এবং তার পেছনে শক্তি আছে (ফাইনান্সিয়াল টাইমস, ৩০ জুলাই)। এরপরেই সোভিয়েত উদ্বেগ অনেক বেড়ে যায়। ৯ আগস্টে ভারত-রাশিয়া মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই বিষয়ে সোভিয়েত উদ্যোগ অনেক পুরনো ছিল তবে ভারতই এতদিন পিছপা ছিল। কিন্তু তারপরেও রাশিয়া নিরাপেক্ষতা বজায় রাখে। তারা সাবধানে সবসময় পূর্বপাকিস্তান নামটি ব্যবহার করে। নভেম্বরে আসে পরিবর্তন্দেখা গেল যে পাকিস্তানের বাংলাদেশ দখলের মনোভাবে কোন পরিবর্তন নেই, কোনরকম সমঝোতার প্রচেষ্টা নেই। তখন সোভিয়েত আগ্রহ মোড় ফেরে। তবে ভারতকে সংযমের চূড়ান্ত পরিচয় দিতে রাশিয়া সবসময় উদ্বুদ্ধ করে। ৯ ডিসেম্বর সোভিয়েত রাশিয়া যুদ্ধবিরতি সমর্থন করে তবে বাধ্যতামূলক সংলাপের অঙ্গীকার ছাড়া যুদ্ধাবসানে অনীহা প্রকাশ করে। তারা সবসময় পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সংলাপ চায়। পশ্চিম পাকিস্তানে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তারা ভারতকে উপদেশ দেয়। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে তাদের কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিলনা এবং এজন্যেই পরপর তিনবার নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রয়োগ করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই মানবতার বিজয়ের একটি মহাকাব্য। এই মহাকাব্যের মূল উপাদান বাংলাদেশেই ছিল। ভারত ও পাকিস্তানেও ছিল ব্যাপক উপাদান। তৎকালীন বিশ্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বহির্বিশ্ব এই মহাকাব্যে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে এবং তাতে প্রধান ভূমিকা রাখে কতিপয় রাষ্ট্র, যেমন-আমেরিকা, রাশিয়া, চীন ও ব্রিটেন। জাতিসংঘ একটি ভূমিকা রাখতে পারত তবে পরাশক্তিশাসিত বিশ্বে সেই সুযোগটি দেয়া হলোনা। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া বর্তমানের মত না এগোলেও ১৯৭১ সালে বিশ্বজনমত বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিংশ শতাব্দীতে সশস্ত্র বিচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশেরই উদ্ভব হয়। এজনয অবশ্য দাম দিতে হয়েছে অনেক। তিরিশ লক্ষ জীবন, আড়াইলাখ মহিলার সম্ভ্রমহানি, দেশের সম্পদের প্রায় অর্ধেক স্বাধীন বাংলাদেশে বিধ্বস্ত অর্থনীতি, সহিংস সমাজ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ব্যর্থতা- এমনি ধরনের ত্যাগ ও বঞ্চনা দেশটিকে পোহাতে হয়।
[২০৩] আবুল মাল আব্দুল মুহিত
বাংলাদেশ (১)
ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকার সম্পাদক আবুল হাসান চৌধুরী। বাংলাদেশ সম্পাদনা পরিষদের পক্ষে আবুল হাসান চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত এবং আব্দুল মমিন কর্তৃক বাংলাদেশ প্রেস, রমনা ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। পত্রিকার নামের নিচে লেখা থাকত ‘সাপ্তাহিক সংবাদপত্র’। প্রথম প্রকাশ মে, ১৯৭১। চার কলাম ও চার পাতার এই পত্রিকার মূল্য পনের পয়সা। পত্রিকাটি
২৫৫
অবরোধের সবকটি মাস সক্রিয় ছিল। যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা সংবলিত প্রবন্ধ ও অন্যান্য সংবাদও প্রকাশিত হয়। ২৩ আগস্ট সংখ্যায় একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয় ‘ছয় দফা না মুজিববাদ’। এতে বলা হয় ৬ দফা গঠনের পেছনে কাজ করেছে মুজিববাদ এবং এটি নিজেই একটা মতাদর্শ।
[৪৬৫] হাসিনা আহমেদ
বাংলাদেশ (২)
সম্পাদক অধ্যক্ষ শেখ আব্দুর রহমান ও ভারপ্রাপ্ত যুগ্ম সম্পাদক সালেহা বেগম ও রণজিৎ দাস কর্তৃক ‘বাংলাদেশ’ নামক পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। এটি একটি সাপ্তাহিক মুখপত্র, পরিকাটির নামের নিচে “রক্ত সূর্য ঊঠেছে, বীর বাঙালী গজেগেছে।” কথাগুলো লেখা রয়েছে। প্রথম প্রকাশিত সংখ্যা ও অন্যান্য বিষয় তেমন জানা যায়নি। তবে দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৫ জুন, ১৯৭১ আর বাংলায় ছিল ৩১ জৈষ্ঠ, মঙ্গলবার, ১৩৭৮। এর মূল্য ১০ পয়সা ও কলামসংখ্যা ২ দেখা যায়। প্রথম পাতার প্রধান সংবাদ শিরোনাম “শত্রু নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলার জনগণ যুদ্ধ চালিয়ে যাবে- বাংলার প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ” এ ধরনের সংবাদ ছাড়াও আরো অন্যান্য খবরাখবরও প্রকাশিত হয়।
[৪৬৩] হাসিনা আহমেদ
বাংলাদেশ (৩)
বরিশাল হতে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকাটি ছিল একটি অর্ধ-সাপ্তাহিক। সম্পাদনায় ছিলেন এসএম ইকবাল, মিন্টু বসু, হেলালউদ্দীন এবং প্রকাশনায়ঃ হারেচ এ খান, এনায়েত হোসেন, মুকুল দাস। প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১। আর বাংলায় তারিখ ছিল ৩ বৈশাখ, ১৩৭৮। দুই পাতার এই পত্রিকার দাম রাখা হয়েছিল ১৫ পয়সা। তবে এই পত্রিকাটির একটিমাত্র সংখ্যাই প্রকাশ পায়। ২য় সংখ্যা প্রকাশকালে বরিশালে বিমান হামলা ও পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমনের ফলে সবকিছু বিনষ্ট করে ফেলা হয়। প্রথম সম্পাদকীয় ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে’ এবং প্রথম পাতার প্রথম সংবাদ শিরোনাম ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ’ দিয়ে শুরু করা হয়। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে তার নিচে ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি সংযোজন করা হয়। আরো ছিল রণাঙ্গনের খবর, যুদ্ধ, রণাঙ্গনের দ্বায়িত্বভার এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিভিন্ন মন্তব্য। কাজী মকবুল হোসেন তাঁর এক প্রবন্ধে লেখেন- স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র ‘বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের গেজেট বা বাংলাদেশের সংবাদপত্র
২৫৬
সাময়িকীতে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় তাতে বরিশাল থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকাটিকেই বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
[৪৬২, ১৬৬] হাসিনা আহমেদ
বাংলাদেশ (৪)
‘বাংলাদেশ’ নামক এই পত্রিকার সম্পাদক ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন কীর্তি (মিজানুর রহমান) নামে। সাপ্তাহিক এই পত্রিকাটি বিপ্লবী পরিষদ কর্তৃক শত্রুসেনা পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের কোন এক স্থান থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। মুদ্রণে তড়িৎ নাম ব্যবহার করা হত। হাতে লেখা এই পত্রিকাটির মূল্য ২৫ পয়সা ছিল। প্রথম প্রকাশিত হয় ৩১ অক্টোবর, ১৯৭১ (১৩ কার্তিক, ১৩৭৮ বাংলা)। পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫, কলাম সংখ্যা ২ ছিল এবং এর মোট ১১ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ প্রকাশের প্রয়াস নিয়েছিল। পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যার নামের নিচে ডানপাশে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার কিছু কিছু বিশেষ উল্লেখযোগ্য অংশ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যেমন- ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন’, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়’, ‘শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থাই আমার কাম্য’। প্রথম ও শেষ সম্পাদকীয় ‘মুক্তিপথের যাত্রী সশস্ত্র বাঙালি’ এবং ‘শান্তি ও শৃংখলা রক্ষা’ ছিল। এই পত্রিকার সবগুলো সংখ্যা নিয়ে সম্পাদক মিজানুর রহমান (কীর্তি) তার সম্পাদনায় ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ৭০ দিন’ নামে ইতিমধ্যে একটি বই প্রকাশ করেছেন।
[৬৫] হাসিনা আহমেদ
বাংলাদেশ (৫)
আব্দুল মতিন চৌধুরী ‘বাংলাদেশ’ সাপ্তাহিকীটির সম্পাদক ছিলেন। প্রবাসী সরকারের জালালাবাদ আঞ্চলিক তথ্য ও জনসংযোগ দফতর থেকে এটা প্রকাশিত হত। প্রথমে পাক্ষিক পরে সাপ্তাহিক হিসেবে বেশ কিছুদিন নিয়মিত বের হয়।
[২২] হাসিনা আহমেদ
বাংলাদেশ (৬)
‘দৈনিক বাংলাদেশ’ নামক এই দৈনিক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন কাজী মাজহারুল হুদা। এই দৈনিকটি ৭ এপ্রিল দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও থেকে বের হয়। বঙ্গশ্রী প্রেস, ঠাকুরগাঁও হতে কাজী আব্দুর রহমান কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত। পত্রিকার নামের নিচে ‘স্বাধীন বাংলার স্বাধীন সংবাদপত্র’ কথাগুলো লেখা আছে।
২৫৭
৩-৪ কলামবিশিষ্ট এই পত্রিকার বিনিময়মূল্য ১৫ পয়সা। পত্রিকাটির ৭ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৬ টি সংখ্যা বের হয়। পরে আবার তেঁতুলিয়া মুক্তাঞ্চল থেকে আরো ৪ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৮ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত। ১ম বর্ষ ৭ সংখ্যার প্রকাশনা ১৮ন জুন, ১৯৭১, ঠাকুরগাঁও ৩ আষাঢ়, শুক্রবার ছিল। ৭ সংখ্যার সম্পাদকীয় ‘বিশ্ব মোড়লদের সমীপে’ এবং প্রথম পাতার প্রথম শিরোনাম ছিল ‘বীর বাঙালী লাখো সালাম’।
[৪৬৪] হাসিনা আহমেদ
বাংলাদেশ (৭)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে বহিঃপ্রচার বিভাগ থেকে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ’ বুলেটিন। এই বুলেটিন ফেরদৌস মুরশিদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় এবং এর উপদেষ্টা ছিলেন মওদুদ আহমেদ। এই বুলেটিন মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল বলে জানা যায়।
[৩২] হাসিনা আহমেদ
বাংলাদেশ ক্রাই ফর হেল্প
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বোম্বের বাংলাদেশ এইড কমিটি এই বিখ্যাত পোস্টারটি প্রকাশ করে। পোস্টারটি মুক্তিযুদ্ধের সমইয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, মানবতাবিরোধী ঘৃণ্য কাজকে বিশ্বমানবতার প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলে। প্রকৃতপক্ষে ইয়াহিয়া বাংলায় পোড়ামাটি নীতি গ্রহন করে। মূলত দুর্দশাগ্রস্ত বাঙালি শরনার্থী ও ও বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের আবেদনের জন্যেই এই পোস্টারটি প্রকাশ করা হয়। তবে এর ফলে হানাদার পাকিস্তানিদের চেহারা বিশ্ববাসীর কাছে প্রকাশ পেয়ে যায়, এতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং স্বীকৃতি পাওয়া সহজতর হয়। এই পোস্টারটি দেশ ও বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন এই পোস্টারটি মুক্তিযোদ্ধা ও অবরুদ্ধ বাঙালিদের মধ্যে উৎসাহ জোগাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
[৮১] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন
বাংলাদেশ তথ্যানুসন্ধান কমিটি
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা ধরণের খবর পৌঁছাচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গে। এর মধ্যে বিভ্রান্তিকর তথ্য/খবরও ছিল অনেক। বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি তথ্যনিষ্ঠো স্বয়ংসম্পূর্ণ রিপোর্ট প্রণোয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব হওয়ায় কলকাতায় জুলাই
২৫৮
মাসে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ তথ্যানুসন্ধান কমিটি। কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে ডা. রমেশচন্দ্র মজুমদার ও শৈবাল কুমার গুপ্ত। সদস্য ছিলেন করুনা কুমার হাজরা, রণদেব চৌধুরী, সোমেন্দ্র চন্দ্র বসু ও রেভা জন ক্রাপহাম। বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতি এর আংশিক ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য কিছু অনুদান দিয়েছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে তথ্য প্রদান করেন শেবালংমার গুপ্ত (ফোন-৪৬-৭৮২০) ‘দৈনিক আনন্দবাজারে’ একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে বলা হয়েছিল-
“কমিটির পক্ষে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রমাণ সংগ্রহ সহজ বা সম্ভব নয়, সুতরাং এপারে আগত শরণার্থীদের বিবৃতির উপরেও তাঁদের প্রধানত নির্ভর করতে হবে। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে সম্প্রতি প্রাপ্ত চিঠিপত্রের মধ্যেও মূল্যবান তথ্য থাকতে পারে। সুতরাং যেসব শরণার্থী ৫ থেকে ২৫ মার্চ এবং ২৫ মার্চের পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তাহাদিগকে নিম্নলিখিত ঠিকানায় বিবৃতি পাঠানোর জন্য আবেদন জানাচ্ছি। বিবৃতি তথ্যাশ্রয়ী অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।”
কমিটি কোন রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল কিনা জানা যায়নি।
[৫৭৬] মুনতাসীর মামুন
বাংলাদেশ দি মার্ডার অফ পিপলস
এই পোস্টারটি১৯৭১ সালে শিকাগো শহর থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। এই পোস্টারটি বাঙালির প্রতি মার্কিন জনগণের সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ। যদিও মার্কিন সরকার বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। পোস্টারটির ছবিতে দেখা যায় শত শত গৃগত্যাগী বাঙালি শরণার্থী গৃহের অভাবে অব্যহৃত সিমেন্টের পাইপের ভিতর বসবাস করছে। এই পোস্টারটিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঙালির দুঃসহ দিনাতিপাত, হানাদারদের অত্যাচার ও মানবাধিকার লংঘনের চিত্র ফুটে উঠেছে। এই পোস্টারটি স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রতি ও বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্ববাসী এবং মার্কিন জনগণের সমর্থন আদায়ে সাহায্য করেছিল। সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধা ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশের বাঙালিদের মধ্যে এক নব চেতনার সূচনা হয়। মুক্তিসংগ্রামে বাঙালি এখন আর একা নয়। তাদের পাশে এখন অনেক সহযোদ্ধা রয়েছে, বিশ্বের প্রতাপ্সহালী দেশের জনগণও তার সহযোদ্ধা।
[৫৭৩] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন
বাংলাদেশ নিডস ইওর হেল্প
৭১ X ৪৬ সেন্টিমিটার পরিমাপের এই পোস্টারটি কোথা থেকে প্রকাশিত তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে সাহায্য পাঠানোর যে ঠিকানা আছে তা ভারতের নতুন দিল্লীর।
২৫৯
তা দেখে মনে হয় এটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বাঙালিদের সাহায্যকারী সংস্থার উদ্যোগে ভারত থেকে প্রকাশিত। এই পোস্টারটিতে একটি অসহায় শিশুর ছবিই মুখ্য। একটি অসহায় শিশু, তার চোখে দুঃখের, অনিশ্চয়তার ছাপ। শিশুটির দু ফোঁটা অশ্রু দু গালে গড়িয়ে পড়ছে। এই ছবিটিকে দুভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, নিষ্পাপ শিশুটি আমাদের শান্তিময় নিষ্কলঙ্ক মাতৃভূমি বাংলার প্রতিভূ, হানাদারের আক্রমনে ‘বাংলা মা’ আজ দিশাহারা তার সন্তানের দুঃখে তার দু গাল গড়িয়ে অশ্রু ঝরছে। এই দুঃখ থেকে মুক্তি দেয়ার জন্যে মা করুন নয়নে সাহায্য চাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই নিষ্পাপ শিশুটি বাংলার নিষ্পাপ শিশুরই প্রতিকৃতি, আজ হানাদারের নিষ্ঠুর অত্যাচারের মুখে অসহায় অনাহার অনাদরে আজ তাদের জীবন ওষ্ঠাগত, হানাদারের গুলি, বেয়নেটের খোঁচায়বহু শুশু আজ মৃত; এইজন্যে শিশুটির চোখে আজ অনিশ্চয়তার ছায়া, বুঝি হানাদার বর্গী কখন তার এই ছোট্ট জীবনটা কেড়ে নেয়। পাষনড ইয়াহিয়া দাবী করেছিল পূর্ব বাংলায় পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, তাই কোন বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজন নেই। এই পোস্টার আর্ত মানবতার প্রতিভূ হয়ে ইয়াহিয়ার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে প্রকাশিত হয়। এই পোস্টারটির মূল লক্ষ্য মূলত বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক ও সামাজিক সাহায্যের পাশাপাশি বিশ্ব বিবেক কে সচেতন করা। পোস্টারটিতে সাহায্য পাঠানোর ঠিকানা ছিল Send your donation’s to Bangladesh Assistance Committee, Himalaya House, Curzon Road, New Delhi-1 (Phone-40522)
[২৭২] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন
বাংলাদেশ ফুটবল দল১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মাধ্যম মুক্তিযোদ্ধাদের অপরাজেয় সাহসিকতা অক্ষুন্ন রেখেছে তাদের নির্ভীক পদক্ষেপের মাধ্যমে। এসময় বাংলাদেশ বেতার, বিভিন্ন পত্র পত্রিকার অবিস্মরণীয় অবদান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি পদক্ষেপে প্রেরণা যুগিয়েছেসর্বাগ্রে এগিয়ে যাবার। মুক্তিযুদ্ধের সময় আরেকটি মাধ্যম যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য জনমত গঠন এবং অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে অন্যরকম একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তাহলো “স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।”
বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের উদ্যোগে গঠিত এ দলটির পেছনে যাঁদের অবদান চিরস্মরণীয়- মরহুম আলী ইমাম, জাকারিয়া পিন্টু, প্যাটেল, প্রতাপ শংকর হাজরা, আশরাফ, লুতফর রহমান প্রমুখ।
এ দলটি ভারতেরই বিভিন্ন স্থানে ১৬ টি প্রদর্শনী খেলায় অংশগ্রহন করেছিল। তারমাঝে ১২ টিতে জয়লাভ, ৩ টিতে পরাজিত, এবং ১ টিতে ড্র করার মাধ্যমে বিপুল সাড়াজাগানো প্রশংসা অর্জন করেছে।
২৬০
প্রথম খেলার পূর্বে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং জাতিয় সঙ্গীত বাজিয়ে সেদিন ভারতবাসী উষ্ণ অভ্যর্থনার মাধ্যমে বাঙালীকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন জানিয়েছিল।
স্বাধীনবাংলা ফুটবল দলের প্রথম সভাপতি ছিলেন শামসুল হক; দ্বিতীয় সভাপতি ছিলেন আশরাফ আলী চৌধুরী এবং তৃতীয় সভাপতি ছিলেন এনএ চৌধুরী
তানভীর মাঝহারুল ইসলাম তান্না ছিলেন ফুটবল দলটির ম্যানেজার এবং ননী বসাক ছিলেন গর্বিত দলটির কোচ।
স্বাধীনবাংলা ফুটবল দলে যেসব মুক্তিযোদ্ধা অভীষ্ঠ জয় অর্জনে বদ্ধপরিকর ছিলেন-
অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু, সহ অধিনায়ক প্রতাপ শংকর হাজরা, লে. নুরুন্নবী, আলি ইমাম, লালু, শাহজাহান আলম, আইনুল হক, অমলেশ সেন, কায়কবাদ, শেখ আশরাফ আলী, সুভাষচন্দ্র সাহা, বিমল কর, সাইদুর রহমান পযাটেল, তসলিম, এনায়েতুর রহমান, অনিরুদ্ধ, আব্দুল হাকিম, নওসুরুজ্জামান, কাজী সালাহউদ্দীন, খোকন সুরুজ, মোমিন, গোবিন্দ কুন্ডু, মাহবুবুর রহমান, নিহার, সঞ্জিত, লুতফর রহমান, মোজাম্মেল, পেয়ারা, সাত্তার ও মাহমুদ।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল জয়বাংলা ফুটবল দল হিসেবে পরিচিত ছিল।
রয়া মুনতাসীর
বাংলাদেশ বিমানবাহিনী
বাংলাদেশের স্বাধিনতাযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। এই বাহিনীর প্রধান ছিলেন গ্রুপ কমোডর এ কে খন্দকার। মুক্তাঞ্চলে ছোট একটি রানওয়ে ছিল। সেই রানওয়ের পাশে একটি বাঁশের ঘরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর পাইলট এবং টেকনিশিয়ানরা থাকতেন। মুক্তাঞ্চলের এই জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় রাতের আঁধারে বিমান চালিয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন গ্রুপ কমোডর এ কে খন্দকার। উল্লেখ্য ৩ ডিসেম্বর ‘৭১ তারিখের পর ভারতীয় বিমান বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সাথে যোগ দেওয়ায় প্রথম তিন-চার দিনের মধ্যেই ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তান বিমানবাহিনীকে পঙ্গু করে দিতে সমর্থ হয়েছিল।
তবে এই বিমান আক্রমনের প্রথম কৃতিত্ব নিয়েছিল নবগঠিত বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। এয়ার কমোডর এ কে খন্দকারের পরিচালনাধীন প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বৈমানিকগণ বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর নিজস্ব বিমান নিয়েই ৪ ডিসেম্বর ‘৭১ তারিখে চত্তগ্রাম ও ঢাকায় প্রথম আক্রমণ চালিয়েছিলেন। উল্লেখযোগ্য কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই তারা সেদিন বোমার আক্রমনের যে নৈপুণ্য
২৬১
দেখিয়েছিলেন তা ছিল বিস্ময়কর। এই বিমানের রক্ষণাবেক্ষণের সম্পূর্ণ দ্বায়িত্বও নিয়েছিলেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রকৌশলীগণ।
বোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বিরাজমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য একটি কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ-বিষয়ে কর্ণেল ওসমানীর তত্ত্বাবধানে একটি প্ল্যান তৈরি করা হয়। এই প্ল্যানে যুদ্ধ পরিচালনায় দক্ষ একটা কমান্ড গঠন, মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নীতি অবলম্বন, প্রশিক্ষণ ও পরিবেশের উন্নতি এবং সমন্বয় ও যোগাযোগের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনের সুপারিশ করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, আগেই বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের এক সভায় ডিপি ধর সহবহু শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় কর্মকর্তার উপস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অধিকতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং যুদ্ধোপকরণ সরবরাহের দাবী জানানো হয়।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠন ও বিমানবাহিনীর যুদ্ধ তৎপরতা সম্পর্কে জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী মন্ত্রীপরিষদ সভায় একটি প্রতিবেদন পেশ করেছিলেন। তিনি রণাঙ্গণ ঘুরে এসে অথবা যুদ্ধনীতি সম্পর্কে তাঁর পরিকল্পনা মন্ত্রীপরিষদ সভায় আলোচনা ও বিবেচনার জন্য পেশ করতেন। বিমানবাহিনী গঠন সম্পর্কিত তাঁর বিবরণ প্রণিধানযোগ্য। আমাদের নিজস্ব বিমান ছিলনা। তবে যুদ্ধের শেষের দিকে কয়েকটি বিমান নিয়ে ছোটখাট একটা বিমানবাহিনী গঠন করা হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ বৈমানিক স্থলযুদ্ধে রত ছিলেন। তাদের মধ্যে থেকে লোক নিয়ে বিমানবাহিনী গঠন করা হয়। এই বাহিনীর কৌশল ছিল গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ঘাঁটিতে হামলা করা এবং ইন্টারডিকশন অর্থাৎ শত্রুর যোগাযোগের পথকে বন্ধ করে দেবার জনয লক্ষ্যবস্তুত উপর আঘাত হানা। শত্রুর উপর যে বিমান হামলা হয়েছে তা বাংলাদেশের বীর বৈমানিকেরা করেছে। ২৬ মার্চ থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে যুদ্ধ হয়েছে তাতে আমাদের বিমান অপ্রতুল ছিল, কিন্তু আমাদের বৈমানিকগণ বিমান ঘঁটিগুলোতে আঘাত হেনেছিল।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সার্বিক সহযোগিতা দানের পূর্বশর্ত হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় চরিত্র আরোপ এবং এর অর্থনৈতিক দিকগুলো তুলে ধরার পরামর্শ দেন। বন্ধুরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা ও পরামর্শের আলকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয়। তবে বাংলাদেশ সরকার বাগেই জনগণকে বিভিন্ন নির্দেশ দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কিভাবে করতে হবে তা প্রচার করেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার, প্রচারপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে। একটি স্বাধীন দেশের পূর্ণাঙ্গ সশস্ত্র বাহিনী গঠনের প্রশ্নটিকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার তখন বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গড়ে তোলার কথাও চিন্তা করেন। বিমান বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা তখন অনুভূত হচ্ছিল। গ্রুপ কমোডর এ কে খন্দকার বিমান বাহিনী গঠনের ব্যাপার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও কর্ণেল ওসমানীর সঙ্গে
২৬২
নিবিড়ভাবে আলোচনা করেন। এ আলচনার পরিপ্রেক্ষিতে পরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের উপস্থিতিতে ভারতীয় প্রতিরক্ষা সচিব মি কে বি লাল এবং বিমানবাহিনীর এয়ারভাইস মার্শাল দেয়ানের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনা হয়।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বলেন যে, আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশ বৈমানিকদের ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গেই অপারেট করতে হবে এবং স্বভাবতই ভারতীয় নিয়ম কানুন আমাদের উপর প্রযোজ্য হবে। এ প্রস্তাবে অসম্মতি জ্ঞাপন করা হয় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে। এবং বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে আমাদের বিমান ও আনুষঙ্গিক সুবিধা প্রদানের অনুরোধ জানানো হয়। এটা এজন্য যে বাংলাদেশ বিমান তার নিজস্ব নিয়ম ও নিজস্ব সত্ত্বা নিয়ে অপারেট করতে পারলে ভারতীয় বিমান বাহিনীর অনেকটা দ্বায়িত্ব কমে যাবে। এর কারন হিসেবে উল্লেখ করা হয় যে, আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বৈমানিক ওটেকনিশিয়ানের কোন অভাব তখন ছিলনা। তাছাড়া জাতীয় সার্বভৌমত্বের কথা আমাদের বিবেচনায় সবসময়ই ছিল। পাকিস্তানি জান্তাদের অপপ্রচার সবসময়ই ছিল। বিশ্ব বিবেকও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিকে সজাগ দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল। এজন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমাদেরই পরিচালনা করতে হবে, এ আত্মসম্মানবোধ আমাদের প্রবল ছিল।
এর কিছুদিন পর কলকাতায় ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল প সি লালের সঙ্গে আবার আমাদের এ ব্যাপারে আলাপ হয়। এবার তিনি সম্মত হনেবং আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ভারতীয় বিমানবাহিনী থেকে কয়েকটি বিমান, একটি ডাকোটা, দুটি হেলিকপ্টারসহ যুদ্ধ বিষয়ক সবধরনের সহযোগিতা লাভ করি। আমাদের নিজস্ব পাইলট ও টেকনিশিয়ানগণ ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এসব বিমান, হেলিকপ্টার নিয়ে ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে বিমাঙ্ঘাঁটিতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠন করেন। সে সময় উইং কমান্ডার বাশার ৬ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নুরুল কাদের তখনো যথাক্রমে ৪ এবং ৫ নম্বর সেক্টরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে নিয়োজিত ছিলেন। এ তিনজন বিমান বাহিনী সদস্য ছাড়া বাকি সকল বৈমানিক বিমান বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হন।
স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ তখন ১ নম্বর সেক্টরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাঁকে সেখান থেকে ডিমাপুরে নিয়ে আসা হয়েবং বিমানবাহিনীর প্রশাসনিক ও অপারেশনের দ্বায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত করা হয়। এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার বাংলাদেশ বিমানবাহিনী সৃষ্টির কৃতিত্ব দাবী করতে পারেন।
এইচ টি ইমাম
২৬৩
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে জনমত সংগঠনে এবং শরণার্থীদের জন্য ত্রাণকার্য পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বিভিন্ন পেশাজীবি সংগঠনের সঙ্গে তারা যৌথ কার্যক্রম পরিচালনা কোঁরে।
সভাপতিঃ ডক্টর আজিজুর রহমান মল্লিক (তৎকালীন উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)
কার্যকরী সভাপতিঃ জনাব কামরুজ্জামান (তৎকালীন প্রধান শিক্ষক, কিশোরীলাল জুবিলী হাইস্কুল, ঢাকা)
কোষাধ্যক্ষঃ ডক্টর সারওয়ার মুর্শিদ (তৎকালীন অধ্যক্ষ, ইংরেজী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
সাধারণ সম্পাদকঃ ডক্টর অজয় রায় (রিডার, পদার্থবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ডক্টর অজয় রায় মুজিবনগর পৌঁছার পর স্বেচ্ছায় তিনি এ দ্বায়িত্ব ডক্টর রায়ের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন।)
এই সমিতির কার্যকরী সংসদের সদস্য ছিলেন সর্ব্জনাব আনোয়ারুজ্জামান (তৎকালীন পেরধান শিক্ষক, লোহাগড়া হাইস্কুল, যশোর) এবং গোলাম রশীদ
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ শিক্ষক সমতিকে সার্বিক সহায়তা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি। এই সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী। তিনি তাঁর সমিতির পক্ষ থেকে মোত ৩০০ টাকা অনুদান হিসেবে প্রদান করে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির প্রাথমিক ফান্ড খুলতে সাহায্য করেছিলেন। পরবর্তীকালে ভারত এবং বাংলাদেশের আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের আনুকুল্য পেয়েছিল এই সমিতি।
এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের এসব বাস্তুত্যাগী শিক্ষক ভারত এবং ভারতের বাইরে অনেক বেশি বেতনে চাকরির আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহযোগিতা প্রদানের বৃহত্তর স্বার্থে সেসব পদ বা আমন্ত্রণ গ্রহন করেন নি। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির উল্লিখিত নিবেদিত কর্মীর সাথে স্মরণ করতে হয় চাঁদপুর ভোলানাথ মাল্টিল্যাটারেল স্কুলের অন্যতম শিক্ষক মি. নিত্যগোপাল সাহার নাম।
এই সমিতি গঠিত হবার অল্প দিন পরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির উদ্যোগে ডক্টর এ আর মল্লিক এবং ডক্টর আনিসুজ্জামানকে পাঠানো হয়েছিল উত্তর ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে তাদের নৈতিক সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
২৬৪
সহাতক সমিতির পক্ষে এই দলে ছিলেন ডক্টর অনিরুদ্ধ রায়, অধ্যাপক অনিল সরকার, অধ্যাপক সৌরিন্দ্র ভট্টাচার্য এবং অধ্যাপক বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী। ডক্টর মল্লিকের নেতৃত্বে এই দল বহু সুধীজনের সংশয় ও দ্বিধা দূর করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁরা ভারতের তৎকালীন প্রধানম্নত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথেও দেখা করেছিলেন।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির দ্বিতীয় দলটি গিয়েছিলেন মধ্য ভারতে। এই দলে ছিলেন ডক্টর মাযহারুল ইসলাম (তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।), ডক্টর অজয় রায় এবং অধ্যাপক শামসুল আলম সাইদ। তাদের সহযোগিতা দান করেন পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। তৃতীয় দলটি যায় দক্ষিন ভারতে। এই দলে ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান এবং ডক্টর মাযহারুল ইসলাম।
‘৭১ এর ঐ দুঃসময়ে শরণার্থী শিবিরের কিশোর কিশোরীদের মধ্যে অপরাধপ্রবনতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল খুব বেশি। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির কার্যকরি সভাপতি জনাব কামরুজ্জামানের দৃষ্টি এদিকে আকৃষ্ট হল। শরণার্থী শিবিরে এদের জনয ‘ওয়েলফেয়ার সেন্টার’ বা স্কুল খোলার কাজে লেগে গেলেন তিনি। মূল উদ্দেশ্য ছিল শরণার্থী শিশুরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে উচ্ছৃখলতার দিকে যাতে পা না বাড়ায়। তাঁর এ প্রচেষ্টায় মোট ৫৬ টি স্কুল খোলা হয়েছিল এবং এতে প্রায় ৭২৫ শরণার্থী শিক্ষক নিয়োজিত হয়েছিলেন। এই প্রচেষ্টায় সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি। তাছাড়া বঙ্গীয় প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতা সভা, নেতাজী রিসার্চ ব্যুরো, নয়া প্রকাশ এবং ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি (কলকাতা শাখা) প্রভৃতি সংস্থাও এই প্রচেষ্টায় উদারভাবে সহযোগিতা প্রদান করেছে। জনাব কামরুজ্জামানের এ কাজে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির যেসব উদ্বাস্তু শিক্ষক একান্ত নিবিড়ভাবে সহযোগিতা প্রদান করেছেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার, শ্রীযুক্তা হেনা দাস, ও শ্রীমতী মালা চৌধুরী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সদস্য অধ্যাপক প্রিয়দর্শন সেন শর্মার নিরিলস সহযোগিতার কথাও কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করতে হয়। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদের কাছে বাংলাদেশের সংগ্রামের কথা পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে ‘বাংলাদেশ দ্য রিয়েলিটি’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন। পুস্তিকাটির ব্যয়ভার বহন করেছিল পশ্চিমবঙ্গের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।
ডক্টর এ আর মল্লিকের নেতৃত্বে প্রায় ৫০ জন শিক্ষক শরণার্থী পুনর্বাসন সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ কোঁরে একটি বাস্তব সম্মত পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। এছাড়া এই সমিতির পক্ষে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র এবং গ্রেট ব্রিটেনে ডক্টর মল্লিক কর্তৃক
২৬৫
গণসংযোগ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃতি বিশ্লেষন ও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির অন্যতম অবদান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটি প্ল্যানিং সেল গঠন। প্রাথমিক পর্যায়ে এই সেলের সদস্য ছিলেন ডক্টর মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, ডক্টর সারওয়ার মুর্শিদ, ডক্টর মোশাররফ হোসেন, ডক্টর আনিসুজ্জামান, ডক্টর অজয় রায় এবং অধ্যাপক সনৎ দত্ত।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সাধ্যানুযায়ী শরণার্থী শিক্ষকদের অর্থ সাহায্য প্রদান করেন। অবশ্য এ যাবৎ বেশিরভাগ অর্থ সংগ্রহ করতে সহায়তা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়তা সমিতি। শরণার্থী শিক্ষকগণের জন্য অর্থ সংগ্রহে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে যাঁরা অত্যধিক পরিশ্রম করেছেন, তাঁদের মধ্যে ডক্টর অজয় রায়, শ্রী নিত্যগোপাল সাহা, জনাব আনোয়ারুজ্জামান ও শ্রীমতি নীহার সেনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি একটি ইনফরমেশন ব্যাংক খুলেছিল। কিন্তু মূলত এই ব্যাংকের কাজ করেছেন বাংলাদেশ শিক্ষকগণ (প্রথমে জামিল চৌধুরী এবং পরে ডক্টর অসিত মজুমদার)।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীগণ এমনিভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সপক্ষে শুধু অণুপ্রেরণাই যোগাননি, তাঁদের অনেকে সরাসরি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহন করেছিলেন। এমনি কয়েকজন শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধার নাম নিচে সন্নিবেশ করলাম।
১। জনাব আতিয়ুর রহমান, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
২। জনাব নূর মোহাম্মদ মিঞা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
৩। জনাব এস এম আনোয়ারুজ্জামান, প্রধান শিক্ষক, লোহাগড়া হাইস্কুল, যশোর।
৪। জনাব হেমায়েতউদ্দীন, আলফাডাঙ্গা, ফরিদপুর।
৫। জনাব জিল্লুর রহমান, কামারগ্রাম, ফরিদপুর।
৬। জনাব নুরুল আরেফিন, ফরিদপুর।
৭। জনাব আব্দুল মালেক, ফরিদপুর।
৮। জনাব আমিরুজ্জামান, প্রধান শিক্ষক, ইতনা হাইস্কুল।
৯। জনাব হীরু মাস্টার, শিক্ষক, ইতনা হাইস্কুল, যশোর।
১০। জনাব লুতফর রহমান, কোলা, যশোর।
১১। জনাব শাহজাহান মিঞা, খুলনা।
১২। জনাব কাজী আব্দুল হাফিজ, প্রধান শিক্ষক, তেরখাদা হাইস্কুল, খুলনা।
২৬৬
১৩। জনাব বোরহানউদ্দীন, শিক্ষক, তেরখাদা হাইস্কুল, খুলনা।
১৪। জনাব আব্দুস সাত্তার, নোয়াপাড়া হাইস্কুল, যশোর।
১৫। জনাব আব্দুস সালাম, কালিয়া হাইস্কুল, যশোর
১৬। জনাব মোশাররফ হোসেন, গ্রাজুয়েট হাইস্কুল, ঢাকা।
১৭। জনাব ওয়াহিদুর রহমান, অধ্যক্ষ, লোহাগড়া কলেজ।
১৮। জনাব আবু সুফিয়ান, অধ্যাপক, দৌলতপুর কলেজ, খুলনা।
১৯। জনাব আবুল কালাম আজাদ, তৎকালীন সভাপতি, প্রাইমারী শিক্ষক সমিতি (বাংলাদেশ)
২০। জনাব আইয়ুবুর রহমান, অধ্যাপক, রামদিয়া কলেজ, ফরিদপুর।
২১। শ্রী দেব্দাস ঘোষাল। জুবিলী হাইস্কুল, ঢাকা।
২২। শ্রী অমল ব্যানার্জি, জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা।
২৩। জনাব মোসলেম উদ্দীন, চুয়াডাঙ্গা হাইস্কুল।
আগেই উল্লেখ করেছি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতিকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে কলকাতা বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি। এ দুই সমিতির উদ্যোগে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশের হণহত্যা সম্পর্কে একটি সচিত্র পুস্তিকা ‘Bangladesh the Truth’. পুস্তিকাটির কপি পৃথিবীর সম্ভাব্য সব কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছিল। এই পুস্তিকার সম্পাদনা করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর বঙ্গেন্দুগাঙ্গুলী এবং ডক্টর (শ্রীমতি) মীরা গাঙ্গুলী। প্রায় একই সময় অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রদত্ত ৭ মার্চ, ‘৭১-এর ভাষণ সংগ্রহ করে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। আওয়ামী লীগের ৬ দফা সংযোজন করেও তিনি অন্য আর একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন। শরণার্থী শিক্ষকগণের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কাহিনী অবলম্বনে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ’ নামে একটি সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন অধ্যাপক যতীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসাদুজ্জামান রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’ ডক্টর দুলাল চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতি নৈতিক সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বাংলাভাষায় লিখিত পুস্তক পুস্তিকা ছাড়াও যে কয়টি ইংরেজী পুস্তক পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল তার একটি তালিকা নিম্নে সন্নিবেশিত হলো।
1. Conflict in East Pakistan:
Background & Prospect by Professor Edward S. Mason. Robert Dorffman & Stephen A Marzlin.
2. Bangladesh Through Lens:
২৬৭
An Album containing photos of the war-torn Bangladesh.
3. Bangladesh: Throw of a New Life:
Edited by Doctor Bangendu Ganguly and Doctor (mrs) Meera Ganguly.
4. Pakistan and Bengali Culture:
by Osman Zaman (University of Chittagong)
5. Bleeding Bangladesh; A document of valuable photos.
Edited by Mrs Shipra Aditya.
উল্লিখিত সবকয়টি ইংরেজি পুস্তক-পুস্তিকা পৃথিবীর সকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। এছাড়া কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশনও ভিন্নভাবে এসব পুস্তক-পুস্তিকা পৃথিবীর বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনে পাঠিয়েছিল। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে প্রকাশিত এসব পুতক-পুস্তিকা বাংলাদেশের অনুকূলে জনমত সৃষ্টির ব্যাপারে এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশ শিক্ষক্ম সমিতি ছাড়াও জুন ‘৭১ এর মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু শিক্ষক, বঈজ্ঞানিক, চারু ও কারু শিল্পী, লেখক, সাংবাদিক, নাট্যকার ও অভিনেতা সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল ‘দি বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অফ দি ইন্টেলিজেন্সিয়া’। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির মত এই কাউন্সিলেরও উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বধীনতা যুদ্ধের সমর্থনে সহানুভূতিশীল বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এছাড়া পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির যুদ্ধাপরাধের প্রামাণ্যচিত্র তুলে ধরা, স্বাধীনতা যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণে সহযোগিতা প্রদান করা এবং যুদ্ধের কাজে নিয়োজিত উক্ত লিবারেশন কাউন্সিলের সদস্যবৃন্দের থাকা-খাওয়ার সংস্থান করাও ছিল এই কাউন্সিলের কর্মসূচির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
উক্ত ‘দি বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অফ ইন্টেলিজেন্সিয়া’র পক্ষ থেকে বিশ্ববাসীর কাছে প্রেরিত এমনি একটি আবেদনপত্রের অনুলিপি এখানে উপস্থাপন করলাম। উক্ত কাউন্সিলের সদস্য বৃন্দের নামও এ আবেদনের শেষে পরিদৃষ্ট।
AN APPEAL FROM THE BANGLADESH LIBERATION COUNCIL OF THE INTELLIGENSIA
The Bangladesh Liberation Council of the Intelligensia is an organization of the displaced teachers, scientists, poets, painters, writers, journalists and actors from Bangladesh who managed to escape the warth of the West Pakistani army which is responsible for the history’s blackest mass murders and purges.
[১৪৪] শামসুল হুদা চৌধুরী
বাংলাদেশ সরকার
দ্র. স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার
২৬৮
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানম্নত্রীর প্রথম বক্তৃতা
স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাইবোনেরা,
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের আমার সংরামী অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে তাঁদের, যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধিনতা রক্ষা করতে গিয়ে তাঁদের মূল্যবান জীবন আত্মাহুতি দিয়েছেন। যতদিন বাংলার আকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা রইবে, যতদিন বাংলার মাটিতে মানুষ থাকবে, ততদিন মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে বীর শহীদদের অমর স্মৃতি বাঙালির মানসপটে চির অম্লান থাকবে।
…. সিলেটও কুমিল্লা অঞ্চলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মোশাররফ কে আমরা সমর পরিচালনার দ্বায়িত্ব দিয়েছি। খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিবাহিনী অসীম সাহস ও কৃতিত্বের সাথে শত্রুর সঙ্গে মকাবেলা করেছেন এবং শত্রুসেনাদের সিলেট ও কুমিল্লা ও কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্টের ছাউনিতে ছাউনিতে ফিরে যেতে বাধ্য করেছেন। আমাদের মুক্তিবাহিনী শীগগিরই শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার সংকল্প গ্রহন করেছে।
চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজত জিয়াউর রহমানের উপর। নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনির আক্রমনের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলের ভাইবোনেরা যে সাহসিকতার সাথে শত্রুর মোকাবেলা করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরোধ স্টযালিংরাদের পাশে স্থান পাবে। এই সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরোধের জন্য চট্টগ্রাম আজও শত্রুর কবলমুক্ত রয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের কিছু অংশ ছাড়া চট্টগ্রাম ও সম্পূর্ণ নোয়াখালী জেলাকে ‘মুক্ত এলাকা’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল এলাকার দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছে মেজর সফিউল্লাহর ওপর। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল এলাকা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করে আমাদের মুক্তিবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পূর্বাঞ্চলের এই তিনজন বীর সমর পরিচালক ইতিমধ্যে বোইঠকে মিলিত হয়েছেন এবং এক যোগে ঢাকা রওনা হবার পূর্বেই পূর্বাঞ্চলের শত্রুদের ছোট ছোট শিবিরকে সমূলে নিপাত করার পরিকল্পনা গ্রহন করেছেন।
দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ইপিআরের বীর সেনানী মেজর ওসমানের ওপর দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কুষ্টিয়া এবং যশোর জেলার। কুষ্টিয়ার ঐতিহাসিক বিজয়ের পর আমাদের মুক্তিবাহিনী সমস্ত এলাকা থেকে শত্রু বাহিনীকে বিতাড়িত করেছে এবং শত্রুসেনা এখন যশোর ক্যান্টনমেন্টে ও খুলনা শহরের একাংশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। মেজর জলিলের উপর ভার দেওয়া হয়েছে ফরিদপুর-খুলনা-বরিশাল
২৬৯
পটুয়াখালির।
উত্তরবঙ্গে আমাদের মুক্তিবাহিনী মেজর আহমদের নেতৃত্বে রাজশাহীকে শত্রুর কবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করেছেন। মেজর নজরুল হক সৈয়দপুরে এবং মেজর নওয়াজেশ রংপুরে শত্রু বাহিনিকে সম্পূর্ণ অবরোধ করে বিব্রত করে তুলেছেন। দিনাজপুর, পাবনা ও বগুড়া জেলাকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা হয়েছে। রংপুর ও সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ছাড়া জেলার বাকি অংশ এখন মুক্ত।
স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের এ অভূতপূর্ব সাফল্য ভবিষ্যতে আরও নতুন সাফল্যের দিশারি। প্রতিদিন আমাদের মুক্তিবাহিনীর শক্তি বেড়ে চলেছে। একদিকে যেমন হাজার হাজার মানুষ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে, তেমনি শত্রুর আত্মসমর্পনের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। আর একই সঙ্গে আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসছে শত্রুর কেড়ে নেওয়া হাতিয়ার। এই প্রাথমিক বিজয়ের সাথে সাথে মেজর জিয়াউর রহমান একটি পরিচালনা কেন্দ্র গড়ে তোলেন, এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কন্ঠস্বর। এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়।
আপাতত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মুক্ত এলাকায়। পূর্বাঞ্চলের সরকারী কাজ পরিচালনার জনয সিলেট-কুমিল্লা এলাকায় বাংলাদেশ সরকারের আর একটি কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে।
আমরা এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রের প্রতিনিধি, কূটনীতিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, তাঁরা যেন স্বচক্ষে এবং সরেজমিনে দেখে যান যে স্বাধীন বাংলাদেশ আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। সাথে সাথে আমরা সমস্ত বন্ধুরাষ্ট্র ও পৃথিবীর সমস্ত সহানুভূতিশীল ও মুক্তিকামী মানুষের কাছে ও ‘রেডক্রস’ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সাহায্যের আহবান জানাচ্ছি। যা&রা আমাদের সাহায্য করতে ইচ্ছুক অথচ বর্বর ইসলামাবাদ শক্তি যাদের এই শক্তি যাদের এই মানবিক কাজটুকু করার বিরুদ্ধে নিষেধ উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁরা এখন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে সরাসরি যগাযোগ স্থাপন করতে পারেন।
আমাদের বাঙালি ভাইয়েরা আপনারা পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে থাকুন না কেন, আজকে মার্তিভূমির এই দুর্দিনে সকল প্রকার সাহায্য নিয়ে আপনাদের এগিয়ে আসতে হবে। বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে অস্ত্র কিনে আমাদের মুক্ত এলাকায় পাঠিয়ে দিন, যাতে করে আমাদের মুক্তিবাহিনীর সৈনিকরা অতি সত্ত্বর সে অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে তার মাতৃভূমিকে রক্ষা করার কাজে।
ইতিমধ্যেই আমাদের বাংলাদেশের ঘরে ঘরে প্রত্যেকেই নিজেদের হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। যাঁদের হাতে আজও আমরা আধুনিক অস্ত্র তুলে দিতে পারিনি তাঁদের আহবান জানাচ্ছি , যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে লড়াইয়ে অংশ নিন।
২৭০
আমাদের স্থির বিশ্বাস যে, শীগগিরই আপনাদের হাতে আমরা আধুনিক অস্ত্র তুলে দিতে পারব। ইতিমধ্যে প্রত্যেকে আধুনিক অস্ত্র ব্যবহারের ট্রেনিং নেবার জন্য নিকটবর্তী সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। যাদের হাতে আধুনিক অস্ত্র নেই তাদেরও এই জনযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্ব ও ক্ষমতা রয়েছে।
হানাদার শত্রুবাহিনীর সাথে কোন প্রকার সহযোগিতা করা বা সংস্রব রাখা চলবে না। বাংলাদেশে আজ কোন মীরজাফরের স্থান নেই। যদি কেউ হঠাত করে নেতা সেজে শত্রু সঈন্যের ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক গোর থেকে গাত্রোত্থান করতে চায়, যাদের গত সাধারণ নির্বাচনে বাংলার মানুষ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে তারা যদি এই সুযোগে বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়, তবে বাংলাদেশের মানুষ তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে। তারা সাড়ে সাতকোটি বাংলাদেশবাসীর রোষবহ্নিতে জ্বলে খাক হয়ে যাবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের দেশের উপর একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজেই জীবনযাত্রা ব্যাহত হতে বাধ্য। হয়ত কোথাও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
আমাদের যে সকল ভাইবোন শত্রুকবলিত শহরগুলোতে মৃত্যু ও অসম্মানের নাগপাশে আবদ্ধ, আদিম নৃশংসতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সাহস ও বিশ্বাসের সাথে মুক্তির পথ চেয়ে আছেন তাঁদের আমরা এক মুহুর্তের জন্যেও ভুলতে পারিনা। যাঁরা আমাদের সংগ্রামে শরিক হতে চান, তাঁদের জন্য রইল আমাদের আমন্ত্রন। যাঁদের পক্ষে নেহাতই মুক্ত এলাকায় আসা সম্ভব নয় তাঁদের আমরা আশ্বাস এবং প্রেরণা দিচ্ছি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে, শহীদ ভাইবোনদের বিদেহী আত্মার পক্ষ থেকে। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারেনা। ইনশাআল্লাহ জয় আমাদের সুনিশ্চিত…।
বাংলাদেশের নিরিন্ন দুঃখী মানুষের জন্য রচিত হোক এক নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষ মানুষকে শোষণ করব্রনা। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক ক্ষুধা, রোগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি। এই পবিত্র দ্বায়িত্বে নিয়োজিত হোক সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙালি ভাই-বোনের সম্মিলিত মনোবল ও অসীম শক্তি। যাঁরা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করছে বাংলাদেশের মাটি। এই মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। গণমানুষের কল্যানে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তিপ্রস্তর লেখা হোক “জয় বাংলা”, “জয় স্বাধীন বাংলাদেশ”।
[পূর্ণ বক্তৃতার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধঃ দলিলপত্র ৩ নং খন্ডের ৮-১৫ পৃষ্ঠা দেখুন।]
[১৫৩] সংকলন
২৭১
বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-যুবক সকলেই আজ মুক্তিযোদ্ধা
৫০ X ৪৬ সেন্টিমিটার পরিমাপের পোস্টারটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতরের পক্ষ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। পোস্টারটির অংকনশিল্পী প্রাণেশ কুমার মন্ডল। এই পোস্টারটি বাংলাদেশের সমাজের সকল শ্রেনী যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রগন করেছিল তারই প্রতিফলন। বাঙালি সমাজ খুব প্রাচীন সমাজ; এই সমাজে শ্রেনীভেদ প্রথা বিদ্যমান। মুক্তিযুদ্ধ সকল শ্রেনীর ভেদাভেদকে ভেঙে দিয়ে সলকে এক ন পরিয়ে পচিত করে, তা হো ‘মুক্তিযোদ্ধা’। কৃষশ্রমিক বাংলাদেশের শ্রেনী বিভাজে নিম্ন স্তরভুক্ত। তাদের মধ্যে শিক্ষার হার প্রায় শূন্যের কোঠায়। ফে এই শ্রেনী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত যুবকশ্রেনীর সাথে একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশরহন করতে পারবে কিনা তা নিয়ে অনেকের মধ্যে একপ্রকারের দ্ব্দ্ব দেখা দেয়। ইসকল দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে এসে এক কাতারে দাঁড়ানোর ব্জন্য এই পোস্টারটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সাহায্য করে। এই পোস্টারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক হল আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যে জনযুদ্ধ তা প্রমাণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। একটি দেশের সকল শ্রেনী যখন মুক্তির জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহন করে তখন তা প্রকৃত জনযুদ্ধে পরিণতি লাভ করে। এই প্রকৃত জনযুদ্ধের স্বরূপ হানাদার পাকিস্তানিদের মিথ্যা প্রচারণা ‘ভারত কর্তৃক পাকিস্তান বিভক্ত করার জন্য তাদের (ভারতীয়) মুষ্টিমেয় তাঁবেদার কর্তৃক বিশৃংখলা সৃষ্টির চেষ্টা’ এই প্রচারণার অসারতা প্রমান করে। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহনের ফলেই বাংলার স্বাধীনতা এসেছে। অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত কৃষক কৃষিকাজের পাশাপাশি গেরিলাযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছে। কখনোবা সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছে। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ শ্রমিক শ্রেনীর হাতেও উঠেছিল অস্ত্র। লক্ষ লক্ষ ছাত্র-যুবক তাঁদের প্রাণকে বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন।
এই পোস্টারটিতে সবুজ ও লাল রঙের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক জাতীয় পতাকার সাথে সাযুজ্য রেখে রঙ নির্বাচন করা হয়েছে। তাছাড়া সবুজ রঙ আমাদের সবুজ বাংলাদেশ ও লাল রঙ আমাদের সংগ্রামের দীপ্ত চেতনাকে তুলে ধরে।
[৫৭৩] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন
বাংলাদেশের প্রথম পতাকা
১৯৭০ সালের ৭ জুন পল্টন ময়দানে ছাত্রদের সামরিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিবাদন জানাতে গঠিত হয় ‘জয়বাংলা বাহিনী’। এ বাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় একটি পতাকা তৈরির, যে পতাকায় ফুটে উঠবে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন। কুচকাওয়াজের আগেরদিন সন্ধ্যায় ইকবাল হলের ১১৬ নং কক্ষে বৈঠকে বসেন
২৭২
ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম। বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ কলেজের নজরুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিবনারায়ন দাস, হাসানুল হক ইনু ও ইউসুফ সালাহউদ্দীন। বৈঠকে কাজী আরেফের প্রস্তাবনায় সিদ্ধান্ত হয় সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের মধ্যে হলুদ রঙের বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরি করার। ডিজাইনের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয় শিব নারায়নণকে। হাসানুল হক ইনু শিবনারায়ণ কে নিয়ে যান তার হলে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হলে ৪০১ নং কক্ষে শুরু হয় পতাকা ডিজাইন করা। রাত ১১ টা থেকে ২ টা পর্যন্ত কাজ করে শিব নারায়ণ দাস সম্পন্ন করেন ডিজাইনটি। সে রাতেই পতাকা সেলাইয়ের জন্য নিউমার্কেট এলাকায় যান। বলাকা বিল্ডিং এর ৩ তলায় ছাত্রলীগ অফিসের পাশে নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্সের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। টেইলার্সের ম্যানেজার নাসিরুল্লাহ পতাকা তৈরিতে রাজি হন। সে রাতেই কাজ শুরু করেন। টেইলার্স মাস্টার আব্দুল খালেক মোহাম্মাদী ভোরের আগেই তৈরি করেন বেশ কিছু পতাকা।
৭ জুন সকাল ১০ টায় পল্টন ময়দানে জয়বাংলা বাহিনির কুচকাওয়াজ। স্বপ্নের পতাকাটি গুটিয়ে কুচকাওয়াজে নেতৃত্ব দেন আ স ম আব্দুর রব। আর ছাত্রলীগের পতাকা নিয়ে অধিনায়কের দ্বায়িত্ব পালন করেন হাসানুল হক ইনু। রব হাতে গুটানো পতাকা তুলে দেন বঙ্গবন্ধুর হাতে। তারপর বঙ্গবন্ধু উপস্থিত ছাত্র জনতার সামনে সে পতাকা ওড়ান। কুচকাওয়াজ শেষে নিরাপত্তার কারনে হাসানুল হক ইনু পতাকাটি নিয়ে যান তার কক্ষে। সহপাঠী শরীফ নুরুল আম্বিয়া শেরেবাংলা হলের ৪০৪ নং কক্ষে খবিরুজ্জামানকে বলেন পতাকাটি লুকিয়ে রাখতে। দীর্ঘ ৬ মাস পতাকাটি সেখানেই ছিল। পরে ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ জাহিদ হোসেন এটি তার মালিবাগের বাসায় নিয়ে যান। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার পর ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত হয় বিশাল এক সমাবেশ। সেখানে বক্তৃতা দেন ছাত্রনেতা আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন। সে সময় শেখ জাহিদ হোসেন সে পতাকা একটি বাঁশের মাথায় বেঁধে রোকেয়া হলের দিক থেকে মিছিল নিয়ে মঞ্চস্থলে আসেন, তখন উপস্থিত ছাত্র জনতার কন্ঠে ধ্বনিত হয়, এই যে আমাদের স্বাধীন বাংলার পতাকা। সবার দৃষ্টি পতাকার দিকে। রব বক্তৃতা থামিয়ে পতাকা হাতে নিয়ে নাড়তে থাকেন। তখন বজ্রকন্ঠে শ্লোগান ওঠে ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। রাতের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অনেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৈরি করেন সেই পতাকা। ২৩ মার্চ পতাকা দিবসে সেনানিবাস ছাড়া কোথাও ওড়েনি তারকাখচিত পাকিস্তানি পতাকা। সেদিন সারাদেশে ওড়ানো হয়েছিল জয়বাংলা বাহিনীর সেই পতাকা।
২৭৩
সে থেকে পতাকাটি পরিণত হয় স্বাধীন বাংলার পতাকায়।
[৫৭৭] সংকলন
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালীদের ভূমিকা
১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী কলকাতা থেকে একটি টেলিফোন কল পান। তিনি তখন লন্ডনে। তাজউদ্দীন আহমদের নির্দেশে ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম তাঁর সাথে যোহগাযোগ করেন।
১০ এপ্রিল বিচারপতি চৌধুরী বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ভাষায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক হত্যার কথা বর্ণনা করেন। এই হত্যাকান্ডের কথা তিনি বিশ্ববাসীর কাছে জানালেন এবং দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত দেশে ফিরবেন না বলে ঘোষণা করেন। এই সাক্ষাৎকারের বিবরণ ভারতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। তাঁর বিবৃতি পড়ে সবাই খুশি হয়েছে বলে উল্লেখ করে আমীর উল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশেরর যেসব নেতৃবৃন্দ ভারতে এসেছেন তাঁরা শীগগিরই প্রবাসী সরকার গঠন করবেন এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হবেন। তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে বিদেশে প্রবাসী সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগ করতে চান, তাঁর সম্মতি নেবার জন্য আমীর উল ইসলাম কে দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিচারপতি চৌধুরী বলেন, ‘আপনাদের সঙ্গে কোনরকম যোগাযোগ না করলেও আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমি ধন্যবাদের সঙ্গে প্রবাসী সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার সম্মতি জ্ঞাপন করছি।’
আমীর-উল-ইসলাম বলেন, মন্ত্রীসভা শীগগিরই শপথ গ্রহন করবে। এবং তারপরই বিচারপতি চৌধুরীর নিয়োগপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ২১ এপ্রিল বিচারপতি চৌধুরীর নিয়োগপত্রে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষর দান করেন। এই নিয়োগপত্র সঙ্গে নিয়ে লন্ডন প্রবাসী বাঙালি ব্যবসায়ী রকিব উদ্দীন ২৩ এপ্রিল কলকাতা থেকে লন্ডন পৌঁছান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালীর ভূমিকা অনুধাবন করতে হলে পঞ্চাশের ও ষাটের দশকের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা মনে রাখতে হবে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির সময় থেকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের কর্মকর্তারা পূর্ববাংলার জনসাধারণের সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত হয়েও তারা নিজদেশে পরাধীন জীবনযাপন
২৭৪
করতে বাধ্য হয়। মুসলিম লীগের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয় পরবর্তী কালে প্রতিষ্ঠানটি আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে। বিরোধী দলের নেতাদের মধ্যে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান। পঞ্চাশের দশকে তাঁরা যখন লন্ডন আসেন তখন প্রবাসী বাঙালিরা তাঁদের সঙ্গে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক দাবিদাওয়া সম্পর্কে আলোচনা করেন। এই উপলক্ষে আব্দুল মান্নান (ছানু মিয়া), মিনহাজউদ্দীন, হরমুজ আলী ও আইয়ুব আলীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রয়োজনমত তারা বাঙালি নেতাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন এবং সর্বপ্রকার সাহায্য দিয়েছেন। পাকিস্তানের বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের অনেকেই আর্লস কোর্ট এলাকায় ২৭৫ নম্বর ওল্ড ব্রমটন রোডে অবস্থিত মান্নান সাহেবের রেস্তোরাঁ ‘গ্রীন মাস্ক’ এবং কেনসিংটন এলাকায় ২৯ নম্বর সেন্ট মেরি অ্যাবটস টেরাসে (বর্তমানে অন্য নামে পরিচিত) তাঁর নিজস্ব বাড়িতে আতিথ্য গ্রহন করেন। ১০৭০ সালের ৮ ডিসেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর জুলফিকার আলী ভুট্টো নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রকারান্তরে তাকে সমর্থন করেন। প্রবাসী বাঙালিতা বিবিসি ও লন্ডনের সংবাদপত্রের মারফত দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সর্বশেষ সংবাদ সংগ্রহ করেন। ৯ ডিসেম্বর ‘দি টাইমস’ এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে এই নির্বাচনকে পাকিস্তানের সর্বপ্রথম এবং সম্ভবত শেষ নির্বাচন বলে উল্লেখ করা হয়। রাজনীতি সচেতন ছাত্র ও কর্মীরা পরিষ্কার বুঝতে পারেন দেশের রাজনীতিতে একটা গুরুতর পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এই পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের কর্তব্য নির্ধারণ ও কার্যসূচী তৈরি করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র প্রতিষ্ঠান ও অরাজনৈতিক সংস্থা ঘরোয়া সভা ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
১৫ ডিসেম্বর নাইটস ব্রিজ এলাকায় চেশ্যাম প্লেসে অবস্থিত পাকিস্তানি ছাত্রাবাসে বাঙালি ছাত্র ও যুবকরা এক আলোচনা সভায় নির্বাচন পরবর্তী পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনার জন্য মিলিত হন। প্রস্তাবিত গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও ভুট্টো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার সুযোগ দেবেনা বলে সভায় অংশগ্রহনকারীরা একমত হন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত এ ধরনের আরো কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য ও সমর্থকরা সভায় অংশগ্রহন করেন। আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ও কর্ম পদ্ধতি সম্পর্কে একমত না হওয়ায় তখন পর্যন্ত সর্বদলীয় ‘অ্যাকশন কমিটি’ গঠন করা সম্ভব হয়নি।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ নবনির্বাচিত পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হবার কথা
২৭৫
ছিল। পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রস্তাবিত অধিবেশন বয়কট করবেন বলে ঘোষণা করেন। ২১ ফেব্রুয়ারী লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক সভায় লন্ডন আওয়ামী লীগ ভুট্টোর এই সিদ্ধান্তকে অগণতান্ত্রিক বলে ঘোষণা করে। মিনিহাজউদ্দীন এই সভায় সভাপতিত্ব করেন।
লন্ডনে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে সুলতান শরীফ বলেন, পার্লামেন্টের প্রস্তাবিত অধিবেশন্সথগিত রাখার সম্ভাবনা আঁচ করে বঙ্গবন্ধু পার্লামেন্টেড় অধিবেশন নির্ধারিত তারিখে অনুষ্ঠানের দাবীতে লন্ডনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের নির্দেশ দেন। এই নির্দেশ অনুযায়ী ২৮ ফেব্রুয়ারী লন্ডন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে এক প্রচন্ড বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৩ হাজার প্রবাসী বাঙালী এই বিক্ষোভে অংশগ্রহন করেন। বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্টের আসন্ন অধিবেশন স্থগিত রাখার বিরুদ্ধে সাবধানবানী উচ্চারণ করেন। সেদিন সন্ধ্যাবেলা ‘ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকা ও রেডিও মারফত পার্লামেন্টের অধিবেশন স্থগিত রাখার সংবাদ পাওয়া যায়। প্রবাসী বাঙালিরা অবিলম্বে মশাল মিছিল ও হাইকমিশনের সামনে ২৪ ঘন্টা ব্যাপী ‘ভিজিল’ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে এই ‘ভিজিল’ ২৮ ফেব্রুয়ারী থেকে ক্রমাগত চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়।
২ মার্চ বার্মিংহাম থেকে আজিজুল হক ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একদল বাঙালী রাজনৈতিক কর্মী লন্ডনে এসে ‘ভিজিল’ এ অংশগ্রহনকারীদের সঙ্গে যোগ দেন। ৩ মার্চ বিক্ষোভকারীরা পাকিস্তানের রাজনৈতিক মৃত্যু ঘোষণা করে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের পতাকায় অগ্নিসংযোগ করেন। বাঙালি রেস্তোরাঁর মালিকরা বিক্ষোভে অংশগ্রহনকারীদের জন্য খাবার সরবরাহের দ্বায়িত্ব নেন। ২৫ মার্চের পর বিক্ষোভকারীরা পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে থেকে সরে গিয়ে হাইড পার্কে ক্রমাগত বিক্ষোভ প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। কিছুসংখ্যক বিক্ষোভকারী ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সাহায্যের আবেদন জানান।
৩ মার্চ ‘দি ডেইলী টেলিগ্রাফ’ এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, ইসলাম ও ভূগোলের মধ্যে বিরোধের ফলে সৃষ্ট বিপরীতমুখী শক্তি পাকিস্তানকে দুভাগে ভাগ করে ফেলবে বলে আশংকা দেখা দিয়েছে। এই নিবন্ধে পাকিস্তানকে কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট মুসলিম রাষ্ট্র বলে উল্লেখ করা হয়।
৭ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে উত্তেজিত ছাত্র ও যুবকরা পাকিস্তানি ছাত্রাবাসের দেয়াল থেকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবু খুলে পায়ের তলায় ফেলে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে পাকিস্তানের সাসকদের প্রতি তাদের ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করেন। ছাত্রাবাসে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিকটবর্তী লাউন্ডস স্কোয়ারে
২৭৬
পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে ক্রমাগত বিক্ষোভ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে কয়েকশ ছাত্র ও যুবক জমায়েত হন। শেখ মান্নানের নেতৃত্বে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের যুক্তরাজ্য শাখার সদস্য এবং আওয়ামী লীগের সমর্থকেরাও এই বিক্ষোভে অংশগ্রহন করেন। পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেবার ব্যাপারে মাওপন্থীদের মধ্যে উৎসাহের অভাব ছিল। ৭ মার্চ পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা না করে শেখ মুজিব ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেন বলে তারা মনে করে।
উল্লিখিত তারিখে উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের ৯১ নম্বর হাইবারি হিল এ অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান ভবনে অনুষ্ঠিত এক গণসমাবেশে পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেদিন সন্ধ্যাবেলা পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে ছাত্র-যুবকদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে ঘোষণাটি ইংরেজি ও বাংলা প্রচারপত্র হিসেবে বিলি করা হয়।
সেদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেনঃ ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলুন এবং আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ঘোষণার খবর পরদিন লন্ডনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। ৭ মার্চ ‘দি সানডে টাইমস’ এ প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছিল, শেখ মুজিব একতরফাভাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন। যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালিরা রেসকোর্স ময়দানের জনসমাবেশে প্রদত্ত বক্তৃতার বিবরণ জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল।
৯ মার্চ (মঙ্গলবার) ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, শেখ মুজিবের অগ্নিগর্ভ বক্তৃতার পরদিন (সোমবার) ঢাকার জীবনযাত্রা মোটামুটিভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তবে এটা পরিষ্কার বোঝা যায়, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ববাংলায় পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। তাঁর অনুমতি ছাড়া কোন সরকারী কার্য পরিচালির হবেনা। গত রোববারে তার বক্তৃতা ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে প্রচারিত না হওয়ার ফলে কর্মচারীরা বেতার অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন। পরদিন (৮ মার্চ) বক্তৃতাটি প্রচারিত হওয়ার পর রেডিও স্টেশনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে।
১০ মার্চ (দি টাইমস) পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতার সারমর্ম উল্লেখ করা হয়।
বিভিন্ন দেশের সরকার কিংবা তাদের কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে পূর্ববঙ্গের আসন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ সাহায্যদানের অনুরোধ
২৭৭
জানাবার জন্য বঙ্গবন্ধুর পূর্ব-নির্দেশ অনুযায়ী মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে (১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে) সুলতান শরীফ, মিনহাজউদ্দিন ও মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আগা পন্থের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বলেন ভারত সরকার কর্তৃক এই ব্যাপারে সর্বপ্রকার সাহায্যদানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লন্ডনস্থ ভারতীয় হাইকমিশন কর্তৃক প্রবাসী বাঙালিদের সর্বপ্রকার সাহায্য দেয়া হবে। বিদেশে ভারতের প্রত্যরকটী দূতাবাসকেও প্রয়োজনীয় সাহায্যদানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ১৪ মার্চ লন্ডনে একটি গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বহু শহর থেকে দশ হাজারেরও বেশি বাঙালি হাইড পার্কে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে যোগদান করেন। হাইডপার্ক থেকে বিক্ষোভকারীরা যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতি গাউস খানের নেতৃত্বে লাউন্ডস স্কোয়ারে অবস্থিত পাকিস্তান হাইকমিশনে গিয়ে পূর্ববাংলার দাবীসংবলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। এর আগে লন্ডনে বাঞালিদের এত বড় সমাবেশ আর দেখা যায়নি।
এই সমাবেশের পর বাঙালিদের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি পায়। কয়েকদিনের মধ্যে তারা প্রায় ১৫ টি শহরে ‘অ্যাকশন কমিটি’ গঠন করেন। এই শহর গুলোর মধ্যে ছিল লন্ডন, বার্মিংহাম, লিডস, ব্রাডফোর্ড ও ম্যানচেস্টার। ইতিপূর্বে বার্মিংহামে সংগঠিত পূর্ব পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি নাম গ্রহন করে। এই কমিটি বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের বীভৎস হত্যাকান্ড সম্পর্কে সংবাদ পরিবেশন করার জন্যে তাঁরা ‘বিদ্রোহী বাংলা’ শীর্ষক একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই কমিটির উদ্যোগে ২১ মার্চ বার্মিংহামে একটি গণসমাবেশের আয়োজন করা হয়। এই সমাবেশে ৭ হাজারেরও বেশি বাঙালি ও তাঁদের দাবির সমর্থকরা যোগদান করেন।
১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় পৌঁছেন। ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণে ২১ মার্চ জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসেন। ২২ মার্চ বঙ্গবন্ধু ও ভুট্টো এক বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠক অনুষ্ঠানকালে ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়, গণপরিষদের প্রারম্ভিক অধিবেশনের তারিখ ২৫ মার্চ থেকে পিছিয়ে দেয়া হবে।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালি ছাত্রদের প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গল স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি’ ও তাদের সমর্থকরা ২৩ মার্চ তারিখে ‘দি টাইমস’ এ প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপনে বাংলার জনগণের সঙ্গে তাদের সংহতি ঘোষণা করে। ছাত্রনেতা এ জেড মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু অ্যাকশন কমিটির কনভেনার ছিলেন।
২৫ মার্চ সন্ধ্যার আগে করাচি থেকে প্রেরিত ‘দি টাইমস’ ও ‘দি গার্ডিয়ান’ এর সংবাদদাতাদের খবরে বলা হয়, ইয়াহিয়ার সংগে শেখ মুজিবের আলচনা ব্যর্থ হয়েছে। শেখ মুজিব এক জরুরী ঘোষণা জারি করে বিদেশী কোম্পানিদের
২৭৮
মাল রপ্তানী সম্পর্কিত আর্থিক লেনদেন পূর্ব বাংলার দুটি ব্যাংকের মারফত করার নির্দেশ দেন। করাচির পরিবর্তে ম্যানিলা ও লন্ডনের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে টেলিযোগাযোগ রক্ষার জন্য তিনি বিদেশী ডাক ও টেলিফ্রাফ কোম্পানীদের অনুরোধ করেন।
প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়ার এক খবরে প্রকাশ, পূর্ববঙ্গের ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশের অসহযোগিতার ফলে পাকিস্তানি সৈন্যরা পুলিশ বাহিনিকে অস্ত্র পরিত্যাগে বাধ্য করতে পারেনি। তাছাড়া ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, অস্ত্রধারী রিজার্ভ পুলিশ ও বেসামরিক পুলিশ বাহিনির বাঙালি সদস্যরা একযোগে শেখ মুজিবের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ২৬ মার্চ লন্ডনের সংবাদপত্রে এসব খবর ফলাও করে প্রকাশ করা হয়। পরবর্তী খবরে প্রকাশ, ২৫ মার্চ দিবাগত রাত্রির অন্ধকারে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের রক্তপিপাসু বর্বর সেনাবাহিনী বাংলাদেশের অসহায় পুরুষ-মহিলা-শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করে রক্তবন্যার সূচনা করে। এই কালরাত্রির স্মৃতি স্বাধীনতামন্ত্রে দীক্ষিত বাঙালি জাতি কোনদিন ভুলবেনা। ১৯৭১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদানের জন্য জেনেভায় আসেন। তার সঙ্গে আসেন বেগম চৌধুরী ও তাঁদের ছোট ছেলে এবং একমাত্র মেয়ে। তাঁদের বড় ছেলে কায়সার বছর খানেক আগে পড়াশোনার জন্য লন্ডনে এসেছে। তার সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ কাটানোর জন্য বিচারপতি চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে লন্ডনে রেখে জেনেভায় ফিরে যান।
মার্চ মাসের মাঝামাঝি ঢাকার নানা খবরে বিচারপতি চৌধুরী উদ্বিগ্ন বোধ করেন। দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষের দিকে জেনেভার একটি পত্রিকায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র নিহত হবার খবর পান। ১৫ মার্চ তারিখে লিখিত এক পত্রে তিনি প্রাদেশিক শিক্ষা সচিবকে জানান, ‘আমার নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর গুলি চালনার পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোন যুক্তিসঙ্গত কারন নেই, তাই আমি পদত্যাগ করলাম।’ জেনেভায় অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে তিনি পত্রখানি ঢাকায় পাঠান।
৭ মার্চ বাঙালিছাত্রদের সর্বদলীয় এক বিরাট সভায় বিস্তারিত আলোচনার পর ১১ সদস্যবিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি ইন গ্রেট ব্রিটেন’ গঠন করা হয়।
১ থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত বাঙালি ছাত্ররা রাউন্ডস স্কোয়ারে পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে ২৪ ঘন্টা অবস্থান ধর্মঘট করে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ৭ মার্চ যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ কর্তৃক আয়োজিত এক প্রতিবাদ মিছিলে হাজার হাজার বাঙালি জনসাধারণের সঙ্গে
২৭৯
ছাত্ররাও যোগ দেয়। আন্দোলনের প্রথমদিকে ছাত্ররা দলে দলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ভারত, শ্রীলংকা ও বার্মার দূতাবাসে বারাবার গিয়ে স্মারকলিপি ও আবেদন পত্র পেশ করে। তাছাড়া বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও জাতিসংঘের কাছে প্রেরিত তারবার্তায় বাংলাদেশে পাকিস্তান কর্তৃক গণহত্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সংবাদপত্রের কাটিং এবং বিভিন্ন তথ্য সংবলিত প্রচারপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। শমিক দলীয় সদস্য পিটার শোর-এর সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের পর তিনি শেখ মুজিবের শারীরিক নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এরপর থেকে জন স্টোনহাউস, ব্রুস ডগলাসম্যান, ফ্রেড ইভান্স, টোবি জেসেল এবং পার্লামেন্টের অন্য সদস্যরা বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন এবং সর্বপ্রথম সাহায্যের আশ্বাস দেন। পার্লামেন্টের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগকালে ছাত্র প্রতিনিধিরা জোর দিয়ে বলেন, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কোন সমাধান বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহনযোগ্য নয়।
বাংলাদেশে পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবিতে বাঙালিছাত্র শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক) ও তাঁর সহকর্মী আফরোজ আফগান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের নিকটবর্তী রাস্তার ফুটপাতে ২৫ মার্চ (বৃহস্পতিবার) থেকে অনশন শুরু করেন। অনশনকারীদের ছবি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কয়েকদিন পর শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শোর এর অনুরোধে শামসুদ্দিন চৌধুরী ও তার সহকর্মী অনশন ভঙ্গ করেন।
২৬ মার্চ সকালবেলা বিবিসির খবর শুনে বিচারপতি চৌধুরী অনুমান করলেন, বাংলাদেশে গুরুতর কিছু একটা ঘটেছে। ঢাকার সঙ্গে বাইরের জগতের কোন যোগযোগ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক শিক্ষিকার কথা তাঁর মনে পড়ল। তিনি অত্যন্ত অস্বস্তিবোধ করলেন। সেদিনের অধিবেশনে গিয়ে তিনি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মি. এগিলার অনুমতি নিয়ে বিবিসির খবরের কথা উল্লেখ করে লন্ডনে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেন।
লন্ডন বিমানবন্দরে তাঁর বড় ছেলে কায়সার ও হাবিবুর রহমান তাকে অভ্যর্থনা জানায়। হাবিবুর রহমান তখন পাকিস্তান হাইকমিশনে কর্মরত ছিলেন। বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের ফলে তিন সপ্তাহ পরে তিনি চাকরিচ্যুত হন। দক্ষিণ লন্ডনের বাসায় পৌঁছাবার কিছুক্ষণ পর সুলতান মাহমুদ শরীফ কয়েকজন বাঙালি সহকর্মীসহ বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা সবাই ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে বিচারপতি চৌধুরীর মতো শংকিত ছিলেন।
২৮০
তিনি তখনই ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ের প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ডের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। সন্ধ্যার পর তাঁর সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। পরদিন (শনিবার) ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও তিনি বেলা ১১ টার সময় বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজি হন। তাঁর অনুরোধক্রমে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রীর একান্ত সচিব মি. ব্যারিংটনও পরদিন পররাষ্ট্র দপ্তরে আসতে রাজি হন।
২৬ মার্চ যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতা গাউস খানের উদ্যোগে লন্ডনের বেরিক স্ট্রিটে অবস্থিত তাঁর এলাহাবাদ রেস্তোরাঁর উপরতলার অফিসে এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনার পর পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে অবিলম্বে বিক্ষোভ প্রদর্শনের সিদ্ধান্ট গ্রহন করা হয়।
সেদিন সন্ধ্যার দিকে হাইকমিশনের সামনে প্রায় ৩০০ বাঙালি ছাত্র ও জনসাধারণ তুমুল বিক্ষোভ শুরু করেন, একপর্যায়ে তারা হাইকমিশন ভবন দখলের চেষ্টা করেন। রাত্রি প্রায় নয়টার দিকে উত্তেজিত ছাত্র ও যুবক এবং পুলিশের সংগে এক সংঘর্ষের ফলে মোহাম্মদ ইসহাক ও শফিকুল হক সহ মোট আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। মি. ইসহাক তখন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উৎসাহী সদস্য ছিলেন। পরদিন তিনজনের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দায়ের করে। ১ জুন মার্ল্বারা স্ট্রিট কোর্টে প্রেরিত মামলায় মি. ইসহাককে ছয় সপ্তাহের কারাদন্ড দেওয়া হয়। গাউস খান এই মামলার ব্যয় বহন করেন।
লন্ডনে আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনহাজ উদ্দীনও এই বিক্ষোভে যোগ দেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তান হাইকমিশনার কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে না নেওয়া পর্যন্ত তিনি হাইকমিশন ভবনের বাইরে অবস্থান করবেন। ২৭ মার্চ ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয় প্রায় একশ জন ছাত্র ও জনসাধারন সারারাত হাইকমিশন ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এদের মধ্যে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের নেতা শেখ আব্দুল মান্নান এবং ছাত্রনেতা মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জুও ছিলেন।
২৭ মার্চ হাবিবুর রহমান বিচারপতি চৌধুরীকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে নিয়ে যান। তিনি মি. সাদারল্যান্ডের রুমে পৌছানোর পর মি. ব্যারিংটন এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেন। কিছুক্ষণ পর মিস্টার সাদারল্যান্ডের সেক্রেটারি ঢাকা থেকে টেলেক্সযোগে সংবাদ আসছে বলে খবর দিলেন। টেলেক্সের লম্বা সংবাদ পড়ার মাঝখানেই বেদনা ও সহানুভূতি ভরা মুখ তুলে মি. সাদারল্যান্ড বিচারপতি চৌধুরীর দিকে তাকালেন। ধীরে ধীরে তিনি বললেন, ‘খবর খুব খারাপ। বহু লক প্রাণ হারিয়েছে। আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্রছাত্রী হতাহত হয়েছে।’ এই কথা বলে তিনি আবার পড়তে শুরু করলেন। পড়া শেষ হলে তিনি বললেন, ‘পঁচিশে মার্চ দিবাগত রাতে ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার একটি ভয়াবহ রাত যাপন করেন।
২৮১
পরেরদিন তিনি গুলশান থেকে শহরের দিকে আসার চেষ্টা করে রাস্তায় অনেক মৃতদেহ দেখে ফিরে যান। জনৈক ফার্স্ট সেক্রেটারী সান্ধ্য আইন শিথিল করার পর অল্পক্ষণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পেরেছিলেন। তিনি দেখেছেন ইকবাল হলের সিঁড়ি বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পরছে। তিনি জানতে পারেন, জগন্নাথ হলের সামনে গণকবর খুঁড়ে সেখানে নিহত ছাত্র শিক্ষকদের মৃতদেহ ছুড়ে ফেলা হয়। আর যেসব ছাত্রকে গুলির ভয় দেখিয়ে মৃতদেহ গণকবরের সামনে আনতে বাধ্য করা হয়, তাদেরও পরে গুলি করে সেই কবরেই ফেলা হয়।’
বিদেশী দূতাবাস কর্তৃক টেলেক্স ব্যবহার নিষিদ্ধ করার ফলে ঢাকা থেকে এরপর সংবাদ পাঠানো যাবেনা বলে মি. সাদারল্যান্ডকে জানানো হয়।
বিচারপতি চঊধুরী মি. সাদারল্যান্ডকে বলেন, ‘এই মুহুর্ত থেকে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আমার আর কোন সম্পর্ক রইলনা। আমি দেশ থেকে দেশান্তরে যাব, আর পাকিস্তানি সৈন্যদের এই নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার কথা বিশ্ববাসীকে জানাব। তারা আমার ছেলেমেয়েদের হত্যা করছে। এর প্রতিবিধান চাই।’
বিদায় নেবার আগে বিচারপতি চৌধুরী পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেবার জন্য মি. সাদারল্যান্ডকে অনুরোধ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম ( পরবর্তীকালে লর্ড হিউম) তখন স্কটল্যান্ডে ছিলেন। লন্ডন ফিরে আসলে তিনি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেবেন বলে তিনি কথা দিলেন। তাছাড়া তাছাড়া বৈদেশিক সাহায্য দফতরের মন্ত্রী রিচার্ড উড-এর সাথে সাক্ষাৎ করার ব্যবস্থা করে দেবেন বলে আশ্বাস দেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের আগে সংবাদপত্রে কোন বিবৃতি নে দেয়ার জন্য তিনি বিচারপতি চৌধুরিকে অনুরোধ করেন। কারন, সংবাদপত্রে বিবৃতি দেবার পর তাকে বিদ্রোহী ব্যক্তি হিসেবে গন্য করা হবে।এর ফলে তার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে প্রটোকল ভঙ্গের অভিযোগ উঠতে পারে।
বাংলাদেশের হত্যাকান্ডের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ আন্দোলনের কয়েকজন সমর্থক প্রাথমিক আলাপ আলোচনার পর ২৭ মার্চ একটি ইংরেজি নিউজলেটার প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩০ মার্চ নিউজলেটার এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ আন্দোলনের অকুন্ঠ সমর্থক ফরিদ এস জাফর সম্পাদনার দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রাক্তন এয়ার কমোডর এম কে জানজুয়া সম্পাদনা পরিষদের সদস্য হন। কিছুকাল পর ড. প্রেমেন আড্ডি এই উদ্যোগে অংশগ্রহন করেন।
আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার’-এ প্রবাসী বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিবরণ, ‘মুজিবনগর’ সরকারের কার্যক্রম, মুক্তিবাহিনির সামরিক তৎপরতা, বাংলাদেশ আন্দোলনে বিদেশী সমর্থকদের অবদান, মুক্তিবাহিনীর আক্রমনে পর্যুদস্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী
২৮২
সম্পর্কিত খবর এবং বিদেশী সংবাদপত্রে প্রকাশিত বাংলাদেশ সম্পর্কিত খবর ও সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশ করা হয়। এর ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের গতি ও প্রকৃতি সম্পর্কে একটি পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হয়।
২৭ মার্চ বিকেলবেলা শিল্পী আব্দুর রউফ ও মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জুসহ কয়েকজন ছাত্র ও যুবনেতা বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। তাছাড়া ব্রিটেনে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ড. মোশাররফ হোসেন জোয়ার্দার এবং আব্দুল হাকিমও তার সঙ্গে দেখা করেন।তাঁদের সবাইকে তিনি সংঘবদ্ধ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গঠনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবার পরামর্শ দেন। তাঁর নিজের ভূমিকা সম্পর্কে বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীনুতা আন্দোলনের পক্ষে কাজ করে যাবেন। তাছাড়া বিভিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, শিক্ষাবিদ ও পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের সাহায্য প্রার্থনা করবেন।
উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের পূর্ব পাকিস্তান ভবনে সেদিন বিকেলবেলা ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২৯ মার্চ ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, প্রায় ৮০০ লোক এই সভায় যোগদান করে। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ, লন্ডন আওয়ামী লীগ এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মস্কো ও চীনপন্থী গ্রুপসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা সভায় হাজির হয়েছিলেন। ছাত্রদের প্রস্তাবিত কর্মপন্থার প্রতি সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা তাদের সঙ্গে একযোগে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহনে বিরত থাকেন। পূর্ব লন্ডনের আর্টিলারি প্যাসেজে একটি ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে আওয়ামী লীগ সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সদস্যরা তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য পৃথক সভার আয়োজন করেন। এই সভায় পূর্ব পাকিস্তান ভবনের বক্তব্য পেশ করার জন্য পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি একটি প্রতিনিধিদল পাঠানো হয়। শেখ আব্দুল মান্নান এই প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। পুর্ব পাকিস্তান ভবনে সবার শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
পূর্ব লন্ডনের সভায় যোগদানের জন্য ব্রিটেনের বিভিন্ন শহর থেকে প্রতিনিধিরা আসেন। পূর্ব পাকিস্তান ভবন থেকে সরাসরি পূর্ব লন্ডনে গিয়ে শেখ আব্দুল মান্নান, আমীর আলী, মোহাম্মদ আইয়ুব, সাখাওয়াত হোসেন এবং আরো কয়েকজন এই সভায় যোগদান করেন। গাউস খান এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন সম্পর্কে দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পরবর্তী সভায় গ্রহনের প্রস্তাব অনুযায়ী ২৯ মার্চ সোমবার পর্যন্ত সভার কাজ স্থগিত রাখা হয়।
শনিবার বিকেলবেলা পূর্ব লন্ডনের ফুরনিয়ার স্ট্রিটে অবস্থিত পাকিস্তান ওয়ালফেয়ার এসোসিয়েশনের বাড়িতে অনুষ্ঠিত অপর এক সভায় কয়েকশ
২৮৩
বাঙালি যোগদান করেন। এদের মধ্যে অনেকেই প্রয়োজনমতো মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে নিজেদের নামঠিকানা তালিকাভুক্ত করান।
‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ২৮ মার্চ (রোববার) প্রায় ৭ হাজার পতাকা ও প্ল্যাকার্ড ধারী বাঙালি বার্মিঙ্ঘামের স্মলহিথ পার্কে সমবেত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানায়। তাদের ব্যানারে ‘পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ’ শব্দগুলো বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল। (‘দি গার্ডিয়ান’ ২৯ মার্চ, ১৯৭১)।
২৮ মার্চ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারেও একটি বিরাট প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সমর্থকেরাও এই সভায় যোগদান করেন। বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, কভেন্ট্রি, লুটন ও অন্যান্য শহর থেকে কোচ ও ট্রেনযোগে কয়েক হাজার বাঙালি এই সভায় যোগদানের জন্য আসেন। সভায় বিভিন্ন বক্তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করেন এবং বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেবার জন্য বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর প্রতি আহবান জানান। গাউস খান ট্রাফালগার স্কোয়ারে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তলন করেন।
২৮ মার্চ পশ্চিম লন্ডনের লেডবেরি রোডে মিসেস জেবুন্নেসা বখসের বাড়িতে নেতৃস্থানীয় বাঙালি মহিলারা সমবেত হয়ে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি গঠন করেন। মিসেস বকস সর্বসম্মতিক্রমে প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন। সমিতির পক্ষ থেকে ফেরদৌস রহমান, আনোয়ারা জাহান ও মুন্নী রহমান জনসংযোগের দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন।
বিচারপতি চৌধুরী তাঁর ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ শীর্ষক স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “বাংলাদেশ মহিলা সমিতি অত্যন্ত কর্মচঞ্চল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। এরা পৃথকভাবে বেশ কয়েকটি সম্মেলনের আয়োজন করেন। তাছাড়া স্টিয়ারিং কমিটি ও অন্যান্য সমিতি কর্তৃক আয়োজিত সভায় মহিলা সমিতির সদস্যবৃন্দ যোগদান করেন। সমিতির পক্ষ থেকে বক্তৃতা করেন সভানেত্রী জেবুন্নেসা বকস ও অন্যান্য মহিলা নেতৃবৃন্দ। আমাদের আন্দোলনের কাজে ব্যবহৃত পোস্টারগুলো লেখায়ও তাদের অবদান ছিল অপরিসীম। ফেরদৌস রহমানের বাড়িতে যখনই গিয়েছি, দেখেছি তাঁর বাড়ি বোঝাই রয়েছে পোস্টার। আর সবাই মিলে তইরি করছেন পোস্টার, পতাকা ইত্যাদি।
“মহিলা সমিতি একটি শোভাযাত্রা করে ‘সেভ দি চিলড্রেন ফান্ড’ এর অফিসে গিয়ে ভারতে অবস্থানরত শরনার্থী শিশুদের মৃত্যু ও দুর্বিসহ জীবনযাপনের বর্ণনা দেয় এবং একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন। পল কনেট কর্তৃক প্রেরিত ‘অপারেশন ওমেগা’ সংক্রান্ত কাজেও মহিলা সমিতি যথেষ্ট সহায়তা করে।”
২৮ মার্চ কার্ডিফ থেকে বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি ইন ওয়েলসের সদস্যরা
২৮৪
লন্ডনে এসে বেঙ্গল স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির সদস্যদের সঙ্গে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, শ্রীলংকা ও সোভিয়েত দূতাবাসে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আবেদন জানান। ২৭ মার্চ গঠিত ওয়েলস সমিতির সদস্যরা কার্ডিফের অ্যাঞ্জেল হোটেলের সামনে জমায়েত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে প্রচারপত্র বিলি করেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তখন অ্যাঞ্জেল হোটেলে ছিলেন। ১১ এপ্রিল ওয়েলস কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় প্রায় ৫০০ জন বাঙালি উপস্থিত ছিলেন। এঁরা ওয়েলসের বিভিন্ন শহর থেকে সভায় যোগ দেবার জন্য কার্ডিফে আসেন।
২৯ মার্চ সোমবার লন্ডনের পোল্যান্ড স্ট্রিটে অবস্থিত মহাঋষি রেস্তোরাঁয় গাউস খানের সভাপতিত্বে পূর্ব লন্ডনের অসমাপ্ত সভার কাজ শুরু হয়। সভায় আলাপ-আলোচনার পর ‘কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ’ নামে প্রতিষ্ঠান গঠন সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে সংগঠিত অ্যাকশন কমিটি গুলোকে কাউন্সিল কর্তৃক অনুমোদন দানের ক্ষমতা অর্পন করা হয়। কার্যকরী পরিষদ হিসেবে ১১ জন নির্বাচিত সদস্য এবং ব্রাডফোর্ড, শেফিল্ড, গ্লাসগ, বার্মিংহাম প্রভৃতি শহরে সংগঠিত অ্যাকশন কমিটির ১০ জন প্রতিনিধি নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। গাউস খান, শেখ আব্দুল মান্নান, আতাউর রহমান খান, ও কোহিনূর রেস্তোরাঁর মালিক আব্দুল হামিদ যথাক্রমে কমিটির প্রেসিডেন্ট, জেলারেল সেক্রেটারী সাংগঠনিক সেক্রেটারি, সাংগঠনিক সেক্রেটারি ও কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। উইন্ডমিল স্ট্রিট্রে লক্ষ্মৌ রেস্তোরাঁর মালিক কর্তৃক শওকত আলী তাঁর রেস্তোরাঁর দুটি রুম বিনা ভাড়ায় কমিটির অফিস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য দেন। তাছাড়া তিনি অফিসের কাজে বিনা খরচে একটি টেলিফন ব্যবহার করার অনুমতি দেন।
যুক্তরাজ্যের প্রায় প্রত্যেকটি অ্যাকশন কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটির কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে অনুমোদন গ্রহনের বিরোধিতা করে। এই কমিটির উৎসাহী সদস্যদের মধ্যে ছিলেন নুরুল হক চৌধুরী, এ এইচ জোয়ার্দার, নৃপেন্দ্রনাথ ঘোষ, মোহাম্মদ রফিক ও এ ইসলাম। মি. তালুকদার ও নুরুল হক চৌধুরী যথাক্রমে এই কমিটির প্রেসিডেন্ট ও প্রচার সম্পাদক ছিলেন। মি. তালুকদার ২৯৪ নম্বর স্টেথাম হাই স্ট্রিটে অবস্থিত ‘কুলাউড়া’ রেস্তোরাঁর মালিক ছিলেন। রেস্তোরাঁর উপরের তলা অ্যাকশন কমিটির অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। নুরুল হক চৌধুরীর ‘বাংলাদেশ ফাইট ফর ফ্রিডম’ শীর্ষক একটি ইংরেজি পুস্তিকা এই কমিটি প্রকাশ করে। বিচারপতি চৌধুরী এই পুস্তিকার ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন।
বার্মিংহামের দুটি অ্যাকশন কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটির কর্তৃত্ব মেনে নেওয়া সত্ত্বেও গাউস খানের নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি হয়নি। এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের
২৮৫
স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। এ দুটি কমিটির মধ্যে জগলুল পাশা ও আজিজুল হক ভূঁইয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত কমিটি সদস্য সংখ্যার বিচারে লন্ডনের পর দ্বিতীয় স্থান দখল করে। মি. পাশা ও মিস্টার ভূঁইয়া যথাক্রমে এই কমিটির প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারী ছিলেন। তোজাম্মেল হক অপর কমিটির নেতা ছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কিত কার্যকলাপে উভয় কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটিকে পূর্ণ সহযোগিতা করে।
২৯ মার্চ ‘দি টাইমস’ এর সংবাদদাতার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকার প্রসংগে গাউস খান বলেন, নবগঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল তাঁর নেতৃত্বে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে চারদফা পরিকল্পনা পেশ করেন। এই পরিকল্পনাইয় ব্রিটেন কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান, জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য ব্রিটেন কর্তৃ অনুরোধ জ্ঞাপন, তৈরি অস্ত্র সস্ত্র পশ্চিম পাকিস্তানে চালান নিষিদ্ধ এবং অসহায় ও নিরস্ত্র জনসাধারণকে নির্বিচারে হত্যার নীতি পরিহার করার জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহনের প্রস্তাব করা হয়। পররাষ্ট্র দপ্তর তাদের পরিকল্পনা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনার আশ্বাস দেয় বলে মি. খান প্রকাশ করেন।
৩০ মার্চ তারিখের ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ এর লিড স্টোরিতে ঢাকার বিস্তারিত খবর সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সংবাদদাতা সাইমন ড্রিং ২৫ মার্চ রাতে অন্য বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান শেরাটন হোটেল) ছিলেন। বিদেশী সাংবাদিকদের যখন বহিষ্কার করা হয়, তখন তিনি হটেলের ছাদে লুকিয়ে ছিলেন। পরে সুযোগমত হোটেল থেকে বেরিয়ে গিয়ে সারা শহর ঘুরে তিনি হত্যা ও ধ্বংসলীলা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেন।
তিন কলামব্যাপী সংবাদে বলা হয়, আল্লাহ ও অখন্ড পাকিস্তানের নামে ঢাকাকে একটি বিধ্বস্ত ও ভীতসন্ত্রস্ত নগরীতে পরিণত করা হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনি কর্তৃক ২৪ ঘন্টাব্যাপী নিষ্ঠুর ও নির্মম গোলাগুলির ফলে অন্তত ৭ হাজার লোক নিহত ও বিস্তীর্ণ এলাকা ধূলিসাৎ হয়েছে। ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার কর্তৃক ‘দেশের অবস্থা শান্ত’ বলে দাবী করা সত্ত্বেও হাজার হাজার লোক শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে যাচ্ছে।
সাইমন ড্রিং বলেন, শেখ মুজিবকে টেলিফোনে সতর্ক করে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে অবহিত করা হয়। তিনি তাঁর বাড়ি ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেন। তাঁর জনৈক আস্থাভাজন ব্যক্তিকে তিনি বলেন, “আমি যদি পালিয়ে থাকি তাহলে তারা (পাকিস্তান সেনাবাহিনী) আমাকে খুঁজে বের করার জন্য সমগ্র ঢাকা নগরীকে পুড়িয়ে দেবে।”
সাইমন ড্রিং এর এই রিপোর্ট প্রবাসী বাঙালিদের সংঘবদ্ধ করার ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করে। স্বাধীনতা সংগ্রামে অংগ্রহঙ্কারীরা এই রিপোর্টটি অমূল্য
২৮৬
দলিল হিসেবে ব্যবহার করেন।
‘ইনার টেম্পল’এ অধ্যয়নরত আইনের ছাত্র শামসুল আলম চৌধুরী বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ৩০ মার্চ লন্ডন পৌঁছান। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক অনুষ্ঠিত হতযাকান্ডকে গণহত্যা বলে উল্লেখ করে কয়েকটি হত্যা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দেন। ঢাকায় ধানমন্ডি এলাকায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছে তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে তিনি ছিলেন। তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বিবরণ ‘দি ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড’ ও ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকশিত হয়।
মার্চ মাসের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র প্রেরণের প্রতিবাদে স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির সদস্য আব্দুল হাই খান ও মিসেস রাজিয়া চৌধুরী লন্ডনে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। বিচারপতি চৌধুরীর অনুরোধক্রমে তাঁরা অনশন প্রত্যাহার করেন।
৩০ মার্চ বিচারপতি চৌধুরী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং সেন্ট ক্যাথরিন কলেজের অধ্যক্ষ লর্ড অ্যালেন বুলকের সাথে দেখা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হতাহত শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের কথা জানান। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী বিচারপতি চৌধুরী কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিজ অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারী জেনারেল স্যার হিউ স্প্রিঙ্গারের সাথে দেখা করেন। স্যার হিউ ইতিমধ্যে সংবাদপত্রের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হত্যাযজ্ঞের খবর পেয়েছিলেন। বিচারপতি চৌধুরীর অনুরোধ অনুযায়ী স্যার হিউ হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে তারবার্তা পাঠান। অবিলম্বে রক্তক্ষয় বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শান্তি স্থাপন করার জন্য তিনি ইয়াহিয়া খানকে অনুরধ জানান।
৩ এপ্রিল শনিবার প্রবাসী বাঙালি মহিলাদের একটি প্রতিবাদ মিছিল্লন্ডনের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণের পর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে অবস্থিত প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবনে গিয়ে একটি স্মারক লিপি পেশ করে। ছাত্র ও মহিলাদের প্রতিনিধিদল পৃথকভাবে লন্ডনের বিভিন্ন দূতাবাসে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করেন। কেবল চীনের দূতাবাস স্মারকলিপি গ্রহন করতে অস্বীকার করে। দূতাবাসের কর্মচারীরা বলেন, ইয়াহিয়া খান সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিশেদবাদবিরোধী এবং ‘বিদ্রোহ’ দমন করার অধিকার তার আছে। অতএব তারা ইয়াহিয়া খানকে পুরোপুরি সমর্থন করেন।
৩ এপ্রল ইয়াহিয়া খানের কাছে প্রেরিত এক কূটনৈতিক বার্তায় সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে গৃহীত নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা অবিলম্বে প্রত্যাহার ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার আবেদন জানান। তাঁর আবেদন সম্পর্কিত খবর প্রকাশিত পর বিচারপতি চৌধুরী লন্ডনস্থ সোভিয়েত দূতাবাসে গিয়ে জনৈক উর্ধ্বতন কূটনীতিবিদদের সঙ্গে দেখা করে
২৮৭
বাংলাদেশের জনগনের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ৪ এপ্রিল রোববার দুপুর বেলা বাঙালি ছাত্রদের উদ্যোগে লন্ডনের হাইডপার্কে একটি জনসমাবেশ এবং বিকেলবেলা ট্রাফালগার স্কোয়ারে একটি বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ট্রাফালগার স্কয়ারে প্রায় ১০ হাজার লোকের এই জনসভায় অন্যান্যের মধ্যে কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির জেনারেল সেক্রেটারী শেখ আব্দুল মান্নান, সুলতান শরীফ, আব্দুল মতিন (ম্যানচেস্টার), সাখাওয়াত হোসেন ও মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু বক্তৃতা করেন। গাউস খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় কার্য পরিচালনা করেন বি এইচ তালুকদার।
উল্লিখিত তারিখে সন্ধ্যাবেলা লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড টাউনহলে শ্রমিকদলের প্রভাবশালী সদস্য জন এনালসের সভাপতিত্বে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের জন্য আহূত এই সভায় বক্তৃতাদানকারীদের মধ্যে ছিলেন লর্ড ব্রকওয়ে, শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শোর, পাকিস্তানি ছাত্রনেতা তারিক আলী, শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য মাইকেল বার্ণস, শেখ আব্দুল মান্নান, মিসেস বিলকিস বানু, লন্ডন আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি সুলতান শরিফ ও ‘বাংলাদেশ নিউজলেট’এর সম্পাদক ফরিদ জাফরী।
লর্ড ব্রকওয়ে পূর্ববঙ্গের ব্যাপারে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ দাবী করেন। এবং পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে কোন প্রকার সাহায্য না দেবার জন্য শ্রীলংকার প্রতি আবেদন জানান।
৫ এপ্রিল একদল পার্লামেন্ট সদস্য পূর্ববঙ্গে ‘গৃহযুদ্ধ’ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের অনুরোধ জানিয়ে পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। ৬ তারিখের মধ্যে ১৬০ জনেরও বেশি পার্লামেন্ট সদস্য এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউমও পার্লামেন্টে পূর্ববঙ্গ সমস্যা সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করেন। পার্লামেন্টে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেনা। প্রবাসী বাঙালীরা তার এই মন্তব্যে মর্মাহত হন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মোহাম্মাদ ইশাক ও কয়েকজন নেতৃস্থানীয় বাঙালী ছাত্র তৎকালীন টোরি দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য কুইন্টিন হগ এর (পরবর্তীকালে লর্ড হেইলশ্যাম) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে স্যার আলেককে এই উক্তি প্রত্যাহারে রাজি করানোর জন্য অনুরোধ জানান। অন্যান্য মহল থেকেও তাকে এ ধরণের অনুরোধ জানানো হয়। কিছুকাল পরে স্যার আলেক বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হত্যাযজ্ঞ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয় বলে ঘোষণা করেন।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বিচারপতি চৌধুরী ব্রিটিশ মিনিস্টার ফর
২৮৮
ওভারসিজ ডেভলপমেন্ট রিচার্ড উডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি মি. উডকে অবিলম্বে রক্তক্ষয় বন্ধ এবং শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করার অনুরোধ জানান। মি. উড বলেন ব্রিটিশ সরকার ইতিমধ্যে পাকিস্তানে নিয়োজিত ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ স্থাপন করেছেনএবং একটি বন্ধু রাষ্ট্রকে যতটুকু চাপ দেয়া সম্ভব তা তারা নিশ্চয় দেবেন।
৬ এপ্রিল ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালইয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ও সম্মানিত শিক্ষাবিদ লর্ড জেমস বিচারপতি চৌধুরীকে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ করেন। অতিথি হিসেবে জন পনেরো অধ্যাপক তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। লর্ড জেমস ও অধ্যাপকের সঙ্গে আলোচনাকালে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সম অধিকারের দাবী আজ স্বাধীনতার দাবীতে রূপান্তরিত হয়েছে। আজ আমরা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দৃঢ়সংকল্প; জীবনে কখনো রাজনীতির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিলনা। কিন্তু একজন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন বাঙালি হিসেবে আমি এই সংগ্রামে যোগদান করেছি।’ লর্ড জেমস বলেন, ছয়মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
১০ এপ্রিল বিচারপতি চৌধুরী ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। স্যার আলেক তাঁকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর শারীরিক সুস্থ্যতা সম্পর্কে তারা নিশ্চয়তা পেয়েছেন এবং তাঁর প্রাণহানির আশংকা তখন পর্যন্ত ঘটেনি। এ সাক্ষাৎকার কালে বিচারপতি চৌধুরী পরিষ্কার বুঝতে পারেন স্যার আলেক বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতুশীল।
হোয়াইট হলে অবস্থিত পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বেরিয়ে এলে বিচারপতি চৌধুরী একটি ট্যাক্সি নিয়ে অল্ডউইচ এলাকায় অবস্থিত বুশ হাউজে বিবিসির ওভারসিজ সার্ভিসের বাংলা বিভাগে যান। সিরাজুর রহমান, শ্যামল লোধ তৈরি হয়েই ছিলেন। তাঁরা বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎকার গ্রহন করেন। এই সাক্ষাতকারকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী হত্যার কাহিনী বর্ণনা করেন। বিবিসি সেদিনই (১০ এপ্রিল) এই সাক্ষাৎকার প্রচার করে।
বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পর বুশ হাউজ ত্যাগ করার সময় স্থানীয় পাকিস্তান দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারী মহিউদ্দীন আহমদকে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। মহিউদ্দীন বলেন, ‘স্যার আমি আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় আছি। আপনি ডাকলেই আমাকে পাবেন।’ লন্ডনে তখনও প্রবাসী সরকারের কূটনৈতিক অফিস স্থাপন করা হয়নি বলে বিচারপতি চৌধুরী তাকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনে যোগ দেবার কথা তখন বলেননি।
১২ এপ্রিল কলকাতার প্রবাসী সরকারের প্রতিনিধির (ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম) সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করার পর বিচারপতি চৌধুরী দক্ষিণ লন্ডনের ব্যালহাম এলাকার বাড়ি থেকে উত্তর লন্ডনের ফিঞ্চলি এলাকায় একটি বাড়িতে উঠে
২৮৯
যান। পাকিস্তান হাই কমিশনের সালমান আলী ব্যালহামের বাড়ির টেলিফোন নাম্বার যোগাড় করে বিচারপতি চৌধুরীকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করা সত্ত্বেও বারাবার তাঁকে টেলিফোন করা হয়। নিরাপত্তার খাতিরে তিনি বাড়ি বদলাতে বাধ্য হন। ফিঞ্চলির ফ্ল্যাটে এক সপ্তাহ থাকার পর তিনি পশ্চিম লন্ডনের অ্যাকটন এলাকায় একটি ছোট বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে যান।
উল্লিখিত তারিখে গাউস খানের নেতৃত্বে কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাব্লিক অফ বাংলাদেশের কয়েকশ বাঙালি লন্ডনস্থ চীনা দূতাবাসে গিয়ে ইয়াহিয়া খানের প্রতি চীনের সমর্থন প্রত্যাহার করার আবেদন জানায়। প্রবাসী বাঙালিরা চীনা দূতাবাসে যাওয়ার আগে হাইড পার্ক থেমে মিছিল সহকারে ডাউনিং স্ট্রিটের পাশ দিয়ে হোয়াইট হল হয়ে ট্রাফালগার স্কোয়ারে গিয়ে এক জনসভায় যোগ দেন।
এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা বিচারপতি চৌধুরীর সাথে পৃথকভাবে দেখা করে তাদের দলের নেতৃত্ব গ্রহন করার জন্য তাঁকে অনুরোধ জানায়। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি নিয়োজিত হবার আগে তিনি নির্দলীয় ব্যক্তি হিসেবে স্বাধীনতার জন্য কাজ করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হবার পরেও তিনি সবাইকে এই উত্তর দেন। কোন বিশেষ দল বা সমিতিতে যোগ না দিয়ে সরাসরি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বিভিন্ন দলের সংগ্রামী স্পৃহা ও প্রচেষ্টার সমন্বয় সাধন করবেন।
গাউস খানের অনুরোধক্রমে শেখ আব্দুল মান্নান বিচারপতি চৌধুরীর সাথে দেখা করে তাঁকে কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশের নেতৃত্ব গ্রহন করার অনুরোধ জানান। কাউন্সিলের সাফল্য কামনা করে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, তিনি কোন বিশেষ দল বা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেবেন না।
১৮ এপ্রিল বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থনে পূর্ব লন্ডনে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় পাঁচশ বাঙালি শ্রমিক এই সভায় যোগদান করেন। সেদিন বিকেলবেলা ট্রাফাল্গার স্কোয়ারে এক সমাবেশে প্রায় পাঁচ হাজার লোক যোগদান করেন। বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই জনসমাবেশের পর একটি বিক্ষোভ মিছিল ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট্রে গিয়ে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবিসংবলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করে।
২৩ এপ্রিল পূর্ব লন্ডনের আর্টিলারি প্যাসেজে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধি দলের এক সভায় কভেন্ট্রি শহরে ২৪ এপ্রিল একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। এই সম্মেলনে অ্যাকশন কমিটি গুলোকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়। সভার উদ্যোক্তারা বিচারপতি চৌধুরীকে সম্মেলনে উপস্থিত
২৯০
থাকার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান।
২৪ এপ্রিল কভেন্ট্রি শহরের একটি মিলানায়তনে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। এই সম্মেলনে বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে ১২৫ জন প্রতিনিধি ও ২৫ জন পর্যবেক্ষক যোগদান করেন। সকল দলের পক্ষ থেকে বিচারপতি চৌধুরীকে সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার অনুরোধ জানানো হয়। তিনি তাতে রাজি না হয়ে মিসেস লুলু বিলকিস বানুর নাম সভানেত্রী হিসেবে প্রস্তাব করেন। সভার কাজ আরম্ভ হবার পর বিচারপতি চৌধুরী সকল দলের সমর্থনপুষ্ট ও সকলের বিশ্বাসভাজন একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের জন্য আবেদন জানান। তাঁর এই বক্তৃতার আগেই তাঁকে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ সম্পর্কিত পত্রখানি রকিব উদ্দীন পড়ে শোনান।
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা তৈরি করার ব্যাপারে অচলাবস্থা দেখা দেয়। বহু আলাপ আলোচনার পর ‘অ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ ইন দি ইউ কে’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রাস্তাব গৃহীত হয়। সংগঠনের কার্য পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য হিসেবে ১. আজিজুল হক ভুঁইয়া ২. কবীর চৌধুরী ৩. মনোয়ার হোসেন ৪. শেখ আব্দুল মান্নান এবং ৫. শামসুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়। স্টিয়ারিং কমিটির প্রথম বৈঠকে একজন আহবায়ক নিয়োগ করা হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। অপর এক প্রস্তাবে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় সংগঠিত অ্যাকশন কমিটি গুলোকে কেন্দ্রীয় কমিটির শাখার মর্যাদা দেওয়া হয়।
কভেন্ট্রি সম্মেলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির পরিবর্তে আঞ্চলিক অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিদের নিয়ে স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি না থাকায় আন্দলনের কর্ম্পন্থা নির্ধারণের ব্যাপারে এবং কমিটির দৈনন্দিন কার্যকলাপের সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিলনা। এলাহাবাদ রেস্তোরাঁর উপরের তলায় স্টিয়ারিং কমিটির জন্য বিনা ভাড়ায় অফিস দেবার প্রস্তাব গৃহীত না হওয়ায় গাউস খান নিরুৎসাহ বোধ করেন।
শেখ আব্দুল মান্নান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ২৪ এপ্রিল কভেন্ট্রি থেকে চোচযোগে লন্ডনে ফিরে আসার পথে তিনি কাউন্সিল ফর দা পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ ভেঙে দিয়ে লন্ডন এলাকার জন্য কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটির একটি শাখা গঠনের প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাব অনুযায়ী ২৬ এপ্রিল পূর্ব লন্ডনে হাসেল স্ট্রিটে হাফেজ মনির হোসেনের দোকানে একটি সভার আয়োজন করা হয়। এই সভায় যারা যোগদান করেন তাদের মধ্যে ছিলেন শামসুর রহমান, জিল্লুর রহমান, আমীর আলী, সাখাওয়াত হোসেন, ড. নূরুল হোসেন ও শেখ আব্দুল মান্নান। সভায় অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও শেখ আব্দুল মান্নানের প্রস্তাব অনুযায়ী গাউস খান
২৯১
সভাপতি নির্বাচিত হন। এই শাখা কমিটি লন্ডন অ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ নাম গ্রহন করে। ৫৮ নম্বর বেরিক স্ট্রিটে কমিটির অফিস স্থাপন করা হয়। কিছুকাল পরে লন্ডন কমিটি একটি সংবিধান প্রণয়ন করে গ্রেটার লন্ডন কমিটি নাম গ্রহন করে।
স্টিয়ারিং কমিটির প্রথম সভা ২১ নম্বর রোমিলি স্ট্রিটে অনুষ্ঠিত হয়। মিসেস বিলকিস বানু সভাপতিত্ব করেন। এই সভায় বিচারপতি চৌধুরী অবিলম্বে একটি অফিস স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।
৩০ এপ্রিল শেখ আব্দুল মান্নানের বাড়িতে স্টিয়ারিং কমিটির দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। কভেন্ট্রি সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজিজুল হক ভুঁইয়াকে কমিটির আহবায়ক নিয়োগ করা হয়। বিচারপতি চৌধুরী এই সভায় উপস্থিত ছিলেন।
১ মে উরস্টার শহরে ব্রিটেন সফরকারী পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের প্রথম ম্যাচের বিরুদ্ধে প্রায় ৬০০ বাঙালি পুরুষ ও মহিলা শান্তিপূর্ণ ভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির বার্মিংহাম শাখার প্রেসিডেন্ট জগলুল পাশার নেতৃত্বে এই বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। লন্ডন থেকে কোচযোগে আগত প্রায় ১০০ বাঙালি ছাত্র ও যুবক এই বিক্ষোভে যোগদান করে।
৩ মে পূর্ব লন্ডনের ১১ নম্বর গোরিং স্ট্রিটে স্টিয়ারিং কমিটির অফিস খোলা হয়। সেদিনই বিচারপতি চৌধুরীর উপস্থিতিতে নতুন অফিসে স্টিয়ারিং অফিসের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সামসুল আলম চৌধুরী অফিস সেক্রেটারীর দ্বায়িত্বভার গ্রহন করেন।
নতুন অফিসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন উপলক্ষে সমবেত বাঙালিদের সম্বোধন করে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, ‘মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহর পাকিস্তানের মৃত্যুবরণ ঘটেছে। বাংলাদেশ আজ একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে সংগ্রাম করেছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনিকে খতম না করা পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’
৬ মে বার্মিংহামের নিকটবর্তী এজবাস্টন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের বাইরে প্রায় দুইহাজার বাঙালি নারী পুরুষ পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। জগলুল পাশা বিক্ষোভকারীদের নেতৃত্ব দেন।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রায় এক হাজার কানাডাপ্রবাসী বাঙালি ও তাদের সমর্থকরা মন্ট্রিয়ল শহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে একটি মিছিলের আয়োজন করেন। রাস্তার দুপাশ থেকে বহুলোক মিছিলে অংশগ্রহনকারীদের অভিনন্দন জানায় এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে উতসাহজনক মন্তব্য করে।
ইতিমধ্যে মুজিবনগর সরকার বিচারপতি চৌধুরিকে আমেরিকায় গিয়ে
২৯২
জাতিসংঘে নিয়োজিত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদল ও মার্কিন জনসাধারণকে বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করেন। অবিলম্বে ভিসার ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে তিনি লন্ডনস্থ মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে কন্সাল জেনারেলের কাছে দরখাস্ত পেশ করেন। তিনি তিন মাসের ভিসার জন্য আবেদন করেছিলেন। কিনতি কন্সাল জেনারেল তাঁকে ১৯৭১ সালের ৬ মে থেকে ১৯৭৫ সালের ৬ মে পর্যন্ত চার বছরের ভিসা মঞ্জুর করেন।
ভিসা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীর পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে আলোচনার দিন ধার্য করা হয়েছিল। বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে পার্লামেন্ট সদস্যদের অবহিত করার জন্য তাঁর লন্ডনে অবস্থান অবশ্য প্রয়োজন বলে তিনি তাঁর যুক্তরাষ্ট্র সফর সাময়িক ভাবে স্থগিত রাখেন।
শিকাগো প্রবাসী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি স্থপতি ফজলুর রহমান খান মে মাসের প্রথম সপ্তাহে লন্ডন এসেছিলেন। বিচারপতি চৌধুরী তাঁর প্রস্তাবিত আমেরিকা সফর সম্পর্কে মি. খানের সঙ্গে পরামর্শ করেন। মি. খান যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে বসবাসকারী বাঙালিদের নিয়ে একটি ডিফেন্স কমিটি গঠনের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। শিকাগো থেকে তিনি বিভিন্ন শহরে বাঙালিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটনে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। ওয়াশিংটনে পৌঁছে প্রতিনিধিদল তাদের এলাকার সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি, বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান ও বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্য প্রত্যাহার করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকারকে চাপ দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এর ফলে বিভিন্ন এলাকা থেকে নির্বাচিত সিনেটর ও কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনে বক্তৃতা ও বিবৃতি দেন।
৮ মে গোরিং স্ট্রিটের অফিসে সমস্ত যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির প্রায় ১০০ জন প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারীর এক জরুরী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আন্দোলনের সাহায্যার্থে ‘বাংলাদেশ ফান্ড’ নামে একটি তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। বহু আলাপ আলোচনার পর বিচারপতি চৌধুরী, ডেনাল্ড চেসওয়ার্থ ও শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউস কে সদস্য মনোনীত করে ‘বোর্ড অফ ট্রাস্টি’ গঠন করা হয়। ‘বাংলাদেশ ফান্ড’ থেকে স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যবৃন্দ, ট্রাস্টি বৃন্দ এবং বিচারপতি নিজে ব্যক্তিগত খরচবাবদ কোন অর্থ গ্রহন করেননি।
উল্লিখিত তারিখে লন্ডনের উত্তরে অবস্থিত নর্থহ্যাম্পটন শহরের ক্রিকেট গ্রাউন্ডের বাইরে প্রায় ২০০ বাঙালি পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
স্টিয়ারিং কমিটির পরিকল্পনা অনুযায়ী জনসংযোগের উদ্দেশ্যে ৯ মে
২৯৩
সকালবেলা ব্র্যাডফোর্ড এবং বিকেলবেলা বার্মিংহামে জনসভার আয়োজন করা হয়। ব্র্যাডফোর্ডে বক্তৃতা দানকালে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, শেখ মুজিবকে বন্দি করে পাকিস্তান বাঙালি জাতির অনুভূতির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করে। দীর্ঘ বক্তৃতায় মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ ব্যাখ্যা করেন। বার্মিংহাম কমিটির পক্ষ থেকে জগলুল পাশা ও স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে শেখ আব্দুল মান্নানের বক্তৃতার পর বিচারপতি চৌধুরী প্রধান বক্তা হিসেবে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। এই সভার কথা উল্লেখ করে বিচারপতি চৌধুরী তাঁর স্মৃতিকথায় বলেন, বাঙালির সংগ্রাম ছিল আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। সে আদর্শ এমন এক অণুপ্রেরণা, উদ্দীপনা ও উৎসাহের সৃষ্টি করেছিল যা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব না।
১২ মে ল্যাংকাশায়ার ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল পার্লামেন্টের প্রত্যেক সদস্যের হাতে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে ৬৩০ খানি চিঠি নিয়ে পার্লামেন্ট ভবনে এসে হাজির হন। প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন এম রহমান, জাহির চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, এ কে কামাল উদ্দীন এবং লতিফ আহমদ।
কার্ডিফে সংগঠিত দক্ষিণ ওয়েলসের বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির পাঁচজন বাংলাদেশ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে ১৩ মে দুপুরবেলা থেকে পরদিন বিকেলবেলা পর্যন্ত মোট ২৬ ঘন্টা অনশন পালন করেন। অনশনকারীদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল হান্নান, এম জেড মিয়া, মোহাম্মদ ফিরোজ, আব্দুল হালিম ও আব্দুস শহীদ।
মে মাসের প্রথম দিকে শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য ব্রুস ডগলাসম্যান বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে হাউস অফ কমন্সে যে ব্যক্তিগত প্রস্তাব পেশ করেন্সে সম্পর্কে ১৪ মে সরকার ও বিরোধী দলের সম্মতিক্রমে এক বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। বিতির্ক অনুষ্ঠিত হবার আগেই বিচারপতি চৌধুরী পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হিউমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আলোচনা প্রসঙ্গে স্যার আলেক বলেন, শেখ মুজিবের মুক্তি ও বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকারকে রাজি হবার জন্য ব্রিটিশ সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাবে।
প্রায় তিনশ পার্লামেন্ট সদস্য মি. ডগলাসের প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। প্রস্তাবের স্বপক্ষে বক্তৃতাকালে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্রিটেনের যে প্রভাব রয়েছে তা প্রয়োগ করে পাকিস্তানকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা ব্রিটিশ সরকারের কর্তব্য। দীর্ঘ আলোচনার পর প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
২২ মে বিচারপতি চৌধুরী বেচলি ও অক্সফোর্ড শহরে বাঙালিদের দুটি পৃথক সভায় বক্তৃতা করেন। অক্সফোর্ডের সভায় তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার
২৯৪
পাকিস্তানের সঙ্গে আপোষ করে ফেলতে পারেন বলে যে গুজব ছড়ানো হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনশেখ আব্দুল মান্নানও উভয় সভায় বক্তৃতা করেন।
পরদিন বিচারপতি চৌধুরী ও শেখ মান্নান স্কটল্যান্ড যান। গ্লাসগো বিমানবন্দরে স্থানীয় অ্যাকশন কমিটির সদস্যরা তাঁদের অভ্যর্থনা জানায়। স্থানীয় একটি হলে অবস্থিত জনাকীর্ণ এক সভায় তাঁরা দুজন বক্তৃতা করেন। বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন কি করে স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিনত হয় তা ব্যাখ্যা করেন। সন্যাবেলা বিমানযোগে তাঁরা লন্ডনে ফিরে আসেন।
২৪ মে বিচারপতি চৌধুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে রওয়ানা হন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন এনামুল হক। তিনি ফোর্ড ফাউন্ডেশনের বৃত্তি নিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রীর জন্য অক্সফোর্ডে গবেষণারত ছিলেন।
নিউইয়র্ক বিমানবন্দরে প্রায় ২০০ বাঙালি সহকর্মীকে নিয়ে এ এইচ মাহমুদ আলী বিচারপতি চৌধুরীকে অভ্যর্থনা জানান। ২৬ এপ্রিল তিনি নিউইয়র্কে নিয়োজিত পাকিস্তান ভাইস কন্সাল পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। হোটেলে পৌঁছে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে স্থানীয় বাঙালীদের অবহিত করার পর ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে তাঁর ধারণা ব্যাখ্যা করেন। দুপুর রাত পর্যন্ত আলোচনার পর ঠিক হল বিভিন্ন দল বিভিন্ন দিনে ওয়াশিংটন গিয়ে সিনেটর ও কংগ্রেসম্যান্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি বিশ্লেষণ করে তাঁদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করবেন।
মাহমুদ আলী, ইনামুল হক ও বিচারপতি চৌধুরী প্রতিদিন জরুরী ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কয়েকদিনের মধ্যে তাঁরা নরওয়ে, সুইডেন, মিশর, ইরাক, জর্ডান, সিরিয়া, লিবিয়া, আলজেরিয়া, সৌদি আরব, ফিলিপাইনস ও আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রাষ্ট্রদূতদের তাঁরা বলেন, বাংলাদেশের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। নরওয়ের রাষ্ট্রদূত মিস্টার হ্যামব্রো তখন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি ছিলেন। তিনি রেডক্রসের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। সহানুভূতির সঙ্গে তিনি বিচারপতি চৌধুরী ও তার সহকর্মীদের সাথে কথা বলেন।
নিউইয়র্ক পৌঁছাবার পরদিন মাহমুদ আলী বিচারপতি চৌধুরিকে জাতিসংঘে অবস্থিত আন্তর্জাতিক প্রেস্ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ড. যোগেন্দ্রকুমার ব্যানার্জীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ড. ব্যানার্জী কয়েকজন আমেরিকান ও ইউরোপীয়ান সাংবাদিকের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেন। ‘নিউউয়র্ক টাইমস’এর সংবাদদাতা বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎকার গ্রহন করেন। এই সাক্ষাৎকারের এক কলামব্যাপী বিবরণ যথাসময়ে প্রকাশিত হয়। ইউরোপ ও অন্যান্য মহাদেশের কয়েকজন সাংবাদিকও তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহন করেন।
২৯৫
নিউইয়র্কে অবস্থানকালে বিচারপতি চৌধুরী জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্টের বিশেষ প্রতিনিধি এবং ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহন করায় পাকিস্তানি দূতাবাস ফোর্ড ফাউন্ডেশনের বৃত্তিপ্রাপ্ত বাঙালি ছাত্রদের বৃত্তি কেটে দেবার ব্যবস্থা করেন। বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনার পর তাঁরা একটি সাময়িক ব্যাবস্থা গ্রহন করেন। এর ফলে বৃত্তিভোগী বাঙালী ছাত্রদের বৃত্তির টাকা সরাসরি তাদের ঠিকানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
২৯ মে বিচারপতি চৌধুরী লন্ডনে ফিরে আসেন। পরদিন তিনি ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করেন। ম্যানচেস্টারের অধিবাসী প্রবীন বাঙালি আব্দুল মতিন এই সভার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতার ক্যাসেট বাজিয়ে সভার কাজ শুরু হয়। এই ঐতিহাসিক ভাষণ শ্রোতাদের উপর এক অবর্ণনীয় প্রভাব বিস্তার করে। বিচারপতি চৌধুরী তাঁর বক্তৃতায় ২৫ মার্চের রাত থেকে শুরু করে ৩০ মে পর্যন্ত সংঘঠিত ঘটনাগুলোর বিবরণ দেন। তিনি আমেরিকায় বাঙালিদের সংগঠন এবং তৎপরতার কথাও উল্লেখ করেন।
৪ জুন বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে লন্ডনে এক মিছিল আয়োজন করে। সমিতির আহবায়িকা মিসেস জেবুন্নেসা বখসের নেতৃত্বে প্রায় ২০০ মহিলা ও শিশু সেন্ট জেমসেস পার্ক থেকে মিছিল করে ডাউনিং স্ট্রিটে যান। মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দলের নেত্রী হিসেবে মিসেস বখস ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাওয়ার্ড হিথের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। শেফিল্ড অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে ৫ জুন স্থানীয় টাউন হলে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়। সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, ‘আমরা একটি পবিত্র সাধনায় লিপ্ত। বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে সেখানে সংসদীয় গণতন্ত্র স্থাপনে আমরা দৃঢ়সংকল্প।’ সভায় বক্তৃতাকারীদের মধ্যে ছিলেন কবীর চৌধুরী, আফরজ চৌধুরী ও শেখ আব্দুল মান্নান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার ও শেখ মুজিবের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সোবহান মে মাসে কলকাতা থেকে লন্ডন হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যান। সেখানে তিনি ‘এইড কনসোর্টিয়াম’ এর সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্যদান বন্ধ করার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন।
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনে ফিরে এসে মি. সোবহান কয়েকটি প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদপত্রের সম্পাদক ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এর ফলে ৪ ও ৫ জুন ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় তাঁর দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রথম নিবন্ধে তিনি পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্য দান বন্ধ করার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন
২৯৬
করেন। দ্বিতীয় নিবন্ধে তিনি মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনার পটভূমি ব্যাখ্যা করেন। ৫ জুন তিনি স্থানীয় গঙ্গা রেস্তোরাঁয় ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার’ ও ‘বাংলাদেশ ফ্রিডম মুভমেন্ট ওভারসিজ’ এর কর্মী ও সমর্থকদের এক ঘরোয়া সভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বক্তৃতা করেন।
মে মাসের প্রথমদিকে করাচির ইংরেজি দৈনিক ‘ডন’ পত্রিকার লন্ডন সংবাদদাতা নাসিম আহমেদ দি রয়াল কমনওয়েলথ সোসাইটির এক সভায় বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীদের তীব্র ভাষায় আক্রম করেন। রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা প্রমাণ করার জন্য সোসাইটির কর্তৃপক্ষ বিচারপতি চৌধুরীকে হাইকোর্টের জজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আওয়ামী লীগের ছয়দফা সম্পর্কে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ৮ জুন তাঁর বক্তৃতায় বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠানের জন্য পাকিস্তানের তীব্র সমালোচনা করেন। সভার কাজ শেষ হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. ডব্লুই এ জেঙ্কিন্সের স্ত্রী লেডি জেঙ্কিন্স সভামঞ্চে গিয়ে বিচারপতি চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে নিহতদের জন্য শোক প্রকাশ করেন।
অবরুদ্ধ ঢাকা নগরী থেকে লন্ডন ফিরে এসে শফিক রেহমান (চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট) ‘দি গার্ডিয়ান’ ও ‘ডেইলী টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার সংবাদদাতাদের সঙ্গে ৯ জুন এক সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে বলেন, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কর্ম তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। তাঁরা মাইনের সাহায্যে রাস্তাঘাট ও রেলওয়ে লাইনের বিপুল ক্ষতিসাধন করেছে। এবং খুলনাগামী স্টিমার সার্ভিস বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা ওঁৎ পেতে থেকে সামরিক যানবাহনের ক্ষতিসাধন এবং পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সহযোগিতাকারী দেশদ্রোহীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেছে।
১৩ জুন লন্ডনের বহুল প্রচারিত ও প্রভাবশালী ‘দি সানডে টাইমস’ পত্রিকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে এক বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। করাচির ‘মর্ণিং নিউজ’ পত্রিকার সহ সম্পাদক ও ‘দি সানডে টাইমস’এর পাকিস্তান সংবাদদাতা অ্যান্থনি মাসকারিনহাস এর চাক্ষুষ বিবরণ ‘গণহত্যা’ শিরোনাম দিয়ে ফলাও করে ছাপানো হয়। প্রায় দশহাজার শব্দ সংবলিত মূল রিপোর্টটি পাঁচ কলামব্যাপী শিরোনাম দিয়ে ১২ থেকে ১৪ পৃষ্ঠায় ছাপানো হয়। এই চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী রিপোর্ট বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপ্ত্র, টিভি ও রেডিওর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এর ফলে পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ববঙ্গে গণহত্যা সম্পর্কিত সংবাদ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
১১৩ জুন সন্ধ্যাবেলা আইটিভির ‘ম্যান ইন দা নিউজ’ প্রোগ্রামে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে এক সাক্ষাতকারের বিবরণ প্রচারিত হয়। এই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হত্যাযজ্ঞের খবর চেপে যাওয়ার
২৯৭
চেষ্টা করছে। ‘সেনাবাহিনী পাকিস্তানকে খতম করেছে। বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হবে।’
বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য লাভের উদ্দেশ্যে বিচারপতি চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৪ জুন একটি শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে কোচযোগে বহু বাঙালি লন্ডনে এসে শোভাযাত্রায় যোগ দেন। হোয়াইট হলে এসে শোভাযাত্রাটি শেষ হয়।
১৭ জুন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিচারপতি চৌধুরীর কূটনৈতিক পরিচয়পত্রে স্বাক্ষরদান করেন। এই পরিচয়পত্রে বিচারপতি চৌধুরীকে যুক্তরাজ্যে হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। এই পরিচয়পত্র রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সরকারি বাসভবন বার্কিংহাম প্যালেসে পেশ করা হয়। যথাসময়ে পরিচয়পত্র প্রাপ্তিস্বীকার করে বার্কিংহাম প্যালেস থেকে বিচারপতি চৌধুরীর নিকট একটি পত্র পাঠানো হয়। এই পত্রের মাধ্যমে প্রকারান্তরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হয় বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন।
২১ জুন বিচারপতি চৌধুরী হল্যান্ড সফরে যান। দুইদিন আগে হল্যান্ড থেকে একটি টেলিভিশনে এই সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। ২২ জুন তিনি পার্লামেন্টের একটি কমিটি রুমে বৈদেশিক ব্যাপার সম্পর্কিত একটি সাব কমিটির সঙ্গে মিলিত হন। দুই ঘন্টারও বেশি সময় ধরে প্রশ্নোত্তরের পর সাব কমিটির চেয়ারম্যান বলেন, বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনার পর তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক অনুষ্ঠিত হত্যাযজ্ঞের পর বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে থাকতে পারেনা। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের সংগ্রামকে তাঁরা আদর্শগত ভাবে সমর্থন জানাবেন।
২৩ জুন বিচারপতি চৌধুরী হল্যান্ড থেকে লন্ডনে ফিরে আসার পর স্টিয়ারিং কমিটির এক সভায় ‘বাংলাদেশ টুডে’ নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রিহিন করা হয়।এই সভায় শেখ আব্দুল মান্নান সভাপতিত্ব করেন। পত্রিকাটি প্রকাশনার দ্বায়িত্ব নিয়েছিলেন আমীর আলী, কবীর উদ্দীন আহমেদ এবং আরো কয়েকজন উৎসাহী কর্মী। সুরাইয়া খানম, শিল্পী আব্দুর রউফ এবং মহিউদ্দীন আহমদ চৌধুরীও এ ব্যাপারে সাহায্য করেন। ১ আগস্ট পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
২৬ জুন নিউইয়র্ক শহরে বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা ইনকরপোরেটেডের নিউইয়র্ক শাখার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্টড় ও কানাডা থেকে আগত শতাধিক প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগদান করেন। বাংলাদেশ লীগের ওয়াশিংটন (ডিসি), কেন্টাকি, টেনেসি ও উত্তর ক্যারোলিনা শাখার প্রতিনিধি ছাড়াও সমগোত্রীয় প্রতিষ্ঠানবাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ, বাংলাদেশ
২৯৮
অ্যাসোসিয়েশন অফ দেলাওয়ার ভ্যালি এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ওহাইয়োর প্রতিনিধিরা ‘দর্শক’ হিসেবে এই সম্মেলনে যোগদান করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে পরিচালিত কার্যক্রম সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনার পর প্রতিষ্ঠান গুলোর কর্মসূচীর সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে একতি সংযোগ রক্ষাকারী কমিটি গঠন করা হয়।
জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে টোরিদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য মিসেস জিল নাইটের নেতৃত্বে একটি পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল পূর্ব বাংলা সফর করে। জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ব্রিটিশ টেলিভিশনের সংবাদ পরিক্রমায় জিল নাইটের পুর্ববাংলা সফর সম্পর্কিত চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। এই চলচ্চিত্রে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে এক জনসমাবেশে আলোচনারত মিসেস নাইটকে দেখানো হয়। এই সমাবেশে মুসলিম লীগের নেতা শাহ আজিজুর রহমান দেশে কোন গোলযোগ বা অশান্তি আছে কিনা তা জিজ্ঞেস করার জন্য মিসেস নাইটকে অনুরোধ করেন। তাঁর (মিসেস নাইট) প্রশ্নের উত্তরে সমাবেশের মধ্যে থেকে বলা হয়, দেশের অবস্থা সম্পুর্ণ শান্ত ও স্বাভাবিক। বলা বাহুল্য পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের সহায়তায় এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল।
উল্লিখিত সংবাদ পরিক্রমা দেখার পর পূর্ব লন্ডনের প্রবীন সমাজকর্মী আব্দুল মালেক গভীর রাতে শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শোর এর সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেন। মি. শোরকে তিনি বলেন, অবিলম্বে এই মিথ্যা প্রচারণার জোরালো প্রতিবাদ না করা হলে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিপূর্বে পার্লামেন্টে উত্থাপিত প্রস্তাবের প্রতি যারা সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন তাদের কেউ কেউ হয়ত সমর্থন প্রত্যাহার করবেন। মি. শোরও তাই ভাবছিলেন। তিনি মি. মালেককে প্রবাসী বাঙালিদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবাদ পত্র টাইপ করে পরদিন মি. শোরের হাতে পৌঁছে দেন। মি. শোর এই প্রতিবাদ পত্র নিয়ে পরদিন পার্লামেন্টে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পরামর্শ দেন। মি. মালেক তার কন্যার সাহায্যে একটি প্রতিবাদপত্র টাইপ করে পরদিন শোরের হাতে পৌঁছে দেন। মি. শোর এই প্রতিবাদ পত্র নিয়ে শ্রমিকদলীয় নেতা মি. উইলসনের সঙ্গে আলোচনা করেন। অন্যান্য বাংলাদেশ সমর্থক মহলও পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা বন্ধ করার দাবি জানান।
২৯ জুন ১৫ জন বাঙালি খালাসি ও অফিসার ওয়েলসের কার্ডিফ বন্দরে নোঙর করা পাকিস্তানি জাহাজ ‘এম ভি কর্ণফুলী’ থেকে পালিয়ে ট্রেনযোগে লন্ডন পৌঁছে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। তাঁরা বলেন, করাচি থেকে রওয়ানা হবার পর নানাভাবে তাদের হয়রান ও অপমান, এমনকি শারীরিক নির্যাতন করা হয়। অফিসারদের মুখপাত্র এ কে এম নূরুল হুদা বলেন, পাকিস্তানে ফিরে গেলে তাদের শারীরিক নির্যাতন কিংবা হত্যা করা হবে বলে তারা
২৯৯
আশংকা করেন। বিচারপতি চৌধুরী কার্ডিফ থেকে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য অ্যালফ্রেড এভারেন্সর সহায়তায় বাঙালি খালাসি ও অফিসারদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রার্থনা মঞ্জুর করতে সক্ষম হন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রিডার ড. মোহর আলী কর্তৃক যুক্তভাবে স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ৭ জুলাই তারিখে ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লন্ডনের রয়্যাল গার্ডেন হোটেল থেকে লিখিত এই চিঠির মাধ্যমে তাঁরা উভয়েই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তান সামরিক চক্রের সমর্থনে নির্জলা মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করেন। বিদেশে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাবার জন্য পাকিস্তানের সামরিক সরকার সাজ্জাদ হোসেন ও মোহর আলীর ব্যয়বহুল সফরের ব্যবস্থা করে।
উল্লিখিত চিঠিতে তারা বলে, গ্রেট ব্রিটেনের বহু লোক মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সহ বহু সংখ্যক বাঙালিকে ২৫ মার্চ ও তারপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা হয়েছে- একথা জানতে পেরে তারা বিস্মিত হয়েছে। তারা জোর দিয়ে বলে, বুদ্ধিজীবীদের বেপরোয়াভাবে হত্যা করা হয়নি। ২৫ মার্চ কিংবা তারপর চট্টগ্রাম কিংবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন অধ্যাপককে হত্যা করা হয়নি। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলের আশেপাশে সশস্ত্র সংগ্রামের ফলে নয়জন অধ্যাপক মারা গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এই ছাত্রাবাস গুলোকে ঘাঁটি করে সেনাবাহিনীকে আক্রমণ না করলে এই প্রাণহানি এড়ানো যেত। তাদের ‘ব্যক্তিগত বন্ধু’ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা গুলির আঘাতে আহত হয়ে হাসপাতালে গিয়ে তিনদিন পর মারা যাওয়ার আগে তাঁর বন্ধুদের নাকি বলেছেন আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবীরা তাঁর বাড়িতে না ঢুকলে তিনি সেনাবাহিনির আক্রমন এড়াতে পারতেন।
১০ জুলাই বাঙালিদের উদ্যোগে বেডফোর্ড শহরের একটি পাবলিক হলে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানিরা হলটি চারিদিক থেকে ঘিরে বাধা দেবার চেষ্টা করে। প্রত্যেকটি গেটের সামনে তাদের লোক দাঁড়িয়ে ছিল। সম্ভাব্য গোলযোগ এড়ানোর জন্য হলের চারপাশে পুলিশ মোতায়েন ছিল। পাকিস্তানিদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে বিচারপতি চৌধুরী দৃঢ় মনোভাব নিয়ে সভার কাজ চালিয়ে যান। তিনি কঠোর ভাষায় পাকিস্তানিদের হীন মনোভাবের নিন্দা করেন। পাকিস্তানিদের এই হটকারিতায় বাংলাদেশ আন্দোলন লাভবান হয়েছে এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। অধ্যাপক কবীর ও শেখ আব্দুল মান্নান এই সভায় বক্তৃতা করেন।
১৬ জুলাই স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে লন্ডনস্থ চীনা দূতাবাসের সামনে
৩০০
শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। সেখান থেকে একটি মিছিল ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের দিকে যায়। মিচিলে অংশগ্রহন কারীরা বিভিন্ন শ্লোগানের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ব্রিটিশ জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বিক্ষোভ ও মিছিলে যোগদান করার জন্য ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক বাঙালি কোচযোগে লন্ডনে আসেন। জগলুল পাশার নেতৃত্বে একটি বিরাট দল বার্মিংহাম থেকে এসে বিক্ষোভ ও মিছিলে যোগ দেয়। জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আমেরিকান বার এসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলন লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে যোগদানকারী সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটি ইন গ্রেট ব্রিটেন একটি ‘খোলা চিঠি’ ২০ জুলাই ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় অর্ধপৃষ্ঠা ব্যাপী বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রকাশের ব্যবস্থা করে। এই খোলা চিঠিতে এসোসিয়েশনের সদস্যদের লক্ষ্য করে বলা হয়, আইনজীবী হিসেবে আইন ভঙ্গ করা তাদের দৃষ্টী আকর্ষণ করা হচ্ছে। তাছাড়া আমেরিকান নাগরিক হিসেবে তারা বাঙালিদের দুঃখ-দুর্দশা ও নির্যাতনের খবর সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অবহিত করে এই অমানিশার অবসান ঘটাতে পারেন। বিজ্ঞাপনটির অর্ধেক জায়গাজুড়ে জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি ছাপানো হয়।
ওয়াশিংটন প্রবাসী বাঙালি ও তাদের সমর্থকেরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে প্রচার ও ‘লবি’ করার জন্য বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। মার্কিন কংগ্রেস ভবনের অদূরে সিওয়ার্ড স্কোয়ারের অফিস থেকে তাঁরা ২৪ জুলাই তাঁদের প্রথম বুলেটিন প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থন এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে চিঠি ও তারবার্তা এবং টেলিফোনের মাধ্যমে কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বুলেটিনের পাঠক দের অনুরোধ জানানো হয়। বুলেটিনে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ইন্টারন্যাশনাল লংশোরম্যানস (জাহাজ শ্রমিক) ইউনিয়নের সদস্যরা পাকিস্তানগামী জাহাজে অস্ত্র বোঝাই করবেননা বলে ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন।
২৬ জুলাই হাউস অফ কমন্সের হারকোর্ট রুমে স্বাধীন বাংলাদেশের ৮ টি ডাকটিকিট প্রকাশ উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পার্লামেন্টের সকল দলের নেতৃস্থানীয় সদস্য এবং প্রায় ৪০ জন সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত বিচারপতি চৌধুরী সদ্য প্রকাশিত ডাকটিকেটগুলো প্রদর্শন করেন। দশ পয়সার টিকেটে বাংলাদেশের মানিচিত্র এবং পাঁচ পয়সার টিকিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়। বাঙালি
৩০১
গ্রাফিক্স শিল্পী বিমান মল্লিক ডাকটিকিটগুলোর নকশা তৈরি করেন। বিদেশে চিঠিপত্র পাঠানোর জন্য ভারত সরকার টিকিট গুলো ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন বলে উদ্যোক্তরা প্রকাশ করেন। এই অনুষ্ঠানে বিচারপতি চৌধুরী ঘোষণা করেন, আগস্টমাস শেষ হবার আগেই ব্রিটেনে বাংলাদেশের দূতাবাস স্থাপন করা হবে।
আগস্ট মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানের সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু হবে বলে খবর পাওয়ার পর বিচারপতি চৌধুরী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী সন ম্যাকব্রাইডকে বলেন কোন বিদেশী আইঞ্জীবীকে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ অথবা তাঁর পক্ষ সমর্থন করতে দেওয়া হবেনা। ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্ত অনুযায়ো রুদ্ধদ্বার কক্ষে শেখ মুজিবের বিচার এবং তাঁর পক্ষ সমর্থন করার জন্য একজন পাকিস্তানি আইনজীবী নিয়োগ করা হবে।
১ আগস্ট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে যে গণসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে সে সম্পর্কে জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিভিন্ন পত্রিকায় ২৯ জুলাই অগ্রিম সংবাদ পরিবেশিত হয়। এই সংবাদে বলা হয় ‘বিটলস’ গ্রুপের জর্জ হ্যারিসন কর্তৃক ‘বাংলাদেশ’ নামে যে নতুন রেকর্ড তৈরি করা হয়েছে তা বেলা দুটোর সময় ট্রাফালগার স্কোয়ারের গণসমাবেশে বাজিয়ে শোনানো হবে। ঠিক তখন নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে রেকর্ডটির উদ্বোধন উপলক্ষ্যে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। রেকর্ড বিক্রি করে সংগৃহীত অর্থ শরনার্থী সাহায্য তহবিলে দান করা হবে।
৩০ জুলাই ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় ‘পূর্ব বঙ্গে গণহত্যা’ শীর্ষক অর্ধপৃষ্ঠাব্যাপী একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। ঢাকা শহরের রাস্তায় পরত্যক্ত তিনজন তরুনের মৃতদেহের একটি ছবির নিচে লেখা রয়েছে, এই ছবিটি আপনার ছেলেমেয়েদের দেখান এবং ১ আগস্ট তাদের সঙ্গে নিয়ে ট্রাফালগার স্কোয়ারের জনসমাবেশে যোগ দিন। অ্যাকশন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়।
পাকিস্তানের অত্যাচারী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে ১ আগস্ট রোববার লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে এক বিরাট জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পল কনেটের নেতৃত্বে গঠিত অ্যাকশন বাংলাদেশের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই জনসমাবেশে ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে ২০ হাজারেরও বেশি বাঙালি যোগ দেন। শতাধিক বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির সদস্যদের লন্ডনে নিয়ে আসার জন্য কমিটিগুলো বহু কোচ ভাড়া করে। শুধু বার্মিংহাম থেকে ৭০ টি কোচ লন্ডনে আসে।।
৩০২
সভায় বক্তৃতা দানকারীদের মধ্যে ছিলেন বিচারপতি চৌধুরী, লর্ড ব্রুকওয়ে, অশোক সেন (পরবর্তী কালে ভারতের আইনমন্ত্রী), পিটার শোর, রেজ প্রেন্টিস, ব্রুস ডগলাসম্যান, জন স্টোনহাউস, লর্ড গিফোর্ড, পল কনেট, বেগম লুলু বিলকস বানু ও গাউস খান।
বক্তৃতা দানকালে বিচারপতি চৌধুরী ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ কখনো তার স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ থেকে বিচ্যুত হবেনা। বাংলাদেশের পূতঃপবিত্র ভূমি থেকে হানাদার পাকবাহিনীকে সম্পূর্ণ বিতাড়িত না করা পর্যন্ত আমাদের আপোষহীন, বিরামহিন সংগ্রাম চলবে। এই সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সংগ্রাম।
বক্তৃতা প্রসঙ্গে বিচারপতি চৌধুরী মুজিবনগর সরকারের তিনটি নির্দেশের কথা উল্লেখ করেন। প্রথম নির্দেশ অনুযায়ী শীগগিরই লন্ডনে একটি হাইকমিশন স্থাপন করা হবে বলে তিনি ঘোষণা করে। দ্বিতীয় নির্দেশ অনুযায়ী পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের বিমানযোগে ভ্রমন না করার জন্য বাংলাদেশের নাগরিকদের তিনি আহবান জানান। তৃতীয় নির্দেশ অনুযায়ী তিনি পাকিস্তানি সরকারি কর্মচারী হিসেবে পাকিস্তান ও বিদেশে নিয়োজিত বাঙালিদের অবিলম্বে পদত্যাগ করে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের আহবান জানান।
বিচারপতি চৌধুরীর বক্তৃতার পর অপ্রত্যাশিতভাবে লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনে নিয়োজিত দ্বিতীয় সেক্রেটারী মহিউদ্দীন আহমদ বক্তৃতা দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেন। জনতার বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে মি. আহমদ ঘোষণা করেন, পাকিস্তানের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করছেন। ইউরোপে কর্মরত পাকিস্তানি কূটনৈতিকদের মধ্যে মহিউদ্দীন আহমদই সর্বপ্রথম পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। সভার শেষে একটি শোভাযাত্রা সহকারে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ১০ নাম্বার ডাউনিং স্ট্রিটে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।
১ আগস্ট ওয়াশিংটনে পাকিস্তানি দূতাবাসে ইকোনোমিক কাউন্সেলর পদে নিয়োজিত এ এম এ মুহিত পদত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের সংবাদ অনুষ্ঠান ‘কমেন্ট’ এর প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, হত্যা ও নিপীড়নের মাধ্যমে পাকিস্তান বেপরোয়াভাবে পূর্ববঙ্গে একটি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।
২ আগস্ট পাকিস্তান হাইকমিশনের চ্যান্সেরী বিভাগের প্রধান অফিসার বখতিয়ার আলী স্বাক্ষরিত একটি দলিলে প্রকাশ, ইয়াহিয়া খানের পক্ষে প্রচারণা চালাবার জন্য যুক্তরাজ্য সফরকারি বেগম আখতার সোলায়মান (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কন্যা) ও তাঁর স্বামী এস এ সোলায়মানকে ভাতা বাবদ নগদ অর্থ দেয়া হয়। লন্ডনের সাপ্তাহিক ‘জনমত’ পত্রিকায় ভাতাদান সম্পর্কিত দলিলটির
৩০৩
‘ফ্যাকসিমিলি’ ১২ সেপ্টেম্বরের সংখ্যায় ছাপানো হয়। লন্ডন সফরকালে ১৫ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে ট্রাফালগার স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বেগম সোলায়মান বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেন।
৪ আগস্ট ওয়াশিংটনে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাস ও নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ দপ্তরে পাকিস্তানি মিশনের মোট ১৫ বাঙালি কূটনৈতিক অফিসার একযোগে পদত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন চ্যান্সেরির প্রধান ও মন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন এনায়েত করিম এবং জাতিসংঘে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের স্থায়ী উপনেতা সৈয়দ আনোয়ারুল করিম।
৫ আগস্ট লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনে ডাইরেক্টর অফ অডিট ও অ্যাকাউন্টস পদে নিয়োজিত লুতফুল মতিন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
জুলাই মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানি জেলে বঙ্গবন্ধুর নির্যাতনের গুজব শোনার পর বিচারপতি চৌধুরী অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারী জেনারেল মার্টিন অ্যালান্সের পরামর্শ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অফ জুরিস্টসেকাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদনপত্র পেশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। ৫ আগস্ট জেনেভায় গিয়ে তিনি উভয় প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তরে আবেদনপত্র পেশ করেন।
‘নিউইয়র্ক টাইমস’ ও ‘দি ওয়াশিংটন পোস্ট’ এর যৌথ উদ্যোগে প্যারী থেকে প্রকাশিত ‘ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন’ পত্রিকার ৯ আগস্ট সংখ্যায় রফিক আনোয়ার জনৈক বাঙালির দৃষ্টিকোন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ১৯ জুলাই ‘ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধের উত্তরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কর্মরত বাঙালি সাংবাদিক মি. আনোয়ার এই নিবন্ধ লিখেছেন বলে উল্লেখ করা হয়।
মি. আনোয়ার বলেন, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে তার সঙ্গে এক সাক্ষাতকার কালে শেখ মুজিব বলেছিলেন, পাঞ্জাবের কায়েমী স্বার্থবাদীদের কুক্ষীগত রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তন করে পূর্ববঙ্গের ন্যায্য দাবী আদায় করা বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেও সম্ভব হবেনা। পূর্ববঙ্গের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ছয়দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে অসাম্য দূর করা সম্ভব বলে বিবেচিত হয়।
আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথম দিকে ‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকার মালিক হামিদুল হক চৌধুরী পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি দেশ সফর করে লন্ডনে পৌঁছান। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিরুদ্ধে প্রচারণার জন্য তাঁকে এবং গণতন্ত্রী দলের নেতা মাহমুদ আলীকে বিদেশে পাঠানো হয়। লন্ডন সফরকালে তাঁরা
৩০৪
বিখ্যাত ল্যাংকারস্টার হোটেলে অবস্থান করেন। পাকিস্তান সরকার তাদের ব্যয়ভার বহন করে। ভাতাদান সম্পর্কিত সরকারী দলিলের ফ্যাকসিমিলি লন্ডনের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘জনমত’ এর ৫ সেপ্টেম্বর সঙ্খ্যায় প্রকাশিত হয়।
হামিদুল হক চৌধুরী বর্তমান লেখক কে বলেন, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায়, অথচ পূর্বপাকিস্তানের জনসাধারণ তা চায়না। বিগত নির্বাচনে যারা আওয়ামো লীগকে ভোট দিয়েছে তারা পাকিস্তান ধ্বংস করার ম্যান্ডেট (নির্দেশ) তাঁকে দেয়নি।
মি. চৌধুরী আরো বললেন, মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ও সাহস আওয়ামী লীগের নেইবাঙালিদের সাহসের অভাব সম্পর্কে তিনি ফেনিয়ে-ফাঁপিয়ে গল্প বললেন।
হামিদুল হক চৌধুরী ও মাহমুদ আলী কয়েকদিন লন্ডনে ছিলেন। কয়েকটি বাঙালি রেস্তোরাঁয় গিয়ে তারা ঘরোয়া আলোচনাকালে ভারতের তথাকথিত দুরভিসন্ধির কথা উল্লেখ করেন। ব্যারিস্টার আব্বাস আলীসহ মাত্র অল্প কয়েকজন পাকিস্তানপন্থী বাঙালি মাহমুদ ও হামিদুল হক চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। গোলযোগের আশংকায় তারা প্রবাসী বাঙালিদের জনসভা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ত্যাগ করেন।
আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে বর্তমান লেখকের প্যারি সফরকালে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ বলেন, তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত লেখকের জানা ছিলনা। লন্ডন থেকে যেসব বুলেটিন ও সংবাদপত্রের ক্লিপিং তাঁকে পাঠানো হয়েছে, তা তিনি যথাসময়ে পেয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে খবর সরবরাহের ব্যাপারে বুলেটিন ও ক্লিপিংগুলো তাঁর খুবই কাজে লেগেছে। বিখ্যাত ‘লালসালু’ উপন্যাসের লেখক তখন প্যারিতে অবস্থিত ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক দপ্তরের ডেপুটি ডাইরেক্টরপদে নিয়োজিত ছিলেন।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে তিনি লন্ডনে আসেন। বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি চৌধুরী তখন লন্ডনের বাইরে ছিলেন বলে তাঁর সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার জন্য জয়প্রকাশ নারায়ণ কর্তৃক দিল্লীতে যে আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছিল তাতে যোগ দেবার জন্যব সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নিতান্ত ব্যক্তিগত কারণে তিনি এই সম্মেলনে যোগ দিতে পারেননি। ১০ অক্টোবর তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে প্যারিতে মৃত্যুবরণ করেন।
১০ আগস্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন দপ্তর থেকে প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পরদিন (বুধবার) একটি সামরিক আদালতে
৩০৫
রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও অন্যান্য গুরুতর অভিযোগে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে। এই বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, শেখ মুজিবের পক্ষ সমর্থন করার জন্য কৌঁসুলি নিয়োগের সুযোগ দেওয়া হবে। তবে পাকিস্তানের নাগরিক ছাড়া অন্য কাউকে কৌঁসুলি নিয়োগ করা যাবেনা। সামরিক আদালতের সদস্যদের নাম এবং কোথায় এই গোপন প্রহসনের বিচার অনুষ্ঠিত হবে তা বলা হয়নি।
শেখ মুজিবকে মুক্তিদানের দাবী জানিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কিছুকাল আগে উত্থাপিত প্রস্তাবটি ২০০ জনেরও বেশি পার্লামেন্ট সদস্য সমর্থন করেছেন জেনে বিচারপতি চৌধুরী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি ব্রিটিশ সরকার ও জনগনের কাছে শেখ মুজিবের মুক্তি অর্জনের ব্যাপারে কার্যকর সমর্থন দানের জন্য আবেদন জানান।
সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের পক্ষ সমর্থন করার জন্য বাংলাদেশ মিশন কর্তৃক লন্ডনের বিখ্যাত সলিসিটর দের প্রতিষ্ঠান বার্নার্ড শেরিডান অ্যান্ড কোম্পানীকে নিয়োগ করা হয়। ‘দি টাইমস’এ প্রকাশিত এক পত্রে তাঁরা বলেন, শেখ মুজিবকে আইনগত পরামর্শ গ্রহনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এ সম্পর্কে তাঁরা পাকিস্তান হাইকমিশন মারফত যে পত্র প্রেরণ করেন, তার কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধুর বিচারের প্রতিবাদে ১১ আগস্ট লন্ডনের হাইড পার্কে এক বিরাট জসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটেনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কোচযোগে বাঙালিরা দলে দলে হাইডপার্কে এসে জমায়েত হন। এই সভায় পাকিস্তান হাইকমিশনে অফিসার পদে নিয়োজিত লুতফুল মতিন, ফজলুল হক চৌধুরী এবং আরো কয়েকজন পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। সভার শেষে এক বিরাট শোভাযাত্রা বিভিন্ন রাস্তা পরিক্রমনের পর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।
পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ১৫ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে বাংলাদেশবিরোধী একটি জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান হাইকমিশনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে কয়েকজন বাঙালি ‘কুইসলিং’ যোগদান করেন। এদের নেতা মোহাম্মদ আবুল হায়াত পাকিস্তানি অর্থ সাহায্য গ্রহন করে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণার জন্য ‘মুক্তি’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে।
ট্রাফালগার স্কোয়ারে ইয়াহিয়া খানের সমর্থনে অনুষ্ঠিত জনসমাবেশের প্রতিবাদে অ্যাকশন বাংলাদেশের সমর্থকরা ১৫ আগস্ট লন্ডনস্থ মার্কিন দূতাবাসের সামনে একটি নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা করেন। ‘মর্নিং স্টার’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদচিত্রে কয়েকজন শাড়ি পরিহিতা বাঙালি মহিলাকে পায়ে-চলা রাস্তার
৩০৬
ওপর শুয়ে থাকতে দেখা যায়। তিনটি গাড়িবোঝাই ‘সৈন্য’ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে তাদের ‘হত্যা’ করে। ‘সৈন্য’দের গায়ে ছিল পাকিস্তানি সামরিক পোষাক। বাংলাদেশে পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এই ‘হত্যা অভিনয়’ অনুষ্ঠিত হয়।
১৬ আগস্ট ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত আধপৃষ্ঠাব্যাপী এক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের মুক্তি দাবী করার জন্য বিশ্ব জনমতের কাছে আহবান জানানো হয়। তাঁর একটি প্রতিকৃতির নিচে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণ ও গণহত্যা এবং সামরিক আদালতে গোপন বিচার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তথ্য দেওয়া হয়। এই বিজ্ঞাপনের উদ্যোক্তাদের তালিকায় ৬৮ টি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করে।
১৭ আগস্টজেনেভায় অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস ও যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন সম্পর্কেও সাংবাদিকিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। স্থানীয় পাকিস্তান দূতাবাস সম্মেলন বানচাল করার ব্যর্থ চেষ্টা করে।
২১ আগস্ট ইরাকে নিয়োজিত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ ইরাক থেকে গোপনে লন্ডনে এসে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ২০ জন বাঙালি কূটনৈতিক অফিসার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের পক্ষে যোগ দেন। এঁদের মধ্যে মি. ফতেহ সবচেয়ে উচ্চপদস্থ অফিসার ছিলেন।
২২ আগস্ট বার্মিংহাম বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির প্রেসিডেন্ট জগলুল পাশা ৬ হাজার ৫০০ পাউন্ডের একটা চেক পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় গ্রহনকারী দুস্থ বাঙালিদের সাহায্যার্থে ভারতীয় হাইকমিশনারের হাতে অর্পন করেন।
২৭ আগস্ট বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী লন্ডনের রোজ ওয়াটার এলাকায় নটিংহিল গেটের কাছে ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেন্সে প্রায় ৩০০ বাঙালি এবং বহু বিদেশী সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ মিশনের উদ্বোধন করেন। ভারতের বাইরে লন্ডনেই প্রথম বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়।
দূতাবাস স্থাপিত হবার পর সরকারি অফিসারগণ ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেন্সে এবং বেসরকারি কর্মীরা ১১ নম্বর গোরিং স্ট্রিটের অফিসে কাজ করবেন বলে বিচারপতি চৌধুরী সিদ্ধান্ত করেন। গোরিং স্ট্রিটের কর্মীরা সাংগঠনিক ও প্রচার এবং পেমব্রিজ গার্ডেন্সের অফিসাররা কূটনৈতিক কার্য পরিচালনার দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন। বিচারপতি চৌধুরী সকালবেলা গোরিং স্ট্রিটে এবং বিকেলবেলা
৩০৭
পেমব্রিজ গার্ডেন্সে উপস্থিত থেকে বাংলাদেশ আন্দোলন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
আগস্ট মাসের শেষের দিকে রুমানিয়ায় ‘বিজ্ঞান ও বিশ্ব শান্তি’ শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি চৌধুরী ছাত্রনেতা মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জুকে সম্মেলনে যোগদানকারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁদের অবহিত করার উদ্দেশ্যে রুমানিয়া যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কিত প্রচার পুস্তিকা নিয়ে তিনি ৩০ আগস্ট রুমানিয়া পৌঁছান।
১ সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী লন্ডন থেকে নরওয়ের রাজধানী অসলো পৌঁছান। বিমানবন্দরে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রফিকুজ্জামান সহ ছয় সাতজন বাঙালি তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। স্থানীয় টিভি তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহন করে। এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি নরওয়ের অধিবাসিদের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনের সারমর্ম ব্যাখ্যা করার সুযোগ লাভ করেন।
অসলো শহরে ছয়দিন অবস্থানকালে তিনি নরওয়ের প্রধান বিচারপতি পিয়ের অল্ড, অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিন, অসলোর মেয়র এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী স্টলটেনবার্গের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কামনার কারণগুলো বিশ্লেষণ করেন। ২ সেপ্টেম্বর তিনি স্থানীয় রোটারী ক্লাবের সভায় অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। সভা শুরু হবার আগে তিনি এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে ‘সংগ্রামী বাঙালির দৃঢ় প্রত্যয়ের বাণী’ স্যদের কাছে পৌঁছে দেন। ৬ সেপ্টেম্বর সকালবেলা এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি বাংলাদেশের সংগ্রামের উদ্দেশ্য, বিদ্যমান পরিস্থিতি এবং সংগ্রামের অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেশ করেন। সেদিন সন্ধ্যাবেলা তিনি অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা করেন। নরওয়ের এক বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা একটি ব্যঙ্গচিত্র এবং ছাত্র ইউনিয়নের পোস্টার হিসেবে বযবহার করে। এই ব্যঙ্গচিত্রে ইয়াহিয়া খানকে নরহত্যাকারী দৈত্যরঊপে দেখানো হয়।
কিছুকাল আগে মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশে গণহত্যা সংগঠনের অপরাধে পাকিস্তানের বিচার অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য বিচারপতি চৌধুরীকে অনুরোধ জানান। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পর অসলো বিশ্ববিদ্যালইয়ের আইন বিভাগের ডিন প্রস্তাবিত ট্রাইব্যুনালের সদস্যপদ গ্রহন করতে রাজি হন। এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার আগেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী নরওয়ে থেকে সুইডেন পৌঁছান। সুইডেনে নিয়োজিত পাকিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত আব্দুর রাজ্জাক বিমানবন্দরে উপস্থিত
৩০৮
ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর তিনি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন।
স্টকহোমে পৌঁছাবার দুইঘন্টা পর বিচারপতি চৌধুরী নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক গুনার মিরডালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশ আন্দোলনের আদর্শ ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার পর বিচারপতি চৌধুরী অধ্যাপক মিরডালকে স্থানীয় বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যান পদ গ্রহন করার জন্য অনুরোধ জানান। তিনি সানন্দে রাজি হন।
সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যালবার্গ , প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারী পিয়ের শোরি, সুপ্রীম কোর্টের অস্থায়ী বিচারপতি মিসেস ইনগ্রিড গার্ডেওয়াইডেমার এবং লিবারেল পার্লামেন্টারি পার্টির চিফ হুইপ ইয়ান স্টিফেনসনের সঙ্গে পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে আলোচনা করেন। তাছাড়া তিনি ‘এক্সপ্রেসেন’ (সান্ধ্য দৈনিক) পত্রিকার সম্পাদক টমাস হ্যামানবার্গ , ‘সভেনসকা ডাগ ব্লাডেট’ পত্রিকার প্রতিনিধি ফ্রেডারিকসনের সঙ্গেও বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করেন। ৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন।
১৩ সেপ্টেম্বর সুইডেন ত্যাগ করার আগে বিচারপতি চৌধুরী আব্দুর রাজ্জাককে সুইডেনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার দ্বায়িত্ব অর্পনের জন্য মুজিবনগর সরকারকে পত্রযোগে অনুরোধ জানান।
১ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্যারিতে আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রায় ৭০০ প্রতিনিধি যোগদান করেন। সংশ্লিষ্ট দেশের স্পীকার তাঁদের প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দেন। সম্মেলনে যোগদানকারী পার্লামেন্ট সদস্যদের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে। ছাত্র প্রতিনিধিরা নানা দেশের পার্লামেন্ট সদস্যদের কাছে বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি এবং মুক্তি আন্দোলনের ইতিবৃত্ত ব্যাখ্যা করেন।
বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সম্মেলনে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
১৩ সেপ্টেম্বর দুজন বাঙালি কূটনীতিবিদ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের পক্ষে যোগদান করে। এঁদের মধ্যে ছিলেন ফিলিপাইনসের রাজধানী ম্যানিলায় রাষ্টদূত খুররম খান পত্নী এবং নাইজেরিয়ার রাজধানী লাগোসে নিয়োজিত চ্যান্সেরির কর্মকর্তা মহীউদ্দিন আহমেদ জায়গীরদার।
১৩ সেপ্টেম্বর বিমানযোগে বিচারপতি চৌধুরী সুইডেন থেকে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি পৌঁছান। হেলসিংকিতে নিয়োজিত ব্রিটিশ কনসাল জেনারেল
৩০৯
রয় ফক্স বিমানবন্দরে বিচারপতি চৌধুরীকে ব্যক্তিগত বন্ধু হিসেবে অভ্যর্থনা জানান। সেদিন বিকেলে তিনি বিশ্ব শান্তি পরিষদের সেক্রেটারী জেনারেল রমেশ চন্রর সাথে তাঁর অফিসে দেখা করেন। সেখানে বসেই তিনি তাঁর গেলসিংকি কর্মসূচী তৈরি করেন।
পরদিন সকালবেলা ফিনিশ টেলিভিশন বিচারপতি চৌধূরীর সাক্ষাৎকার গ্রহন করে এবং বিকেলে তিনি স্থানীয় ছাত্রদের এক জনসভায় বক্তৃতা করেন। তারপর পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলোচনা করেন। এরপর পররাষ্ট্র দপ্তরের জনৈক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, বাংলাদেশ আন্দোলনের ব্যাপকতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে ফিনল্যান্ড সরকার সজাগ রয়েছে। সন্ধ্যাবেলা হেলসিংকি ত্যাগ করার আগে সুপ্রিম কোর্টের জজ ও মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ভ্যাটওসারিয়োর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
১৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যাবেলা ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনের বিমানবন্দরে মতিউর রহমান এবং লেয়াকত হোসেসহ কয়েকজন বাঙালি কর্মী বিচারপতি চৌধুরীকে অভ্যর্থনা জানায়। কোপেনহেগেনে অবস্থানকালে দুটি সংবাদপত্র (‘ইনিফরমেশান’ ও পলিটিকেন’) এবং স্থানীয় টিভি তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহন করে। স্থানীয় বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি টিভি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেছিল। অ্যাকশন কমিটির আহবায়িকা ক্রিস্টেন ওয়েস্টগার্ড একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তিনি ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন। সেদিনের হত্যাকান্ড তিনি নিজের চোখে দেখেছিলেন বলে দেশে ফিরে এসেও তা ভুলতে পারেননি। কমিটির উদ্যোগে ডেনিশ ভাষায় একটি সংবাদ বুলেটিন নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল। ক্রিস্টেন ওয়েস্টগার্ড ও তাঁর সহকর্মীরা এই বিলেটিন প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।
বিচারপতি পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য, পার্লামেন্টের স্পিকার এবং বৈদেশিক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে আলোচনা করেন। জাতিসংঘের আসন্ন অধিবেশনে যোগদানের জন্য মনোনীত ডেনিশ প্রতিনিধিদলের নেতার সঙ্গেও তিনি সাক্ষাৎ করেন। জাতিসংঘের অধিবেশনকালে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে ডেনিশ প্রতিনিধি দলের নেতা সহায়তা করবেন বলে বিচারপতি চৌধুরীকে আশ্বাস দেন।
১৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যাবেলা বিচারপতি চৌধুরী কোপেনহেগেন থেকে বিমানযোগে লন্ডনে রওয়ানা হন। উত্তর ইউরোপের দেশগুলোতে তাঁর সফরসঙ্গী ছিলে রাজিউল হাসান রঞ্জু।
১৭ সেপ্টেম্বর ফরাসি সাহিত্যিক, মুক্তিযোদ্ধা ও বামপন্থী রাজনীতি বিদ আঁন্দ্রে মারলো প্যারিতে প্রকাশিত এক বিবৃতি প্রসঙ্গে বলেন, পূর্ববঙ্গে গিয়ে তিনি বাঙালি
৩১০
মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যোগ দেবার জন্য তৈরি রয়েছেন। তাঁর বিবৃতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবার পর বিচারপতি চৌধুরী তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞগতা প্রকাশ করেন।
১৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনের ওভাল নামে পরিচিত ক্রিকেট খেলার ময়দানে বাংলাদেশের বাস্তুহারাদের সাহায্যার্থে একটি বিরাট ‘পপ’ সঙ্গীতের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৩৩ হাজার তরুন তরুনী এই উৎসবে যোগদান করে। টিকিট বিক্রির আয় থেকে ১৫ হাজার ২ পাউন্ড ভারতে ভারতে আশ্রয় গ্রহনকারী বাঙালিদের জন্য পাঠানো হয়।
১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনের কনওয়ে হলে বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে ‘অস্ত্র হাতে তুলে নাও’ শীর্ষক একটি নৃত্যনাট্য অনুষ্ঠিত হয়। সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইনামুল হক (বর্তমানে ড. ইনামুল হক) নৃত্যনাট্যটি রচনা করেন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের এই বিপ্লবী আলেখ্য দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করে। বিচারপতি চৌধুরী এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন।
২১ সেপ্টেম্বর মুজিবনগর সরকার কর্তৃক বিচারপতি চৌধুরীর কাছে প্রেরিত এক তারবার্তায় বলা হয়, জাতিসংঘের আসন্ন অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করার জন্য ১৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল পাঠাবার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়েছে। বিচারপতি চৌধুরী এই প্রতিনিধিদলের নেতা মনোনীত হয়েছেন।
বিচারপতি চৌধুরী গোরিং স্ট্রিটের অফিস এবং পেমব্রিজ গার্ডেন্সের দূতাবাসে তাঁর অনুপস্থিতিতে কার্য পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করে ২৩ সেপ্টেম্বর লন্ডন থেকে নিউইয়র্কের পথে রওয়ানা হন।
৪ আগস্ট ওয়াশিংটনস্থ পাকিস্তানি দূতাবাসের সকল বাঙালি সদস্য পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলে বাংলাদেশ আন্দোলনের স্থানীয় সংগঠন পূর্ণতা লাভ করে। তাদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে একটি দূতাবাস স্থাপিত হয়। আগস্টের শেষে কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। জাতীয় সংসদ সদস্য মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োজিত হন। অনুরূপভাবে মুজিবনগর সরকার বিচারপতি চৌধুরীকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এবং নিউইয়র্ক দূতাবাসের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করে।
প্রথমদিনের পূর্ণাংগ প্রতিনিধিদলের সভায় গকির সাহাবুদ্দিনকে দলের সদস্য সচিবের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়। তাছাড়া এ এইচ মাহমুদ আলীকে প্রতিনিধিদলে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়। তিনি ২৬ এপ্রিল পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সকলের প্রশংসা অর্জন করেন। বিচারপতি চৌধুরীর অনুরোধে শাহাবুদ্দিন অফিস পরিচালনার দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন।
শাহাবুদ্দিনের কাজ অত্যন্ত দ্বায়িত্বপূর্ণ ছিল। তিনি বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। তাছাড়া কোনো
৩১১
সাংবাদিক কিংবা রেডিও ও টিভির প্রতিনিধিরা বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে তিনি তা সুচারুরূপে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করেন।
প্রতিদিন সকালে কয়েক মিনিটের জন্য বেলমন্ট প্লাজার সভাকক্ষে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের বৈঠক বসে। ইতিমধ্যে প্রতিনিধি দলকে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। প্রতিনিধিদলের কোন গ্রুপ কোন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং কী কথা হয়েছে তা সকালের বৈঠকে পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ প্রতিনিধিরা দূতাবাসে গিয়ে সাধারণত রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেন। পরবর্তীকালে শাহাবুদ্দিন প্রতিদিনের আলোচনার বিবরণসংবলিত শতাধিক পৃষ্ঠা রিপোর্ট তৈরি করেন।
বিচারপতি চৌধুরী প্রতিদিন একবার জাতিসংঘ ভবনে যান। তাঁর গ্রুপে ছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য সৈয়দ আব্দুস সুলতান এবং তরুন কূটনীতিবিদ এ এইচ মাহমুদ আলী। ভারতের সাহায্য নিয়ে জাতিসংঘের দপ্তরে যাওয়া উচিত হবেনা বলে বিচারপতি চৌধুরীর গ্রুপ ড. জে কে ব্যানার্জির অতিথি হিসেবে জাতিসংঘ ভবনে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। ১৯৭১ সালে ড. ব্যানার্জি জাতিসংঘ সবাদদাতা সমিতির সভাপতি ছিলেন।
জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদানকারী প্রতিনিধিদলের ‘লাউঞ্জ’ এবং অন্যান্য জায়গায় বিচারপতি চৌধুরী ও তাঁর গ্রুপ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতগণ সহৃদয়তার সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিচারপতি চৌধুরী ও তাঁর সহকর্মীদের বক্তব্য শোনেন এবং তাঁদের সরকারকে তা জানাবেন বলে আশ্বাস দেন। কোন কোন দেশের প্রতিনিধিরা সরাসরি সমর্থন জ্ঞাপন করেন।
বিচারপতি চৌধুরী তাঁর ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ শীর্ষক স্মৃতিকথায় লিখেছেনঃ মে মাসে (১৯৭১) যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে খোরশেদ আলম ও মাহাবুবুল আলম আমার সঙ্গে দেখা করে আন্দোলনের পক্ষে কাজ শুরু করার কথা জানান। সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা গিয়ে দেখলাম তাঁরা সংঘবদ্ধ হয়েছেন এবং সুসংহতভাবে আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। খোরশেদ আলম বৃহত্তর বোস্টনের বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি আন্দোলনের পূর্বে সিএসপি অফিসার ছিলেন। এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহন করেছিলেন রেজাউল আলম ভুঁইয়া। প্রকৌশলী আমিনুল ইসলামও সংগ্রাম পরিষদে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা ‘শিখা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করে।
মে মাসে আমি (বিচারপতি চৌধুরী) বিদ্যুৎ প্রকৌশলী রেজাউল হাসানকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যোগাযোগ যন্ত্র প্রেরণের ব্যাপারে সক্রিয় প্রচেষ্টা চালাতে অনুরোধ করেছিলাম। সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা পৌঁছে যোগাযোগ যন্ত্র প্রেরণের
৩১২
ব্যাপারে অভাবিত সাফল্যের কথা শুনে নিবিড় আনন্দ পেলাম। ২৪ মের আগেই হারুন অর রশীদ মুজিবনগরে গিয়ে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দেখা করে এসেছিলেন। রেজাউল হাসান তাঁর কাছ থেকে যোগাযোগযন্ত্রের প্রয়োজন সম্পর্কে বেশ কিছুটা ধারনা লাভ করেছিলেন।’
একাডেমী অফ অ্যাপ্লাইড সায়েন্সের প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্ট ড” রবার্ট রাইস তাঁর প্রিতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ত্রাণকার্যে ব্যবহারের জন্য যোগাযোগযন্ত্র গুলো প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। বাঞালি ছাত্র তৈয়ব উদ্দিন মাহতাব যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে মুজিবনগরে যান।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ ভবনের বিপরীত দিকে অবস্থিত চার্চ সেন্টারের একটি বড় হলঘরে ১ অক্টোবর বিচারপতি চৌধুরী ও তাঁর সহকর্মীরা এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দেশ্য ও আদর্শ ব্যাখ্যা করেন। প্রশ্নোত্তরকালে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে বাঙালিদের অর্থনৈতিক শোষণ এবং রাজনৈতিক নিপীড়ন সহ্য করতে হয়। ২৩ বছরের মধ্যে আইনসঙ্গত পন্থায় এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়নি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরজনগণের আশা আকাঙ্খা পূর্ণ হবে বলে আশা করা হচ্ছিল। পূর্ববঙ্গের ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি শেখ মুজিবের পার্টি কর্তৃক দখলের ফলে পাকিস্তানের সামরিক চক্র ষড়যন্ত্র শুরু করে। ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে আলোচনায় ব্যস্ত রেখে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনার ব্যবস্থা করে। শেষ পর্যন্ত আলোচনার অবসান ঘোষণা করেই ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নির্বিচারে হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের কাজে নিয়োজিত হয়। এই পরিস্থিতেতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান তিনটি পূর্বশর্তের উপর নির্ভরশীল। যথা, ১. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দান ২. অবিলম্বে এবং বিণাসর্তে গণতান্ত্রিক প্রথায় নির্বাচিত বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিদান এবং ৩. ইয়াহিয়া খানের হানাদার বাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে অবিলম্বে অপসারণ।
বলাবাহুল্য, এই সাংবাদিক সম্মেলনটি সাফল্যমন্ডিত হয়েছিল। বিচারপতি চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতি , সংসদের আটজন নির্বাচিত সদস্য, দুজন রাষ্ট্রদূত, দুজন ভাইস চ্যান্সেলর, একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং কয়েকজন অভিজ্ঞ কূটনীতিবিদ। তাঁরা সহজেই সম্মেলনে যোগদানকারী সাংবাদিকদের শ্রদ্ধা অর্জন করেন। সাংবাদিক সম্মেলনের বিবরণ প্রচারিত হওয়ার পর আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য প্রবাসী বাঙালিদের কাছ থেকে বিচারপতি চৌধুরী বহু আমন্ত্রণ পান।
৩১৩
৪ অক্টোবর নয়াদিল্লিস্থ পাকিস্তানি দূতাবাসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী প্রকাশ্যে বাংলাদেশ আন্দোলনে যোগদান করেন। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দিল্লিতে ‘চিফ অফ মিশন’ পদে নিয়োগ করে।
৫ অক্টোবর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নিন্দাসূচক দীর্ঘ বক্তৃতা দানকালে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের ‘বাঙালি’ নেতা মাহমুদ আলী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত অঘোষিত যুদ্ধে নিয়োজিত রয়েছে বলে অভিযোগ করেন। শুধু পাকিস্তানের আত্মসংযমের ফলে এই যুদ্ধ ব্যাপকতা লাভ করেনি বলে তিনি দাবি করেন।
৮ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান’এর কূটনৈতিক সংবাদদাতা প্রদত্ত এক সংবাদে বলা হয়, লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের ‘পলিটিক্যাল কাউন্সেলর’ রেজাউল করিম পদত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে যোগদান করেছেন। এ পর্যন্ত যেসব বাঙালি অফিসার হাইকমিশন থেকে পদত্যাগ করেছেন তাদের মধ্যে মি. করিম সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
আর্জেন্টিনায় পাকিস্তানি দূতাবাসে নিয়োজিত বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমিন ১১ অক্টোবর পদত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে যোগদানের কথা ঘোষণা করেন। ১৩ অক্টোবর তিনি লন্ডন পৌঁছে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
ভারত উপমহাদেশের তৎকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ২৪ অক্টোবর নয়াদিল্লি ত্যাগ করেন। তিন সপ্তাহকাল বিদেশে অবস্থানকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ব্রাসেলস, ভিয়েনা, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, প্যারি ও বন সফর করেন।
২৯ অক্টোবর মিসেস গান্ধী ভিয়েনা থেকে লন্ডন পৌঁছান। সেদিন ‘দি টাইমস’ এ প্রকাশিত এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে মিসেস গান্ধীর কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ৯০ লক্ষ বাস্তুত্যাগীকে আশ্রয় দিতে বাধ্য হওয়ার ফলে ভারত এক অসহনীয় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দ্বায়িত্ব বহন করছে। মিসেস গান্ধী মনে করেন, বাস্তুত্যাগীদের জন্য সাহায্য বরাদ্দ করে কেবল সাময়িক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তাঁর অভিমত সমর্থন করে সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে বাস্তুত্যাগীদের পূর্ববঙ্গে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। উপসঙ্ঘারে বলা হয়, উপমহাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে মিসেস গান্ধীর যুক্তিগুলো গ্রহনযোগ্য।
মিসেস গান্ধী লন্ডন পৌঁছানোর কয়েকঘন্টা পর বাংলাদেশ মিশনের প্রধান ও মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ক্ল্যারিজেস হোটেলে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। লন্ডনস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের উদ্যোগে এই সাক্ষাতের আয়োজন করা হয়।
মিসেস গান্ধীর সঙ্গে ইতিপূর্বে বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎ হয়নি। তিনি
৩১৪
বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে পুরানো বন্ধুর মত কথা বলতে শুরু করেন। বিচারপতি চৌধুরীর ফ্রান্স, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ড সফরের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি জানতে চান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আগে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে যথেষ্ট সময় না দিয়ে তিনি এই সাক্ষাতের আয়জন করার অনুরোধ জানিয়েছিলেনবলে মিসেস গান্ধী উল্লেখ করেন।
বিচারপতি চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন দেশের সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান সম্পর্কে তঁরা বলেন, ভারত কর্তৃক স্বীকৃতিদানের উপর তাঁদের সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে।
আবেগপূর্ণ স্বরে তিনি আরো বলেন, মিসেস গান্ধীর পিতা বেঁচে থাকলে তিনি শুধু বাস্তুত্যাগীদের আশ্রয় দিয়েই ক্ষান্ত থাকতেন না। অবশ্য এর প্রতিদান দেবার মত বিচারপতি চৌধুরীর কিছু নেই। বাংলাদেশ কখনো ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত হবেনা। তবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারতের বন্ধুরাষ্ট্রের ভূমিকা গ্রহন করবে। এই বন্ধুত্ব ভারতের কাম্য কিনা, ভারত তা বিচার করবে।
মিসেস গান্ধী ধৈর্য ধরে তাঁর বক্তব্য শোনার পর বিনীতভাবে বলেন, বন্ধুত্বের কথা বলে বিচারপতি চৌধুরী সৌজন্য প্রকাশ করেছেন। এ সম্পর্কে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ কর্তৃক সিদ্ধান্ত গ্রহন করা পর্যন্ত অপেক্ষা করা বাঞ্ছনীয় বলে তিনি মনে করেন।
বিচারপতি চৌধুরীর উল্লিখিত প্রতিদান সম্পর্কে মিসেস গান্ধী বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে তিনি একটামাত্র প্রতিদান আশা করেন- তা হল গণতন্ত্র। পার্শ্ববর্তী দেশে তিনি সামরিক শাসন দেখতে চান না।
এই সাক্ষাৎকার কালে বিচারপতি চৌধুরীকে আশ্বাস দিয়ে মিসেস গান্ধী বলেন, উপযুক্ত সময়ে বিনা দ্বিধায় বাংলাদেশকে ভারত স্বীকৃতিদান করবে।
(সূত্রঃ বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে লেখকের সাক্ষাতকার, ১৯৮৬)
৩০ অক্টোবর লন্ডনের হেনরী থনটন স্কুলে বাংলাদেশ জাতীয় ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি এই সম্মেলনের আয়োজন করে। ম্যাঞ্চেস্টার, লিডস, বার্মিংহাম, এক্সেটার, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র প্রতিনিধিদল সম্মেলনে যোগদান করেন। বিচারপতি চৌধুরী আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলন উদ্বোধন করেন। শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শোর এবং ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ছাত্র প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্য অধিবেশনে বক্তৃতা করেন। বিকেলবেলার অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে সুদূরপ্রসারী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি চৌধুরী আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহান স্বাধীনতা
৩১৫
সংগ্রামের রাজনৈতিক পটভূমি ব্যাখ্যা করেন। আলোচনায় অংশগ্রহন করে ড. আজিজুর রহমান খান স্বাধীনতা সংগ্রামের অর্থনৈতিক পটভূমি ব্যাখ্যা করেন।
সম্মেলনে ছাত্ররা ঘোষণা করেন, পূর্ণ স্বধীনতা ছাড়া আর কোন সমাধান তাঁদের কাছে গ্রহনযোগ্য নয়।
৩ নভেম্বর প্রাপ্ত এক সংবাদে বলা হয়, সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্ণে অবস্থিত পাকিস্তানি দূতাবাসে সেকেন্ড সেক্রেটারী হিসেবে নিয়োজিত অয়ালিউওর রহমান পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের পক্ষে যোগ দিয়েছেন। তিনি সুইজারল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। সাংবাদিকিদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মি. রহমান বলেন, জেনেভায় একটি বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র খুলবেন বলে তিনি আশা করেন।
জাপান থেকে প্রাপ্ত এক সংবাদে বলা হয়, টোকিওতে অবস্থিত পাকিস্তানি দূতাবাসে নিয়োজিত প্রেস অ্যাটাসে এস এম মাসুদ ও থার্ড সেক্রেটারী মি. রহিম পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছেন।
৭ নভেম্বর বৃহত্তর লন্ডন এলাকায় বাঙালিদের উদ্যোগে গঠিত ১৪ টি অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিগণ এক সভায় মিলিত হয়ে গ্রেটার লন্ডন কো-অর্ডিনেটিং কমিটি গঠন করেন। বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির কর্মসূচীর সমন্বয় সাধন এবং প্রস্তাবিত জাতীয় সম্মেলন সাফল্যমন্ডিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনের উদ্দেশ্যে উল্লেখিত কমিটি গঠন করা হয়। এস এম আইয়ুব কমিটির আহবায়ক মনোনীত হন।
ইতিমধ্যে নতুন একটি উপসর্গ দেখা দেয়। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাহায্যদানের জন্য কিছুসংখ্যক চীনপন্থী বাঙালি ভারতের বিরুদ্ধে নানা প্রকার কুৎসা প্রচারে আত্মনিয়োগ করে। চীনে বাংলাদেশবিরোধী নীতির সমর্থকরা দাবী করে, মুজিবনগর সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থন দুরভিসন্ধিমূলক। বাংলাদেশকে ভারতের উপনিবেশে পরিনত করাই তাদের আসল উদ্দেশ্য। ভারতবিরোধী প্রচারে চীনপন্থীরা মওলানা ভাসানীর নাম ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করেনি। ভারতে ও বিদেশে প্রচারিত বিবৃতিতে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের অবস্থায় দিনযাপন করতে বাধ্য করেছে। কিছুকাল আগে ‘দি টাইমস’ এ প্রকাশিত এক চিঠিতে লন্ডনের ন্যাপ সমর্থক মিসেস বারবারা হক মওলানা সাহেবকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তিদানের দাবি জানান। তাঁকে মুক্ত করার জন্য ভাসানীপন্থী ন্যাপের উদ্যোগে লন্ডনে একটি কমিটি গঠিত হয়।
শেষ পর্যন্ত মওলানা ভাসানী তাঁর ভক্তদের এই মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ১২ নভেম্বর বিচারপতি চৌধুরীর কাছে লিখিত এক পত্রে তিনি গৃহবন্দী থাকার সংবাদ দুরভিসন্ধিমূলক নয় বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, যখন খুশি এবং যেকোন জায়গায় যাওয়ার সম্পূর্ণ
৩১৬
স্বাধীনতা তিনি ভোগ করছেন। বর্তমান বিপদজনক পরিস্থিতিতে তিনি প্রকাশ্য চলাফেরা করা এবং প্রত্যেককে সাক্ষাৎদান নিরাপদ ও বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয় বলে মনে করেন। পত্রের উপসংহারে তিনি বলেন, ‘হিন্দুস্থান নিঃস্বার্থভাবে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা ও নির্যাতিত শরণার্থীদের জন্য যা করেছে তার কথা বাঙালিরা চিরদিন মনে রাখবে।
নভেম্বর মাসের শেষদিকে বিচারপতি চৌধুরী লন্ডন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তন করেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যাখ্যা করার জন্য হার্ভার্ড, নিউইয়র্ক সিটি, কলম্বিয়া, হোফস্ট্রা ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ম্যাসাচুয়েটস ইনস্টিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি) ও হার্ভার্ড স্কুল অফ ল সফর করেন। উল্লিখিত প্রতিষ্ঠান গুলোতে বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনাকীর্ণ সভায় তিনি বক্তৃতা করেন।
এমআইটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধিকর্তা অধ্যাপক ইথেল ডি লা সোলাপুর বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে বক্তৃতা দানের জন্য বিচারপতি চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানান।তাঁর সম্মানার্থে অধ্যাপক সোলাপুর কর্তৃক আয়োজিত এক মধ্যাহ্নভোজে অন্যান্য বিভাগের ১৫-১৬ জন অধ্যাপককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিচারপতি চৌধুরীকে নানা প্রশ্ন করে তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে অকাট্য যুক্তি ও তথ্য সংগ্রহ করেন।
মধ্যাহ্ন ভোজের পর বিচারপতি চৌধুরী হার্ভার্ড স্কুল অফ ল এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সভায় পাকিস্তান কর্তৃক অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক বঞ্চনার ইতিহাস উল্লেখ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পশ্চাৎপট ব্যাখ্যা করেন। সন্ধ্যাবেলা এমআইটির ছাত্র ও অধ্যাপকদের এক সভায় বিচারপতি চৌধুরী প্রায় এক ঘন্টা যাবত বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। সভায় যোগদানকারীরা প্রকাশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জ্ঞাপন করেন। হোফস্ট্রা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভার উদ্যোক্তা ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মায়ার বার্স। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের উদ্যোগে পৃথক একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। নিউইয়র্ক সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় বক্তৃতা দান ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিও স্টেশন থেকে বিচারপতি চৌধুরী স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করেন। প্রায় ঘন্টাব্যাপী প্রচারিত এই বেতার অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের যুবক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সংহতি ঘোষণা করার জন্য বিচারপতি চৌধুরী তাদের পক্ষ থেকে মার্কিন যুবক ও ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আহবান জানান।
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সফর করার পর বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে ট্রেনযোগে ওয়াশিংটন সফরে যান। ১ আগস্ট স্থানীয় পাকিস্তান দূতাবাস থেকে একযোগে
৩১৭
পদত্যাগকারী অফিসারগণ রেলওয়ে স্টেশনে প্রতিনিধি দলকে অভ্যর্থনা জানান। পরদিন বিচারপতি চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলের সদস্যগণ সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ও সিনেটর স্যাক্সবিসহ কয়েকজন সিনেটর এবং কংগ্রেসম্যান গ্যালাঘারের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করেন।
ওয়াশিংটনে নিয়োজিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত এম আর সিদ্দিকী প্রতিনিধিদলের সদস্যদের সম্মানার্থে একটি সান্ধ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও দুতাবাসের প্রতিনিধিরা এই অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে দুয়েকটি দেশের দূতাবাস ছাড়া অন্য দূতাবাসের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের উচ্চ পদস্থ অফিসার মি. কনস্টেবলের সঙ্গেও বাংলাদেশ সম্পর্কে আলোচনা করেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাসভবন হোয়াইট হাউসের নিকটবর্তী লাফায়েত পার্কে স্থানীয় তরুন তরুনীরা ভারতে আশ্রয় গ্রহনকারী পূর্ববাংলার বাস্তুত্যাগীদের দুর্দশা সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য শরণার্থী শিবিরের অনুরূপ একটি শিবির নির্মাণ করে। লুঙ্গি ও গেঞ্জি এবং শাড়িপরা মার্কিন তরুন তরুনীরা এই শিবিরের বিরাটাকায় কার্ডবোর্ড নির্মিত পাইপের ভিতর আশ্রয় নিয়ে বাস্তুত্যাগীদের করুন অবস্থার প্রতিফলন করতে সক্ষম হয়। বিচারপতি চৌধুরী ও তাঁর সহকর্মীরা এই শিবির পরিচালনাকালে সংবাদপত্র, টিভি ও রেডিওর কয়েকজন প্রতিনিধি ও প্রেস ফটোগ্রাফার উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকদের কাছে উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা উপলক্ষে তরুন তরুনীরা বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণের সঙ্গে তাদের সংহতি ঘোষণা করে। বিচারপতি চৌধুরী মার্কিন তরুন তরুনীদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
একটি টিভি সাক্ষাৎকারকালে বিচারপতি চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করা হয়, মার্কিন সরকার কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে বলে কি তিনি আশা করেন? উত্তরে তিনি বলেন, নিক্সন সরকার বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়; কিন্তু মার্কিন জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে। অতএব মার্কিন সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হবে।
অপর একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারকালে জনৈক সাংবাদিক বলেন, ভারতের সহায়তায় সংগ্রাম শুরু করার ফলে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ একটি অধীনস্ত রাজ্যে পর্যবসিত হতে পারে বলে অনেকে আশংকা করেন। এর উত্তরে বিচারপতি পালটা প্রশ্ন করেন, গত মহাযুদ্ধে নাৎসি কবলমুক্ত হবার পর ফরাসিদেশ কি মিত্রপক্ষের অধীনস্থ রাজ্যে পরিণত হয়েছে? তিনি দৃঢ়কন্ঠে বলেন, ভারত বন্ধু ও সহকারী দেশ হিসেবে এগিয়ে এসেছে। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ ভারতের বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হবে। ভারত কিংবা অন্য কোন রাষ্ট্রের অধীনস্থ রাজ্যের মর্যাদা বাংলাদেশের জন্য কখনো গ্রহনযোগ্য হবেনা। (সূত্রঃ
৩১৮
বিচারপতি চৌধুরী কর্তৃক লন্ডনে প্রদত্ত সাক্ষাৎকার, ৩১ অক্টোবর, ১৯৮৬)।
৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতের অব্যবহিত পর এক বেতার ভাষণে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে পূর্ণোদ্যমে যুদ্ধ শুরু করেছে। এবং দেশে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। সারাদেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণার পর জাতির উদ্দেশ্যে এই বেতার ভাষণ প্রচার করা হয়।
বিগত সপ্তাহের শেষে লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বাংলাদেশ ও ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণ পরিচালনার জন্য পাকিস্তান সামরিক চক্রের তীব্র নিন্দা করা হয়। ওয়ালী খান ও মুজাফফর আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী পার্টি ও পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট অফ বাংলাদেশের উদ্যোগে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে লর্ড ব্রকওয়ে বলেন, এই যুদ্ধের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া অন্যান্য বৃহৎ শক্তিবর্গ বিশেষভাবে দায়ী। পূর্ববঙ্গে সামরিক আক্রমন চালিয়ে গণহত্যা শুরু করার পর তারা নিষ্ক্রিয় থাকার নীতি গ্রহন করে।
৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার কর্তৃক স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনী যখন জয়যাত্রা শুরু করে তখনই সিকিউরিটি কাউন্সিলের অধিবেশন আহবান করা হয়। বাংলাদেশে কাশ্মীরের মত অচলাবস্থা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ও তার সমর্থকরা কাউন্সিলের হস্তক্ষেপ কামনা করে। বিচারপতি চৌধুরী ও বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের অপর সদস্যগণ দিনরাত পরিশ্রম করে এর বিরোধিতা করেন। কাউন্সিল সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন না করার জন্য তাঁরা অনুরোধ করেন।
সিকিউরিটি কাউন্সিলে উপমহাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা শুরু হবার পর মুজিবনগর সরকারের বক্তব্য পেশ করার জন্য বিচারপতি চৌধুরী কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের নিকট একটি আবেদনপত্র পেশ করেন।
জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি দেবার পূর্বে কোন একটি সরকারের প্রতিনিধিকে কাউন্সিলের অধিবেশনে যোগ দিয়ে তাদের বক্তব্য পেশ করতে দেয়া উচিত হবে কিনা সে সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্পর্কে দুবার ভোট গ্রহন করা হয়। উভয়ক্ষেত্রে অধিকাংশ সদস্যদেশ বিচারপতি চৌধুরীর বক্তব্য পেশ করার প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। দুবারই চীন ভেটো প্রয়োগ করে প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়।
বৃহত্তর লন্ডন এলাকার ১৪ টি বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল ৬ ডিসেম্বর লন্ডনস্থ ভারতীয় হাইকমিশনে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে। প্রতিনিধিরা ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে ইন্ডিয়া হাউসে প্রবেশ করেন। ভারতীয়
৩১৯
হাইকমিশনার আগা পন্থের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি বলেন, ভারত কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে ঐতিহাসিক সত্যকে মেনে নেওয়া হয়েছে।
সোভিয়েত ইউনয়ন ও চীন কর্তৃক ভেটো প্রয়োগের ফলে সিকিউরিটি কাউন্সিল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে অসমর্থ হওয়ায় ১৩১ সদস্যবিশিষ্ট সাধারণ পরিষদ ৭ ডিসেম্বর জরুরী ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহন করে। সেদিন রাত্রিবেলা সাধারণ পরিষদে গৃহিত এক প্রস্তাবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে পরস্পরের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার আহবান জানানো হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ১০৪ টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। ভারত, ভুটান, মঙ্গোলিয়া, কিউবা, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট দেশ (রুমানিয়া ছাড়া) প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোটদান করে। ভারত সরকার প্রস্তাবটি উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে।
১২ ডিসেম্বর বিকেলবেলা লন্ডনের হাইডপার্ক কর্নারে প্রায় ১৫ হাজার প্রবাসী বাঙালির এক গণসমাবেশে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবী করা হয়। ব্রিটেনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দলে দলে প্রবাসী বাঙালীরা কোচযোগে লন্ডন এসে এই সমাবেশে যোগদান করেন। সমবেত জনগনের উদ্দেশ্যে বক্তৃতাদানকারীদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ মিশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান কর্মকর্তা রেজাউল করিম, শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শোর ও জন স্টোনহাউস এবং মুজিবনগর থেকে আগত আওয়ামী লীগ নেতা আসাবুল হক।
হাইড পার্ক থেকে প্রবাসী বাঙালিরা বিরাট মিছিল সহকারে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে অবস্থিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পৌঁছায়। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট গাউস খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ভেতরে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের অনুরোধ সংবলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে মুক্তির ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানানো হয়। ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে এই মিছিলকে ‘ভিক্টরি প্যারেড’ (বিজয় সমারোহ) বলে অভিহিত করা হয়। ডাউনিঙ স্ট্রিট থেকে প্রবাসী বাঙালিরা অল্ডউইচে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনে গিয়ে একটি ধন্যবাদসূচক পত্র পেশ করেন।
১৬ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে এসোসিয়েট প্রেস অফ আমেরিকা কর্তৃক প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আয়োজিত এক সামরিক অনুষ্ঠানে পূর্ববঙ্গে নিয়োজিত পাকিস্তানি বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজী পূর্বাঞ্চলে নিয়োজিত ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর যুক্ত কমান্ডার সর্বাধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে ৪ টা ৩১ মিনিটের সময় অনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পন করে।
৩২০
পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পন সম্পর্কে ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে প্রদত্ত ভাষণে মিসেস গান্ধী বলেন, পাকিস্তান বাহিনী বিনাশর্তে আত্মসমর্পন করেছে। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের রাজধানী।
নতুন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান তাঁত দেশের জনগণের মধ্যে ন্যায্য আসন গ্রহন করে বাংলাদেশকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবেন বলে মিসেস গান্ধী আশা প্রকাশ করেন। সোনার বাংলার স্বপ্ন সফল সফল করার সুযোগ উপস্থিত হয়েছে। এ ব্যাপারে ভারতের শুভেচ্ছা থাকবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।
১৬ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে অবস্থানরত বিচারপতি চৌধুরী ও তাঁর সহকর্মীরা ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর যুক্ত কমান্ডের কাছে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পনের সংবাদ পান। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দানকারী বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করার জন্য আরো কয়েকদিন অবস্থানের পর তিনি এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের অপর সদস্যগণ ২২ ডিসেম্বর লন্ডনে ফিরে আসেন। লন্ডন ফিরে আসার পর বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছে থেকে একটি তারবার্তা পান। এই তারবার্তায় তাঁকে অবিলম্বে দেশে ফেরার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। বিচারপতি চৌধুরী টেলিফোনযোগে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে আলোচনাকালে বলেন, ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী বাঙালিরা বাংলাদেশের জন্য আপ্রাণ পরিশ্রম করেছেন; তাদের ধন্যবাদ না জানিয়ে তিনি দেশে ফিরতে পারেন না। তাছাড়া সাংগঠনিক কয়েকটি কাজ সমাধান না করে ব্রিটেন থেকে তিনি ফিরে যেতে পারেন না। (সূত্রঃ বিচারপতি চৌধুরী কর্তৃক লন্ডনে প্রদত্ত সাক্ষাতকার, ৩১ অক্টোবর ১৯৮৬)।
সদ্য প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে স্বাগত জানাবার জন্য ২ জানুয়ারি ১৯৭২ লন্ডনের হাইড পার্কে বাংলাদেশ স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। পাঁচ হাজারেরও বেশি লোক সভায় অংশগ্রহন করেন। শেখ আব্দুল মান্নানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় বক্তৃতাদানকারীদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি ও যুক্তরাজ্যে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী ও ব্রিটিশ শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউস, মহিলা সমিতির বেগম শামসুন্নাহার, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু ও বাংলাদেশ ডাক্তার সমিতির একজন প্রতিনিধি।
বিচারপতি চৌধুরী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহনকারী প্রবাসী বাঙালি ও সমর্থন দানকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের অশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। ৯ মাস যাবত আতিথেয়তা প্রদর্শনের জন্য ব্রিটেনকেও তিনি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
৬ জানুয়ারী ১৯৭২ সন্ধ্যাবেলা বিচারপতি চৌধুরী লন্ডন থেকে বিমানযোগে
৩২১
ঢাকার পথে রওয়ানা হন। কোলকাতা হয়ে ৮ জানুয়ারি তিনি ঢাকা পৌঁছান।
১২ জানুয়ারি ১৯৭২, বিচারপতি চৌধুরী গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহন করেন।
লন্ডন, ১০ জুন ১৯৯৬
[১২৬] আব্দুল মতিন
বাংলাদেশের সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদ
আমাদের বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব যারা মুজিবনগরে ছিলেন তাঁরা স্বাধীনবাংলা বেতারের মাধ্যমে জনযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী সকলকে দারুনভাবে উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত করে রাখেন। একদিকে মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী সকলকে জয়ের আশায় দিপ্ত করে রাখে, অন্যদিকে শত্রু পক্ষকে পরাজয়ের ভীতি প্রদর্শন করে মনোবল ভেঙে দেয়। পশ্চিমবণহহে গঠিত সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদ সারা ভারতে সভা, সমিতি, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ভারতের সর্বস্তরের জনগণ এসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয় এবং সংহতি প্রকাশ করে।
বাংলাদেশ সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদের মধ্যে ছিলেন চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান। তাঁর আঁকা ‘দৈত্য ইয়াহিয়া’র ভয়ংকর ছবি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্মরনীয় কর্ম। এ ছবির নামকথা ছিলঃ এই জানোয়ারদের হত্যা করুন। ওরা মানুষ হত্যা করছে। আসুন আমরা জানোয়ার হত্যা করি। এছাড়া তিনি বিভিন্ন পোস্টার তৈরি করেছিলেন। শিল্পী কামরুল হাসান মুজিবনগরে অবস্থানকালে অনেকগুলো ছবি এঁকেছিলেন।
[৩২] এইচ টি ইমাম
বাংলাদেশের সম্পদ বৃদ্ধি করুন/পাকিস্তানি পণ্য বর্জন করুন
৫১x৩৬ সেন্টিমিটার পরিমাপের পোস্টারটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দপ্তরের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়। এই পোস্টারটিতে পাকিস্তানকে সর্বাত্মকভাবে বর্জন করার জন্য বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। ৭ মার্চ থেকে বাংলায় বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে বাংলার মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগ দেয়। এরপর পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ বাঙালির অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর হাতে চলে আসে। এই সময় বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করার জন্য পাকিস্তানি পণ্য বর্জনের ডাক দেন। এই পোস্টারটিতে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অধিক দামে পূর্ব বাংলায় বিক্রি করত। পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের অর্থসম্পদও পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করত। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন পশ্চিম পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক চাপের মুখে রাখার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি পন্য বর্জন বিজয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল ছিল। কারন পাকিস্তানি পন্য বর্জনের
৩২২
ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের পন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বর্জন করলে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প ও ব্যবসা ক্ষেত্রে মন্দা দেখা দেবে। এর ফলে খোদ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নরপিশাচ ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন হবে এবং পাকিস্তানের প্রশাসনিক শৃংখলার অবনতি হবে। এর ফলে স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত হবে। গোটা বিশ্বেও এই পন্য বর্জন বাঙালির সর্বাত্মক আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই পোস্টারটিতে লাল, কালো ও সাদা রঙের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।
[৫৭৩] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন
বাংলাদেশের স্বীকৃতি
একটি নবীন রাষ্ট্রের জন্য স্বীকৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। স্বীকৃতির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী একটি রাজনৈতিক সম্প্রদায় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জাতিসংঘ পরিবারের সদস্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জন্মলগ্নে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। স্বীকৃতি আদায়ের জন্য মুজিবনগর সরকার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক কূটনৈতিক প্রয়াস চালায়। বিশেষভাবে ভারত সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তৎপরতা অব্যাহত রাখে। এক পর্যায়ে ভারতের সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দল ‘তাৎক্ষণিক’ স্বীকৃতি দানের জন্য জোর আন্দোলন গড়ে তোলে। লোকসভাসহ বিভিন্ন বিধানসভায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের পক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু স্বীকৃতিদানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন ও রাজনীতি প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত। স্বীকৃতিদানের দায় এড়ানোর চেষ্টায় ভারত সরকার বারবার একই কথা বলেছে যে, ‘উপযুক্ত সময়ে’ স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।
ভারত সরকারের বিবেচনা অনুযায়ী বাংলাদেশ ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। যদিও অনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি অর্জনের অনেক পূর্বেই বাংলাদেশ অব্যক্ত স্বীকৃতি লাভ করেছিল।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানের শক্তিশালী কূটনৈতিক তৎপরতার মুখে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশের পক্ষে স্বীকৃতি আদায় সহজসাধ্য ছিলনা। তারপরও বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র দেড় মাসের মধ্যে পরাশক্তি সহ বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল।
[৯৮] মোহাম্মদ সেলিম
ওবায়দুর রহমান সম্পাদিত ‘সোনার বাংলা’র পরিবর্তিত নাম ‘বাংলার কথা’। ১ সেপ্টেম্বর ২য় সংখ্যা থেকে এ পরিবর্তন করা হয় (ঘোষণা অংশ)। এ
৩২৩
সংখ্যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক এএইচএম কামরুজ্জামান ৯হেনা), স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ,গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নাম উল্লেখ করা হয়। এবং বার্তা সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন শহিদুল হক। বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত এর রেজিস্ট্রেশন নং ১১ হয়। পৃষ্ঠাসংখ্যা ৮, কলামসংখ্যা ৪। মূল্য নিদ্ধারণ করা হয় কমপক্ষে ২৫ পয়সা। ১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত দ্বিতীয় সংখ্যার সম্পাদকীয় লেখা হয় ‘মানবিকতা-বাংলাদেশ-রাষ্ট্রপুঞ্জ’ এবং উল্লেখযোগ্য সংবাদ শিরোনামগুলো ছিল ‘পাক প্রশাসন যন্ত্রে পরিবর্তন আসন্ন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নাভিশ্বাস’, ‘রাজশাহীতে মুক্তিবাহিনীর সাফল্য’, ‘বাংলাদেশ মিশন লন্ডনে’, ‘পর্যবেক্ষণ না গণহত্যা?’, ‘সিয়াটোর দরবারেও পাক জঙ্গিশাহী ঠাঁই পেলনা’ ইত্যাদি। এ ছাড়াও প্ত্রিকায় প্রকাশ পেত বিভিন্ন প্রবন্ধ, কবিতা, কবিতা, চিঠিপত্র। ৩য় সংখ্যা থেকে ‘বাংলাদেশের জনগণের মুখপত্র’ হিসেবে ক্যাপশন লেখা হয়। এ সংখ্যার মূল্য মাত্র ১০ পয়সা এবং পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪ রাখা হয়। ৪র্থ সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২৮ অক্টোবর ১৯৭১ এবং এ সংখ্যার মূল্য ১৫ পয়সা ও পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮ হয়। ‘বিশ্ব জনমত উ থান্টের বিলম্বিত উপলব্ধি’ শিরোনামে ছিল এর সম্পাদকীয়। ‘ওঁ শান্তি’ নামে সম্পাদকীয় লেখা হয় ১৫ নভেম্বর ৫ম সংখ্যায়।
[৪৬৮] হাসিনা আহমেদ
বাংলার ডাক (১)
‘বাংলার ডাক’ এর সম্পাদক দীপক রায় চৌধুরী ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক অধ্যাপক ইউসুফ আলী এবং কার্যকরী সম্পাদক দুলাল কুমার ছিলেনপত্রিকার নামের নিচে রক্তাক্ত বাংলার সাপ্তাহিক মুখপত্র লেখা ছিল। কলাম সংখ্যা ২ এবং দাম ২০ পয়সা ছিল। প্রথম প্রকাশ জানা যায়নি। মুজিবনগর থেকে ৫ম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২৪ অক্টোবর ১৯৭১ আর বাংলায় ৬ কার্তিক, রোববার, ১৩৭৮ লেখা দেখা যায়। সংবাদ শিরোনামও,’বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি-চালের মণ ১০০ টাকা, পাট কেউ কিঞ্ছেনা,’ ‘স্বাধীন বাংলাদেশই রাজনৈতিক সমাধানের একমাত্র পথ-আওয়ামী লীগ’, ‘উ থান্টের চিঠি’ ছিল।
[৪৭১] হাসিনা আহমেদ
বাংলার ডাক (২)
সুশীল সেনগুপ্তের সম্পাদনায় ‘বাংলার ডাক’ প্রকাশিত হত। আঙ্গিক তেমন আকর্ষণীয় ছিলনা । এ সাপ্তাহিকীতে সংবাদ পর্যালোচনার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের টুকটাক খবর প্রকাশিত হত।
[১৯] হাসিনা আহমেদ
৩২৪
বাংলার প্রাণ এক মুঠো ধান/ফলানোর আরেক নাম স্বাধীনতা সংগ্রাম৫০x৩৮ সেন্টিমিটার পরিমাপের পোস্টারটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দপ্তরের পক্ষ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। পোস্টার অংকন করেছেন শিল্পী কামরুল হাসান। পোস্টারটি স্বাধীনতা সংগ্রামের বহুমাত্রিকতা বোঝানোর জন্য প্রকাশ করা হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের অর্থ এই নয় যে অস্ত্র হাতে সবাইকে যুদ্ধ করতে হবে। স্বাধীনতা সংগ্রাম অর্থ প্রত্যেকে তার স্ব স্ব অবস্থান থেকে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। বাংলার কৃষককূলকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এই পোস্টার টি প্রকাশ করা হয় এবং পোস্টারটি তৎকালীন পরিস্থিতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়। বাংলার সমস্ত কৃষক স্বাধীনতার জন্য যদি যুদ্ধে চলে আসে তবে দেশের ফসল আর ফলবেনা। এতে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ নানারকম সমস্যার উদ্ভব হবে। ফলে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম তার মূল চেতনা থেকে বিচ্যুত হবে। এই সুযোগে শত্রুপক্ষ বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। এই জন্য বলা হয়েছে বাংলার প্রাণ/একমুঠো ধান/ফলানোর আরেক নাম/স্বাধীনতা সংগ্রাম। এই পোস্টার সেই সময় দিকভ্রান্ত কীইষক কূলকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে সমর্থ হয়েছিল। অনেক কৃষক এই পোস্টারে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে এবং ফসল ফলানোও যে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এই বিষয়ে তাদের আর কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব রইল না। এই পোস্টারটি কৃষকশ্রেনীর প্রতি স্বাধীন বাংলা সরকারের নির্দেশ হিসেবে প্রকাশ করা হয়। পোস্টারটি দু রঙে মুদ্রিত। লাল রং সংগ্রামের প্রতীকস্বরূপ ব্যবহার করা হয়েছে। ।
[৫৭৩] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন
বাংলার বানী
‘বাংলার বাণী’ স্বাধীনতা যুদ্ধকালের একটি অন্যতম সুসম্পাদিত এবং সুচিন্তিত সাপ্তাহিক পত্রিকা। পত্রিকাটির প্রথম ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা জানুয়ারী, ১৯৭০ সালে হাফেজ হাবিবুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল। মুজিবনগরে প্রথম প্রকাশিত হয়১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। ভারতে এর সম্পাদনার দ্বায়িত্ব আমির হোসেন পালন করতেন। পত্রিকাটি মুজিবনগর থেকে আমির হোসেন কর্তৃক বাংলার বাণী প্রেস হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। মূল্য ৩০ পয়সা, পৃষ্ঠা ৮ ছিল। ২১ সেপ্টেম্বর ৪র্থ সংখ্যার শিরোনাম ছিল এরূপ ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মারিয়া বাঙালি কূটনীতিবিদদের আনুগত্য বদল অব্যাহত’। ৫ অক্টোবর ৬ সংখ্যায় এর রাজনৈতিক ভাষ্যের শিরোনাম ছিল ‘কাহার সঙ্গে আপোষ, কিসের আপোষ’। বেশ কয়েকটি সংখ্যায় উপসম্পাদকীয় ‘রাজনৈতিক দিগন্তে’ লিখতেন ‘যাত্রিক’। যাত্রিক এবং আব্দুল গাফফার চৌধুরীর নিয়মিত কলাম ছাড়াও একটি কম্পোজিট স্টোরি ‘পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও বিশ্বরাজনীতি’ ছিল।
৩২৫
২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সংখ্যা বাংলার বাণীতে আব্দুল গাফফার চৌধুরী ‘ঢাকা আমায় ডাকে’ কলামে পাকিস্তানের সামরিক শাসকের অভিপ্রায় বিশ্লেষণ করে লিখেছিলেনঃ
‘দেশ-বিদেশের অনেকেই আশংকা করছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে চরম মার খেয়ে চূড়ান্ত পরাজয়ের মুখে পাকিস্তানের বর্বর জঙ্গিচক্র আকস্মিক ভাবে ভারত আক্রমন করতে পারে এবং এভাবে যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটিয়ে তার আন্তর্জাতিক মুরব্বিদের বাংলাদেশ সমস্যায় হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেবে। ইয়াহিয়া চক্র আশা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রশ্ন বা পাস করে তারা যদি একে পাকিস্তান ও ভারতের বিরোধ বলে প্রতিপন্ন করতে পারে এবং এই বিরোধ মীমাংসা বৃহৎ মুরব্বি রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রগুলোকে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিতে পারে একমাত্র তাহলেই তার বাঁচোয়া।’ এর একটি সংখ্যার সম্পাদকীয় শিরোনাম ছিল ‘ইতিহাস আমাদের অনুকূলে’। পত্রিকাটি স্বাধীনতার দাবীতে অতি সোচ্চার ছিল।
[১৪১,৪৭২] হাসিনা আহমেদ
বাংলার মায়েরা/বাংলার মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা
৭২x৫০ সেন্টিমিটার পরিমাপের এই পোস্টারটি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দপ্তরের পক্ষ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। পোস্টারটির অংকন শিল্পী প্রাণেশ কুমার মন্ডল। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ লক্ষ যোদ্ধার পাশে নারী যোদ্ধারা যে যুদ্ধ করেছে তারই স্বীকৃতি স্বরূপ ও বাংলার সকল নারীকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার জন্য পোস্টারটি প্রকাশ করা হয়। এই পোস্টারটি নারী পুরুষ সকল মুক্তিযোদ্ধা ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে সকল নারী-পুরুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সমর্থ হয়। মুক্তিযুদ্ধে বাংলার মা ও মেয়েরা নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছে, কখনো খাবার দিয়ে, কখনো সেবা দিয়ে, কখনো অস্ত্র কিংবা মুক্তিযোদ্ধাটিকে লুকিয়ে রেখে। তাঁরা জানত ,ধরা পড়লে সম্ভ্রম এমনকি জীবনও যেতে পারে। সেদিকে তাঁরা ভ্রুক্ষেপই করেননি। এমনকি বাংলার অনেক নারী হানাদার কর্তৃক অত্যাচারিত, নিগৃহীত, লাঞ্ছিত হয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে হানাদারদের কোন তথ্য দেননি। তাছাড়া সরাসরি যুদ্ধেও বাংলার অনেক নারী অংশগ্রহন করে। তারামন বিবি, ডা. সিতারার মত খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা তো আছেই। তৎকালীন সময়ে সরকারিভাবে প্রকাশিত এই পোস্টারটি আবহমান কাল ধরে শোষিত নারী সমাজের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের অবদান ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাদের স্বীকার করে নেওয়া হয়। এই পোস্টারটির ছবিতে রাইফেল হাতে এক বাঙালি রমনীর আবক্ষ প্রতিকৃতি। স্বাধীনতার দীপ্ত চেতনায় বলীয়ান এই নারীর চোখে প্রতিরোধের তীব্র আকাঙ্খাওতি নৈপুণ্যের সঙ্গে পোস্টারটিতে তিনটি
৩২৬
রঙের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। সাদা রঙে লেখা ‘বাংলার মায়েরা মেয়েরা ‘ শান্তিপ্রিয় বাংলার মায়ের শাশ্বত রমনীকুল বোঝাতে এখানে সাদা রঙের ব্যবহার করা হয়েছে। ‘সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’ কথাটিতে লালচে রঙ এখানে সংগ্রামের প্রতিভূ। পাকিস্তানি হানাদার আজ পুত্র, কন্যা, শিশু, পিতা, স্বামী সকলকে হত্যা করেছে। শোকাহত নারী এখন সংগ্রামের দীপ্ত চেতনায় মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে এই পোস্টারটি বাংলাদেশসহ বাইরের বিশ্বকে বাংলার মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে এক ভিন্নরূপ ধারণা দেয়।
[৫৭৩] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন
বাংলার মুখ
‘বাংলার মুখ’ একটি সংবাদ নিবন্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং এর সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান আশরাফী ছিলেন। এটি রঞ্জনা প্রকাশনীর পক্ষে সিদ্দিকুর রহমান আশরাফী কর্তৃক পলাশ আর্ট প্রেস মুজিবনগর বাংলাদেশ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। দাম ২৫ পয়সা, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৪-৮, কলাম সংখ্যা ৫, রেজিস্ট্রেশন নং ৫, সচিত্র এবং ঝকঝকে ছাপা ছিল।প্রথম আত্মপ্রকাশ ১৩ আগস্ট, ১৯৭১। বাংলার মুখের ত্রিপুরা ও ভারতের পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগের অফিস ছিল দৈনিক সংবাদ আগরতলা, ত্রিপুরা, ফোনঃ ৬২৮। কোলকাতা অফিসঃ বাংলার মুখ ৩২/এ পাটুয়াটোলা লেন, কোলকাতা ৯ এবং স্থায়ী ঠিকানাঃ বাংলার মুখঃ মুজিবনগর, বাংলাদেশ। পত্রিকাটির ৬ সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ (৩১ ভাদ্র, ১৩৭৮, শুক্রবার)। এ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে ছিল ‘সংগ্রামী নেতৃবৃন্দের প্রতি’। বাংলার মুখের ১০ তম সংখ্যার সংবাদ শিরোনাম ছিলঃ ‘বাংলার স্বাধীনতা অশ্রু আর রক্তে- তাজউদ্দিন’। উল্লেখিত সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীনতা অশ্রু আর রক্ত। এরই বিনিময়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে বাংলার সাড়ে সাত কোটি নর-নারীর স্বাধীনতা সংগ্রাম। কালের গতির সাথে সাথে স্বাধীনতার সোনালী সূর্যের ক্ষণটি নিকটতর হচ্ছে। কিন্তু এর জন্য চাই আরো রক্ত, আরো অশ্রু, আরো আত্মত্যাগ, আরো জীবন কষ্ট।’ পত্রিকাটির ১ম বর্ষ ১৪ সংখ্যাটি মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ সংখ্যা।
[১৭৫, ৪৭৫] হাসিনা আহমেদ
বাংলার হিন্দু/বাংলার খ্রিস্টান/বাংলার মুসলমান/আমরা সবাই বাঙালি
৭১x৪৮.৫০ সেন্টিমিটার পরিমাপের পোস্টারটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতরের পক্ষ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। এই পোস্টারটির অংকনশিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী। এই পোস্টারটিতে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’কে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন
৩২
পাকিস্তানিরা মুক্তিযুদ্ধ হলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের যুদ্ধ বলে অপপ্রচার চালায়। এই হিন্দুরা মূলত ভারতীয়, তারা ভারতের কাছে পূর্ব পাকিস্তানকে তুলে দিতে চায়। এই অপপ্রচারে বাঙালিরা যাতে বিভ্রান্ত হয়ে না পড়ে এবং হিন্দু, খিস্টান, বৌদ্ধ, মুসলমান ধর্ম বিশ্বাসীরা সকলেই বাঙালি এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করে এটাই ছিল এই পোস্টারটি প্রকাশের মূল কারন। এই পোস্টারে একটি বিষয় লক্ষনীয় যে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, মুসলমানের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। এর কারন হিসেবে বলা যায় যে, মুসলমান ছাড়া আর বাকি সবাই সংখ্যালঘু। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় এইসকল সংখ্যালঘু সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত এবং বেদের বিরুদ্ধে অনেক অপপ্রচারও ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ বাংলাদেশ, মুক্তিযোদ্ধা ও বিশ্ব জনমত সংগঠনে এই পোস্টারটি অনন্য ভূমিকা পালন করে। এই পোস্টারটিতে মন্দির, মসজিদ, প্যাগোডা ও গীর্জার স্থাপত্যশৈলীকে মোটিফ হিসেবে শিল্পীর তুলিতে সন্নিবেশিত হয়েছে। পোস্টারটিতে কাল, কমলা ও সাদা রঙের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। মোটিফগুলো কালো রঙের, পিছনের জমিনে কমলা রঙের ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলার হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, মুসলমান এই লেখাগুলোতে সাদা রঙের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। বঙালি শব্দটাতে কমলা ও সাদা রঙ উভয়ের ব্যবহার করা হয়েছে। এই পোস্টারটি একাত্তরের উত্তাল মুক্তিযুদ্ধের সময় সকল বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে।
[৫৭৩] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন
বাংলাদেশ
‘বাংলাদেশ’ নামক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আমিনুল হক বাবুল এবং যুগ্ম সম্পাদক অমল চন্দ্র পাল। পত্রিকার নামের নিচে বন্ধনীতে ইংরেজিতে লেখা হত THE BANGLADESH। এটি আমিনুল হক বাবুল কর্তৃক সম্পাদিত ও অমিয় কুমার ঝুনু কর্তৃক ‘আদর্শ ছাপাখানা’ (বাংলাদেশ) হতে প্রকাশিত ও মুদ্রিত। চার পাতার এই পত্রিকার মূল্য ১৫ পয়সা। ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা শনিবার ১৮ ভাদ্র ১৩৭৮ এবং ইংরেজী ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ প্রকাশিত হয়। এ সংখ্যার সম্পাদকিয় শিরোনাম ছিলো ‘গোলটেবিলে নয়-রণাঙ্গনেই সমাধান’।
[৪৬৬] হাসিনা আহমেদ
বাঙালি
বাঙালি বলতে আমরা সাধারণত যাঁদের মাতৃভাষা বাংলা, তাদের বুঝি। বাংলা ভাষায় শুধু যে বাংলাদেশের জনগণ কথা বলে তা নয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে এই বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চল। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর গঙ্গাঋদি থেকে
৩২৮
বাংলাদেশ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ”হিমালয়ের দক্ষিণ ও বঙ্গোপসাগরের উত্তরে যে ভূখন্ডটি রয়েছে সেখানে যারা বাস করেন বা করবেন ইতিহাস-ভূগোলে তাদের বাঙালি বলেই চিহ্নিত করা হবে। এই ভৌগোলিক সীমার বাইরেও ভারতে কিছু এলাকায় এমনকি সারা বিশ্বে বাঙালি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের বাঙালিরা বাংলাদেশী এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা ভারতীয় পরিচয়ে পরিচিত হলেও বহির্বিশ্বে বাঙালির জাতিগত পরিচয় বাঙালি নামেই।”
আমাদের বাঙালির পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। পন্ডিতদের মতে, চতুর্দশ শতক থেকে এই পরিচয় শুরু হয়েছে। তখন এই পরিচয় ছিল দেশ বা অঞ্চলগত। আমরা নিজেদের বাঙালি বলার বহু আগে থেকেই বিদেশী বণিক সওদাগর আমাদের বাঙালি বলে চিহ্নিত করেছেন।
বাঙালির আবাসভূমি বলতে প্রাচীনকালে কোন একক রাষ্ট্র ছিলনা। বিভিন্ন জনপদে বিভক্ত ছিল। যেমন-গৌড়, বঙ্গ, সমতট, রাঢ়, বরেন্দ্র, পুন্ড্র ইত্যাদি। এই জনপদগুলো ওই অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর নামানুসারে পরিচিত ছিল। এগুলোর ভৌগোলিক সীমারেখা বিভিন্নযুগে ক্ষমতার হ্রাস বৃদ্ধির কারনে বিভিন্ন হয়েছে।
জাতি হিসেবে বাঙালি কত প্রাচীন? এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের প্রাগৈতিহাসিক যুগে যেতে হবে। বিশেষজ্ঞ পন্ডিতদের মতে, প্লাইস্টোসিন যুগে (১০ থেকে ২৫ লক্ষ বছর পূর্বে) এখানে মানুষের বসতি ছিল। যদিও প্লাইস্টোসিন যুগের কোন নরকঙ্কাল পাওয়া যায়নি, তবে সে যুগের মানুষের তৈরি এবং ব্যবহৃত পাথরের হাতিয়ার পাওয়া গেছে, যা দিয়ে তারা পশু শিকার করত। বাঙালি জাতি গঠন প্রক্রিয়া এদেশে নেগ্রিটোজের আসার সময় (প্লেইসটোসিল যুগে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চল থেকে এসেছিল) থেকেই শুরু হয়। এরপর দিনে দিনে অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, আলপাইন, আর্য ও মঙ্গোলীয়দের আগমনের কারনে তা জোরালো হয়েছে। বলা যায়, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকের গুপ্তযুগে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় আর্য আগমন বেড়ে যায় এবং উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলে আর্যরা প্রথম বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীকালে রাঢ় এলাকা, বাংলার দক্ষিণ ও পূর্বভাগে তা বৃদ্ধি পায়। এদিকে উপমহাদেশে আসার পর আলপেনিয়নদের একটি দল উড়িষ্যা ও বাংলা পর্যন্ত এসেছিল বলে জানা যায়। এভাবে দেখা যায় কালের যাত্রাপথে নেগ্রিটো, আদি অস্ট্রেলীয়, আলপেনিয়ান একসাথে বাস করতে করতে এক সময় মিলেমিশে এক হয়ে যায়। খ্রিস্টীয় সপ্তম অষ্টম শতকের দিকে এই মিশ্রণ একটি নির্দিষ্ট অবয়ব লাভ করে। প্রাচীন বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা হিসেবে আমরা শশাংক কে (আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টাব্দ) পাই। যাকে অনার্য উৎসের মানুষ হিসেবে অনেকেই বিবেচনা করেন। এরপর ক্ষমতায় আসেন পাল রাজারা, যারা বাংলায় ৪ শত বছর ক্ষমতায় ছিলেন। পালদের পর দক্ষিণ ভারত থেকে আসেন সেনরা।
৩২৯
সেন রাজাদের সময় দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে বাংলার যোহাযোগ ছিল। সেন রাজা লক্ষণ সেনের সময় ১২০৪ এ ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মাদ বখতিয়ার খলজী এখানে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ত্রয়োদশ শতক থেকে এখানে ইরানি, তুর্কি, আফগান, ও অন্যান্য মুসলিম জনগোষ্ঠীর আগমন বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে মিশ্রণ প্রক্রিয়া চলতে থাকে। সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ প্রথম বাঙলা ভাষাভাষি অঞ্চল একত্রিত করে নিজে শাহ-ই-বাঙ্গালাহ উপাশি ধারণ করেন। তাঁর সময়ই এ অঞ্চল বাঙ্গালাহ (পরবর্তীকালে বঙ্গদেশ) এবং তার অধিবাসীরা বাঙালি নামে পরিচিতি লাভ করে। বাংলা প্রায় ২০০ বছর স্বাধীন সুলতানদের অধীনে থাকার পর মোঘল সম্রাট আকবরের সময় দিল্লির নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সুবাহ বা প্রদেশে পরিণত হয়। তখন থেকে এর নাম হয় সুবাহ বাংলা বা বাংলা প্রদেশ।
সুলতানি ও মোঘল আমলে পাঠান ও মধ্য এশীয় সৈনিকরা বাংলায় বিপুল সংখ্যায় এসেছিল। যথারীতি তারাও এদেশের জনসমাজে মিশে গেছে। এই সময় সেনাদলে হাবসি সৈন্যদের উপস্থিতি ছিল (এরা আফ্রিকান উৎসের মানুষ, ইথিওপিয়া সহ আফ্রিকার নানা অংশ থেকে দাস হিসেবে এদের পূর্বপুরুষরা এসেছিল) এদের সঙ্গেও এই জনসমাজের মিশ্রণ ঘটে। পরবর্তীতে আসে পর্তুগীজ ও ইংরেজসহ অন্যান্য ইউরোপীয় জাতি। এদের সঙ্গেও স্থানীয় মানুষের মিশ্রণ ঘটা ছিল স্বাভাবিক। এভাবে বাঙালি নামের একটি শংকর জাতির সৃষ্ঠি হয়। এটা হল বাঙালির ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। এছাড়া আরেকটি বিশ্লেষণ আছে তা হল ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। বাংলাভাষার অন্তর্ভুক্ত আলোচ্য গোষ্ঠীর লোকদের ভাষার শব্দসমূহের প্রাচুর্য তার সাক্ষ্য বহন করে।
বাঙালিরা দেখতে কেমন? এক কথায় এর উত্তর দেয়া মুশকিল। শংকর জাতি হবার কারণে বাঙালির শারীরিক বৈশিষ্ট্যেয় রয়েছে নানা বৈচিত্র্য। বাঙালিরা উচ্চতায় নার্ডিকদের মত সবসময় হয়না। তবে ইউরোপীয় বৈশিষ্ট্যের বাঙালি মোটেও বিরল নয়। নিগ্রোয়েডদের মত মোটা ঠোঁট, থ্যাবড়া নাক, কৃষ্ণবর্ণ কোঁকড়ানো চুলও বাঙালিদের মধ্যে দেখা যায়। অস্ট্রেলিয়ার বৈশিষ্ঠ্যের তরঙ্গায়িত চুল, মঙ্গোলায়েড বৈশিষ্ট্যের সরল চুল ও সমতল মুখও বাঙালি জাতিতে রয়েছে। তবে সাধারণত বাঙালিরা মাঝারি গড়নের হয়ে থাকে। এদের অধিকাংশের গায়ের রঙ কালো কুচকুচেও নয়, আবার সাদা ধবধবেও নয়- শ্যামলা। এদের নাক মাঝারি ধরনের।
বাঙালিকে স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার জন্য দীর্ঘ সময় পাড়ি দিতে হয়েছে। বাঙালির ইতিহাস একটা রূপ নিয়েছে ১৯৪৭-১৯৭১ এর মধ্যে। এ সময় বাঙালি জাতিকে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছিল তার ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। এই জাতিসত্তার সূচনা ১৯৫২ তে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভাষাপ্রীতি, আত্মত্যাগ ও জাতিগত ঐক্যবোধের মধ্যে দিয়ে।
৩৩০
১৯৫২ তে যার সূচনা ১৯৭১ এ প্রতিষ্ঠা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে নতুন রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে আছে আমাদের জাতিগত পরিচয়।
[৫৩] মঞ্জুমা সেলিম
বিচারের নামে প্রহসন বন্ধ কর, বন্ধ কর
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, এবং বাংলার মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বন্দি করে। এই সময় তাঁকে পশ্চিম পাকিতানের অন্ধ কারাগারে বন্দি রাখা হয়। এরই মধ্যে হানাদার পাকিস্তানি কর্তৃক বিচারের নামে প্রহসন শুরু করা হয়। বাঙালির গণমানুষের নেতা শেখ মুজিবকে মৃত্যুদন্ড দেবার পাঁয়তারা করা হয়। সংগ্রামী বাঙালীরা এর বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। তারা ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে, তাদের শোভাযাত্রা ও সমাবেশে এই শ্লোগানটির ব্যাপক ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। এর ফলে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবীর প্রতি বিদেশীদের ব্যাপক সমর্থন পাওয়া সহজ হয়।
[১৬] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন
বিদেশী সাময়িকীর প্রচ্ছদে ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি ও বাংলাদেশে যেমন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, তেমনি হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তার এদেশীয় রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের নির্মন অত্যাচার, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুন্ঠন, ধর্ষণ বিশ্বমানবতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলে। বাঙালির ন্যায্য দাবি আদায়ের যুদ্ধকে পাকিস্তান ও তার সহযোগী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি আরবসহ অন্যান্য আরব দেশ বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রচার করতে থাকে। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে তারা কতিপয় বিচ্ছিন্নতাবাদী ভারতপন্থী হিন্দুদের কার্যক্রম ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ গন্ডগোল বলে প্রচার প্রচারণা চালাতে থাকে। এই প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ বাঙালিরা গোপনে দেশের অভ্যন্তরে এবং বিদেশের মাটিতে পাকিস্তানিদের নির্মমতা ও রণাঙ্গনা মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের চিত্র তুলে ধরে বিভিন্ন পত্র পত্রিকা প্রকাশ করতে থাকে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে। সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী , রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী, মানবাধিকার কর্মী, শিল্পী সাহিত্যিক, সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন রাষ্ট্র এটাকে অন্যায় ও মানবতার বিপর্যয় এবং বাঙালির ন্যায্য অধিকার হরণ বলে অভিহিত করে প্রতিবাদে সোচ্ছার হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তি ও সংস্থার বভিন্ন প্রচারমাধ্যমে
৩৩১
বাংলাদেশের নির্মম গণহত্যা বর্বর পাকিস্তানিদের অত্যাচারের চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে। একই সঙ্গে প্রাণভয়ে ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহনকারী এক কোটি বাঙালি অনাহারে, অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপনের চিত্রও বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেউ। তারা স্বাধীন বাংলাদেশকে সমর্থন প্রদানের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, সাফল্যের প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রাখেন। ফলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়। এই সময় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাময়িকী নিউজউইক, টাইম, ডি ইকোনোমিস্ট, ফার ইস্টার্ণ ইকনোমিক রিভিউ-এর বিভিন্ন সংখ্যার প্রচ্ছদে ছবিসহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই ঘোটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্য স্বাধীনতা ঘোষিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও তার মুজিবনগর সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া সহজতর হয়।
নিউজউইকঃ ৫ এপ্রিল ১৯৭১ সালে এই সাময়িকীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রচ্ছদ ছাপা হয়। এই দিনের সাময়িকীর পুরোটা জুড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ছাপা হয়। প্রচ্ছদের ওপরের অংশে Civil War in Pakistan লেখা রয়েছে। ছবির বামদিকের অংশে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের মানচিত্র সংবলিত আমাদের জাতীয় পতাকার ছবি এবং ছবির নিচের অংশে Sheikh Mujibur Rahman লেখা ছিল। এই দিনের সাময়িকীতে বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রকাশ হওয়াতে বাংলাদেশের গণমানুষের নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক হিসেবে শেখ মুজিব আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেন।
২৫ মার্চ নির্মম গণহত্যার পরই একটি আন্তর্জাতিক বিদেশী সাময়িকীর প্রচ্ছদে বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ায় বাংলাদেশের বিষয়টি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রচ্ছদের উপরের অংশে Civil War in Pakistan লেখা আছে। এর ব্যাখ্যা হিসেবে বলা যায়, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বাঙালি হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিসংগ্রাম করছে কিন্তু তখনো মুজিবনগর সরকার গঠিত না হওয়াতে পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে এই সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান হওয়াতে প্রচ্ছদের ছবিতে তাঁকে নির্বাচিত করা হয়েছে। ‘নিউজউইক’এর ‘৭১ এর ২ আগস্ট সংখ্যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ প্রকাশ করা হয়। প্রচ্ছদের বিষয় বস্তুও ছিল বাংলাদেশ। এই সংখ্যার পুর প্রচ্ছদজুড়ে খোলা মাঠের মধ্যে পিতামাতা হারা, গৃহহীন, বস্ত্রহীন, ক্ষুধার্ত বাঙালী অবোধ শিশু জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে বসে থাকার ছবি ছাপা হয়। শিশুটির পাশে লেখা আছে Bengal অর্থাৎ এটি বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র, সেই বিষয়টি বোঝানো হয়েছে। প্রচ্ছদের নিচের অংশে লেখা আছে THE MURDER OF A PEOPLE. এই কথাটির মাধ্যমে বাংলাদেশের হানাদার পাকিস্তানিরা
৩৩২
যে নির্মম গণহত্যা ও শিশুহত্যা চালাচ্ছে সেই বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। নির্দয় পাকিস্তানিরা শিশুটির পিরামাতাকে হত্যা করেও ক্ষান্ত হয়নি, এখন তাকে হত্যা করতে এসেছে। সেই কারণে অবোধ শিশুটি অবাক ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। পাকিস্তানিদের হাতে মরনাস্ত্র দেখে জিজ্ঞাসু নয়নে বস্তুটি কি তা বোঝার চেষ্টা করছে। ‘নিউজউইক’ এর প্রচ্ছদে প্রকাশিত শিশুটির এই ছবি বিশ্বমানবতাকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল।
‘নিউজউইক’ এর এই প্রচ্ছদটি তৎকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। এর ফলে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আরো সহানুভূতিশীল হয়। ‘নিউজউইক’ এর ৬ ডিসেম্বর ‘৭১ সংখ্যাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই দিনের সংখ্যার প্রচ্ছদে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছবি ছাপানো হয়। এই দিনের প্রচ্ছদে ‘৭১ এর বাংলাদেশের ভিন্নতর চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় বাঙালি যেমন পাকিস্তানিদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিল, তেমনি এই বর্বরতার বিরুদ্ধে বীরের মত প্রতিবাদও করেছে। প্রচ্ছদের ছবিতে বাংলার বীর দামাল ছেলেদের নিয়ে যে গেরিলা বাহিনী গঠিত হয়েছিল সেই বাহিনীর দুজন সদস্যের ছবি প্রকাশ করা হয়। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পোষাক, লুঙ্গি ও শার্ট পরা দুজন গেরিলা , তাদের একজনের হাতে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় অস্ত্র স্টেনগান এবং অন্যজনের হাতে বন্দুক। প্রচ্ছদের ছবির উপরের অংশের ডানদিকে ক্রসাকারে লেখা আছে INDIA ATTACKS, নিচের লাইনে লেখা আছে The Battle for Bengal। ছবিটির বামদিকের নিচের অংশে Bangla Desh নিচের লাইনে Guerilla লেখা আছে। ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতীয় ভূখন্ডে বোমা নিক্ষেপ করলে ভারত পরের দিন ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহন করে। এই কারনে ৬ ডিসেম্বর এই সংখ্যাতে বাংলাদেশের যুদ্ধের পক্ষে ভারতের আক্রমণ শিরোনামে প্রচ্ছদ প্রকাশিত হয়। ছবিতে বাংলাদেশের গেরিলার ছবি অংকিত হবার মূল কারণ হলো এই সময় পাকুস্তান ও পাকিস্তানপন্থীরা এই যুদ্ধকে ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ বলে প্রচার করতে থাকে। এই প্রচ্ছদটি তাদের এই প্রচারণার বিরুদ্ধে দাঁতভাঙা জবাব। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণমানুষের অংশগ্রহনে একটি জন্মযুদ্ধ, ভারত এই যুদ্ধে একটি সহযোগী শক্তি হিসেবে মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল। এই কারণে যুদ্ধশেষে অল্প দিনের মধ্যে তারা নিজ দেশে ফিরে যায়। আন্তর্জাতিক একটি স্বনামধন্য সাময়িকীর প্রচ্ছদে বাংলাদেশের গেরিলার ছবি প্রকাশিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব ও গ্রহনযোগ্যতা অনেক বেড়ে যায় এবং বাংলাদেশের স্বীকৃতি অর্জন সহজতর হয়।
৩৩৩
‘টাইম ম্যাগাজিন’
২ আগস্ট ১৯৭১ সালে প্রকাশিত ‘টাইম ম্যাগাজিন’এর সংখ্যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই দিনের প্রচ্ছদও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভিত্তি করে ছাপানো হয়। প্রচ্ছদে অনাহারক্লিষ্ট, ক্ষুধার্ত, হাড়জিরজিরে একটি শিশুকে কোলে নিয়ে একজন দিশাহারা পিতার ছবি ছাপানো হয়। প্রচ্ছদের বিষয় হিসেবে PAKISTAN’S AGONY উল্লেখিত হয়েছে। AGONY এর আভিধানিক অর্থ তীব্র যন্ত্রণা, মর্মবেদনা, সন্তাপ অর্থাৎ পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের তীব্র যন্ত্রণার চিত্র এই প্রচ্ছদে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। হানাদার পাকিস্তানিদের আক্রমনে সন্ত্রস্ত ঘরবাড়ি, ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে বেড়ানো একজন দিশাহারা পিতা তার প্রাণপ্রিয় আডোড়েড় ক্ষুধার্ত সন্তানের মুখে একটু আহারের ব্যবস্থা করতে না পারার তীব্র যন্ত্রণার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যদিও সে নিজে অনাহারে রয়েছে তবুও তার শিশু সন্তানটিকে কোলে জড়িয়ে ধরে তার নিজের সন্তাপ ভোলার চেষ্টা করছে। একজন পিতার এর চেয়ে মর্মবেদনা আর কি থাকতে পারে। এই প্রচ্ছদটিতে হিংস্র পশুর মত নির্দয় পাকিস্তানিদের নির্মমতার, নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
বর্বর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় লাভের পর৭১ এর ২০ ডিসেম্বরে প্রকাশিত ‘টাইম ম্যাগাজিন’এর সংখ্যাতে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই দিনের সংখ্যার প্রচ্ছদের ছবিতে স্টেনগান হাতে বিজয়ের আনন্দে উল্লসিত একজন মুক্তিযোদ্ধার ছবি। ছবিতির উপরের অংশে The Bloody Birth of Bangladesh লেখা রয়েছে। এই প্রচ্ছদটি ৩০ লক্ষ তাজা প্রাণের রক্তের বিনিময়ে যে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে তারই প্রমাণ বহন করে। এই প্রচ্ছদটি একদিকে বাংলাদেশের জন্মের আনন্দবার্তা বহন করে, পাশাপাশি কত জানা অজানা শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে বর্মান সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলসমূহ ‘বাংলাদেশে কোন মুক্তিযুদ্ধ হয়নি’ বা কোন রক্তপাত ঘটেনি তাদের এই মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে এই প্রচ্ছদটিকে একটি প্রামাণিক তথ্য হিসেবে উপস্থাপিত করা যায়।
‘দ্য ইকোনোমিস্ট’
১৯৭১ সালের ১২-১৮ জুন তারিখে প্রকাশিত ‘দ্য ইকোনোমিস্ট’ সাময়িকীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিষয়বস্তু করে প্রচ্ছদ ছাপা হয় ও সংবাদ প্রকাশিত হয়। হানাদার পাকিস্তানিদের আক্রমণে প্রাণভয়ে প্রায় এক কোটি নারীপুরুষ , শিশুবৃদ্ধ ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহন করেছিল। এদের মধ্যে আশ্রয় গ্রহনকারী শিশুদের নিদারুন দুঃখ বেদনা ও কষ্টের একটি চিত্র এই সংখ্যার প্রচ্ছদে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রচ্ছদের ছবিতে বস্ত্রহীন, অনাহারক্লিষ্ট, কঙ্কালসার একটি শিশু খাদ্যের আশায় একখানি খালি বাটি হাতে নিয়ে সামনে রাস্তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে। তার এই অপেক্ষা ক্ষুধা নিবারনের জন্য সামান্য খাদ্যের আশায়। মুক্তিযুদ্ধ
৩৩৪
চলাকালীন ভারতে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহনকারীরা অনাহারে, অর্ধাহারে মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকে। এদের মধ্যে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, বস্ত্র, আশ্রয় ও চিকিৎসার অভাবে শিশুরা অপুষ্টিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতপ্রায় অবস্থায় কোনরকম বেঁচে আছে। ছবিটির শিশুটি এদেরই একজন। এই শিশুটির পরিচয় তুলে ধরার জন্য ছবিটির পাশে লেখা রয়েছে Child of a day । এটা ছিল মূলত মানবতার এক নির্মম বিপর্যয়।
”ফার ইস্টার্ণ ইকোনোমিক রিভিউ’
৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ প্রকাশিত সংখ্যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যার প্রচ্ছদে এই সময়কালীন বাংলাদেশের বিষয়বস্তুকে উপজীব্য করে ছবি প্রকাশিত হয়। প্রচ্ছদের ছবিতে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বসে আছেন। তিনি দৃপ্ত চেতনায় সম্মুখ দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর পাশে তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ। তিনি মাথাটি ঘুরিয়ে পিছনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। এই দুই নেতার ছবির পেছনের দৃশ্যে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন সদস্য দাঁড়িয়ে আছে ও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্পের ছবি দেখা যাছে। ছবিটির নিচের অংশে Bangladesh পরের লাইনে NO LOOKING BACK লেখা রয়েছে। সাময়িকীটির এই সংখ্যা যখন প্রকাশিত হয় তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্যপটের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। ইতিমধ্যে ভারত তার সেনাবাহিনী নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সাথে মিত্রবাহিনী গড়ে তুলে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। দীর্ঘ নয় মাসের দুঃসাহসিক যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত। বাংলাদেশের জয় তখন সময়ের ব্যাপারমাত্র।
মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন
বিপ্লবী বাংলাদেশ
‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ সাপ্তাহিক মুখপত্রের সম্পাদক ছিলেন নুরুল আলম ফরিদ। পত্রিকাটি বরিশাল, বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়। সহ সম্পাদক সন্তোষ কুমার চৌধুরী, বার্তা সম্পাদক মিঠু বসু, রণাঙ্গন প্রতিনিধি ফরিদুল ইসলাম এবং আলোকচিত্র প্রতিনিধি মহ. তৌফিক ইমাম ছিলেন। পত্রিকাটির কর্মাধ্যাক্ষ মুহাম্মদ ইউসুফ নাহিদ কর্তৃক চাঁপা প্রেস বাংলাদেশ থেকে মুদ্রিত ও রফিক হায়দার রবিন কর্তৃক প্রকাশিত ছিল। ৩য় সংখ্যা ২৯ আগস্ট, ১৯৭১ থেকে পত্রিকার নামের নিচে ইংরেজিতে Biplabi Bangla Desh লেখা ছাড়াও ‘জনগণের নির্ভীক কন্ঠস্বর’-এ তিনটি শব্দ পত্রিকার নামের উপর লেখা হত। প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা ৪ আগস্ট, ১৯৭১ প্রকাশিত হয় এবং এর মোট প্রকাশ সংখ্যা ১৯ ছিল। ১৯ তম সংখ্যাটি প্রকাশ পায় ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, রোববার। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একই দাম ১৫ পয়সা রাখা
৩৩৫
ছিল। এর সাইজ ট্যাবলয়েড, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪-৬। সচিত্র, ঝকঝকে ছাপা, কলামসংখ্যা ৪-৫। বাংলাদেশ সরকারের রেজিস্ট্রেশন নং ১৯ (৬ষ্ঠ সংখ্যা থেকে)। ৫ম সংখ্যা থেকে পত্রিকার উপরে শ্লোগান/নির্দেশাবলী ও প্রথম পৃষ্ঠার নিচে একটি করে আবেদন থাকত যেমন, বাংলাদেশকে জানতে হলে ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ পড়ুন। ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ আপনি পড়ুন এবং অন্যকে পড়তে দিন। ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ মুক্তিসংগ্রামীদের মুখপত্র। ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পাশেই রয়েছে। ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ ন্যায় ও সত্যের সংগ্রামে অবিচল ইত্যাদি ছিল। প্রধান কার্যালয়, সদর রোড বরিশাল, বাংলাদেশ। ভারতীয় প্রধান কার্যালয়, বিপ্লবী বাংলাদেশ, হাসনাবাদ চব্বিশ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ কার্যালয় ২২/২৬ মনোশ্বর পুকুর রোড, কলি ২৯, ফোন ৪৭-৯১৪৯ লেখা হত। এ পত্রিকাটিতে যুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে বেশ কিছু প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রকাশিত হয়প্রথম সংখ্যায় ‘বিশ্ব বিবেকের কাছে আবেদন’ ও ১৯ তম সংখ্যায় ‘একটি প্রস্তাব ভুট্টোর নয়া খেলা’ শিরোনামে সম্পাদকীয় ছিল। ২৯ আগস্ট প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে লিখেছে ‘মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর যতই দিন যাচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের জয় ততই সুনিশ্চিত হয়ে উঠছে। দিকে দিকে গড়ে উঠেছে আঞ্চলিক প্রতিরোধ বাহিনী, গেরিলাযুদ্ধ জোরদার হচ্ছে, পাক সৈন্য খতম হচ্ছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে মুক্তাঞ্চল।’ ৭ নভেম্বর সংখ্যায় একটি শিরোনামে যুদ্ধের সংবাদ পরিবেশন করে ‘উঠেছে অমৃত, দেরি নেই আর, উঠিয়াছে হলাহল, থামিসনে তোরা চালা মন্থন।’ পত্রিকাটির প্রবাস সংখ্যা শুরু হয়েছিল ৪ আগস্ট এবং শেষ সংখ্যা বের হয় ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। পরবর্তীতে ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ সাপ্তাহিক হিসেবে ২১ বছর বের হবার পর ১৯৯১ সালের ৯ জুলাই পত্রিকাটি সাপ্তাহিক থেকে দৈনিকে পরিণত হয়।
[৬৫] হাসিনা আহমেদ
বিবিসি
গণমাধ্যমের অনেকগুলো মাধ্যমের অন্যতম একটি হচ্ছে রেডিও। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ প্রচারে রেডিও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। তার মধ্যে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’, ‘আকাশবানী’, ‘বিবিসি’, ‘ভয়েস অফ আমেরিকা’ তথ্যবহুল, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সরবরাহ করে জনপ্রিয়তা পায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন বা বিবিসির বাংলা বিভাগ নিরপেক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের খবর ও তথ্য পরিবেশন করত। বিবিসির মাধ্যমে স্বাধীনতাকামী মানুষ মুজিবনগর সরকার, শরণার্থী, মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধের নানা খবর জানতে পারত। এ সমস্ত খবর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের অনুপ্রেরণা যোগাত। পাশাপাশি বিবিসি জনমত গঠনেও সাহায্য করেছে।
সে সময় বিবিসির বাংলাদেশ বিষয়ক সংবাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য
৩৩৬
শিরোনাম গুলো হলো-বিশ্ব সংবাদ, সাম্প্রতিক ঘটনাবলী, এশিয়া বিষয়ক আলোচনা, এবং সাপ্তাহিক সংবাদ পরিক্রমা। ২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনীর আক্রমনের পূর্বে ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশী সাংবাদিকদের বাধ্যতামূলক একটি বিশেষ বিমানে করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে যুদ্ধের প্রথম দিকে বিবিসিকে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের দেওয়া তথ্যের উপর নির্ভর করতে হত। একপর্যায়ে বিদেশী সাংবাদিকদের সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তান সফরের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। তখন বিবিসির অনুষ্ঠান সম্পাদক মার্ক টালি পূর্ব পাকিস্তান আসেন। তিনি প্রায় একমাস থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশের বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প, পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ সহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখেন। সে সময় তিনি পাক সামরিক বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ, নিরস্ত্র বাঙালির উপর নির্যাতন, গণহত্যা, শরণার্থী, মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেন, যা বাংলা ভাষাভাষি স্বাধীনতাকামী মানুষকে প্রেরণা যোগায়।
‘৭১ এ বিবিসির প্রচারিত সংবাদের সব সময়ই মাধ্যম বা সংবাদপ্রাপ্তির উৎসকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধারা তাই ভিড় করে বিবিসি প্রচারিতসংবাদের জন্য অপেক্ষা করত। খবরের জন্য তারা পাকিবাহিনী ও রাজাকারদের ভয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে বা খাটের নিচে লুকিয়ে, লেপ মুড়ি দিয়ে নানাভাবে সংবাদ শুনত। যে কারণে বাংলাদেশের একটি বাজারের নাম হয়ে যায় বিবিসি বাজার।
[১৭৩] দিলরুবা বেগম
বিশ্ব শান্তি পরিষদ
মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্হন জানিয়ে যেসব আন্তর্জাতিক সংগঠন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল তাদের মধ্যে বিশ্ব শান্তি পরিষদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে গণহত্যার শুরু থেকেই হেলসিংকিতে অবস্থিত বিশ্ব শান্তি পরিষদের সদর দপ্তর সংগ্রামী বাঙালির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। তৎকালীন মুখ্য নির্বাহী মহাসচিব রমেশচন্দ্র সরাসরি জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে প্রেরিত এক তারবার্তায় অবিলম্বে জাতিসংঘ কর্তৃক পদক্ষেপ গ্রহনের আবেদন জানান। এপ্রিল মে মাসে বুদাপেস্টে আয়োজিত বিশ্ব শান্তি পরিষদের বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে মুক্তিযুদ্ধকে ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম’ হিসেবে অভিহিত করে তার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা হয়। এই অধিবেশনে আব্দুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল অংশগ্রহন করে। সম্মেলনে অংশগ্রহনকারী দেশ সমূহের প্রতিনিধি বৃন্দ এক যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মম হত্যাকান্ডের নিন্দা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণের সঙ্গে সহতি প্রকাশ করেন।
জুলাই মাসে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের
৩৩৭
সঙ্গে বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশচন্দ্রের দীর্ঘ বৈঠক ও মতবিনিময় হয়। এই বৈঠকের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আশু মুক্তির জনয বিশ্ব শান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হয়। এই সময় হেলসিংকি থেকে বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি স্বেতপত্র একই সাথে ৭ টি ভাষায় প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশ্ব শান্তি পরিষদের মাধ্যমে সংগৃহীত ওষুধ, রক্ত ও বিভিন্ন সাহায্য সামগ্রী বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের প্রধান আলী আকসাদের মাধ্যমে যথাস্থানে পৌঁছানো হত।
বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হবার পর বিশ্ব শান্তি পরিষদ যে পুণর্গঠনমূলক কর্মসূচী গ্রহন করে তার লক্ষ্য ছিলঃ ১.বঙ্গবন্ধুর আশু মুক্তি দাবি ২.বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক স্বীকৃতি আদায় করা ৩.যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও ছিন্নমূল বাঙালির জন্য ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ এবং গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। উল্লেখ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহ জাতীয় শান্তি কমিটি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার দ্বায়িত্ব নেয়।
[১২৬] এইচ টি ইমাম
বৈদেশিক মিশনসমূহ
বিদেশে অবস্থানরত তৎকালীন পাকিস্তানের বৈদেশিক কূটনৈতিক মিশনের বাঙালি অফিসার ও কর্মচারীগণের তাৎক্ষণিক সমর্থন ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। সেদিন তাঁরা শুধু এমনি সমর্থনই জানাননি, সদ্য ঘোষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমর্থনে এবং যুদ্ধরত বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণে তাঁদের অবদান ছিল অপরিসীম। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতার সমর্থক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মুক্তিযুদ্ধের ইউনিটগুলো, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও মুজিবনগর থেকে প্রচারিত যুদ্ধকালীন পত্রপত্রিকা এবং দেশ প্রেম্মিক ছাত্র শিক্ষক জনতার পাশে তাঁদের নামও লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে।
দিল্লীর দূতাবাস
৬ এপ্রিল ‘৭১ মধ্যরাতের কিছু পরদিল্লির পাকিস্তানি হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারী জনাব কে এম শাহাবুদ্দিন এবং প্রেস অ্যাটাসে জনাব আমজাদুল হক পাকিস্তান দূতাবাসের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন এবং দূতাবাস ভবন ত্যাগ করেন। নয়াদিল্লি তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের মিশন খোলা হলে জনাব শাহাবুদ্দিন এই মিশনের প্রধান এবং জনাব হক এর প্রেস অ্যাটাসে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
৩৩৮
উল্লেখ্য যে, মুজিবনগরে অস্থায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল ১০ এপ্রিল ‘৭১ এবং এই নতুন সরকার দেশী বিদেশী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল্কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে ১৭ এপ্রিল ‘৭১। কাজেই আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠিত হবার আগেই ৬ এপ্রিল ‘৭১ দিল্লির পাকিস্তান দূতাবাসের উক্ত দুজন বাঙালি কূটনীতিক কর্তৃক সদ্য ঘোষিত বাংলাদেশের প্রতি তাৎক্ষণিক আনুগত্য প্রকাশ ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যবাহী। স্পষ্ঠতই পাকিস্তানের অন্যান্য বৈদেশিক মিশনের বাঙালি সদস্যগণকেও এমনি তাৎক্ষণিকভাবে এগিয়ে আসার জন্য তাঁরা উৎসাহ দানে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছেন।
কলকাতা বাংলাদেশ মিশন
কলকাতার ৯ নং সার্কাস এভিনিউতে ছিল পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশন ভবন। ১৮ এপ্রিল রোববার বেলা ১২ টা ৪১ মিনিটে রাষ্ট্র বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পতাকা উত্তোলনের দুঃসাহস করেছিলেন উক্ত মিশনের তৎকালীন ডেপুটি হাইকমিশনার জনাব হোসেন আলী ও তাঁর বাঙালি সহকর্মীবৃন্দ। ১৮ এপ্রিল ‘৭১ নবরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি কলকাতা মিশনের যাঁরা আনুগত্য ঘোষণা করেছিলেন তাঁরা ছিলেন সর্ব জনাব এম হোসেন আলী, (ডেপুটি হাইকমিশনার), রফিকুল ইসলাম চৌধুরী (ফার্স্ট সেক্রেটারী), আনোয়ারুল করিম চৌধুরী (থার্ড সেজ্রেটারী), এম মোকসেদ আলী, (অ্যাসিসট্যান্ট প্রেস অ্যাটাসদে), সায়িদুর রহমান, এমএ হাকিম, আমীর আলী চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ সায়েদুজ্জামান মিয়া, জয়নাল আবেদীন চৌধুরী, মোসতাফিজুর রহমান, আলিমুজ্জামান, এজেডএমএ কাদির, মতিউর রহমান, কাজী সেকান্দার আলী, মোহাম্মদ গোলাম রহমান, শামসুল আলম, মোহাম্মদ সিদ্দিকউল্লাহ, একেএম আবু সুফিয়ান, আব্দুর রব, মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, মোহাম্মদ আমিনুল্লাহ, মোহাম্মদ আবুল বাশার, এবিএম খুরশীদ আলম, আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া, আব্দুর রহমান ভুঁইয়া, মোহাম্মদ আব্দুর রহিম, মোহাম্মদ নুড়ুল আমীন, নূর আহমদ, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, সমীরউদ্দিন, মোহাম্মদ সোলায়মান, এস শামসুদ্দিন হোসেন, মোহাম্মদ জহুর হোসেন, মীর মোজাম্মেল হক, মোহাম্মদ জাকারিয়া, মোহাম্মদ ওয়াহিদুর রহমান, আব্দুন নূর, একেএম আব্দুর রব, এএনএম কামরুর রশীদ, আনোয়ারুজ্জামান, আব্বাসউদ্দিন আহমদ চৌধুরী, ওয়াহিদুর রহমান, শারফুল আলম, আব্দুল কাদের, আব্দুল মতিন প্রধানিয়া, আব্দুল আমিন, মোহাম্মদ হোসেন, মতিউর রহমান, আব্দুল গফুর মৃধা, আমান হোসেন, হাতেম আলী, বজলুর রহমান, মোহাম্মাদ হেদায়েতুল্লাহ, নূরুল হক, শামসুল আনোয়ার, মোমতাজ মিঞা, হরমুজুল হক, শমু মিঞা, মোহাম্মদ ইলিয়াস ও আব্দুল হাশেম। অন্যান্য মিশন থেকে যাঁরা কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরা
৩৩৯
ছিলেন সর্বজনাব মোহাম্মদ খলিলউদ্দি।, আলী আহমদ খান, এমএ মহীউদ্দিন ও মোহাম্মদ আব্দুল হাই।
বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে বাঙালি উর্ধ্বতন কূটনীতিক বৃন্দের মধ্যে জনাব হোসেন আলীর বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা ছিল এক দুঃসাহসী কাজ। তিনি শুধু কলকাতা বাংলাদেশ মিশনেরই প্রধান ছিলেন না, তিনি পরিণত হয়েছিলেন ৯ মাস ব্যাপী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম প্রেরণার উৎস হিসেবে। তাঁর সুযোগ্য পরিচালনায় কলকাতার বাংলাদেশ মিশন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান দুর্গে পরিণত হয়েছিল। বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের এই মহান সেনানী ২ জানুয়ারি, ১৯৮১ কানাডায় মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কানাডায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে কানাডার অটোয়ায়।
ক্রমে ইরাক, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, বার্মা, জাপান, হংকং প্রভৃতি বিভিন্ন দেশ থেকে বাঙালি কূটনৈতিক কর্মী ও পদস্থ অফিসারগণ বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। নভেম্বর, ৭১ এর শেষ দিকে দিল্লির পাকিস্তানি দূতাবাসের অবশিষ্ট বাঞালি কর্মচারীও দূতাবাস ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি নিউইয়র্কের বিভিন্নামেরিকান সংগঠনের সমর্থন আদায়ের জন্য তাঁরা কাজ করেছেন। এজন্য সেখানে তাঁরা একটি অফিসও খুলেছিলেন।
সর্বজনাব এএমএ এবং এনায়েত করিম ছিলেন্তখন ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের মিনিস্টার এবং জনাব কিবরিয়া ছিলেন কাউন্সিলর। জনাব এসএ করিম ছিলেঞ্জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ি উপপ্রতিনিধি (ডেপুটি পার্মানেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ)। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ প্রান্তে তাঁরাও বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছিলেন। তাঁরা সবাই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছিলেন।
[১১৪] শামসুল হুদা চৌধুরী
৩৪০
ভারতের স্বীকৃতি
[বাংলাদেশকে ৬ ডিসেম্বর স্বীকৃতি প্রদান উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা]
প্রচন্ড প্রতিকূলতার মুখে বাংলাদেশের জনগণের সাহসী সংগ্রাম স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক নতুন বীরত্ব গাঁথা উন্মোচিত করেছে। এর আগে সাধারণ নির্বাচনে তারা বিরাট গণতান্ত্রিক সাফল্য অর্জন করেছিল। এমনকি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানম্নত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। আমরা কখনোই বুঝতে পারিনা, এই সৎ উদ্দেশ্য ভো বাস্তববোধ সত্যিকারে পরিণত করতে কী বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমরা মনে করি পূর্ব পাকিস্তানকে প্রতারণ এবং এর জনগণের প্রতি ঘৃণাই ছিল প্রধানতম দৃষ্টিভঙ্গি।
আমাদের বলা হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পার্টি আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের প্রতিরোধে অহিংস আন্দোলন শুরু করার পরিকল্পনা গ্রহন করেছে। কিন্তু তাদের অজান্তে তাদের উপর পৈশাচিক সামরিক পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে। সুতরাং স্বাধীনতা ঘোষণা করা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় ছিলনা। শুরুতে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের নিয়ে মুক্তি ফৌজ গঠন করা হয়। এবং পরবর্তীতে গড়ে তোলা হয় মুক্তিবাহিনী যেখানে স্বাধীনতা এবনহ ভবিষ্যত গড়ে তোলার লক্ষ্যে জীবন উৎসর্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পূর্ব বাংলার হাজার হাজার তরুন যোগদান করেন। একতা, দৃঢ়তা এবং সাহসের সঙ্গে বাংলাদেশের আপামর জনগণের এই সংগ্রামের কথা বিশ্ব প্রচারমাধ্যম গুলোতেও স্থান পেয়েছে। আমাদের দোরগোড়ার এই ঘটনা এবং এবং যার ফলে শরণার্থীদের বন্যার মত আগমন, আমাদের দেশেও এর প্রতিক্রিয়া না হয়ে পারেনা। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক, আমাদের সহানুভূতি বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতিই রয়েছে। কিন্তু এই সংগ্রামের প্রতি আমাদের স্বীকৃতি আকস্মিক কোন ঘটনা নয়। আমাদের সিদ্ধান্ত কোন আবেগতাড়িত সিদ্ধান্ত নয়। চলমান ঘটনা এবং ভবিষ্যৎ বাস্তবতার বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি।
জনগণের বিদ্রোহ
বাংলাদেশের আপামর জনগণের বিদ্রোহ এবং তাদের সংগ্রামের বিজয়ে এটা ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, তথাকথিত মাতৃভূমি পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সম্পূর্ণ অক্ষম।
গোটা বিশ্ব এখন সম্পূর্ণ অবগত যে, বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা ওই দেশের নিরঙ্কুশ জনগণের ইচ্ছারই প্রতিফলন। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের আইনসিদ্ধ অবস্থান যা বিশ্বে বেশি ন আহলেও অনেক সরকারই দাবি করতে পারেন না। গভর্নর মরিসের প্রতি জেফারসনের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘জাতির
৩৪১
ইচ্ছা’ বাংলাদেশ সরকারের সমর্থনে রয়েছে, যা ইতিমধ্যেই যথেষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এই মানদন্ড প্রয়োগ করে বলা যায়, পাকিস্তানের সামরিক শাসন জনগণের কমই প্রতিনিধিত্ব করছে, এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানেরও জনগণ। যদিও কতিপয় দেশ পাকিস্তানের সামরিক শাসন টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে খুবই উদগ্রীব। এখন পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে। সুতরাং আমাদের দিক থেকে এখন যেকোন স্বাভাবিক ইতস্ততা অর্থাৎ আমাদের দিক থেকে এমন কিছু করা উচিত হবেনা, যা কোন শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছাতে বাধা হয়ে দেখা দেবেওথবা অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ বলে মনে হবে। এ সমস্ত কিছুর গুরুত্বই এখন আর নেই। বাংলাদেশের জনগণের অস্তিত্বের জনয যুদ্ধ এবং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের যুদ্ধ এখন একই কারণে অংশীদারিত্বে নিবেদিত।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি
আমি এই হাউসকে আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে এবং বাংলাদেশ সরকারের পুনঃপৌনিক অনুরোধে সাড়া দিয়ে যথেষ্ট সতর্ক বিবেচনার পরে ভারত সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করল। আমাদের বিশ্বাস ক্লক্রমে আরও অনেক দেশ স্বীকৃতিদান করবে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ শীগগিরই বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি দেশ হিসেবে স্থান করে নেবে।
এই মুহুর্তে আমাদের চিন্তা নতুন এই রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমান কে নিয়ে। আমি নিশ্চিত এই হাউস আমার মাধ্যমে বাংলাদেশের সম্মানিত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং সম্মানিত প্রধানমন্ত্রীকে উষ্ণ অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাতে আগ্রহী।
বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে সমস্ত চিঠিপত্রের কপি আমি এই হাউসে পেশ করলাম। সম্মানিত সদস্যবৃন্দ জেনে আনন্দিত হবেন যেবাংলাদেশ সরকার জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বৈষম্যমুক্ত একটি সস্মতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা সহ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় নীতি ঘোষণা করেছে। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার জোটনিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের কথা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছে এবং উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থানে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে, এই আদর্শগুলির প্রতি ভারত উৎসর্গীকৃত।
শরণার্থী প্রত্যাবর্তন
বাংলাদেশ সরকার আমাদের দেশে সাময়িক আশ্রয় গ্রহনকারী তাদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিতে এবং ব্জমিজমাসহ সমস্ত সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবার মাধ্যমে পুণর্বাসনের আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেছে। সুতরাং এই কাজে স্বাভাবিকভাবেই সবধরনের সহায়তা আমরা করব। আমি এই মর্মে দৃঢ় আস্থা পোষণ করি যে, একই আদর্শ ও উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত দুটি দেশের সরকার ও জনগণ একে অপরের সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় অখন্ডতার প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, একে অপরের অভ্যন্তরীণ
৩৪২
বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, সমতা ও পারস্পরিক সুবিধার নীতির উপর ভিত্তি করে সম্পর্ক গড়ে তুলবে। এভাবে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার সপক্ষে কাজ করে দুটি দেশ সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক স্থাপনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে, যা হবে এই অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও প্রগতির গ্যারান্টি.
বাংলাদেশের প্রতি জানাচ্ছি আমাদের শুভেচ্ছা।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের লোকসভায় প্রধানম্নট্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রধানম্নত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চিঠিঃ
ডিসেম্বর ৬, ১৯৭১
প্রিয় প্রধানম্নত্রী,
সম্মানিত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আপনি ডিসেম্বর ৪ তারিখ যে বার্তা পাঠিয়েছেন তাতে ভারত সরকারে আমার সহকর্মীবৃন্দ এবং আমাকে নাড়া দিয়েছে। এই চিঠি পাওয়ার পর ভারত সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য আপনাদের অনুরোধ আরো গভীর ভাবে বিবেচনা করেছে। আমি আপনাকে আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, বর্তমান বিরাজিত অবস্থার আলোকে ভারত সরকার স্বীকৃতিদানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে। আজ সকালে আমাদের লোকসভায় আমি এই মর্মে একটি বিবৃতি দিয়েছি যার কপি এখানে সন্নিবেশিত হলো।
বাংলাদেশের জনগণ অশেষ দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছেন। আপনাদের তরুনরা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য আত্মোৎসর্গকৃত সংগ্রামে নিয়োজিত। একই মূল্যবোধ রক্ষার্থে ভারতীয় জনগণও যুদ্ধ করে যাচ্ছে। আমার সন্দেহ নেই, যুদ্ধে এবং জীবন উৎসর্গে এই সহযাত্রা মহৎ আদর্শের প্রতি ও দুই দেশের জনগণের পারস্পরিক বন্ধুত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টাকে আরো শক্তিশালী করবে। পথ যত দীর্ঘ হোক, ভবিষ্যতে আমাদের দুইদেশের জনগণকে আরো যতই ত্যাগ স্বীকার করতে হোক, আমি নিশ্চিত আমরা বিজয়ী হব।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে আপনাকে, আপনাদের সহকর্মীদের এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য অ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আমার সর্বোচ্চ সহযোগিতার নিশ্চয়তা দিচ্ছি।
আপনার একান্ত
ইন্দিরা গান্ধী
মহামান্য জনাব
তাজউদ্দীন আহমদ
প্রধানমন্ত্রী,
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
মুজিবনগর
[১৪৪] ভাষান্তরঃ হারাধন গাঙ্গুলী
৩৪৩
মওলানা ভাসানীর আহবান [মার্চ, ১৯৭১]
বঞ্চিত জনসাধারণের প্রতি মওলানা ভাসানীর আহবান
প্রিয় দেশবাসী,
আজ সাত কোটি পূর্ববাংলার মানুষের কাছে এই জরুরী আহবান জানাতে বাধ্য হচ্ছি যে, আপনারা দল, মত, ধর্ম ও শ্রেনী নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ একত্রে এবং একযোগে একটি সাধারণ কর্মসূচী গ্রহন করুন, যার মূল লক্ষ্য হবে ২৩ বছরের অমানুষিক এবং শোষণকারী শাসকগোষ্ঠীর করাল কবল থেকে পূর্ববাংলাকে সম্পূর্ণ ও চূড়ান্তভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম করা।
১৯৪৭ সালের তথাকথিত স্বাধীনতা হস্তান্তরের ইতিবৃত্ত ও নির্গলিতার্থ এবং তার পরবর্তী অধ্যায়ে নবরূপে শোষণের প্রক্রিয়া সম্পর্ক্র শতকরা ৯৮ ভাগ দেশবাসী অবগত আছেন। এবং সেই জন্যেই আজ আমি আহবান জানাচ্ছি যে, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীন সুখী দেশ প্রতিষ্ঠা করার নামে সমঝোতার মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেনীর শোষকদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে স্বাধীনতার যে প্রহসন সৃষ্টি করা হয়েছিল, আসুন আজ আমরা একত্রিত হয়ে সেই কপট স্বাধীনতাকে সত্যিকারের স্বাধীনতার রুপান্তরিত করি।
আসুন আজ আমরা বজ্র কন্ঠে ঘোষণা করি যে, পূর্ববাংলার পূর্ণ স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের হাতে গণতান্ত্রিক পূর্ণ ক্ষমতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমরণ সংগ্রাম করে যাব।
আসুন আমরা ঘোষণা করি যে, পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। এর চেয়ে কম কিছু নয়। কারণ, অন্য কোন উপায়ে শোষিত কোটি কোটি পূর্ববাংলার সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতি এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসতে পারেনা।
আসুন, এই আন্দোলনকে আমরা সত্যিকারের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দ্বিতীয় ও শেষ পর্যায়ের মরণপণ সংগ্রামে পরিণত করি। সত্যিকারের জাতীয় মুক্তির আর কোন পথ নেই।
আসুন, আমরা বজ্র কন্ঠে ঘোষণা করি যে, ‘জয়বাংলা’ রব তুলে নিপীড়িত কোটি কোটি বাঙালির ভোট তথা সমর্থন নিয়ে সেই শক্তির বিনিময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক ও সামরিক শাসকদের সাথে হাত মিলিয়ে যেনতেন প্রকারের একটা আপোস এবং সমঝোতার সরকার গঠনপূর্বক শোষিত বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের দ্বিধাহীন ও দুর্বার আকাঙ্খাকে পুনর্বার বানচাল করার যে চক্রান্ত মুষ্টিমেয় বাঙালি ও তাদের হোতারা করে চলেছে সেই হীন ষড়যন্ত্রকে আমরা শতকরা ৯৫ জন শোষিত, নিপীড়িত বাঙালি একযোগে অঙ্কুরেই প্রতিহত
৩৪৪
ও বিনষ্ট করব। আসুন আমরা শেষ ও চূড়ান্ত বারের মত পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতা রক্ষার আন্দোলনে একত্রিত হই এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদী ও মুষ্টিমেয় বাঙালি শোষকের শত বাধা বিপত্তি ও আক্রমনকে প্রতিহত করে জয়যাত্রা শুরু করি।
ঘরে ঘরে ডাক পাঠাই তৈরি হও জোট বাঁধো-
মাঠে কিষাণ, কলে মজুর, নওজোয়ান জোট বাঁধো।
এই মিছিল সর্বহারার সব পাওয়ার এই মিছিল,
হও সামিল হও সামিল হও সামিল।
মার্চ ৯, ১৯৭১।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী
[২৫] সংকলন
মণি সিংহ (১৯০১-১৯৮৪)
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মণী সিংহ ১৯০১ সালের ২৮ জুন জন্মগ্রহন করেন ময়মনসিংহ জেলার সুসং দুর্গাপুরে। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য কলকাতায় যান। কলকাতায় ১৯১৪ সালে তিনি সশস্ত্র বিপ্লবী গোশগঠী অনুশীলন দলে যোগ দেন। ১৯২৫ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।
১৯৩০ সালে গ্রেফতার হন। এবং ১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাসে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি সুসং দুর্গাপুরে আসেন। এখানে অবস্থানকালে তিনি এখানকার কৃষকদের সুসংগঠিত করে টংকপ্রথার বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন পরিচালনা করেন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর মনি সিংহ পূর্ববাংলায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহন করেন। এ সময় তিনি ময়মনসিংহ জেলার হাজং কৃষকদের নিয়ে আবার টংক প্রথা উচ্ছেদের আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলন সশস্ত্র রূপ পরিগ্রহ করলে পাকিস্তান সরকার ১৯৫১ সালে টংক প্রথা বাতিল করে এবং মণি সিঙ্ঘের উপর হুলিয়া জারি করে তাঁর সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করে নেয়। এ অবস্থায় ১৯৫১ সালে মণি সিংহ পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৫৬ সালে গোপনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে তিনি আবারও সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৬৮ সালে গোপনে অনুষ্ঠিত পার্টির কংগ্রেসে তিনি তৃতীয়বার পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কিষান সভায় মহা সম্মেলনের তিনি অন্যতম সংগঠক ও অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন।
৩৪৫
১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের চাপে সরকার তাকে মুক্তি দেয়। মুক্তিলাভের কিছুদিনের মধ্যেই পুনরায় তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ৭ এপ্রিল রাজশাহী কারাগার থেকে বের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পুরো সময় মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে মণি সিংহ পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন১৯৭৫ সালে তিনি বাকশালে যোগদান করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিকে পুনরুজ্জীবিত করেন। ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহন করেন। ১৯৮০ সালের কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসে তিনি পুনরায় পার্টির সবাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দুইখন্ডে রচিত তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ জীবন সংগ্রাম সমকালীন রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা।
[৭৩] কনক খান
মনিকৃষ্ণ সেন
বিশিষ্ট রাজনীতিক মনিকৃষ্ণ সেন জন্মগ্রহন করেন ১৯০৩ সালে রংপুরে ১৯২৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ এবং ল পাশ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই বাঙালীর স্বাধীকারের পক্ষে ছিলেন সোচ্চার। বহুবার কারাবরণও করেছেন এজন্য। ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলনে ছিলেন বিশেষ সক্রিয়। তিনি ১৯৭১ এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তাঁরই নেতৃত্বে রংপুরে আটটি মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং সেন্টার ও ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশ স্বাধীনের পর কমিউনিস্ট পার্টিকে (সিপিবি) সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭৩ এ পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ। নিজ সম্পত্তির বিরাট অংশ তিনি জনকল্যানমূলক কাজে দান করে দেন। নিজ গ্রাম রংপুরে প্রতিষ্ঠা করেন মায়ের নামে প্রমদা সুন্দরী সেবা কল্যান ট্রাস্ট ও পিতার নামে হাইস্কুল। ১৯৯১ সালের ২৮ অক্টোবর কলকাতায় এই বরেণ্য রাজনীতিবিদের চিরপ্রয়াণ ঘটে।
[৭৩] মোহাম্মদ সেলিম
মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়
দ্র. স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার
৩৪৬
মফিজ চৌধুরী (১৯১৪-১৯৯৩)
বগুড়ার জয়পুরহাটে মফিজ চৌধুরী ১৯১৪ সালে জন্মগ্রহন করেন। অত্যন্ত মাধাবী মফিজ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে এমএসসি ডিগ্রী লাভ করেন ১৯৩৭ সালে। শ্রেষ্ঠ গবেষণা কাজের জন্য ১৯৪৩ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কেমেস্ট্রির কুপার স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৪৯ এ রসায়ন শাস্ত্রে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন যুক্তরাষ্ট্রের লেহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে দ্বায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজস্ব শিল্প কারখানা গড়ে তোলেন, ছাত্রজীবন থেকে মফিজ চৌধুরী ছিলেন রাজনীতিতে সক্রিয়। নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র সমিতির প্রথম ছাত্র সমিতির প্রথম ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৬৭ তে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ৭০ এর নির্বাচনে জয়পুরহাটে পাঁচবিবি ক্ষেতলাল আসন থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হলে তিনি মুজিবনগর চলে আসেন। এবং প্রত্যক্ষভাবে নীতি নির্ধারণে অংশগ্রহন করেন। মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে জাতিসংঘে গমন করেন।
পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রীসভায় পেট্রোলিয়াম ও খিনিজ সম্পদ, বিজ্ঞান ও কারিগরি গবেষণা দফতরের মন্ত্রী হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন। অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে মফিজ চৌধুরীর সুনাম ছিল। তিনি ১৯৯৩ সালে পরলোক গমন করেন।
[৭৩] রিয়াজ আহমেদ
ময়েজউদ্দীন আহমেদ (১৯৩৩-১৯৮৪)
ময়েজউদ্দীন আহমেদ ১৯৩৩ সালের ১ মার্চ গাজীপুরের কালিগঞ্জের বড়হরা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ এবং ১৯৫৫ তে এলএলবি পাস করেন। এরপর ঢাকা বারে আইনব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে হাইকোর্ট ও সুপ্রীম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা ছিলেন এবং বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগে বিশেষ দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এছাড়া ১৯৭৭-৮৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ রেডক্রস সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির জেনারেল সেক্রেটারী ছিলেন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৮৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর হরতালের সমর্থনে কালিগঞ্জের একটি মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে নিজ দলীয় অফিসে ফেরার পথে দুষ্কৃতকারী কর্তৃক নিহত হন।
[৭৩] কনক খান
৩৪৭
মা বোনেরা অস্ত্র ধর বাংলাদেশ মুক্ত কর
অসহযোগ আন্দোলনের সেই উত্তাল মার্চ মাসে বিভিন্ন নারী সংগঠনের মিছিলে এই শ্লোগানটির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যেত। মার্চ মাসের মহিলা পরিষদের একটি মিছিলের প্লাকার্ডেও শ্লোগানটি ব্যবহার করতে দেখা যায়। মুক্তিকামী বাঙালিদের সম্মিলিত মিছিল সমাবেশে এই শ্লোগানটি ব্যাপক ব্যবহার হত। মূলত মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহনে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে এই শ্লোগানটিকে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তোলা হয়। মনে হয় এটি একমাত্র শ্লোগান যেখানে মেয়েদের সরাসরি সংযুক্ত করে আন্দোলনে অংশগ্রহন করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
[৫৭৩] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন
মালেক মন্ত্রিসভা
পাকিস্তান অধিকৃত বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খান ‘স্বাধীনতা’ ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে ডা. এমএ মালেকের নেতৃত্বে একটি প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা গঠন করেন ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে। এমএ মালেক একসময় শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল বহির্বিশ্বে প্রচার করা যে বাংলাদেশে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে। মন্ত্রীসভায় স্বাধীনতা বিরোধী মুসলিম লীগ, খেলাফত আন্দোলন, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি দল থেকে ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হয়েছিল। মন্ত্রীসভার যারা সদস্য ছিলেন তারা হলেন-
১. আবুল কাশেম
২. নওয়াজেশ আহমেদ
৩. এএমএম সোলায়মান
৪. ওবায়দুল্লাহ মজুমদার
৫. আব্বাস আলী খান
৬. মওলানা একেএম ইউসুফ
৭. মওলানা ইসহাক
৮. শামসুল হক
৯. সামসুদ্দিন আহমেদ
১০. আখতারুদ্দীন আহমদ
১১. মং শু প্রু চৌধুরী
১২. এএম মোশাররফ হোসেন
১৩. মুজিবুর রহমান
মুনতাসীর মামুন
মালেক মন্ত্রীসভাঃ শেষ দিনগুলি
১৬ ডিসেম্বর ঢাকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে এ মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করে। এ সময় জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার জন কেলি মধ্যস্থতা করেন। কেলির কাছে মালেক ইয়াহিয়া খানের গোপন বার্তার কিছু দলিলপত্র ছিল। এ দলিলপত্র থেকে হানাদার
৩৪৮
বাহিনীর সহযোগী সরকারের দিনগুলির কথা জানা যায়। এখানে সেগুলোর অনুবাদ দেওয়া হল-
১.
তারিখ ২-৩-৭১
প্রিয় প্রেসিডেন্ট,
করাচি পৌঁছার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি আপনার কাছ থেকে কিছু সময় বরাদ্দ করিয়ে নিতে ব্রিগেডিয়ার ইশহাককে অনুরোধ করেছি। কাল বিকেলে আমি ইসলামাবাদ ফিরে যাচ্ছি।
২৩ ফেব্রুয়ারি আপনি আমাদের উদ্দেশ্যে যে বিদায়ী ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন, আপনি খেয়াল করে দেখুন, ঐ অনুষ্ঠানে আমি আপনাকে বলেছিলাম ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন স্থগিত হলে পূর্ব পাকিস্তানে বিপ্লব না হোক একটা গণবিক্ষোভ হনে। সে রকম হলে, কিংবা অধিবেশনে বসার ব্যাপারে অন্য কোন ধরনের সংঘর্ষ বাধা হয়ে দাঁড়ালে আমার পক্ষে উপদেষ্টা পদ গ্রহন করা সংক্রান্ত আপনার সদয় প্রস্তাব , জেনারেল পীরজাদার ২২-২-৭১ তারিখের চিঠিতে যার উল্লেখ করা হয়েছিল, রক্ষা করা সম্ভব হবেনা।
আমি আরো উল্লেখ করতে চাই, আমি যখন আপনার মন্ত্রীসভায় যোগ দিতে সম্মত হয়েছিলাম, তখন এ রকম এক খোলামেলা সমঝোতা হয়েছিল যে, দেশে গণতন্ত্র সুরক্ষা করা হবে এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই সরকার গঠন করবে। একাধিকবার বিভিন্ন গণসমাবেশে আমি এ কথা জানিয়ে দিয়েছি যে, যেইমাত্র আমি বুঝতে পারব জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতায় আসার কিংবা গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার সুযোগ তিরোহিত হয়েছে, আমি তখুনি সরকার থেকে পদত্যাগ করব।
এখন যেহেতু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত বেধেছে এবং গণতন্ত্র সুরক্ষার এবং জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনাও তিরোহিত হয়েছে। সেহেতু উপরোল্লিখিত পীরজাদার চিঠির মাধ্যমে আপনি আমার কাছে প্রস্তাব রেখেছেন তাতে রাজি হবার ব্যাপারে আমার অপারগতাইয় দুঃখপ্রকাশ ছাড়া আমার আর অন্য কোন পথ খোলা নেই। তথাপি আমি একথাও জানাতে চাই শেষের দেড় বছর আপনার অধীনে কাজ করতে পারা আমার কাছে খুবই আনন্দের ছিল এবং শুধু পাকিস্তানের অখন্ডতার জন্যই না, এদেশকে সকল স্তরের জনগণের জন্য ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা প্রদানকারী একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করার ব্যাপারে আপনার আন্তরিক ও সৎ অভিপ্রায়কে আমি খুবই সম্মান করি।
৩৪৯
পাকিস্তানের খেদমত করার জন্য আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবন দান করুন এবং যে মহৎ লক্ষ্যের জন্য আপনি কাজ করছেন তা সফল করুন।
শুভ কামনায়
আপনার একনিষ্ঠ,
(ড. আবদুল মোতালেব মালিক)
জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, এইচ জে
প্রধান সামরিক শাসক এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট,
প্রেসিডেন্ট ভবন,
রাওয়াপিন্ডি।
২.
এম এস জি ফর্ম
ডি টি জিঃ
ফ্ল্যাশ
অতি গোপনীয়
প্রেরকঃ গভর্নর, পূর্ব পাকিস্তান এ ৬০০৫
প্রাপকঃ সি এম এল এ সদর দপ্তর, রাওয়ালপিন্ডি।
বরাবর,
পাকিস্তানের প্রেসডেন্ট।
পূর্ব পাকিস্তানের সঠিক পরিস্থিতি আপনার গোচরে আনা অত্যাবশ্যক। আমি জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে আলাপ করেছি, যিনি আমাকে বলেছেন, সৈন্যরা বীরদর্পে লড়াই করছে তবে গোলাবারুদ এবং বিমান বাহিনীর সহায়তার অভাবে খুব অসুবিধা হচ্ছে। বিদ্রোহীদের উৎপাত অব্যাহত। এবং লোকবল ও অস্ত্রশস্ত্রের ক্ষয়ক্ষতি প্রচুর ও অপূরনীয়। পূর্ব ও পশ্চিম সেক্টরে রণাঙ্গনের পতন হয়েছে। মেঘনা নদীর পূর্বে পুরো করিডোরের পতন এড়ানো সম্ভব হবেনা। ইতিমধ্যেই যশোরের পতন ঘটেছে যা পাকিস্তানপন্থীদের মনোবলের উপর ভয়ানক আঘাত হয়ে দেখা দেবে। লোকপ্রশাসন অকার্যকর, কেননা যোগাযোগ ছাড়া বেশি কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। চট্টগ্রাম থেকে কোন কিছুই পরিবহন করা না যাওয়ায় এবং এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় চলাচল সম্ভব না হওয়ায় খাদ্য ও অন্যান্য মজুদ ফুরিয়ে আসছে। এমনকি ঢাকায় ৭ দিনের মধ্যে খাবার ফুরিয়ে যাবে। খাদ্য এবং তেলের অভাবে জীবনযাত্রা পুরপুরি স্থবির হয়ে যাবে । সেনাবাহিনী কর্তৃক ছেড়ে যাওয়া এলাকাগুলোর আইনশৃংখলা পরিস্থিতি ভয়াবহ, বিদ্রোহীরা হাজার হাজার পাকিস্তানপন্থীকে জবাই করেছে। লাখ লাখ অবাঙালি এবং অনুগত মৃত্যুর প্রহর গুনছে। বিশ্ব শক্তিসমূহের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া মৌলিক সহানুভূতি কিংবা বাস্তব সহায়তা কোন কিছুই কাজে দেবেনা।
৩৫০
আমাদের কোন মিত্র যদি সহায়তা করতে ইচ্ছুক হয় তাহলে আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তাকে তা করতে হবে। যদি সাহায্যের কোন আশা না থাকে তাহলে আমি আপনাকে আলোচনায় বসতে মিনতি করছি, যাতে একটা সভা আর শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর সম্ভব হয় এবং লাখ লাখ জীবন রক্ষা পায়, অকথিত দুর্দশা এড়ানো যায়। যখন পরিণতি অনিবার্য তখন আত্মবলিদান কি খুব কাজের কথা! যদি সাহায্য আসে, যেকোন পরিণতির বিনিময়ে আমরা লড়তে রাজি। যোগাযোগ রক্ষা করার অনুরোধ রইল।
৩.
ফ্ল্যাশ
ডি টি জিঃ ০৭১৯২৫
প্রেরকঃ সি এম এল এ সদরদপ্তর
অতি গোপনীয়
প্রাপকঃ গভর্ণর, পূর্ব পাকিস্তান
প্রেসিডেন্ট কর্তৃক গভর্ণরকে
আপনার ফ্ল্যাশ সংকেত নম্বর এ ৬০০৫, তারিখ ৭ ডিসেম্বর প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে। সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পশ্চিম প্রান্তে পূর্ণমাত্রায় এবং তিক্ত যুদ্ধ চলছে। বিশ্ব শক্তি একটা যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। রাশিয়ার অনড় ভেটো প্রদানের পর বিষয়টি সাধারণ পরিষদে পাঠানো হয়েছে। অতি উঁচু ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রতিনিধিদল নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে ছুটে গেছে। দয়া করে নিশ্চিন্ত হন। আপনারা যে ভয়াবক পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন তার ব্যাপারে আমি পুরোপুরি সচেতন। কী সামরিক কৌশল গ্রহন করতে হবে তা নিয়াজিকে জানিয়ে দিতে চিফ অফ স্টাফকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আপনি ও আপনার সরকার খাদ্য, রেশনিং ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহ কাটছাঁট করার ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেবেন যাতে যুদ্ধ করার ক্ষমতা সর্বোচ্চ সময় পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা যায়। আল্লাহ আপনার সহায় হোন। আমরা আপনাদের জন্য দোয়া করছি।
৪.
এম এস জি ফর্ম
ডি টি জিঃ ০৯১৮০০
প্রেরকঃ গভর্ণর, পূর্ব পাকিস্তান
প্রাপকঃ সি এম এল এ সদর দপ্তর
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বরাবরে
সামরিক বাহিনীর বেপরোয়া অবস্থা। পশ্চিমে শত্রুবাহিনী ফরিদপুরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং পূর্বে কুমিল্লা ও
৩৫১
লাকসামে আমাদের সৈন্যদের ঘাঁটি ডিঙিয়ে মেঘনা নদীর কাছাকাছি চলে এসেছে। শত্রুবাহিনীর হাতে চাঁদপুরেরপতন ঘটায় নদীপথে সকল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বাইরে থেকে কোন সাহায্য না এলে শত্রুবাহিনী যেকোনদিন ঢাকার উপকন্ঠে এসে হাজির হতে পারে। ঢাকায় জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিনিধি প্রস্তাব দিয়েছেন ঢাকায় বেসামরিক লোকজন বিশেষত অবাঞালিদের জীবন বাঁচাতে ঢাকাকে ‘ওপেন সিটি’ ঘোষণা করা হোক। আমি তাঁর প্রস্তাব গ্রহনে আগ্রহী। অচিরেই বিষয়টি অনুমোদন করা হোক। জেনারেল নিয়াজী রাজি নন, কেননা তার মতে তার দ্বায়িত্ব শেষমূহুর্ত পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়া। এবং তাহলে তাহলে ঢাকার পতন অবশ্যম্ভাবী। এই অ্যাকশন শেষ পর্যন্ত পুরো সেনাবাহিনী, পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশ এবং সকল অস্থানীয় জনগণ এবং অনুগত ব্যক্তিদের হত্যাযজ্ঞ ডেকে আনবে। আমি আপনাকে আর একবার অনুরোধ করছি অচিরেই যুদ্ধবিরতি ঘোষণার কথা বিবেচনা করুন কিংবা বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে নিষ্পত্তি করুন নতুবা ভারতীয় সৈন্যরা যদি একবার পূর্ব প্রান্তে ঢুকে পড়ে, অল্প কদিনেই পশ্চিম প্রান্তও অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে। বুঝে দেখুন, দখলকৃত এলাকার স্থানীয় জনগণ ভারতীয় সৈন্যদের স্বাগত জানিয়েছে এবং তাদের সম্ভাব্য সর্বোত সহায়তা দিচ্ছে। বিদ্রোহীদের তৎপরতার কারণে আমাদের সৈন্যদের পক্ষে পিছুহটা কিংবা যুদ্ধ কৌশল পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের গণআত্মবলিদান অর্থহীন।
৫.
ফ্ল্যাশ
ডি টি জিঃ ০৯২৩০০
প্রেরকঃ সি এম এম এ সদর দপ্তর
প্রাপকঃ গভর্নর, পূর্ব পাকিস্তান
অতি গোপনীয়। জি ০০০১
প্রেসিডেন্ট কর্তৃক গভর্নরকে প্রেরিত।
আপনার ৯ ডিসেম্বরের ফ্ল্যাশ মেসেজ এ-৪৬৬০ পাওয়া গেছে এবং পুরোপুরি বুঝতে পারা গেছে। আমার কাছে যেসব প্রস্তাব করেছেন সেসবের ব্যাপারে আপনাকে সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুমতি দেয়া হল। আমি সকল পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক ভাবে নেয়ার ব্যাপারে চেষ্টা করেছি এবং করছি। তবে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে আমাদের পারস্পরিক সিদ্ধান্তের পূর্ণ বিচ্ছিন্নতার কারনে আমি সবকিছু আপনার সুবুদ্ধি এবং বিচারবোধের উপর ছেড়ে দিলাম। আপনি যে সিদ্ধান্তই নেন না কেন আমি তা অনুমোদন করব এবং আমি একই সঙ্গে জেনারেল নিয়াজিকে নির্দেশ দিচ্ছি আপনার সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার এবং সে অনুযায়ী কাজ করার। আপনার উল্লিখিত বেসামরিক লোকজনের অর্থহীন ধ্বংস রোধ করতে
৩৫২
আপনি যে উদ্যোগই গ্রহন করুননা কেন, বিশেষত আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে রক্ষা করতে যে কোন উদ্যোগ নিতে পারেন এবং আমাদের প্রতিপক্ষের সঙ্গে যেকোন রাজনৈতিক পথ-উপায় নির্ধারণ করতে পারেন।
৬.
এম এস জি ফর্ম
ডি টি জিঃ ১০
ফ্ল্যাশ
অতি গোপনীয়
প্রেরকঃ গভর্নর, পূর্ব পাকিস্তান এ -৭১০৭
প্রাপকঃ সি এম এল এ সদর দপ্তর
বরাবর,
প্রেসিডেন্ট পাকিস্তান।
আপনার ০৯২৩০০ ডিসেম্বর জি-০০০১। যেহেতু আমাকে যেকোন ধরনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছে, আমি আপনার অনুমোদন সাপেক্ষে নিম্নোদ্ধৃত নোটটি উপ-মহাসচিব মি. পল মার্ক হেনরির কাছে হস্তান্তর করছি। নোট শুরুঃ
পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে এক পুরোদস্তুর যুদ্ধে নিজেদের জড়িয়ে ফেলার কোন অভিপ্রায় কখনোই পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর ছিলনা। তথাপি এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যা সশস্ত্র বাহিনীকে আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহনে বাধ্য করেছে। পাকিস্তান সরকারের সবসময় অভিপ্রায় ছিল রাজনৈতিক সমাধানের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের ইস্যুগুলো সুরাহা করা, যার জন্য আলোচনার পথ খোলা রাখা ছিল। শত বিরুপতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনী বীরের মত লড়েছে এবং এখনো সে লড়াই চালিয়ে যেতে পারে। তবে আরো রক্তারক্তি এবং জীবনক্ষয় এড়াতে আমি নিম্নোক্ত প্রস্তাবগুলো পেশ করছি।
যেহেতু রাজনোইতিক কারনে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে এর অবসান ঘটাতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রেসিডেন্টের প্রাজ্ঞাধিকার প্রাপ্ত হয়ে আমি পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আহবান করছি শান্তিপূর্ণ উপায়ে ঢাকার সরকার গঠন করার। এ প্রস্তাব রাখার পাশাপাশি আমি দ্বায়িত্বের কারনে এটাও বলতে বাধ্য যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের ভূমি থেকে ভারতীয় সৈন্যদের দ্রুত অপসারণ দাবি করবে। এ জন্য আমি ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের বন্দোবস্ত করতে জাতিসংঘকে আহবান করছি এবং অনুরোধ করছি। ১. অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ২. পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী সম্মানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবাসন। ৩. পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যেতে ইচ্ছুক সকল পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তার প্রত্যাবাসন ৪. ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসতি স্থাপনকারী
৩৫৩
সকল ব্যক্তির নিরাপত্তা ৫. পূর্ব পাকিস্তানে কোন ব্যক্তির উপর প্রতিশোধ নেওয়া হবেনা এমন নিশ্চয়তা।
আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের ব্যাপারে এটি একটি নির্দিষ্ট প্রস্তাব। সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমর্পনের অনুরোধ উত্থাপিত হবেনা এবং সে প্রশ্নও ওঠেনা এবং এ প্রস্তাব গ্রহন করা না হলে সশস্ত্র বাহিনীর শেষতম লোকটি লড়াই চালিয়ে যাবে। নোট শেষ।
জেনারেল নিয়াজি আমার সঙ্গে আলাপ করেছেন এবং উনি আপনার আদেশ মেনে নিয়েছেন। অবিলম্বে আপনার অনুমোদনের অনুরোধ জানাচ্ছি।
৭.
ফ্ল্যাশ
ডি টি জিঃ ১১০৪৩০
প্রেরকঃ প্রেসিডেন্ট
অতি গোপনীয়
প্রাপকঃ গভর্নর, পূর্ব পাকিস্তান
জি ০০০২
জ্ঞাতব্যঃ কমান্ডার ইস্টার্ণ কমান্ড মেজর জেনারেল ফরমান আলি।
আমার শেষ বার্তা অনুযায়ী কোন অ্যাকশন নেবার প্রয়োজন নেই। আমাদের মিত্ররা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক এবং সামরিক পদক্ষেপ নিচ্ছেন। যেকোন প্রকারে আরো ৩৬ ঘন্টা টিকে থাকা আমাদের জন্য খুবই দরকারি। দয়া করে এই মেসেজটি জেনারেল নিয়াজি ও জেনারেল ফরমানের বরাবরে পাঠিয়ে দিন।
৮.
ফ্ল্যাশ
১০ নিল
প্রেরকঃ সি এম এল এ সদর দপ্তর
অতি গোপনীয়
প্রাপকঃ গভর্নর, পূর্ব পাকিস্তান
জি ০০০২
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে।
আপনার ১০ ডিসেম্বরের ফ্ল্যাশ মেসেজ এ-৭১০৭। আপনার মেসেজের উল্লিখিত প্রস্তাবের খসড়ায় আপনি যা বলেছেনেবং আমি যা অনুমোদন করেছিতার চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেছে। যখন আপনি ক্ষমতা হস্তান্তর, রাজনৈতিক সমাধান কিংবা পূর্ব পাকিস্তান থেকে সৈন্যদের
৩৫৪
প্রত্যাবাসনের উল্লেখ করেছেন তখন এমন মনে হয়েছে যেন আপনি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কথা বলছেন। এসবের অর্থ দাঁড়ায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া। আপনার এলাকায় যে পরিস্থিতি তাতে পূর্ব পাকিস্তানে সহিংসতা বন্ধে আপনার সীমিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। সে কারনে আমি আপনাকে একটি খসড়া প্রস্তাব করছি যা আপনাকে ইস্যু করার অধিকার দেওয়া হচ্ছে। নোট শুরুঃ
যেহেতু বিপুল সংখ্যক ভারতীয় সৈন্যের দ্বারা সমুদ্র ও আকাশপথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায় এবং বেসামরিক নাগরিকদের অর্থহীন রক্তপাত পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে, সে কারণে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আমাকে আমার ইচ্ছেমত প্রাজ্ঞাধিকার দিয়েছেন। অতএব আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, যদিও পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে বীরের মত লড়েছে এবং লড়াই চালিয়ে যেতে এখনো সক্ষম তথাপি আরো রক্তপাত এবং নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি এড়াতে আমি নিম্নোক্ত প্রস্তাব পেশ করছি।
১. সহিংসতা এড়াতে পূর্ব পাকিস্তানে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি।
২. ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসতিও স্থাপনকারি কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
৩. পূর্ব পাকিস্তানে কোন লোকের উপর প্রতিশোধ মূলক পদক্ষেপ নেয়া হবেনা এমন নিশ্চয়তা।
৪. পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র বাহিনীর সকল কর্মকর্তার নিরাপত্তা।
আমি একথা পরিষ্কার করতে চাই যে, সকল প্রকার সহিংসতার অবসানের লক্ষ্যে এটি একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব এবং সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমর্পনের কথা বিবেচনা হবেনা এবং সে প্রশ্নও উঠবেনা। নোট শেষ।
এই কাঠামোর ভেতর থেকে আপনি আপনার ইচ্ছে অনুযায়ী পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করতে পারবেন। ক্ষমতা হস্তান্তর এবং রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নটি জাতীয় পর্যায়ে সমাধা করা হবে এবং করা হয়েছেও।
৯.
বরাবর,
লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী
এস এ এম মানেকশ, ভারতের সামরিক বাহিনী প্রধান কর্তৃক প্রেরিত।
প্রথমত, আমি আজ ১৪ টা ৩০ মিনিটে নয়াদিল্লিতে অবস্থিত জাতিসংঘ অফিস মারফত বাংলাদেশে যুদ্ধবিরতি প্রসঙ্গে আপনার বার্তাটি পেয়েছি।
দ্বিতীয়ত, এর আগে আমি জেনারেল ফরমান আলিকে দুটি বার্তা পাঠিয়ে জানিয়ে দিয়েছি যে, আমি যেসব বিষয়ে নিশ্চয়তা দেব সেগুলো হলো- (ক)
৩৫৫
বাংলাদেশে আমার কাছে আত্মসমর্পনকারী আপনাদের সকল সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তা। (খ) বিদেশী নাগরিক, জাতিগত সংখ্যা লঘু এবং পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সকলের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা। যেহেতু আপনি যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে আপনার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন, আমি আশা করছি আপনি বাংলাদেশে আপনার কমান্ডের অধীন সকল বাহিনীকে অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতি করার এবং যেখানে যেখানে আমার আগুয়াণ বাহিনী অবস্থান করছে তাদের কাছে আত্মসমর্পন করার নির্দেশ ইস্যু করবেন।
তৃতীয়ত, আমি আপনাকে আনুষ্ঠানিক নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, যেসব কর্মকর্তা আত্মসমর্পন করবেন, তাঁদের যথাযথ্য মর্যাদা ও সম্মান দেখানো হবে। এবং আমি জেনেভা কনভেশনের শর্ত মেনে চলব। এছাড়া যেহেতু আপনারা ব্যাপকভাবে আহত হয়েছেন আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি তাদের ভালোভাবে যত্ন নেয়া হবে এবং তাঁদের যথাযথভাবে সৎকার করা হবে। যে যেখান থেকেই আসুক না কেন তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সঙ্কিত হবার প্রয়োজন নেই। আমার কমান্ডের অধীন বাহিনীর কেউ তাদের উপর প্রতিশোধ নেবেনা।
চতুর্থত, আপনার কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ভারত ও বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল অরোরাকে পূর্বাঞ্চলে আপনার বাহিনীর উপর সকল প্রকার আকাশ ও ভূমি তৎপরতা বন্ধ করার নির্দেশ দেব। আমাদের প্রতিজ্ঞার বিশ্বাসযোগ্যতার সাক্ষ্য হিসেবে আমি নির্দেশ জারি করলাম আজ ১৭ টা থেকে ঢাকায় কোন বিমান তৎপরতা চালানো হবেনা।
পঞ্চমত, আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, যেহেতু আমি প্রাণহানিকে ঘৃণা করি, আপনার সেনাদলে অযথা লোকক্ষয় ঘটানো হবেনা। ১৬ ডিসেম্বর ভারতের স্থানীয় সময় ৯ টার মধ্যে আপনি যদি আমার প্রস্তাব না মানেন্তাহলে সর্বশক্তি দিয়ে পুনরায় আক্রমণ শুরু করা ছাড়া আমার অন্য কোন বিকল্প থাকবেনা।
ষষ্ঠত সকল বিষয় দ্রুত আলোচনা ও চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে আমি আজ ১৫ ডিসেম্বর ভারতের স্থানীয় সময় ১৭ টা থেকে লিসেনিং ওয়াচে বেতার সংযোগের বন্দোবস্ত করেছি। বেতার তরঙ্গ হবে দিনের বেলা ৬৬০৫ (৬৬০৫) কিলোহার্টজ এবং রাতের বেলা ৩২১৬ (৩২১৬) কিলোহার্টজ। কল সাইন হবে CAL (কলকাতা) এবং DAC (ঢাকা)। আমি আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি অচিরেই মাইক্রোওয়েভ সংযোগ তৈরি করতে আপনি আপনার সিগন্যালারদের নির্দেশ দেন।
১০.
লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী কর্তৃক
১৬০২২৩
ভারতের চিফ অফ স্টাফ জেনারেল এস মানেকশের বরাবরে প্রেরিত মেসেজ
৩৫৬
আমি পূর্ব পাকিস্তানের স্থানীয় সময় ১৬টা ২০ মিনিটে মার্কিন ক্যনসুলেটের মারফত আপনার মেসেজ পেয়েছি। আমার প্রস্তাবটি জনগণের জীবন বাঁচানোর তাগিদ থেকে সৃষ্ট, যা সকল সেনা দলকে সময়মত জ্ঞাত করে এবং ঠিকমত সকল প্রকার পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহন করার মাধ্যমেই কেবল নিশ্চিত করা সম্ভব। যোগাযোগ সমস্যা এবং বসেনাদল গুলোর বিচ্ছিন্নতার কারণে অস্ত্রবিরতি আরো ৬ ঘন্টা বাড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। যদি যত দ্রুত সম্ভব ঢাকায় আধাসামরিক অফিসারদের একটি বৈঠক বসানোর ব্যাপারে আপনি রাজি হন্তবে আরো সুবিধা হয়। দয়া করে আজ পূর্ব পাকিস্তান সময় ১৫ টা পর্যন্ত অস্ত্র বিরতি সময় বর্ধিত করার বিষয় নিশ্চিত করুন এবং ঢাকা বিমানবন্দরে আপনার যেসব স্টাফ কর্মকর্তা হেলিকপ্টার যোগে অবতরণ করবেন তাদের নাম ও পৌঁছানোর সময় জানিয়ে দিন। ইত্যবসরে আমরা আপনার অনুরোধ মোতাবেক যুদ্ধবিরতির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করব।
১১.
জনাব হার্বার্ট ডি স্পিভাক
ঢাকা, পূর্ব পাকিস্তান
কনসাল জেনারেল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১
আমেরিকান ক্যনসুলেট জেনারেল
ঢাকা, পূর্ব পাকিস্তান
নিরপরাধ জনগণের প্রাণহানি এড়াতে, যা ঢাকার মত প্রধান শহর গুলোয় সহিংসতার পরিণতিতে অনিবার্যভাবে ঘটবে, আমি আপনাকে নিম্নলিখিত শর্তগুলোর অধীনে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানাচ্ছিঃ
(ক) নির্ধারিত এলাকাসমূহে পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর পুনরেকত্রীকরণ বিপক্ষ বাহিনীর কমান্ডারদের সঙ্গে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে হবে।
(খ) সকল সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
(গ) ১৯৪৭ সাল থেকে যারা পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করছে তাদের সকলের নিরাপত্তা।
(ঘ) ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে যারা প্রশাসনকে সহায়তা করছে তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিশোধ নেয়া হবেনা এমন অঙ্গীকার।
এই শর্ত গুলোর অধীনে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনী অবিলম্বে তাদের সকল সামরিক অপারেশন বন্ধ করবে।
বর্তমান বিবাদের স্থায়ী নিষ্পত্তির লক্ষ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক পাসকৃত যেকোন প্রস্তাব আমি মেনে চলব।
৩৫৭
পূর্ব পাকিস্তান ‘বি’ জোনের সামরিক শাসন প্রশাসক ও ইস্টার্ণ কমান্ডের কমান্ড হিসেবে এ এলাকায় সকল পাকিস্তানি সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর উপর চূড়ান্ত অথোরিটি হিসেবে আমার যে অবস্থান তারই ভিত্তিতে আমি এ প্রস্তাব করছি।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল
কমান্ডার
ইস্টার্ণ কমান্ড মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর
জোন-বি
( এ এ কে নিয়াজী, এইচ জে (বার) এসপিকে এফকেএমসি)
১২.
বরাবর
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট
দেশে আরো রক্তপাত বন্ধের লক্ষ্যে আমরা গভর্ণর ও মন্ত্রীপরিষদের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করছি, যা অচিরেই কার্যকর হবে এবং সরকারের সঙ্গে সকল সংযোগ ছিন্ন করছি।
ও আরো ১১ জন।
১৩.
এ এম মালেক
ফ্ল্যাশ
১৪১৩৩২
প্রেরকঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান
ইউ এন ক্লাস
প্রাপকঃ গভর্ণর, পূর্ব পাকিস্তান
জি-০০১৩
কমান্ডার ইস্টার্ণ কমান্ড
প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে গভর্নর ও জেনারেল নিয়াজীকে।
গভর্নরের ফ্ল্যাশ মেসেজ পেয়েছি। বিপুল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তোমরা বীরের মত লড়েছ। জাতি তোমাদের নিয়ে গর্বিত এবং সারা বিশ্ব তোমাদের প্রশংসায় মুখরিত। সমস্যার গ্রহনযোগ্য সমাধান খোঁজার ব্যাপারে আমি মানুষের পক্ষে সম্ভব সবকিছু করেছি। তোমরা এমন এক অবস্থায় পৌঁছে গেছ যেখানে আর প্রতিরোধ তৈরি করা মানসিকভাবে অসম্ভব এবং তা আর কোন কাজেও দেবেনা। এতে শুধু প্রাণহানি
৩৫৮
আর ধ্বংসই বাড়বে। এখন তোমাদের যুদ্ধ বন্ধের এবং সশস্ত্র বাহিনীর সকল কর্মকর্তা, পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক ও অনুগতদের জীবনরক্ষার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ইত্যবসরে আমি পূর্ব পাকিস্তানে সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করতে এবং সকল সশস্ত্র বাহিনী ও অন্য যাদের দুষ্কৃতকারীদের লক্ষ্যবস্তু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাদের সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারতের কাছে আবেদন জানাতে জাতিসংঘকে অনুরোধ করেছি।
১৪.
প্রিয় জেনারেল নিয়াজী,
ঢাকা, ১৫-১২-৭১
আমি কি জানতে পারি, প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে আপনার ও গভর্নর হিসেবে আমার কাছে পাঠানো পাক আর্মি সংকেত নম্বর জি ০০১৩, তারিখ ১৪-১২-৭১ মেসেজটির ব্যাপারে আপনার পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কিনা? মেসেজটিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে “যুদ্ধ বন্ধ করতে এবং সশস্ত্র বাহিনীর সকল কর্মকর্তা, পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক ও সকল অনুগতের জীবন রক্ষা করতে এখন তোমাদের সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ গ্রহন করা উচিত।” ওই মেসেজে আরো বলা হয়েছে, “তোমরা এ মূহুর্তে এমন এক অবস্থায় পৌঁছে গেছ যেখানে আর প্রতিরোধ তঈরি করা মানসিকভাবে অসম্ভব এবং তা কোন কাজে দেবেনা।” সহিংসতা এখনো বন্ধ হয়নি এবং প্রাণহানি ও ধ্বংস অব্যাহত রয়েছে। আমি আপনাকে যা প্রয়োজন তা করার অনুরোধ জানাচ্ছি।
বিনীত,
আপনার একনিষ্ঠ,
এসডি, এ এম মালেক
ফোন-২৫২৯১১, ১২
অনুবাদঃ শিবব্রত বর্মণ
মায়ের ডাক
‘মায়ের ডাক’ সম্পাদিকা সালেহা বেগম, একমাত্র মহিলা যিনি এ ধরনের একটি সাপ্তাহিক পরিচালনা করতেন। এ পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি অধ্যক্ষ শেখ আব্দুর রহমান ( প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ছিলেন)। মায়ের ডাক প্রেস, মুজিবনগর থেকে মুদ্রিত এবং শ্রীমতী নীলিমা দে কর্তৃক পরতিকাটি প্রকাশিত হয়। যোগাযোগের ঠিকানা ছিল প্রধান কার্যালয়ঃ মুজিবনগর, বাংলাদেশ। আর অন্যান্য জায়গায় ছিল যেমন, মায়ের ডাক, মিউনিসিপাল ট্রাংক রোড, খুলনা। মায়ের ডাক, বাগেরহাট, খুলনা। খুরশিদ আরা ইয়াসমিন, এ এ ১৮৬ লবনহ্রদ, কলকাতা ৪৮।
জামরুলতলা, বশিরহাট, চব্বিশ পরগ্ণা। প্রথম প্রকাশ সম্পর্কে জানা যায়না। ২য় সংখ্যা ২২ অক্টোবর, শুক্রবার ১৯৭১ এবং বাংলায় ৪ কার্তিক, ১৩৭৮ প্রকাশিত হয়। মায়ের ডাক ছিল বাংলাদেশের সংগ্রামী মহিলাদের একমাত্র মুখপত্র। মুক্তিযুদ্ধে মা বোনেরাও পিছিয়ে ছিলেন না। বাংলাদেশের প্রতিটি মায়ের প্রাণের কথা ও সংগ্রামী ভূমিকা ফুটে ওঠে ‘মায়ের ডাক’এর মাধ্যমে। প্রকাশিত হত প্রতি শুক্রবার। বাংলাদেশ সরকার রেজিস্টার্ড নং – ১৭, মূল্য ১৫ পয়সা, ৪ পৃষ্ঠা, ৫ কলামে প্রকাশিত হত। দ্বিতীয় সংখ্যার সম্পাদকীয় ‘শীত আসছে, মায়েরা তৈরি হোন’ ছিল। স্বাধীনতার পর বাগেরহাট থেকে সম্পাদিকা পত্রিকাটি পুনঃপ্রকাশ করেছিলেন।
[১৮০, ২২৯] হাসিনা আহমেদ
মিত্রবাহিনী
১৯৭১ সালের প্রেক্ষাপটে ‘মিত্রবাহিনী’ একটি পরিচিত শব্দ। এরা মূলত সেই ভারতীয় সৈন্য বাহিনী যারা স্বাধীনতাকামী বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন।
ভারত ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ও প্রধান মিত্রদেশ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে নির্বিচারে বাঙালি নিধন শুরু হলে লক্ষ লক্ষ বাঙালি জনতা সীমান্ত পেরিয়ে নিকটবর্তী ভারতীয় রাজ্যসমূহে পাড়ি জমায়। ভারত সরকার তাদের আশ্রয় প্রদান করে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সহায়তা দান করে।
কিন্তু এই সহায়তার পরেও ভারতীয় বাহিনী সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করেনি। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহে সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা দান করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে তারা প্রত্যক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। কিন্তু ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পশ্চিম সেক্টরে পাকিস্তান বাহিনী আক্রমন চালানোর পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। দ্রুত গঠিত হয় যৌথ বাহিনী। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত বাহিনীর হাতে দ্রুত পরাজিত হয় পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী। এই যৌথবাহিনীর হাতেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রমনা রেসকোর্সে আত্মসমর্পন করে জেনারেল নিয়াজীর নেতৃত্বে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী।
[৭৩] হারুন হাবীব
৩৬০
মুক্তবাংলা (১)
‘সাপ্তাহিক মুক্তবাংলা’ পত্রিকাটি সিলেট জেলায় বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামীদের মুখপত্র ছিল। ষষ্ঠ সংখ্যায় দেখা যায় পত্রিকার নামের নিচে বন্ধনীতে লেখা হয়েছে MUKTOBANGLA, The weekly mouth piece of the liberation movement of Bangladesh, Sylhet Zone. সিলেট জেলা সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আবুল হাসনাত সাদত খান মুক্তবাংলা সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি ও পরিচালক। তিনি সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদেরও আহবায়ক ছিলেন। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আকাদ্দস সিরাজুল ইসলাম সিলেট জেলার প্রখ্যাত সুসাহিত্যিক। আবুল হাসনাত কর্তৃক মুক্তবাংলা প্রেস থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। এ সাপ্তাহিকীটি সিলেট জেলা (করিমগঞ্জ) থেকে প্রকাশিত। তাছাড়া এটী আসাম থেকেও প্রকাশ হত। ভারতীয় ঠিকানাঃ প্রযত্নে এ এম চৌধুরী, করিমগঞ্জ, আসাম ছিল। পত্রিকাটির শুভেচ্ছামূলঅ্যা ২০ পয়সা। লন্ডনে সডাহ ১.০০ (এক) টাকা। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪ এবং কলাম সংখ্যাও ৪ ছিল। ছাপাও ছিল সুন্দর ও ঝকঝকে। প্রথম প্রকাশ ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। মুক্তবাংলার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামে সিলেট জেলার বিভিন্ন রণাঙ্গনে সিলেট জেলার ভূমিকাকে যথাযোগ্যভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরা – অর্থাৎ সিলেট জেলার বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিসেনাদের তৎপরতা এবং জেলার জনসাধারণের প্রকৃত মনোভাব প্রবাসী সিলেটিরা যাতে সঠিকভাবে বুঝতে পারেন তার চেষ্টা করা। ৩য় সংখ্যা প্রকাশিত হয় ৪ অক্টোবর ১৯৭১ এবং এর প্রধান সংবাদ শিরোনাম ‘জয় নিপীড়িত প্রাণ! জয় নব অভিযান! জয় নব উত্থান’ দেখা যায়। আর ২৭ নভেম্বর দশম সংখ্যায় ‘বাংলার জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে এখন চতুর্দিকে যুদ্ধ চলছে’, ‘সিলেটে হার্মাদেরা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ’, ‘জকিগঞ্জে বেসামরিক প্রশাসন চালু হয়েছে’ এবং ‘বাংলাদেশের স্বীকৃতি আসন্ন’ সংবাদ শিরোনাম।
[৪৮০, ৪৮১] হাসিনা আহমেদ
মুক্তবাংলা (২)
”মুক্তবাংলার’ সম্পাদনায় ‘দ-জ’। সম্পাদকের নাম পত্রিকাটিতে সাংকেতিক ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং প্রকাশকের ঠিকানা গোপন রাখা হয়েছে। মুক্তবাংলা প্রকাশনী, বাংলাদেশ। পত্রিকাটি শত্রুসেনা পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের কোন স্থান থেকে সাইক্লোস্টাইলে প্রকাশিত একপাতার ক্ষুদে পত্রিকা। এটা একটা বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা বলে প্রতীয়মান হয়। বর্ষ ও সংখ্যা অনুল্লেখিত। ২৩ অক্টোবর, ১৯৭১ এ প্রকাশিত একটি সংবাদ শিরোনাম ‘আত্মসমর্পনের হিড়িক’ ছিল।
[১৫৫] হাসিনা আহমেদ
৩৬১
মুক্তি (১)
মুক্তি সম্পাদক শরিফউদ্দীন আহমেদ। এটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মাসিক সাহিত্যপত্র। প্রদীপ্ত সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত। পত্রিকাটি শত্রুসেনা পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের যে কোন স্থান থেকে প্রকাশিত হয়। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১ কার্তিক, ১৩৭৮ (অক্টোবর ১৯৭১)। এই সংখ্যার সম্পাদকীয়- বাংলাদেশে আজ যুদ্ধ। যুদ্ধের পটভূমিতে সাহত্য রচনা আজ বাংলার লেখক লেখিকাদের অবশ্য কর্তব্য। অধিকৃত বাংলার প্রগতিবাদী সাহিত্যিকরা যুদ্ধের মাঠে অস্ত্র ধরেছে। অস্ত্রের ভাষায় কলম ধরেছে। তারই কলম এই ‘মুক্তি’ পত্রিকা। এই মাসিক সাহিত্যপত্রটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে গণসাহিত্য ছিল।
[১৫৫, ১৭৫] হাসিনা আহমেদ
মুক্তি (২)
‘মুক্তি’ একটি পাক্ষিক সাময়িকী। সম্পাদক ছিলেন সাহাবুদ্দিন খান। প্রথম প্রকাশ ২ অগ্রহায়ন ১৩৭৮। পত্রিকাটি সাইক্লোস্টাইল করে ঢাকার আড়াইহাজার থেকে প্রকাশিত হত।
[১৭৫] হাসিনা আহমেদ
মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এবং ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মধ্যে দিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। এই সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম ছিল বিভিন্ন ঘটনা, বিরূপ পরিস্থিতি ও গুরুতর বিষয়ের কারণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের ক্রমাগত অবনতির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ দের নিকট থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মধ্যে যেসব ইস্যুতে সম্পর্কের অবনতি ঘটে , সেগুলোর মধ্যে ছিল ভূমি সংস্কার, রাষ্ট্রভাষা , অর্থনীতি ও প্রসাশনের ক্ষেত্রে দুই প্রদেশের মধ্যে বৈষম্য, প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা এবং এতদসংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়।
১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ টি আসনের ১৬৭ টিতেই আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে এবং আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের একক প্রতিনিধিউ হিসেবে আবির্ভুত হন। পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করে। ১৯৭১ এর ৭ মার্চ শেখ মুজিব যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, তাতেই পাকিস্তানের সামরিক জান্তার নিকট তাঁর মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরপর শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ইতিমধ্যে সমস্যা নিরসনের জন্য শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়।
৩৬২
আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যায় এবং ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ মধ্য রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালি হত্যার কর্মযজ্ঞ শুরু করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যেসব বাঙালি সৈন্য ছিল এবং আধা সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা তাৎক্ষণিক ভাবে জনগণের মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে।
২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে অর্থাৎ ২৫ মার্চ দিবাগত রাত একটায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বাঙালিদের উপর অপারেশন চালাবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী দুটি সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর তত্ত্বাবধানে প্রথম দপ্তরটি গঠিত হয়। এখানে ৫৭ তম ব্রিগ্রডের ব্রিগেডিয়ারকে শুধু ঢাকা নগরী ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় এবং মেজর জেনারেল খাদিম রাজাকে প্রদেশের অবশিষ্টাংশের অপারেশনের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়। অপারেশনের সার্বিক দ্বায়িত্বে থাকেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান।
ছাত্ররা এবং স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনরত রাজনৈতিক কর্মীরা ক্যান্টনমেন্টের বাইরে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের অভিযান ঠেকাতে রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবন্ধক তৈরি করা হয়। ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা ওয়্যারলেস বসানো জিপ ও ট্রাকে করে ঢাকার রাস্তায় নেমে পড়ে। তাদের প্রথম সাঁজোয়া বহরটি ঢাকার ক্যানটনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এক কিলোমিটারের মধ্যে ফার্মগেট এলাকায় ব্যারিকেডের মুখে পড়ে। রাস্তার এপাশ ওপাশ জুড়ে সেখানে ফেলা ছিল এক বিশাল গাছের গুঁড়ি। অকেজো পুরানো গাড়ি ও অচল স্টিম রোলারও ব্যারিকেডের কাজে ব্যবহার করা হয়। কয়েকশ লোক প্রায় ১৫ মিনিট ধরে জয়বাংলা শ্লোগান দেয়। তবে সেনাদের গুলি দ্রুতই তাদের নিস্তব্ধ করে দেয়, সেনাবহর শহরময় ছড়িয়ে শুরু করে গণহত্যা।
পাকিস্তানি সৈন্যরা রাস্তায় ফুটপাতে যাকেই দেখতে পায় তাকেই হত্যা করে, সামনে পড়া সবকিছু ধ্বংসের হুমকি দেয়। বাছবিচার না করে শহরের মানুষ ও সরকারি বেসরকারি সব ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত করে চষে বেড়ায় সৈন্যদের ট্যাংক। কামান ও বন্দুকের গোলায় ধ্বংস করে বহু আবাসিক এলাকা, সেগুলোতে আগুণ ধরিয়ে দেয়। সৈন্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ঢুকে অনেক ছাত্রকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। পুরান ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় তারা হামলা চালায়, অসংখ্য মানুষ হতযা করে। বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় ও লুটপাট করে, মহিলাদের ধর্ষণ করে। নিরস্ত্র জনগণের উপর এই গণহত্যা অভিযান বিশ্বের সংবাদমাধ্যম গুলো প্রচার করে।
২৬ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের
৩৬৩
সকল এলাকায় স্বাধীনতার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান গড়ে ওঠে। এই অভ্যুত্থানে অংশ নেয় সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী, রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র শিক্ষক, কৃষক, পেশাজীবী নির্বিশেষে সকল শ্রেনীর মানুষ। পাকবাহিনীর আক্রমন ও গণহত্যা মোকাবেলার জন্য গড়ে তোলা প্রতিরোধ প্রাথমিক পর্যায়ে স্বল্পস্থায়ী হয়। শত্রুসেনারা সংখ্যায় অনেক ও তারা ছিল অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত, তাই মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যায়। শিগগিরই ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া বিচ্ছিন্ন মুক্তিসংগ্রামীদের অস্থায়ীভাবে একটি কমান্ডের অধীনে আনা হয়।
এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে মুক্তিবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চা বাগানে পরিবৃত আধা পাহাড়ি এলাকা তেলিয়াপাড়ায় অবস্থিত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের সদর দপ্তরে একত্রিত হন। কর্ণেল এমএ জি ওসমানী, লে. কর্ণেল আবদুর রব, লে. কর্নীল সালাহউদ্দিন মোহাম্মদ রেজা, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর শাফায়েত জামিল, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী এবং আরো অনেকে সেখানে উপস্থিত হন। এ সভায় ৪ জন সিনিয়র কমান্ডারকে অপারেশনের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়। মেজর শফিউল্লাহকে সিলেট-ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া অঞ্চলের অধিনায়কের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়। কুমিল্লা নোয়াখালি অঞ্চলের দ্বায়িত্ব পান মেজর খালেদ মোশাররফ। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের দ্বায়িত্ব পান মেজর জিয়াউর রহমান। এবং কুষ্টিয়া যশোর অঞ্চলের অধিনায়ক হন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। এ সভাতেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী বাহিনী সম্পর্কিত সাংগঠনিক ধারনা এবং কমান্ড কাঠামোর রূপরেখা প্রনীত হয়। কর্নেল এম এ জি ওস্মানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বময় নেতৃত্ব দেওয়া হয়।
১০ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের একটি প্রবাসী সরকার মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। পরদিনই তাজউদ্দিন আহমদ আরো ৩ জন আঞ্চলিক অধিনায়কের নাম ঘোষণা করেন। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ রংপুর অঞ্চলের, মেজর নাজমুল হক দিনাজপর, রাজশাহী ও পাবনা অঞ্চলের এবং মেজর এম এ জলিল বরিশাল পটুয়াখালি অঞ্চলের অধিনায়কত্ব পান। প্রতিটি অঞ্চলকে এক একটি সেক্টর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১০-১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত সেক্টর কমান্ডার দের এক সম্মেলনে অপারেশন চাল;আনোর সুবিধার্থে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১ টি সেক্টর ও বিভিন্ন সাব সেক্টরে বিভক্ত করা হয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৭ মার্চ বাঙালিদের সংগ্রামের প্রতি তাঁর সরকারের সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) অত্যাচারিত ঈ ভীতসন্ত্রস্ত বাঙালিদের নিরাপদ আশ্রয় প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা
৩৬৪
রাজ্যের সরকার গুলো সীমান্তে শরণার্থী শিবির স্থাপন করে। এ শিবিরগুলো থেকে তাৎক্ষণিক ভাবে মুক্তিযোদ্ধা বাছাই করা হত। পাকিস্তানিদের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার অদম্য বাসনায় ছাত্র শিক্ষক কৃষক শ্রমিক ও রাজনৈতিক কর্মীরা মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেযুদ্ধের কৌশল, অস্ত্র চালনা এবং বিস্ফোরক সম্পর্কে প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের বিভিন্ন সেক্টরে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিয়োজিত করা হয়। কলকাতায় ৮ নং থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। ১২ এপ্রিল থেকে এই সদর দপ্তর কার্যক্রম শুরু করে। লে. কর্নেল এম এ রব এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে যথাক্রমে চিফ অফ স্টাফ নিয়োগ করা হয়।
পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি আরো অনেক বাহিনী গঠিত হয়। এসকল বাহিনীর মধ্যে টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনী, সিরাজগঞ্জের রফিক মির্জা বাহিনী, ঝিনাইদহের আকবর হোসেন বাহিনী, ফরিদপুরের হেমায়েত বাহিনী, বরিশালের কুদ্দুস মোল্লা বাহিনী ও গফুর বাহিনী এবং ময়মনসিংহের আফসার বাহিনী ও আফতাব বাহিনী উল্লেখযোগ্য। এ সকল বাহিনী স্থানীয়ভাবে সংগঠিত হয়ে নিজেদের শিক্তিতে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ শিকদার বরিশালে তার বাহিনীকে সংগঠিত করেন। ভারতের সেনাবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল ওবানের সক্রিয় সহযোগিতায় মুজিব বাহিনী নামে আরেকটি বাহিনী গঠিত হয়। মুজিব বাহিনীর সদস্যদের দেরাদুনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক এবং সিরাজুল আলম খান এই বাহিনীর সংগঠক।
মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত এবং অনিয়মিত এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। অনিয়মিত বাহিনী গণবাহিনী নামে পরিচিত ছিল। নিয়মিত বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পূর্বপাকিস্তান রাইফেলসের সদস্যরা। ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর বিভিন্ন সেক্টরে গণবাহিনীতে নিয়োগ করা হত।
গণবাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শত্রুর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য পাঠানো হয়। নিয়মিত বাহিনীর সদস্যরা সশস্ত্র বাহিনীর প্রথাগত যুদ্ধে নিয়োজিত ছিলেন। ‘জেড ফোর্স’ নামে পরিচিত নিয়মিত বাহিনীর প্রথম ব্রিগেডটি জুলাই মাসে গঠিত হয়। এই ব্রিগেডের কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমানের নামের ইংরেজি আদ্যাক্ষর জেড অনুসারে ব্রিগেডটির নামকরণ করা হয়। ব্রিগেডটি ১ম, ৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত হয়। ‘এস ফোর্স’ নামে পরিচিত দ্বিতীয় নিয়মিত ব্রিগেডটি ২য় ও একাদশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের নিয়ে অক্টবরে গঠিত হয়। এ ব্রিগেডের অধিনায়ক
৩৬৫
ছিলেন শফিউল্লাহ। খালেদ মোশাররফের অধিনায়কত্বে ‘কে ফোর্স’ গঠিত হয় ৪র্থ, ৯ম, ও ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের সদস্যদের নিয়ে।
নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হয়। এবং এর সংগঠক ছিলেন এয়ার কমোডর এ কে খন্দকার। স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লে. বদরুল আলম, ক্যাপ্টেন খালেক, সাত্তার, শাবুদ্দিন, মুকিত, আকরাম, শরফুদীন এবং ৬৭ জন বিমানসেনা নিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। তাঁদের সম্বল ছিল মাত্র কয়েকটি ডাকোটা, অটার টাইপ বিমান, এবং অ্যালুভেট হেলকপ্টার। অনুরূপভাবে পাকিস্তান নৌবাহিনী থেকে বেরিয়ে নোউ সেনাদের নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ নৌ বাহিনী। ১৯৭১ সালের ৯ নভেম্বর প্রথম নৌবহর ‘বঙ্গবন্ধু নৌবহর’ উদ্বোধন করা হয়। এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল মাত্র ৬ টি ছোট নৌযান।
নিয়মিত ব্রিগেড, সেক্তর ট্রুপ ও গেরিলা বাহিনী, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনী নিয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সুসংগঠিত ছিল। মুক্তিবাহিনী শুরুতে প্রতিরোধ মূলক অনেক গুলো যুদ্ধে শত্রুর সাথা সফল্ভাবে লড়াই করে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে তাদের সামরিক পশ্চাদপসরণ করতে হয়। মুক্তিবাহিনী অবশ্য পরে সংগঠিত হয়ে উচ্চতর অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে একাত্তরের এপ্রিল মে মাসের পর থেকে নব উদ্দীপনায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অন্তর্জাতিক পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণপ্রজাতন্ত্রী চীনপাকিস্তানকে কৌশলগত সমর্থন দেয়। পক্ষান্তরে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তাদের মিত্র দেশ সমূহ এবং জাপান ও পাশ্চিমের অনেক দেশের সাধারণ গনগণ বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়। চীন-যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান অক্ষের বিরুদ্ধে কৌশলগত সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট ভারত সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে একটি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়।
এদিকে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কৌশল পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হয়। চিরাচরিত রণকৌশল পাকিস্তানি সৈন্যদের পরাজিত করার পক্ষে অনুকূল হবেনা ভেবে সারাদেশে সর্বাত্মক গ্রতিলা যুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে মতে সেক্টর কমান্ডারদের দেশের অভ্যন্তর থেকে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়।
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড গঠিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লে. জগজিৎ সিং অরোরা যৌথ বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। অবশ্য ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় অমৃতসর, শ্রীনগর ও কাশ্মীর উপত্যকায় পাকিস্তান বিমানবাহিনীর
৩৬৬
বোমাবর্ষনের পর থেকেই মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড কার্যকর ভূমিকা গ্রহন করে। তখনই ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর উপর নিদ্দেশ আসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে প্রত্যাঘাত করার। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ক্রমশ অগ্রসর হতে থাকে। ফলে পাকিস্তানি সৈন্যদের দের পরাজয় ও আত্মসমর্পন অনিবার্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হবার প্রাক্কালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন এতে ভেটো প্রয়োগ করায় এই প্রচেষ্টা নস্যাৎ হয়ে যায়। ভারতীয় সৈন্য এবং ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ১৪ ডিসেম্বর ঢাকার টঙ্গীর কাছে পৌঁছান। ১৬ ডিসেম্বর সকালে তাঁরা সাভারে অবস্থান নেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৬ নম্বর ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল জামশেদ ঢাকা নগরীর সন্নিকটে মিরপুর সেতুর কাছে ভারতীয় অধিনায়ক মেজর জেনারেল নাগরাকে অভ্যর্থনা জানান। সকাল ১০ টায় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সৈন্যরা ঢাকায় প্রবেশ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পনের খসড়া দলিল নিয়ে অপরাহ্ন এক ঘটিকায় ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। লে. জেনারেল অরোরা এক হেলিকপ্টার বহরে তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে বিকাল ৪ টায় ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছেন। মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। পরাজিত পাকিস্তানি অধিনায়ক লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজীলে. জেনারেল অরোরাকে আত্মসমর্পন সূচক অভ্যর্থনা জানান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটা এক মিনিটে রমনা রেসকোর্সে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যৌথ কমান্ডের পক্ষে লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের পক্ষে লে. জেনারেল নিয়াজী পাকিস্তানের আত্মসমর্পনের দলিলে স্বাক্ষর করেন।
[১৩১] রফিকুল ইসলাম
মুক্তিযুদ্ধ
‘মুক্তিযুদ্ধ’ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র। সম্পাদকের নাম সাংকেতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এবং প্রকাশকের ঠিকানা গোপন রাখা হয়েছে। এ সাপ্তাহিক পত্রিকাটি পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক প্রকাশিত ও মুক্তিযুদ্ধ প্রেস বাংলাদেশ হতে মুদ্রিত। প্রথম প্রকাশিত হয় জুলাই, ১৯৭১, রোববার পর্যন্ত এর ২৫ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রতি সংখ্যার মূল্য ১০ পয়সা এবং এর কলামসংখ্যা ৫। দুই রং এ ছাপা এই পত্রিকাটিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সামরিক সংবাদ ছাড়াও থাকত কিছু কিছু সুচিন্তিত বিশ্লেষক নিবন্ধ।
৩৬৭
অনিল মুখার্জি লিখিত ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি’ নামক গ্রন্থটি এই পত্রিকাতেই প্রথম ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। ২৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত পত্রিকার প্রথম শিরোনাম’মুক্তির আনন্দে উচ্ছ্বল সোনার বাংলা’ এবং সম্পাদকীয় ‘ইয়াহিয়ার সাথে ভুট্টোর বিচার চাই’ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই পত্রিকাটির ভূমিকা ছিল স্মরণীয়। বাঙালীর চলমান আন্দোলন সম্পর্কে বিশ্ববাসীর মতামত, দেশের পরিস্থিতি, মুক্তিসংগ্রাম সংগঠিত হওয়ার ঘটনাবলী জনগণ খুব সহজেই এর মাধ্যমে পেয়ে যেত।
[৪৮২, ৪৮৩] হাসিনা আহমেদ
মুক্তিযুদ্ধ ও আফগানিস্তান-ইরান
আফগানিস্তানের সরকারকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করানো ও আফগান জনগণের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিষয়ে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার আফগানিস্তানেও একটি কূটনৈতিক মিশন পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭১ সালের ২৯ জুন পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম (চাষী) মোহাম্মদ আব্দুস সামাদ আজাদকে এ বিষয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেন। এ প্রতিনিধিদলে অন্য সদস্যগণ ছিলেন সর্বজনাব আশরাফ আলী চৌধুরী, এম এন এ মওলানা খায়রুল ইসলাম যশোরী ও অ্যাডভোকেট নূরুল কাদের। ২৭ আগস্ট আব্দুস সামাদ আজাদ ও নূরুল কাদের কাবুলে পৌঁছান। আফগানিস্তানে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত কে এল মেহতা ও কূটনীতিক সালমান হায়দার ও এইচ কে খান আফাগআনিস্তানে প্রচার কাজে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনকে সার্বিকভাবে সহায়তা করেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা আফগানিস্তানের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ডায়েরি অন বাংলাদেশ ও রিফিউজি ৭১ নামের দুটো ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাকিস্তানি নির্যাতন তুলে ধরা হয়। অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকার কাটিংও প্রদর্শন করা হয়। আফগানিস্তানের রাজা জহির শাহ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুসা শফিক ও পাখতুন নেতা আব্দুল গাফফার খানের সাথে বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণ দেখা করে দেশের পরিস্থিতি তুলে ধরেন এবং মুক্তিযুদ্ধে আফগানিস্তানের সহযোগিতা কামনা করেন। এ প্রতিনিধিদল কাবুলের পাকিস্তান দূতাবাস কর্তৃক বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণার জবাব দেন।
১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানে প্রেরিত বাংলাদেশের বিশেষ কূটনীতিক অ্যাডভোকেট নূরুল কাদের কাবুল থেকে তেহরান গমন করেন। তেহরানের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এম এ রহমানের সহযোহিতায় ইরানের শাহান শাহও প্রধানম্নত্রীর কাছেমুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ব্যাখ্যা করে জনাব নূরুল কাদের দীর্ঘ চিঠি লেখেন। এতে তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনের পক্ষে ইরানের সরকার ও জনগণের
৩৬৮
সহায়তা কামনা করেন। ইরান সরকার এক পর্যায়ে পাকিস্তানপন্থী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরবদেশীয় জাহেদীকে বাদ দিয়ে উদারপন্থী আব্বাস আলী খালাত বারীকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ দেন। ১৫ সেপ্টেম্বর ইরানের ভারতীয় দূতাবাসের প্রথম সচিব শৈলেন্দ ঘোষের বাসভবনে কয়েকজন সাংবাদিক ও কূটনীতিকের সাথে আলোচনায় নূরুল কাদের বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন। এছাড়া তিনি তেহরানের পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি কূটনীতিক ও কর্মচারীদের সাথে গোপনে যোগাযোগ করে তাদের বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশের অনুরোধ জানান। কিন্তু বাঙালি কূটনীতিকদের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। ২২ সেপ্টেম্বর জনাব নূরুল কাদের তেহরান ত্যাগ করেন।
[৯৬] মো. ফায়েক-উজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ ও ইন্দোনেশিয়া
অধিকাংশ মুসলিম দেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানপ্নথী ভূমিকার বিপরীতে বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার মধ্যপন্থী, ভারসাম্য মূলক, সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরামর্শ, কখনো বা মধ্যস্থতার প্রস্তাব ছিল উল্লেখযোগ্য। সর্বোপরি একাত্তরের ডিসেম্বর মাসে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলে জাতিসংঘে ইন্দোনেশিয়া রেখেছে নিরপেক্ষ ভূমিকা।
মুক্তিযুদ্ধে ইন্দোনেশিয়ার ভূমিকা তিন পর্বে বিভিক্ত ছিল। প্রথম পর্বে ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়া সরকার শুধু মামুলি বিবৃতির মাধ্যমে পাকিস্তান সমস্যাকে ‘অভ্যন্তরীন বিষয়’, ‘পাকিস্তানের সংহতির’ পক্ষে মতামত দেয়। সামরিক শাসনে মিছিল নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে ইন্দোনেশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০ ছাত্রের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক হত্যার প্রতিবাদে মিছিল, পত্র পত্রিকায় লেখালিখি, বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ ও বিরোধী দলের বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ভূমিকায় সরকারের ভুল ভাঙতে থাকে। সর্বোপরি এপ্রিল-জুন মাসে ইন্দোনেশিয়ার জনপ্রিয় পত্রিকা Pedomen of Indonesia এর সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আলামুদ্দির ৬ সপ্তাহব্যাপী ইউরোপ ও ভারত সফর শেষে ১৩ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আদম মালিকের সঙ্গে বৈঠক ও মন্ত্রণালয়ে পেশ করা প্রতিবেদন সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটায়। পররাষ্টড় মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করেন, পাকিস্তানের জনগণের বড় অংশ বাঙালি মাত্রেই উপলব্ধি করেছে পাকিস্তানের সংহতি চিরতরে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এর পরপরই ইন্দোনেশিয়া সংসদের স্পীকার Achmed Sjaicho এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মোহাম্মদ নাটচির পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে প্রেরিত এক বার্তায় পাকিস্তান সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহবান জানান। জুলাই মাসে ইন্দোনেশিয়া সরকার পাকিস্তান সংক্রান্ত সংবাদ ছাপানোর উপর
৩৬৯
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা ছাড়াও ইন্দোনেশীয় টিভি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করে। সাক্ষাৎকারে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন। এর ফলে সংবাদপত্র গুলোতে বাংলাদেশ বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ বৃদ্ধি পায়। বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা আরো সোচ্চার হন এবং ইন্দোনেশিয়ার প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন ‘আমরা’ সক্রিয় হয়।
সরকারের পাকিস্তান নীতিতে দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তনের ফলে আগস্ট মাসে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ইন্দোনেশিয়ার নীতির দ্বিতীয় পর্ব। পরের মাসে ইন্দোনেশিয়া সরকার ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থী পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে। রুশ-ভারত চুক্তি স্বাক্ষরের ৪ দিনের মধ্যে ১২ আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী শরণ সিং জাকার্তা উপস্থিত হন। সফর শেষে স্বাক্ষরিত যুক্ত ইশতেহারে উভয় সরকার একমত হয়, ‘পূর্ব পয়াকিস্তানের’ অবস্থার উন্নতির উপরই শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাওয়া নির্ভর করে। পরের মাসে ভারতের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী বিষয়ক সহযোগিতা , দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বিষয়ে সেমিনারে ইন্দোনেশিয়ার প্রতিনিধির অংশগ্রহন, অক্টোবরে পাকিস্তান সরকারের ৪ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের জাকার্তার ব্যর্থ সফর থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ইন্দোনেশিয়া পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার ধারণা থেকে দূরে সরে এসেছে।
তৃতীয় পর্বে জাতিসংঘে ইন্দোনেশিয়ার শান্তির পক্ষে এবং যুদ্ধ বন্ধের সকল উদ্যোগে ভূমিকা পালন উল্লেখ করা যায়। অক্টোবর মাস থেকে ইন্দোনেশিয়াও উদ্যোগ অব্যাহত রাখে এবং এ মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মালিক যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অধিবেশনের আহবান জানান। তবে ৩ ডিসেম্বর চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২৬ তম অধিবেশনে যুদ্ধবিরতি, শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বিষয়ে যে আলোচনা হয়, তাতে ইন্দোনেশিয়া অংশ নেয়। ৭ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির পক্ষে ইন্দোনেশিয়া সহ ১৪ টি দেশ খসড়া প্রস্তাব দেয়। ৭ ডিসেম্বর মন্ত্রীসভার বৈঠক শেষে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট বারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধ বন্ধে তার দেশের মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেন। পরের দিন ইন্দোনেশিয়ার একজন সরকারি মুখপাত্র জানান, তার সরকার যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকবে এবং যেকোন দেশের সামরিক সাহায্য প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে।
এভাবে প্রথম থেকে শেশ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়া ভারসাম্যমূলক ভূমিকা গ্রহন করে। মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশ জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক পদক্ষেপকে সমর্থন দিলেও ইন্দোনেশিয়া এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি। পাকিস্তান বেশ কয়েকটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে ভারত মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের এলাকা ইন্দোনেশিয়ার সরাসরি হস্তক্ষেপ
৩৭০
কামনা করলেও ইন্দোনেশিয়া শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের প্রতি মত ব্যক্ত করে।
[১৯০] আবু মো. দেলোয়ার হোসেন
মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)
ওআইসির করাচি সম্মেলনের মাত্র তিনমাসের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ওআইসিতে পাকিস্তানের গুরুত্ব ও পাকিস্তান কর্তৃক পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী তৎপরতার সঙ্গে সংস্থা দ্বিমত পোষণ করেনি। প্রথম থেকেই পাকিস্তান ওআইসির সদস্যদের সমর্থনের জন্য মুক্তিযুদ্ধকে পরিকল্পিত ভাবে ভারত ও ইজরাইলের প্ররোচনায় ‘মুসলিম সংহতি’ বিনষ্টের প্রচেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত করে। বিচিত্র রাষ্ট্র কাঠামোর ও আই সি এর সদস্য দেশ গুলো পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় ঐক্মত্য প্রকাশ করতে কুন্ঠিত হয়নি। মূলত, নবপ্রতিষ্ঠিত সংস্থার ভাঙন রোধ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন তাদের সন্দিহান করে তোলে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার তিনদিনের মধ্যে ২৯ মার্চ সংস্থার মহাসচিব টেংকু আব্দুর রহমান এক বিবৃতিতে ‘পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাকে’ পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যা’ বলে মন্তব্য করেন। ভারতকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আমি মনে করি বাইরের কোন দেশের এতে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। এই বিবৃতির পর ৩০ মার্চ ও আই সি এর সদস্য আরব আমিরাত অনুরূপ মতামত ব্যক্ত করে। ও আই সি এর সবচেয়ে বেশি বৈঠক হয় ১৯৭১ সালে। এপ্রিলে ইরানে ইসলামিক সংবাদ সংস্থা বৈঠক, জুনের প্রথমদিকে মরক্কোতে ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের বৈঠক এবং জুনের শেষ নাগাদ জেদ্দায় ও আই সি সম্মেলনের চার্টারের খসড়া সংক্রান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেপ্টেম্বরে কাবুলে তৃতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও আফগানিস্তানে দুর্ভিক্ষের কারণে তা অনুষ্ঠিত হয়নি। এসব সম্মেলনের মধ্যে ইরান ও মরক্কো সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান ইস্যু আলোচনায় না এলেও পাকিস্তান মুসলিম বিশ্বের কাছাকাছি আসার সুযোগ পায় এবং বৈঠকে যোগদানকারী সদস্যদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানের তৎপরতার সাফল্য বয়ে আনে জুনের শেষদিকে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত জেদ্দা সম্মেলনে (২৪-২৬ জুন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়)। এই সম্মেলনে ও আই সি এর সনদ চূড়ান্ত হয়। সম্মেলনের প্রাক্কালে মহাসচিব তার ২৯ মার্চ দেওয়া বিবৃতির পুনরাবৃতি করেন এবং পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন। মুসলিম বিশ্বের কাছে পাকিস্তানি জনগণকে সাহায্যের আবেদন জানান। অবশ্য এখানে তিনি পাকিস্তান জনগণ বলতে পাকিস্তানপন্থী না বাংলাদেশপন্থীদের
৩৭১
বোঝাতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট ছিলনা। তবে ও আই সি এর কর্মকান্ড থেকে মনে হয় তিনি পাকিস্তানের জন্যেই সাহায্য চেয়েছেন। অবশ্য সম্মেলনের প্রাক্কালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারও সদস্যদের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও আই সি এর সদস্যদের উদ্দেশ্য করে বলেনঃ
“It is a tragic error on their part to think that Yahya’s orders are waging a war of Islamic rightousness in Bangladesh. Their silence, therefore, condones colonialism and barbarism. Materials support to Islamabad puts them on the side of dictatorship”
সম্মেলন চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংস্থার কাছে প্রেরিত তারবার্তায় পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নৃশংস হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তারের জন্য সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেনঃ
“বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের শতকরা ৮০ ভাগ মুসলমান। ইয়াহিয়া সরকার জনগণের নির্বাচনের রায়কে অগ্রাহ্য করে বিশ্বাসঘাতকের মত অন্যায় যুদ্ধ শুরু করেছে বলেই বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার ঘোষণা করেছে। তারা ১০ লাখের বেশি লোককে হত্যা করেছে। ৬০ লাখের বেশি লোক গৃহ হারা হয়ে দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদাররা মসজিদ সমূহ ধ্বংস করেছে, মসজিদের ইমামদের এবং নামাযরত মুসলমানদের গুলি করে হত্যা করেছে। আর তারা এসব করেছে ইসলামের নামেই।”
এছাড়া সম্মেলন চলাকালে ২৬ জুন নয়াদিল্লিস্থ বাংলাদেশের কূটনীতিক কে এম শিহাবুদ্দিন জেদ্দা সম্মেলনের সদস্যদের বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের আহবান জানান। বাঙালির উপর পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ তুলে ধরে তিনি বলেনঃ
“The question of living together with Pakistan buchers, who have shed the blood of millions of our innocent people and who have disrupted our economy does not arise. I emphasize again that pakistan is dead and buried under the bodies of martyrs.”
বাংলাদেশের এসব উদ্যোগ ও আহবান মুসলিম বিশ্বের নেতাদের মধ্যে কোন সহানুভুতি সৃষ্টি করেনি। তারা মুসলিম উম্মাহর সংহতি রক্ষায় পাকিস্তানকে বিব্রত না করার নীতি গ্রহন করে। বাংলাদেশের প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনের কোন চেষ্ঠা না করেই পাকিস্তানের প্রতি একতরফা সমর্থন অব্যাহত রাখে। সম্মেলন শেষে ১ জুলাই প্রকাশিত যুক্ত ইশতেহারে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশী হস্তক্ষেপের নিন্দা এবং পাকিস্তানের ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষার ন্যায়সঙ্গত প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানান। অধিকাংশ সদস্য পাকিস্তানকে সহযোগিতার মত ব্যক্ত করে। ইরান সঙ্কটকালে সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করার ইচ্ছে ব্যক্ত করে।
৩৭২
কারণ ইসলামী সংহতি রক্ষার জন্য তা জেহাদের মত নৈতিক কর্তব্য।
জেদ্দা সম্মেলনে প্রকারন্তরে ভারতকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। বৈদেশিক হস্তক্ষেপ বলতে ভারতকে বোঝানো হয়েছে। অন্যদিকে সঙ্কটকালে পাকিস্তানের পাশে এসে দাঁড়ানোর আহবানও ভারতকে ভয় দেখানোর জন্য বলা হয়েছে। ভারত তেল সরবরাহে বিভিন্ন দিক দিয়ে ধনী আরব রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল থাকায় এ হুমকি দেয়া হয়। পাকিস্তানের গণমাধ্যমে যুক্ত ইশতেহারকে ভারতের ‘কূটনৈতিক পরাজয়’ হিসেবে আখ্যা দেয়। কারণ হিসেবে বলা হয়ঃ
১. ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পৃথিবীব্যাপী যে প্রচারাভিযান চালাচ্ছে এ ঘোষণার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে ভারত একঘরে হয়ে যাবে।
২. ভারতকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
৩. কোন কোন দেশ পাকিস্তানকে সরাসরি সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। এর ফলে পাকিস্তান যে একা নয়, সঙ্কটকালে সাহায্য ও সহযোগিতা পাওয়া যাবে তার নিশ্চয়তা পায়। ফলে মে মাস পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিক্ষিপ্তভাবে পাকিস্তানের অখন্ডতার জন্য বিবৃতি দিলেও ইসলামী সম্মেলনের পর মুসলিম বিশ্ব একযোগে পাকিস্তানের পক্ষ নেবার সুযোগ পায়। মুসলিম বিশ্বের নেতাদের পাকিস্তানে এবং পাকিস্তানের নেতাদের মুসলিম বিশ্বে যোগাযোগ বেড়ে যায়। বাঙালি জাতির জন্য সবচেয়ে দুঃখজনক হল দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হয়েও বাঙালির উপর গণহত্যা ও আই সি এর সদস্যদের মধ্যে সাড়া জাগায়নি। বরং এই সম্মেলনে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যাকে আইনসম্মত করা হয়েছে।
যদিও সম্মেলনের পরই কুয়েত, ইরান, জর্ডানের প্রতিনিধির সমম্বয়ে ও আই সি এর মহাসচিবের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত সফরের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়। জুলাইয়ে এই প্রতিনিধিরা ঢাকা সফর করেন। সফরকালে তারা বিভিন্ন এলাকা পরিদর্ষন ছাড়াও গভর্ণর টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। যদিও তারা বাঙালি হত্যা বন্ধে কোন ভূমিকা রাখেনি। ওয়াই সি এর এই মিশনের দুজন সদস্য সুলায়মান আবু দাউদ ও ইরানের রেজা তাখওয়াইকে ভারত সফরে অনুমতি না দেওয়ায় মহাসচিব পরিষ্কার জানিয়ে দেন, যেহেতু তিনি সংস্থার মহাসচিব হিসেবে এই সফর করছেন ব্যক্তিগত ভাবে কোন দেশের প্রতিনিধি হিসেবে নয়, তাই অন্যান্য সদস্য ছাড়া তার সফরের প্রশ্নই ওঠেনা। ৪ আগস্ট কুয়ালালামপুরে এক বিবৃতে ভারতের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন ও শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য সংস্থার আগ্রহ সত্ত্বেও ভারতের অনুমতির অভাবে তা করা সম্ভব হচ্ছেনা বলে অভিযোগ আনেন। তিনি শরণার্থী সমস্যা সমাধানে ভারতের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং বলেন, ‘পাকিস্তান নয়, ভারতের কারণেই সমস্যার সমাধান হচ্ছেনা।’ তিনি পাকিস্তানের মতো শরণার্থীদের সংখ্যা
৩৭৩
ভারতের ঘোষিত সংখ্যার চেয়ে অনেক কম বলে মন্তব্য করেন। তিনি পরিষ্কার বলেন, ভারত শরণার্থীদের সংখ্যা ৭.২ মিলিয়ন বললেও প্রকৃতপক্ষে তা ৪ মিলিয়নের বেশি হবেনা। অবশ্য ভারত সরকার মহাসচিবের বক্তব্য উড়িয়ে দেয়। এবং স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে, দুটি কারণে ভারত ইসলামী সংস্থার প্রতিনিধিদের গ্রহন করতে পারেনা।
১. ভারতে ৭০ মিলিয়ন মুসলমানের বসবাস হওয়া সত্ত্বেও এ সংস্থা কখনো ভারতের প্রতিনিধিকে গ্রহন করেনি।
২. ও আই সি বরাবর সাম্প্রদায়িক মনোভাব পোষণ করেছে। যদিও মহাসচিব ভারতের এই মনোভাব সত্ত্বেও পরেরদিনই ব্যক্তিগতভাবে ভারত সফর করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে নয়াদিল্লিতে বৈঠক করেন। এ সময় ভারতের পররাষ্ট্র দফতর জানিয়ে দেয় মহাসচিবের এই সফর ব্যক্তিগত সফর, সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে নয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের টেংকু আব্দুর রহমান জানান ও আই সি শরণার্থীদের সাহায্য করতে চায়েবং বৈঠকে তা আলোচিত হলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী কোণ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। মহাসচিবের এসব একপেশে বক্তব্য থেকে মনে হয় তিনি পাকিস্তানের ধারাতেই এগোচ্ছিলেন।
এরপর ইসলামী সম্মেলন সংস্থা পাকিস্তান ইস্যুতে সাংগঠনিকভাবে আর তেমন কোন উদ্যোগ নেয়নি। সেপ্টেম্বরে কাবুলে অনুষ্ঠিতব্য ও আই সি এর তৃতীয় সম্মেলনে হয়ত এ বিষয়টি বিস্তারিত আলোচিত হত। কিন্তু কাবুল সরকার ৬ আগস্ট সংস্থাকে জানিয়ে দেয়, আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারনে তারা সম্মেলন আয়োজন করতে পারবে না। এরপরই মহাসচিব কাবুল সম্মেলন স্থগিত করেন এবং জেদ্দায় ১৯৭২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ মার্চ পর্যন্ত এই সম্মেলনের দিন নির্ধারিত হয়। ও আই সি এরপর পাকিস্তান ইস্যুতে না জড়ালেও ও আই সি সংগঠকদের অন্যতম পাকিস্তানের অন্ধ সমর্থক সৌদি আরব, জর্ডান, ইরান, তুরস্ক, লিবিয়া পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি অংশ নেয়। মার্কিন কংগ্রেস পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করলে অক্টোবর থেকে নিক্সন প্রশাসন গোপনে এসব দেশের মাধ্যমে অস্ত্র সরবরাহ করতে থাকে। ইরান ৫২ টি মার্কিন ফ্যান্টম বিমান, লিবিয়া জেট বিমান, সৌদি আরব ৭৫ টি জঙ্গি বোমারু বিমান, জর্ডান ১০ টি এফ ১০৪ বিমান সরবরাহ করে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপত্র রবার্ট মেকলসকি এর সত্যতা স্বীকার করেন। এসব অস্ত্র ডিসেম্বরে চূড়ান্ত যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়।
উল্লিখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় যে, মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অজ্ঞতা, আরব বিশ্বের বিশেষ করে সৌদি আরব, জর্ডান, লিবিয়া, ইরানের, সামরিক বাহিনী পুনর্গঠনে পাকিস্তানের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা, সংস্থার মুসলিম উম্মার সংহতির ধারণা একাত্তরে পাকিস্তানপন্থী নীতি গ্রহনে অনুপ্রাণিত করে। পৃথকভাবে কয়েকটি দেশ যেমন ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মিশর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সামান্য
৩৭৪
সহানুভূতিশীল হলেও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তাদের নীতি ছিল পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার পক্ষে। মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রকাঠামো রাজতন্ত্র, স্বৈরাচারী ও সামরিক শাসন প্রভাবিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধের মত স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে জড়িয়ে নিজেদের দেশে জাতীয়তাবাদী, স্বৈরশাসন/সামরিক শাসন বুরিধী তৎপরতাকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে রাজি হননি। মুক্তিযুদ্ধের মতো পৃথিবী আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি ঘটনায় জাতিসংঘের বিতর্কে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোও সোচ্চার থাকার কথা সত্ত্বেও একপেশে ভূমিকা বাঙালি জাতির কাছে কাম্য ছিলনা। ভারতীয় দূতাবাস, মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা সত্ত্বেও মুসলিম বিশ্বের ভূমিকা ছিল রীতিমত ন্যক্কারজনক। মুসলিম বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় নীতির প্রতিফলন ঘটে ওআইসিতে। ওআইসির উদ্যোক্তা সৌদি আরব প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ানোর ফলে সৌদি আরবের উপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল ৩৩ দেশের অনেকগুলো বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও প্রকাশ্যে তার প্রতিফলন ঘটেনি।
অথচ ওআইসির নিরপেক্ষ ভূমিকা পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশে গণহত্যাকে বহুলাংশে কমিয়ে আনতে পারত। মুসলিম উম্মার কল্যান ও ভ্রাতৃত্বের গালভরা শ্লোগান দিলেও দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, মসজিদ ধ্বংস ওআইসির মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি। বরং ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্থগিত তৃতীয় ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলন ১৯৭২ সালে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে নগ্নভাবে ওআইসি পাকিস্তানের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ভূমিকা রাখে। ওআইসির এসব ভূমিকা বাঙালিকে ওআইসি সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব গ্রহনে বাধ্য করে। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ওআইসির সদস্য হওয়া পর্যন্ত ওআইসি বাংলাদেশের প্রতি এই মনোভাব অব্যাহত রাখে।
[৭৪] আবু মো. দেলোয়ার হোসেন
মুক্তিযুদ্ধ ও কমিউনিস্ট পার্টি
কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম ব্রিটিশ ভারতে, প্রায় সাত দশক আগে, রুশ বলশেভিক পার্টির প্রত্যক্ষ সাহায্য ও সহযোগিতায় ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল। ১৯২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর কানপুরে কমিউনিস্ট কনফারেন্সে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম গঠনতন্ত্র প্রকাশিত হয়। ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের প্রথম জেলা কমিটি গঠিত হয় পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ সরকার অনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করে। ১৯৪৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত ভারতের
৩৭৫
কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুসারে পাকিস্তান ভিত্তিক পার্টি অর্থাৎ পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি রূপ লাভ করে। এইসময় হাজঙ নানকার বিদ্রোহ পুনরায় শুরু হলে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায় এবং প্রচন্ড রকম নির্যাতন শুরু করে। ফলে কমিউনিস্ট পার্টি আত্মরক্ষার পর্যায়ে চলে যায়।
১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহীর সেন্ট্রাল জেলের খাপরা ওয়ার্ডে কমিউনিস্ট বন্দীদের উপর কারা কর্তৃপক্ষ নির্মমভাবে গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই ৭ জনের মৃত্যু হয়। ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান সরকার কমিউনিস্ট নেতাদের ওপর ‘রাওয়ালপিন্ডি’ ষড়যন্ত্র মামলা চালিয়ে দিয়ে কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী ইলা মিত্রের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ১৯৫০ সালে রাজশাহীর নাচোলে ঘটে ঐতিহাসিক ক্ররষক বিদ্রোহ। ১৯৫১ সালের কমিউনিস্ট পার্টির চেষ্টায় গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ। এই যুবলীগ ছিল তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল সংগঠন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন করে। ১৯৫৪ সালের জুলাই মাসে সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৫৬ সালে কলকাতায় পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ব পাকিস্তান কমিটির প্রথম কংগ্রেস গোপনে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬০-৬১ সালে আত্মগোপন অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টি এককভাবে আইয়ুব ও সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে যাওয়ার চেষ্টা করে। ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন করে। ১৯৬৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একপক্ষ কমরেড মণি সিংহ এর নেতৃত্বে মস্কোপন্থী নামে পরিচিতি পায়। অন্যপক্ষ চীনপন্থী নামে কাজ চালাতে থাকে। চীনাপন্থীদের একক কোন নেতা ছিলনা। ১৯৬৮ সালে মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৮ সালে করাচিতে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও আওয়ামী লীগের ঐক্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। এবং তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সংযুক্ত বিরোধী দল গড়ে ওঠে।
১৯৬৯ সালে ওয়ামী লীগের ৬ দফা ও ঐক্যবদ্ধ ছাত্রসমাজের ১১ দফা ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদের প্রবল গণআন্দোলনের মুখে তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন কাঠামো আদেশ ঘোষণা করলে কমিউনিস্ট পার্টি নিজে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে আওয়ামী
৩৭৬
লীগকে পুরপুরি সমর্থন দানের সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে ৩১৩ টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭ টি আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ট দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া ও পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো নির্বাচনী ফলাফলের ভিত্তিতে সংখ্যাগরিস্টহ দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলে কমিউনিস্ট পার্টি তার নিজস্ব অবস্থান থেকে সে ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে চেষ্টা চালায়।
১৯৭১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির এক প্রস্তাবে বলা হয়- “প্রেসিডেন্টের ঘোষণা মোতাবেক জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহবান, সেখানে জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি, সমন্বিত শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সে শাসনতন্ত্র অনুমোদন ও ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।” এই প্রস্তাবে নির্বাচনের রায়কে কার্যকর করতে না দেওয়া হলে বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলন একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দিকে যেতে পারে বলে সতর্কবানী উচ্চারণ করা হয়।
পয়লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার মাধ্যমে পাক শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র জনগণের নিকট পরিষ্কার হয়ে উঠল। পরিস্থিতি সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টির মূল্যায়ন ছিল যে, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালী জাতির এই অভ্যুত্থান দমন করার জন্য সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগ করবে এবং স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজন হবে। সেজন্য গনগণকে প্রস্তুত করা দরকার।”
কমিউনিস্ট পার্টি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেই নিজের দ্বায়িত্ব শেষ করেনি। ৭ মার্চ ১৯৭১, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্সের ঐতিহাসিক জনসভা থেকে “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” বলে ঘোষণা দিয়ে যে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করেন, কমিউনিস্ট পার্টি সে আন্দোলনকে সর্বাত্মক সমর্থন করে।
ইয়াহিয়া খান যখন ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় বসেন তখন কমিউনিস্ট পার্টি আলোচনার বিরোধিতা করাকে যুক্তিসঙ্গত মনে করেনি। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির মূল্যায়ন ছিল ঐ আলোচনায় কোন আপসরফা হবেনা। কেননা জনগণ স্বাধীনতার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছে এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি তা মেনে নিতে পারেনা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র, নিরপরাধ, অসহায় মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতা কমরেড মণি সিংহ ছিলেন রাজশাহী কারাগারে বন্দি। তিনি অন্যান্য বন্দির
৩৭৭
মতো জেল ভেঙে বের হয়ে নৌকাযোগে ভারতে পৌঁছান। কমিউনিস্ট পার্টির অন্যান্য নেতারা পরিস্থিতি অনুযায়ী দেশের ভিতরে থেকে প্রতিরোধ সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। এক পর্যায়ে ঢাকায় থাকা অসম্ভব এবং সবার থাকা অপ্রয়োজনীয় মনে হলে পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম, খোকা রায়, মোহাম্মদ ফরহাদ, জ্ঞান চক্রবর্তী, সাইফ উদ্দিন মানিক, মনজুরুল আহসান খান প্রমুখ ঢাকা জেলার বেলাব থানার রায়পুরায় ঘাঁটি করে অবস্থান করেন। রায়পুরা এলাকা পাকবাহিনীর পদানত হলে নেতৃবৃন্দ আশুগঞ্জে অবস্থান নেন। আশুগঞ্জে বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরোধ ভেঙে পড়লে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে তারা সীমান্ত অতিক্রম করেন।
পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমনের মুখে কমিউনিস্ট পার্টির প্রায় ৬ হাজার নেতাকর্মী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, ও মেঘালয় রাজ্যে আশ্রয় নেয়। ফলে গোটা পার্টির সংগঠন সাময়িক ভাবে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই সময় পার্টির প্রধান লক্ষ্য ছিল-
১. কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ ক্যাম্প স্থাপন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সহায়তায় ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহনকারীদের আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা,
২. বাংলাদেশ সরকারের সহায়তা গ্রহন ও ক্যাম্পে সংগঠিত তরুনদের সরকারের মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং-এ প্রেরণ।
৩. কমিউনিস্ট পার্টি , ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের সমন্বয়ে একটি নিজস্ব গেরিলাবাহিনী গঠন।
৪. কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ নামক একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ।
ভারতে যাওয়ার পরপরই ১৯৭১ সালের মে মাসে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম বৈঠকে স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌলিক চরিত্রসংগ্রামের শক্তি এবং শত্রু মিত্র প্রভৃতি সম্পর্কে মূল্যায়ন করে একটি দলিল গ্রহন করা হয়।
কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্রইউনিয়নের যৌথ নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প থেকে ৫ হাজার তরুনকে ট্রেনিং দিয়ে আলাদাভাবে মুক্তিযুদ্ধে পাঠানো হয়। এছাড়া ১২ হাজার তরুনকে ক্যাম্পের মাধ্যমে সংগঠিত করে মুক্তিবাহিনীতে প্রেরণ করা হয়।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, ভারত সরকার, সমাজতান্তিক বিশ্ব ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বিশ্বের প্রগতিশীল শক্তির সমর্থন আদায়ে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র বিউনিয়ন অনন্য ভূমিকা পালন করে। কমরেড মণি সিংহ, আব্দুস সালাম প্রমুখ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মুক্তিযুদ্ধের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় শক্তির সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি
৩৭৮
গঠিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান কমরেড মণি সিংহকে এর অন্যতম সদসয হিসেবে মনোনীত করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালামকে একটি মিশনে পাঠানো হয় মস্কোতে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের পটভূমি তৈরি ও মুক্তিসংগ্রামে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহনের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টি অনন্য ভূমিকা পালন করে। শুধু সিশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই নয়, কূটনৈতিক ও সাংগঠিক শক্তির মাধ্যমেও বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছে কমিউনিস্ট পার্টি। বিভিন্ন রণাঙ্গনে এই সংগঠনের অসংখ্য নেতাকর্মী জীবন বিসর্জন দেন। অনেকে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। তাঁদের সকলের এই মহৎ আত্মত্যাগের বিনিময়েই আজকের বাংলাদেশ।
[৫৮৮] মো. সালেহ আতাহার খান
মুক্তিযুদ্ধ ও কলকাতা বিশহ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি
দেশ ও জাতির স্বার্থে এমনকি আমাদের জীবন ও জীবিকার স্বার্থেও ১৯৭১ সালের আমরা পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ করেছিলাম। সে লড়াইয়ে জিতেছিলাম বলেই আজ বাংলাদেশ স্বাধীন, বাঙালি জাতি স্বাধীন; আজ আমরা রবীন্দ্রনাথের সেই তালগাছের মত বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু হেরে গেলে বাঙালি জাতি যে বিশ্ব মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেত , এ ব্যাপারে সন্দেহের ববকাশ নেই। জেতার পরেও বারাবার ভুলের কারণে আমাদের অস্তত্ব আজ সংকটের সম্মুখীন। তবে আশা এ সঙ্কট একদিন কেটে যাবে।
আমরা যুদ্ধ করেছিলাম আমাদের স্বার্থে। আমাদের রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে, বাঙালি সভ্যতা সংস্কৃতি রক্ষার লক্ষ্যে। কিন্তু অবাঙালি ও অবাংলাদেশী অনেক ব্যক্তি এ যুদ্ধে সামিল হয়েছিলেন কেবলই মানবতার স্বার্থে। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ হ্যারিসন, ভারতের পন্ডিত রবিশংকর আরো অনেকের নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। শুশু ব্যক্তিই নন, অনেক প্রতিষ্ঠানও প্রত্যক্ষে পরোক্ষে আন্তরিকভাবে আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু। এর মাত্র ৭ দিন পরেই ৩ এপ্রিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গঠিত হয় ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালিয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’ নামে একটি সাহায্য সংস্থা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ, তদনুমোদিত কলেজের শিক্ষকবৃন্দ এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দের এক যৌথ সভায় এ সমিতি গঠিত হয়। সমিতির সভাপতি ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ সেন স্বয়ং। অন্যান্য পদে ছিলেন কার্যনির্বাহী সভাপতি উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক পি কে বোস। কোষাধ্যক্ষ উপ-উপাচার্য (অর্থ) শ্রী হীরেন্দ্রমোহন মজুমদার, সম্পাদক অধ্যাপক ডি
৩৭৯
কে চক্রবর্তী এবং যুগ্ম সম্পাদকবৃন্দ অধ্যাপক ইলা মিত্র ও অধ্যাপক এস দাশগুপ্ত। দীর্ঘ ৯ মাস দ্বায়ত্ব পালনের পর ১৪ ডিসেম্বর সমিতি ইংরেজি ভাষায় ৪৪ প্রৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদন টি ‘ভারত ফটোটাইপ স্টুডিও’ (৭২-১, কলেজ স্টড়িট, কলকাতা ১২) তে মুদ্রিত এবং দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং, কোলকাতা ১২ থেকে প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই প্রবন্ধটি রচিত।
সমিতি গঠনের উদ্দেশ্য
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরুর আগেই পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে অনেক রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। অপারেশন শুরুর পরেই সঙ্গত কারনেই এর মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এবং জ্ঞাত তথ্যমতে এক কোটির উপর বাংলাদেশী শরণার্থী ভারতের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়। তাদের মধ্যে নানা শ্রেনী পেশার লোক ছিলেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের শিক্ষকও ছিলেন তাদের মধ্যে। প্রধানত তাদের সাহায্যার্থেই এই সহায়ক সমিতি গঠিত হয়েছিল। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ শরণার্থীদেরও যথাযথ সাহায্য করা হয়েছে এর মাধ্যমে।
বাংলাদেশকে সহায়তার জন্য তখন ভারতে আরও কয়েকটি সংগঠন/সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেমন, বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতি (পুনা), বাংলাদেশ এইড কমিটি (বোম্বে), ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি ফর বাংলাদেশ, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহায়তা কমিটি (বোম্বে শাখা), বোম্বে ইউনিভার্সিটি কমিটি, বাংলাদেশ সংগ্রাম সহায়ক সমিতি (লেক গার্ডেন, কলকাতা) Bangladesh Fact Finding Committee, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক সমিতি নিজস্ব কর্মসূচীর বাইরে এসব সংগঠনের মধ্যে সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করে। ঐসব সংগঠন মূলত এই সমিতির মাধ্যমেই তাদের সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করত। ভারতের বাইরের কিছু সংগঠনও এর মাধ্যমেই সাহায্য করেছে। যেমন, ফ্রেন্ডস অফ দ্য বাংলাদেশ মুভমেন্ট (শিকাগো), ফ্রেন্ডস অফ ঢাকা ইউনিভার্সিটি (লন্ডন), বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কাউন্সিল (লন্ডন), আউট টু দ্য পিপল (শ্রীলংকা), বাংলাদেশ গ্রীন ক্রস (লন্ডন)।
সহায়ক সমিতির কর্মকান্ড মূলত সাত ভাগে বিভক্ত ছিল, যথা- ১.সমর্থন, প্রচার ও সাহায্যের আবেদন ২.শিক্ষা ও শিক্ষকদের কর্মসংস্থান ৩.মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প পরিদর্শন ও সাহায্য প্রদান ৪.ত্রাণকার্য ৫.চিত্রপ্রদর্শনী ৬.তথ্যসংগ্রহ ও৭.প্রকাশনা।
৩৮০
কার্যক্রম প্রতিবেদন অনুযায়ী ৫,০০০ টাকার প্রাথমিক মূলধন নিয়ে সমিতির কার্যক্রম শুরু হয় । শুরু থেকেই সমিতির পক্ষ থেকে শরণার্থীদের মধ্যে খাদ্য, ওষুধ ও প্রাথমিক চিকিৎসার উপাদানসমূহ বিতরণ করা হতে থাকে । কিন্তু শরণার্থীর সংখ্যা ক্রমাগতই বাড়ছিল । দেখতে দেখতে লাখ এবং অর্ধকোটিতে পৌঁছে যায় । সুতরাং কার্যক্রম চালানোর জন্য পর্যাপ্ত অর্থের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায় । সুতরাং কার্যক্রম চালানোর জন্য পর্যাপ্ত অর্থের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় । বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী শ্রীমতী বীণা ভৌমিকের নেতৃত্বে শ্রীমতী কমলা বোস, শ্রীমতী মৃন্ময়ী বোস,শ্রীমতী মীরা সেন এবং অন্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি টিম প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে সমিতির ফান্ডে জমা দেন । সমিতির আহ্বানে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষকগণও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন ।
সমর্থন,প্রচার ও সাহায্যের আবেদন সমিতির সভাপতি অধ্যাপক সেন ৫ এপ্রিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান এবং শরণার্থীদের সাহয্যের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিকট আবেদন জানান । তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এবং ইউনেসকোর মহাপরিচালক । আবেদনপত্র ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ তুলে ধরা হয় । উভয়েই টেলিগ্রামের মাধ্যমে আবেদনপত্রের প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন এবং গণহত্যার শিকারদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি প্রকাশ করেন ।
সমিতির পক্ষ থেকে সাধারণ জনগণ, বিশেষত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট অর্থ সাহায্যের আবেদন জানানো হয় । তাতে সাড়া দিয়ে প্রথম এগিয়ে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল্যের এক সময়ের বিশ্বখ্যাত অধ্যাপক এবং তৎকালীন ভারতের জাতীয় অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বোস । একে একে এগিয়ে আসেন কৃষ্ণনগর মহিলা কলেজ, সরোজিনী নাইডু কলেজ , বেথুন স্কুল,কলাকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ড. বিধানচন্দ্র রায় ইনস্টিটিউট অব বেসিক মেডিসিন-এর শিক্ষক ও কর্মচারীবৃন্দ, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতুকোত্তর বিভাগগুলোর ৬১ জন শিক্ষক, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস, আধুনিক ইতিহাস ও ইংরেজি বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ, ভারত চ্যারিটি ট্রাস্ট, মেসার্স প্রেস এজেন্টস প্রা.লি.,মেসার্স অ্যালাইড এজেন্সি, প্যাস্টার ল্যাবরেটরিজের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ, সিদ্ধেশ্বর হোসিয়ারি ফ্যাক্টরি, গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস কলেজে, উমেশচন্দ্র কলেজ, বাংলাদেশ এইড কমিটি (বোম্বে), শ্রী এইচ পি লোহিয়া , অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান জুট মিলের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাবেক অ্যাডভোকেট জেনারেল শ্রী অজিত কুমার দত্ত,ফাদার পি ফ্যালেন (এস জে),শ্রী অমিতেশ ব্যানার্জী, অধ্যক্ষ নীরদকুমার ভট্টাচার্য, অধ্যক্ষ মমতা অধিকারী এবং আরো
৩৮১
অনেকে। বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক পি বি গজেন্দ্র গদকর এবং অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অতীন্দ্র মজুমদারও পর্যাপ্ত অর্থ সাহায্য করেন। শ্রী উৎপল চৌধুরী এবনহ শ্রীমতী সোমা চ্যাটার্জী বিনামূল্যের ওষুধ সংগ্রহ করেন। এছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীবৃন্দ সমিতির পক্ষে অর্থ সংগ্রহ করেন।
এই দান গ্রহনের ব্যাপারে সার্বক্ষণিক দ্বায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক জ্ঞানেশ পত্রনবীশ, শ্রী যতীন চ্যাটার্জী, শ্রী দীপক হাজরা এবং শ্রী পি সেন শর্মা।
সমিতির কার্যক্রম পরিচালিত হত দ্বারভাঙা ভবনের দোতলায় সকাল এগারোটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। এবং ১৪ নং বিধান সরণীর দোতলায় সন্ধ্যা ৬ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত। সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয় যে এই বিরাট দ্বায়িত্ব পালনের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। তাই কিছুদিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারী সকলকে নিয়মিত মাসিক অনুদান দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, যারা এই ত্রাণ কাজে সাহায্য করবে, তাদের আয়কর মওকুফের জন্য সমিতির পক্ষ থেকে ভারত সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয় এবং সরকার তা মেনে নেয়।
শরণার্থী ও মুক্তিবাহিনীর সাহায্যার্থে মে মাসে সমিতির শুভাকাঙ্খী ও বন্ধুরা বেশ কিছু অর্থ দান করে। অনেকেই এক মাসের বেতন দান করার মত প্রশংসনীয় প্রতিশ্রুতিও দেন। এই প্রতিশ্রুতি প্রথম পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক অসীমা চট্টোপাধ্যায়। এ সময় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও অর্থ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দিয়ে সমিতিকে সাহায্য করে। বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতি, বাংলাদেশ এইড কমিটি, আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যবেক্ষক কর্মচারী সমিতি, এগরা সারদা-শশীভূষণ কলেজ, প্রেসিডেন্সী কলেজ, সেন্ট সুরজমল জলন মহিলা কলেজ, বিদ্যাসাগর মহিলা কলেজ, বিবেকানন্দ শতবার্ষির্কী কলেজ, বাগনান কলেজ, যোগমায়াদেবী কলেজ, আর কে এন বানিজ্য কলেজ (বরহামপুর),জঙ্গিপুর কলেজ কর্মচাতি সমিতি, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্র ছাত্রীবৃন্দ সমিতিকে অর্থ দান করেন। শ্রী নীরদ কুমার সেন নামে এক ব্যক্তি মুক্তিসেনাদের জন্য পানীয় জলের বোতল দান করেন, যা বিভিন্ন সেক্টরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মেসার্স দে’জ মেডিকেল স্টোর এবং CIBA দান করে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র।
জুন মাসে সমিতির কাজের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পায়। এ সময় কৃষ্ণনগর সহ বিভিন্ন ক্যাম্পে মুক্তিফৌজদের জন্য ওষুধ ও রেডক্রস সেন্টারের জন্য চিকিৎসা যন্ত্রপাতি পাঠানো হয়।
এ সময় সহায়ক সমিতির ছাত্রফ্রন্ট একটি চিত্র প্রদর্সশনীর আয়োজন করে।
৩৮২
এর জন্য শ্রী দেবব্রত মুখোপাধ্যায় এবং শ্রীমতি শিপ্রা আদিত্য কতগুলো পোস্টার তৈরি করে দেন। সমিতির জন্য শ্রী মানস হালদার, শ্রী অনিল বসু এবং শ্রী অংশুমান মল্লিক সহ বাংলাদেশের আরো অনেকে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদারককারী এবং অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারী যে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন, তাও এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যতই দিন যাচ্ছিল, সমিতির কর্মকান্ড ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এর জন্য তাদের অর্থের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তাই বাঙালিদের যুদ্ধের প্রতি সমর্থন আদায়ের পাশাপাশি তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদান অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে সমিতি দেশী বিদেশী বিভিন্ন রাষ্ট্র, সংস্থা ও ব্যক্তির নিকট অনবরত আবেদন জানিয়ে আসছিল।
এ সময় সহায়ক সমিতির পক্ষ থেকে ইউরোপের গনমান্যদের সমর্থন আদায়ের জন্য তিনজন বিশেষ দূত প্রেরণ করা হয়। তাদের প্রথমজন ছিলেন ফাদার পি ফ্যালন। তিনি বাংলাদেশ সংক্রান্ত সর্বশেষ খবর এবং তার প্রমাণে বিভিন্ন ছবি ও খবর সঙ্গে নিয়ে যান। দ্বিতীয়জন কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শ্রী অনিলকুমার দাস। তিনি নিজ খরচেই লন্ডন গিয়েছিলেন। কিন্তু সমিতির পক্ষে লন্ডনসহ ইউরোপের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহর ঘুরে বাংলাদেশের খবর প্রচার করেন। তৃতীয় জন হচ্ছেন প্রফেসর ইলা মিত্র। সহায়ক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক। তিনি মস্কোসহ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক শহর ঘুরে বাঙালিদের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা প্রচার করেন।
এ মাসে সমিতির পক্ষ থেকে বোম্বে বেশ প্রচারকার্য চালানো হয়। সমিতির সম্পাদক প্রফেসর চক্রবর্তী শ্রীমতী মৃন্ময়ী বোসকে নিয়ে বোম্বে যান। সেখানে তাঁরা সর্বস্তরের জনগনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাঁদের মিশন খুব সফল হয়। তাঁরা মহারাষ্ট্রের গভর্ণর এবং Bangladesh Aid Committee এর পৃষ্ঠপোষক জনাব নওয়াব আলী জাবের জং এর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। এইড কমিটির চেয়ারম্যান শ্রী হরিষ মহিন্দ্রর গভর্ণরের সাথে এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন।
বাংলা গানের তিন কিংবদন্তী শ্রী সলিল চৌধুরী, শ্রীমতি সবিতা চৌধুরী এবং শ্রী মান্না দে তখন বোম্বে অবস্থান করছিলেন। তাঁরা ‘বাংলা, বাংলা আমার’ শীর্ষক তাঁদের একটি গানের রেকর্ডের সম্পূর্ণ রয়্যালটি মুক্তিযুদ্ধের জন্য দান করেন। বোম্বে ফার্টিলাইজার কর্পোরেশনের কর্মকর্তা কর্মচারীবৃন্দ মোটা অংকের অর্থ দান করার প্রতিশ্রুতি দেন। শ্রী ঋষিকেশ মুখার্জী এবং শ্রী হিতেন চৌধুরী নিয়মিত অনুদান দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। বোম্বের জনগনের এই যোগাযোগের ব্যাপারে কমিটিকে সাহায্য করেন বোম্বের Indian Merchants Chamber এর শ্রী সি এল ঘিওয়ালা। তিনি অর্থ সাহায্যেরও প্রতিশ্রুতি দেন। এছাড়া আরো যারা কমিটিকে নানাভাবে সহায়তা করেছেন, তাঁরা হলেন
৩৮৩
শ্রীমতী মনোবীণা রায়,জাতীয় বিদ্যা ভবনের ড.অশোক মজুমদার এবং বোম্বে হাইকোর্টের আইনজীবী শ্রী গিরীশ মুনশী,শ্রী বংশীভাই মেহতা,তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী সুশীলা মেহতা এবং শ্রী আর সি জাবেরী ।
এ সময় বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় এক বিরাট ভূমিকা পালন করে । বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি গজেন্দ্রগদকর একটি কমিটি গঠন করে ফান্ড সংগ্রহ করেন এবং সহায়ক সমিতি যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, সেসব বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব অধ্যাপক সক্রিয়ভাবে এ কাজে সাহায্য করেন তাঁরা হলেন শ্রী দস্তওয়ালা,শ্রী অলু দস্তুর,শ্রীমতী ঊষা মেহতা প্রমুখ।
বোম্বের ফিল্ম ডিভিশনও এ সময় আন্তরিকভাবে সাহায্যে এগিয়ে আসে । শ্রী অরুণ চৌধুরীর সহায়তা সমিতি প্রকাশিত ছবির অ্যালবামের জন্য বেশকিছু অসাধারণ ছবি ফিল্ম ডিভিশন তাঁদের দান করে । শান্তিনিকেতন আশ্রমিক সঙ্ঘের শ্রী ডবি-উ এম ভান্ডারী ঘোষণা করেন যে পরবর্তী অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য চার দিনব্যাপী চ্যারিটি শো-র সমস্ত অর্থ সমিতিকে দান করা হবে । বোম্বের সহায়ক সমিতির জন্য আরো যাঁরা নগদ ও ভবিষ্যৎ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন তাঁরা হলেন শ্রী পি পতি,শ্রী ক্ষেমেন সেন,প্রফেসর কে এম দেওধর(সহ-সভাপতি, AIFUCLTO),শ্রী প্রবীর সন্দেল,শ্রী বসন্ত ব্যানার্জী,শ্রীমতী চিত্রা বড়ুয়া,শ্রী মিনু মাসানি,শ্রী এস ভি রাজু প্রমুখ । ভারতীয় বিদ্যা ভবনের সম্পাদক শ্রী এস রামকৃষ্ণন এ সময় সমিতির সাহায্যের জন্য নানা কর্মসূচির আয়োজন করেন ।
এসময় আরো যেসব প্রতিষ্ঠান সমিতির সাহায্যে এগিয়ে আসে সেগুলো হলশ্রী শিক্ষায়তনের শিক্ষক এবং প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রদের সংস্থা শ্রীসংঘ, সিউনারেইন রামেশ্বর ফতেপুরিয়া কলেজ, র্যাডিয়্যান্ট প্রসেস, রাজা পিয়ারি মোহন কলেজের শিক্ষকবৃন্দ, আমতা বালিকা বিদ্যালয়, উদ্বোধন ট্রাস্ট, মুগবেরিয়া গঙ্গাধর কলেজ ইত্যাদি।
জুলাই মাসে বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর গিজেন্দ্রগদকরের আমন্ত্রণে সমিতি কয়েকজন প্রতিনিধিসহ বাংলাদেশী শিক্ষকদের একটি টিম সেখানে প্রেরণ করে। একইসময় প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী শ্রীমতি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে অপর একটি দল পাঠানো হয় শ্রীলংকায়। এসবের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রচার ও সমর্থন আদায়। কলকাতায় তখন শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে পাকিস্তান জান্তা যে প্রহসন মূলক বিচার করেছিল, তার প্রতিবাদে মিছিল হচ্ছিল। সমিতি তাতে সকৃয়ভাবে অংশগ্রহন করে।
এসময় ফাদার পি ফ্যালন এবং জাস্টিস এ কে দাস ইউরোপ থেকে ফিরে আসেন। ফাদার তার সফরের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট সমিতির নিকট জমা দেন এবং ১৯
৩৮৪
জুলাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক সাংবাদিক সম্মেলন করেন । তাঁর রিপোর্ট ২২ জুলাই দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নিকট হস্তান্তর করা হয় । এর কপি দেয়া হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী শরণ সিং ইউনিয়ন মন্ত্রী শ্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে । এ মাসে একটি বিশেষ ঘটনা কয়েকজন উচ্চপদস্থ জাপানির কলকাতায় আগমন । জাপানের সংসদ সদস্য,সংসদীয় দলের সাধারণ সম্পাদক এবং Council of World Association of World Federalists এর চেয়ারম্যান মি. কান-ইচি নিশিমুরা অসলো যাওয়ার পথে কলকাতায় যাত্রাবিরতি করেন । সমিতির পক্ষ থেকে প্রফেসর পি সেনশর্মা তাঁকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান এবং সমিতির এক সেট প্রকাশনা তাঁকে দান করেন । সেগুলো থেকে মি. নিশিমুরা বাংলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে সম্যক অবহিত হন । ২৬ জুলাই সমিতির পক্ষে প্রফেসর অমিয় চৌধুরী এবং প্রফেসর শর্মা পুনরায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ।
এছাড়া বাংলাদেশ সলিডারিটি ফ্রন্ট,জাপান-এর মহাসচিব প্রফেসর সেতসুরে সুরুশিমা,জাপান-বাংলা ফ্রেন্ডশিপ অ্যসোসিয়েশন-এর নির্বাহী সদস্য মি.টি সুসুকি এবং টিভি ক্যামেরাম্যান মি.তেমিসুক কলকাতায় কার্যালয় পরিদর্শন করেন । তাঁদেরও সমিতির প্রকাশনাসমূহ দেয়া হয় এবং সেগুলো তাঁরা বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারের কাজ ব্যবহারের জন্য জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেন । এছাড়া সমিতিকে ভবিষ্যৎ (সাহায্যের)…প্রতিশ্রুতি দেন ।
এ সময় পুনার বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির সম্পাদক এবং মহারাষ্ট্র বিধানসভার সদস্য শ্রী শ্যামকান্ত ডি মোরে আন্তর্জাতিক সংসদীয় সম্মেলনে যোগদানের উদ্দ্যেশে কুয়ালালামপুর যাচ্ছিলেন । সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারকার্য চালানোর জন্য তাঁকে সমিতির পক্ষ থেকে বাংলাদেশসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ দিয়ে দেয়া হয় । ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিসের মি.থিয়াগরাজন সমিতির বিভিন্ন প্রকল্পে যথাসাধ্য সাহায্য দিয়া যাচ্ছিলেন । এ সময় খ্যাতনামা ঐতিহাসিক প্রফেসর এ এল বাশাম অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন । তিনি কলকাতায় সমিতির অফিস এবংকর্মকান্ড প্রত্যক্ষ করে অত্যন্ত মুগ্ধ হন এবং শরণার্থীদের জন্য ফান্ড সংগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন ।
এ মাসে সমিতির প্রতিনিধি শ্রীমতী মৃন্ময়ী বোস অল ইন্ডিয়া রেডিওর পরিচালক শ্রী বিমান ঘোষের সহায়তায় কয়েকজন বাংলাদেশী সঙ্গীতশিল্পীকে কলকাতা কার্যালয়ে পরিচয় করিয়ে দেন । তাঁরা সঙ্গীত পরিবেশনের সুযোগ পান এবং এর ফলে মুক্তিযুদ্ধও বেশ প্রচার লাভ করে । ইউরোপে প্রচারের জন্য শ্রী বংশীভাই মেহেতা এবং শ্রীমতী সুনীলা মেহতা সমন্বয়ে দুই সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করা হয় । একই সঙ্গে শরণার্থী
৩৮৫
ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য যাতে অব্যাহ্বত থাকে,সে জন্য সমিতির পক্ষ থেকে সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্ববান জানানো হয় । আগস্ট মাসে সমিতির পক্ষ থেকে প্রায় ২০০ বিদেশী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়,যারা বাংলাদেশের সমর্থনে কাজ হয়েছিল ।
অক্টোবরে বহির্ভারতে প্রচারে বেশ গুরুত্ব দেয়া হয় । ডাকখরচ বেড়ে যাওয়ায় সমিতির পক্ষে এসব কাজ করা কঠিন হলেও বিশ্বের সমমনা সংস্থাসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা হয় । শ্রী শিবনাথ ব্যানার্জীকে এ সময় কাবুলে পাঠানো হয় । তিনি ১৯২২ সালে সেখানকার মক্তব-ই-হাবিবিয়ার শিক্ষক ছিলেন । কাবুলে পৌঁছে শ্রী ব্যানার্জী খান আবদুল গফফার খানসহ অন্যান্য আফগান নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাদেশের সর্বশেষ অবস্থা,বিশেষত দেশত্যাগী শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরেন । শ্রী পুর্ণেন্দু নারায়ণ রায় যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ ভ্রমণশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খান । তাঁর সূত্র ধরে ড.অলের নেতৃত্বে নরওয়ের একটি প্রতিনিধিদল কলকাতায় আসে । তাঁরা ভারতে স্বল্পমূল্যের উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার তৈরির একটি কারখানা স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন । প্রতিনিধিদল ভারত সরকারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও দেখা করেন এবং তাঁদের ইচ্ছার কথা সরকারকে জানান । World Council of World Federalist Association -এর সভাপতি Prof. Knud Nielson Ges WSCF (Geneva)- Gi Mr. Jack Laksirch কলকাতা আসেন । তাঁরা সমিতির কার্যালয় এবং কয়েকটি শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেন । তাঁরা বাংলাদেশী শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গেও তাঁদের সমস্যার ব্যাপারে আলাপ করেন এবং সমিতির কর্মকান্ডে অত্যন্ত সন্তোষ প্রকাশ করেন । Jack-কে সমিতির এক সেট প্রকাশনা উপহার দেয়া হয় । এ সময় চারজন বিদেশী সাংবাদিক সমিতির কার্যালয় পরিদর্শন করেন এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে সমিতির সাহায্য কামনা করেন । তাঁরা হলেন SA Nilsson (Stockholm), AM Skipper (Denmark), VSB Balkert (Denmark এবং MI Ojha (Sweden) ।
বিগত নয় মাস যাবত বাংলাদেশের ব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যের লোকজকে অবহিত করার যে প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল,অবশেষে নভেম্বর-ডিসেম্বরে এসে তাদের কাছ থেকে কিছু কিছু সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল । কুয়েত ও আফগানিস্তান পাত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা জানতে চায় ।প্রসেষ্টা অব্যাহত থাকলে হয়তো অচিরেই তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ব্যাপারটি বুঝতে পারবে-সমিতির পক্ষ থেকে এরূপ আশা করা হয় ।
এ সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের এমএনএ শ্রী ত্রিদিব রায় ইয়াহিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে শ্রীলঙ্কা সফর করছিলেন । বাংলাদেশ-বিরোধী তাঁর ঘৃণ্য ভূমিকার বিষয়টি সেখানকার শুভাকাঙ্ক্ষী নীমল পেরেরা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন । তিনি
৩৮৬
বাংলাদেশের কল্যাণ কামনা করে চতুর্দশ শতকের একটি বৌদ্ধ মন্ত্র বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ঊদ্দেশে সমিতির নিকট প্রেরণ করেন এবং তা তাঁদের নিকট পৌছে দেয়া হয় ।
৩০ নভেম্বর নিঊজিল্যান্ডের ইয়ুথ ইন্টারন্যাশনাল কমিটির সম্পাদক ও সহ-সভাপতি যথাক্রমে মি, অবভিন এফ আর্নল্ড এবং মি, ট্রেভন জে ওয়াল্টন সমিতির কার্যালয় পরিদর্শন করেন । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোস্থ ফ্রেন্ডস অব দ্য বাংলাদেশ মুভমেন্ট-এর মিসেস এভেলিন চেইতকিন এ সময় কলকাতায় আসেন এবং তাঁকে কয়েকটি ক্যাম্প স্কুল ঘুরে দেখানো হয় । তিনি এ পকল্প পরিচালনায় সমিতিকে সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দেন ।
এ সময় বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসেবক দলের চেয়ারম্যান জনাব আমিরুল ইসলাম ( এমএনএ ) এবং ব্রিটিশ এমপি ও War on Want -এর মি. জন স্টোনহাঊজ কলকাতায় আসেন । সমিতির পক্ষ থেকে তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশকে সাহায্যের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানানো হয় । মি. জন সমিতির কর্মকান্ডে অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করেন ।
সমিতির বিশেষ দূত হিসেবে শ্রী পি এন রায় ইঊরোপ ও আমেরিকায় দীর্ঘ সফরশেষে এ মাসেই ফিরে আসেন এবং তাঁর সফরের ফলাফল সমিতিকে অবহিত করেন ।
১৬ ডিসেম্বর দেস স্বাধীন হলে ও এর পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্য আরো কিছুদিন সাহায্যের ধারা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন ছিল । তাই সমিতি ২১ ডিসেম্বর থেকে কলকাতায় বাংলাদেশ বিষয়ে এক সেমিনারের আয়োজন করেছিল । কিন্তু অনিবার্য কারণে তা সম্ভব হয়নি । পরবর্তী বছর ১৪ এফ্রিল থেকে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল । তাতে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা অধ্যাপক ওবুদ্ধিজীবীর অংশগ্রহণের কথা ছিল । প্রফেসর এ আর মল্লিক এ আমন্ত্রণ গ্রহণও করেছিলেন । কিন্তু এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিনা তা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় না।
সাহায্যপ্রাপ্তি
সমিতির গঠনের পর থেকে জুন পর্যন্ত যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে সাহায্য পাওয়া গেছে তা ওপরে ঊল্লিখিত হয়েছে । জুলাই মাসে ভারত ও বহির্ভারত থেকে ঊল্লেখযোগ্য অর্থ সাহায্য পাওয়া যায় । অন্ধ্র ও জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যাল্য, ইন্টার-স্টেট অ্যাসোসিয়েশন ফর কালচারাল ইন্টিগ্রেশন ( বোম্বে ), ইন্ডিয়ান প্লাস্টিক ফেডারেশন, ঊলুবেরিয়া কলেজ, পালপাড়া ওয়াই এস কলেজ, শ্রীকৃষ্ণ কলেজ ( নদীয়া ), ফারটিলাইজার কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া (চেম্বর) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র-শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিকট থেকে প্রচুর সাহায্য আসে ।
ভারতের বাইরে অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রফেসর অতীন্দ্র মজুমদার (মেলবোর্ণ)
৩৮৭
এবং নিঊজিল্যান্ড থেকে ড,এ মজিদ খান ( ভিক্টোরিয়া ) ও প্রফেসর প্রিয়তোষ মৈত্র ( ওটাগো )-এর মাধ্যমে স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের অনুদান পাওয়া যায় ।
আগস্ট মাসে বাংলাদেশ গ্রিন-ক্রস (লন্ডন ) থেকে বিপুল পরিমাণ ওষুধ ও চিকিৎসা ঊপকরণ পাঠানোর কথা সমিতিকে জানানো হয় । শীত এগিয়ে আসছিল । তাই বিশেষত শিশু, বৃদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য শীতবস্ত্র চেয়ে সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে আবেদন জানানো হয় ।
সমিতির ফান্ড সংগ্রহের ঊদ্দেশ্যে আগস্টের ২৩ ও ২৪ তারিখ কলকাতার রবীন্দ্রসদনে দুটি চ্যারিটি শো-র আয়োজন করা হয় । নব নালন্দা গ্রুপ ও শান্তি নিকেতন আশ্রমিক সঙ্ঘ এতে অংশ নেয় । প্রথম দিন অনুষ্ঠানের উদ্বোধনের করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊপাচার্য প্রফেসর সেন এবং প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊপাচার্য প্রফেসর এ আর মল্লিক । দ্বিতীয় দিন উদ্বোধন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊপ-ঊপাচার্য প্রফেসর পি কে বসু এবং প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের এমএনএ জনাব আমিরুল ইসলাম । রবীন্দ্রসদনের কর্মকর্তা শ্রী সুকুমার দাস, শ্রী বি চক্রবর্তী, ড, ধ্রুব লাহিড়ী এবং প্রফেসর সোমেন বোস বিনামূল্যে সমস্ত বন্দোবস্ত করেন ।
এ মাসে ভারত এবং বহির্ভারত থেকে যাঁরা অর্থ সাহায্য করেন তাঁরা হলেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অতীন্দ্র মজুমদার ও ছাত্রবৃন্দ, ফ্রান্সের Miss Coletto Dutilla, লন্ডনের প্রবাসীবৃন্দ, কজকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মচারীবৃন্দ, অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊপাচার্য, Bengali Social and Cultural association, Western Australian Institute of Technology এর প্রফেসর প্রদীপ মিত্র, পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি মি-কে এল জৌরা এবং Bhawanipore Education Society College এর শিক্ষক সমিতি ।
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে সমিতির কার্যক্রম চালানো কিছুটা কঠিন হয়ে পড়ে । কারণ, পাবলিক কমিটিগুলোর সাহায্যের পরিমাণ কমে আসছিল । কিন্তু সমিতিকে তার আরব্ধ কাজ চালিয়েই যেতে হয়েছিল । তাই কলকাতার প্রাক্তন শেরিফ শ্রী এস সি রায়ের সঙ্গে সমিতি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করে। তিনি তখন Bangladesh Aid Committee এবং National Co-ordination Committee for Bangladesh-এর পক্ষে গুরুত্বপৃর্ন দায়িত্ব পালন করছিলেন । শেষোক্ত কমিটির প্রাধান ছিলেন শ্রী এম সি চাগলা এবং এর প্রধান কর্যালয় ছিল নেজাতি ভবনে । সমিতির পক্ষ থেকে ২ সেপ্টেম্বর পুনরায় ইঊনিয়ন মিনিস্টার শ্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হয় । এবং তাঁকে বাংলাদেশী শিক্ষকদের কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য সাহায্যের কথা বলা হয় । সেপ্টেম্বর মাসে শরণার্থীদের জন্য শীতবস্ত্র চেয়ে যে আবেদন জানানো
৩৮৮
হয়েছিল, তাতে সাড়া দিয়ে এ মাসে অনেকেই শীতবস্ত্র পাঠিয়েছেন । কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল খুবই সামান্য । তাই নতুন করে আবার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হয় ।
সমিতির কার্যক্রম অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে বোম্বের কয়েকজন হিতৈষী ব্যক্তি সহায়ক সমিতির বোম্বে ইউনিট গঠন করেন । শ্রী নবীন টি খাশুওয়ালা আহ্বায়ক-কোষাধ্যক্ষ এবং মহারাষ্ট্রের মাননীয় গভর্নর নওয়াব আলী জাবের জং প্রধান পৃষ্ঠপোষক হন । সমিতির উদ্যোগে ফান্ড সংগ্রহের জন্য কয়েকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং গভর্নর তার উদ্বোধন করেন ।
এ মাসে যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নিকট থেকে অর্থ সাহায্য পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন-পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর কে এল জৌরা,নর্থ বেঙ্গল বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ্ম সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ প্রফেসর এস কে বিষ্ণু, পশ্চিমবঙ্গ সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির কৃষ্ণনগর ইউনিট, মেসার্স গুড কোম্পানি, লন্ডন প্রবাসী শ্রী আর এন ভট্টাচার্য, বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর অতীন্দ্র মজুমদার ।
নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সমিতির ফান্ডে যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি সাহায্য প্রধান করেন, তাঁরা হলেন-ইস্তরি সৎ সঙ্ঘ (মহারাষ্ট্র),জনাব আজিজুর রহমান, শ্রী এস প্রকাশ খান্না,শ্রী ঈশ্বরলাল প্যাটেল, শ্রী এন সি দে, জনাব আলাউদ্দিন, শ্রী এম এ চৌধুরী, জনাব মুনীর আলী, শ্রী নরেশ চন্দ্র নন্দ, জনাব মোজাদ্দার আলী (লন্ডন), শ্রীমতী নীপা ব্যানার্জী (ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি ফ্যাকাল্টি, বেলজিয়াম), ড. নীহার সরকার (ব্যাংকক), মি. রিক রজার্স, প্রফেসর এডগার লেডেবার (ফ্রান্স) এবং শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ । এর পরেও সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্যের প্রয়োজনে সমিতির পক্ষ থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাহায্য কামনা করা হয় । এ উদ্দেশ্যে সহায়ক সমিতির বোম্বে শাখা বোম্বেতে ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে । কলকাতার শান্তিনিকেতন আশ্রামিক সঙ্ঘও এ উদ্দেশ্যে বোম্বে যায় । সমিতির পক্ষ থেকে ছোত একটি দল তাদের সহায়তার জন্য বোম্বে যায় ।
শিক্ষা ও শিক্ষকদের জন্য কর্মসংস্থান
জীবনের ভয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব শিক্ষক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সমিতির পক্ষ থেকে তাঁদের সাহায্যের জন্য তাঁদের জীবনবৃত্তাস্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়, যাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে । তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের কিছু আর্থিক সাহায্য প্রদানেরও ব্যবস্থা করা হয় । এ জন্য একটি রেজিস্টার খোলা হয় । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. অনিরুদ্ধ রায় এ কাজের দায়িত্ব গ্রহণ
৩৮৯
করেন । তাঁর সহযোগী ছিলেন স্নাতকোত্তর বাণিজ্য বিভাগের শ্রী অনিল সরকার এবং শ্রী পীযূষ দাস, শ্রী অংশুমান মল্লিক ও শ্রী অনিল বসু । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বাংলাদেশী শিক্ষক-পন্ডিতদের ভিজিটং প্রফেসর হিসেবে নিয়োগের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করে । বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং ভারতে ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় । রাজ্য সরকারগুলোর অনুমতি নিয়ে স্কুল পর্যায়েও এ প্রকল্প বিস্তৃত করার সিদ্ধান্ত হয় ।
মে মাসে সমিতির সভাপতি এবং উপাচার্য শ্রী এস এন সেন দিল্লি যান । সেখানে গিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং ভারত সরকারের সহায়তায় কয়েকজন বাংলাদেশী শিক্ষককে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে নিয়োগের একটি প্রকল্প চূড়ান্ত করেন । তাঁরই প্রচেষ্টায় পশ্চিমবঙ্গের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে গঠন করা হয়, যার সম্পাদক নির্বাচিত হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার শ্রী অরুণ রায় । এ কমিটি বাংলাদেশী শিক্ষকদের অস্থায়ী ভিত্তিতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দানের উদ্দেশ্যে কাজ করে ।
এর পাশাপাশি বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলাদেশী ছেলেমেয়েদের শিক্ষার কথা চিন্তা করে স্কুল সেকশনসহ ক্যাম্প-কলেজ স্থাপনেরও সিদ্ধান্ত হয় । এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলোচনার জন্য সমিতির যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক সৌরীন্দ্রনাথ ভট্টেচার্য দিল্লি যান । এ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক সেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য পুনরায় দিল্লি যান ।
এদিকে ২১ মে সহায়ক সমিতি এবং বাংলাদেশী শিক্ষকদের মধ্যে এক সভা অনুষ্ঠিত হয় । সভায় ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’ নামে একটি সমিতি গঠিত হয়,যার সভাপতি, নির্বাহী সভাপতি এবং সাধারণ নির্বাচিত হন যথাক্রমে ড. এ আর মল্লিক, জনাব কামরুজ্জামান এবং ড. আনিসুজ্জামান ।
একই দিন একটি আইরিশ-ব্রিটিশ টিম এ অঞ্চলে পরিদর্শনে আসে এবং সমিতির সমগে তাদের সাক্ষাৎ হয় । ৩১ মে যুক্তরাজ্যের সাংসদ William Barnes এবং লন্ডন কাউন্টি কাউন্সিলের সদস্য ও War on War-এর সভাপতি Donald Chesworth বাংলাদেশ সফর শেষে কলকাতায় ফিরে বিশেবিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন । এ টিম কলকাতা প্রেসক্লাবে একটি সাংবাদিক সম্মেলনও করে । সহায়ক সমিতির পক্ষে সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন শ্রীমতী মৃন্ময়ী বোস ।
জুন মাসে ড.এ আর মল্লিকের নেতৃত্বে শিক্ষকদের একটি যৌথ টিম উত্তর প্রদেশ ও দিল্লি সফর করে । দলে ছিলেন ড.আনিসুজ্জামান,জনাব সুবিদ আলী,ড. অনিরুদ্ধ রায়,অধ্যাপক সৌরীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী এবং
৩৯০
অধ্যাপক অনিল কুমার সরকার । এ টিম এলাহাবাদ,দিল্লি,আগ্রা এবং লক্ষ্মৌ বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে । এর ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ভারতের আশ্রয় গ্রহণকারী শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে স্থানীয়দের মনে একটি সহানুভূতিশীল ধারণার সৃষ্টি হয় । টিমের সমস্ত খরচ বহন করে সহায়ক সমিতি ।
এদিকে উপাচার্য অধ্যাপক সেন শিক্ষকদের কর্মসংস্থানের প্রকল্প পাস করানোর ব্যাপারে দিনের পর দিন দিল্লিতে থেকে চেষ্টা চালিয়ে যান । সেখানে আলহাজ লুতফর হক,শ্রী চিত্ত বসু,শ্রী ডি এল সেনগুপ্ত এবং সকল সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন । সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোপীয় ভাষা বিভাগের প্রধান ফাদার পি ফ্যালনকে ভ্যাটিকানের মাননীয় পোপের নিকট পাঠানো হবে । তাঁর আসা-যাওয়ার খরচ বহন করবেন কলাকাতার লর্ড বিশপ । শিধান্ত অনুযায়ী তিনি সেখানে যান এবং পোপের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারের খবর অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রচারিত হয় । ফাদার ফ্যালন পোপের নিকট বাঙালিদের ওপর ইয়হিয়ার নৃশংস অত্যাচারের কাহিনী তুলে ধরেন ।
এ সময় World University Service I Indian National committee-এর নির্বাহী সাম্পাদক VN Thiagarajan সমিতির কার্যালয় পরিদর্শন করেন এবং এর প্রকাশনা ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচির প্রশংসা করেন । তিনি সমিতির ক্যাম্প-স্কুল সম্পর্কেও খোজ-খবর নেন এবং এ ব্যাপারে সাহায্যের আশ্বাস দেন ।
এ সময় একটি আন্তর্জাতিক ত্রাণ কমিটি সমিতির কার্যালয় পরিদর্শন করে । কমিটিতে ছিলেন ambassador angier Biddle Duke, Mr. Morton Hamburg (General Counsel, International Rescue Committee- IRC), Mrs. Lee Thaw (Director, IRC), Dr. Daniel L Wander (Professor of Surgery, Albert Einstein College of Medicine, NY) এবং Mr. Thomas W Phipps (লেখক)। তাঁরা সমিতির বিভিন্ন কর্মকান্ড সম্পর্কে আলোচনা করেন । তবে ক্যাম্প-স্কুল কর্মসূচি তাদের সার্বাদিক আকর্ষণ করে । তাঁরা স্কুল পরিচালনার জন্য প্রতিমাসে ১০,০০০ ডলার অনুদান প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন এবং বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতিকে নগদ ১,০০০ ডলার দিয়ে যান । সমিতি এ অর্থ দিয়ে সাতটি ক্যাম্প-স্কুল চালু করে ।
বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংগঠনও সমিতির এই ক্যাম্প-স্কুল কর্মসূচির প্রতি আন্ত্রিক সমর্থন জানায় এবং অর্থ প্রেরণ করে । সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কলম্বোর ইনস্টিটিউট অব সিলোনিজ স্টাডিজ এবং লন্ডনের Friends of Dacca University ও Bangladesh Students Action Council। ইনস্টিটিউট অব সিলোনিজ স্টাডিজ-এর কর্ত্রী শ্রীমতী নীমল পেরেরা জানান যে, তিনি OUT TO
৩৯১
THE PEOPLE নামে একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন এবং বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের জন্য বৌদ্ধ ভিক্ষুদের এক সমাবেশ মাননীয় মহানায়ককে বক্তব্য দানে সম্মত করেছেন ।
অধ্যাপক অতীন্দ্র মজুমদারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র,শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ তাঁদের সাহায্যের প্রথম কিস্তি হিসেবে এ মাসে ১৩,২৬৫.৫২ রুপি প্রেরণ করেন । শুধু তা-ই নয়, এ ব্যাপারে গভীর আগ্রহ প্রাকাশ করেন ।
লন্ডনস্হ Friends of Dacca University-এর পরিচালক Proffesor Esra Bennatham সহায়ক সমিতি প্রেরিত বাংলাদেশী শিক্ষকদের জীবনবৃত্তান্ত পেয়ে অত্যন্ত খুশী হন এবং তাঁদের পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেন । এছাড়া বিভিন্ন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত উভয় বাংলার কয়েকজন অধ্যাপকও ব্যক্তিগতভাবে সমিতিকে সাহায্য করেন । তাঁরা হলেন জনাব এ এইচ সাদউদ্দীন (ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়, নিউজিল্যান্ড),অধ্যাপক নরেশ নন্দ (লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়) প্রমুখ ।
এদিকে সমিতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভারতের,বিষেশত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ও বাংলাদেশী শিক্ষকদের সাময়িক কর্মসংস্থানের ব্যাপারে এগিয়ে আসে । এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (WBCUTA)। এ সমিতি সহায়ক সমিতির কাজে সুবিধার জন্য একটি টাইপরাইটার প্রদান করে । অন্যদিকে কেবল বিশ্ববিদ্যালয় এ বছরের রবীন্দ্র-বক্তৃতা প্রদানের জন্য কয়েকজন বাংলাদেশী শিক্ষককে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নেয় ।
জুলাই মাস পর্যন্ত কেবল পশ্চিমবঙ্গেরই ৬০৪টি শরনার্থী ক্যাম্প স্থাপিত হয় এবং এ ক্যাম্পগুলোতে ৩১টি স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আশ্রিত শিশুদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয় । IRC-এর অর্থানুকূল্যে এ ক্যাম্প-স্কুলগুলো চালু করা হয়েছিল । অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুদান দিয়ে এসব স্কুলে শ্লেট,খাতা এবং অ্যান্য শিক্ষা-উপকরণ প্রদান করা হয় । শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের মেসার্স ভারত স্টেশনারিজ বিনালাভে এসব উপকরণ সরবারহ করে । কলাকাতার প্রকাশক ও বিক্রেতা সংস্থা বিনামূল্যে অথবা অলাভে এসব স্কুলে পাঠ্যবই সরবারহে সম্মত হয় । শুধু তা-ই নয়, তারা তাদের হলরুম সপ্তাহে একদিন বিনা ভাড়ায় ক্যাম্প-স্কুল পরিচালককে ব্যবহারের সুযোগ দেয় । ‘সেসার্স নয়া প্রকাশ’ টেলিফোনসহ একটি সজ্জিত কক্ষ অফিসের জন্য ছেড়ে দেয় । এদিকে সহায়ক সমিতির সম্পাদক প্রফেসর ডি কে চক্রবর্তীর নেতৃত্বে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধদল মহারাষ্ট্রের গভর্নর মাননীয় নওয়াব আলি জাবের
৩৯২
জং-এর সঙ্গে রাজভবনে সাক্ষাৎ করলে তিনি একটি আবাসিক স্কুল প্রকল্প গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন । এ অনুযায়ী প্রফেসর পি এন শর্মা একটি প্রকল্প তৈরি করে তাঁর নিকট প্রেরণ করেন এবং তৎকালীন PWD ইঞ্জিনিয়ার শ্রী এ কে রায় স্কুল ও হোস্টলের প্লান করে দেয় । এ সময় দিল্লিতে বাংলাদেশ বিষয়ে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় । তাতে আয়োজক CASA কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে সমিতির পক্ষ থেকে প্রফেসর অমিয় চৌধুরী অংশগ্রহণ করেন এবং ক্যাম্প-স্কুল কর্মসূচিন্তুলে ধরেন । এতে উপস্থিত সকলে সন্তোষ প্রকাশ করেন ।
আশ্রিত বাংলাদেশী শিক্ষকদের কর্মসংস্থানের বিষয়টি চূরান্ত করার জন্য এ মাসে সমিতির সভাপতি প্রফেসর সেন দিল্লি যান । কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিষয়টি এবারেও চূড়ান্ত হয়নি । ২২ জুলাই সমিতির সম্পাদক প্রফেসর চক্তবর্তী দিল্লি যান এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাৎ করেন । তিনি সমিতির কর্মকান্ডে অত্যন্ত খুশি হন এবং এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার জন্য পশ্চিমবঙ্গের ইউনিয়ন মিনিস্টার শ্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন । শ্রী রায়ের সঙ্গে দেখা হলে তিনি কলকাতায় বসে বিস্তারিত আলোচনা কথা বলেন । কিন্তু সময়ের অভাবে তা সম্ভব না হওয়ায় ২৯জুলাই রাইটার্স বিন্ডিং-এ তাঁর নিকট একটি নোট পৌঁছে দেয়া হয়,যার কপি প্রধানমন্ত্রীর নিকটও পাঠানো হয় ।
বাংলাদেশী শিক্ষকদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে এ সময় সমিতির সম্পাদক প্রফেসর ডি কে চক্রবর্তী শান্তিনিকেতন আশ্রমিক সাঙ্ঘের কর্ত্রী শ্রীমতী মৃন্ময়ী বোসকে নিয়ে দিল্লি যান । সেখানে তাঁরা সফররত বাংলাদেশী শিক্ষকদেরসহ গোটা দলের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাকে বাংলাদেশের সমস্যা ও এ ব্যাপারে সহায়ক সমিতির গৃহীত সকল প্রকার উদ্যোগের কথা জানান । তৎকালীন সাংসদ এবং National CO-ordination Comittee for Bangladesh -এর আহ্বায়ক প্রফেসর সমর গুহ এ সাক্ষাতের ব্যাবস্থা করেন । তাঁরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক আচার্য শ্রীমতী পদ্মজা নাইডুর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন এবং তিনি শরণার্থী শিশুদের জন্য খাবার ও ওষুধ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন । এছাড়া UGC-সহ আরো অনেক সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গেও তাঁরা সাক্ষাৎ করেন।
জুলাই মাসে কলম্বোর Institute of Ceylonese Studies বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি এবং সহায়ক সমিতি থেকে শিক্ষকদের এক যৌথ দলকে আমন্ত্রণ জানায়। এ দলের নেতৃত্ব দেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) প্রফেসর পি কে বোস । আগস্ট মাস পর্যন্ত সমিতি মোট ৩১টি ক্যাম্প-স্কুল প্রতিষ্ঠা করে-পশ্চিম্নঙ্গে ২১টি এবং আগরতলায় ১০টি । এতে চার শতাধিক বাংলাদেশী শিক্ষকের কর্মসংস্থান হয় ।
৩৯৩
এদিকে বাংলাদেশী শিক্ষকদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী, ইউনিয়ন শিক্ষামন্ত্রী এবং UGC সম্মত হয় । ইতিমধ্যে পতিয়ালা,যোধপুর, মুজফফরপুর ও যাবদপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়ান ফর কালটিভেশন অব সায়েন্স (কলকাতা),ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (বোম্বে) ও ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট (কলকাতা) বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী শিক্ষককে নিয়োগ দেয় । দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ও এ ব্যাপারে সাহায্যের প্রস্তাব দেয় ।
আগস্ট মাসে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রধান ড.মাযহারুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথের ওপর একটি ধারাবাহিক বক্ত্রতা প্রদান করেন । সহায়ক সমিতি তাঁকে স্পনসর করে এবং এ জন্য তিনি সম্মানীও পান ।
প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন, তাঁদের একটি তালিকা মিস মেরি স্যাটনের অনুরোধে দিল্লিতে পাঠানো হয় । তিনি বাংলাদেশের জন্য প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ফান্ড সংগ্রহ করেছিলেন
এ মাসে সহায়ক সমিতি ভারত সরকারের Registration of Societies Act-এর অধীনে নিবন্ধনভুক্ত হয় এবং সমিতির অনুরোধে শরণার্থীদের জন্য সাহায্যদাতাদের আয়কর মওকুফ করা হয় ।
সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি যৌথ দল বোম্বে এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সফরে যায়। দলে ছিলেন প্রফেসর এ আর মল্লিক, প্রফেসর আলী আহসান এবং প্রফেসর সুবিমল মুখার্জী । দলের নেতৃত্ব দেন ড.বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য । এ সময় শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের উদ্যোগে দিল্লিতে বাংলাদেশ বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় । সহায়ক সমিতির পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন ড.ভট্টাচার্য ।
অক্টোবর মাস পর্যন্ত সমিতির উদ্যোগে মোট ৫১ টি ক্যাম্প-স্কুল চালু হয় । এর মধ্যে ১০টি ত্রিপুরায়, বাকিগুলো পশ্চিমবঙ্গে । এসব স্কুলে মোট ৭১৪ জন বাংলাদেশী শিক্ষকের কর্মসংস্থান হয় । স্কুলগুলোর ব্যয় নির্বাহ হতো ত্রাণ সাহায্যে ।
এ মাসেই বিশ্ববিদ্যলয়ের উপাচার্য প্রফেসর গজেন্দ্রগদের অবসরে যান । তার আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের নিকট থেকে সংগৃহীত ৬৭,০০০ রুপির একটি চেক সমিতিকে প্রদান করেন । একক কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে এটাই সবচেয়ে বড় অবদান । দ্বিতীয় স্থানে ছিল অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় । সেখান থেকে বিভিন্ন সময়ে মোট ৪১,০০০ রুপি দেয়া হয়েছিল । বাংলাদেশী শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের সাহায্যার্থে এ অর্থ দেয়া হয় ।ভারতের
৩৯৪
সর্বদলীয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ শিক্ষকদের সাহায্যার্থে এ সময় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় রাষ্ট্রদৃত জনাব এম হোসেন আলীকে দুই লক্ষাধিক রুপি দান করেন । এ মাসে ইঊজিসির অর্থ সাহায্যে বাংলাদেশের ওপর একটি জাতীয় সেমিনার অনুষ্টানের ঊদ্যোগ গ্রহন করা হয় । এতে ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের কয়েকজন খ্যাতনামা ব্যক্তি অংশ নেবেন বলে সমিতি আশা প্রকাশ করে । প্রফেসর যতীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী এ ব্যাপারে আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন । অক্টোবর মাসে শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব আলীকে যে অর্থ দিয়েছিল, তা থেকে নভেম্বর-ডিসেন্বর মাসে সহায়ক সমিতিকে ১,৯৯,৯০০ রুপি দেয়া হয় শিক্ষকদের সহায়তার জন্য । প্রফেসর এ আর মল্লিক এবং মুজিবনগরস্থ বাংলাদেশ পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগিতায় এ অর্থ ব্যয়ের একটি পরিকল্পনা করা হয় । এ ব্যাপারে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সম্পাদক ড, অজয় কুমার রায়, সহকারি সনপাদক জনাব আনোয়ারুজ্জামান এবং সদস্য শ্রী নিত্যগোপাল সাহা সক্রিয় সহযোগিতা করেন । এ সময় ক্যাম্প-স্কুলসমূহ আগের মতোই চলতে থাকে । তবে ডিসেম্বরের শেষভাগে শরণার্থীরা বাংলাদেশে ফিরতে শুরু করলে অনেক স্কুল বদ্ধ হয়ে যায় । বাকিগুলোর ছাত্র-ছাত্রীদের পুস্তকাদি ক্রয়ের জন্য IRC উলেখযোগ্য অর্থ দান করে । ঊল্লেখ্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এক পত্রে সমিতির এই ক্যাম্প-স্কুল প্রকল্পের ভূয়সী প্রশংসা করেন মি, ভি এন থিয়াপরাজন এসময় ক্যাম্প-স্কুল পরিদর্শন করে অত্যন্ত সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশেী ছাত্রদের জন্য শিক্ষামূলক কর্মসূচিতে আর্থিক সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন । ডিসেম্বরের ৬ তারিখ ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে সমিতির কর্মকর্তাগন জনাব এম হোসেন আলীর মাধ্যমে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দকে অভিনন্দন জানান বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে দখলদারমুক্ত হলে তাঁরা মুজিবনগরস্থ বাংলাদেশ সরকারকেও অভিনন্দন জানান এর ঊত্তরে মুজিবনগর সরকার তাঁদের মুজিবনগর পরিদর্শনে আমন্ত্রণ জানান । বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার শ্রী জি সি ব্যানার্জী,পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শ্রীমতী এম বোস,প্রফেসর ডি কে চক্রবর্তী সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধিদল মুজিবনগর যান বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানাতে । অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী জানাব তাজউদ্দীন আহমদ গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁদের গ্রহণ করেন এবং দীর্ঘ নয় মাস সমিতি বাংলাদেশের জন্য যা করেছে,তার জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন । রাষ্ট্রপতি উপাচার্য প্রফেসর সেন এবং স্মিতির অন্যান্য সদস্যের প্রতিও গভীর কৃতজ্ঞতা
৩৯৫
জ্ঞাপন করেন । তিনি অত্যন্ত আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও কর্মব্যস্ততার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে যেতে পারেননি বলে দুঃখ প্রকাশ করেন । তবে অচিরেই তিনি যখন কলকাতা যাবেন,তখন বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন । তিনি এও বলেন যে, একজন শীক্ষক হিসেবে তিনি নিজে শিক্ষদের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা অনুভব করেন ।
মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প পরিদর্শন ও সাহায্য প্রদান
২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার আগ থেকেই বিভিন্ন পথে বাংলাদেশের নেতা-কর্মীরা ভারতে প্রবেশ করতে শুরু করেন । এর পরিমান ক্রমাগতই বাড়ছিল । ভারতে গিয়ে তাঁরা সংগঠিত হ্ওইয়া এবং যুদ্ধের প্রশিক্ষন নেয়ার চেষ্টা করেন । এর ফলে মে মাসের মধ্যই ভারতের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয় । সেখানে তাদের যুদ্ধের প্রশিক্ষন দেয়া হতো । সহায়ক সমিতির পক্ষ থেকে এসব ক্যাম্প পরিদর্শন করা হতো এবং সাধ্যানুসারে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য দেয়া হতো । এঊদ্দেশ্যে সমিতির পক্ষ থেকে শ্রীমতী ঈন্সিতা গুপ্তের নেতৃত্বে একটি টিম মুর্শিদাবাদ জেলার বরহামপুর ক্যাম্পে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে । ত্রিপুরার বিভিন্ন স্থানেও টিম পাঠানো হয় । সেখানকার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসব টিমের অভিজ্ঞতা তাকে জানানো হয় । আগরতলা থেকে এ ব্যাপারে একটি বিবৃতিও দেওয়া হয়, যা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় । এসব টিমের নেতৃত্বে ছিলেন সমিতির নির্বাহী সভাপতি শ্রী পি কে বসু ।
জুন মাসে সমিতির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন যুব-ক্যাম্পে ওষুধ ও খাদ্যসামগ্রী পাঠানো হয় । এ সময় কলকাতার লেক গার্ডেনস্থ ‘বাংলাদেশ সংগ্রাম সহায়ক সমিতির সভাপতি শ্রী নীরদ মুখার্জী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বেশ কিছু কম্বল ও ওয়াটার প্রুফ ট্রিপল দান করেন ।
জুলাই মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সমিতির সাহায্যের ধরণ ও পরিমাণ বৃদ্ধি পায় । বাংলাদেশের চারদিকে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে এ সময় ট্রানজিস্টর রেডিও, কম্বল, ত্রিপল,ওষুধ এবং চিড়া-গুড় পাঠানো হয় ।
আগস্ট,সেপ্টম্বর ও অক্টোব্র মাসে মিক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং তাঁদের জন্য সাহায্যর ধারা আগের মতোই অব্যাহত থাকে । তাঁদের জন্য মশারি, বুটজুতা ইত্যাদি প্রেরণ করা হয় । শ্রী কল্যান মুখার্জী এবং তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী বাণী মুখার্জী নিয়মিতভাবে চিড়া-গুড়-চিনি সরবরাহ করেন এবং সেগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট পৌছে দেয়া হয় ।
নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে পাকসেনা ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধের তীব্রতা যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি সহায়ক সমিতির কর্ম তৎপরতাও বৃদ্ধি পায়। তখন শীতকাল ।মৃত্যুকে ঊপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে তুমুল যুদ্ধে রত । তাঁদের বিভিন্ন জিনিসের তীব প্রয়োজন দেখা দেয় । সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও সহায়ক সমিতি
৩৯৬
তাঁদের জন্য কম্বল, শীতবস্ত্র, ট্রানজিস্টর,বই, ওষুধপত্র ইত্যাদি পাঠায় । বাংলাদেশের রাজশাহী, খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলার পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, নদীয়া এবং চব্বিশ পরগনা জেলার বিভিন্ন মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে এগুলো পাঠানো হয় । মেঘালয়ের তুরাতে যুব ক্যাম্পেও বই ও ট্রানজিস্টর পাঠানো হয় । যুদ্ধে আহত কতিপয় মুক্তিযোদ্ধাকে কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয় । Institute of Basic Medicine-এর প্রফেসর এবং Board of Health-এর সম্পাদক ডাক্তার প্রবোধ রায় তাঁর কয়েকজন সহযোগী নিয়ে এ কাজ করেন ।
ত্রাণকার্য
শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি সাধারণ শরণার্থীদেরও সমিতির পক্ষ থেকে যথাসাধ্য সাহায্য করা হয় । এ উপলক্ষে জুলাই মাসে সমিতি অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ থেকে বেশ কিছু পোশাক ও অন্যান্য –চোপ্র-চোপড় পায় । সেগুলো আশ্রিত শিক্ষক এবং অন্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয় । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ও সিনেট সদস্য ড.প্রবোধ রায় নিয়মিতভাবে শরনার্থীদের জন্য বিনামূল্যে ওষুধ সরবারহের প্রতিশ্রুতি দেন । শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের যেকোনো গুরুতর অসুস্থ রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারেও তাঁরা সাহায্যের আশ্বাস দেন । শ্রী কল্যাণ মুখার্জী এবং তাঁর স্ত্রী নিজ খরচে কয়েকজন অসুস্থ ও আহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন ।
অক্টোবর মাসে শ্রীমতী মৃন্ময়ী বোসকে সমিতির মেডিক্যাল ইউনিটের দায়িত্ব দেয়া হয় । এর ফলে নিয়মিত ওষুধ সরবারহ নিশ্চিত হয় । এ ব্যাপারে শ্রীমতী পদ্মজা নাইডু এবং শ্রীমতী লাল-এর অবদান স্মরণীয় । স্থানীয় রেডক্রসও সমিতির সাহায্যে এগিয়ে আসে ।
চিত্রপ্রদর্শনী
বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি বিশ্ববাসীর সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে সহায়ক সমিতি নানা কৌশল অবলম্বন করে । তাঁরা বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর অত্যাচার,গণহত্যার এবং গৃহহীন শরণার্থীদের দুরবস্থার ছবি তুলে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনীর আয়োজন করে এবং হাজার হাজার লোক তাতে অংশ নেয় । ৯ মে কলকাতার সার্কাস এভিন্যুতে আয়োজিত হয় প্রথম প্রদর্শনী । এতে দুই হাজার দর্শনার্থী অংশগ্রহণ করে । দ্বিতীয় প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় নবীনচন্দ্র বড়াল লেনে । এ প্রদর্শনী চলে ২১,২২ ও ২৩ মে তিন দিনব্যাপী এবং দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল চার হাজার । তৃতীয় প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় চব্বিশ পরগনা জেলার গোবরডাঙ্গায় । ২৫,২৬ ও ২৭ মে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এ প্রদর্শনীতে দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল মোট পাচঁ হাজার ।
পুনার ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির আমন্ত্রণে জুলাই মাসে শ্রী
৩৯৭
মানস হালদার এবং শ্রী গৌতম ঘোষ পুনা যান এবং প্রদর্শনীয় আয়োজন করেন । এতে পুনার সমিতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয় এবং বোম্বেসহ মহারাষ্ট্রের অন্যান্য স্থানেও অনুরূপ প্রদর্শনীর প্রস্তাব দেন ।
অক্টোবর মাসে দূর্ঘাপূজার সময় সমিতির পক্ষ থেকে হাওড়া,মুর্শিদাবাদ এবং পশ্চিমবঙ্গের আরো অনেক স্থানে একাধিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় । পরবর্তী নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে কোনো প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত না হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের মুক্ত এলাকাসমূহের বিভিন্ন ধরনের ছবি সংগ্রহের কাজ অব্যাহত থাকে ।
তথ্যব্যাংক
বাংলাদেশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য আগস্ট মাসে সহায়ক সমিতি নতুন এক ধরনের কাজ শুরু করে । তা হলো একটি তথ্যব্যাংক গড়ে তোলা । কলকাতার প্রথম শ্রেণির বিজ্ঞাপন সংস্থাসমূহের সমন্বয়ে এটি করা হয় । হিন্দুস্তান থম্পসন আসোসিয়েটস লি.-এর কর্ণধার শ্রী রাম রায় এ প্রকল্পে নেতৃত্ব দেন । নেতাজি ভবনে এর কেন্দ্র স্থাপিত হয় । বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসেবক দল এ প্রকল্পে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয় ।
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে তথ্যব্যাংক আরো সমৃদ্ধ হয় । কলকাতাস্থ ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসেস তিনটি সংবাদপত্রের কপি দান করে, যাতে বিগত তিন মাসের বাংলাদেশ সংক্রান্ত সমস্ত ঘটনার বিবরণ মুদ্রিত হয় । অন্যান্য অনেক বিদেশী পত্র-পত্রিকাও পাওয়া গেছে । এর ফলে বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে গবেষকদের গবেষণা করার এক বড় সুযোগ সৃষ্টি হয় । তথ্যব্যাংকে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনাব জামিল চৌধুরীর অধীনে ১৪ জন ছাত্র কাজ করছিলেন । বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রচার ও তথ্য বিভাগও এ ব্যাপারে সাহায্য করছিল ।
নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের রিডার ড. এ মজুমদারের তত্ত্বাধানে তথ্যব্যাংকের কাজ সন্তোষজনকভাবে চলছিল । কলকাতার প্রথম শ্রেণীর পত্রিকাগুলোতে ব্যাংকের সাফল্য গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয় । শ্রী দুর্গাদাস তরফদার এ ব্যাপারে খুবই আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং এর কর্মপরিধি বৃদ্ধির ব্যাপারে মূল্যবান পরামর্শ দেন । শ্রী রাম রায় গুরুত্বপূর্ণ সংবাদসমূহের অনুলিপি করার দায়িত্ব নেন এবং এ জন্য তাকে সমিতি থেকে তাঁকে ২,০০০ টাকা প্রদান করা হয় । তথ্যব্যাংকের স্বেচ্ছাসেবকগণ ব্যাংককে ঢাকায় স্থানান্তরের ইচ্ছা প্রকাশ করলে সমিতির এক সভায় বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসেবক সার্ভিক দল কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকায় স্থানান্তর সিদ্ধান্ত হয় । উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সম্পাদক ড.অজয় কুমার রায়, স্বেচ্ছাসেবক দলের চেয়ারম্যান জনাব আমিরুল ইসলাম এবং সহায়ক সমিতির সদস্য শ্রী রাম রায় ।
৩৯৮
১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বাংলাদেশের পুরোপুরি স্বাধীন হয় । কিন্তু তার একদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর পাকসেনা ও তাদের স্থানীয় সহযোগিদের দ্ধারা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঘটনা তখনো অনাবিস্কৃত । সহায়ক সমিতির জন্য এটি একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয় । অবশেষে জনাব শফিঊদ্দিনের মাধ্যমে সমিতি বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রথম তালিকাটি সংগ্রহ করে এবং স্থানীয় পত্র –পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয় । শুধু তা-ই নয়, সমিতির পক্ষ থেকে প্রফেসর বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রীকে ঢাকায় পাঠানো হয় । তিনি এ ব্যাপারে তাঁর অবিজ্ঞতালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন সমিতির নিকট জমা দেন ।
প্রকাশনা
বাংলাদেশে পাকবাহিনীর অত্যাচার ও গণহত্যা সম্পর্কে সঠিক তথ্য তুলে ধরার জন্য সমিতির পক্ষ থেকে বেশ কিছু বুকলেট ও ব্রশিয়্যার প্রকাশ করে বিশ্বব্যাপী প্রচার করা হয় ।এছাড়া, সমতির পক্ষ বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা মুদ্রিত করে প্রচার করা হয় । এটি মুদ্রণের দাতিত্ব পালন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্র এবং ‘ভারত ফটোটাইপ স্টডিও ‘র স্বত্বাধিকারী শ্রী অজীত মোহন গুপ্ত । চিত্রাঙ্গদা স্টুডিওর ফট্যেগ্রফার শ্রী স্বরাজ ভট্রাচার্য বহু মূল্যবান ছবি দিয়ে তাঁকে সাহায্য করেন ।
সমিতির ঊদ্যেগে ঊপাচার্য এবং সমিতির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক সেনের মুখবন্ধ সংবলিত Bangladesh-The Truth শ্রীর্ষক একখানা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ মে মাসের ৯ তারিক প্রকাশিত হয় । দিনটি ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন । গ্রন্থটি বিশ্বের সকল বিশ্ববিদ্যালয়,খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গ,সংসদ এবং পত্র-পত্রিকায় প্রেরণ করা হয় । এর ফলে বাংলাদেশের চলমান ঘটনা সম্পর্কে তাঁরা ভীষণভাবে উৎসাহী হয়ে ওঠেন ।
এ সময় সমিতি আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশ করে । প্রথমটি অধ্যাপক আসফ-উজ-জামানের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ । গ্রন্থটি Radiant Process-এর মালিক শ্রী সুধীর চন্দ্র মুখোপাধ্যায় বিনামূল্যে মুদ্রিত করেন । দ্বিতীয় গ্রন্থটি ঢাকায় দেশবাসীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক আহ্বান (৭ মার্চ ?) সংক্রান্ত । এটি স্বল্প অর্থের বিনিময়ে প্রকাশ করেন ফটোটাইপ স্টুডিওর মালিক শ্রী অজিত মোহন গুপ্ত ।
এ মাসে সমিতি আরো দুটি গ্রন্থ প্রকাশ করে । একটি দুই খন্ডের ছবির অ্যালবাম এবং অন্যটি ডকুমেন্টারি । অ্যালবামের প্রথম খন্ড ভারত ফটোটাইপ এবং দ্বিতীয় খন্ড Radiant Process প্রকাশ করে । দ্বিতীয় গ্রন্থে পান্ডুলিপি তৈরি করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মি. ডর্ফাম্যান এবং তাঁর দুজন সহযোগী । এটিও Radiant Process বিনা মূল্যে প্রকাশ করে ।
সমিতি এ সময় আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে । মেসার্স নয়া প্রকাশ
৩৯৯
প্রকাশিত সেনা প্রশিক্ষণবিষয়ক একখানা গ্রন্থ প্রাথমিক যুদ্ধবিদ্যা প্রত্যেক প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রেরণ করে । গ্রন্থের অনেকগুলো কপি লেখক ও প্রকাশকে পক্ষে থেকে সৌজন্যস্বরূপ দেয়া হয়েছিল । বাংলাদেশের নবীন যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণে এটি অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে এবং তাঁদের দীর্ঘদিনের চাহিদা মেটায় । জুন মাসে সমিতির পক্ষ থেকে একটি বুকলেট ও একখানা গ্রন্থ প্রকাশিত হয় । মেসার্স রেডিয়্যান্ট প্রসেস বিনা মূল্যে Conflict In East Pakistan-Background and Prospects নামক বুকলেটটি প্রকাশ করে । এর লেখক প্রফেসর এডওয়ার্ড ম্যাসন, প্রফেসর রবার্ট ডর্ফম্যান এবং স্টিফেন এ মার্গলিন । তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রচার ও তথ্য বিভাগের সহযোগিতায় পেকাশিত এ বুকলেটটি পেধানত মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় প্রচার করা হয় ।আর গ্রন্থখানা হচ্ছে Bangladesh-Through Lens । এটি আসলে একটি ছবির অ্যালবাম এবং এ জাতীয় প্রথম প্রকাশনা । জুলাই মাসে সমিতি তিনটি গ্রন্থ প্রকাশ করে; Bangladesh-of a new life এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ । প্রথমটির সম্পাদক ড, বঙ্গন্দু গাঙ্গুলী ওড, মীরা গাঙ্গুলী । এর ভূমিকা লেখেন শ্রী চপলাকান্ত ভট্রাচার্য । প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভুমিকাসহ শ্রী যতীন্দ্রনাথ চট্রোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় গ্রন্থটি । আসলে যেসব শিক্ষক ইয়াহিয়ার টার্গেটে পরিণত হইয়েছি,তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত । এ সময় দ্বিতীয় ছবির অ্যালবামটিও প্রকাশিত হয় এবং সমিতির সম্পাদকমণ্ডলী আরো কয়েকটি গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি প্রকাশের জন্য পরীক্ষা করতে থাকেন । এছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড, এস কে মিখার্জী প্রণীত এবং পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত Bangladesh and International Law শীর্ষক গ্রন্থের ৫০০ কপি সমিতিকে দান করা হয়, যেগুলো বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয় । সমিতির এসব কাজে রোটারিয়ান শ্রী সুধীর মুখার্জী সক্রিয় সহযোগিতা করেন । বাংলাদেশের প্রকৃতপক্ষে কী ঘটছে, তা সঠিকভাবে জানার জন্য এ মাসেই ভারতে Bangladesh Fact Finding Committee নামে একটি কমিটি গঠিত হয় । সহায়ক সমিতি এর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রশ্নমালা তৈরি করে দেয় । আগস্ট মাসে কোনো প্রকাশনার খবর পাওয়া যায় না । সেপ্টম্বর-অক্টোবরে চট্রগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওসমান জামালের pakistanisin and Bengali Culture শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় । Good Company-এর মালিক শ্রী বারিন মিত্র বিনামূল্যে এটি মুদ্রণ করেন ।
৪০০
নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সহায়ক সমিতি গুরুত্বপূর্ণ দুটি গ্রন্থ প্রকাশ করে । ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিশেষ বিশেষ ঘটনা-যা বাংলাদেশের অভ্যুথান সহায়তা করে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন সময়ের ছবিসহ Bleeding Bangladesh নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় । এর Foreword লেখেন উপাচার্য প্রফেসর সেন এবং Prefece লেখেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব হোসেন আলী । গ্রন্থটি সম্পাদনা করেন শ্রীমতী শিপ্রা আদিত্য এবং প্রচ্ছদ আঁকেন শ্রী দেবব্রত মুখার্জী । Radiant Process- এর স্বত্বাধিকারী শ্রী মুখার্জী বিনামূল্যে গ্রন্থটি প্রকাশ করেন । দ্বিতীয় গ্রন্থ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি । এটি আসলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বাংলাদেশের সর্ব শ্রেণী ও পেশার নেতৃবৃন্দ শুভেচ্ছার সংকলন । এটি যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেন সহায়ক সমিতির প্রফেসর যতীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী এবং বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির প্রফেসর সুকুমার বিশ্বাস । এক নজরে সমিতির প্রকাশনা ১. ৬দফা দাবি ২. মুজিবরের ঐতিহাসিক ভাষণ ৩. মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ (মূল্য: ১ রুপি) ৪. Bangladesh : The Truth(Rs.1) ৫.Conflict in Earth Pakistan-Background and Prospects ৬.Bangladesh: Through the Lens ৭.Bangladesh: Throes of a New Life ৮. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ৯. মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ১০.Pakistanism and Bengali culture(Rs.3) ১১.Bleeding Bangladesh (picture album;Rs.10) বাংলাদেশ পুনর্গঠন
যুদ্ধের নয় মাস সমিতির কর্মকান্ড বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের গভীর আস্থা অর্জন করে । ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের অসহায় জনগণের সাহায্যের জন্য সমিতিকে অনুরোধ জানানো হয় । তখন সমিতির পক্ষ থেকে ড.পি লাহাড়,শ্রীমতী মৃন্ময়ী বোস,প্রফেসর এ চৌধুরী,শ্রী জে চট্টোপাধ্যায়,শ্রী মানস হালদার,শ্রী অনিল বোস ও সমিতির সম্পাদক প্রফেসর চক্রবর্তী এবং বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে ড.অজয় কুমার রায়,জনাব আনোয়ারুজ্জামান,শ্রী নিত্যগোপাল সাহা ও ড.আনিসুজ্জামানসহ আরো অনেকে যশোর,কুষ্টিয়া ও খুলনা জেলার বিভিন্ন অঞ্চল
৪০১
পরিদর্শন করেন। সেখানে তাঁরা জনগণের মধ্যে ওষুধ,কম্বল,শিশুখাদ্য এবং নগদ অর্থ বিতরণ করেন । তাঁরা কুষ্টিয়া সার্কিট হাউজ দ্রুত পুননির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণাদি সরবারহ করেন । সমিতির পক্ষে এর সমস্ত খরচ বহন করেন শ্রী এন বি মুখার্জী । বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় শহিদ ফান্ড খোলা হলে তাতেও সমিতি অর্থ সাহায্য দেয়। এ সময় পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর ছিলেন শ্রী এ এল দায়াস । তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী বাংলাদেশ পুনর্গঠনে কার্যকর অবদান রাখার উদ্দেশ্যে সমিতি নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে । সেসবের মধ্যে অন্তত এক শিক্ষা বছরের জন্য ধ্বংসপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিস্থানসমূহে পুনর্নির্মাণ এবং নিহত বুদ্ধিজীবীদের পরিবারগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার ওপর তাঁরা সর্বাদিক গুরুত্বারোপ করেন ।এ উপলক্ষে তাঁরা নিম্নলখিত কাগজপত্রও তুলে দেন: ১. জনাব আমিরুল ইসলাম (এমএনএ), চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ স্বাচ্ছাসেবক দল: সশন্ত্র যুবক এবং ত্রাণ ও পুনবাসন সমস্যা; ২. বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা বিভাগ: কৃষি সমবায় ও শিক্ষা । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সাহায্য প্রদানকে নানা জনে নানাভাবে মূল্যায়ন করেন । কেউ বলেন-নিজের স্বার্থেই ভারত এটা করেছে । নিজের স্বার্থ হলো পাকিস্তানকে ভাঙতে পারলে রাজনৈতিক দিক থেকে তার সুবিধা হয় । আবার কেউ বলেন মানবিক কারণেই তাঁরা এটা করেছেন । স্বাধীনতাকামী কোনো জাতিকে বিশ্বের অনেক দেশেই সাহায্য করে । আবার কোনো কোনো দেশ বিরোধিতাও করে । সুতরাং এ বিতর্ক এখানে অবান্তর । বাস্তবতা হচ্ছে ভারত আমাদের পরম মিত্র হিসেবেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই তাঁদের সাহায্য গ্রহণ করেছি । ভারতের সহায়তা না পেলে স্বাধীনতা আমাদের কবে জুটত,কিংবা আদৌ জুটত কিনা এর উত্তর আজানা। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্দী যেভাবে বিশ্বময় ঘুরে-ঘুরে আমাদের প্রতি বিশ্ববাসীর সহানুভূতি আদায় করেছেন, তা এক কথায় অসাধারণ । এ জন্য কোথাও কোথাও তাঁকে অপমানিতও হতে হয়েছে । একা আমাদের পক্ষে এই সহানুভূতি আদায় করা সম্ভব হতো কিনা, সে প্রশ্নের উত্তর অজানা । ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির এই প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, যুদ্ধের পেছনে ভারত সরকারের যে পলিসিই থাকুক না কেন, ভারতের সাধারণ জনগণ অন্তরের টানেই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এ
৪০২
ব্যাপারে সন্দেহে কোনো অবকাশ নেই । যুদ্ধের নয় মাস তাঁরা অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন আমাদের জন্য । জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, অর্থনীতির ওপর অতিরিক্ত চাপ, সামাজিক ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি সমস্যা তাঁদের মোকাবেলা করতে হয়েছে । তারপরও তাঁরা কতভাবে আমাদের সাহায্য করেছেন । উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তাঁরা কতভাবে আমাদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন । আমাদের শিক্ষকদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন । মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করেছেন । আশ্রিত ক্যাম্পবাসীদের অন্ন-বস্ত্রের জোগান দিয়েছেন । চৌদ্দ দিনের যুদ্ধে ভারতের ৪২টি বিমান,৮১টি ট্যাঙ্ক ও ১ খানা যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস হয়। উভয় রণাঙ্গনে ভারতের নিহত সৈন্যসংখ্যা ২৪৭৩, আহত ৬৬৫৮ এবং নিখোঁজ ৩০৩৮ । আর্থিক ক্ষতির কথা বাদই দিলাম। বাংলাদেশ বিরোধীরা ভারতের এ অবদানকে খাটো করে দেখতে পারে । কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যারা বিশ্বাস করেন , স্বাধীন বাংলাদেশকে যারা ভালোবাসেন, তাঁদের পক্ষে একে অন্য দৃষ্টিতে দেখা, কিংবা একে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় । ড.দুলাল ভৌমিক মুক্তিযুদ্ধ ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ স্বাধীনতা সংগ্রামকালে দালালির ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর পরেই সবচেয়ে সুসংগঠিত ভূমিকা পালন করেছিল খাজা খয়েরুদ্দিনের নেতৃত্বধীন কনভেনশন মুসলিম লীগ এবং কাজী কাদেরের নেতৃত্বাধীন কাইয়ুমপন্থি মুসলিম লীগ । কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটিতে জামায়াতে ইসলামীর প্রভাব বলয়ের প্রধান প্রতিদ্বন্দী ছিল এই তিন দল । বাংলাদেশে আজ যে সমস্ত স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি তৎপর তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর পরই মুসলিম লীগের বিভিন্ন অংশের নাম আসতে পারে । আল-শামস বাহিনীতে এই দলের ছাত্রকর্মীদের প্রাধান্য ছিল । আইডিএল-এর পুরনো কর্মীদের প্রায় প্রত্যেকে যেমন রাজাকার ও আল-শামস,মুসলিম লীগের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে । জাতীয় সংসদেও এই দলের এমন কয়েকজন সদস্য রয়েছেন যারা একাত্তরে শান্তি কমিটি ও রাজাকারের মুল নেতৃত্বে ছিলেন । আমরা মুসলিম লীগের কয়েকজন নেতার একাত্তরের বক্তৃতা-বিবৃতির অংশবিশেষ উদ্ধুদ্ধ করব । ’৭১-এ কাইয়ুমপন্থি মুসলিম লীগের প্রাদেশিক প্রধান, বর্তমানে মুসলিম লীগ সভাপতি কাজী আবদুর কাদের শান্তি কমিটি গঠনের সময় করাচিত ছিলেন বলে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটিতে প্রথম থেকেই যোগ দিতে পারেননি । তবে তিনি করাচি থেকে পাকবাহিনীর গণহত্যাকে সমর্থন দান করেন । করাচিত ৮ এপ্রিল
৪০৩
এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক ব্যবস্থা গ্রহণ সঠিক ও সময়োচিত হয়েছে । রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন । পরবর্তীতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে কাজী কাদের স্বাধীনতাবিরোধিতায় মূখ্য ভূমিকা পালন করেন,যে কারণে স্বাধীনতার পর তাঁর নাগরিক্ত্ব বাতিল হয়ে যায় । বর্তমানে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত মুসলিম লীগের স্বাধীনতা বিরোধী নেতৃবৃন্দের মধ্যে কাজী কাদেরের পরের নামটি হতে পারে মুসলিম লীগের সহসভাপতি এএসএম ইউসুফ । দালালির ক্ষেত্রে জামায়াতী নেতাদের চেয়ে তাঁর ভূমিকা কোনোক্রমেই কম ছিল না । ৭ এপ্রিল তারিখেই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে ‘বাংলাদেশে’ সরকারের কোনো অস্তিত্ব নেই । বেতার নগ্ন প্রচারণা,পাকিস্তানে আক্রমণ পরিচালনার জন্য সেখানকার জনগণের তৎপরতা,পাকিস্তানের শাস্তি প্রিয় জনগণকে বিঘ্নিত করার জন্য লোক,অন্ত্র ও অর্থ সংগ্রহের দ্বারা আন্তর্জাতিক সনদের বরখোলাপ করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য আমরা ভারতের তৎপরতার নিন্দা করছি’। ১২ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন) প্রেসিডেন্ট শামসুল হুদা ও সাধারণ সম্পাদক এএনএম ইউসুফ এক যুদ্ধ বিবৃতিতে ‘প্রদেশে সকল পার্টি ইউনিটকে শান্তিরপ্রিয় জনসাধারণকে নিয়ে কমিটি গঠনের জন্য স্ব স্ব অঞ্চলে সক্রিয়ভাবে প্রচেষ্টা চালানোর নির্দেশ দেন । দলীয় ইউনিটগুলোকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে কমিটি গঠনের’ নির্দেশ দিয়ে তাঁরা বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক । পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক জনগণের মিথ্যা প্রচারণা ও উত্তেজনাপূর্ণ কাহিনী শুনিয়ে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হবে না’। মে মাসে এএনএম ইউসুফ প্রথমে দলীয় নেতৃবৃন্দসহ টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তারপর শান্তি কমিটি গঠনের জন্য বিভিন্ন জেলায় সাংগঠনিক সফর শুরু করেন । এ সময় এপিপি পরিবেশিত এক খবরে বলা হয়, ‘মোমেনশাহী জেলায় বিভিন্ন স্থানে দুষ্কৃতকারীদের সমাজ থেকে উৎখাতের জন্য সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছে’। পূর্ব পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক এএনএম ইউসুফ মোমেনশাহী জেলার সকল মহকুমা সদর দফতরসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো সফর করেন । অধিকাংশ জায়গাতে তার উপস্থিতিতেই শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছে । ময়মনসিংহ সফরের পর তিনি উত্তরবঙ্গের শান্তি কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যে সাংগঠনিক সফর করেন । মানিকগঞ্জ, পাবনা, শাহজাদপুর ও বগুড়া সফর করে তিনি এ সমস্ত এলাকায় শান্তি কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে। ২৫
৪০৪