় পত্রিকার নামের উপরে ছাপা হয় সুকান্তের কবিতার দুটি পঙক্তি ‘প্রিয়ারে আমার কেড়েছিস তোরা ভেঙেছিস ঘরবাড়ি, সে কথা কি আমি জীবনে মরণে কখনো ভুলিতে পারি!’ এ সংখ্যার প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন ও নিবন্ধের শিরোনামগুলো যেমন ছিল ‘বাংলার সংগ্রামী জনতার প্রতি আহবান’, ‘জয় আমাদের হবেই’ ইত্যাদি। এ সংখ্যার সম্পাদকীয় শিরোনাম ‘আপোষ নয়- দু হাতে বাজাও প্রতিশোধের দামামা’। তাছাড়া ‘তবুও মোরা রহিব বাঁচিয়া’ নামে একটি কবিতাও এ সংখ্যায় প্রকাশ পায়।
স্বাধীন বাংলা (৪)
কাজী জাফর, মেনন প্রমুখের পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি কর্তৃক এই পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২৫ অক্টোবর। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এই গ্রুপটি তখন সোভিয়েত বিরোধী বামপন্থীদের নিয়ে পৃথক একটি কমিটি গড়েছিল। পত্রিকাটি সকল স্বাধীনতাকামী শক্তির মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য আহবান করে, যদিও আওয়ামী লীগ এই ডাকে মোটেই সাড়া দেয়নি। পত্রিকাটি দীর্ঘকালীন
৫৯১
গেরিলা যুদ্ধের সমর্থক ছিল। ১ নভেম্বর সংখ্যায় বলা হয়, ‘ভারতের জনগণ ও সরকার আমাদের নৈতিক ও বৈষয়িক সাহায্য প্রদান করিতেছে। আর ইহাও অনস্বীকার্য সত্য যে কোন বিদেশী রাষ্ট্রের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হইয়া একটি দেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ চলিতে পারেনা।’ ইমামুর রশীদ তার এক প্রবন্ধে এই পত্রিকা সম্পর্কে লিখেছেন- পাক্ষিক এই পত্রিকাটি ১ অক্টোবর প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধে রূপান্তরের পক্ষপাতী এবং দীর্ঘকালীন গেরিলা যুদ্ধের সমর্থক ছিল। এ জন্যে স্বাধীনতাকামী শক্তির মধ্যে ব্যাপকতর ঐক্যের আহবান জানিয়েছিল পত্রিকাটি।
স্বাধীন বাংলা (৫)
‘স্বাধীন বাংলা’ (সোনার দেশ) পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাত্রী সম্পাদিকা মিসেস জাহানারা কামরুজ্জামান। সম্পাদক এস এ আল মাহমুদ চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত এবং বলাকা প্রেস জামালগঞ্জ, রাজশাহী বাংলাদেশ হতে এম এ মজিদ কর্তৃক মুদ্রিত। প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন এ এইচ এম কামরুজ্জামান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বাংলাদেশ সরকার। পত্রিকাটি প্রথম জুন, ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয় বলে জানা যায়। পত্রিকায় ‘সোনার দেশ’ কথাটী পত্রিকার নামের নিচে ছোট করে বন্ধনীতে এবং দুই পাশের বক্সে ‘সোনার বাংলা আজ শ্মশান কেন?’ জাতির পিতা শেখ মুজিব’ এবং ‘এ বাংলাকে বাঁচাতেই হবে, শেখ মুজিব’ লেখা দেখা যায় পত্রিকাটির ১২ জুলাই সংখ্যাটিতে। এ সংখ্যার পত্রিকাটির মূল্য রাখা হয় ১৫ পয়সা। তাছাড়া স্বাধীন বাংলার সাপ্তাহিক মুখপত্র হিসেবে এ সংখ্যার পত্রিকাটি নিজেকে পরিচয় দেয়। ৭ম সংখ্যা ১২ জুলাই এর প্রধান সংবাদ প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘বিশ্বের নারী সমাজের প্রতি অন্তিম আবেদন বাংলার নারীদের বাঁচান’ ছিল। এ সংখ্যায় একটি নগ্ন মহিলার ছবি ছাপা হয়। ক্যাপশন ছিল ‘৯ জন পাক পশু সেনার ধর্ষণে মৃত রমনী। তার হাতের চুড়িগুলো এখনো বলছে আমি ঘরের বৌ ছিলাম।’ নিচে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় যে নগ্নাবস্থার জন্য তার পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে। এরপরে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দেয়া হয়।
স্বাধীন বাংলা (৬)
‘স্বাধীন বাংলা’ একটি দৈনিক পত্রিকা। চৌমুহনী, নোয়াখালি থেকে আমম আনোয়ারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। ২৬ মার্চ ১৯৭১ প্রথম প্রকাশিত। ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ছাপা হয়।
৫৯২
স্বাধীন বাংলা বেতার
দ্র. স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করেছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি যখন ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনীর আক্রমনে দিশেহারা, শোকাকুল; কামানের গোলায় ঢাকার রাজারবাগসহ দেশের অন্যন্য পুলিশ লাইন সমূহ ভস্মীভূত এবং যখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআরের কিছু বঙ্গ শার্দুল সম্পূর্ণ অন্ধভাবে স্ব স্ব দ্বায়িত্বে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলেন, অন্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন প্রতিরোধ সংগ্রামে, ঠিক তখুনি চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীনবাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। এই বেতার কেন্দ্রের প্রথম অনুষ্ঠান শোনামাত্র বহু বাঙালি অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। সে অশ্রু ছিল আনন্দের, স্বস্তির, গৌরবের। বাঙালি আবার উঠে দাঁড়াল গভীর আত্মবিশ্বাসে। বীর বঙ্গ শার্দুলগণ পেলেন শত্রুর উপর আঘাত হানার নতুন প্রেরণা।
২৫ মার্চ ‘৭১ রাতে ইতিহাসের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পর ২৬ মার্চ ‘৭১ এর সূর্য বয়ে এনেছিল বাঙলার বুকে এক সাগর রক্ত, হাহাকার এবং শোকের কালো ছায়া। কিন্তু ২৫ মার্চের ঐ কালরাত্রির হত্যার সাথেই স্তব্ধ হয়ে যায়নি বাঙালির কন্ঠ। ২৬ মার্চ ‘৭১ এর দ্বিপ্রহরের মধ্যেই তাঁরা ইথারে শুনলেন চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে স্থানীয় জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি জনাব আব্দুল হান্নানের অগ্নিস্ফূলিঙ্গ ভাষণ। কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে ঐ একই সন্ধ্যায় সংগঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র। এই বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকেই মেজর (তৎকালীন) জিয়াউর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচারিত হয়েছিল ২৭, ২৮ এবং ৩০ মার্চ, ‘৭১। ৩০ মার্চ ‘৭১ হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বোমারু বিমানে ট্রান্সমিটারটি বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার পর তৎকালীন ই পি আরের সহায়তায় বেলাল মোহাম্মদের নেতৃত্বে দশজন নিবেদিত শব্দসৈনিক কালুরঘাট থেকে ক্ষুদ্র এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার বয়ে এনেছিলেন প্রথমে রামগড় এবং পরবর্তীকালে ভারতের আগরতলায়। ঐ ট্রান্সমিটারের সাহায্যেই তারা বিক্ষিপ্তভাবে স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের প্রচার অব্যাহত রেখেছিলেন ২৪ মে, ৭১ পর্যন্ত।
পঞ্চাশ কিলোওয়াট মধ্যম তরঙ্গ ট্রান্সমিটার
মুজিবনগর
মুজিবনগরে অস্থায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল ১০ এপ্রিল, ১৯৭১। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথ তলায় এই অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশের পর মুক্তিযুদ্ধের প্রচার জোরদার করার উদ্দেশ্যে স্বাধীব বাংলা বেতার কেন্দ্রকে নতুন করে সংগঠনের দ্বায়িত্ব অর্পিত হল জনাব
৫৯৩
আব্দুল মান্নান এম এন এর উপর। এই বেতার কেন্দ্রের পওক্ষ উপদেষ্টা ছিলেন সর্বজনাব জিল্লুর রহমান (এমএনএ), মোহাম্মদ খালেদ (এমএনএ) এবং তাহের উদ্দিন ঠাকুর (এমএনএ)।
মুজিবিনগরে ৫০ কিলোওয়াট মধ্যম তরঙ্গ শক্তিসম্পন্ন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শুভ সূচনা হয়েছিল ২৫ মে ১৯৭১। পূর্ণ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে শুরু হয়েছিল এই বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার। দৈনিক সকাল ৭ টা ও সন্ধ্যে ৭ টা এ দুই অধিবেশনে শুরু হল এ অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান সূচিতে অন্তর্ভুক্ত হল বাংলা এবং ইংরেজি খবর, সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান ‘অগ্নিশিখা’, ‘চরমপত্র’ বিশেষ কথিকা, বঙ্গবন্ধুর বানী এবং দেশাত্মবোধক গানের অনুষ্ঠান ‘জাগরনী’।
২৫ মে ১৯৭১ প্রথম দিনের প্রচারিত অনুষ্ঠান পত্রের ফটোকপি পরবর্তী পৃষ্ঠায় ছেপে দেওয়া হল পাঠককুলের উদ্দেশ্যে।
নব পর্যায়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য প্রথম গান বানীবদ্ধ করলেন রংপুর বেতারের তৎকালীন পল্লীগীতি শিল্পী শাহ আলী সরকার। শুনেছি স্বাধীনতা প্রাপ্তির কিছুদিন পর তাঁর মষতিষ্ক বিকৃতি ঘটেছিল এবং ঐ অবস্থায়ই তিনি রংপুরে ইন্তেকাল করেছেন। (ইন্নালিল্লাহে…)।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কাজ চলত ছোট একটা দ্বিতল বাড়িতে। অনুষ্ঠান বানীবদ্ধ করার জন্য স্টুডিও ছিল মাত্র একটি। পরে আরো একটি কক্ষ খালি করে অনুষ্ঠান রেকর্ডিং এর ব্যবস্থা হয়েছিল। তবে এগুলোতে পেশাগত স্টুডিওর ন্যায় কোন শব্দ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিলনা। ছিলনা প্রয়োজনীয় বাদ্যযন্ত্র ও যন্ত্রী। অবশ্য পরবর্তীকালে বাদ্য যন্ত্রের আংশিক অভাব পূরণ হয়েছিল। আমরা ড্রাম, সাইড প্রাম, গিটার, করনেট ইত্যাদি যন্ত্রপাতি খরিদ করে নিয়েছিলাম। কিন্তু বাড়ির ব্যবস্থা আর হলোনা। ওখানেই আমরা খেতাম। সারাদিন এবং গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করে ঐ বাড়ির খোলা মেঝেতেই চাদর পেতে শুয়ে পড়তাম।
আগেই বলেছি, ‘চরমপত্র’: বিশেষ ব্যঙ্গ রচনা, ‘অগ্নিশিখা’: মুক্তিবাহিনীর জন্য অনুষ্ঠান জাগরণী: উদ্দীপনা মূলক গানের অনুষ্ঠান এবং ইংরেজি ও বাংলা খবর ইত্যাদি দিয়েই শুরু হয়েছিল মুজিবনগরে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। ‘চরমপত্র’ লিখতেন এবং পড়তেন এমআর আখতার। অনুষ্ঠানটি পরিকল্পনা করেছিলেন জনাব আব্দুল মান্নান (ভারপ্রাপ্ত এমএনএ)। ‘অগ্নিশিখা’: মুক্তিবাহিনীর জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান পরিকল্পনা, প্রযোজনা এবং নামকরণ করেন জনাব টিএইচ শিকদার। প্রথম দিকে কিছুদিন তিনি এ অনুষ্ঠানের পরিচালনাও করেছেন। পরবর্তীকালে পর্যায়ক্রমে সর্বজনাব মোস্তফা আনোয়ার এবং আশরাফুল আলম এ অনুষ্ঠানের পরিচালনার ভার নিয়েছিলেন। অল্প কয়েক দিনের জন্য অধ্যাপক বদরুল হাসানও অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছেন। ‘রক্ত স্বাক্ষর’ : বিশেষ
৫৯৪
সাহিত্যানুষ্ঠানের পরিকল্পনা এবং এবং প্রথম কিছুদিনের প্রযোজনার দ্বায়িত্বে ছিলেন জনাব টিএইচ শিকদার। পরবর্তীকালে এ অনুষ্ঠানের প্রযোজনার ভার নিয়েছিলেন জনাব আশরাফুল আলম। অল্প কয়েকদিন পর সংযোজিত হয়েছিল ‘বিশ্ব জনমত’ এবং সাপ্তাহিক জয়বাংলা পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্য। এ দুটি অনুষ্ঠানের পান্ডুলিপি পড়তেন জনাব আমিনুল হক বাদশা। ‘বিশ্ব জনমত’ লিখতেন জনাব সাদেকীন। তবে মাঝেমধ্যে জনাব আবুল কাশেম সন্দ্বীপও এ অনুষ্ঠানের পান্ডুলিপি লিখে দিয়েছেন। ‘অগ্নিশিখা’ : মুক্তিবাহিনীর জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ‘রণভেরি’, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ সংবাদ বুলেটিন (পরিবর্তিত নাম ‘রণাঙ্গনের সংবাদ’) এবং ‘দর্পন’, মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে লিখিত বিশেষ কথিকা। ‘দর্পন’ কথিকাটি লিখতেন ও পড়তেন জনাব আশরাফুল আলম।
সীমিত কয়েকজন লেখক, কথক এবং শিল্পী নিয়ে শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার। প্রথম প্রথম অভ্যন্তরীণ ভাবে পান্ডুলিপি লেখা ও প্রচারে উৎসাহ পাওয়া গিয়েছিল প্রচুর। কিন্তু সে উৎসাহ বেশিদিন টিকিয়ে রাখা ছিল যথার্থই কঠিন। তাই বিভিন্ন ধারার পান্ডুলিপি লেখক এবং কথক সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হল বিশেষভাবে। অপরদিকে দৈনন্দিন প্রচারিত অনুষ্ঠানে ত্রুটি বিচ্যুতির পর্যালোচনারও প্রয়োজন দেখা দিল চরমভাবে।
৬ জুন ১৯৭১ আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনার জন্য সভা ডাকলাম। এটিই ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সর্বস্তরের কর্মীর প্রথম সভা। এতে এমএনএ পর্যায়ে উপস্থিত ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উপদেষ্টা সর্বজনাব জিল্লুর রহমান, মোহাম্মদ খালেদ এবং তাহের উদ্দিন ঠাকুর। ভারপ্রাপ্ত এমএনএ জনাব আব্দুল মান্নান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ জরুরী কাজে সেদিন মুজিবনগরের বাইরে ছিলেন। তাই এ সভায় তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি। নয়দিনের ব্যবধানে ১৫ জুন ‘৭১ আমরা সম্মিলিত ভাবে আবার একত্রিত হয়েছিলাম। এ দুটি সভায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার সংগঠন প্রসঙ্গে আমরা কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
পরবর্তীকালে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নীতি নির্ধারণী সভা ডাকা সাব্যস্ত হয়েছিল। এ পর্যায়ে প্রথম নীতি নির্ধারণী সভা আহূত হয়েছিল মুজিবনগরস্থিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা সচিব জনাব আব্দুস সামাদের সভাপতিত্বে তাঁরই দপ্তর কক্ষে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত জনপ্রিয় শ্লোগানসমূহ
১. হানাদার পশুরা বাংলাদেশের মানুষ হত্যা করছে- আসুন আমরা পশু
৫৯৫
হত্যা করি।
২. বাংলাদেশের প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা এক একটি গ্রেনেড। শুধু পার্থক্য এই- গ্রেনেড একবার ছুড়ে দিলে নিঃশেষ হয়ে যায়, আর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের বারবার ছুড়ে দিয়ে বারবার গ্রেনেড হয়ে ফিরে আসে।
৩. গ্রেনেড গ্রেনেড গ্রেনেড- শত্রুর উপর প্রচন্ড গ্রেনেড হয়ে ফেটে পড়েছে মুক্তিযোদ্ধারা।
৪. বাংলার প্রতিটি ঘর আজ রণাঙ্গন। প্রতিটি মানুষ সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধা। প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতার জ্বলন্ত ইতিহাস।
৫. শত্রুপক্ষের গতিবিধির সমস্ত খবরাখবর অবিলম্বে মুক্তিবাহিনীর কেন্দ্রে জানিয়ে দিন।
৬. কোন প্রকার মিথ্যা গুজবে কান দেবেন না। বা চূড়ান্ত সাফল্য সম্পর্কে নিরাশ হবেন না। মনে রাখবেন, যুদ্ধে অগ্রাভিযান ও পশ্চাদপসরণ দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
৭. প্রতিটি আক্রমণেরে হিংসাত্মক বদলা নিন। সংগ্রামকে ঢেউয়ের মত ছড়িয়ে দিন।
৮. শত্রু কবলিত ঢাকা বেতার কেন্দ্রের মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত হবেননা। এদের প্রচার অভিযানের একমাত্র উদ্দেশ্যই হল আমাদের সাফল্য সম্পর্কে দেশবাসীর মনে সংশয়, সন্দেহ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা।
৯. পদ্মা, মেঘনা, যমুনার মাঝি, কৃষক, কামার, কুমার, তাঁতী, বীর, ক্ষেতমজুর হাতে তুলে নিয়েছে মরণাস্ত্র। এদের বুকে জ্বলে উঠেছে অনির্বাণ আগুন। এরা মরণ পণ করে রুখে দাঁড়িয়েছে নরখাদক দস্যু সৈন্যের মোকাবেলা করতে। ১০. সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।
১১. বর্বরতার জবাব আমরা রণাঙ্গনেই দিচ্ছি, রক্তের বদলে রক্ত নেব। চূড়ান্ত বিজয় আমাদের হবেই হবে।
১২. বাংলাদেশ আহ শত্রু হননের মহোতসব, প্রতিটি হানাদার দস্যু ও বিশ্বাসঘাতককে খতম করুন। ওদের বিষদাঁত ভেঙে দিন। বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে অটুট থাকুন।
১৩. পশ্চিম পাকিস্তানি পণ্যসামগ্রী ব্যবহার বর্জন করুন। শত্রুর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ গড়ে তুলুন।
১৪. ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেওয়া কুকুর গুলোকে খতম করে আসুন আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ি।
১৫. আপনার ভোটে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারই
৫৯৬
বাংলাদেশের বৈধ সরকার। স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ছাড়া আর কোন হানাদার সরকারের আনুগত্য রাষ্ট্রদ্রোহিতারই সামিল।
১৬. মুক্তিবাহিনী লড়ছেন আমার জন্য, আপনার জন্য, বাংল;আদেশের ইজ্জতের জন্য।
১৭. স্বাধীনতার প্রশ্নে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আজ ঐক্যবদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের সবল হাতের হাতিয়ার শত্রুর কলিজায় ঘা মেরেছে। জয় আমাদের সুনিশ্চিত।
১৮. স্বাধীনতা কারো যৌতুক হিসেবে পাওয়া যায়না। তা কিনে নিতে হয় এবং একমাত্র রক্তের বিনিময়েই স্বাধীনতা কিনে নেওয়া সম্ভব। বাঙালি সে মূল্য দিচ্ছে এবং আরো দেবে।
১৯. আমাদের মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ করছে শত্রুর থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অস্ত্র দিয়ে, এমনিভাবে মুক্তিবাহিনীর অপ্রতিহত অগ্রগতি চলছে দুর্বার গতিতে। তারা আর থামবেনা। কোনদিন থামবেনা। দেশকে শত্রুমুক্ত করার পূর্বে চূড়ান্ত বিজয়ের পূর্বে এই বিজয় থামবেনা।
২০. জল্লাদ বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ্য করুন। নিকটবর্তী মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটিতে খবর দিন।
২১. বিদেশী শাসক এবং হানাদারদের সৃষ্ট কলংকের ইতিহাস বাঙালিরা এবার মুছে ফেলবে।
২২. বাংলাদেশের সর্বত্র আজ শত্রু হননের প্রতিযোগিতা চলছে। রক্ত চাই। শুধু রক্ত।
২৩. প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে আজ প্রতিহিংসার প্রচন্ড উত্তাপ। হানাদার হত্যা করাই আজ আমাদের একমাত্র কর্তব্য।
২৪. চূড়ান্ত বিজয় আমাদের সন্নিকটে। সর্বশক্তি দিয়ে দস্যু সেনাদের আক্রমণ করুন।
২৫. বাংলার শ্যামল মাটি আজ পুঞ্জীভূত বারুদের গোলা-প্রতিটি ঘর এক একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ। বাংলার সাড়ে সাতকোটি মানুষ আজ অপরাজেয় মুক্তিযোদ্ধা। যেখানেই থাকুন না কেন, শত্রুকে প্রচন্ড আঘাত করুন।
২৬. বাংলার মুক্তিযুদ্ধে শহীদানের প্রতিটি রক্তবিন্দু- আজ উদ্দীপ্ত করেছে স্বাধীনতা সূর্যকে।
২৭. মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমনে জঙ্গিশাহীর বর্বর খান সেনারা আজ দিশেহারা। প্রতিটি রণাঙ্গনেই হানাদারেরা হচ্ছে পর্যুদস্ত, আরো জোরে আঘাত হানুন। শত্রুকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করুন।
২৮. সাড়ে সাতকোটি মানুষের মুক্তিসংগ্রাম এখন চূড়ান্ত বিজয়ের পথে বাংলার নবদিগন্তে আজ নতুন প্রত্যুষের নতুন আশ্বাস।
২৯. বাংলার নারী পুরুষ আবাল বৃদ্ধ বনিতা প্রত্যেকেই আজ দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা।
৫৯৭
সাড়ে সাতকোটি মানুষের এই সম্মিলিত শক্তি মোকাবেলায় হানাদার পশুরা চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
৩০. বঙ্গবন্ধুর অগ্নিমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্মিলিত বজ্রকন্ঠ স্তব্ধ করে দিয়েছে জঙ্গিশাহীর উদ্ধত কামানকেও।
৩১. মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আঘাতে শত্রু ছাউনি এখন ছিন্ন ভিন্ন। সংগ্রামের প্রতিটি মূহুর্ত বয়ে আনছে জয়োল্লাস।
৩২. সাবাস মুক্তিযোদ্ধা ভায়েরা। বাংলাদেশের পশ্চিম পাকিস্তানি পশুদের নির্মম গণহত্যার প্রতিশোধ নাও। আরো জোরে আঘাত কর।
৩৩. সাড়ে সাত কোটি বাঙালির পতাকা আজ পতপত করে উড়ছে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে। নব দিক দিশারী এই পতাকাকে জানান আমার সশ্রদ্ধ সালাম।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের (নুজিবনগর) প্রথম দিনের অনুষ্ঠানপত্র
আজ মঙ্গলবার, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮,
২৫ মে ১৯৭১ সাল।
(Signature Tune)
৭-০০ অ.গ. আসসালামু আলাইকুম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি জনগণকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আমাদের প্রথম অধিবেশন শুরু করছি। অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে… মিটারে … কিঃ সাঃ এ।
অধিবেশনের প্রথমে শুনুন তেলাওয়াতে কালামে পাক এবং তার বাংলা তরজমা।
৭-১০ অ. গ. স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আমাদের অনুষ্ঠান সম্পর্কে একটি ঘোষণা। আজ থেকে সকাল সাতটা ও সন্ধ্যে সাতটাইয় দুটি অধিবেশনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে। আজকের প্রথম অধিবেশনের অনুষ্ঠানঃ
* বাংলা খবর প্রচারিত হবে সকাল সোয়া সাতটায়।
* ইংরেজি খবর শুনতে পাবেন সকাল সাতটা বেজে পঁচিশ মিনিটে।
* ‘চরমপত্র’ শুনতে পাবেন সকাল ৭ টা বেজে … মিনিটে।
* বঙ্গবন্ধুর বানী থেকে পাঠ শুনতে পাবেন সকাল ৭ টা বেজে ৪০ মিনিটে।
* ‘জাগরণী’ দেশাত্মবোধক গান শুনবেন সকাল পৌনে আটটায়।
আজকের প্রথম অধিবেশনের অনুষ্ঠান সূচি শুনলেন।
আপনারা এ অনুষ্ঠান শুনতে পাচ্ছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে…
৫৯৮
মিটারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর শুনতে পাবেন। প্রথমে বাংলা ও পরে ইংরেজিতে।
7-15 A.M. (News in Bengali)
7-25 A.M. (News in English)
৭-৩০ অ. গ. সকাল সাড়ে সাতটা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আজ এগারোই জ্যৈষ্ঠ। বিদ্রোহী কবি নিপীড়িত জনগণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। এ উপলক্ষ্যে এখন কবি রচিত কবিতা থেকে আবৃত্তি ও গান শুনুন অগ্নিশিখা অনুষ্ঠানে।
7.40 A.M. Slogans & Sayings of SK. Mujib
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের গঠন, কাঠামো এবং কার্যাবলীর দিকে একটু নজর দিলেই বোঝা যাবে কী অসাধারণ নেতৃত্বে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন এই সরকার। তাও মাত্র নয় মাস সময়ে। অবশ্যই এটি সম্ভব হয়েছিল গণসমর্থনের কারণে। সাম্প্রতিক কালে কোন দেশে জনগণের এত বড় অংশ এত ব্যাপকভাবে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। এই দেশপ্রেম, ত্যাগ, মুক্তিকামনাকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করে দেশে ও বিদেশে সমর্থনের ব্যবস্থা করে স্বাধীনতা অর্জন করাই ছিল আমাদের বিপ্লবী, প্রবাসী সরকারের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কর্মকর্তা, বিশেষ করে বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানেরা এবং অন্যান্য কর্মকর্তা যেভাবে আত্মপ্রচারে নেমে পড়েছিলেন তার পাশাপাশি তুলনা করুন শহীদ চার নেতার প্রচার বিমুখতা আর বিনয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গঠনঃ মন্ত্রণালয় দপ্তরসমূহ
তৎকালীন মন্ত্রী পরিষদ সচিব ১৯৭১ এর ২০ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংগঠন এবং কার্যাবলীর উপর একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। সেই প্রতিবেদন থেকে এখানে উদ্বৃতি দিলাম। এতে সরকারের কার্যাবলী সম্পর্কে একটি ছবি পাওয়া যাবে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নিম্নলিখিত মন্ত্রণালয়/বিভাগে সংগঠিত করা হয়েছিলঃ
১. প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়
২. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
৩. অর্থ, শিল্প ও বানিজ্য মন্ত্রণালিয়
৪. মন্ত্রীপরিষদ সচিবালয়
৫. সাধারন প্রশাসন বিভাগ
৫৯৯
৬. স্বাস্থ্য ও কল্যান মন্ত্রণালয়
৭. তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়
৮. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
৯. ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়
১০. সংসদ বিষয়ক বিভাগ
১১. কৃষি বিভাগ
১২. প্রকৌশল বিভাগ
মন্ত্রণালয়ের বাইরে আরো কয়েকটি সংস্থা ছিল যারা সরাসরি মন্ত্রী পরিষদের কর্তৃত্বাধীন কাজ করত, যেমন-
১. পরিকল্পনা কমিশন
২. শিল্প ও বানিজ্য বোর্ড
৩. নিয়ন্ত্রণ বোর্ড, যুব ও অভ্যর্থনা শিবির
৪. ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি এবং
৫. শরণার্থী কল্যান বোর্ড
১. প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ স্বয়ং। সশস্ত্র বাহিনী দপ্তর এই মন্ত্রণালয়ের প্রধান ও মূল অংগ সংস্থা। এখানে ছিলেন সেনাপতি (কর্ণেল ওসমানী), সেনাপ্রধান (লে. কর্নেল রব), উপসেনা প্রধান ও বিমান বাহিনী প্রধান (গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার), ডাইরেক্টর জেনারেল, মেডিকেল সার্ভিস (লে. কর্নেল শামসুল হক) এবং বিভিন্ন র্যাংকের স্টাফ অফিসার।
বাংলাদেশের সমস্ত যুদ্ধাঞ্চলকে ১১ টি সেক্টরে বিভক্ত করে অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে ৩ টি ব্রিগেড গঠন করে এস ফোর্স, জেড ফোর্স ও কে ফোর্স নামকরণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সাথে প্রতিরক্ষা প্রশাসনের আরো তিনিটি কাজ সংযুক্ত ছিল।
১. স্নায়ুযুদ্ধ/সংগ্রাম কোষ (Psy-warfare Cell) : তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা রেখে কাজ করত।
২. নিয়মিত বাহিনী ও গণবাহিনীর জন্য চিকিৎসা ও কল্যান সাধন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা রেখে এটি পরিচালনা করা হত।
৩. সশস্ত্র বাহিনী সমূহের জন্য সাহসিকতার পুরস্কার প্রদান।
২. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
ক. বিদেশে মিশন স্থাপন- কলকাতা, দিল্লী, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক ও স্টকহোম।
খ. বিদেশে কূটনৈতিক ততপরতাঃ
১. জাতিসংঘে প্রতিনিধি (ডেলিগেশন) প্রেরণ
৬০০
৩. নেপালে ডেলিগেশন প্রেরণ এবং
৪. সিংহল (শ্রীলংকা), বার্মা এবং অন্যান্য দক্ষিণ পূর্ব দেশে ডেলিগেশন প্রেরণ।
উপরোল্লিখিত দেশসমূহের কয়েকটিতে আশানুরূপ ফল পাওয়া গিয়েছিল।
গ. বাংলাদেশী নাগরিক এবং সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সুইডেন, জাপান ও অন্যান্য কতিপয় দেশের সমর্থন লাভের ঐকান্তিক চেষ্টা চালানো। এসব দেশের অতি অনুকূল সংবাদ শিরোনাম প্রকাশিত হয়েছিল। বিদেশে তহবিল সংগ্রহে ছিল উল্লেখযোগ্য সাফল্য।
ঘ. পাকিস্তানের দূতাবাসে কর্মরত বাংলাদেশী কূতনীতিকদের দলত্যাগ-
ইরাক, ফলিপাইন ও আর্জেন্টিনাস্থ রাষ্ট্রদূত গণের আনুগত্য প্রকাশ। কলকাতা এবং দিল্লী ছাড়াও লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, কাঠমুন্ডু এবং হংকং এ কর্মরত উচ্চপদস্থ কূটনীতিকগণ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন।
ঙ. বিদেশে কর্মরত সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারাও (যুক্তরাষ্ট্রে ৭ জন এবং যুক্তরাজ্যে ২ জন) সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ অনুযায়ী কাজ করেছেন।
চ. বিভিন্ন দেশে আমাদের পক্ষে প্রচারণার জন্য External Publicity জোরদার করা হয়।
আমাদের বড় সাফল্য ছিল বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ব্রিটেনে কূটনৈতিক তৎপরতা এবং প্রবাসী বাংগালিদের সংঘবদ্ধ করে আন্দোলন ও জনমত গঠন।
৩. অর্থ, শিল্প এবং বানিজ্য মন্ত্রণালয়
অর্থ বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়, যেমন-
১. বাজেট প্রণয়নে আয় ও ব্যয়ের হিসাব
২. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও অন্যান্য উৎস থেকে সংগৃহীত সম্পদের হিসেব প্রস্তুত
৩. বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গকে অর্থ প্রদানের দ্বায়িত্ব পালন ও বিধিমালা প্রণয়ন
৪. আর্থিক শৃংখলা প্রবর্তন
৫. রাজস্ব ও শুল্ক আদায়
৬. আর্থিক অনিয়ম তদন্তের জন্য কমিটি গঠন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণাঙ্গ বাজেট ছিল। আয় ব্যয়ের হিসাব সংবলিত এই বাজেটে শুধু সরকারের নয়, বিভিন্ন দপ্তর, অঙ্গ প্রতিষ্ঠান, জোনাল অফিস, যুব ক্যাম্প, শরণার্থী, বেতার, প্রচারণা ইত্যাদির ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা ছিল।
বানিজ্য
স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি বানিজ্য বোর্ড গঠন করা হয়। এই
৬০১
বোর্ড শুধুমাত্র আয়ের উৎস হিসেবেই নয় বরং বাংলাদেশের আর্থিকভাবে টিকে থাকার জন্য বিদেশে পণ্য রপ্তানির বিভিন্ন উৎস অনুসন্ধান করে।
ভারতের সাথে বানিজ্য চুক্তির সম্ভাব্য বিস্তারিত/খুঁটিনাটি বিষয়াদি নির্ধারণের জন্য অর্থ ও বানিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বানিজ্য বোর্ড যুক্তভাবে ভারত সরকার এবং ভারতের রাষ্ট্রীয় ট্রেডিং কর্পোরেশনের সাথে আলোচনা করে। চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর ব্যবহার করতে সক্ষম হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভারতের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানি পণ্য পরিবহন সুবিধাদির ব্যবস্থা সম্পর্কিত বহুবিধ বিষয় সম্পর্কেও তারা আলোচনা করেন। এসব আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়।
৪. মন্ত্রী পরিষদ সচিবালয়
মন্ত্রীপরিষদ সচিব এবং তার অধীনে অতি অল্প সংখ্যক কর্মকর্তা/কর্মচারীর সমন্বয়ে সচিবালয় গঠন করা হয়েছিল। মন্ত্রী পরিষদ সচিবালয়ের দ্বায়িত্বে ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি মন্ত্রী পরিষদের নিকট/সভায় পেশ করা, সিদ্ধান্ত সমূহ লিপিবদ্ধ ও বিতরণ করা, বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ/অনুসরণ এবং মন্ত্রীপরিষদের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয় কিন্তু অন্য কোন মন্ত্রণালয়ের/বিভাগের আওতাধীন নয় এরূপ অন্যান্য বিষয়। মন্ত্রীপরিষদ সচিব রাষ্ট্রপতি সচিবালয়ের দ্বায়িত্বও পালন করেন। আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের অন্যতম দ্বায়িত্ব ছিল।
৫. সাধারণ প্রশাসন/সংস্থাপন
সাধারণ প্রশাসন বিভাগে একজন পূর্ণ সচিব নিয়োজিত ছিলেন। তিনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে কাজ করেন।
এই বিভাগ সরকারের সকল সংস্থাপন বিষয়ক কাজের দ্বায়িত্ব পালন করে, যেমন- প্রবেশন, নিয়োগ, পোস্টিং, বদলি, শৃংখলা ইত্যাদি। এই বিভাগ সরকারি নিয়োগের নীতিমালা বাস্তবায়নের দ্বায়িত্বও পালন করে। মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সংস্থাপন মন্ত্রী (অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী) নিজে সরকারের অধীন ১ম এবং ২য় শ্রেনীর সকল পদে নিয়োগ দান করেন। আঞ্চলিক প্রশাসনিকি কাউন্সিলের অধীনে সকল ১ম এবং ২য় শ্রেনীর পদেওলোক নিয়োগ করাও এই বিভাগের আওতাধীন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনকারী সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীর তালিকা সংরক্ষণ, এই তালিকা বহির্ভূত ব্যক্তিবর্গের নির্বাচন, নিয়োগের জন্য প্যানেল তৈরি করা ইত্যাদি কাজ সাধারণ প্রশাসন বিভাগের দ্বায়িত্ব ছিল।
৬০২
মূল পরিকল্পনার (স্কিমের) অধীনে পাঁচটি অঞ্চল (জোন) সৃষ্টি করা হয়েছিল। পরে পরিকল্পনাটি পরিমার্জন করে আরো ছয়টি অঞ্চল (জোন) সৃষ্টি করা হয়।
দেশব্যাপী সুষ্ঠু প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য জুলাই মাসে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১ টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করে সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণাকারী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে আঞ্চলিক চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হয়। প্রতিটি অঞ্চলে একজন করে আঞ্চলিক প্রশাসকও নিয়োগ করা হয়। এই প্রসশাসক গণ কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ও নিয়ন্ত্রিত ছিলেন। শরণার্থী সমস্যা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সামরিক বেসামরিক বিষয়াবলীর সুষ্ঠু সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণভার এই প্রশাসনিক অঞ্চল গুলোর উপর ন্যস্ত হয়। আঞ্চলিক চেয়ারম্যান তাদের অধীনস্ত অঞ্চলের (দেশের ভেতরে ও বাইরে) রাজনৈতিক সমন্বয়কারী হিসেবে সরকার কর্তৃক দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত হন। প্রতিটি প্রশাসনিক অঞ্চল বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নিম্নবর্ণিত কর্মকর্তাদের নিয়োগ দান করেনঃ
ক. আঞ্চলিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা
খ. আঞ্চলিক শিক্ষা কর্মকর্তা
গ. আঞ্চলিক প্রকৌশল কর্মকর্তা
ঘ. আঞ্চলিক পুলিশ কর্মকর্তা
ঙ. আঞ্চলিক তথ্য কর্মকর্তা
চ. আঞ্চলিক হিসাব কর্মকর্তা
উল্লিখিত কর্মকর্তাগণ স্ব স্ব মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতেন। আঞ্চলিক প্রশাসকগণ প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন।
প্রত্যেক আঞ্চলিক চেয়ারম্যান তাঁর অধীনস্ত রাজনৈতিক এলাকা সুষ্ঠু সমন্বয়ের জন্য উপ অঞ্চলে বিভক্ত করে উপদেষ্টা বা উপ-আঞ্চলিক চেয়ারম্যান নিয়োগ করার অধিকারী ছিলেন। এটি সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত ছিল।
জোনাল কাউন্সিলের বিশেষ দ্বায়িত্ব
১. মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে কাজের সমন্বয় সাধন ও পূর্ণ সহযোগিতা করা।
২. মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প গুলো পরিচালনা এবং সতর্কতার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট ও ট্রেনিং এ পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
৩. শরণার্থীদের দেখাশোনা ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজের সমন্বয় সাধন করা।
৪. তথ্য দপ্তর থেকে প্রকাশিত হাজার হাজার পুস্তিকা, প্রচারপত্র ও পোস্টার শরনার্থী ক্যাম্পগুলো ছাড়াও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিতরণের ব্যবস্থা করা।
৬০৩
হানাদার দখলিকৃত অঞ্চল থেকে কোন সরকারি কর্মচারী এসে হাজির হলে তার নাম ও পরিচয় লিপিবদ্ধ করে যোগ্যতা অনুসারে কাজে লাগানো ও বেতনের ব্যবস্থা করা।
বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর শাসনভার গ্রহন করার পূর্ব পর্যন্ত এই প্রশাসনিক কাঠামো কার্যকর ছিল।
মুজিবনগর সরকারের আঞ্চলিক কাঠামো
প্রশাসনিক অঞ্চল আঞ্চলিক চেয়ারম্যান আঞ্চলিক প্রশাসক আঞ্চলিক সদর দপ্তর
দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল-১ নূরুল ইসলাম চৌধুরী এসএ সামাদ সাবরুম
দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল-২ জহুর আহমেদ চৌধুরী কাজী রকিব উদ্দিন আগরতলা
পূর্ব অঞ্চল কর্নেল এমএ রব ডা. কে এ হাসান ধর্মনগর
উত্ত-পূর্ব অঞ্চল দেওয়ান ফরিদ গাজী এসএইচ চৌধুরী ডাউকি
উত্তর-পূর্ব অঞ্চল-২ শামসুর রহমান খান লুতফর রহমান তুরা
উত্তর অঞ্চল মতিউর রহমান ফয়েজউদ্দিন আহমেদ কোচবিহার
পশ্চিম অঞ্চল-১ মো. আব্দুর রহিম এমএ কাশেম খান বালুরঘাট
পশ্চিম অঞ্চল-২ আশরাফুল ইসলাম মিয়া জহুরুল ইসলাম ভূঁইয়া মালদহ
দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল-১ আব্দুর রউফ চৌধুরী শামসুল হক কৃষ্ণনগর
দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল-২ ফণীভূষণ মজুমদার বিবি বিশ্বাস বনগাঁও
দক্ষিণ অঞ্চল আব্দুর রব সেরনিয়াবত এ মমিন বারাসাত
৬. স্বাস্থ্য ও কল্যান মন্ত্রণালয়
প্রাথমিকভাবে একজন মহাপরিচালকের (ডাইরেক্টর জেনারেল) অধীনে এই বিভাগ গঠন করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে মহাপরিচালক কে সরকারের সচিবের পদমর্যাদা প্রদান করা হয়।
এই বিভাগের কার্যাবলী দুটি পৃথক ক্যাটাগরির অধীনে সংগঠিত করা হয়। যাথা- ১. সেনাবাহিনীর জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং ২. বেসরকারি চিকিৎসা সেবা।
১. প্রতিরক্ষা বিভাগের চিকিৎসা সেবার জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থাদি গ্রহন করা হয়।
ক. সার্জন ও চিকিৎসকদের ব্যবস্থা করা
খ. আহত/মৃত ব্যক্তিদের জন্য পরিবহন
গ. ঔষধপত্র
ঘ. শল্য চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি
ঙ. মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসা দল (ফিল্ড মেডিক্যাল ইউনিট সমূহ) যেমন- অ্যাডভান্স ড্রেসিং স্টেশন সমূহ (এডিএস) এবং মেইন ড্রেসিং স্টেশন সমূহ (এমডিএস)
৬০৪
চ. আরোগ্যের পর বিশ্রামাগার (কনভ্যালেন্সেস হোমস) : যুদ্ধরত সৈনিকদের শুশ্রুষার জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থাদি গ্রহন করা হয়ঃ
১. শহীদদের উপর নির্ভরশীল দের জন্য গাড়ি
২. সম্পূর্ণরূপে অক্ষমদের জন্য পেনশন/ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা এবং
৩. আংশিক অক্ষমদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করা।
উপরোক্ত কাজের জন্য অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থাও করা হয় (প্রায় দশ লক্ষ রুপি)।
বেসরকারি খাতে, বাংলাদেশের নাগরিকদিগকে চিকিৎসা সুবিধা প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই কাজের জন্য ৯,৫০,০০০.০০০ রুপি নির্দিষ্ট করা হয়।
স্বাস্থ্যসচিব বাংলাদেশী চিকিৎসকদের বিভিন্ন কাজের ব্যবস্থা করেন। উদ্বাস্তু শিবিরের তত্ত্বাবধানের জন্য ভারত সরকার এই চিকিৎসক দের নিয়োগ করেছিলেন। বিভিন্ন বন্ধুসুলভ সংস্থা থেকে অনুদান হিসেবে ওষুধ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহ এবং রিকুইজিশনের ভিত্তিতে বিভিন্ন সেক্টরে সেগুলো পাঠানোর দ্বায়িত্বও ছিল স্বাস্থ্য বিভাগের। বিভিন্ন সেক্টরের জন্য সরঞ্জামাদি, অ্যাম্বুলেন্স ইত্যাদি বন্ধু দেশগুলো থেকে পাওয়া না গেলে সেগুলো স্নজ্ঞ্রহের দ্বায়িত্বও স্বাস্থ্য বিভাগের উপর অর্পণ করা হয়।
তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়
স্বাধীন বাংলা বেতার সরকারের অধীন সর্বপ্রথম সংস্থা সমূহের অন্যতম। প্রাথমিক অবস্থায়, মি. আবদুল মান্নান এমএনএর সরাসরি তত্ত্বাবধানে রেডিও স্থাপন করা হয়। প্রাক্তন রেডিও পাকিস্তানের যেসব ব্যক্তি আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন তাদের মধ্যে থেকে কর্মসূচি প্রণয়ন, প্রোগ্রামিং এবং সম্প্রচারের (ব্রডকাস্টিং) জন্য লোক নিয়োগ করা হয়েছিল। ক্রমে ক্রমে শিল্পী ও প্রকৌশলী আমাদের সাথে যোগ দেবার ফলে বেতারের কার্যক্রমের (আউটপুট) উন্নতি সাধিত হয়। স্বাধীন বাংলা বেতারে ১০০ এর অধিক লোক নিয়োগ করা হয়েছিল। বেতার আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রচারমাধ্যম বিধায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কেবল যুদ্ধ পরিচালনার পরেই এর স্থান। সরকার সবসময় এর জন্য বিশেষ আর্থিক সাহায্য দিয়েছে।
তথ্য ও বেতার (সম্প্রচার) মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত অন্যান্য সংস্থাগুলো হলঃ
ক. চলচ্চিত্র পরিচালক
খ. প্রকাশনা পরিচালক এবং
গ. চারুকলা ও ডিজাইন পরিচালক
৮. স্বাধীন বাংলা বেতার
২৫ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে আনুষ্ঠানিকভাবে
৬০৫
কার্যক্রম শুরু হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম দিনের অনুষ্ঠান সূচিতে ছিল কোরআন তেলাওয়াত, মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ অনুষ্ঠান ‘অগ্নিশিখা’, সাহিত্যের অনুষ্ঠান ‘রক্তস্বাক্ষর’, বঙ্গবন্ধুর ভাষণভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘বজ্রকন্ঠ’, বাংলা ও ইংরেজি সংবাদ এবং চরমপত্র। কামাল লোহানী সংবাদ সংগঠনের দ্বায়িত্ব নেন। কোরআন তেলাওয়াত করেন ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী। হাসান ইমাম সালেহ আহমদ ছদ্মনাম নিয়ে বাংলা খবর পড়েন। ইংরেজি খবর পড়েন পারভিন হোসেন। মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা টি হোসেনের স্ত্রি মিসেস টি হোসেন পারভিন ছদ্মনামে পড়েন ইংরেজি খবর। বাংলা সংবাদের ইংরেজি অনুবাদের পান্ডুলিপি তৈরি করেন এ টি এম কামাল উদ্দিন আহমেদ। মিডিয়াম ওয়েভ ৩৬১.৪৪ মিটার ব্র্যান্ডে প্রতি সেকেন্ডে ৮৩০ কিলোসাইকেলে ভেসে আসত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আহবান। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে যে বাড়িতে কলকাতায় আসার পর তাজউদ্দিন সাহেব প্রথম উঠেছিলেন তারই একটি কক্ষে চাদর কাপড় ঝুলিয়ে সাউন্ড প্রুফ রেকর্ডিং এর জন্য সম্বল ছিল দুটো ভাঙা টেপ রেকর্ডার। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে অনুষ্ঠান ধারণ করা হলেও তা প্রক্ষেপণ করা হয় ৩৯ সুন্দরী মোহন স্ট্রিটের ৮ তলা বাড়ির ছাদের ওপর থেকে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার এই উদ্যোগ শুরু হয় বালু হাককাক লেনে জয়বাংলা পত্রিকার অফিসে এপ্রিল মাসে। তৎকালীন টাঙ্গাইলের এমপি বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল মান্নান বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বৈঠক ডাকেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে। এর আগে ভারত সরকারের কাছ থেকে ৫০ কিলোওয়াটের একটি ট্রান্সমিটার যন্ত্র পাওয়া গিয়েছিল।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্নায়ুযুদ্ধ কোষ (Psy Warfare Cell) তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার কাজ করে। সরকারের বহির্বিশ্বে সম্প্রচারের দ্বায়িত্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপর ন্যস্ত। এই শাখা পুস্তিকা, প্যামপ্লেট, ব্রশিউর ইত্যাদি বহুসংখ্যক প্রকাশনা বের করেছে। এগুলো আমাদের বৈদেশিক সম্প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশের কতিপয় প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীও বাংলাদেশে এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে বহুবিধ বিষয়ে পুস্তক-পুস্তিকা রচনা/প্রকাশ করেছেন।
সকল দিকে আমাদের প্রচার জোরদার করার উদ্দশ্যে মিত্র সরকার সমূহের অধীনস্ত তথ্য সংস্থা প্রধানদের সাথে পর্যায়ক্রমিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এই বিভাগের কার্যাবলি দেখার জন্য মি. আনোয়ারুল হক খানকে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ করা হয়। মি. আবদুল মান্নান এমএনএর সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় তিনি কাজ করতেন।
৯. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
৬০৬
এটি একজন পূর্ণ সচিবের অধীনে সংগঠিত ছিল। প্রথম দিকে পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল এই বিভাগের কার্যাবলী সম্পাদন করছিলেন। তথ্য সংগ্রহ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার নিকট সেগুলো প্রেরণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রধান কাজ ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ৪ টি রেঞ্জের জন্য ৪ জন ডিআইজি এবং প্রতি জেলার জন্য একজন এসপি নিয়োগ করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল সমূহের দ্বায়িত্বও পালন করেন। তাঁর মন্ত্রণালয় অন্যান্য কাজের সাথে নিম্নোক্ত কার্যাবলি সম্পাদন করেঃ
ক. অবমুক্ত এলাকার প্রশাসনিক কাঠামো
খ. ভ্রমন ডকুমেন্ট ইস্যু করা এবং
গ. তদন্ত অনুষ্ঠান
১০. ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ
একটি রিলিফ কমিশনের অধীনে সংগঠিত যিনি সরাসরি স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণমন্ত্রীর অধীনে কাজ করেন। ত্রাণের জন্য গৃহীত বিভিন্ন প্রকার আবেদনপত্রসমূহ নিখুঁতভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বিশেষ ক্ষেত্রে বাংলাদেশী নাগরিকদিগকে সাহায্য করে এই বিভাগ। জোনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাঠামোর কাউন্সিলের মধ্যে জোনাল রিলিফ অফিস সমূহের ব্যবস্থা করে ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ।
এই মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ শিক্ষক মন্ডলীর রিলিফের ব্যবস্থাও করেছে। উদ্বাস্তু শিবিরের শিশুদের উপকারার্থে বাংলাদেশ শিক্ষকদের সেবা কাজে লাগানোর জন্য বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সহযোগিতায়, যার নির্বাহি প্রেসিডেন্ট ছিলেন মি. কামরুজ্জামান এমএনএ, ক্যাম্প স্কুল সমূহের জন্য একটি স্কিম প্রণয়ন এবং আংশিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়।
১১. সংসদীয় বিষয়ক বিভাগ (পার্লামেন্টারি অ্যাফেয়ার্স ডিভিশন)
পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে এটি দেখাশোনা করতেন। নির্বাচিত প্রতিনিধি সমস্যাদি সমাধানের দ্বায়িত্ব পালন করেছে এই বিভাগ।
১২. কৃষি বিভাগ
এই বিভাগ পুরোপুরি সংগঠিত ছিলনা। কেবল একজন সচিব নিয়োগ করা হয়েছিল যিনি স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের নীলনকশা তৈরি করার দ্বায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
১৩. প্রকৌশল বিভাগ
একজন প্রধান প্রকৌশলী (চিফ ইঞ্জিনিয়ার) নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁর অধীনস্ত জোনাল ইঞ্জিনিয়ারদের সেক্টর কমান্ডারদের প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করার জন্য পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা মুক্ত এলাকার প্রকৌশল বিষয়ক সমস্যাদির সমাধানের দ্বায়িত্বও পালন করতেন।
৬০৭
১৪. পরিকল্পনা (প্ল্যানিং) কমিশন
সরকার পূর্ববর্তী পরিকল্পনা কোষকে একটি পূর্নাঙ্গ পরিকল্পনা কমিশনে সংগঠিত করেছে। ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরীকে নিম্নলিখিত সদস্যবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত কমিশনের চেয়্যারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিলঃ
ক. ড. খান সারওয়ার মুর্শিদ
খ. ড. মোশাররফ হোসেন
গ. ড. এস আর বোস এবং
ঘ. ড. আনিসুজ্জামান
কমিশন বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের মধ্যে থেকে এর নিজস্ব কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ করেছেন।
কমিশনের ওপর নিম্নোক্ত কার্যাবলির দ্বায়িত্বভার অর্পন করা হয়।
ক. বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র (মেনিফেস্টো) এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং আওয়ামী লীগের উর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দ (হাইকমান্ড) কর্তৃক প্রণীত উদ্দেশ্যাবলির ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন।
খ. দেশ ও অর্থনিতির পুনর্গঠনের জন্য মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন। এই পরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে এবং
গ. যেহেতু পুনর্গঠন একটি অতি বৃহৎ কাজ হবে এবং এই সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সরকারের পক্ষে কোনরূপ কালক্ষেপণ করা যাবেনা, যেহেতু আমাদের সকল পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিয়ে আমাদের এখনই প্রস্তুত থাকতে হবে সেহেতু পরিকল্পনা পড়ণয়ন বাস্তব অর্থেই অতি জরুরি হিসেবে গণ্য হয়েছে। দেশের তাৎক্ষণিক পুনর্গঠনের জন্য নিচের সমস্যাদির দিকে মনোযোগ দিতে হয়েছেঃ
ক. বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের সমস্যা
খ. উচ্ছেদকৃত লোকদের বাসস্থান সমস্যা
গ. খাদ্য সরবরাহ
ঘ. যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন
ঙ. সাধারণ সুবিধাদি, যেমন- স্বাস্থ্য, বিদ্যুত, পানি, হাসপাতাল ইত্যাদির পুনর্বাসন
চ. ক্ষতিগ্রস্ত সকল বন্দর, কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি পুনরায় চালু করা
ছ. আইনশৃংখলা ফিরিয়ে আনা
জ. শিক্ষার সুযোগ সুবিধাদি পুনঃস্থাপন
ঝ. যতটুকু সম্ভব মুক্তিবাহিনীতে যোগদানকারী যুবকদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা
ঞ. সরকারের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী ব্যাংক, ইন্সুরেন্স ও অন্যান্য আর্থিক
৬০৮
প্রতিষ্ঠান জাতীয় করণ আরম্ভ করা
ট. ব্যবসা ও বানিজ্যের পুনর্বাসন
ঠ. দেশের ভবিষ্যৎ বানিজ্য ইত্যাদি পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারকে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ প্রদান করত।
১৫. বানিজ্য বোর্ড
বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের অশীনে ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে।
১৬. যুব ও অভ্যর্থনা শিবিরসমূহের নিয়ন্ত্রণ বোর্ড
এই বোর্ডের প্রধান হলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী, এমএনঅএ। পুনর্গঠিত কাঠামো অনুযায়ী যুবশিবির পরিদপ্তর (ইয়ুথ ক্যাম্প ডাইরেক্টরেট) অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত হয়। প্রধানমন্ত্রী যুবশিবিরগুলো তত্ত্বাবধানের দ্বায়িত্ব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপর অর্পন করেন, যিনি বোর্ড অফ কন্ট্রোল ফর ইয়ুথ অ্যান্ড রিসেপশন ক্যাম্পের সাহায্য ও সহযোগিতার দ্বায়িত্ব পালন করেন।
ঐ সময় ২৪ টি যুব শিবির ও ১১২ টি অভ্যর্থনা শিবির ছিল। বোর্ড অনুমোদিত বাজেটের ভিত্তিতে ইয়ুথ ও রিসেপশন ক্যাম্প সমূহের চাহিদা মেটাতেন। ব্যাপক আকারে ইয়ুথ ক্যাম্প ইউনিটগুলোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নিয়মিত ভাবে যুব ক্যাম্প থেকে ছেলেদের এনে গেরিলা বাহিনীতে ভর্তি করা হয়। যুবকদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, যেমন বিছানাপত্র, গরম পোষাক, কম্বল ইত্যাদির ব্যবস্থা বন্ধু সংস্থাসমূহ এবং আমাদের নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাদি থেকে করা হয়েছে।
১৭. ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি
এই কমিটির প্রধান হলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তিনি বাংলাদেশী উদ্বাস্তুদের দেখাশোনার দ্ব্যিত্ব পালন করেন।
১৮. উদ্বাস্তু কল্যান বোর্ড
একজন চেয়্যারম্যান নিয়োগ করা হয়েছিল।
সরকারের কার্যক্রমের বাইরে বাংলাদেশের নাগরিকগণ নিচের তিনটি সমিতি গঠন করেছিলেনঃ
১. বাংলাদেশ রেডক্রস সমিতি (ড. আসহাবুক হক, এমপিএ)
২. বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (মি. কামরুজ্জামান, এমএনএ)
৩. বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা (মি. আমিনুল ইসলাম, এমএনএ)
(বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোর)।
আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রীসভা শপথ গ্রহনের পর এক নজরে প্রবাসী সরকারঃ
রাষ্ট্রপতি : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
(পাকিস্তান সামরিক জান্তার হাতে আটক)
উপ রাষ্ট্রপতি : সৈয়দ নজরুল ইসলাম (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং পদাধিকার বলে সশস্ত্র
ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দ্বায়িত্ব গ্রহন)
৬০৯
প্রাধানমন্ত্রী : তাজউদ্দিন আহমদ
অর্থমন্ত্রী : এম মনসুর আলী
স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী : এ এইচ এম কামরুজ্জামান
পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী : খন্দকার মোশতাক আহমদ
প্রধান সেনাপতি : কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) ওসমানী, এমএনএ
চিফ অফ স্টাফ : কর্নেল (অব) আবদুর রব
বিমান বাহিনীর প্রধান এবং ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ : গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার
বিশেষ দ্বায়িত্বে নিয়োজিত গণপ্রতিনিধিবৃন্দ
সাহায্য ও পুনর্বাসন : অধ্যাপক ইউসুফ আলী, এমঅএনএ
তথ্য, বেতারো প্রচার : আবদুল মান্নান, এমএনএ
ভলান্টিয়ার কোর : আমিরুল ইসলাম এমএনএ
বানিজ্য বিষয়ক বিষয়াদি : মতিউর রহমান। এমএনএ
অস্থায়ী সচিবালয়ের সরকারি কর্মচারী বৃন্দ
সেক্রেটারি জেনারেল : রুহুল কুদ্দুস
ক্যাবিনেট সচিব : হোসেন তওফিক ইমাম
অর্থ সচিব : খিন্দকার আসাদুজ্জামান
প্রতিরক্ষা সচিব : আবদুস সামাদ
পররাষ্ট্র সচিব : মাহবুবুল আলম চাষি (নভেম্বর ১৯৭১, পদচ্যুত)
তথ্য ও বেতার সচিব : আনোয়ারুল হক খান
সংস্থাপন সচিব : নূরুল কাদের খান
কৃষিসচিব : নূরুদ্দীন আহমদ
স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ প্রধান : আবদুল খালেক
বহির্বিশ্বে বিশেষ দূত : বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী
নয়াদিল্লীতে মিশন প্রধান : হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী
কলকাতায় মিশন প্রধান : হোসেন আলী
পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান্ম : ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যবৃন্দ : ড. মোশাররফ হোসেন
: ড. খান সরওয়ার মুর্শিদ
: ড. স্বদেশ রঞ্জন বোস
৬১০
: ড. আনিসুজ্জামান
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির প্রধান : ড. এ আর মল্লিক
ইয়ুথ ক্যাম্প পরিচালক : উইং কমান্ডার এস আর মির্জা
পরিচালক আর্টস ও ডিজাইন : কামরুল হাসান
পরিচালক ও তথ্য প্রচার দপ্তর : এম আর আখতার মুকুল
পরিভচালক বেতার কেন্দ্র : শূন্য
পরিচালক, চলচ্চিত্র বিভাগ : আবদুল জব্বার খান
পরিচালক, স্বাস্থ্য দপ্তর : ডাক্তার টি হোসেন
সহকারী পরিচালক, স্বাস্থ্য দপ্তর : ডাক্তার আহমদ আলী
রিলিফ কমিশনার : শ্রী জেজি ভৌমিক
উপসচিব, দেশরক্ষা মন্ত্রণালয় : আকবর আলী খান
উপসচিব, সংস্থাপন মন্ত্রণালয় : ওয়ালিউল ইসলাম
উপ সচিব, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় : খোরশেদুজ্জামান চৌধুরী
ট্রন্সপোর্ট অফিসার : এম এইচ সিদ্দিকী
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব : কাজী লুৎফুল হক
প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব : ড. ফারুক আজিজ খান
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব : মামুনুর রশীদ
অর্থমন্ত্রীর একান্ত সচিব : সা’দত হোসাইন
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব : কামাল সিদ্দিকী
প্রধানমন্ত্রীর স্টাফ অফিসার : মেজর নূরুল ইসলাম শিশু
প্রধানমন্ত্রীর পি আর ও : আলী তারেক
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পি আর ও : রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পি আর ও : কুমার শংকর হাজরা
প্রধান সেনাপতির দুজন এডিসি : ক্যাপ্টেন নূর ও শেখ কামাল
প্রধান সেনাপতির পি আর ও : মোস্তফা আল্লামা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অফিসার : জাওয়াদুল করিম ও আমিনুল হক বাদশা
স্বাধীনতা
‘স্বাধীনতা’ কবি অরুনাভ সরকার সম্পাদিত ৪ পৃষ্ঠার পত্রিকা। এ সংক্রান্ত আর অন্য কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
৬১১
স্বাধীনতা (প্রতিরোধ)
‘স্বাধীনতা (প্রতিরোধ)’ নামক কাগজটি পাক্ষিক ছিল এবং এর নির্দিষ্ট কোন সম্পাদক ছিলনা। পত্রিকা প্রকাশনা ও লেখালিখির সাথে যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, কুতুবুর রহমান। ঢাকা থেকে সাইক্লোস্টাইলে প্রকাশিত হয়। প্রথম দিকে পত্রিকাটির নাম স্বাধীনতা থাকলেও পরে বদলে প্রতিরোধ করা হয়। মোট ৬-৭ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
স্বাধীনতা/না হয় মৃত্যু
এই পোস্টারটি ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষে মুজিবনগর থেকে মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি জনাব নুরুল ইসলাম প্রকাশ করেন। তিনি ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগের মাধ্যমে এই পোস্টারটি পৃথিবীর বহু দেশে প্রেরণ করেন। এই পোস্টারটি মুক্তিযোদ্ধাদের ও বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। বঙ্গবন্ধুর তর্জনী উঁচু করে নির্দেশের ভঙ্গিমার ছবিটিই এখানের মূল আবেদন। এই পোস্টারটি মনে হচ্ছে বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিচ্ছেন স্বাধীনতা অর্জন করতেই হবে। , এতে যদি মৃত্যুও হয়, হবে। কারণ বর্বর পাকিস্তানিদের হাতে অধীনতার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত স্বাধীনতা অর্জন না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত প্রতিটি বাঙালি জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করবে এটাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ। এই পোস্টারটি প্রকৃতপক্ষে সংগ্রামী বাঙালিদের মনস্তাত্ত্বিক শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই প্রকাশ করা হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। তার প্রতিটি নির্দেশই সংগ্রামী বাঙালির প্রেরণা। এই কারণে বঙ্গবন্ধুর ছবি ও বানীর ব্যবহার করা হয়েছে। মূল পোস্টারটি সংগৃহীত অবস্থায় না পাওয়াতে এর আকার ও রঙ নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব হলোনে।
স্বাধীনতা বিরোধী তৎপরতাঃ অবরুদ্ধ বাংলাদেশ
একাত্তর সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত্রি থেকে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাত্মক সামরিক অভিযান, গণহত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসলীলা, লুন্ঠন, ধর্ষণ ইত্যাদি মানবতাবিরোধী নৃশংস বর্বরতা ও পৈশাচিক কর্মকান্ড শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সমগ্র বাঙালি জাতি তার অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে সংগ্রাম বাংলাদেশের ভিতরে সীমাবদ্ধ থাকেনি, সীমান্তের ওপারে, পাকিস্তানে আটকে পড়া এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসী বাঙালিরা নানাভাবে সে সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করে। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ছিল এবং তা বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছু বঙ্গ সন্তানের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। পলাশীর যুদ্ধের
৬১২
ইতিহাসে নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার নামের সাথে শুধু বীর সেনাপতি মোহনলালের নামই উচ্চারিত হয়না, সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাসঘাতক সিপাহশালার মীরজাফর এবং সিরাজ উদ্দৌলার হত্যাকারী মোহাম্মাদী বেগের নামও ঘৃণাভরে উল্লেখিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও তেমনি বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম বা বীর প্রপ্তীকদের নামের সাথে সাথে অনেক দালাল, রাজাকার, আলবদর, আল শামস ও শান্তি কমিটির সদস্যদের নাম এসে পড়ে। আলোচ্য নিবন্ধে অতি সংক্ষেপে মুক্তিযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ বাংলাদেশের কতিপয় রাজনৈতিক নেতার কার্যকলাপ তুলে ধরা হচ্ছে। নিম্নে প্রদত্ত তথ্যসমূহ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাঙালাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রের সপ্তম খন্ড থেকে গৃহীত।
একাত্তরের ২৫ মার্চের মাত্র ১০ দিনেরে মধ্যে ৪ এপ্রিল জনাব নূরুল আমিনের নেতৃত্বে ১২ জন রাজনীতিক জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রেস রিলিজ অনুসারে ঐ দলে ছিলেন মৌলভী ফরিদ আহমদ, অধ্যাপক গোলাম আযম, খাজা খায়ের উদ্দিন, জনাব শফিকুল ইসলাম, মওলানা নুরুজ্জামান প্রমুখ। ৬ এপ্রিল আরো কয়েকজন রাজনীতিক জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেনেবং পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন। জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে যারা পৃথক পৃথক ভাবে দেখা করেন, তাদের মধ্যে ছিলেন জনাব হামিদুল হক চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামী সভাপতি অধ্যাপক গোলাম আযম, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সভাপতি পীর মোহসেন উদ্দিন (দুদু মিয়া) ও অ্যাডভোকেট এ কে সাদী। জনাব আবদুস সবুর খান ৭ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন। টিক্কা খানের সঙ্গে যোগাযোগের পর তথাকথিত ‘শান্তি কমিটি’ গঠিত হয়।
৯ এপ্রিল, ১৯৭১ খাজা খয়েরউদ্দিনকে আহবায়ক করে ১০৪ সদস্য বিশিষ্ট শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল। কমিটির প্রথম পদক্ষেপ ছিল পাক বাহিনীর কার্যকলাপের সমর্থনে বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে চক মসজিদ পর্যন্ত একটি শোভাযাত্রা বের করা। কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিল এ কিউ এম শফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক গোলাম আযম, মওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম, আবদুল জব্বার খদ্দর, মাহমুদ আলী, এ কে রফিকুল হোসেন, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া), আবুল কাশেম, ফরিদ আহাম্মদ, অধ্যাপক গোলাম সরওয়ার, সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া), এস এম সোলায়মান, পীর মোহসেন উদ্দিন (দুদু মিয়া), অ্যাডভোকেট শফিকুর রহমান, মেজর আফসার উদ্দিন, সৈয়দ মোহসেন আলী, অ্যাডভোকেট ফজলুল হক চৌধুরী, আলহাজ সিরাজ উদ্দিন, অ্যাডভোকেট আতাউল হক খান, অ্যাডভোকেট এ টি সাদী, মকবুলুর রহমান, আলহাজ মোহাম্মাদ আকিল, অধ্যক্ষ রুহুল কুদ্দুস, নুরুল রহমান, ‘ইয়ং পাকিস্তান’ সম্পাদক মওলানা মফিজুল হক, অ্যাডভোকেট আবু সালেক, অ্যাডভোকেট আবদুল নইম প্রমুখ। ১৫ এপ্রিল শান্তি কমিটির নতুন নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি’
৬১৩
এবং ২১ সদস্য বিশিষ্ঠ একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়। জনাব নুরুল আমীনের নেতৃত্বে শান্তি কমিটির একটি প্রতিনিধিদল ১৬ এপ্রিল জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১৮ এপ্রিল মওলানা সাইদ মাহমুদ আর মুস্তফা আল মাদানীর নেতৃত্বে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলামের একটি প্রতিনিধিদল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে। ১৯ এপ্রিল টিক্কা খানের কাছে যায় কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী। ইতিমধ্যে ১৫ এপ্রিল তারিখে ‘পূর্ব পাকিস্তান শান্তি ও জনকল্যান স্টিয়ারিং কমিটি’র প্রথম বৈঠকে ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সময়োচিত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ায় গভীর সন্তোষ প্রকাশ করা হয়’ এবং উৎসাহীদের কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদকের সাথে ধানমন্ডির ৫ নম্বর রোড, ১২ নম্বর বাড়িতে যোগাযোগ করতে বলা হয়। ঐ বৈঠকে সভাপতিত্ব করে মওলানা ফরিদ আহাম্মদ, সংস্থার লক্ষ্য ব্যাখ্যা করে সাধারণ সম্পাদক মওলানা নুরুজ্জামান। বৈঠকে উপস্থিত ছিল মওলানা ওয়াজি উল্লাহ খান, মোহাম্মদ আলী সরকার, মুস্তাফিজুর রহমান, মওলানা নুরুজ্জামান এবং আজিজুর রহমান খান। জনাব আবুল ফয়েজ বোখারি, আবদুর রশীদ ও ডক্টর আবদুর রফিককে সদস্য কোঅপট করা হয়।
ইতিমধ্যে ঢাকা মগবাজারস্থ ৩ নম্বর এলিফ্যান্ট লেনে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির অফিস খোলা হয় এবং অ্যাডভোকেট নুরুল হক্মজুমদারকে দফতর সম্পাদক করা হয়। শান্তি কমিটির বিভিন্ন কাজের মধ্যে একটি ছিল বাঙালি নিধনে অভিযানরত পাকসেনাদের বিভিন্ন স্থানে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন, যেমন মেজর আবেদের নেতৃত্বে পাকবাহিনী ৯ মে মুন্সীগঞ্জ শহরে অভিযানকালে তাদের অভ্যর্থনা জানান মুন্সিগঞ্জ শান্তি কমিটির চেয়্যারম্যান আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী। পরে পাকসেনা দলের অভিযান মুন্সিগঞ্জের অভ্যন্তরে টঙ্গীবাড়ি, সিরাজদিখান, রামপাল, মাওয়া, ভাগ্যকুল, কুমারভোগ, লৌহজং প্রভৃতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে সম্প্রসারিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম মাস থেকেই এভাবে শান্তি কমিটির সদস্যরা পাকিস্তান বাহিনীর বাঙালি নিধন অভিযানে সাহায্য ও সহযোগিতা যোগায়।
যেসব রাজনীতিবিদ সংবাদপত্রে বিবৃতিদান করে মুক্রিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা যজ্ঞকে সমর্থন জানায়, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টিরভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব মাহমুদ আলী। ৭ এপ্রিল ১৯৭১ সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী সকল দেশপ্রেমিক মানুষের কাছ থেকে পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতার দাবী রাখে।’ বিশিষ্ট অ্যাডভোকেট জনাব হামিদুল হক চৌধুরীও একই তারিখে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিবৃতিকে অভিনন্দন জানায়। ৮ এপ্রিল প্রকাশিত এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রেসিডেন্ট পীর মোহসেন উদ্দিন (দুদু মিয়া) সকলকে
৬১৪
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার অনুরোধ জানান। পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ইত্তেহাদুল উলেমার সাধারণ সম্পাদক মওলানা মিয়া মফিজুল হক যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সামরিক কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানিয়ে একই তারিখে সংবাদপত্রে বিবৃতি দেয়। পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগের ১১ জন নেতা ৮ এপ্রিল সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দান করে ভারতীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের সংগ্রামের সমর্থনে প্রস্তাব পাস করায় বিষোদগার করে। ঐ বিবৃতিতে স্বাক্ষরদাতা ছিল মুসলিম লীগের সভাপতি কিউ এম শফিকুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম, প্রাদেশিক সভাপতি সৈয়দ খাজা খয়েরউদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আতাউল হক খান, যগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুরুল হক মজুমদার, শহর লীগের সভাপতি মোহাম্মদ সেরাজউদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম মজিবুল হক, ঢাকা জেলা লীগের সম্পাদক কে এম সেরাজুল হক, জেলা লীগের সম্পাদক নেজামুদ্দিন এবং শহর লীগের সম্পাদক অ্যাডভোকেট এ মতিন। পাকিস্তান মুসলিম লীগের (কাইয়ুম গ্রুপ) প্রধান সংগঠক কাজী আবদুল কাদের ৮ এপ্রিল করাচিতে এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমান ও বেআইনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের নিন্দা করে। মৌলভী ফরিদ আহমেদ ১৬ এপ্রিল প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলে, ‘ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতেই সেনাবাহিনী এই সমস্ত লোক উচ্ছেদ করে পরিস্থিতি আয়ত্তে এনেছে। এদেরই হিন্দুস্থানি গুন্ডারা বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী বলে উল্লেখ করছে।’ শাহ আজিজুর রহমান ৪ মে সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিবৃতিতে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা দান করার জন্য জনগণের প্রতি আবেদন জানায়। পাকিস্তান মরকাজী জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলামের ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট মো. আতাহার আলী ৮ জুলাই প্রকাশিত এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের নিরাপত্তা, সংহতি ও সমৃদ্ধির জন্য উদ্যমের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করার আহবান জানাইয়।
৮ জুলাই ‘লন্ডন টাইম’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক পত্রে দুইজন শিক্ষাবিদ ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন ও ড. মোহর আলী ‘পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই’ এ কথার প্রতিবাদ জানায়। বুদ্ধিজীবীদের পাইকারি হত্যা করা হয়েছে বলে যে কাহিনী প্রচারিত হয়েছে তাও তারা অস্বীকার করে। চিঠিতে অবশ্য তারা স্বীকার করে যে, ‘মার্চের ২৫ এবং ২৬ তারিখে জগন্নাথ ও ইকবাল হলের আশেপাশের এলাকায় যুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষক প্রাণ হারিয়েছেন। চিঠিতে তারা লেখে, আমাদের ৩ জন সহযোগী প্রাণ হারাতেন না, যদি না তারা যে ভবনগুলোতে বাস করতেন সেগুলোকে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের তৎপরতার ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করত।’ মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক ‘যুদ্ধে’ নিহত হননি, পাকিস্তানি সেনারা বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে ড. মনিরুজ্জামান, ড.
৬১৫
গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. ফজলুর রহমান, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা প্রমুখ শিক্ষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বলাবাহুল্য যে এঁদের কারো বাড়িতে আওয়ামী লীগ বা কোন সশস্ত্র বা নিরস্ত্র কোন প্রকার স্বেচ্ছাসেবকও ছিলনা।
কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট ফজলুল কাদের চৌধুরী ১৬ জুলাই লাহোরে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ দল নিজেদের ভুলের কারণে তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে।’ নেজামে ইসলাম পার্টির পার্লামেন্টারী বোর্ডের সম্পাদক সৈয়দ মনজুরুল আহসান ও যুগ্ম সম্পাদক মওলানা আবদুল মতিন আলেম সম্প্রদায়কে সশস্ত্র বাহিনীর সাথে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা প্রদানের আহবান জানিয়ে ২৬ জুলাই সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রদান করেন। পাকিস্তান মুসলিম লীগের (কাইয়ুম গ্রুপ) সেক্রেটারী জেনারেল খান আবদুস সবুর খান ২৯ জুলাই করাচি বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে এক বিবৃতিতে সমস্যার মোকাবেলায় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের তৎপরতার প্রশংসা করে। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক গোলাম আযম করাচিতে জামাত অফিসে ১ সেপ্টেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনে অবিলম্বে আদমশুমারি, নতুন নির্বাচন এবং ইতিমধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ছাড়াও ভাসানী ও ওয়ালী ন্যাপ এবং আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগ নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি জানায়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, ইতিমধ্যে পাক বাহিনীর বর্বরতায় ৯০ লক্ষের অধিক বাঙালি দেশত্যাগ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় গ্রহনে এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রায় সকল সদস্য দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। এছাড়া পাকিস্তান বাহিনী ও তার সহযোগীরা ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের জনসংখ্যা কোটি খানেকের উপর কমিয়ে ফেলেছিল। অধ্যাপক গোলাম আযম ঐ সাংবাদিক সম্মেলনে আরো বলে, ‘কোন ভাল মুসলমানই তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক হতে পারেনা।’ পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রধান করাচিতে ১৮ সেপ্টেম্বর এবং মৌলভী ফরিদ আহম্মেদ ১৯ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাষণের প্রশংসা করে। অধ্যাপক গোলাম আযম ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা হোটেল এম্পায়ারে এক সংবর্ধনা সভায় বলে, ‘জামায়াতে ইসলামের কর্মীরা মুসলিম জাতীয়তাবাদের আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মেনে নিতে রাজি নয়।’ সে আরো বলে, ‘যে উদ্দেশ্য নিয়ে জামায়াত রাজাকার বাহিনীতে লোক পাঠিয়েছে, শান্তি কমিটিতে যোগ দিয়েছে সেই উদ্দেশ্যেই মন্ত্রী সভায় লোক পাঠিয়েছে। জনাব নুরুল আমীন ৬ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাজাকারদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তাদের আরো অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার দাবি পেশ করে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার ২ মাসের মধ্যেই দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা সত্ত্বেও সামরিক কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে পুনর্বিন্যাস করার জন্যে
৬১৬
নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের নিয়ে ২৯ মে তারিখে ‘ভার্সিটি শিক্ষা পুনর্বিন্যাস কমিটি’ গঠন করেঃ ড. সাজ্জাদ হোসেন- ভাইস চ্যান্সেলর, ড. হাসান জামা ডিরেক্টর জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরো, ড. মোহর আলী, ঢা-বি, জনাব এ এফ এম আব্দুর রহমান, ঢাবি, ড. আব্দুল বারী, রাবি, ড. মকবুল হোসেন, রাবি, ড. সাইফুদ্দিন জোয়ারদার, রাবি, ৩১ আগস্টের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট পেশ করতে বলা হয়। জেনারেল টিক্কা খান ১৯৭১ সালের ২১ মে তারিখের মধ্যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার নির্দেশ দেন। জেনারেল টিক্কা খান ১৮ জুলাই তারিখে বিএনআর জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরো ভেঙে দিয়ে তার পরিবর্তে ‘পাকিস্তান বিষয়ক একাডেমী’ নামে একটি সংস্থা চালু করে এবং ড. হাসান জামানকে তার ডিরেক্টর নিয়োগ করে।
ইতিমধ্যে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। ৩ সেপ্টেম্বর ড. এ এস মালিক গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহন করেন, একই তারিখে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের পাকিস্তানি কমান্ডার লে. জেনারেল এ একে নিয়াজী সামরিক আইন প্রশাসকের দ্বায়িত্বভার গ্রহন করে। ঐ উভয় দ্বায়িত্বই এতদিন পালন করে আসছিল লে. জেনারেল টিক্কা খান। মেজর জেনারেল রহিম খান সহকারী সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। ডা. মালিকের শপথ গ্রহন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল প্রাক্তন গভর্নর জনাব সুলতান উদ্দিন আহমেদ ও জনাব আবদুল মোনায়েম খান। এছাড়া উপস্থিত ছিল অধ্যাপক গোলাম আজম, খান এ সবুর, শামসুল হুদা, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া), এ এস এম সোলায়মান, আবদুল জব্বার খান, পীর মোহসেন উদ্দিন, কাজী আনোয়ারুল হক, হাফিজুদ্দিন, দোহা, কিউএম রহমান, নওয়াব হাসান আসকারী, এম এম ইস্পাহানী, বিচারপতি আমিন আহমদ। শপথবাক্য পাঠ করান ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জনাব বিএ সিদ্দিকী। অন্যদিকে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব মাহমুদ আলী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৫ তম সাধারণ অধিবেশনে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দান করেন। এ দলে আরো ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান, অ্যাডভোকেট জুলমত আলী খান, মিসেস রাজিয়া ফয়েজ, ডা. ফাতিমাসাদিক, অ্যাডভোকেট এটি সাদী। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন শুরু হয় নিউইয়র্কে ২১ সেপ্টেম্বর থেকে।
১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ গভর্নর ডা. মালিক ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি মন্ত্রীপরিষদ গঠন করেন। এই মন্ত্রীরা ছিলেন রংপুরের কাউন্সিল মুসলিম লীগের জনাব আবদুল কাসেম (অর্থ), বগুড়ার জামায়াতে ইসলামী নেতা জনাব আব্বাস আলী খান (শিক্ষা), বরিশালের কনভেনশন মুসলিম লীগের ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন আহমেদ (বানিজ্য, শিল্প, আইন পার্লামেন্টারি), ঢাকার কে এস পি নেতা জনাব এ এস এম সোলায়মান (শ্রম, সমাজকল্যান ও পরিবার পরিকল্পনা), পার্বত্য চট্টগ্রামের মি. আউং শু প্রু চৌধুরী (বন, সমবায়, মৎস), খুলনা জামায়াতে ইসলামী নেতা জনাব এ কে এম
৬১৭
ইউসুফ (রাজস্ব, পূর্ত, বিদ্যুত, সেচ), পাবনার নেজামে ইসলাম নেতা মওলানা মোহাম্মাদ ইসহাক (মোলিক গণতন্ত্র, স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসন), কুষ্টিয়ার কাউন্সিল মুসলিম লীগের অ্যাডভোকেট নওয়াজিশ আহমদ (খাদ্য ও কৃষি), নোয়াখালীর প্রাক্তন আওয়ামী লীগের জনাব ওবায়দুল্লাহ মজুমদার (স্বাস্থ্য ও তথ্য) এবং চট্টগ্রামের প্রাক্তন আওয়ামী লীগের অধ্যাপক শামসুল হক (সাহায্য ও পুনর্বাসন)।
গভর্নর ডা. মালিকের ঐ পুতুল মন্ত্রীসভা গঠন করার পর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগ সদস্যদের ৭৮ টি সদস্য পদ খারিজ করে একাত্তরের অক্টোবর মাসে এসব শূন্যপদের জন্য উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। ২২ অক্টোবর ১৯৭১, ঐ তথাকথিত নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র বাছাই করা হয় এবং প্রথম দফায় নিম্নোক্ত প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় এম এন এ বা জাতীয় পরিষদের সদস্য ঘোষণা করা হয়। পিডিপির সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া (বাখরগঞ্জ-১), সৈয়দ মুসলেম উদ্দিন (ময়মনসিং -১৭), দলিলুর রহমান (কুমিল্লা-২), মোহাম্মাদ নুরুল্লাহ (চট্টগ্রাম), ফজলুল হক (সিলেট-৩), অধ্যাপক ইউসুফ আলী (ঢাকা-৫), মতিউর রহমান শাহ (বাখরগঞ্জ-৬), জনাব উদ্দিন আহমদ (রংপুর), কনভেনশন মুসলিম লীগের মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ (ঢাকা-১০), এম এ মতিন (পাবনা-৩), কাইয়ুম মুসলিম লীফের মুজিবুর রহমান (ময়মনসিংহ-১৬)। স্বতন্ত্র প্রার্থী মাসুদুর রহমান (যশোর-৫) এর মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষিত হয়।
১৯৭১ জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচনে প্রার্থী তালিকা ছিল নিম্নরূপঃ
ময়মনসিং- ১৩ মোহাম্মদ মওলানা মনজুরুল হক ও এ কে ফজলুল হক, যশোর-১ এম এ রশীদ (পিডিবি) ও শেখ শরফ উদ্দিন আহমদ (কনভেনশন লীগ)। যশোর-২ সৈয়দ শামসুর রহমান (কাউন্সিল লীগ) ও আহমদ রফিউদ্দিন (স্বতন্ত্র), যশোর-৭ মৌলবী সোলায়মান মোল্লা (জামায়াতে ইসলামী) ও আমীর হোসেন (স্বতন্ত্র), বাখরগঞ্জ-৫ মৌলবী আবদুর রব, মো. ইসমাইল খান, আবদুস সোবহান মৃধা (কাইয়ুম লীগ) ও মো. আবদুল আজিজ। বাখরগঞ্জ-৩ ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন (কনভেনশন লীগ), এম শমসের আলী, শামসুদ্দীন আহমদ, আবদুর রব ও আবুল হোসেন উকীল। রংপুর-২ আবুল বাশার (কাউন্সিল লীগ), সৈয়দ আলী (কাইয়ুম লীগ), আলহাজ গরীবউদ্দিন আহমদ (কনভেনশন লীগ), সৈয়দ কামাল হোসেন রিজভী (পিপিপি)। পাবনা ৫ মুনসী আব্দুল মজিদ (স্বতন্ত্র), রিয়াজ উদ্দিন মিয়া (স্বতন্ত্র), সৈয়দ আজগর হোসেন জায়েদী (কাইয়ুম লীগ)। পাবনা-৬ আবদুস সোবহান (জামায়াত), মো. মোতারব আলী (স্বতন্ত্র)। নোয়াখালী ২ আব্দুল জব্বার খন্দকার (পিডিপি), খাজা আহমদ, মোসলেহ উদ্দিন আহমদ, শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী (কনভেনশন)। নোয়াখালী-৩ অ্যাডভোকেট সাইদুল হক (কনভেনশন), মওলানা মকবুল আহমদ (নেজামে ইসলামী), মো. গোলাম মোস্তফা। নোয়াখালী-
৬১৮
৬ মো. হারিস মিয়া (কনভেনশন লীগ), মো. শফিকুল্লাহ (জামায়াত)। নোয়াখালী-৭ আবদুল ওয়াহাব উকিল (পিডিপি), আবু সুফিয়ান (স্বতন্ত্র), সিলেট-১ নাসির উদ্দিন (পিডিপি), আব্দুল বারী (কনভেনশন)। সিলেট-৪ সৈয়দ আবুল খায়ের (স্বতন্ত্র), মাহিবুর রহমান (কনভেনশন), মো. আব্দুস সাত্তার (জামায়াত), মো. মইনুল হোসেন (জামায়াত), হাজী হাবিবুর রহমান চৌধুরী (কনভেনশন)। সিলেট – ১০ গোলাম জিলানী চৌধুরী (পিডিপি), মেসবাউদ্দোহা আহমদ (কনভেনশন), আব্দদুস সাত্তার পীর (জামায়াত)। কুমিল্লা-৫ মো. সাজিদুল হক, মো. বজলুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মান্নান, আব্দুল মজিদ। কুমিল্লা-৬ মোহাম্মাদ ইবরাহিম মজুমদার, হাশমত উল্লাহ, হাজী মজহারুল হক চৌধুরী, আলী আসগর। কুমিল্লা-৮ তমিজউদ্দিন (পিডিপি) ও আব্দুর রব। টাঙ্গাইল-১ মৌলবী ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (স্বতন্ত্র) ও গোলাম আজম (জামায়াত)। টাঞগাইল-৩ এম এ মান্নান (কনভেনশন) মওলানা আব্দুস সামাদ দেওয়ান (জামায়াত), মওলানা আব্দুল হাই হানাফী লাহোরী (নেজাম)। টাঙ্গাইল-৪ অধ্যাপক এ খালেক (জামায়াত), ডা. শওকত আলী ভুঁইয়া (কনভেনশন), হাকিম হাবিবুর রহমান (কনভেনশন)।
২৩ অক্টোবর ১৯৭১ আরো তিনজন প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় জাতিয় পরিষদে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। কুষ্টিয়া-৪ আসমত আলী (কাউন্সিল মুসলিম লীগ), সিলেট-২ সৈয়দ কামরুল আহসান (নেজামে ইসলাম), কুমিল্লা-৫ সাজেদুল হক (নেজামে ইসলাম)। পরের দিন যশোর-৩ থেকে কনভেনশন মুসলিম লীগের আব্দুল ওয়াহাবকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এম এন এ নির্বাচিত ঘোষিত করা হয়। ২৮ অক্টোবর প্রকাশিত নির্বাচন কমিশনের এক ঘোষণা অনুসারে নির্বাচনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনপ্রদেশের ৭৮ টি উপনির্বাচনের ৩৩ টি আসনের মধ্যে ৩১ টি আসনের প্রার্থীগণ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কাইয়ুম মুসলিম লীগের সভাপতি খান আব্দুস সবুর, জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম, কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি খাজা খয়ের উদ্দিন, পিডিপ[ইর সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া ও প্রাদেশিক রাজস্বমন্ত্রী জামায়াত নেতা মওলানা এ কে এম ইউসুফ। ২৯ অক্টোবর আরো ১৯ জন অর্থাৎ মোট ৫০ জন সদস্যকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পিপিপির ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আলী, কাউন্সিল মুসলিম লীগের সহসভাপতি শফিকুল ইসলাম ও পিডিপির আব্দুল জব্বার খন্দকার।
৩০ অক্টোবর আরো দুজন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষিত হন, তারা হলেন ফরিদপুর-৪ থেকে কনভেনশন লীগের আব্দুর রহমান ও রাজশাহী-৬ থেকে জামায়াতে ইসলামীর আফাজ উদ্দিন।
৯ নভেম্বর ১৯৭১ জাতীয় সংসদে আরো ৬ জন প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়
৬১৯
নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। তারা হল, রাজশাহী-৩ জসীম উদ্দিন আহমেদ (কাইয়ুম লীগ), রাজশাহী-৪ মমতাজ উদ্দীন আহমদ (পিডিপি), রাজশাহী-৭ আব্দুস সাত্তার খান চৌধুরী (কাউন্সিল মুসলিম লীগ), পাবনা-৫ আফজাল হোসেন জাহেদী (কাইয়ুম লীগ), পাবনা-৬ মাওলানা আব্দুস সোবহান (জামায়াতে ইসলামী), বাকেরগঞ্জ-৯ মওলানা আব্দুর রহীম (জামায়াতে ইসলামী)। ফলে প্রদেশে জাতীয় পরিষদের ৭৮ টি শূন্য আসনের জন্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সদস্যের সংখ্যা ৭৮ আর দলীয় অবস্থান – জামায়াতে ইসলামী ১৫, পিডিপি ১২, কনভেনশন মুসলিম লীগ ৭, কাইয়ুম খান মুসলিম লীগ ৭, নেজামে ইসলাম ৬, কাউন্সিল মুসলিম লীগ ৬ এবং পিপিপি ৫। যেসব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার কথা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ফরিদপুর-৩ কেন্দ্রে পিডিপি নেতা ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া বনাম স্বতন্ত্র প্রার্থী জনাব মকিম উদ্দিন, চট্টগ্রামের একটি কেন্দ্র থেকে মুসলিম লীগ সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বনাম পিডিপি নেতা মাহমুদুন নবী চৌধুরী এবং অপর একটি কেন্দ্র থেকে পাকিস্তান শান্তি ও কল্যান পরিষদের সভাপতি মৌলবি ফরিদ আহমেদ বনাম মাহমুদুন নবী চৌধুরী। অবশ্য ঐসব নির্বাচন আর অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। তবে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে জনাব নুরুল আমীন পাকিস্তানের প্রধানম্নত্রী নিযুক্ত হন। এবং জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে বলেন, ‘আসুন আমরা সম্মুখপানে অগ্রসর হই এবং সেনাবাহিনীর সহিত কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া কাজ করি।’ কিন্তু জনাব নুরুল আমীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হবার এক সপ্তাহের মধযেই বাংলাদেশে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী পরাজিত হয় এবং মিত্র ও মুক্তি বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পন করে, আর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ৭ দিনের মধ্যে জনাব নুরুল আমিন জেনারেল টিক্কা খানের কাছে ধরনা দিয়েছিল আর পুরস্কার সে পেল মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার ৭ দিন আগে। ইতিমধ্যে অবশ্য পাকিস্তানের নবনিযুক্ত উপ প্রধান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাক-ভারত যুদ্ধের ব্যাপারে বক্তব্য পেশের জন্য ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে ৬ ডিসীম্বর নিউইয়র্ক যায়। তার দলের বেসরকারি সদস্যের মধ্যে পূর্বাঞ্চলের কাইয়ুম মুসলিম লীগ নেতা ও উপনির্বাচনে নির্বাচিত ঘোষিত এম এন এ জনাব মুজিবর রহমানও ছিল।
একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে কিছু রাজনৈতিক নেতা ও কতিপয় শিক্ষাবিদের দালালি ছাড়াও রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনী অবরুদ্ধ বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উপর যে সুপরিকল্পিত নৃশংস হত্যালীলা চালিয়ে যায়, তার ইতিহাস আজও অলিখিত। তবে যে শান্তি ও কমিটির মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও রাজাকার, আল বদর ও আল শামস
৬২০
বাহিনীর নামে ঐসব রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র অঙ্গদলসমূহ অবরুদ্ধ বাংলাদেশে নারকীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ সমূহ করে, সেসব কর্মকান্ডের নায়কদের সংক্ষিপ্ত তালিকা মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র প্রকাশিত ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ গ্রন্থে সন্নিবেশিত রয়েছে।
স্বাধীনতার ঘোষণা
THE PROCLAMATION OF INDEPENDENCE
Mujibnagar, Bangladesh
Dated 10th day of April, 1971.
Whereas free elections were held in Bangladesh from 7th December, 1970 to 17th January, 1971, to elect representatives for the purpose of framing a constitution,
AND
Whereas at these elections the people of Bangladesh elected 167 out of 169 representatives belonging to the Awami League,
AND
Whereas General Yahya Khan summoned the elected representatives of the people to meet on the third March, 1971, for the purpose of framing a constitution,
AND
Whereas the Assembly so summoned was arbitrarily and illegally postponed for indefinite period,
AND
Whereas instead of fulfilling their promise and while still conferring with the representatives of the people of Bangladesh, Pakistan authorities declare an unjust and treacherous war,
AND
Whereas in the facts and circumstances of such treacherous conduct Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, the undisputed leader of the 75 million people of Bangladesh, in due fulfilment of the legitimate right of self determination of the people of Bangladesh, duly made a declaration of independence at Dacca on March 26, 1971, and urgedthe people of Bangladesh to defend the honour and integrity of Bangladesh,
AND
Whereas in the conduct of a ruthless and savage war the Pakistani authorities committed and are still continuously committing numerous acts of genocide and unprecedented tortures, amongst others on the civilian and unarmed people of Bangladesh,
৬২১
Whereas the Government by levying an unjust war and committing genocide by and other repressive measures made it impossible for the elected representatives of the people of Bangladesh to meet and frame a Constitution, and give to themselves a Government,
AND
Whereas the people of Bangladesh by their heroism, bravery and revolutionary fervour have established effective control over the territories of Bangladesh,
We the elected representatives of the people of Bangladesh, as honor bound by the mandate given to us by the people of Bangladesh whose will is supreme duly constituted ourselves into a constituent Assembly, and
having held mutual consultations, and
in order to ensure for the people of Bangladesh equality, human dignity and social justice,
declare and constitute Bangladesh to be sovereign Peoples Republic and thereby confirm the declaration of independence already made by Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, and
do hereby affirm and resolve that till such time as a Constitution is framed, Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman shall be the president of the Republic and that Syed Nazrul Islam shall be the Vice-President of the Republic, and
that the president shall be Supreme Commander of all the Armed Forces of the Republic,
shall exercise all the Executive and Legislative powers of the Republic including the power of grand pardon,
shall have the power to appoint a Prime Minister and such other Ministers as he considers necessary,
shall have the power to levy taxes and expend monies,
shall have the power to summon and adjourn the Constituents Assembly, and
do all other things that may be necessary to give to the People of Bangladesh an orderly and just Government,
We the elected representatives of the People of Bangladesh do further resolve that in the even of there being no President or the President being unable to enter upon his office or being unableto exercise his powers and duties due to any reason whatsoever, the Vice-President shall have and exercise all the powers, and responsibilities herein conferred on the President,
৬২২
We Further resolve that we undertake to observe and give effect to all duties and obligations that develop upon us a as a member of the family of nations and under the Charter of United Nations,
We further resolve that this proclamation of independence shall be deemed to have come into effect from 26th day of March, 1971.
We further resolve that in order to give effect to this instrument we appoint prof. Yusuf Ali our duly Constituted Potentiary and to give to the president and the Vice-President oaths of office.
স্বাস্থ্য ও কল্যান মন্ত্রণালয়
দ্র. স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার
স্বীকৃতি জ্ঞাপন
ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্ত অবহিত করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নিকট ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পত্র
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
প্রিয় প্রধানমন্ত্রী,
৪ ডিসেম্বর তারিখে মাননীয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আপনি যে বানী আমার কাছে পাঠিয়েছেন, তাতে আমার সহকর্মীবৃন্দ, আমি খুবই অভিভূত হয়েছি। পত্র পাওয়ার পর আপনাদের সাফল্যজনক নেতৃত্বে পরিচালিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদান সংক্রান্ত আপনাদের অনুরোধ ভারত সরকার পুনরায় বিবেচনা করেছে। আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, বর্তমানে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার প্রেক্ষাপটে ভারত সরকার আপনাদের স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে। আজ সকালে আমি পার্লামেন্টে এ ব্যাপারে একটি বিবৃতি দান করেছি। তার অনুলিপি এতদসঙ্গে পাঠালাম।
বাংলাদেশের জনসাধারণ দুঃখকষ্টের মধ্যে কালযাপন করছে। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য আপনাদের যুব সম্প্রদায় নিঃস্বার্থভাবে আত্মাহুতির মাধ্যমে এক মরণপন সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। ভারতের জনসাধারণও একই মূল্যবোধকে রক্ষার উদ্দেশ্যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। আমি সন্দেহাতীত ভাবে বলতে চাই যে, আমাদের মহান উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে এই অধ্যবসায় ও আত্মদান আমাদের দুই দেশের জনসাধারণের মধ্যে বন্ধুত্বকে আরো সুদৃঢ় করবে। পথ যতই দীর্গ হোক না কেন এবং ভবিষ্যতে আমাদের জনসাধারণের যতই ত্যাগ করতে হোক না কেন, বিজয়মাল্য আমরা বরণ করবই।
এই উপলক্ষ্যে আমি আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে এবং আপনার সহকর্মী ও
৬২৩
বাংলাদেশের বীর জনতাকে আমার শুভাশীষ ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।
আমি আপনার মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম কে আমাদের পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করছি।
আপনার বিশ্বস্ত
ইন্দিরা গান্ধী
মাননীয় জনাব তাজউদ্দীন আহমদ
প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
মুজিবনগর
স্বীকৃতি প্রদানকারী দেশ (১৯৭১-১৯৭৫)
ক্রমিক নম্বর দেশ তারিখ
১৯৭১
১. ভারত ৬ ডিসেম্বর
২. ভুটান ৭ ডিসেম্বর
১৯৭২
৩. পূর্ব জার্মানি ১১ জানুয়ারি
৪. মঙ্গোলিয়া ১২ জানুয়ারি
৫. পোল্যান্ড ১২ জানুয়ারি
৬. বুলগেরিয়া ১২ জানুয়ারি
৭. বার্মা ১৩ জানুয়ারি
৮. নেপাল ১৬ জানুয়ারি
৯. বার্বাডোস ২০ জানুয়ারি
১০. ডেনমার্ক ২০ জানুয়ারি
১১. ফিনল্যান্ড ২০ জানুয়ারি
১২. যুগোশ্লাভিয়া ২২ জানুয়ারি
১৩. টোগো ২৪ জানুয়ারি
১৪. সোভিয়েত ইউনিয়ন ২৪ জানুয়ারি
১৫. চেকোশ্লোভাকিয়া ২৪ জানুয়ারি
১৬. হাঙ্গেরি ২৬ জানুয়ারি
১৭. সাইপ্রাস ২৭ জানুয়ারি
১৮. অস্ট্রেলিয়া ৩১ জানুয়ারি
৬২৪
১৯. ফিজি ৩১ জানুয়ারি
২০. নিউজিল্যান্ড ৩১ জানুয়ারি
২১. কম্বোডিয়া ৩১ জানুয়ারি
২২. সেনেগাল ১ ফেব্রুয়ারি
২৩. গ্রেট ব্রিটেন ৪ ফেব্রুয়ারি
২৪. পশ্চিম জার্মানি ৪ ফেব্রুয়ারি
২৬. ডেনমার্ক ৪ ফেব্রুয়ারি
২৭. সুইডেন ৪ ফেব্রুয়ারি
২৮. নরওয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি
২৯. আইসল্যান্ড ৪ ফেব্রুয়ারি
৩০. ইসরাইল ৪ ফেব্রুয়ারি
৩১. অস্ট্রিয়া ৪ ফেব্রুয়ারি
৩২. ওয়েস্টার্ণ ৮ ফেব্রুয়ারি
৩৩. কিউবা ৯ ফেব্রুয়ারি
৩৪. জাপান ১০ ফেব্রুয়ারি
৩৫. লুক্সেমবার্গ ১১ ফেব্রুয়ারি
৩৬. নেদারল্যান্ড ১১ ফেব্রুয়ারি
৩৭. বেলজিয়াম ১১ ফেব্রুয়ারি
৩৮. আয়ারল্যান্ড ১২ ফেব্রুয়ারি
৩৯. ইতালি ১২ ফেব্রুয়ারি
৪০. ফ্রান্স ১২ ফেব্রুয়ারি
৪১. কানাডা ১৩ ফেব্রুয়ারি
৪২. থাইল্যান্ড ১৬ ফেব্রুয়ারি
৪৩. সিঙ্গাপুর ১৭ ফেব্রুয়ারি
৪৪. সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ১৭ ফেব্রুয়ারি
৪৫. মরিসাস ২০ ফেব্রুয়ারি
৪৬. ফিলিপাইন ২৪ ফেব্রুয়ারি
৪৭. মালয়েশিয়া ২৫ ফেব্রুয়ারি
৪৮. ইন্দোনেশিয়া ২৫ ফেব্রুয়ারি
৪৯. মালাউই ২৯ ফেব্রুয়ারি
৫০. গাম্বিয়া ২ মার্চ
৫১. শ্রীলংকা ৪ মার্চ
৬২৫
৫২. সোয়াজিল্যান্ড ১০মার্চ
৫৩. গ্রিস ১১ মার্চ
৫৪. সুইজারল্যান্ড ১৩ মার্চ
৫৫. লেসোথো ২১ মার্চ
৫৬. বোতসোয়ানা ২৩ মার্চ
৫৭. জ্যামাইকা ২৩ মার্চ
৫৭. তাইওয়ান ২৮ মার্চ
৫৯. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২৪ মার্চ
৬০. গ্যাবন ৬ এপ্রিল
৬১. মালদ্বীপ ১২ এপ্রিল
৬২. মালাগাছি ১৪ এপ্রিল
৬৩. সিয়েরা লিওন ২২ এপ্রিল
৬৪. লাওস ২৫ এপ্রিল
৬৫. লাইবেরিয়া ২৬ এপ্রিল
৬৬. কোস্টারিকা ২ মে
৬৭. ভেনিজুয়েলা ২ মে
৬৮. কলম্বিয়া ২ মে
৬৯. মেক্সিকো ১১ মে
৭০. স্পেন ১২ মে
৭১. দক্ষিণ কোরিয়া ১২ মে
৭২. এল সালভেদর ১২ মে
৭৩. ব্রাজিল ১২ মে
৭৪. আর্জেন্টিনা ২৫ মে
৭৫. হাইতি ২৬ মে
৭৬. চিলি ১ জুন
৭৭. ইকুয়েডর ৬ জুন
৭৮. জাম্বিয়া ২১ জুন
৭৯. রুমানিয়া ২৮ জুন
৮০. ইরাক ৮ জুলাই
৮১. তাঞ্জানিয়া ১২ জুলাই
৮২. ডোমিনিক্যান গণপ্রজাতন্ত্র ৩১ জুলাই
৮৩. মাল্টা ১৯ জুলাই
৮৪. গুয়েতেমালা ২২ জুলাই
৮৫. ইয়েমেন গণপ্রজাতন্ত্রী ৩১ জুলাই
৬২৬
৮৬. পেরু ১ আগস্ট
৮৭. বলিভিয়া ২ আগস্ট
৮৮. উগান্ডা ১৬ আগস্ট
৮৯. আপারভাল্টা ১৯ আগস্ট
৯০. পানামা ২৬ আগস্ট
৯১. উরুগুয়ে ২৬ আগস্ট
৯২. প্যারাগুয়ে ২১ সেপ্টেম্বর
৯৩. ভ্যাটিকান ২৫ সেপ্টেম্বর
৯৪. হন্ডুরাস ১৯ অক্টোবর
৯৫. নিকারাগুয়া ১০ নভেম্বর
৯৬. ইথিওপিয়া ২৫ নভেম্বর
৯৭. উত্তর ভিয়েতনাম ২৫ নভেম্বর
৯৮. ঘানা ৮ ডিসেম্বর
১৯৭৩
৯৯. আফগানিস্তান ১৮ ফেব্রুয়ারি
১০০. লেবানন ২৮ মার্চ
১০১. মরক্কো ১৩ জুলাই
১০২. আলজেরিয়া ১৬ জুলাই
১০৩. তিউনিশিয়া ১৬ জুলাই
১০৪. মৌরিতানিয়া ১৬ জুলাই
১০৫. দক্ষিণ ভিয়েতনাম ৩১ জুলাই
১০৬. আইভরি কোস্ট ২৩ আগস্ট
১০৭. জায়ারে ৮ সেপ্টেম্বর
১০৮. মিশর ১৫ সেপ্টেম্বর
১০৯. সিরিয়া ১৫ সেপ্টেম্বর
১১০. নাইজার ২৪ সেপ্টেম্বর
১১১. গিনি বিসাউ ৩০ সেপ্টেম্বর
১১২. ক্যামেরুন ৬ অক্টোবর
১১৩. গিনি ১০ অক্টোবর
১১৪. জর্ডান ১৬ অক্টোবর
১১৫. ডাহোমি (রিপাবলিক অফ বেনিন) ২২ অক্টোবর
১১৬. কুয়েত ৪ নভেম্বর
১১৭. আরব রিপাবলিক অফ ইয়েমেন ৫ নভেম্বর
৬২৭
১১৮. উত্তর কোরিয়া ১৫ ডিসেম্বর
১৯৭৪
১১৯. পাকিস্তান ২২ ফেব্রুয়ারি
১২০. ইরান ২২ ফেব্রুয়ারি
১২১. তুরস্ক ২২ ফেব্রুয়ারি
১২২. নাইজেরিয়া ২৭ ফেব্রুয়ারি
১২৩. কাতার ৪ মার্চ
১২৪. আরব আমিরাত ১০ মার্চ
১২৫. কঙ্গো (ব্রাজা ভিলা) ২১ মার্চ
১২৬. বাহরাইন ফেব্রুয়ারি ১২৭. কম্বোডিয়া (সিহানুক) ৩০ জুলাই
১২৮. ওমান ১০ ডিসেম্বর
১২৯. পর্তুগাল ২০ ডিসেম্বর
১৩০. সোমালিয়া ২৩ ডিসেম্বর
১৯৭৫
১৩১. সৌদি আরব ১৬ আগস্ট
১৩২. সুদান ১৬ আগস্ট
১৩৩. গণচীন ৩১ আগস্ট
স্বীকৃতির আবেদন
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের অনুরোধ জানিয়ে (৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১) ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট বাংলাদেশ সরকারের পত্র।
(গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সিলমোহর)
প্রেরকঃ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী।
প্রাপকঃ মাননীয় ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী, নয়াদিল্লী।
মহামান্য,
আমরা গভীর দুঃখের সঙ্গে জানতে পেরেছি যে, ৩ ডিসেম্বর অপরাহ্নে পাকিস্তান সামরিক জান্তা আপনার দেশের বিরুদ্ধে নগ্ন ভাবে হামলা চালিয়েছে। ইয়াহিয়া খানের এই সর্বশেষ পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ বেপরোয়াভাবে অমান্য করার পরিচয় বহন করেছে এবং চূড়ান্ত ভাবে প্রমান করছে যে, ইয়াহিয়া খান
৬২৮
এই উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলোতে উত্তেজনা, ধ্বংসযজ্ঞ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টিতে বদ্ধ পরিকর। বাংলাদেশের জনসাধারণ পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের এই ধরনের মনোবৃত্তির ব্যাপারে সজাগ এবং প্রায় নয়মাস পূর্বে নিজেদের স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করেছে। ঘটনার বাস্তবতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দান করে আমরা গত ১৫ অক্টোবর এবং ২৩ নভেম্বর আপনাকে পত্র মারফত জানিয়েছি। আমরা পরিষ্কার ভাষায় আপনাকে অবহিত করেছি যে, হানাদার বাহিনী সম্পূর্ণভাবে পরাজিত না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে। এক্ষণে ইয়াহিয়া খান ও তার সমর নয়কেরা যেভাবে আমাদের দেশের উপর আক্রমণ চালিয়েছে তাতে এই আগ্রাসনকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে ভারত ও বাংলাদেশের জনসাধারণের কাঁধে কাঁধ মুলিয়ে লড়াই করার প্রয়োজনীয়তা আরো বেশিভাবে দেখা দিয়েছে। গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠা করা এবং এ ধরনের অন্যান্য মূল্যবোধকে অর্জন করার উদ্দেশ্যে দুই দেশের মধ্যে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে তার জন্য আমরা সম্মিলিতভাবে লড়াই করতে প্রস্তুত।
জনাব প্রধানমন্ত্রী আপনাকে জানাতে চাই যে, ৩ ডিসেম্বর তারিখে আপনার দেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সরাসরি আক্রমনের প্রেক্ষিতে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের যেকোন সেক্টরে অথবা ফ্রন্টে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত ও জোরদার করতে প্রস্তুত রয়েছে। তাই আমরা যদি আনুষ্ঠানিকভাবে পারস্পরিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি তাহলে পাকিস্তানের সামরিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত প্রতিরোধ ব্যাপ্তি লাভ করবে। এই প্রেক্ষাপটে আমরা আপনাদের সমীপে পুনরায় অনুরোধ করতে চাই যে, ভারত সরকার অবিলম্বে আমাদের দেশ ও সরকারকে স্বীকৃতি দান করুক। এই উপলক্ষে আমরা আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিতে চাই যে, উভয় দেশের এই ভয়াবহ বিপদের সময় বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ আপনাদের সঙ্গে রয়েছে। আমাদের আন্তরিক আশা রয়েছে যে, আমাদের যৌথ প্রতিরোধের ফলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের হীন পরিকল্পনা ও জঘন্য ইচ্ছা ব্যররথ হতে বাধ্য এবং আমরা সফল হব।
আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আপনাদের ন্যায় নিষ্ঠা সংগ্রামের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি। আপনাদের প্রতি সহযোগিতার পুনরুল্লেখ করছি।
হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পনের পূর্ব মুহূর্ত
জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনারের প্রতিনিধি জন আর কেলি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পনের পূর্ব মুহূর্তে ছিলেন ঢাকায়। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পনে তিনি
৬২৯
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর বিবরণঃ
এই লেখাটি ১৯৭১ সালের ১৪, ১৫ এবং ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় যা ঘটেছিল তার কিছু কিছু ঘটনা সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিবরণ। এটি কোন ভাবে আমি যে সংস্থার সদস্য সেটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ঘিরে যেসব ঘটনা ঘটেছিল সেসবের কিছু স্মৃতি, যা একান্তই আমার ব্যক্তিগত।
সেসব ঘটনার সঙ্গে আমার নিজের সম্পৃক্তি ঘটে আগস্ট মাসে যখন জাতিসংঘ শরণার্থী হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান আমাকে ঢাকায় পাঠান সেখানকার শরণার্থীদের সম্ভাব্য সমস্যায় তাদের সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য। যেহেতু সেটা ছিল কঠোরভাবে একটি অরাজনৈতিক ও মানবিক সেবামূলক দ্বায়িত্ব, আর যেহেতু এই লেখাটিও একটি অরাজনৈতিক বিবরণ, তাই আমি এখানে সে সম্পর্কে কোন মন্তব্য লিখব না এবং বল্ব যে সম্ভবত আমি একজন আইরিশম্যান বলেই বাঙালি জনগণের প্রতি আমার বেশ সহানুভূতিবোধ হয়েছিল এবং তাদের একটা সুখী, সমৃদ্ধিশালী ও শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ জীবন আমি দেখতে চেয়েছি। ডিসেম্বরের শুরুতে যখন সহিংসতা শুরু হয় তখন এটা খুব পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে যতদিন এসব চলবে ততদিনের জন্য শরণার্থী সংক্রান্ত কাজকর্ম বন্ধই থাকবে। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব জাতসংঘের ত্রাণ কর্মকান্ডের সার্বিক দ্বায়িত্বে ছিলেন পল মার্ক হেনরি, জাঁদরেল ফরাসি ভদ্রলোক। তিনি ছিলেন আমাদের সবার জন্য একটা উদ্দীপনা। ঢাকায় একটি সংঘিপ্ত সফরে এসেছিলেন তিনি ডিসেম্বরে। তখন সহিংসতা শুরু হয়ে গেলে তিনি ঢাকায় আটকা পড়ে যান। স্বভাবতই এখানকার জাতিসংঘ গ্রুপের সকলের দ্বায়িত্ব গিয়ে পড়ে তাঁর কাঁধে। তিনি আমাকে সামরিক সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের দ্বায়িত্ব দেন। এসবের মধ্যে সবই ছিল একান্তভাবেই মানবিক কর্মকান্ড, যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মানুষের জীবন রক্ষা করা ও দুর্ভোগ লাঘব করা। তবে এই লেখাটি শুধু ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় সহিংস ঘটনাবলীর শেষ তিনদিন নিয়ে লেখা।
১৪ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার
১৪ ডিসেম্বর সকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এ এম মালিক আমাকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ফোন করেন। হোটেলে আমি ও জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা পিটার হুইলার ছিলাম। ড. মালিক ফোনে আমাকে তার অবস্থা দেখার জন্য গভর্নর্স হাউজে যেতে বললেন। আগে ঢাকায় জাতিসংঘ শরণার্থী হাইকমিশনের প্রতিনিধি হিসেবে এবং যুদ্ধের সময় যখন আমি সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে লিঁয়াজো করছিলাম তখন অনেকবার ড. মালিকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে।
এই সময়ের মধ্যে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল। পতন ঘনিয়ে আসছিল আর ঢাকার ভিতর থেকে পরিস্থিতিটা মনে হচ্ছিল ১৯৪৫ সালের
৬৩০
বার্লিনের মত। আমি ও পিটার হুইলার যখন গভর্নর্স হাউজে ড. মালিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই তখন তিনি একটা ক্যাবিনেট বৈঠকে ছিলেনঃ কিন্তু তবুও বেরিয়ে এসে আমাদের নিয়ে গেলেন তার এডিসির অফিসে। তঁর ব্যক্তিগত পরিস্থিতির ব্যাপারে তিনি আমাদের পরামর্শ চাইলেন।
আমি তাঁকে বললাম আমার মনে হয় তাঁর এবং তাঁর মন্ত্রীদের সামনে এখন মৃত্যুর বিরাট ও প্রকট ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। আমই আরো বললাম যে, তাৎক্ষণিকভাবে তিনি যদি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের নিউট্রাল জোনে আশ্রয় না নেন তাহলে হয়ত ঐ রাতটার ফাঁড়াই তিনি কাটাতে পারবেন না। তবে নিউট্রাল জোনে প্রবেশের অনুমতি পেতে হলে তাঁদের সব সরকারি দ্বায়িত্ব থেকে ইস্তফা দিতে হবে। তিনি বললেন যে, তার মন্ত্রীসভা ঐ মুহুর্তে ভাবছেন তাঁরা পদত্যাগ করবেন কি করবেন না, তবে তারা তা করতে অনিচ্ছুকই ছিলেন। তিনি বললেন যে, তিনি নিজে মনে করেন ঐ মূহুর্তে তার পদত্যাগ করা উচিত হবেনা, কারণ তাহলে ইতিহাসের দৃষ্টিতে রণেভঙ্গ দিয়ে পলায়ন বলে মনে হবে। তারপর তিনি জানতে চাইলেন তাঁর স্ত্রী ও কন্যাকে নিউট্রাল জোনে পাঠাতে পারবেন কিনা। আমি জবাবে বললাম যে, যদিও তার স্ত্রী ও কন্যা অবশ্যই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের নিউট্রাল জোনে আশ্রয়ের অনুমতি পাবেন কিন্তু তাতে তার লক্ষ্য অর্জিত হবেনা। হোটেলটি তখন সাংবাদিকে ভর্তি, তারা বলেন যে, ড. মালিক এতোটাই আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন যে তিনি তাঁর পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন, এরপর তারা জানতে চাইলেন কখন ড. মালিক নিজে এখানে এসে উঠছেন।
সেই মুহুর্তে গভর্নর্স হাউসটি কয়েকটা প্রচন্ড বিস্ফোরণে ভয়াবহভাবে কেঁপে উঠল। এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমনের কবলে পড়েছে ভবনটি। আমি ও পিটার হুইলার তক্ষুণি ঝুলবারান্দা টপকে বেরিয়ে এলাম এবং গজ পাঁচেক দূরে একটা জিপের নিচে আশ্রয় নিলাম। গোটা ছয়েক ভারতীয় বিমানের প্রত্যেরকটা থেকে দুবার করে রকেট ও কামানের আঘাত এসে পড়ল ভবনটির উপরে। আক্রমণের প্রথম পর্ব যখন চলছে তখন দেখতে পেলাম তৎকালীন মুখ্যসচিব মুজাফফর হুসেইন বিমর্ষভাবে বেরিয়ে এলেন, আমাদের চোখাচোখি হল এবং আমরা উদ্বিগ্ন অভিবাদন বিনিময় করলাম। গভর্নর্স হাউজের ওপর হামলা চলছে, এরই মধ্যে আমি প্রায় ২০ গজ দৌড়ে চলে এলাম একটা ট্রেঞ্চ এর কাছে, ট্রেঞ্চটা ততক্ষণে সৈন্যে ভর্তি। আমি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। এই পুরোটা সময় ন্ধরে আমি আমার হাতের ওয়াকিটকিতে আক্রমণটি সম্পর্কে ধারাবর্ননা চালিয়ে যেতে থাকলাম পল-মার্ক হেনরির উদ্দেশ্যে। তিনি তখন জাতিসংঘের লোকেশনে অবস্থান করছিলেন। জেনারেল ফরমান আলী নিরাপত্তার খোঁজে ছুটছিলেন, ছুটতে ছুটতে তিনি আমাকে বললেন, ভারতীয়রা আমাদের উপর এই হামলা করছে কেন? ২০ গজ দূরে গভর্নর্স হাউজের উপর ভারতীয় বিমান হামলা
৬৩১
চালিয়ে যাচ্ছে রকেট আর কামানের গোলা নিক্ষেপ করে। এই পরিস্থিতিটা জেনারেল ফরমান আলীর সঙ্গে গল্প করার উপযুক্ত নয় বলে মনে হল আমার, তিনি তাট্র নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে থাকলেন। আক্রমণের আওয়াজে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা থামল এবং আমি আমার গাড়িতে উঠে পিটার হুইলারকে তুলে নিয়ে জাতিসংঘের লোকেশনে ফিরে এলাম।
জাতিসংঘ লোকেশনে এসে আমি ঘটনা সম্পর্কে পল-মার্ক হেনরিকে জানালাম এবং ‘দি অবজারভার’ এর গ্যাভিং ইয়ংয়ের সঙ্গে দেখা করলাম। গ্যাভিং ইয়াং খুব আস্থার সঙ্গে আমাকে জানালেন, যা পরে ভুল প্রমানিত হয়েছিল যে, ভারতীয় বিমান বাহিনীর ভারতে গিয়ে জ্বালানী নিয়ে ও রি লোড করে ফিরে আসতে কমপক্ষে এক ঘন্টা লাগবে। তিনি গভর্নর্স হাউজে কি ঘটছে তা দেখতে যাওয়ার প্রস্তাব করলেন। আমি রাজি হলাম এবং আমার গাড়িতে করে তাঁকে নিয়ে আবার গভর্নর্স হাউজে গেলাম। সেখানে সামরিক সচিবের সঙ্গে আমাদের দেখা হল, তিনি আমাদের জানালেন যে ড. মালিক ও মন্ত্রীপরিষদ গভর্নর্স হাউজের বামদিকে একটা বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছে। তিনি আমাদের সেখানে নিয়ে গেলেন। আমরা ড. মালিককে খুবই কাহিল দেখতে পেলাম। তাঁরা তখনো দ্বিধান্বিত পদত্যাগ করবেন কিনা তা নিয়ে। আমি তাদের বললাম যে আমার মনে তারা কেবল অনিয়মিত সৈন্যদের হাতে নিহত হবার সম্মুখীন তা নয়, তাঁদের নিজেদের রক্ষীদের উপরেও তাদের আর নির্ভর করা চলেনা। বরং ভারতীয় বিমান বাহিনী নিজেও তাদের জীবনের উপর প্রত্যক্ষ হামলা করে বসেছে।
সেই মূহুর্তে ভারতীয় বিমান বাহিনী গভর্নর্স হাউজের উপর দ্বিতীয়বারের মত বিধ্বংসী হামলা চালাল। গ্যাভিন ইয়াং দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের ফিরে আসার সম্পর্কে ভুল হিসেব করেছিলেন। বাংকারটি ভূমির উপরে ছিল বলে সেটা খুব একটা নিরাপদ ছিলনা, আর আমরা জানতাম না ভারতীয় বিমান বাহিনী সেটার অস্তিত্বের কথা জানত কিনা। একটা সরাসরি আঘাত হলে সেটা নিশ্চিতই উড়ে যাওয়ার কথা। আক্রমণ চলতে থাকল। মন্ত্রীরা তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্যে পদত্যাগপত্র লিখলেন, ড. মালিক সকল মন্ত্রীর উপস্থিতিতে সেটাতে স্বাক্ষর করলেন। তারপর তিনি বাংকারের আরো ভিতরে একটা ঘরে ঢুকলেন যেখানে তার স্ত্রী ও কন্যা অপেক্ষা করছিলেন। ড. মালিক অযু করলেন এবং নামাযে বসলেন। সদ্য সাবেক গভর্নর ও সদ্য সাবেক মন্ত্রীরা ঐদিনই একটু পরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের নিউট্রাল জোনে উঠে এলেন।
এটা স্পষ্টই মনে হচ্ছিল যে ১৪ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক সরকারের আগাগোড়াই ভেঙে পড়াতে পাকিস্তানের পক্ষে যারা যুদ্ধ পরিচালনা করছিল তারা ভীষণভাবে নাড়া খেয়ে গেছে এবং পরিস্থিতির গুরুত্বটা তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে। এটা খুবই হতে পারে যে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের
৬৩২
সম্মিলিত পদত্যাগ যুদ্ধকে এক বা তারও বেশিদিন সংক্ষিপ্ত করেছে।
১৫ ডিসেম্বর, বুধবার
১৫ ডিসেম্বর খুব সকালবেলা ড. মালিক হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আমার কাছে এসে বললেন যে ১৪ ডিসেম্বর গভর্নর হিসেবে তার পদত্যাগ এবং গভর্নর্স হাউজ থেকে প্রস্থানের মাঝামাঝি সময়ে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছ থেকে একটি টেলিফোন কল পেয়েছে। আমি যতদূর জানি এই প্রথম প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একটা যুদ্ধবিরতির অনুমোদন দিলেন।
ড. মালিক বললেন প্রেসিডেন্টের নির্দেশনার ব্যাপারে তিনি জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। ইয়াহিয়ার নির্দেশঃ যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এখন আপনাকে নিতে হবে। নিয়াজীর সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যাপারে ড. মালিক আমার সহযোগিতা চাইলেন। আরো প্রাণহানি ঠেকানোর উদ্দেশ্যে আমি আমার ব্যক্তিগত সাধ্য থেকে তাকে সহযোগিতা করতে রাজি হলাম। তারপর আমি নিউট্রাল জোনে পাকিস্তান সামরিক লিঁইয়াজো কর্মকর্তা (বেসামরিক পোষাকে) কর্নেল গাফফারের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তারপর আমরা তিনজন আমার রুমে গেলাম এবং সেখান থেকে জেনারেল নিয়াজীকে ফোন করলাম। ড. মালিক জেনারেল নিয়াজীকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রেসিডেন্টের নির্দেশের ব্যাপারে তিনি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন। জেনারেল নিয়াজী উত্তরে বললেন যে এ ব্যাপারে তিনি ড. মালিকের সঙ্গে আলোচনা করতে চান। তিনি ড. মালিককে হোটেল ছেড়ে ক্যানটনমেন্টে যেতে বললেন। আমি ড. মালিককে বললাম, যদি তিনি নিউট্রাল জোন ত্যাগ করেন তাহলে তাঁর আর কোন নিরাপত্তা থাকবে না। আর আগের দিন তার পদত্যাগ ও তার পরবর্তী পরিস্থিতিতে তার নিউট্রাল জোন ত্যাগ করা তার জন্য বিপজ্জনকই হবে। আমি উলটো তাকে পরামর্শ দিলাম জেনারেল নিয়াজীকে হোটেলে আসতে বলেন, কিন্তু জেনারেল নিয়াজী জানালেন তিনি তার পক্ষ থেকে জেনারেল ফরমান কে পাঠাচ্ছেন।
জেনারেল ফরমান ঠিক সময়ে উপস্থিত হলেন। আমি একজন বিদেশী, আর যাই হোক না কেন, কোন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নয়, ব্যক্তিগত ভাবে কাজ করছিলাম, তাই তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এরকম একটা আলোচনা থেকে আমি সরে গেলাম। ড. মালিক, জেনারেল ফরমান ও কর্নেল গফুর আলোচনায় বসলেন। পরে তারা আমাকে আবার আমন্ত্রণ জানালেন এবং তাদের প্রনীত কতোগুলো প্রস্তাব দেখালেন, যা জেনারেল ফরমান জেনারেল নিয়াজীর কাছে নিয়ে যাচ্ছিলেন তার অনুমোদনের জন্য এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে পাঠানোর জন্য।
প্রস্তাব গুলো এই
‘আরো প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি বন্ধ করতে আমরা সম্মানজনক শর্তে এই প্রস্তাব গুলো জানাতে ইচ্ছুকঃ
৬৩৩
ক. পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতি এবং সকল সহিংসতা তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ;
খ. জাতিসংঘের আয়োজন অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের হাতে প্রশাসনের শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর।
গ. জাতিসংঘকে নিশ্চিত করতে হবেঃ
১. সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীগুলোর সকল সশস্ত্র সদস্যের পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের আগ পর্যন্ত সুরক্ষা ও নিরাপত্তা;
২. পশ্চিম পাকিস্তানি সকল বেসামরিক ব্যক্তি ও সরকারি কর্মকর্তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের আগে পর্যন্ত সুরক্ষা ও নিরাপত্তা।
৩. ১৯৪৭ এর পর পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত সকল অস্থানীয় ব্যক্তির নিরাপত্তা;
৪. ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে যারা পাকিস্তান সরকারের সেবা করেছে এবং পাকিস্তানের স্বার্থে সহযোগিতা করেছে তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রত্যাঘাতমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হবেনা এই মর্মে নিশ্চয়তা।
জেনারেল ফরমান ঐদিনই পরে আমাদের কাছে ফিরে এসে তাদের প্রস্তাবের ব্যাপারে জেনারেল নিয়াজী ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতিক্রিয়া জানাবেন বলে কথা দিয়ে গেলেন। রাত ৯ টার দিকে তিনি ফিরে এসে আমাদের জানালেন, জেনারেল নিয়াজী প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করলেও ইসলামাবাদ প্রস্তাবটি অর্থাৎ ‘পূর্ব পাকিস্তানের কাছে প্রশাসন হস্তান্তর’ প্রস্তাবটি নাকচ করে দিয়েছে।
যুদ্ধবিরতির আরো একটি উদ্যোগ এভাবেই শেষ হল।
১৬ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার
১৬ ডিসেম্বর খুব সকালে আমরা জানতে পেলাম ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ঐদিনই ঢাকার সময় সকাল সাড়ে ৯ টার মধ্যে আত্মসমর্পনের আল্টিমেটাম দিয়েছে। কর্নেল গাফফার, লীগ অফ রেডক্রস সোসাইটিজ এর সভেন ল্যামপেল ও আমি হোটেল থেকে টেলিফোনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদরদপ্তরে যোগাযোগের জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমরা কোন যোগাযোগ করতে পারলাম না। ব্রিটিশ আর্মির পদাতিক বাহিনীর একজন অফিসার হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপের ফ্রন্টে অংশগ্রহনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বেশ ভালভাবে জানি ঢাকার উপর একটা সর্বাত্মক সামরিক আক্রমণ কী মর্মান্তিক প্রাণহানি ও ধ্বংসলীলা ডেকে আনতে পারে। কর্নেল গাফফার আমাদের বললেন যেয়াগের দিন ভারতীয় বিমানহামলায় পাকিস্তানি বাহিনীর কমিউনিকেশন সেন্টার ধ্বংস হয়ে গেছে। আর তিনি নিশ্চিত জানেন না, প্রথমত, জেনারেল নিয়াজী আল্টিমেটাম গ্রহন করবেন কি করবেন না। দ্বিতীয়ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আল্টিমেটাম গ্রহন করেছে কি করেনি সেটা তারা ভারতীয় বাহিনীকে জানাতে পেরেছে কি না।
৬৩৪
ভারতীয় বিমান বাহিনী অলরেডি ঢাকার আকাশে চক্কর দিচ্ছিল। মনে হয় আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আর আমরা জানতাম যে শহরের উপকন্ঠে ভারতীয় বাহিনী শক্তি সমাবেশ করছিল। তাও মনে হয় গোলন্দাজ ও পদাতিক বাহিনী দিয়ে একটা মারাত্মক হামলা শুরু করার উদ্দেশ্যে। আমি এখানে আরো বলতে পারি যে পরে ভারতীয় বাহিনী যখন ঢাকায় প্রবেশ করে তাদের অফিসাররা আমাদের বলেছিলেন, পাকিস্তানি বাহিনী যদি তাদের আল্টিমেটাম গ্রহন না করত তাহলে সত্যি সত্যি তারা ঢাকার উপরে একটা সর্বনাশা আক্রমণ চালাত। শহরটাকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি ছিল। প্রায় সাড়ে ৮ টার দিকে কর্নেল গাফফার, ল্যামপেল ও আমি ঠিক করলাম , নিউট্রাল জোন থেকে বেরিয়ে গাড়িতে করে ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে জেনারেল নিয়াজীর কাছ থেকে শুনব কী হচ্ছে, তিনি ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন কিনা।
ক্যান্টনমেন্ট যাওয়ার পথে আমি আমার হ্যান্ডসেট রেডিওর (ওয়াকিটকি) মাধ্যমে জাতিসংঘ লোকেশনে অবস্থানরত পল-মার্ক হেনরিকে জানালাম আমরা কি করছি। তিনি ঢাকা ও নয়াদিল্লইতে জাতিসংঘ রেডিও সিগন্যালারগুলো সম্ভাব্য অতিশয় জরুরি মেসেজের জন্য অন করে সতর্কাবস্থায় স্ট্যান্ডবাই করে রাখলেন। কিছুক্ষণ পর আমরা কমান্ড বাংকারে পৌঁছালাম, কিন্তু জেনারেল নিয়াজীকে দেখা গেলনা। তবে আমরা জেনারেল ফরমানকে বাংকারের ভিতর পেলাম। স্পষ্টতই তিনি একজন প্রধান টার্গেট। তার মুখটা ছাইয়ের মত হয়ে গেছে। আর আগাগোড়াই ভেঙে পড়েছেন তিনি। আসমানের দিকে চেয়ে তিনি এমন একটা ভাব করলেন যে মনে হলো তিনি সব আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি আমাকে জানালেন, তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানে সমগ্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে কথা বলার দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি আরো জানালেন তারা ভারতীয় আলটিমেটাম গ্রহন করতে রাজি হয়েছে। তিনি ন্নিশ্চিত করে আরো জানালেন যে কমিউনিকেশন সেন্টার ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তারা আল্টিমেটাম গ্রহন করেছেন এই তথ্য ভারতীয় বাহিনীকে জানাতে পারেননি। আমি জেনারেল ফরমানের কাছে জানতে চাইলাম পুরোপুরি একটা কমিউনিকেশন চ্যানেল হিসেবে আমি জাতিসংঘের রেডিও নেটওয়র্কের মাধ্যমে পাকিস্তান বাহিনীর আল্টিমেটাম গ্রহনের খবরটা প্রচার করি তা তিনি চান কি না। জেনারেল ফরমান হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেন। আমি তাকে বাংকারের বাইরে নিয়ে এলাম যাতে আমার হ্যান্ডসেট রেডিওটি কাজ করতে পারে। আমি জাতিসংঘ লোকেশনে পল-মার্ক হেনরির সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। জেনারেল ফরমানের উপস্থিতিতে আমি পল-মার্ক হেনতিকে মেসেজটা দিলাম এবং জেনারেল ফরমান আরো দুটি পয়েন্ট যোগ করলেনঃ
১. পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ভারতীয় বাহিনীর প্রতি যুদ্ধ বিরতির সময় আরো ৬ ঘন্টা বাড়ানোর
৬৩৫