You dont have javascript enabled! Please enable it! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব - মযহারুল ইসলাম (Part 3) - সংগ্রামের নোটবুক

‘ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে ছিলেন?’
‘হতে পারে। আমি ঠিক বলতে পারছি না।’
‘১৯৬৭ সালের জুন মাসে সীম্যান সুলতান উদ্দিন আহমদ করাচীতে ছিলেন, এটা কি ঠিক?’
সাক্ষী এ প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘জানি না।’ তবে উক্ত মাসে তিনি ঢাকায় আমার বাসায় এক মিটিং-এ যোগ দিয়েছেন।
‘কিন্তু, যদি বলা হয়, সুলতান উদ্দিন সারা জুন মাসই করাচীতে ছিলেন?’
‘আমি তা’ জানি না।’
… … … …

“আপনি যে আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে ‘ডজডার্ট’-এ ক’রে ফেনী সীমান্তে গিয়েছিলেন–সে কে?”
‘সে পি. আই. এ-র একজন টেলিফোন অপারেটর।’
‘আপনি পি. আই. এ-র একজন ডিস্ট্রিক্ট ম্যানেজার। আপনার সাথে একজন টেলিফোন অপারেটরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ কী ক’রে থাকে?’
‘আনোয়ার হোসেন ছিলেন পি. আই. এ-র এমপ্লয়ীজ ইউনিয়নের সেক্রেটারী। সেই সূত্রে পরিচয।’ … …
‘স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান কী কাজ করতেন আপনি কি তা’ জানেন?’
‘তিনি নৌ-বাহিনীর একটা অফিসার্স মেসে কাজ করতেন।’
‘তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা কতটুকু?’
‘আমি জানি না।’
‘আমরা জানি–‘স্টুয়ার্ড’ মানে যে খাবার এনে দেয়। এমন লোককে কেন আপনারা অর্থ-সংগ্রহের ব্যাপারে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছিলেন?’
‘মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছিলেন, অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপারে স্টুয়ার্ড মুজিবরের বেশ জ্ঞান আছে।’
“আপনাদের দলে তো বেশ কয়েকজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এবং ক্যাপ্টেনও ছিলেন। তাঁরা স্টুয়ার্ড মুজিবরের চাইতে বেশী যোগ্য। তবু কেন স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমানকে সেখানে পাঠানো হ’ল? আলী রেজাই বা সেখানে গেলেন কেন? তিনি তো আর অস্ত্রবিশারদ নন।”
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৮৩

‘আমি জানি না, মোয়াজ্জেম হোসেন জানেন।’
‘আগরতলা সীমান্তে প্রতিনিধিদের পৌঁছে দেবার দিন স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমানের কাছ থেকে যে ট্রাঙ্ককল পান সেটা কখন?’
‘ওই দিন বেলা তিনটে নাগাদ।’
‘ডজগাড়ি ঘন্টায় কত মাইল যায়?’
‘৫০ থেকে ৬০ মাইল।’
‘চট্টগ্রাম থেকে ফেনীর দূরত্ব কত?’
‘৬৫ মাইল।’
‘আপনি বিকেল তিনটে থেকে পাঁচটার মধ্যে কোন ট্রাঙ্ককল পান নি?’
‘একথা ঠিক নয়।’
‘আপনি এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে কতদিন যুক্ত ছিলেন?’
‘গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।’
‘কিন্তু আপনি ম্যাজিস্ট্রেট-এর নিকট প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেছেন যে, মোয়াজ্জেম হোসেন সাহেবের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে যাওয়ার পর পার্টির সঙ্গে কোন সংযোগ ছিলো না।’
‘কী বলেছি মনে নেই।’
আবদুস সালাম খান একটা দলিল পরীক্ষা ক’রে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কর্নেল শেখ কি বাংলাভাষী?’
‘না।’
‘আপনি আপনার ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেছেন, স্বাধীন পূর্ব বাংলায় সব সম্পত্তি ও শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হবে। পৃথিবীর আর কোন দেশ সম্পত্তি ও শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেছে বলে শুনেছেন?’
‘সোভিয়েট ইউনিয়ন ও চীন করেছে।’
‘সভায় যে পরিকল্পিত পতাকাটি পেশ করা হয়েছিল তা’ কিসের তৈরী?’
‘কাপড়ের।’
‘ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট আপনি কি বলেছিলেন যে, পতাকায় পাটের ছবি আঁকা ছিল?’
‘আমার মনে নেই।’
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৮৪

‘ডি-ডে’র (ক্ষমতা দখলের দিন) কোন তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল কি?’
‘না।’
… … … …

সালাম খান জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘দলে টানার জন্য আপনি কারুর সাথে যোগাযোগ করেছিলেন কি?’
‘কে. এম. শামসুর রহমান ছাড়া আমি আর কারো সাথে যোগাযোগ করি নি।
‘শামসুর রহমান সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন?’
‘শামসুর রহমান সি. এস. পি. পরীক্ষায় ফাষ্ট হয়েছিলেন। তিনি খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন।’
‘পূর্ব পাকিস্তানের কোন বাঙালী সামরিক অফিসারকে চেনেন কি?’
‘হ্যাঁ, কর্নেল রব, কর্নেল জব্বার, কর্নেল রহমান এবং কর্নেল মাশকুরুল হক।’
‘তাঁদের দলে আনার চেষ্টা করেছিলেন কি?’
‘না।’
‘ওসমানীর সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময় ক্যান্টনমেন্টের গেটে কি কি জিনিস দেখতে পেয়েছিলেন?’
‘একটা বাঁশের ফাঁড়ি, একজন সেন্ট্রি ও একটা সাইন বোর্ড।’
‘আচ্ছা, বলুন তো ওয়ারলেস সেটের আকৃতি কিরূপ?’
‘ওয়ারলেস সেট দু’ বা এক ফুট বা তারও ছোট হ’তে পারে।’
‘এ ধরনের যন্ত্রে কতো দূরের খবরাখবর আদান-প্রদান করা যায়?’
‘আমার জানা নেই।’
‘ট্রান্সমিটার সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?’
‘একটা রেডিও সেটে কিছু পার্টস সংযোজন করলেই ট্রান্সমিটার সেট করা যায়।’
‘ওয়ারলেস সেট সম্পর্কে আপনাদের সভায় কি কোন আলোচনা হয়েছিল?’
‘হ্যাঁ, মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছিলেন, আমাদের ৬টি শ্লেভ সেট এবং
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৮৫

একটি মাস্টার সেটের প্রয়োজন। শ্লেভ সেটগুলো মাস্টার সেটের সাথে যুক্ত করা হবে।’
‘আচ্ছা বলুন তো, একটা ট্রানজিস্টারাইজড এবং একটি ওয়ারলেস সেটের মধ্যে পার্থক্য কী?’
‘আমি জানি না।’
‘আপনাদের দলের কেউ ওয়ারলেস সেট ব্যবহার করতে জানতেন কি?’
‘বোধ হয়, কেউ জানতেন না।’
‘আপনি কি জানেন কর্পোরাল সামাদ ওয়ারলেস ইন্সপেক্টর ছিলেন?’
‘আমার জানা নেই।’
সালাম খান আর জেরা না ক’রে বসে পড়লেন। এর পর উঠে দাঁড়ালেন আতাউর রহমান খান। তিনি সাক্ষীকে প্রশ্ন করলেন, আপনার প্রকৃত নাম কী?’
‘রমিজ উদ্দীন মোল্লা। ১৯৫৩ সালে বিমান বাহিনীতে চাকুরী নেয়ার সময় আমি আমার নাম পরিবর্তন করি।’
‘আপনি বোধাই মণ্ডলকে চেনেন?’
একটু ইতস্ততঃ ক’রে সাক্ষী বললেন, ‘হ্যাঁ, তিনি আমার প্রপিতামহ। আমার পিতার নাম আলিম উদ্দীন।’
‘রোজিয়া বিবিকে চেনেন?’
সাক্ষী যেন একটু রেগে উঠলেন। তারপর বললেন, ‘না, চিনি না।’
আতাউর রহমান একটু স্মিত হাসি হেসে বললেন, ‘সে কি! নিজের খালাকে চেনেন না।’
একথা বলার পর আতাউর রহমান সাহেব বসে পড়লেন। অপর কয়েকজন জেরা করলেন। তারপর কয়েক দিনের জন্য অধিবেশন মুলতবী রাখা হ’ল।
২৮শে জানুয়ারী, ১৯৬৯ সাল। সময় সকাল ১০টা বেজে পনেরো মিনিট। কুর্মিটোলা ছাউনির অভ্যন্তরে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সামনে আসামীর কাঠগড়ায় এসে দাঁড়ালেন শেখ মুজিব। ভারতীয় অর্থ ও অস্ত্রের সাহায্যে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগের জবাব দিতে হবে তাঁকে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৮৬

আদালতের চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন শেখ মুজিব। তারপর দৃপ্ত কণ্ঠে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন। তিনি বললেন, ‘পূর্ব বাংলার দাবী-দাওয়া ধামাচাপা দেওয়াই এ মামলার উদ্দেশ্য। উক্ত আদালতে তিনি যে লিখিত জবানবন্দী পেশ করেন, তা’ আজো ইতিহাসের বিষয় হয়ে রয়েছে। জবানবন্দীটি নিম্নে উদ্ধৃত করা গেল।

শেখ মুজিবের জবানবন্দী
“স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ কাল থেকেই আমি পাকিস্তান অর্জনের জন্য নিরলস সংগ্রাম করেছি। আমি প্রাক-আজাদী কালে ভারতীয় ও বঙ্গীয় মুসলিম লীগের বিশেষ সক্রিয় সদস্য ছিলাম এবং লেখাপড়া জলাঞ্জলি দিয়ে আমি পাকিস্তান হাসিলের জন্য কাজ ক’রে গেছি। আজাদী লাভের পর মুসলিম লীগ পাকিস্তানের জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করার ফলে ১৯৪৯ সালে আমরা মরহুম জনাব এইচ. এস. সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গঠন করি। আওয়ামী লীগ পূর্বেও নিয়মতান্ত্রিকতার পথ অনুসারী একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিগণিত ছিল এবং এখনো তা’ সেইরূপই রয়েছে।
১৯৫৪ সালে আমি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হই এবং পরে আমি জাতীয় পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হই। আমি দু’বার পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলাম। তা’ ছাড়াও আমি গণচীন রিপাবলিকে প্রেরিত পার্লামেন্টারী প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করেছিলাম। জনসাধারণের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী দল গঠনের জন্য ইতিপূর্বেই এ সময়ের মধ্যে আমাকে কয়েক বৎসর কারাভোগ করতে হয়েছে। সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর বর্তমান সরকার আমার ওপর নির্যাতন চালাতে শুরু করেন। তাঁরা ১৯৫৮ সালের ১২ই অক্টোবর তারিখে পূর্ব পাকিস্তান জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স অনুসারে আমাকে গ্রেফতার করেন এবং প্রায় দেড় বৎসর কাল আমাকে বিনা বিচারে আটক রাখেন। আমি এ ভাবে আটক থাকার সময় তাঁরা আমার বিরুদ্ধে ৬টি ফৌজদারী মামলা রুজু করেন, কিন্তু সকল অভিযোগ থেকে আমি সসম্মানে ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর অথবা ১৯৬০ সালের জানুয়ারী নাগাদ উক্ত
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৮৭

আটক অবস্থা থেকে মুক্তিলাভ করি। আমার মুক্তিলাভের সময়ে আমার উপর এই মর্মে বিধি-নিষেধ জারী করা হয় যে, ঢাকা ত্যাগ করতে হ’লে আমাকে লিখিতভাবে, আমি কোন কোন স্থানে যেতে চাই তার বিবরণ স্পেশাল ব্রাঞ্চকে জানাতে হবে এবং ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পরও লিখিতভাবে সে বিষয় স্পেশাল ব্রাঞ্চকে জানাতে হবে। গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা সর্ব সময় ছায়ার মত আমার পিছনে থেকেছে। অতঃপর ১৯৬২ সালের বর্তমান শাসনতন্ত্র জারী করার প্রাক্কালে আমার নেতা মরহুম এইচ. এস. সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয়। সে সময় আমাকেও জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স অনুসারে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় এবং প্রায় ছয় মাসকাল আমাকে বিনা বিচারে আটক রাখা হয়। জনাব সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর পাকিস্তানের উভয় অংশেই অন্যতম রাজনৈতিক দল হিসাবে ১৯৬৪ সালের জানুয়ারী মাসে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয় এবং সম্মিলিত বিরোধী দলের অন্যতম অঙ্গদল হিসাবে আমরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। সম্মিলিত বিরোধী দলের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রার্থী হিসাবে জনাব আইয়ুব খানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে মোহতারেমা মিস ফাতেমা জিন্নাহকে মনোনয়ন দান করা হয়। আমরা তখন নির্বাচনী অভিযান শুরু করি। আমার বক্তৃতাসমূহ সম্পর্কে কয়েকটি মামলা রুজু ক’রে পুনরায় আমার বিরোধিতা ও আমাকে হয়রানী করা শুরু হয়। ১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধ চলতে থাকার সময় যে সকল রাজনৈতিক নেতা ভারতীয় আক্রমণের নিন্দা করেন আমি তাঁদের অন্যতম এবং সরকারের যুদ্ধ-প্রচেষ্টাকে পুরাপুরিভাবে সমর্থন করার জন্য আমি আমার পার্টি ও জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই। যুদ্ধ-প্রচেষ্টায় সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য করার জন্য আহ্বান জানিয়ে আমার প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও তার সকল ইউনিটের নিকট সার্কুলার প্রেরণ ক’রে উক্ত যুদ্ধের সময়ে পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের ভবনে যে সর্বদলীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় উহার পক্ষ থেকে আমি এই অংশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সাথে একটি যুক্ত বিবৃতি ইস্যু করি। উক্ত বিবৃতিতে ভারতীয় আক্রমণের নিন্দা করা হয় এবং ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ ক’রে
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৮৮

যাওয়ার জন্য এবং দেশের যুদ্ধ-প্রচেষ্টায় সাহায্য করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আগমন করলে আমন্ত্রিত হয়ে আমি স্বয়ং এবং অন্যান্য সকল রাজনৈতিক নেতা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করি। উক্ত সাক্ষাৎকারের সময়ে আমি পূর্ব পাকিস্তানকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দান এবং যুদ্ধের সময়ের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানকে প্রতিরক্ষার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ ক’রে তোলার জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট আবেদন জানাই। কারণ যুদ্ধের সময়ে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান এবং বিশ্বের অবশিষ্ট অংশ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। আমি তাসখন্দ ঘোষণাকেও সমর্থন করেছিলাম। কারণ আমার পার্টি ও আমি অগ্রগতির জন্য বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাসী, বিধায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে যাবতীয় আন্তর্জাতিক বিরোধের মীমাংসা হওয়া উচিত বলে মনে করি।
১৯৬৬ সালের গোড়ার দিকে লাহোরে একটি সর্বদলীয় জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনের বিষয়-নির্বাচনী কমিটির নিকট আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যাবলীর নিয়মতান্ত্রিক সমাধানের উপায় হিসাবে ৬-দফা কর্মসূচী পেশ করি। ৬-দফা কর্মসূচীতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয়কেই পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দানের কথা বলা হয়েছে।
অতঃপর আমার পার্টি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ৬-দফা কর্মসূচী গ্রহণ করে এবং যাতে দেশের উভয় অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বৈষম্যমূলক অবস্থা দুর করা যেতে পারে তার জন্য উহার (অর্থাৎ ৬দফার) অনুকূলে জনমত গঠনের উদ্দ্যেশ্যে আমরা জনসভা অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হই।
তাতে সরকারী-যন্ত্র এবং প্রেসিডেন্টসহ সরকারী দলের নেতৃবৃন্দ আমার প্রতি অস্ত্রের ভাষায় ও গৃহযুদ্ধের হুমকী প্রদান করেন এবং আমার বিরুদ্ধে ডজনখানেকেরও বেশী মামলা রুজু ক’রে আমাকে হয়রানী করতে শুরু করেন। তাঁরা প্রথমে ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে যশোরে আমাকে গ্রেফতার করেন। এ সময়ে আমি খুলনায় জনসভা অনুষ্ঠানের পর যশোর হয়ে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করছিলাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৮৯

আপত্তিকর বলে কথিত বক্তৃতা দানের অভিযোগে ঢাকা থেকে প্রেরিত গ্রেফতারী পরোয়ানাবলে তথায় আমাকে আটক ও গ্রেফতার করা হয়। আমাকে ঢাকা মহকুমা মাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করা হয়। আমি ঢাকার সদর মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির হই। কিন্তু তিনি আমার জামিন মঞ্জুর করতে অস্বীকার করেন। তবে মাননীয় দায়রা জজ আমার জামিন মঞ্জুর করলে ঐ দিনই আমাকে মুক্তি দেয়া হয়। আমি সন্ধ্যা সাতটার সময় স্বগৃহে আগমন করি। ঐ দিন রাত ৮টার সময় সিলেটে তথাকথিত আপত্তিকর বক্তৃতা দানের ব্যাপারে সিলেট থেকে প্রেরিত একটি গ্রেফতারী পরোয়ানাসহ পুনরায় পুলিশ আমার গৃহে উপস্থিত হয়। আমাকে তখন গ্রেফতার করা হয় এবং ঐ দিন রাত্রে পুলিশ পাহারাধীনে আমাকে সিলেটে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন সকালে সিলেটের মহকুমা ম্যাজিষ্ট্রেট আমার জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন এবং তিনি আমাকে জেলে পাঠান। পরদিন সিলেটের মাননীয় দায়রা জজ আমার জামিন মঞ্জুর করেন। মুক্তিদানের পর পুলিশ ময়মনসিংহের এক জনসভায় আপত্তিকর বলে কথিত একটি বক্তৃতা দানের দায়ে ময়মনসিংহ থেকে প্রেরিত একটি গ্রেফতারী পরোয়ানাবলে সিলেটে আমাকে গ্রেফতার করে। আমাকে ময়মনসিংহের মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করা হয়। অনুরূপভাবে তিনি আমার জামিন মঞ্জুর করতে অস্বীকার করেন এবং আমাকে জেলে প্রেরণ করেন। ধারাবাহিকভাবে এসব গ্রেফতার, হয়রানী ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। পরদিন ময়মনসিংহের দায়রা জজ আমার জামিন মঞ্জুর করেন এবং জেল থেকে মুক্তিলাভ ক’রে আমি ঢাকা প্রত্যাবর্তন করি।
১৯৬৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ৮ই মে তারিখে আমি নারায়ণগঞ্জে এক জনসভায় বক্তৃতা দান করি এবং রাত্রে আমি আমার বাসায় প্রত্যাবর্তন করি। ঐ দিন রাত্রি একটার সময় পুলিশ পাকিস্তান রক্ষাবিধি অনুসারে আমাকে গ্রেফতার করে। তারপরই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী তাজউদ্দিন আহমদ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মোশতাক আহমদ, প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট মজিবর রহমান, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯০

এম. এ. আজিজ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রাক্তন ট্রেজারার নূরুল ইলাম চৌধুরী, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের লেবার সেক্রেটারী জহুর আহমদ চৌধুরীসহ অন্যান্য বহুসংখ্যক পার্টি নেতাকে যুগপৎ গ্রেফতার করা হয়। কয়েক দিন পর এম. এন. এ. ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অর্গানাইজিং সেক্রেটারী মেসার্স মীজানুর রহমান, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পাবলিসিটি সেক্রেটারী এ. মোমেন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সোস্যাল ওয়েলফেয়ার সেক্রেটারী ওবায়দুর রহমান, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শামসুল হক, ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট হাফিজ মোহাম্মদ মুসা, এডভোকেট ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মোল্লা জালালউদ্দিন আহমদ, প্রাক্তন মন্ত্রী ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, প্রাক্তন এম. এন. এ. আমজাদ হোসেন, এডভোকেট আমিন উদ্দিন আহমদ, পাবনার এডভোকেট আমজাদ হোসেন, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা সারোয়ার, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী মহিউদ্দিন আহমদ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অফিস সেক্রেটারী জনাব মোহাম্মদুল্লাহ, এডভোকেট ও অন্যতম নেতা জনাব শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সেক্রেটারী জনাব বজলুর রহমান, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের অফিস সেক্রেটারী জনাব সিরাজুদ্দিন আহমদ, রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব হারুন-অর রশীদ, তেজগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট জনাব শাহাবুদ্দীন চৌধুরী, ঢাকা সদর নর্থ আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী জনাব আবদুল হাকিম, ধানমণ্ডি আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব রাশেদ মোশাররফ, সিটি আওয়ামী লীগের অফিস সেক্রেটারী জনাব সুলতান আহমদ, গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগ কর্মী জনাব নূরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের অস্থায়ী সেক্রেটারী জনাব. এম. এ. মান্নান, পাবনার এডভোকেট জনাব হাসনাইন, ময়মনসিংহের গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগ কর্মী জনাব এ. রহমান সিদ্দিকী, এবং অন্যান্য বহুসংখ্যক কর্মী ও ছাত্র এবং শ্রমিক নেতাকে পাকিস্তান রক্ষাবিধির ৩২নং ধারা অনুসারে গ্রেফতার করা হয় ও কারাগারে
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯১

আটক রাখা হয়। তাঁরা আমার এক ভাগিনেয় প্রাক্তন জি. এস. ই. পি. এস. এল. শেখ ফজলুল হক ও এক ভ্রাতুষ্পুত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ শহীদুল ইসলামকেও কারারুদ্ধ রেখেছেন।
উপরোক্তগুলি ছাড়াও সরকার পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদপত্র ‘ইত্তেফাক’কে নিষিদ্ধ করেছেন। উহার একমাত্র কারণ এই যে, উক্ত পত্রিকা কখনো কখনো আমার পার্টির অভিমতকে সমর্থন করতেন। সরকার উহার প্রেসকেও বাজেয়াপ্ত করেছেন, উহার সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন স্বনামধন্য সাংবাদিক জনাব তফাজ্জল হোসেন ওরফে মানিক মিয়াকে আটক করেন, তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে রাখেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকটি ফৌজদারী মামলা রুজু করেন। চট্টগ্রামের গুরুত্বপুর্ণ আওয়ামী লীগ নেতা এবং চট্টগ্রাম মুসলিম চেম্বার অব কমার্সের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব ইদ্রিসকেও পাকিস্তান রক্ষাবিধি অনুসারে কারারুদ্ধ করা হয়।
আমাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদস্বরূপ আমার পার্টি ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন তারিখে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে। সারা প্রদেশে অনুষ্ঠিত এই প্রতিবাদ ধর্মঘটের সময়ে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলি চালনায় ১১ জন নিহত হয় ও প্রায় ৮০০ জন কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়, এবং অন্যান্য অসংখ্য লোকের বিরুদ্ধে কতিপয় মামলা রুজু করা হয়।
পূর্ব পাকিস্তান গভর্নর জনাব মোনায়েম খান কমবেশী খোলাখুলিভাবেই দলে দলে অফিসার ও অন্যান্যদের বলেন যে, যতদিন তিনি (জনাব মোনায়েম খান) বর্তমান থাকবেন ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে থাকতে হবে। ইহা অনেকেরই জানা আছে।
আমাকে আটক রাখার পর থেকে আমাকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের মধ্যে কতিপয় বিচারের সম্মুখীন হ’তে হয়েছে এবং ঐ সময় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলেই আদালতের অধিবেশনের ব্যবস্থা করা হ’ত। উক্ত আটক অবস্থার প্রায় ১১ মাস পরে ১৯৬৮ সালের ১৭ই বা ১৮ই জানুয়ারী নাগাদ রাত ১টার সময় আমাকে আটক অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং জেলগেট থেকে কতিপয় সামরিক কর্মচারী আমাকে জোরপূর্বক ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসে
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯২

এবং তথায় একটি রুদ্ধ কক্ষে আমাকে আটক রাখা হয় ও আমাকে কারো সাথে দেখা করতে দেওয়া হয় না। আমাকে এমনকি খবরের কাগজও পড়তে দেওয়া হয় নি। দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে আমাকে কার্যতঃ বিশ্বের অবশিষ্ট অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল। এ সময়ে আমার প্রতি অমানুষিক মানসিক নির্যাতন চালান হয় এবং আমাকে যাবতীয় সুখ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। সেই মানসিক নির্যাতন সম্বন্ধে যত কম বলা যায় ততই ভাল।
১৮ই জুন তারিখে অর্থাৎ বর্তমান মামলা শুরু হওয়ার ঠিক একদিন পূর্বে সর্বপ্রথম আমি এডভোকেট জনাব আবদুস সালাম খানের সাথে সাক্ষাৎ করি এবং আমি তাঁকে অন্যতম আইনজ্ঞ হিসাবে নিযুক্ত করি।
আমাকে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে এবং আমাকে ও আমার পার্টিকে লোকচোক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে আমাকে মিছামিছি মামলায় জড়িত করা হয়েছে। ৬-দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও চাকুরীর ক্ষেত্রে সংখ্যা সাম্যের দাবীকে ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এ মামলায় আমাকে ও আমার পার্টিকে মিছামিছি জড়িত করা হয়েছে। আমি লেঃ কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, লেঃ মোজাম্মেল হোসেন, ভূতপূর্ব কর্পোরাল আমীর হোসেন, এল. এস. সুলতানউদ্দিন আহমদ, কামাল উদ্দিন আহমদ, স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান, ফ্লাইট সার্জেন্ট মাহফুজুল্লাহ, এবং মামলায় জড়িত স্থল, বিমান ও নৌবাহিনীর অন্যান্য কর্মচারীদের কাউকেই এই কোর্টে আসার আগে আমি চিনতাম না। আমি সি. এস. পি. অফিসারত্ৰয় মেসার্স আহমদ ফজলুর রহমান, রুহুল কুদ্দুস এবং শামসুর রহমানকে জানি। কারণ আমি মন্ত্রী থাকা কালে তাঁরা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীনে চাকুরী করতেন বিধায় সময় সময় তাঁদের জানার সুযোগ আমি পেয়েছি। কিন্তু আমি তাদের সাথে কখনও রাজনীতি বা ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আলাপ করি নি। লেঃ কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন বা কামাল উদ্দিন আহমদের করাচীস্থ বাসভবনে অথবা তাজউদ্দিন আহমদের বাড়ীতে এ মামলায় জড়িত কারো সাথে আমার কোনও বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় নি। ও সব লোক কখনো আমার বাড়ী যান নি। বর্তমানকার তথাকথিত ষড়যন্ত্র
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯৩

মামলায় জড়িত কাউকে আমি কোন অর্থ দেই নি। আমি কখনো ডাঃ সাইদুর রহমান বা মানিক চৌধুরীকে অভিযোগে প্রকাশিত ষড়যন্ত্রে সাহায্য করতে বলি নি। তাঁরা আমার পার্টির শত শত কর্মীর মতই সাধারণ কর্মী মাত্র। আমার পার্টির (পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ) তিনজন ভাইস প্রেসিডেন্ট, ৪৪ জন কার্যকরী সংসদ সদস্য, একজন জেনারেল সেক্রেটারী ও ৮ জন সেক্রেটারী রয়েছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন বহু প্রাক্তন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রী, এম. এন. এ. ও এম. পি. এ. । বর্তমানে জাতীয় পরিষদের ৫ জন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ১০ জন সদস্য আমার দলভুক্ত। চট্টগ্রাম জেলা ও নগর আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারীগণ প্রাক্তন এম. এন. এ. এবং এম. পি. এ. । তা’ ছাড়া সেখানকার বহু প্রতিপত্তিশালী ও ধনবান লোক আমার পার্টিতে রয়েছেন। তাঁদেরও আমি কখনো কোন সাহায্যের কথা বলি নি। কাজেই মানিক চৌধুরীর মত সাধারণ ব্যবসায়ী এবং সাইদুর রহমানের মত সাধারণ একজন এম. এল. এফ. ডাক্তারকে সাহায্যের কথা বলাটা আমার পক্ষে অসম্ভব। ১৯৬৫ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জনাব জহুর আহমদ চৌধুরীর বিরোধিতা করার দায়ে ডাঃ সাইদুর রহমানকে পার্টি থেকে সাসপেণ্ড করা হয়েছিল। আমি কখনো ডাঃ সাইদুর রহমানের বাড়ী যাই নি।
নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আমি প্রেসিডেন্ট। দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নকল্পে আমার পার্টির সুনির্দিষ্ট ও গঠনমূলক ম্যানিফেস্টো এবং কর্মসূচী প্রণয়ন করা হয়েছে। আমি অনিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। ৬-দফা কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত উপায়ে দেশের উভয় অংশের প্রতি সুবিচারই আমার কাম্য। যা কিছু দেশের পক্ষে কল্যাণকর মনে করেছি, তাই নিয়মতান্ত্রিক সীমার মধ্যে থেকে আমি সর্বদাই প্রকাশ্যতঃ বলেছি। তথাপি শাসকগোষ্ঠী ও কায়েমী স্বার্থবাদীরা আমাকে এবং আমার পার্টিকে দমিয়ে রেখে পাকিস্তানী জনগণকে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানীদের শোষণের ব্যবস্থা চিরস্থায়ী করতে চায়।
আমার বক্তব্যের সমর্থনে আমি মাননীয় আদালত সমক্ষে আরো বলতে চাই যে, প্রতিহিংসাবশে আমায় এ মামলায় মিথ্যা জড়ানো হয়েছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯৪

পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের ৬ই জানুয়ারী (১৯৬৮) তারিখের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ২৮ জন অভিযুক্তের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। এবং তাতে আমার নামের তালিকা ছিল না। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল যে, সকল আসামীই দোষ স্বীকার করেছে। তদন্ত প্রায় শেষ হয়ে আসছে এবং শীঘ্রই বিচার শুরু হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
মন্ত্রী দফতর কর্তৃক প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রচার প্রসঙ্গে একজন প্রাক্তন মন্ত্রী হিসেবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে একথা বলতে পারি যে, পূর্বাহ্নে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সেক্রেটারী কর্তৃক ব্যক্তিগতভাবে দলিল পরীক্ষিত ও অনু্মোদিত হওয়া ব্যতিরেকে কোন বিভাগ হতে কোন প্রকার প্রচারপত্র প্রকাশ করা যায় না। এবম্বিধ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে কোন প্রচারপত্র প্রকাশ করতে হলে পূর্বে প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রেসিডেন্টের অনুমোদন নেওয়া আবশ্যক। বর্তমান মামলাও উল্লিখিত নিষ্পেষণ ও নির্যাতন নীতির পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নয়। অধিকন্তু স্বার্থবাদী মহল কর্তৃক শোষণ অব্যাহত রাখার যে যড়যন্ত্র জাল বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বিস্তার করেছে, এই মামলা তারই বিষময় প্রতিক্রিয়া।
আমি পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে কখনো কিছু করি নি এবং পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য স্থল, বিমান বা নৌবাহিনীর কোন কর্মচারী অথবা অন্য কারো সাথে কোন প্রকার ষড়যন্ত্র করি নি। আমি নির্দোষ এবং সম্পূর্ণরূপে নিরপরাধ। কথিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।
[ কৃত্তিবাস ওঝা, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০৯-১৭]

লেঃ কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের জবানবন্দী
এরপর দুই নম্বর আসামী লেঃ কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাঁর জবানবন্দীতে বললেনঃ “গ্রেফতারের পর আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এইমর্মে একটি বিবৃতি দিতে বলে যে, আমি শেখ মুজিবুর রহমান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, এস, এম. মোর্শেদ, সি. এস. পি অফিসার এ. এফ. রহমান, শামসুর রহমান এবং আরো অনেকের নাম বলে গেলে তাঁদের চিনি এবং বলি তাঁরা সকলে স্বাধীন পূর্ব বাংলার আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। বিবৃতিতে যেন আরো উল্লেখ করি, কমাণ্ডো স্টাইলে বিপ্লব
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯৫

করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান সৈনিকদের সংঘবদ্ধ করতে বলেন আমাকে। আমি যেন বলি, ভারত আমাদের অর্থ এবং অস্ত্র সাহায্য দিচ্ছে মিস্টার ওঝার মারফৎ।
আমি এই মিথ্যা বিবৃতি দিতে অস্বীকার করায় কর্নেল আমীর হোসেন ঘুষি মেরে আমার দাঁত ভেঙে দেন।
লেঃ কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম তাঁর সেই ভাঙা দাঁতটি সঙ্গে সঙ্গে আদালতে দাখিল করলেন এবং বললেনঃ তাঁরা আমায় বললেন, যদি আমি তাঁদের কথানুযায়ী বিবৃতি দেই, তা’ হলে আমার অবসর গ্রহণের আবেদন মঞ্জুর করা হবে। অন্যথায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমাকেও ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠাবে। কর্নেল আমীর বললেন, ‘তুমি সহযোগিতা না করলেও অনেকেই করবে। বেসামরিক আদালতে যদি শেখ মুজিব রেহাই পান, সামরিক আদালতে তাঁর মুক্তিলাভের চান্স নেই। মুজিবকে আমরা শেষ করবো। আমাদের প্রেসিডেন্টের বড় শত্রু সে।’
প্রলোভন ও ভীতি প্রদর্শন সত্ত্বেও আমি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজী হলাম না। শেখ মুজিবুর কখনও দেশদ্রোহী হতে পারেন না। তিনি দেশপ্রেমিক। পূর্ব বাংলার সাড়ে ছয় কোটি মানুষের নেতা। তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে আল্লাহ আমায় ক্ষমা করবেন না। বিবৃতি দিতে রাজী হই নি বলে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজিয়েছেন সরকার।”
[ কৃত্তিবাস ওঝা, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০২-৩০৩]

স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমানের জবানবন্দী
তাঁর বক্তব্য শেষ হওয়ার পর বাইশ পৃষ্ঠাব্যাপী একটি লিখিত বিবৃতিও তিনি দাখিল করলেন। এরপর আসামীর কাঠগড়ায় এসে দাঁড়ালেন স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান। তাঁর উপর যে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল, তিনি আদালতে তার এক হৃদয়বিদারক বর্ণনা দেন। জবানবন্দীতে স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান বলেনঃ
‘১৯৬৭ সালের ৯ই ডিসেম্বর ঢাকা থেকে আমাকে গ্রেফতার ক’রে প্রথমে রাজারবাগ, পরে কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যায়। ১১ই ডিসেম্বর আবার আমাকে রাজারবাগ নিয়ে গেল। আমি একটা কক্ষে বসে আছি। একটু বাদে কয়েকশীট টাইপ করা কাগজ হাতে নিয়ে ঢুকলেন লেফটেন্যান্ট
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯৬

শরীফ। তিনি কাছে এসে টাইপকরা শীটগুলো পড়ে গেলেন। তাতে বহু আর্মি অফিসার, সি. এস. পি. অফিসার এবং রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর নাম উল্লেখ ছিল। উল্লেখ ছিল, তাঁরা কিভাবে ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা’ গঠন করবার চেষ্টা করছেন। লেফটেন্যান্ট শরীফ আমাকে ঐ তৈরী স্টেটমেন্ট অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে একটি বিবৃতি দিতে বললেন। বলতে লাগলেন, আমি তাঁদের চিনি এবং ঐ দলে ছিলাম। এই মিথ্যা বিবৃতি দিতে অস্বীকার করলাম আমি। তখন একটা নির্জন কক্ষে নিয়ে গেল আমাকে। তারপর শুরু হ’ল নির্যাতন। নখের ভিতর পিন ঢুকিয়ে দিল। রুল দিয়ে পিটোতে লাগলো একটি লোক। জামা কাপড় রক্তে সপসপে হয়ে উঠল। নাক, মুখ, মাথা দিয়ে রক্ত গড়াল আমার। জ্ঞান হারালাম, বিকেল চারটের দিকে জ্ঞান ফিরলে দেখলাম মেজর নাসের ঘরে ঢুকছেন। তিনিও আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ঐ মিথ্যা জবানবন্দী দিতে বললেন। ‘আমি পারব না’ বলার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড চড় কষালেন তিনি আমার গালে। মারপিটে আমার অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠল। শেষে ডাক্তারের পরামর্শে কয়েকটা দিন মারপিট বন্ধ রাখল তাঁরা। ১৮ই ডিসেম্বর আবার শুরু হ’ল অত্যাচার। ন্যাংটো ক’রে আমাকে বরফের মধ্যে শুইয়ে রাখা। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় ১০ মিনিটে শরীর জলে গেল। তখন কম্বল জড়িয়ে অন্য ঘরে নিয়ে গেল।
পনের ষোল বারেরও বেশী মেজর নাসের, কর্নেল শরীফ আমাকে মিথ্যা বিবৃতি দিতে চাপ দেন। আমি অস্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গেই বারবার আমার উপর অমনি নৃশংস নির্যাতন চালানো হয়। বিবৃতি দিতে অস্বীকার করার জন্যই আমার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ আনা হয়েছে।”
[ কলহন, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫৭-২৫৮]
ঠিক এ সময় বাহিরে শোনা গেল শ্লোগান ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, ‘মিথ্যা মামলা তুলে নাও’, ‘আইয়ুবশাহী ধ্বংস হউক।’ গ্যালারিতে বসা ছিল একদল ছাত্র। তারাও ‘শেখ সাহেবের মুক্তি চাই’ ধ্বনিতে আদালত কক্ষ মুখরিত ক’রে বেরিয়ে গেল। জনতা-ছাত্র সমানে শ্লোগান দিয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯৭

চলেছে। মুজিবুর রহমানকে মিলিটারী প্রহরায় নিয়ে যাওয়া হ’ল ক্যান্টনমেন্ট জেলে। মিলিটারীরা ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ ক’রে দিল। সেদিনের মত অধিবেশন মুলতবী থাকে।

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা
ষড়যন্ত্র মামলার অধিবেশনের বাইরে সারা দেশ জুড়ে তখন আগুন আর আগুন। প্রতিদিন শত শত বিক্ষোভ মিছিলের জোয়ারে ভেসে চলেছে বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। আইয়ুব-মোনেম এর লেলিয়ে দেয়া গুণ্ডারা নির্বিচারে সে মিছিলের উপর গুলী বর্ষণ করলো। শত শত শহীদের তাজা রক্তে ভেসে গেল রাজপথ-জনপথ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ আন্দোলন উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নামে অভিহিত হয়ে আসছে। এ আন্দোলনের পটভূমিকা বিস্তারিতভাবে আলোচনা না করলে একটা দেশের জন্ম এবং তার জন্মদাতার ভূমিকার পুরোপুরি মূল্যায়ন সম্ভব নয়। ১৯৬৬ সালে পূর্ব বাংলায় যখন ৬-দফার কর্মসূচী আদায়ের সংগ্রাম চলছে, তখন পশ্চিম পাকিস্তানেও তেমনি আইয়ুবকে সরিয়ে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র চলছিল। ঐ সালেই (’৬৬) নভেম্বরে লণ্ডনের ডেলি টেলিগ্রাফের করাচীস্থ প্রতিনিধি এ বিষয়ে একটি চাঞ্চল্যকর সংবাদ পরিবেশন করেন। সংবাদে বলা হয়েছিল যে, পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর একটা অংশ কালাবাগের নবাবের নেতৃত্বে আইয়ুবের উপর হঠাৎ আক্রমণ চালিয়ে ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করছিল। কালাবাগের নবাব আগে পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন কিন্তু আইয়ুব খান তাঁকে বরখাস্ত করেন। আইয়ুব ষড়যন্ত্রের সংবাদ পেয়ে ১১ জন জেনারেল এবং ২৯ জন কর্নেলকে অযোগ্যতার অভিযোগে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করলেন। শুধু তাই নয়, বখতিয়ার রানা সেনাবাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও আইয়ুব খান তাঁর প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারলেন না এবং তাঁকে ডিঙ্গিয়ে জেনারেল মুসা খানকে সি-এন-সি নিযুক্ত করলেন।
এদিকে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে শেখ মুজিব ও অন্যান্যদেরকে গ্রেফতার ক’রে মামলা দায়ের করা হ’ল। এই ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় বেতার ও তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন ১লা ফেব্রুয়ারী (১৯৬৮) তারিখে এক বিবৃতিও দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন যে,
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯৮

“কোন দেশপ্রেমিক পাকিস্তানী রাষ্ট্রদ্রোহিতাকে ক্ষমা করিতে পারে না। যে সকল শক্তির তীব্র বিরোধিতার মুখে আমরা পাকিস্তান অর্জন করিয়াছি সেই শক্তি আবার পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করিতে চায়।”
কিন্তু জনগণ সরকারের এই ভাওতাবাজীতে বিশ্বাস করতে পারে নি। তারা স্পষ্টতঃই বুঝতে পেরেছিল যে, ৬-দফা আন্দোলনকে নস্যাৎ ক’রে দেয়ার উদ্দেশ্যেই এই ষড়যন্ত্র মামলা দাঁড় করানো হয়েছে।
৪ঠা জুলাই আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে জরুরী দাবীর ভিত্তিতে জনগণকে তাই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দেয়া হ’ল। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন এই ডাকে সাড়া দেন। ১৯৬৮ সালের ৭ই জুন সারা প্রদেশে ৬-দফা আন্দোলনের প্রতীক দিবস হিসাবে উদযাপিত হয়। কিন্তু সরকার এদিনও ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে ১৪৪ ধারা জারী ক’রে আন্দোলনের গতিকে স্তব্ধ ক’রে দিতে চেয়েছিলেন। এর প্রতিবাদে পর দিন প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধী ও স্বতন্ত্র সদস্যরা অধিবেশন কক্ষ বর্জন করেন। তাঁদের অনুপস্থিতিতেই পরিষদের নেতা, শিল্পমন্ত্রী দেওয়ান আবদুল বাসেত বলেনঃ “আমরা সাত-ই জুন-এ নিহতদেরকে শহীদ বলিয়া মনে করি না। তাহারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী এবং তাহারা অপরাধীর (ক্রিমিনাল) চাইতেও নিকৃষ্ট।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ই জুন, ১৯৬৮]
ঐ সালেই বর্ষাকালে পূর্ব বাংলার কয়েকটি জেলা সর্বনাশী বন্যার প্লাবনে ডুবে যায়। দুর্গত জনসাধারণের সাহায্যার্থে সর্বদলীয় ছাত্রসমাজ রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা সংগ্রহে নেমে পড়ে। ১৪ই জুলাই (‘৬৮) বিকাল সাড়ে পাঁচটার সময় এমনি একটি ছাত্রদল প্রদেশের বন্যাদুর্গতদের সাহায্যের আহ্বান সম্বলিত ব্যানারসহ অর্থ সংগ্রহের জন্য ইকবাল হল থেকে বের হয়ে নিউ মার্কেটের পথে ‘বলাকা’ সিনেমা হলের সম্মুখে ভিক্ষা সংগ্রহের সময় লাঠি, ব্যাটন, ঢালধারী ও লৌহ শিরস্ত্রাণ পরিহিত একদল পুলিশ পশ্চাৎ দিক থেকে অকস্মাৎ তাদের আক্রমণ ক’রে মারধোর করে এবং বহু ছাত্রকে গ্রেফতার করে। পরদিন প্রাদেশিক পরিষদে বিরোধী ও স্বতন্ত্র দলের সদস্য এ বিষয়ে একটি মুলতবী প্রস্তাব তুললে ডিপুটি স্পীকার
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯৯

জনাব গমিরউদ্দিন প্রধান তা’ নাকচ করে দেন। এর প্রতিবাদে বিরোধী দলের সদস্যরা পরিষদ কক্ষ বর্জন করেন।
এর পরদিন অর্থাৎ ১৬ই জুলাই প্রদেশের সর্ববৃহৎ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বেসরকারী কলেজ ঢাকা জগন্নাথ কলেজকে সরকার এক নির্দেশবলে সরকারী কলেজে রূপান্তরিত করায় ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এর প্রতিবাদে ২৪শে জুলাই (‘৬৮) ঢাকায় ছাত্র সংগঠনগুলোর এক মিলিত আহ্বানেও অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করা হয়। সরকারের এই শিক্ষা সংকোচন নীতি ও ১৯৬২ সালে প্রণীত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের দাবীতে ১৯৬৮ সালের ১৩ই আগস্ট ছাত্র সংগঠনগুলো প্রদেশব্যাপী এক ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। ময়মনসিংহের ধর্মঘটী ছাত্রদের ওপর পুলিশ লাঠি চার্জ করে ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এতে ১২ জন ছাত্র-ছাত্রী আহত হওয়ার খবর জানা যায়। তা’ ছাড়া ২০ জন ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতারও করে। পুলিশের এই নির্যাতন ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে ক্রমাগত তিন দিন ধরে ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করে। এর কিছুদিন পরে স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী আবার বাংলা ভাষার উপর হামলা চালানোর প্রচেষ্টা চালায়। সরকারের কতিপয় দালালসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিণ্ডিকেট সংস্কার সাধনের নামে বাংলা বর্ণমালা, বানান পদ্ধতি ও লিখন রীতির আমূল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এই ষড়যন্ত্রের প্রধান নায়ক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজী বিভাগের কুখ্যাত অধ্যক্ষ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন। এর প্রতিবাদে প্রদেশের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী মহল আতঙ্কগ্রস্ত ও ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন। ৩১শে আগস্ট (১৯৬৮) ৪১ জন সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিল্পী এর প্রতিবাদে এক বিবৃতি দান ক’রে বলেন, “বাংলা হরফের রদবদল বিশৃংখলা ও অরাজকতার সৃষ্টি করবে।”
এতদসত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট আইযুব খান ঢাকায় এসে ২৪শে সেপ্টেম্বর (’৬৮) নজরুল একাডেমীতে প্রদত্ত এক সম্বর্ধনা সভায় ঘোষণা করেন, “একদিন দেশের সকল ভাষার সংমিশ্রণে একটি পাকিস্তানী ভাষা হবে।” ১লা অক্টোবর জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণেও আইয়ুব খান ঐ একই কথা ঘোষণা করেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০০
ঠিক সেই দিনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর প্রখ্যাত উদারনৈতিক শিক্ষাবিদ ডক্টর মাহমুদ হোসেন আঞ্চলিক সংস্কৃতির বিকাশের পক্ষে জোরালো মত প্রকাশ করেন। ১৯শে অক্টোবর (‘৬৮) ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন জনাব তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া)। সভায় জরুরী দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে সকল রাজনৈতিক দলসমূহকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণ-আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। চারটি পন্থায় এই গণ-আন্দোলন চালিয়ে যাবার কথা ঘোষণা করা হয়ঃ (১) সভা-সমিতি ও মিছিল, (২) হরতাল, (৩) অসহযোগের মাধ্যমে, (৪) প্রয়োজনবোধে আইন অমান্য করে। এই উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে প্রথমে পল্টন ময়দানে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভাষণ দেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মীজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মালেক উকিল, রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, জহুর আহমদ চৌধুরী প্রমুখ নেতা। সভায় কতকগুলো প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবগুলো হ’ল ‘শেখ মুজিবের নেতৃত্বের উপর পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন, রাজবন্দীদের মুক্তি, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত সাহায্য দান, ক্রুগ মিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন, ৬-দফা বাস্থবায়নের জন্য দুর্বার গণ-আন্দোলন। এই গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য জনগণকে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানানো হয়। সভায় ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’ নামক আইয়ুবের ভাষা সংস্কারের প্রচেষ্টাকে নিন্দা করা হয়। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আঘাতকে প্রতিহত করার জন্য সবার প্রতি আবেদন জানানো হয়। এ ছাড়াও অন্যান্য প্রস্তাবাবলীতে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিধান, ইত্তেফাকের ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত আদেশ প্রত্যাহার, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য হ্রাস, শ্রমিক শোষণ বন্ধ ইত্যাদি দাবী করা হয়।

আইয়ুবের উন্নয়ন দশক
২৭শে অক্টোবর (১৯৬৮) আইয়ুব খান মহাসাড়ম্বরে তাঁর উন্নয়ন দশক বা Decade of Reforms পালন করেন। পূর্ব বাংলার জনগণ আইয়ুবের এই কীর্তিকলাপে বিস্মিত না হয়ে পারলেন না। ভেবে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০১

পেলেন না, বাংলার জনগণের জন্যে কি উন্নতি তিনি বিধান করেছেন? রাস্তাঘাট? সেতো মৌলিক গণতন্ত্রীরা ওয়ার্কস প্রোগ্রামের টাকা খেয়ে (যা কিনা ভোটের বিনিময়ে আইয়ুব খান তাদেরকে ঘুষ দিয়েছিলেন) গ্রামের নিরন্নক্লিষ্ট মানুষকে দিয়ে দেশ সেবার নাম করিয়ে কেটে নিয়েছে। দালান-কোঠা? সেটাতো সরকারের কতিপয় তাবেদার ও বুর্জোয়া শ্রেণীর লোকদের ভাগ্যেই তৈরী করার সুযোগ ঘটেছে। শিক্ষা-দীক্ষা? চাকুরীর সংস্থান? কিন্তু এখনো প্রদেশের শতকরা ৮০ জন লোক নিরক্ষর কেন? আর কেনইবা যে পরিমাণ ছাত্র পাশ ক’রে বেরুচ্ছে বেকারত্বের অভিশাপে তাদের জীবন জর্জরিত। আইনশৃংখলার উন্নতি? হ্যাঁ, এদিক দিয়ে আইয়ুব-মোনেম যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তার নজীর বিরল। তার মৌলিক শাসন-ব্যবস্থায় আইনের বিরুদ্ধে যে কেউ এক ধাপ গিয়েছেন, সরকার তাঁর বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন—জেলে পুরেছেন, বেয়োনেট আর টিয়ার গ্যাস আর লাঠির আঘাতে ধরাশায়ী করেছেন, প্রয়োজনবোধে হত্যাও করেছেন। আইয়ুব খানের দশ বছরের এই ইতিহাসকে ‘উন্নয়ন দশক’ বা ‘ডিকেড অব রিফর্মস’ হিসেবে অভিহিত করা যায় বটে!

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য
অবশ্য পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এই উন্নয়ন দশক উৎসব পালন করে। কেননা গত দশ বৎসরে তাদের অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছিল। পূর্ব বাংলার জনগণের রক্ত চুষে নিয়ে তাদের দেহে তা’ সঞ্চার ক’রে দেয়া হয়েছিল। খাওয়া পরার অভাব নেই, সরকারী খরচে রাস্তাঘাট ঝকঝকে করা হয়েছে—মরুভূমির শুষ্ক বালির বুক চিরে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে খনন করা হয়েছে খাল। বড় বড় দালানকোঠা গড়ে তোলা হয়েছে, গড়ে উঠেছে বড় বড় কলকারখানা। পাশ করে বেরুলেই চাকুরী পাওয়া যায়। কিছুসংখ্যক লোকের পক্ষে, বিশেষ ক’রে যাদের হাতে ক্ষমতা, অর্থ ও প্রতিপত্তি আছে, তাঁদের পক্ষে আমোদ-প্রমোদ-বিলাস-ব্যসনে গা ভাসিয়ে দিয়ে জীবনটাকে উপভোগ করার তো কোন অসুবিধে নেই—অতএব আইয়ুবের উন্নয়ন দশক তাঁদের জন্যই সার্থক। তবে একই দেশের দুই অঞ্চলে বৈষম্যের যে চিত্র দিন দিন প্রকট হয়ে উঠেছে, আইয়ুব সরকারের পক্ষে সেই চিত্র সম্পূর্ণ লুকিয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০২

ছাপিয়ে রাখা সম্ভব হয় নি। সরকার অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য হয়েছে এই বৈষম্যের কথা স্বীকার করতে। গত কয়েক বৎসরে জাতীয় পরিষদে প্রশ্নোত্তরকালে সরকার যে সব বৈষম্যের কথা স্বীকার করেছেন, সমসাময়িক পত্র-পত্রিকা থেকে তার অংশবিশেষ এবং অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদির কিয়দংশ এখানে তুলে ধরে দেখানো যেতে পারে যে, পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের সরকার কি ভাবে দেশের একটি অঞ্চলকে বঞ্চিত ক’রে অপর অংশকে গড়ে তুলেছেন।
।। ২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫, দৈনিক ইত্তেফাক ।।
আজকের দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক তথ্য থেকে ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ব্যয়ের পরিমাণ নিম্নরূপ বলে জানা গেছেঃ

পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান
১৯৫৪ ৫ লক্ষ ২৫ লক্ষ
১৯৫৫ ১৩ লক্ষ ৪৭ লক্ষ
১৯৫৬ ৫ লক্ষ ১০ লক্ষ
১৯৫৭ ১৭ লক্ষ ৮৩ লক্ষ
১৯৫৮ ২৬ লক্ষ ৯০ লক্ষ
১৯৫৯ ১৮ লক্ষ ১০৮ লক্ষ
১৯৬০ ১৮ লক্ষ ৯৭ লক্ষ
১৯৬১ ১৫ লক্ষ ৮৫ লক্ষ
১৯৬২ ৩২ লক্ষ ৯৯ লক্ষ
১৯৬৩ ৪২ লক্ষ ১১৪ লক্ষ
মোট- ১৯১ লক্ষ মোট- ৭৫৮ লক্ষ
শতকরা হার- ২০% ৮০%

।। ১৭ই মার্চ, ১৯৬৬, দৈনিক ইত্তেফাক ।।
গতকাল জাতীয় পরিষদে প্রশ্নোত্তরকালে পররাষ্ট্র দফতরের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী জানান যে, বিদেশে পাকিস্তানের হাই কমিশনসমূহে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০৩

কর্মরত বিভিন্ন শ্রেণীর ৩১ জন কর্মচারীর মধ্যে ১৩ জন পূর্ব পাকিস্তানী এবং ৮ জন হাই কমিশনারের মধ্যে ২ জন পূর্ব পাকিস্তানী।
পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী জনাব আবদুল আওয়াল ভূঁইয়া জনাব মুখলেসুজ্জামানের এক প্রশ্নের জবাবে জানান যে, বিদেশে কার্যরত ৩৫ জন রাষ্ট্রদূতের মধ্যে ৭ জন পূর্ব পাকিস্তানী। তিনি আরো বলেন যে, সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারীয়েটে পাকিস্তানী কর্মচারীদের সংখ্যা ৩০ জন। এঁদের মধ্যে কে যে কোন প্রদেশের বাসিন্দা তার পুরো তথ্য এখনো পাওয়া যায় নি। এ পর্যন্ত যে ২৫ জনের তথ্য জানা গেছে তার মধ্যে ২১ জন পশ্চিম পাকিস্তানী এবং ৪ জন পূর্ব পাকিস্তানী। ডঃ আলীম-আল-রাজীর এক প্রশ্নের জবাবে জনাব আওয়াল জানান যে, পররাষ্ট্র দফতরে ১০৪ জন প্রথম শ্রেণীর মধ্যে ৩০ জন পূর্ব পাকিস্তানী এবং ২০৪ জন ২য় শ্রেণীর ননগেজেটেড কর্মচারীর মধ্যে ৫৫ জন পূর্ব পাকিস্তানী।
।। ১৮ই মার্চ, ১৯৬৬, দৈনিক ইত্তেফাক ।।

জাতীয় পরিষদে প্রশ্নোত্তরকালে জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরীর এক প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী কাজী আনোয়ারুল হক গতকাল জানান যে, ১৯৬৩ সাল হতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত শিক্ষা দফতর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত সর্বমোট ৩৫টি বৃত্তির মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানী ছাত্রদের ৩০টি বৃত্তি দেয়া হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্রগণ ৫টি বৃত্তি লাভ করেছে।
জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরীর প্রশ্নের উত্তরে জনাব কাশিম মালিক জানান যে, দেশের ২৩টি বেসামরিক বিমান বন্দরের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে ১৮টি এবং পূর্ব পাকিস্তানে রয়েছে ৭টি। এ ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর ৪টি বন্দরও পি. আই. এ. ব্যবহার ক’রে থাকে।
।। ২৩শে মার্চ, ১৯৬৬, দৈনিক ইত্তেফাক ।।
জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরীর এক প্রশ্নের জবাবে তথ্য দফতরের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী মালিক আল্লা ইয়ার খান জানান যে, গত বৎসর জুন হতে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত সময়ে সরকার পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০৪

খাতে ব্যয় করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানে ৭ লক্ষ ৮৬ হাজার ২১০ টাকা এবং পূর্ব পাকিস্তানে ২ লক্ষ ২ শত ৯৩ টাকা।
তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন গতকাল বলেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ৫টি ক’রে বেতার কেন্দ্র রয়েছে। এদের মধ্যে ট্রান্সমিটিং ক্ষমতা যথাক্রমে ১৬৫ কিলোয়াটসম্পন্ন পূর্ব পাকিস্তানে এবং ২৫৪.৫ কিলোয়াটসম্পন্ন পশ্চিম পাকিস্তানে রয়েছে। জনাব মুখলেসুজ্জামান খানের এক প্রশ্নের জবাবে মালিক আল্লা ইয়ার খান এক তথ্য প্রকাশ ক’রে বলেন যে, রেডিও পাকিস্তান ডিরেকটরেটে ২০ জন প্রথম শ্রেণীর অফিসারের মধ্যে ১৯ জন পশ্চিম পাকিস্তানী এবং ১ জন পূর্ব পাকিস্তানী রয়েছেন।
।। ৫ই এপ্রিল, ১৯৬৬, দৈনিক ইত্তেফাক ।।
কেন্দ্রীয় শিল্প ও প্রাকৃতিক সম্পদ দফতরের মন্ত্রী জনাব আলতাফ হোসেন অদ্য করাচীর ‘তোগলক হাউসে’ অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে পাকিস্তানের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বিনিয়োগ তফসীল বা কর্মসূচী ঘোষণা করেন—এই তফসীল অনুযায়ী মোট ২০০টি শিল্পে ১হাজার ৮৮ কোটী ৫২ লক্ষ টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তন্মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় হবে ৫০২ কোটী ৫৫ লক্ষ টাকা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হবে ৫৮৬ কোটী ৭ লক্ষ টাকা। জনাব আলতাফ হোসেন উল্লেখ করেন যে, তৃতীয় পরিকল্পনা আমলে বেসরকারী খাতে (প্রাইভেট সেক্টরে) দেশের দু’অঞ্চলের জন্য মোটামুটি বরাদ্দ হ’ল পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ৪৬ ভাগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে শতকরা ৫৪ ভাগ।
।। ৪ঠা জুন, ১৯৬৬, দৈনিক ইত্তেফাক ।।
গতকাল জাতীয় পরিষদে যোগাযোগ দফতরের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারীর ভাষণে প্রকাশ ডাকঘর ও টেলিগ্রাফ অফিসের সংখ্যা পূর্ব পাকিস্তানে যথামে ৫,৩৩০টি ও ৬০২টি, পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানে যথাক্রমে ৬,৬৩০টি এবং ১,২৮৬টি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০৫

।। ৭ই জুন, ১৯৬৬, দৈনিক ইত্তেফাক ।।

গত ৫ই জুন কেন্দ্রীয় সংখ্যাতত্ত্ব অফিস কর্তৃক পরিবেশিত অস্থায়ী হিসেব থেকে জানা যায় যে, মে মাসে বহির্বাণিজ্যে পূর্ব পাকিস্তান রফতানী করে ১২.৪৪ কোটী এবং পশ্চিম পাকিস্তান রফতানী করেছে ১১.৩২ কোটী টাকা। কিন্তু আমদানীর ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য করা হয়েছে ১৮.৭২ কোটী টাকা এবং পূর্ব পাকিস্তান পেয়েছে ৮.৪৬ কোটী টাকা।
।। ১০ই জুন, ১৯৬৬, দৈনিক ইত্তেফাক ।।

গতকাল জাতীয় পরিষদে প্রশ্নোত্তরকালে এক তথ্যে প্রকাশ রাষ্ট্রদূতসহ প্রথম শ্রেণীর কর্মচারীর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানী রয়েছেন ৫৮ জন, পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যা ১৭৯ জন। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানী যথাক্রমে ৪৮, ১৭ ও ৮ জন এবং পশ্চিমাঞ্চলের অধিবাসী রয়েছেন যথাক্রমে ১৯৬, ৫৮ এবং ৮৯ জন। উভয় প্রদেশের শতকরা হার হ’ল পূর্ব পাকিস্তানী ২০.১৮% এবং পশ্চিম পাকিস্তানী ৭৯.৮২%।
।। ২৫শে নভেম্বর, ১৯৬৬, দৈনিক আজাদ ।।

জাতীয় পরিষদে প্রশ্নোত্তরকালে গতকাল অর্থনৈতিক দফতরের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী জানান যে, ১৯৬২-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান লাভ করেছে ১০৫৭টি বৃত্তি আর পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগে পড়েছে ১৯৫১টি বৃত্তি। এক প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ১৯৬০-১৯৬৫ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ২৫ লক্ষ ২২ হাজার ৯১৯ টাকা ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ৩১ লক্ষ ৭১ হাজার ১১৯ টাকা শিক্ষাখাতে ব্যয় করা হয়েছে। অর্থনৈতিক দফতরের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী নওয়াব জান সাদিক আলী জনাব মুখলেসুর রহমানের এক প্রশ্নের জবাবে জানান, ১৯৬০-৬১ এবং ১৯৬৫-৬৬ সরকার আমেরিকা থেকে যে ২৫ কোটী ৮০ লক্ষাধিক ডলার ঋণ গ্রহণ করেন তার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান পরিকল্পনাসমূহে ৪ কোটী ৭০ লক্ষ ৪৭ হাজার ডলার ব্যয় বরাদ্দ করা হয় এবং
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০৬

পশ্চিম পাকিস্তান পরিকল্পনা খাতে ৫ কোটী ৮৩৩০ হাজার ডলার ব্যয় বরাদ্দ করা হয়। অবশিষ্ট ডলার কেন্দ্রীয় সরকারের খাতে খরচ করা হয়।
।। ২৬শে নভেম্বর, ১৯৬৬, দৈনিক আজাদ ।।

গতকাল ডক্টর আলীম-আল-রাজীর এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট বিভাগের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী জানান, স্বরাষ্ট্র বিভাগের প্রথম শ্রেণীর ৩২ জন কর্মচারীর মধ্যে ৫ জন পূর্ব পাকিস্তানী এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ১ জন রয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানী।
।। ২৮শে নভেম্বর, ১৯৬৬, দৈনিক আজাদ ।।

গতকাল জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলীয় জনৈক সদস্যের প্রশ্নের জবাবে পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী জনাব রফিক সায়গল জাতীয় শিপিং কর্পোরেশনে কর্মরত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মচারীদের সংখ্যার মধ্যে নিম্নলিখিত বৈষম্যের কথা স্বীকার করেছেন।

পশ্চিম পাকিস্তানী পূর্ব পাকিস্তানী
কেন্দ্রীয় দফতরে ১৪৪ জন ৫৫ জন
প্রথম শ্রেণীর ১৭ জন ৫ জন
দ্বিতীয় শ্রেণীর ৩১ জন ৮ জন

।। ৩০শে নভেম্বর, ১৯৬৬, দৈনিক আজাদ ।।

গতকাল জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলীয় সদস্য জনাব ইউসুফ আলী অভিযোগ করেন যে, জনসংখ্যার দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পি. আই. এ-র কর্মচারীদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর সংখ্যা শতকরা ৫ ভাগের বেশী নয়। সংস্থার উর্ধ্বতন কর্মচারীদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের একজনও লোক নাই।
বিরোধী দলীয় অপর সদস্য জনাব মুখলেসুজ্জামান খান বলেন যে, পি. আই. এর ১২ হাজার কর্মচারীর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যা মাত্র ৮০০ জন। এই ৮০০ জন কর্মচারীর অধিকাংশ পিয়ন, লোডার প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০৭

।। ১লা ডিসেম্বর, ১৯৬৬, দৈনিক আজাদ ।।
গতকাল জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলীয় সদস্য জনাব মুখলেসুজ্জামান খানের এক প্রশ্নের জবাবে কৃষি ও খাদ্য দফতরের মন্ত্রী জানান, কৃষি সংখ্যাতত্ত্ব ও মার্কেটিং ইন্টেলিজেন্স বিভাগে মোট ৩৭২ জন কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ১০০ জন পূর্ব পাকিস্তানী।
জাতীয় পরিষদে আলোচনাকালে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগে চাকরীতে কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে যে আঞ্চলিক বৈষম্যের কথা সরকার স্বীকার করেন তার শতকরা হার নিম্নরূপঃ

পদ পূর্ব পাকিস্তানী পশ্চিম পাকিস্তানী
প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারীয়েট ১৯ ৮১
দেশরক্ষা ৮.১ ৯১.৯
শিল্প ২৫.৭ ৭৪.৩
স্বরাষ্ট্র ২২.৭ ৭৭.৩
শিক্ষা ২৭.৩ ৭২.৭
তথ্য ২০.১ ৭৯.৯
স্বাস্থ্য ১৯ ৮১
কৃষি ২১ ৭৯
আইন ৩৫ ৬৫

।। ২রা ডিসেম্বর, ১৯৬৬, দৈনিক আজাদ ।।

গতকাল জাতীয় পরিষদে প্রশ্নোত্তরকালে ডঃ আলীম-আল-রাজীর এক প্রশ্নের জবাবে যোগাযোগ মন্ত্রী জনাব খান এ. সবুর জানান, পাকিস্তানে মোট ১ লক্ষ ৩২ হাজার ৩৪২টি টেলিফোন রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৩১ হাজার ৪৩৪টি পূর্ব পাকিস্তানে আর অবশিষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানে রয়েছে।
ডঃ রাজীর অপর এক প্রশ্নের জবাবে খান সবুর বলেন, প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনাকালে যেখানে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের ২৬টি ইঞ্জিন, ১৪৬টি যাত্রীবাহী বগী ও ২৯৪টি মালবাহী বগী ছিল, সেখানে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জন্য ৭৮টি ইঞ্জিন, ৪৫৮টি যাত্রীবাহী বগী ও ৬৯৫৯টি মালবাহী বগী ছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০৮

বিরোধী দলীয় সদস্য জনাব মুখলেসুজ্জামান খানের এক প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য দফতরের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী জনাব নূরুল হক চৌধুরী জানান, কেন্দ্রীয় আমদানী-রফতানী নিয়ন্ত্রণ দফতরে ৮৯ জন একজিকিউটিভ অফিসারের মধ্যে মাত্র ১৬ জন পূর্ব পাকিস্তানী ও ৭৩ জন পশ্চিম পাকিস্তানী এবং ৪৫ জন সহকারী আমদানী-রফতানী কন্ট্রোলারের মধ্যে মাত্র ১৫ জন পূর্ব পাকিস্তানী ও বাকী ৩০ জন পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী।
ডঃ রাজীর অপর এক প্রশ্নের জবাবে আইন দফতরের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী বলেন, ইসলামী গবেষণা সংস্থা উর্দু ভাষায় ৪টি পুস্তক প্রকাশ করেছেন বটে, কিন্তু বাংলা ভাষায় একটিও করা হয় নি। এই সংস্থায় কর্মরত ২৮ জন অফিসারের মধ্যে মাত্র ৬ জন পূর্ব পাকিস্তানী।
।। ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৬৬, দৈনিক আজাদ ।।

গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় পরিষদে প্রশ্নোত্তরকালে দেশরক্ষা দফতরের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী কর্তৃক প্রদত্ত এক অতিরিক্ত প্রশ্নের জবাবে প্রকাশ, চাকুরী সন্ধানী পূর্ব পাকিস্তানীদের ব্রিটেন যাবার জন্য পূর্ব পাকিস্তানি হ’তে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ ভাউচার প্রদান প্রথা বিলুপ্ত করা হলেও পশ্চিম পকিস্তানে তা’ টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এর প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়াস্বরূপ চলতি সালের জানুয়ারী হতে অক্টোবর পর্যন্ত সময়কালে যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের লণ্ডন যাত্রীর সংখ্যা হ্রাস পেয়ে মাত্র ৮৭৯ জন হয়েছে, সেখানে একই সময়কালে পশ্চিম পাকিস্তানী লণ্ডন যাত্রীর সংখ্যা ৫১৮৬ জন। ১৯৬৫ সালে সেকশন অফিসারের পদে উন্নীত ১৬ জন এ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিন্টেন্ডেন্টের মধ্যে একজনও পূর্ব পাকিস্তানী নেই। এস্টাবলিশমেন্ট দফতরের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী জনাব শহীদুল্লাহ এই তথ্য প্রকাশ করেন।
।। ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৬৬, দৈনিক আজাদ ।।

জনাব মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ আওয়ামী লীগের জনাব নূরুল ইসলামের একটি প্রশ্নের জবাবে জানান, সেন্ট্রাল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের হেড
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০৯

অফিসে কর্মরত ২০০ কর্মচারীর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান হতে মাত্র ২৭ জন কর্মচারী রয়েছেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর অফিসারের পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানের একজন কর্মচারীও নেই।
।। ৯ই ডিসেম্বর, ১৯৬৬, দৈনিক আজাদ ।।

গতকাল জাতীয় পরিষদে জনাব মালিক কাশিম জনাব মুখলেসুজ্জামান খানের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, পি. আই. এ. সি-র মোট ১২৩ জন সিনিয়র অফিসারের মধ্যে মাত্র ২৩ জন, ৭ জন ভাইস প্রেসিডেন্টের মধ্যে ১ জন এবং ৪ জন জেনারেল ম্যানেজারের মধ্যে ১ জন পূর্ব পাকিস্তানী রয়েছেন। তিনি আরো জানান, পি. আই. এ. সি-র দেশী এবং বিদেশী স্টেশনসমূহে কর্মরত মোট ১০ হাজার ১৫০ জন কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ২হাজার ৩ শত ৫৯ জন পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা।
।। ১০ই ডিসেম্বর, ১৯৬৬, দৈনিক আজাদ ।।

অর্থ দফতরের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী জনাব মোহাম্মদ খান ডঃ আলীম-আল-রাজীর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, কৃষি উন্নয়ন ব্যাঙ্কের সদর অফিসে ২০৩ জন কর্মচারী রয়েছেন, তন্মধ্যে মাত্র ৬৪ জন পূর্ব পাকিস্তানী।
।। ১৩ই ডিসেম্বর, ১৯৬৬, দৈনিক আজাদ ।।

দেশরক্ষা দফতরের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী জনাব মোহাম্মদ মালিক কাশিম সদস্য জনাব নূরুল ইসলামের এক প্রশ্নের জবাবে গতকাল জানান, পি. আই. এ-র ১ শত ৩ জন বিমানবালার মধ্যে মাত্র ৪ জন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী।
।। ১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৬৬, দৈনিক আজাদ ।।

পররাষ্ট্র দফতরের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী জনাব আবদুল আওয়াল ভূঁইয়া এক প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, ২৮ জন রাষ্ট্রদূতের ৪ জন, ৯ জন মন্ত্রীর ৪ জন, ২৭ জন উপদেষ্টার ১৩ জন এবং ২৪ জন প্রথম শ্রেণীর সেক্রেটারীর মধ্যে মাত্র ১১ জন পূর্ব পাকিস্তানী রয়েছেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১০

।। ১৯শে ডিসেম্বর, ১৯৬৬, দৈনিক আজাদ ।।

পাক আমলে ৮টি আর্থিক বছরে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের মধ্যকার বৈষম্য সামগ্রিকভাবে শতকরা ৪১ ভাগ পর্যন্ত বর্ধিত হয়েছে।
বৈষম্যের কয়েকটি দিক-
বেসরকারী খাতে পূর্ব পাকি-স্তানের পুঁজি বিনিয়োগ ১৯৬৫-৬৬ সালে শতকরা ২২ ভাগ। পশ্চিম পাকিস্তানে শতকরা ৭৮ ভাগ পুঁজি বিনিয়োগ তফসীল পূর্ব পাকিস্তান ১৯৬৫-৬৬ ও ১৯৬৬-৬৭ সালে শতকরা ৩৩ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে উক্ত দু’বৎসরে শতকরা ৬৭ ভাগ
পিকিক-এর ঋণ ১৯৬৫-৬৬ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ২২.২০ ভাগ। পশ্চিম পাকিস্তানে উক্ত সময়ে শতকরা ৭৭.৮০ ভাগ। শিল্প ব্যাঙ্কের ঋণ ১৯৬৫-৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ২৪ ভাগ। পশ্চিম পাকিস্তানে শতকরা ৭৬ ভাগ।

১৯৬০-৬১ ও ’৬১-৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান রফতানীতে পাকিস্তানের শতকরা ৭০ ভাগ আয় করতো। বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানের রফতানী বৃদ্ধি পাওয়ায় পূর্ব পাকিস্তান ১৯৬৭ সালে শতকরা মাত্র ৫৬ ভাগ রফতানী আয় করেছে।
।। ১০ই ডিসেম্বর, ১৯৬৭, সাপ্তাহিক পূর্বদেশ ।।

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আমদানী-রফতানী সম্পর্কিত ক্রমবর্ধমান ব্যবধানের ফলে পূর্ব পাকিস্তান একাধারে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার দিক হতে দারুণভাবে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি আন্তঃপ্রাদেশিক বাণিজ্যের দিক থেকেও মার খাচ্ছে।
১৯৫৮-৫৯ সাল থেকে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ১০ বছরে সাড়ে চারশত কোটী টাকার অধিক পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছে। এই সময় পর্যন্ত ৬৪৬ কোটী ৫৭ লক্ষ টাকার পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্য পূর্ব পাকিস্তানে আমদানী করা হয়, আর পূর্ব পাকিস্তান
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১১

থেকে তার বদলে পশ্চিম পাকিস্তানে রফতানী করা হয় মাত্র ২৯৬ কোটী ৯১ লক্ষ টাকার পণ্য।

আমদানীর ব্যবধান
১৯৬৫ সালের জুলাই মাস থেকে ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১৮০ কোটি ২৮ লক্ষ টাকার পণ্য পূর্ব পাকিস্তানে আমদানী করা হয়। আর পশ্চিম পাকিস্তানে রফতানী হয় মাত্র ১০৩ কোটী ২৮ লক্ষ টাকার পণ্য। এই বৎসরে ৮৩ কোটী টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছে।
১৯৬৪-৬৫ সালেও পশ্চিম পাকিস্তানে এমনিভাবে পাঠানো হয়েছে ৩৫ কোটী টাকা। ১৯৬৩-৬৪ সালে ৩৮ কোটী ৪১ লক্ষ টাকা, ১৯৬২ সালে ৪৮ কোটী ৫৭ লক্ষ টাকা।
১৯৬৩-৬৪ এবং ১৯৬৫-৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের আমদানীর পরিমাণ যথাক্রমে ৫১ কোটী ১২ লক্ষ টাকার পণ্য ও ৫২ কোটী ২৩ লক্ষ টাকা, পক্ষান্তরে ঐ বৎসরসমূহে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য আমদানী করা হয় যথাক্রমে ৯০ কোটী ৫২ লক্ষ ও ১৩৬ কোটী ৬২ লক্ষ টাকার পণ্য।
।। ২২শে ডিসেম্বর, ১৯৬৭, সংবাদ ।।

পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশনের অধীনে জাহাজগুলিতে ডেক ও ইঞ্জিন রুমের ৩৯৩ জন অফিসারের মধ্যে মাত্র ৪৩ জন পূর্ব পাকিস্তানী আর বাকী ৩৫০ জনই পশ্চিম পাকিস্তানী।
পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশনের করাচীস্থ সদর দফতরে অফিসার, কেরানী, সাব-অর্ডিনেট স্টাফ মিলিয়ে ২৬০ জন কর্মচারীর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানীদের সংখ্যা ছিল ৭৪ জন (৭ জন অফিসার, ৫৭ জন কেরানী ও ১০ জন সাব-অর্ডিনেট) আর চট্টগ্রাম, খুলনা ও ঢাকা অফিসের অফিসার, কেরানী ও সাব-অর্ডিনেট স্টাফ মিলে পূর্ব পাকিস্তানীদের সংখ্যা ছিল ৩৫ জন অফিসার (১ম শ্রেণী ১৩ জন, দ্বিতীয় শ্রেণী ২২ জন, কেরানী ৮০ জন, সাব-অর্ডিনেট ২৪ জন)। পক্ষান্তরে ৬ জন ডেপুটেশনিস্ট ছাড়াও ১ম শ্রেণী ও ২য় শ্রেণী মিলে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যা ছিল ৫৬ জন, কেরানী ১০৬ জন ও সাব-অর্ডিনেট ১৯ জন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১২

।। ৩রা ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৮, দৈনিক আজাদ ।।
জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায় যে, ১৯৬৭ সালে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন ব্যাঙ্ককে ৩ কোটী ৩২ লক্ষ টাকা এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে ৫ কোটী ২লক্ষ টাকার কৃষি ঋণ দেয়া হয়েছে। মোট কথা পূর্ব পাকিস্তানকে ১ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা কম দেয়া হয়েছে। ১৯৬৬ সালের ৬ মাসের (জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত) কৃষি ঋণের হিসেবে দেখা যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান অপেক্ষা প্রায় আড়াই গুণ অধিক ঋণ পেয়েছে।
।। ৩রা জুলাই, ১৯৬৮, দৈনিক পাকিস্তান ।।

যোগাযোগ বিভাগের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী জনাব রফিক সায়গল গত ২-৭-৬৮ তারিখে জাতীয় পরিষদে এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, Post Office Directorate-এর জন্য কোন Asstt. Director-এর পদ মঞ্জুর করা হয় নি। তবে করাচীস্থ সি. এ. ও. (Central Accounting Office)-তে এ ধরনের দুটি পদ রয়েছে। এ ধরনের পদগুলির মধ্যে একটি পদে একজন পূর্ব পাকিস্তানী নিযুক্ত রয়েছেন।
।। ৬ই জুলাই, ১৯৬৮, দৈনিক আজাদ ।।

সরকারী এক ঘোষণা থেকে জানা যায় যে, পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ের উন্নয়নের জন্য চলতি সালের নিমিত্ত বার্ষিক প্ল্যান অনুযায়ী ৩১ কোটী টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। অপরপক্ষে পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বাবদ ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যাদি ছাড়াও বিভিন্ন পরিসংখ্যানের সূত্র থেকে আইয়ুবী শাসনে উভয় প্রদেশের মধ্যে বৈষম্যের যে চিত্র উদ্ঘাটিত হয়েছে তার একটি উল্লেখযোগ্য নমুনা এখানে তুলে ধরা হ’লঃ

।। উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে ব্যয় বরাদ্দ ।।

(শতকরা হারে)
বিষয় পঃ পাক পূঃ পাক
বিভিন্ন উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা ৮০% ২০%
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১৩

(শতকরা হারে)
বিষয় পঃ পাক পূঃ পাক
বৈদেশিক সাহায্য (মার্কিন সাহায্য ছাড়া) ৯৬% ৪%
মার্কিন সাহায্য ৬৬% ৩৪%
পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন কর্পোরেশন ৫৮% ৪২%
পাকিস্তান শিল্প ঋণ ও বিনিয়োগ করপোরেশন ৮০% ২০%
শিল্পোন্নয়ন ব্যাঙ্ক ৯৬% ৪%
গৃহ নির্মাণ ৮৮% ১২%

মোট গড়পড়তা ব্যয় ৭৭% ২৩%

[Why Bangladesh—by A group of Scholars in Vienna: Bangladesh Documents, P. 16.]

আইয়ুবী শাসনের এই উন্নয়ন দশক স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের পক্ষে উৎফুল্লজনক ছিল। কিন্তু বাংলার নিপীড়িত, নিষ্পেষিত জনগণ সরকারের মুখে থুথু না ছিটিয়ে পারেন নি। তাঁদের কাছে মনে হ’ল, সরকারের উন্নয়ন দশক উদযাপন আসলে এক নগ্ন উপহাস। তাঁরা এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলেন এবং এই উৎসবের আয়োজনকে তছনছ ক’রে দেবার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন।
এই ‘উন্নয়ন দশক উৎসব’ আইয়ুবের পক্ষে মারাত্মক পরিণতির সুচনা বয়ে আনলো। উন্নয়ন দশকের নামে এই প্রবঞ্চনার সত্যটি যখন উদঘাটিত হ’ল তখন অন্য কোন লাভের আফিম খাইয়ে বাঙালীকে আর ঘুম পাড়িয়ে রাখা গেল না। অর্থের প্রশ্নটি যখন সামনে এসে দাঁড়ালো, ধর্মের বাঁধন তখন গেল টুটে। এক জাতি, এক প্রাণ একতার মোহটাকে ভেঙে নবজাতীয়তায় মোক্ষ সন্ধান করলো বাঙালী। উদ্দীপ্ত হ’ল বাংলার মুক্তি আন্দোলন।”
[ বাংলাদেশঃ অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতঃ মতিলাল পাল, রক্তাক্ত বাংলা, কলিকাতা, ১৯৭১, পৃঃ ১৫৪]

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম আবার আস্তে আস্তে নব দিগন্তের পথে যাত্রা শুরু করলো—এবারের সংগ্রামের ভিত্তি গণ-আন্দোলন। আইয়ুবের গুণগ্রাহী মওলানা ভাসানীও শেষ পর্যন্ত আইয়ুব-বিরোধী মনোভাব প্রকাশ করতে লাগলেন। তিনি আইয়ুব সরকারের বিরোধিতা
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১৪

করা প্রতিটি জনগণের নৈতিক কর্তব্য বলেও মত প্রকাশ করলেন। ৩রা নভেম্বর (১৯৬৮) পল্টন ময়দানে এক জনসভায় সরকারের তীব্র সমালোচনা ক’রে এই বর্ষীয়ান নেতা বলেন যে, দারিদ্র প্রপীড়িত জনসাধারণের কল্যাণ সাধনে সরকার ব্যর্থ, তাই আইয়ুব খানকে এই মুহূর্তে পদত্যাগ করা উচিত। তিনি আরো বলেন যে, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবী আজ প্রদেশের এক সার্বজনীন দাবীতে পরিণত হয়েছে। স্বায়ত্তশাসনের দাবীর সাথে সাথে মওলানা ভাসানী রাজবন্দীদের মুক্তি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, জরুরী আইন প্রত্যাহার প্রভৃতি দাবীও সোচ্চার কণ্ঠে ঘোষণা করেন। অন্যদিকে সরকার আবার দমন-নীতির মাধ্যমে জনগণের অধিকার আদায়ের দাবীকে নস্যাৎ ক’রে দেবার প্রচেষ্টায় তৎপর হয়ে উঠলে, প্রতিবাদে ছাত্র-জনতার সাথে সাথে প্রদেশের বুদ্ধিজীবী মহল রাস্তায় নেমে পড়েন।
১৮ই নভেম্বর (’৬৮) ঢাকার আইনজীবীরা সরকারী দমন-নীতির প্রতিবাদে কালো কোট ও কালো টাই পরিধান করে বিভিন্ন দাবী-দাওয়া সম্বলিত প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুনসহ এক বিরাট মিছিল বের করেন। তাঁদের দাবী-দাওয়ার মধ্যে ছিল “রাজবন্দীদের মুক্তি চাই”, “পূর্ব বাংলাকে শোষণ করা চলবে না”, “কালা কানুন বাতিল কর”, “স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক”, “স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে”, “বিনা বিচারে আটক রাখা চলবে না”, “জরুরী আইন প্রত্যাহার কর”, “সরকারী নির্যাতন বন্ধ কর” “সামাজ্যবাদ ধ্বংস হউক”, “সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হবে”, “সার্বজনীন ভোটাধিকার দিতে হবে”,“দ্রব্যমূল্য হ্রাস কর”,“শ্রমিক স্বার্থবিরোধী আইন প্রত্যাহার কর”,“কৃষকদের বর্ধিত খাজনা নেওয়া বন্ধ কর”, “শিক্ষা সংকোচন-নীতি বাতিল কর”,“শিক্ষা বিভাগে সরকারী হস্তক্ষেপ বন্ধ কর”, “ছাত্র-জনতার দাবী মানতে হবে”, “একনায়কত্ব ধ্বংস কর” প্রভৃতি।
মিছিল বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে জমায়েত হলে পর সমিতির সভাপতি বলেন, “আমাদের এই বিক্ষোভ মিছিল কোন নতুন সংগ্রাম নয়, আমাদের সংগ্রাম বহু পূর্বেই শুরু হয়েছে। আজকের মিছিল তারই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।”

জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি
সেদিন ছাত্ররাও সারা দেশব্যাপী প্রতীক প্রতিবাদ দিবস পালন করেন। সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানেও আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে শুরু করেছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১৫

সে আন্দোলনের নেতা ছিলেন আইয়ুব কতৃক ক্ষমতাচ্যুত পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিঃ জুলফিকার আলী ভুট্টো। এখানে বলে রাখা ভাল যে, তাঁদের সে আন্দোলনের পেছনে পূর্ব বাংলার মত অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক মুক্তির কোন দাবী ছিল না। যা ছিল তা’ হ’ল ক্ষমতা দখলের লড়াই। ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের যুবশক্তিকে সংহত ক’রে নিজের অনুকূলে নেবার চেষ্টা করলেন এবং সেই কাজে তিনি বিশেষ সাফল্য অর্জন করলেন। সুদীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে এমনিতেই সেখানে জনমত ও তরুণ সম্প্রদায় বিক্ষুদ্ধ ছিল। ভুট্টোর নিজের চিন্তায় যত স্ববিরোধিতা ও বৈপরীত্যই থাক, সময়মত সুচতুর পন্থায় অগ্রসর হয়ে এই পরিবেশকে তিনি নিজের স্বার্থে ব্যবহার করলেন। নিজে একটি দল গঠন করলেন এবং গালভরা নাম দিলেন ‘পিপলস পাটি’।
এই রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে তিনি আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুললেন। লারকানার নবাব নিম্নশ্রেণীর জনগণকে নবাব, জমিদার ও শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলবার চেষ্টায় ব্রতী হলেন। ভুট্টো বার বার ঘোষণা করতে লাগলেন যে, তিনি ক্ষমতায় যেতে পারলে ধনী-নির্ধন সবাইকে এক পর্যায়ে এনে ইসলামী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন।
সাধারণ জনগণ এবং তরুণ সমাজ তাঁর এরকম ভাল কথা স্বাভাবিকভাবেই লুফে নিল-কেননা এ ধরনের কথা আর কোন পশ্চিমা রাজনৈতিক দল কোন দিন শোনান নি। ফলে তুখোড় যৌবনের চাঞ্চল্যে উৎক্ষিপ্ত রাজনীতিবিদ ভুট্টো অতি সহজেই জনগণের সমর্থন আদায় ক’রে নিয়ে আইয়ুবের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে সাহসী হলেন।
আইয়ুব সরকারের কর্মতৎপরতার ক্ষেত্র বেড়ে গেল। এতদিন তিনি পূর্ব বাংলার জনগণকে দমন করতেই ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু ভুট্টোকে বরখাস্ত করার পরিণতি যে এমন মারাত্মক হবে তা’ তিনি ভাবতেও পারেন নি। তাই এখন পশ্চিম খণ্ডেও তাঁর নিজস্ব লোকজনকে লেলিয়ে দিতে বাধ্য হলেন।
ভুট্টো সাহেবকে গ্রেফতার করা হ’ল। গ্রেফতার হলেন তাঁর অনেক সহকর্মী, তাঁর মিছিলের ওপর চালানো হ’ল নির্বিচারে গুলী।
ভুট্টোর গ্রেফতার ও তাঁর সভা-মিছিলের ওপর গুলী বর্ষণের প্রতিবাদে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১৬

পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতাও অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতার প্রধান উদ্দেশ্য স্বৈরাচারী আইয়ুবের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হওয়া, ভুট্টো একটি উপলক্ষ মাত্র।
ক্রমাগত কয়েক দিন ধরেই এদেশের ছাত্র-জনতা পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্র-গণহত্যা ও গ্রেফতার-নির্যাতনের প্রতিবাদে মিছিল-সভা ক’রে অবিলম্বে তা’ বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি দাবী জানালেন।
২৯শে নভেম্বর (১৯৬৮) পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্র-জনতার ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-সমাজের যে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয় তা’ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ঐদিন ঢাকার সর্বদলীয় ছাত্র-সমাজ নিম্নতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ অন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত এক সভায় শাসকগোষ্ঠীর কঠোর নিন্দা করে বিভিন্ন দাবী-দাওয়া পেশ করা হয়। তারপর তাঁরা একটি বিরাট মিছিল বের ক’রে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। মিছিলে ছাত্রগণ ‘ছাত্র ঐক্য জিন্দাবাদ’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে’, ‘গণতন্ত্র ফিরিয়ে দাও’, ‘জরুরী আইন বর্জন কর’, ‘প্রহসনী নিবাচন বন্ধ কর’, ‘বন্যা সমস্যার সমাধান চাই’ প্রভৃতি দাবী-দাওয়া লিখিত প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার ব্যবহার করেন এবং শ্লোগান দান করেন।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও এই সময় জোরদারভাবে সভা-সমিতি ও মিছিলের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনকে মারমুখী ক’রে তোলেন।
এই উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ওয়ালীপন্থী) সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হোসেন আওয়ামী লীগ, ভাসানীপন্থী ন্যাপ ও পি. ডি. এম-এর নেতৃবৃন্দের নিকট অবিলম্বে একটি নেতৃবৈঠকে শরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে এক পত্র দেন। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরী এই ঐক্যের আহ্বানে সাড়া দেন।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করার প্রতিবাদে ১লা ডিসেম্বর তারিখে ঢাকায় সাংবাদিকগণ ও সংবাদপত্রসেবীরা মিছিল বের ক’রে গভর্নর হাউজের সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাঁরা এক সভায় মিলিত
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১৭

হয়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দাবীতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
২রা ডিসেম্বর (’৬৮) আড়াই বছর আটক থাকার পর আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা খোন্দকার মোশতাক আহমদ মুক্তিলাভ করেন। মুক্তিলাভের পর তাঁকে বিপুল সম্বর্ধনা জানান হয়।
সরকারী দমন-নীতির বিরুদ্ধে পি. ভি. এম’-এর পূর্বাঞ্চল শাখা দশদিনব্যাপী প্রতিবাদ দিবস পালনের কর্মসূচী গ্রহণ করেন এবং ডিসেম্বরের ৪ তারিখ থেকে তা’ শুরু করেন।
ভাসানীপন্থী ন্যাপ, কৃষক সমিতি ও শ্রমিক ফেডারেশনের মিলিত উদ্যোগে পল্টন ময়দানে ঐদিন এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে সরকার এই ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠানের অনুমতি দিতে অস্বীকার করেছিলেন, পরে বাধ্য হন। সভায় ভাষণ দান প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানী “বর্তমান দেশব্যাপী গণ-আন্দোলনের নিকট নতি স্বীকার করতঃ ক্ষমতার আসন ত্যাগ করিয়া অবসর জীবন যাপনের জন্য প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি প্রেসিডেন্ট ও গভর্নর মোনেম খানকে তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিণতির কথাও স্মরণ করিয়ে দেন।
মওলানা ভাসানী পাকিস্তান আন্দোলনের অঙ্গীকারের প্রতি সততা প্রদান ক’রে অনতিবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী মেনে নেওয়ার জন্য শাসকশ্রেণীর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “এই দাবীর প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন চলিতে থাকিলে পূর্ব পাকিস্তানবাসী বিচ্ছিন্ন হইয়া স্বাধীন পূর্ব বাংলা গঠন করিবে।”
ঐ সভায় রিক্সাচালকদের ওপর পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদে পরদিন ঢাকা শহরে হরতাল আহ্বানের জন্য রিক্সাচালক ইউনিয়নের জনৈক কর্মকর্তা মওলানা সাহেবকে অনু্রোধ করলে তিনি তৎক্ষণাৎ তা’ মেনে নিয়ে পরদিন এক হরতালের আহ্বান করেন। এই সাথে সাথে তিনি গভর্নর মোনেমের ভবন ঘেরাও ক’রে দাবী-দাওয়া পেশ করার জন্য আহ্বান জানান।
ঐ দিন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব এ. এইচ, এম, কামরুজ্জামান এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১৮

লীগের অস্থায়ী সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিবৃতিতে ন্যাপ-আওয়ামী লীগের যুক্ত উদ্যোগে ১৩ই ডিসেম্বর (’৬৮) ‘দমননীতি প্রতিরোধ দিবস’ পালনের জন্য আহ্বান জানান।

হরতাল
মওলানা ভাসানীর আহ্বানে ৭ই ডিসেম্বর ঢাকা শহরে যথানিয়মে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। কিন্তু সরকার জঘন্যভাবে হরতাল পালন কারীদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। এই দিনের হরতাল ও পুলিশী নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন ঢাকায় প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্রগুলো। ৮ই ডিসেম্বরের একটি দৈনিক থেকে এর অংশবিশেষ তুলে ধরছিঃ
“বিক্ষুদ্ধ জনতা পুরানা পল্টন মোড়ে অবস্থিত পেট্রোল পাম্প, পি. আই.এ-র নিকট একটি গাড়ী এবং কতিপয় আইল্যাণ্ডের গাছপালা ছিন্নভিন্ন করিয়া ফেলে।
পুলিশ সারা দিন বিভিন্ন এলাকায় সময় সময় দোকানপাট এবং সরকারী বেসরকারী ভবনে প্রবেশ করিয়া জনতার উপর লাঠিচার্জ করে। সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়। মগরেবের নামাজের পর পুলিশ বায়তুল মোকাররমে প্রবেশ করিয়া তথায় আশ্রয় গ্রহণকারী ভীত-সন্ত্রস্ত বালকসহ বহু লোককে প্রহার করে এবং মসজিদ হইতে প্রায় ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শহরে পুলিশ ও ই. পি. আর. বাহিনীর গুলীবর্ষণ, বিভিন্ন স্থানে পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপে তিন জন নিহত ও কমপক্ষে ত্রিশজন আহত হয়।
।। এই ঘটনার সুত্রপাত ।।
দোকানের অভ্যন্তরে…সকাল প্রায় ১১ টার সময় জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য নীলক্ষেতের নিকট পুলিশ সর্বপ্রথম লাঠিচার্জ করে। পুলিশের লাঠিচার্জে জনতা ছত্রভঙ্গ হইয়া যায়। কিন্তু স্বল্পক্ষণ পর আবার জমায়েত হইয়া পুলিশের প্রতি ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এই সময় সর্বপ্রথম গুলী বর্ষণ করা হয়। উক্ত গুলী বর্ষণে পাক ইলেকট্রিক শপের ম্যানেজার জনাব আবদুল মজিদ ও কর্মচারী জনাব আবদুল
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১৯

হক আহত হয়। বুলেট আবদুল মজিদের বক্ষে লাগে। তাঁহাদের হাসপাতালে প্রেরণ করা হইলে তথায় জনাব মজিদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

।। গুলিস্তানের নিকট ।।
বেলা প্রায় ১১-৪০ মিনিটের সময় গুলিস্তানের নিকট গুলী বর্ষণ করা হয়। ফলে একটি বালক ঘটনাস্থলেই নিহত এবং আরো তিনজন গুরুতরভাবে আহত হয়।

।। আবার গুলী বর্ষণ ।।
বেলা প্রায় সোয়া একটার সময় ইডেন বিল্ডিং সেকেণ্ড গেটের নিকট বিক্ষুদ্ধ জনতার উপর পুনর্বার গুলী বর্ষণ করা হয়। উক্ত গুলী বর্ষণে সোহেল আহমদ নামক জনৈক ব্যক্তি আহত হয়।

।। সর্বশেষ গুলী বর্ষণ ।।
সন্ধ্যা ৫ টার সময় নবাবপুর রেল ক্রসিং-এর নিকটে সমবেত জনতার প্রতি উক্ত দিনের সর্বশেষ গুলী বর্ষণ করা হয়। ফলে আবদুস সাত্তার নামক জনৈক ব্যক্তি আহত হয়।
[ দৈনিক সংবাদ, ৮ই ডিসেম্বর, ১৯৬৮]

গুলী বর্ষণে কমপক্ষে তিন জন নিহত এবং ৩০ জন আহত হওয়া ছাড়াও পুলিশ প্রায় তিন শতাধিক লোককে গ্রেফতার করে।
পুলিশ ও ই. পি. আর. বাহিনীর এই জঘন্য নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া অচিরেই শুরু হ’য়ে গেল। এই পরিস্থিতি সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করার দাবী জানিয়ে সে দিনই জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে কয়েক ঘন্টার জন্য সভার কাজ মুলতবী রাখার একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সরকার পক্ষের সদস্যগণ উক্ত প্রস্তাবে আপত্তি করলে উভয় পক্ষে প্রবল তর্কযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলীয় সদস্যগণ পরিষদ অধিবেশন বর্জন ক’রে আহতদের দেখার জন্য শোভাযাত্রা সহকারে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গমন করেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২০

ঢাকায় পুলিশের গুলীবর্ষণ, বেপরোয়া লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ, ব্যাপক গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় শুরু হয়। গুলী বর্ষণের প্রতিবাদে পরদিনও স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করা হয়। ঐ দিন কর্মরত সাংবাদিকের ওপর পুলিশের গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে পরদিন অর্থাৎ ৯ই ডিসেম্বর সারা দেশে সাংবাদিকগণ ধর্মঘট পালন করেন। সেদিন শান্তিপূর্ণ হরতাল পালনের মাধ্যমে সংযুক্ত বিরোধী দল আহূত দমননীতি প্রতিরোধ দিবসকে সফল করার আহ্বান জানিয়ে ডক্টর কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আবদুল হক, ব্যারিস্টার শওকত আলী খান, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, ব্যারিষ্টার ভিখারুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও ইসমাইল খানসহ ঢাকা হাইকোর্ট বার ও ঢাকা জেলা বারের অর্ধশতাধিক আইনজীবী একটি বিবৃতি প্রদান করেন। অটোরিক্সা ড্রাইভার্স এবং রিক্সাচালক সমিতিও ‘দমন-নীতি প্রতিরোধ দিবস’ পালনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন।
এলো ১৩ই ডিসেম্বর। এদিনও সারা দেশে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ক’রে পূর্ণ হরতাল পালিত হ’ল। আদমজী-টঙ্গীর কলকারখানার শ্রমিকরা মিছিল সহকারে সারা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। পুলিশ তাদের মিছিলের ওপর লাঠিচার্জ করে এবং বহু ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে।
নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ই. পি. আর. মিছিলের ওপর লাঠিচার্জ করে এবং কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এ ছাড়া তারা ৩৬ জন লোককে গ্রেফতার করে। এদিকে চট্টগ্রামে সেদিন চট্টগ্রামের ইতিহাসে বৃহত্তম মিছিল বের হয়েছিল। সেখানেও পুলিশ লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলী বর্ষণ করে। গুলী বর্ষণে ১২ ব্যক্তি আহত হয়। পরদিন আহতদের একজন শাহাদৎ বরণ করেন। পুলিশ সহস্রাধিক লোককে গ্রেফতারও করেছিল।
১৭ই ডিসেম্বর সম্মিলিত বিরোধী দলের এক কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে গুলী বর্ষণের বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবী করা হয়।
পরদিন সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, “জনগণের সম্মিলিত আন্দোলনের মোকাবিলা করার সাধ্য সরকারের নাই।” তিনি বিরোধী দলগুলোর
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২১

প্রতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানালে সেদিনই ওয়ালীপন্থী ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ তাঁর সে আহ্বানে সাড়া দেন।

গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন
অবশেষে ৮ই জানুয়ারী (১৯৬৯) একনায়কত্বের অপসারণ ও মৌলিক অধিকার পুনরুদ্ধারের দৃঢ় সংকল্প নিয়ে ৮-দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে সম্মিলিত বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ (Democratic Action Committee) গঠিত হ’ল।
দেশের প্রধান ৮টি বিরোধী দলের এই ঐক্যফ্রন্ট ঐদিন সন্ধ্যায় শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে এক ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেন। এই ঘোষণাপত্রে বলা হয়ঃ
“আমরা নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, জামিয়াতুল উলেমা-ই-ইসলাম, পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও পি. ডি. এম-এর অঙ্গদল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ, পাকিস্তান জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ও জামাতে ইসলামের প্রতিনিধিগণ দৃঢ়ভাবে মনে করি যে, দেশে বর্তমান স্বৈরাচারী ও নিপীড়নমূলক এক ব্যক্তির শাসন আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে অবক্ষয় ও ধ্বংস ঢাকিয়া আনিয়াছে। বিশেষ করিয়া এই ব্যক্তির শাসন সচেতন নিরবছিন্নভাবে ইসলামী জীবনব্যবস্থার প্রতি অবহেলা প্রদর্শন, গণতন্ত্র, জনগণের সার্বভৌমত্ব, সকল মৌলিক স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার কাড়িয়া লইয়াছে।
সর্বস্তরের মানুষ, বিশেষ করিয়া ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও অন্যান্য মেহনতী শ্রেণীর উপর বর্তমান সরকার নির্যাতন চালাইবার অপরাধে অপরাধী।
বর্তমান অগণতান্ত্রিক সরকার দেশের সম্পদরাজি কতিপয় পরিবারের কুক্ষিগত করার জন্য সুপরিকল্পিত নীতি অনুসরণ করিয়াছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন চক্র, আমলাতন্ত্র ও প্রশাসন-ব্যবস্থার সহিত জড়িত বিভিন্ন পর্যায়ের লোকের মধ্যে দুর্নীতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতেছে। দুর্নীতি সরকারী ব্যবস্থার অচ্ছেদ্য অঙ্গের বিষয় হইয়া পড়িয়াছে।
ব্যাপকভিত্তিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার, সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে জরুরী অবস্থা বলবৎ রাখা, মৌলিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমানভাবে স্বেচ্ছাচারী সরকার নির্যাতনমূলক
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২২

শাসন চালাইয়া যাইতেছে। এই সরকার এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করিয়াছে যাহাতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান এবং দেশের বিভিন্ন এলাকার মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাইয়াছে। এই বৈষম্য বৃদ্ধির গতি অপ্রতিহত রহিয়াছে, এই অবস্থায় অর্থনৈতিক সুযোগ ও সম্পদের ক্ষেত্রে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে। ইহার ফলে সাধারণ মানুষ অসহ্য মুদ্রাস্ফীতি ও সম্পূর্ণ ক্ষমতাবহির্ভূত উচ্চমূল্যের অসহায় শিকারে পরিণত হইয়াছে। উপরোক্ত সরকার দেশের সামরিক শক্তি ও প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা, বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা জোরদার করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হইয়াছে। উপরন্তু সরকার দেশের সর্বত্র, বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে নিজেদের লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ক্ষমতাহীনতা ও পরবাসীসুলভ মনোভাব জাগ্রত করিয়াছে।
বর্তমান দুর্যোগপূর্ণ জাতীয় পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে উপরোল্লিখিত অন্যায় ও দুর্নীতির প্রতিকার ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য উল্লেখিত দলসমূহের প্রতিনিধিগণ পাকিস্তানে পূর্ণ গণতন্ত্র কায়েম ও জনগণকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্বাধীনতা পুনঃ প্রদানের লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্ব স্ব দলের দ্ব্যর্থহীন সংকল্পের কথা ঘোষণা করিতেছে। দেশে তাঁহারা নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জনের জন্য স্ব স্ব দলের দ্ব্যর্থহীন সংকল্পের কথা ঘোষণা করিতেছেঃ
(ক) ফেডারেল পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার।
(খ) প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন।
(গ) অবিলম্বে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার।
(ঘ) নাগরিক স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার ও সকল কালো আইন, বিশেষ করিয়া বিনা বিচারে আটক ও বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিল।
(ঙ) শেখ মুজিবুর রহমান, খান আবদুল ওয়ালী খান ও জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ সকল রাজবন্দী, আটক ছাত্র, শ্রমিক ও সাংবাদিককে মুক্তিদান ও আদালতে এবং ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন সকল মামলার প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক মামলা জারীকৃত গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রত্যাহার।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২৩

(চ) ১৪৪ ধারা মতে জারীকৃত সকল নির্দেশ প্রত্যাহার।
(ছ) সংবাদপত্রের উপর হইতে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার, নতুন ডিক্লারেশন প্রদান, পত্রপত্রিকা ও সাময়িক পত্রের বাজেয়াপ্তি নির্দেশ প্রত্যাহার এবং ‘ইত্তেফাক’ ও ‘চাত্তান’সহ যে ক্ষেত্রে ডিক্লারেশন বাতিল করা হইয়াছে সে ক্ষেত্রে উহা পুনঃ প্রদান, প্রোগ্রেসিভ পেপারস লিঃ-কে উহার সাবেক মালিকদের পুনঃ প্রদানের জন্যও সংকল্প গ্রহণ করা হইতেছে।
এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারী সকল দলের বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত ও সংকল্প হইতেছে যে, অবাধ ও পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উপরোক্ত শর্তাবলী পূরণ না হইলে বর্তমান ব্যক্তি-স্বাধীনতাবিবর্জিত ও অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত যে কোন নির্বাচনই পাকিস্তানের জনগণের নিকট প্রবঞ্চনা বলিয়াই বিবেচিত হইবে। আমরা তাই আসন্ন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি ও নির্বাচন বর্জনের জন্য জনগণের নিকট আহ্বান জানাইতেছি।
সমগ্র দেশে বর্তমান ব্যাপক গণ-জাগরণে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হইয়াছে যে, পাকিস্তানের জনগণ বর্তমান একনায়কতন্ত্র ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। আমাদের এই ব্যাপারে কোন সংশয় নাই এবং আমরা কৃতসংকল্প যে সমগ্র দেশে যে গণ-আন্দোলনের জোয়ার প্রবাহিত হইতেছে, স্বেচ্ছাচারী ও নির্যাতনকারী সকল শক্তিকে ভাসাইয়া না নেয়া পর্যন্ত উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইবে। আমরা স্ব স্ব দলের পক্ষে এই মর্মে সংকল্প ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা এবং আমাদের দলসমূহ এই বিরাট ঐতিহাসিক ও দেশপ্রেমিক দায়িত্ব পালন ও উল্লেখিত লক্ষ্যসমূহের পূর্ণ ও দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য নিরবচ্ছিন্ন, অহিংসক, সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল গণআন্দোলন জোরদার করার জন্য যে কোন আত্মত্যাগে কুণ্ঠিত হইব না।”
ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেনঃ
(১) জনাব আমীর হোসেন শাহ, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, (২) মোহাম্মদ আলী, সভাপতি, নেজামে ইসলাম পার্টি, (৩) মুফতী মাহমুদ, সেক্রেটারী জেনারেল, জামায়াতে উলেমা-ই-ইসলাম, (৪) জনাব মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা, সভাপতি,
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২৪

পাকিস্তান মুসলিম লীগ, (৫) জনাব নসরুল্লাহ খান, সভাপতি, পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, (৬) জনাব নূরুল আমীন, সভাপতি, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, (৭) জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত), পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, (৮) জনাব তোফায়েল মিয়া, আমীর (ভারপ্রাপ্ত), জামাতে ইসলাম, পাকিস্তান।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ই জানুয়ারী, ১৯৬৯]

এই ঘোষণার সাথে সাথে সর্বত্র তা’ বিপুলভাবে সম্বর্ধিত হয়। এবং ডাক-এর নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের দুর্জয় শপথ গ্রহণ করা হয়।
মওলানা ভাসানী ১২ই জানুয়ারী (’৬৯) দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি, সরকার বিরোধী আন্দোলন ও অর্থনৈতিক অবস্থাদি পর্যালোচনার জন্য এক সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করেন। সম্মেলনে তিনি বলেন, দেশের সর্বত্র এমন ব্যাপক ও সর্বাত্মক কার্যকরী গণ-আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে হইবে যাহাতে বর্তমান শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে কোন নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হয়।
এর দু’দিন পর ঢাকার হাতিরদিয়ায় এক গণ-সমাবেশে তিনি বলেন, জনসাধারণের ভোটাধিকার, লাহোর প্রস্তাবে উল্লিখিত পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজন হইলে খাজনা-ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করিব।
এদিকে যেদিন ‘ডাক’ গঠিত হয় সেদিনই আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এক প্রস্তাবে আগামী সাধারণ নির্বাচন বয়কট করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। আরেক প্রস্তাবে দলীয় সদস্যদের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার আহ্বান জানান হয়।
১২ই জানুয়ারী ‘ডাক’ প্রাদেশিক সমন্বয় কমিটির এক সভায় গৃহীত একটি প্রস্তাবে ১৭ই জানুয়ারী নিম্নলিখিত কর্মসূচীর ভিত্তিতে ‘দাবী-দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
(ক) পল্টনে জনসভা অনুষ্ঠান।
(খ) শোভাযাত্রা সহকারে ঢাকার প্রধান প্রধান রাস্তা প্রদক্ষিণ।
(গ) যদি ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা না হয় তা’ হ’লে তিনজন ক’রে শোভাযাত্রা বের করা।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২৫

নির্দিষ্ট দিনে অর্থাৎ ১৭ই জানুয়ারী গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে দেশব্যাপী ‘দাবী-দিবস’ উদযাপিত হয়। সরকার ১৪৪ ধারা জারী করেন এবং তা’ লঙ্ঘন করলে যে উপযুক্ত শাস্তি পেতে হবে পূর্বাহ্নেই এই হুমকি প্রদর্শন করা হয়। তথাপি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-সমাজ ১৪৪ ধারা উপেক্ষা ক’রে বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবন প্রাঙ্গণে আয়োজিত ছাত্ৰ-সভা শেষে মিছিলযোগে রাজপথে নেমে এলে রাস্তায় অপেক্ষমান পুলিশের সাথে তাঁদের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ মিছিলকারী ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ করে, কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে, এবং ২৫ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের কয়েকজনকে পুলিশ নির্মমভাবে প্রহার করে। প্রহারের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় বর্ষ অনার্সের ছাত্র জনাব মোয়াররেফ হোসেন ও ঢাকা কলেজের বি. এ. ক্লাশের ছাত্র জনাব নূরুল ইসলামের মাথা ফেটে যায়।
পুলিশের এই নির্যাতনের প্রতিবাদে সর্বদলীয় ছাত্র-সমাজ পরদিন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট আহ্বান করেন। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের দুটো গ্রুপ এবং জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের একাংশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছিলেন। গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের পন্থা হিসেবে এই সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১-দফা কর্মসূচী প্রণয়ন করেন। যে ৬-দফায় পূর্ব বাংলার মানুষের মুক্তির সনদ, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১-দফা তারই পূর্ণাঙ্গ রূপ মাত্র। সংগ্রামী ছাত্রসমাজ সেদিন যে ১১-দফা দাবী আদায়ের সংগ্রামে মৃত্যুপণ ক’রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তা’ ইতিহাসের বুকে চিরদিন অম্লান থাকবে। ছাত্রসমাজের বিখ্যাত ১১-দফা দাবিগুলো নিম্নরূপঃ
১। (ক) আত্মনির্ভর কলেজগুলোকে প্রাদেশিকীকরণের নীতি ছাড়তে হবে। জগন্নাথ এবং অন্যান্য যে সব কলেজকে এই আইনের আওতায় আনা হয়েছিল, তাদের সাবেক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
(খ) শিক্ষার ব্যাপক প্রসার যদি সত্যিই সরকারের কাম্য হয়, তবে গ্রামাঞ্চলে আরও অনেক স্কুল-কলেজ খুলতে হবে, যে সব স্কুল-কলেজ ইতিমধ্যে খুলেছে তাদের অনুমোদন দিতে হবে। কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২৬

আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই খুব বেশী, কাজেই সরকারের উচিত আরো বেশী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পলিটেকনিক, টেকনিক্যাল ও কমার্শিয়াল স্কুল খোলা।
(গ) কলেজের সংখ্যা না বাড়ার দরুন ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ ক্ষতি হচ্ছে। কাজেই প্রতিটি কলেজেই নৈশ বিভাগ খোলা উচিত।
(ঘ) ছাত্রছাত্রীদের স্কুল-কলেজের মাইনে অন্ততঃ শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কমাতে হবে। স্কলারশীপ এবং স্টাইপেণ্ডের পরিমাণ বাড়াতে হবে। আন্দোলন করার অপরাধে ছাত্রছাত্রীদের এইসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা চলবে না।
(ঙ) হোস্টেলে খাওয়া খরচার শতকরা পঞ্চাশ ভাগ সরকারকে দিতে হবে সাবসিডি হিসেবে।
(চ) হল, হোস্টেল এবং অন্যান্য ছাত্রাবাসের বিভিন্ন অসুবিধা দূর করতে হবে।
(ছ) মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে বিদ্যাদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
(জ) অধিকাংশ স্কুল-কলেজেই অভিজ্ঞ ও যোগ্য শিক্ষকের সংখ্যা খুব কম। সরকারকে এর মোকাবিলা করতে হবে এবং শিক্ষকদের বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা চলবে না।
(ঝ) অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করতে হবে।
(ঞ) মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি খুলতে হবে। মেডিক্যাল কাউন্সিল অর্ডিন্যান্স এবং নমিনেশনে ভর্তির ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে। নার্স ছাত্রীদের সমস্ত দাবী মেনে নিতে হবে।
(ট) প্রকৌশল শিক্ষায় অটোমেশন প্ৰথা এবং অন্যান্য অন্যায় ব্যবস্থা বিলাপ করতে হবে।
(ঠ) পলিটেকনিক ছাত্রদের ‘কনডেন্স কোর্স’-এর সুযোগ দিতে হবে এবং ডিপ্লোমা দানের ভিত্তি হবে ‘সেমিস্টার’ পরীক্ষা।
(ভ) কৃষিবিদ্যালয়ের ছাত্রদের ন্যায্য দাবী মেনে নিতে হবে।
(ত) রেলপথে যাতায়াতের জন্য ছাত্রছাত্রীরা তাদের আইডেনটিটি কার্ড দেখালে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কনসেশনে টিকিট পাবে। বাসে দূরবর্তী
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২৭

অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য এই একই সুবিধে ছাত্র-ছাত্রীদের দিতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের মত পূর্ব পাকিস্তানেও শহরের ভেতরে বাসভাড়া দশ পয়সা করতে হবে, যাতে শহরের যে কোন জায়গায় সহজেই যাওয়া যায়। ছাত্রীদের স্কুল-কলেজে যাওয়ার জন্যে আরও অনেক বাস চালু করতে হবে।
(ণ) চাকুরীর নিশ্চয়তা দিতে হবে।
(ত) কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।
(থ) শাসকগোষ্ঠীর শিক্ষা সংকোচন নীতির প্রামাণ্য দলিল, জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও হামিদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট বাতিল করতে হবে। শিক্ষা-ব্যবস্থাকে গণমুখী এবং বিজ্ঞানভিত্তিক করতে হবে।
২। প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে। বাক-স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করা চলবে না।
৩। পূর্ব পাকিস্তানের মেহনতি মানুষ চায়, পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। এই পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তি হিসাবে তারা দাবী করে যে-
(ক) দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হবে ফেডারেল ব্যবস্থাভিত্তিক। এই যুক্তরাষ্ট্রে আইন-পরিষদের ক্ষমতা হবে সার্বভৌম।
(খ) ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা এই ক’টি বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্যান্য বিষয়ে প্রদেশগুলির ক্ষমতা হবে নিরঙ্কুশ।
(গ) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য একই মুদ্রা থাকবে এবং কেন্দ্রই হবে মুদ্রা-ব্যবস্থার পরিচালক। কিন্তু শাসনতন্ত্রে এমন একটা সুনির্দিষ্ট বিধান রাখতে হবে, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে। একই কারণে দেশে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং দুই অঞ্চলে দুটি আলাদা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বসাতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে একটা আলাদা অর্থনীতি চালু করতে হবে।
(ঘ) সকল রকমের কর, খাজনা ইত্যাদি ধার্য এবং আদায় করার ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের কোন কর ধার্য
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২৮

করার ক্ষমতা থাকবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউ-এর নির্ধারিত অংশ আদায় হওয়া মাত্রই ফেডারেল তহবিলে জমা হবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাঙ্কগুলির উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রে থাকবে।
(ঙ) ফেডারেশনের প্রতিটি অঙ্গরাজ্য বহির্বাণিজ্যের আলাদা হিসাব রাখবে এবং বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা তাদের অধীনেই থাকবে। ফেডারেল সরকারের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলি সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রের নির্ধারিত হার অনুযায়ী সরবরাহ করবে। দেশে প্রস্তুত যে কোন জিনিসই অঙ্গরাজ্যগুলিতে আমদানী বা রফতানী করা চলবে। এর জন্য কোন শুল্ক থাকবে না। ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে বিদেশী রাষ্ট্রগুলির সাথে চুক্তি করার বা বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপন করার অধিকার অঙ্গরাজ্যগুলির থাকবে।
(চ) পূর্ব পাকিস্তানকে মিলিশিয়া বা প্যারা-মিলিটারী রক্ষীবাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্রকারখানা নির্মাণ এবং নৌবাহিনীর সদর দফতর বসাতে হবে।
৪। পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধুসহ সমস্ত রাজ্যকেই স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে এবং এদের নিয়ে একটা সাব-ফেডারেশন গঠন করতে হবে।
৫। ব্যাঙ্ক, ইস্যুরেন্স, পাটের ব্যবসা এবং অন্যান্য বড় শিল্পের জাতীয়করণ চাই।
৬। কৃষকদের খাজনা ও ট্যাক্সের হার কমাতে হবে। বকেয়া খাজনা ও ঋণ মওকুফ করতে হবে। সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল করতে হবে। পাটের সর্বনিম্ন মূল্য মণপ্রতি চল্লিশ টাকা ধরতে হবে এবং আখের ন্যায্য মূল্য দিতে হবে।
৭। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী, বোনাস, উপযুক্ত শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান দিতে হবে। ধর্মঘট ও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার স্বীকার করে নিতে হবে।
৮। পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা-নিয়ন্ত্রণ এবং জন-সম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২৯

৯। জরুরী আইন, নিরাপত্তা আইন এবং অন্যান্য নির্যাতনমূলক আইন তুলে নিতে হবে।
১০। সিয়াটো, সেন্টো, পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল ক’রে জোট বহির্ভূত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি চালু করতে হবে।
১১। দেশের বিভিন্ন জেলখানায় আটক সমস্ত ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। যাবতীয় গ্রেফতারী পরোয়ানা, হুলিয়া ও মামলা ফিরিয়ে নিতে হবে।
[মহানায়ক মুজিবুরঃ অমরেন্দ্র কুমার ঘোষ, কলিকাতা, ১৯৭২, পৃঃ ১৩৪-১৩৮]

এদিকে ছাত্রদের ১১-দফার দাবীতে ১৮ই জানুয়ারী (’৬৯) ছাত্রগণ যথারীতি ধর্মঘট পালন করে। কিন্তু ধর্মঘটী ছাত্রদের উপরে পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ ক’রে শতাধিক ছাত্রকে আহত করে এবং বহু ছাত্ৰ-নাগরিককে গ্রেফতার করে। পুলিশ সূত্রে ৩৪ জন ছাত্রকে গ্রেফতারের কথা স্বীকার করা হয়। এক পর্যায়ে ছাত্র-পুলিশের খণ্ডযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে ই. পি. আর. বাহিনী তলব করা হয়। এতদসত্ত্বেও পুলিশ ও ই.পি. আর. কর্ডন ভেদ ক’রে কয়েক শত ছাত্রের একটি দল দীর্ঘ মিছিল বের করতে সক্ষম হয়।
এই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেদিন পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র গ্রুপের সদস্যগণ ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশী জুলুম এবং সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাবের প্রতিবাদে একযোগে পরিষদ কক্ষ বর্জন করেন। তাঁরা পরিষদে পুলিশের নির্মম, জঘন্য ও বর্বরোচিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে আলোচনা করতে সরকারী বিরোধিতারও তীব্র প্রতিবাদ করেন।
ছাত্র বিক্ষোভের তৃতীয় দিবসেও অর্থাৎ ১৯শে জানুয়ারীতে ঢাকায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র মিছিলের উপর পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে ও লাঠিচার্জ করে। বেলা ১১টার দিকে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় গেট থেকে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র ১৪৪ ধারা অমান্য ক’রে মিছিল ক’রে এগুতে থাকলে পুলিশের সঙ্গে তাদের এক খণ্ডযুদ্ধ হয়। বেশ কিছুক্ষণ ধরে এই সংঘর্ষ চলার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ জন ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করে। সেইদিন ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের জুলুম চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩০

ছাত্র বিক্ষোভের তৃতীয় দিবস ছিল ১৯৬৯ সালের ২০শে জানুয়ারী। মোনেম খানের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ ও গুণ্ডারা জঘন্য কীর্তির পরিচয় দেয়। ঢাকায় ছাত্র-মিছিলের ওপর গুলী চালিয়ে একজন ছাত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁর নাম আসাদুজ্জামান—ছাত্র সমাজের একটি প্রিয় নাম—সকলের আসাদ ভাই। ২০শে জানুয়ারী পূর্ব ঘটনা অনুযায়ী ছাত্রগণ যথারীতি তাদের উপর পুলিশ ও ই. পি. আর. জুলুমের প্রতিবাদে এবং ঐতিহাসিক ১১-দফার দাবীতে ঢাকাসহ প্রদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালন করে। ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় দশ হাজার ধর্মঘটী ছাত্র-ছাত্রী ১৪৪ ধারা উপেক্ষা ক’রে মিছিল সহকারে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে রাজপথ প্রদক্ষিণ করতে থাকলে পুলিশ বাধা দেয় এবং ফলে উভয়ের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ অনুষ্ঠিত হয়। সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলী বর্ষণ করে। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র জনাব আসাদুজ্জামান (২৫) নিহত হন এবং ১ জন সাংবাদিকসহ ৪ জন ছাত্র আহত হন।

হরতাল
এই খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নাগরিকগণ স্তম্ভিত হয়ে যান এবং শোকাভিভূত হয়ে পড়েন। ছাত্রগণ পরে শহীদ আসাদের লাশসহ মিছিল করে শহর প্রদক্ষিণ করতে চাইলে পুলিশ ও ই. পি. আর. ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্ডন ক’রে রাখায় তা’ সম্ভব হয় না। পরে শহীদ আসাদের স্মৃতির প্রতি ঐকান্তিক শ্রদ্ধা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে কালো পতাকাসহ দুই মাইল লম্বা একটি বিরাট শোক মিছিল নগ্নপদে শহর প্রদক্ষিণ করে। পরদিন ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র পূর্ণ হরতাল পালিত হয়।
২২শে ফেব্রুয়ারী প্রকাশিত সংবাদপত্রে ঐদিনের আন্দোলনের দুর্বারতা ও ঢাকার মিছিলের যে বর্ণনা তুলে ধরা হয়, তার অংশবিশেষ নিম্নরূপঃ

।। লাখো মানুষের মিছিল ।।
পল্টন ময়দানে শহীদ আসাদুজ্জামানের গায়েবানা জানাজা পাঠশেষে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করিয়া প্রায় এক লক্ষ লোকের একটি বিশাল মিছিল
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩১

সমগ্র শহর প্রদক্ষিণ করে। মিছিলের পুরোভাগে শহীদ আসাদুজ্জামানের একটি রক্তমাখা শার্ট বহন করা হয়। মিছিলে অসংখ্য কালো পতাকা ও রক্ত আঁকা ফেস্টুনও বহন করা হয়। মিছিলে ছাত্র-ছাত্রী, কিশোর, মহিলা, শ্রমিক, কর্মচারী, ব্যবসায়ী, দোকানদার, আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতা, কর্মী, পরিষদ-সদস্য, শিল্পী-সাহিত্যিকসহ সকল শ্রেণীর নাগরিক যোগদান করেন। স্মরণকালের এতবড় গণমিছিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় নি।
এই বিশাল গণমিছিলের দৃপ্ত পদভারে ও বজ্র-নির্ঘোষ আওয়াজে ঢাকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হইয়া উঠে। মিছিল যতই অগ্রসর হইতে থাকে, ইহার কলেবরও ততই বৃদ্ধি পাইতে থাকে। পথিপার্শ্বস্থ গৃহসমূহের ছাদ ও জানালা হইতে মিছিলকারীদের উপর পুষ্পবৃষ্টি নিক্ষেপ করা হয়।

কারাগার হইতে ফুল নিক্ষেপ
মিছিলটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পার্শ্ব দিয়া অতিক্রম করার সময় যখন রাজবন্দীদের মুক্তির দাবীতে গগনবিদারী আওয়াজ তুলিতে ছিলেন, তখন কারা-প্রাচীরের অভ্যন্তর হইতে রাজবন্দিগণ মিছিলকারীদের লক্ষ্য করিয়া ফুল ছুড়িতে থাকিলে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়।” “… … মিছিলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’, আওয়ামী লীগ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, এন. ডি. এফ., জমিয়তে উলেমায়ে ইসলামসহ ‘ডাক’ভুক্ত রাজনৈতিক দলসমূহ ও ভাসানীপন্থী ন্যাপের নেতা ও কর্মীগণ, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধী দলীয় সদস্যগণ, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জনাব এস. এম. মোর্শেদ, ঢাকা হাইকোর্ট ও ঢাকা জেলা বার-এর আইনজীবিগণও মিছিল করিয়া যোগদান করেন।
[ দৈনিক সংবাদ, ২২শে জানুয়ারী, ১৯৬৯]

ঐদিনও পুলিশ ও ই. পি. আর. বাহিনী কয়েক রাউন্ড গুলীবর্ষণ করে এবং বেয়োনেট ও ব্যাটন চার্জ করে। ফলে ১৫ জন ছাত্রীসহ বহুসংখ্যক ব্যক্তি আহত হন।
ক্রমাগত কয়েকদিন ধরে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে দেশের সর্বত্র শোক ও মশাল মিছিল এবং গণবিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। গণবিক্ষোভকে দাবিয়ে রাখার জন্য শাসকগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী তলব করে সেনারা
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩২

সারা রাস্তা টহল দিতে থাকে। কিন্ত এতে ছাত্রদের আন্দোলন আরো দুর্বার হয়ে উঠলো। ২৫শে জানুয়ারী (‘৬৯) ঢাকার কয়েকটি জায়গায় এবং খুলনাতে সেনাবাহিনী গুলীবর্ষণ করে। ঢাকায় টহলদানকারী সেনাবাহিনীর গুলীবর্ষণে, আদমজী নগরে পুলিশের গুলীবর্ষণে এবং নারায়ণগঞ্জে ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপে ও ব্যাটন চার্জে ২ জন নিহত এবং তোলারাম কলেজের কয়েকজন অধ্যাপকসহ কমপক্ষে ৩০ জন আহত হন। পরে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে সান্ধ্য-আইন জারী করা হয়।
অনুরূপ ঘটনা ঘটে খুলনার দৌলতপুর ও খালিশপুর এলাকাতেও। পুলিশ ধর্মঘটী ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে গুলীবর্ষণ করলে ৩ জন নিহত এবং বহুসংখ্যক আহত হন। পরে খুলনা শহরেও সর্বত্র কারফিউ জারী করা হয়।
পরদিনও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে ধর্মঘটী ছাত্র-জনতার ওপর সেনাবাহিনী গুলীবর্ষণ করে। এতে ৬ জন নিহত ও ১৪ জন বুলেটবিদ্ধ হন। সরকারী প্রেসনোটে অবশ্য ৩ জন নিহত ও ১০ জন আহত হওয়ার কথা স্বীকার করা হয়। ময়মনসিংহে শোক-মিছিলের ওপর পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং ৮৪ জনকে গ্রেফতার করে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনায় সান্ধ্য-আইনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়।
গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটিসহ সকল বিরোধী দলীয় নেতা এতে বিক্ষুব্ধ হন এবং কারফিউ ও সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের জন্য তাঁরা সরকারের নিকট দাবী জানান।
ঢাকায় ক্রমাগত কয়েক দিন পুলিশের গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে পশ্চিম পাকিস্তানেও গণবিক্ষোভের ঢেউ বয়ে যায়। সেখানকার অবস্থা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে ২৭শে জানুয়ারী করাচী ও লাহোরে সেনাবাহিনী তলব করা হয়। ঐদিন করাচীতে পুলিশের গুলীতে ১ জন নিহত এবং বহুসংখ্যক আহত হন। করাচী এবং লাহোরে উভয় জায়গাতেই সেদিন কারফিউ জারী করা হয়।
পরদিন পেশোয়ারেও সেনাবাহিনী তলব করা হয়। বিক্ষুদ্ধ জনতা আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে দেন। ফলে বহু লোক আহত হন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩৩

২৯শে জানুয়ারী (’৬৯) গুজরানওয়ালায় সেনাবাহিনী তলব করা হয়। সেনাবাহিনী আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলীবর্ষণ ক’রে ৩ জন লোককে নিহত করে।
শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও সংগ্রামী জনতার উত্তাল তরঙ্গের আঘাতে আইয়ুবশাহীর সিংহাসন কেঁপে উঠলো। বিগত বছরসমূহে সরকারের তাবেদারী ক’রে যারা বহু টাকা লুটেছিল এবং গত একটি দশকে যাদের কায়েমী স্বার্থ সমগ্র সমাজের ওপর পাথরের ন্যায় চেপে বসেছিল, তাদের জানমালের নিরাপত্তা সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হ’ল। ছাত্র-জনতা তাদের কারো কারো ঘরবাড়ী ঘেরাও করলো। অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ করলো। শেষ পর্যন্ত পুলিশ-ই. পি. আর. বাহিনীও হাঁপিয়ে উঠলো। রাস্তায় রাস্তায় মানুষের তাজা রক্ত দেখতে দেখতে তারা ক্রমাগত বিবেকর দংশনে জর্জরিত হচ্ছিল। ফলে আস্তে আস্তে তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে থাকলে সরকার কঠোর হস্তে দমনের জন্য সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেন। কিন্তু এতেও শেষরক্ষা হ’ল না। ১লা ফেব্রুয়ারী বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব কতকটা নতিস্বীকার ক’রে বললেন, “শীঘ্রই আলাপ-আলোচনার জন্য আমি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিবর্গকে আমন্ত্রণ জানাইব।”
এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ এবং সর্বদলীয় সংগ্রামী ছাত্র পরিষদ জানান যে, নেতৃবৃন্দকে কারাগারে রেখে কোন প্রকার আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে পারে না। সাবেক বিচারপতি এস. এম. মুর্শেদ আলোচনা বৈঠকের পূর্বে মুজিব-ভুট্টো-ওয়ালীসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবী করেন।
আইয়ুব খান ১৭ই ফেব্রুয়ারী বিরোধী দলের সাথে এই আলোচনার প্রস্তাব করেন। রাওয়ালপিণ্ডিতে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হবার কথা জানানো হয়।
৬ই ফেব্রুয়ারী (’৬৯) প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ঢাকায় আসেন পরিস্থিতি অবলোকন করার জন্য। তিনি সাংবাদিকদেরকে বলেন, জরুরী অবস্থা প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। পরদিন অপর এক সাংবাদিক সম্মেলনে এক তথ্যে দেশরক্ষা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রয়োগ বন্ধ রাখার
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩৪

সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। ৮ই ফেব্রুয়ারী (’৬৯) দৈনিক ইত্তেফাক-এর ছাপাখানা ‘নিউ নেশান প্রিন্টিং প্রেস’-এর ওপর থেকে বাজেয়াপ্ত আদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
৯ই ফেব্রুয়ারী পল্টনে এক ঐতিহাসিক সমাবেশে ১১-দফা আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার সঙ্কল্প ঘোষণা করা হয়।
ঐ দিন সরকারের নীতির প্রতিবাদে ভাসনীপন্থী ন্যাপের সদস্য জনাব মশিউর রহমান ও জনাব আরিফ ইফতেখার জাতীয় পরিষদের সদস্যপদ থেকে ইস্তাফাদান করেন।
প্রেসিডেন্ট কর্তৃক আহুত গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের প্রশ্নে অচলাবস্থার সৃষ্টি হতে থাকে। আওয়ামী লীগ ঘোষণা করেন যে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়া তাঁরা সে বৈঠকে যোগ দেবেন না। মওলানা ভাসানীও একইরূপ সিদ্ধান্তের কথা আগে ঘোষণা করেছিলেন। ছাত্র-জনতারও এ বিষয়ে অন্যান্য বিরোধীদলগুলোর প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ১১ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের সঙ্গে দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নটি জড়িত বলে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইলেন।

জাতীয় পরিষদের সদস্য-পদ থেকে বিরোধী দলের কতিপয় সদস্যের পদত্যাগ
১২ই ফেব্রুয়ারী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ মুক্তি লাভ করেন। ঐ দিন সরকারের নির্যাতন ও গণহত্যার প্রতিবাদে এবং ১১-দফার সমর্থনে জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলীয় সাতজন সদস্য পদত্যাগ করেন। সেদিন জাতীয় পরিষদ অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুলতবী ঘোষণা করা হয়। ১৪ই ফেব্রুয়ারী কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী এক ঘোষণায় বলেন যে, ফেব্রুয়ারী মাসের ১৭ তারিখ থেকে জরুরী আইন প্রত্যাহার করে নেয়া হবে।

সার্জেন্ট জহুরুল হককে নির্মমভাবে হত্যা
ঐ দিনই পল্টনে তিন লক্ষাধিক নাগরিক ‘ডাক’-এর আহ্বানে জমায়েত হয়ে পার্লামেন্টারী সরকার কায়েম ও সার্বজনীন ভোটাধিকার আদায়ের
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩৫

দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করেন। ১৫ই ফেব্রুয়ারী এক অভাবনীয় দুর্ঘটনা ঘটে যায়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে নির্মমভাবে গুলী ক’রে হত্যা করা হয়। সরকারী ভাষ্যে বলা হয়, আসামী নাকি পালাতে চেষ্টা করছিলেন, তাই তাঁর এবং অন্য একজনের প্রতি প্রহরীরা গুলীবর্ষণ করলে উক্ত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। আসলে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেবার জন্যই উপরোক্ত মিথ্যা ভাষ্য প্রদান করা হয়েছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে আসামীরা তাঁদের জবানবন্দীতে তাঁদের স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য যে দৈহিক নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরেছিলেন, তাতে স্বভাবতঃই জনগণের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি তাঁদের ১১-দফায় তাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ক’রে বিনা শর্তে আসামীদের মুক্তি দাবী করেছিলেন। এর স্বপক্ষে জনমতের যে প্রবল তরঙ্গ উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল তাতে সেনাবাহিনী নাখোশ হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। অভিযুক্তদেরকে যে আর শাস্তি প্রদান করা যাবে না, এ বিষয়ে তারা ক্রমে ক্রমে উপলদ্ধি করতে পারছিল, কিন্তু মামলা যদি সরকার তুলে নেন, তা’ হ’লে সেটা হবে সেনাবাহিনীর পক্ষে চরম অপমানজনক। তাই প্রতিশোধ স্পৃহায় দিশাহারা হয়ে তারা একে একে সব অভিযুক্তকে গুলী ক’রে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল। আর তাদের সে পরিকল্পনার প্রথম শিকার হলেন সার্জেন্ট জহুরুল হক। সার্জেন্ট জহুরুল হক ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক। সৈনিক জীবনে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী সৈনিকদের বর্বরতা, বাঙালীর প্রতি তাদের ঘৃণা ও বৈষম্যমূলক আচরণ এবং সর্বোপরি বাঙালী সৈনিকদের ন্যায়সংগত অধিকার থেকে প্রতি মুহুর্তে বঞ্চনা করা ইত্যাদি তিনি বেদনার সাথে লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি শুধু এসবের নীরব দ্রষ্টা ছিলেন না, তাঁর বিবেকচঞ্চল মন এতে বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। তিনি বাংলাদেশের তাঁদেরই একজন ছিলেন যারা নিজেদের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের মুক্তি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারতেন না। বাংলাদেশের সার্বিক স্বাধীনতা ব্যতিরেকে এই মুক্তি সম্ভব নয়। তাই তিনি স্বাধীনতায়
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩৬

পথে নির্ভয়ে পা বাড়িয়েছিলেন। এই পথ যে কত বিঘ্নসংকুল, এই পথে যে কত মৃত্যুর লেলিহানশিখা প্রজ্বলিত, তা’ তিনি জানতেন। তবু একজন নিবেদিতচিত্ত দেশপ্রেমিক হিসেবে সেই বিঘ্নসংকুল মৃত্যুর পথই তিনি বেছে নিয়েছিলেন। আর তাই যে মৃত্যু তিনি বরণ ক’রে নিলেন, সে মৃত্যু মৃত্যু নয়। স্বাধীন বাংলার একজন জাগ্রত অগ্নিপুরুষ হিসেবে চিরদিন এই দেশের মানুষের মনে তিনি অমর হয়ে থাকবেন।

উচ্ছৃঙ্খল জনতা কর্তৃক অগ্নিসংযোগ
সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলী ক’রে হত্যার প্রতিবাদে পরদিন ষোলই ফেব্রুয়ারী প্রদেশে পুনরায় হরতাল আহ্বান করা হয়। ঐ দিন ক্ষুদ্ধ ও শোকাহত জনতা কয়েকটি বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করে। ঢাকার যেসব জায়গায় অগ্নিসংযোগ করা হয় সেগুলো হ’লঃ (১) বিশেষ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপ্রতি এস. এ. রহমান (স্টেট গেস্ট হাউস), (২) কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতার মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিনের বাসভবন (পরিবাগ), (৩) প্রাদেশিক যোগাযোগ মন্ত্রী সুলতান আহমদ (সরকারী ভবন, আবদুল গনি রোড), (৪) প্রাদেশিক পূর্ত মন্ত্রী মং শোয়ে প্রু (সরকারী ভবন, আবদুল গনি রোড), ৫) প্রাদেশিক কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি খাজা হাসান আসকারীর বাসভবন। এছাড়াও আরও কয়েকটি প্রেস ও অফিসে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

সেনাবাহিনীর গুলীবর্ষণ ও সান্ধ্য-আইন জারী
অগ্নিসংযোগকালে সেনাবাহিনী ক্ষিপ্ত কুকুরের মত গুলী বর্ষণ করে। গুলী বর্ষণে একজন নিহত ও বহু লোক আহত হন। তা’ ছাড়া ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সান্ধ্য-আইনও জারী করা হয়। সেদিন পল্টনে লক্ষাধিক শ্রমিক-ছাত্র-নাগরিকের এক সমাবেশে বৃদ্ধ জননেতা মওলানা ভাসানী দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, “দুই মাসের মধ্যে ১১-দফা কায়েম, এবং রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া না হইলে খাজনা বন্ধ করা হইবে।” ঐদিন প্রেসিডেন্ট এক ঘোষণাবলে সারা দেশ থেকে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করেন। ১৭ই ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) সারাদেশে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। করাচীতে এক উচ্ছৃঙ্খল জনতার উপর ডব্লু. পি. আর. ও পুলিশ গুলী চালালে দু’জন
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩৭

নিহত ও ২৬ জন আহত হয়।

ডক্টর শামসুজ্জোহাকে নির্মমভাবে হত্যা
১৮ই ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসনের এক কলঙ্কজনক এবং শোকাবহ দিন। ঐ দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের রীডার ডক্টর শামসুজ্জোহাকে আইয়ুবের বর্বর সৈনিকদল সু-পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। দেশের অন্যান্য স্থানের মত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররাও সরকারী নির্যাতন ও গণহত্যার প্রতিবাদে হরতাল পালন করে চলছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসমাজের শান্তি রক্ষার দায়িত্ব ছিল শহীদ শামসুজ্জোহার ওপর। তিনি এবং কতিপয় শিক্ষক ধর্মঘটী ছাত্রদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালনে সাহায্য করছিলেন। এদের মধ্যে আমি নিজেও ছিলাম। ছাত্রগণ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ক’রে মিছিলসহ শহরের দিকে যাবার প্রস্তুতি নেবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটে এসে সমবেত হয়। গেটের সামনেই সৈনিকরা মোতায়েন ছিল। আমি, ডক্টর শামসুজ্জোহা, অধ্যাপক হাবিবুর রহমান (বর্বর পাকবাহিনীর হাতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় শহীদ হন), অধ্যাপক আবু সাঈদ এবং আরও কয়েকজন অধ্যাপক ছাত্র-সৈনিকের সংঘর্ষ এড়ানোর উদ্দেশ্যে সেখানে উপস্থিত হয়ে ছাত্রদের বোঝাতে চেষ্টা করি যেন তারা চারজন ক’রে একটি দলে রাস্তায় বেরিয়ে যায় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ক’রে বিপদ ডেকে না আনে। সশস্ত্র বর্বর সৈনিকদের মোকাবেলা করতে হলে এছাড়া গত্যন্তরও ছিল না। প্রথম দিকে ছাত্রগণ উচ্ছৃঙ্খল হলেও শেষ পর্যন্ত আমাদের অনুরোধে রাজী হয়ে যায় এবং ৪জন ক’রে দল বেঁধে রাস্তায় প্রবেশ করতে থাকে। উপস্থিত সৈনিকগণও এ প্রস্তাবে সম্মতি প্রকাশ করে। কিন্তু যখন সবই শান্ত এবং যখন আমরা ফিরে আসবার জন্য প্রস্তুত, ঠিক সেই মুহূর্তে বিশ্বাসঘাতক সৈনিকগণ গুলীবর্ষণ করে। ডক্টর জোহা আমার পাশেই ছিলেন। গুলী আমার কানের পাশ দিয়ে চলে গেল। ডক্টর জোহা রাস্তার দক্ষিণ দিকে গর্তের মধ্যে আশ্রয় নিলেন, আমাকে অধ্যাপক আবু সাঈদ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন। আমি হামাগুড়ি দিয়ে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে রাস্তার উত্তর দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলাম। যারা ডক্টর
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩৮

জোহার সাথে খড়ের গাদার মধ্যে শুয়ে পড়েছিলেন তাঁদের মুখে জানা গেল যে, বর্বর পাক সৈন্যদের একজন বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে ডক্টর জোহার পেট বিদীর্ণ করে। আহত হবার কয়েক ঘন্টা পর তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ডাঃ দত্ত তাঁকে অপারেশন করেন। আমি নিজে বহু বিপদ পেরিয়ে হাসপাতালে অপারেশন টেবিলে উপস্থিত হয়েছিলাম। আমাদের সবাইকে নিরাশ করে অপরাহ্নে তিনি শেষ নিঃস ত্যাগ করেন। আইয়ুব-মোনেমের বর্বরতা একজন নিষ্ঠাবান ও সম্ভাবনাময় অধ্যাপকের জীবনকে এভাবে ধ্বংস করে। ডক্টর জোহা ছাড়া সেদিন নূরুল ইসলাম নামে একজন ছাত্রকেও রাজশাহী শহরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ডক্টর জোহার মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। এর প্রতিবাদে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা অনির্দিষ্ট কালের জন্য ধর্মঘট ঘোষণা করেন। পরদিন ঢাকায় কারফিউ থাকা সত্ত্বেও কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা বিক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেন। সরকারী নির্দেশে পুলিশ, ই. পি. আর. ও সৈন্যের সম্মিলিত বাহিনী তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে ২০ জন লোক নিহত হন। এছাড়া কুষ্টিয়া ও নোয়াখালীতেও ৪ ব্যক্তি নিহত এবং বহু লোক আহত হন।

আইয়ুবের ঘোষণা
২১শে ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবস। ঐ দিন ছাত্ররা অন্যান্য বৎসরের মত যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে শহীদদের স্মৃতি তর্পণ করার জন্য প্রতিটি শহরে মিছিল বের করেন। খুলনায় এমনি একটি মিছিলের উপর পুলিশ গুলী চালালে ৮ জন নিহত হন। উত্তেজিত ছাত্র-জনতার হাতে একজন পুলিশও মৃত্যুবরণ করে। সেই দিন আইয়ুব খান জাতির উদ্দেশে প্রচারিত এক বেতার ভাষণে ঘোষণা করেন যে, পরবর্তী নির্বাচনে তিনি আর প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াবেন না।
ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট আহুত গোলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিবকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তাঁকে মুক্ত মানব হিসেবে যোগ দানের সুযোগ প্রদানে প্রেসিডেন্ট রাজী হন নি। আওয়ামী লীগের
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩৯

নেতৃবৃন্দসহ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে এর উত্তর দিয়ে বলেছিলেন যে, শেখ মুজিব প্যারোলে বৈঠকে যোগ দিতে পারবেন না। শেখ মুজিব স্বয়ং ঘৃণাভরে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে গোলটেবিল বৈঠকে তাঁর যোগদানের প্রশ্নে একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। শেখ মুজিব ছাড়া যে গোলটেবিল বৈঠক কোন মতেই সফল হতে পারে না, আইয়ুব সরকার তা’ ভালভাবেই উপলদ্ধি করেছিলেন। আর বৈঠক সফল না হতে পারলে যে নিজের ও অনুসারীবৃন্দের স্বার্থকে রক্ষা করতে পারবেন না—এবিষয়েও তিনি নিশ্চিত ছিলেন।

শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি
তাই বাধ্য হয়ে সরকার ১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী হঠাৎ এক ঘোষণায় আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ক’রে শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীকে বিনাশর্তে মুক্তি দিলেন এবং তাঁকে গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে আইয়ুব খান তাঁর দূত হিসেবে খাজা শাহাবুদ্দিনকে পাঠালেন। শেখ সাহেব পূর্ব বাংলার দাবী আদায়ের জন্য উক্ত বৈঠকে যোগ দিতে রাজী হলেন। সেনাবাহিনীর ছাউনি থেকে মুক্তি পাওয়ার পর অগণিত ছাত্র-জনতা শেখ সাহেবকে অভিনন্দন জানান। শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তির সংবাদ পরদিনের দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে আবেগমণ্ডিত ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। একটি দৈনিক পত্রিকার বর্ণনা এখানে তুলে ধরা যাকঃ “পূর্ব বাংলার মাটিতে অবশেষে বাস্তিলের কারাগার ধ্বসিয়া পড়িয়াছে। জনতার জয় হইয়াছে। গণদাবীর নিকট নতিস্বীকার করিয়া দোর্দণ্ডপ্রতাপ সরকার তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করিয়া পূর্ব বাংলার অগ্নিসন্তান, দেশগৌরব, আওয়ামী লীগ-প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানসহ এই মামলায় অভিযুক্ত সকলকে কুর্মিটোলার সামরিক ছাউনির বন্দীনিবাস হইতে গতকল্য (শনিবার) মধ্যাহ্নে বিনাশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হইয়াছেন। আর মুক্তি দিতে বাধ্য হইয়াছে কৃষক নেতা মনি সিং, আওয়ামী লীগের সমাজসেবা সম্পাদক জনাব ওবায়দুর রহমান ও একমাত্র মহিলা রাজবন্দী মতিয়া চৌধুরীসহ নিরাপত্তা আইনে আটক বা দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আরো ৩৪ জন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে। প্রদেশের কারাগারে কেবলমাত্র
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪০

গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া অপর কেহই আজ আর বিনা বিচারে আটক নাই।” সেদিন নিজ বাসভবন থেকে বাষ্পরুদ্ধ কষ্টে সমবেত জনতার উদ্দেশে শেখ মুজিব বলেছিলেনঃ “মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করিতে গিয়া যে সূর্য-সন্তানেরা অকালে হৃদয় নিংড়ানো রক্তে রাজপথ রাঙ্গাইয়া গেলেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ভাষা আমার নাই। আজকের দিনে কোটি কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলাইয়া আমিও বলি, জয়, ছাত্র-জনতার জয়।” অগণিত ভক্তের প্রেম-ভালবাসার অনির্বাণ শিখার সামনে আকণ্ঠ মাল্যভূষিত হইয়া শেখ মুজিব দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, “সংগ্রামী ছাত্ররা যে ১১-দফা দিয়াছেন তার প্রতি আমারও সমর্থন রহিল। কারণ ১১-দফার মধ্যে আমার দলের ৬-দফার রূপরেখাও রহিয়াছে।”
[ ইত্তেফাক, ২৩শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯]

আগরতলার মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তি সম্পর্কে ইত্তেফাক যে সম্পাদকীয় লিখেছেন তা’ নানা কারণে উল্লেখযোগ্যঃ “জয় নিপীড়িত জনগণের জয়, জয় নবউত্থান—আজ উৎসবের দিন নয়, বিজয়ের দিন। আজ আনন্দের দিন নয়, স্মরণের দিন। তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহৃত হইয়াছে। দুঃশাসনের কারাকক্ষ হইতে দেশের প্রিয় সস্তান শেখ মুজিব অন্যান্য বন্দীর সঙ্গে মুক্ত হইয়া আবার তাঁর প্রিয় দেশবাসীর মাঝে ফিরিয়া আসিয়াছেন। শহিদী ঈদে আমাদের অভিযান সফল হইয়াছে। গণজাগরণের প্রবল প্লাবনের পলিমাটিতে রক্তাক্ষরে লিখিত হইয়াছে নুতন এক উষার স্বর্ণদুয়ার উন্মুক্ত করার অবিস্মরণীয় কাহিনী। এ কাহিনী অসংখ্য শহীদের আত্মদানের, অসংখ্য বীরমাতা ও বীরজায়ার অশ্রু ও হাহাকার সংবরণের কাহিনী।
তবু আজ অহল্যাপ্রতিম পূর্ব বাংলা জাগ্রত। তার অশোক আকাশে ফাল্গুনের রক্তসূর্যে নূতন প্রাণের পতাকা শিহরিত। মেঘের সিংহবাহনে নুতন প্রভাত আসিয়াছে। এই প্রভাতের সাধনায় তিমির রাত্তির তপস্যায় যাহারা আত্মাহুতি দিয়াছেন আজ বিপুল বিজয়ের কান্তিলগ্নে তাঁদেরই সর্বাগ্রে স্মরণ করি। তাঁহাদের স্মৃতির উদ্দেশে জানাই আমাদের অবনত চিত্তের অভিনন্দন। চারিদিকে আজ জয়ধ্বনি। চারিদিকে আজ প্রলয়োল্লাস। বজ্রের ভেরীতে প্রাণের সাড়া জাগিয়াছে। দুঃশাসনের
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪১

বন্দীশালায় সুপ্ত গণবাসকী জাগরণের প্রথম চমকে দুলিয়া উঠিয়াছে। সব বাধা, সব চক্রান্ত, সব আগল ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। গণবিরোধী প্রতিক্রিয়ার দুর্গে গণজাগরণের বিজয়কেতন একদিন উড্ডীণ হইবেই, এ প্রত্যয় আমাদের চিরকালের। ইতিহাসের এই শিক্ষা মিথ্যা হয় নাই। একদিন যাহাকে মনে হইয়াছিল দুর্ভেদ্য, আজ তাহা লুপ্ত। মধ্যরাত্রির সূর্য-তাপসদের যে সাধনাকে একদিন মনে হইয়াছিল ব্যর্থ প্রয়াস, আজ তাহাই জয়ের মহিমায় মহিমান্বিত। এই মহিমা গণচেতনার। এই বিজয় গণমানুষের। দুঃশাসনের লৌহকপাট ভাঙ্গিয়া, প্রভাতের রক্তসূর্য ছিনিয়া আনিয়া এ গণমানুষেরা আবার প্রমাণ করিল, তাহারা অপরাজেয়। তাহারা চিরকালের অপরাভূত শক্তি।
এই শক্তিকে যাহারা দমন করিতে চাহিয়াছিল, তাহারা ব্যর্থ হইয়াছে। গণ-অধিকারের অপ্রতিরোধ্য প্রতিষ্ঠা আজ সফল সংগ্রামের মাঝে মূর্ত হইয়া উঠিয়াছে। তবুও আমরা আনন্দ করিব না। দেশের মানুষ আজ তাহাদের হাতে অধিকার ফিরিয়া পাওয়ার সম্ভাবনায় অধীর। কারাকক্ষের লৌহকপাট খুলিয়া দেশপ্রেমিক সন্তানেরা দীর্ঘদিনের বন্দীদশা শেষে আবার এক এক করিয়া মুক্ত আলো-বাতাসে ফিরিয়া আসিতেছেন। দেশের মানুষ ফিরিয়া পাইয়াছে তাহাদের প্রিয় মুজিবকে। পরিবার পরিজনের কাছে ফিরিয়া আসিয়াছেন তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলার সকল অভিযুক্ত, কেবল ফিরিয়া আসেন নাই একজন। তিনি কোনদিন ফিরিয়া আসিবেন না। প্রিয়জনের ব্যগ্র বাহুর সান্নিধ্য আর তিনি কোনদিন লাভ করিবেন না। বন্দীদশাতেই নির্মমভাবে নিহত হইয়াছেন সার্জেন্ট জহরুল হক। বহু নাম জানা আর না-জানা শহীদের রক্তে মিশিয়া গিয়াছে শহীদ জহুরুল হকের রক্ত। এ শোণিত-চিহ্ন আমাদের স্মৃতি হইতে কোনদিন মুছিয়া যাইবে না। জহরুল হকের শোণিত-রেখা এ দেশের গণজাগরণের প্রদীপ্ত পথরেখা। জহরুল হক অমর। নিজের প্রাণের মধ্যে এ দেশের গণ-সংগ্রামের ইতিহাসে তিনি মৃত্যুহীন প্রাণের পতাকা উড্ডীন করিয়া গেলেন।
ইতিহাসের গতি অনিরুদ্ধ। গণশক্তির বিজয় অপ্রতিরোধ্য। সকল সংগ্রামের এই চূড়ান্ত পর্যায়ে তাই আমরা আবার আমাদের লক্ষ্যের ধ্রবতারা
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪২

অন্বেষী হইয়াছি। বিজয়ের গৌরবে আমরা যেন মোহাবিষ্ট না হই। পথভ্রষ্ট না হই। জনগণের বিজয়ের রথচক্রে সেই বজ্রের ভেরীই নিনাদিত হউক-যাহার মধ্যে দেশ ও দেশবাসীর প্রকৃত সার্থক ও অধিকার চেতনা জাগ্রত। জনগণের জয় সার্থক হউক, জনগণের উত্থান স্থায়ী ও সফল হউক।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৩শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯]

শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক গণসম্বর্ধনা ও তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দান
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাবার পর অপরাহ্নে শেখ মুজিব মওলানা ভাসানীর সঙ্গে পৌনে এক ঘন্টাব্যাপী এক আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। পরে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খানের বাসভবনেও গমন করেন। পরদিন শেখ মুজিবকে রেসকোর্সে গণ-সংবর্ধনা জানানোর জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক আহ্বান জানান। পরদিন ২৩শে ফেব্রুয়ারী রবিবার। শেখ মুজিবকে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তরফ থেকে এক সম্বর্ধনা জানানো হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি জনাব তোফায়েল আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। দশ-লক্ষাধিক জনতার উপস্থিতিতে শেখ মুজিব সে ভূষণ শিরোধার্যরূপে গ্রহণ করেন। বাংলার নয়নমণি শেখ মুজিব এবার থেকে হলেন বঙ্গবন্ধু।

ঊনসত্তর অভ্যূত্থানের নায়ক তোফায়েল আহমদ
১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে যাঁদের নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে উজ্জ্বল ভাষায় লেখা থাকবে তাঁদের মধ্যে ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বৃহত্তর ঢাকা শহরে এবং সমগ্র পূর্ব বাংলার ছাত্র-সমাজকে আন্দোলনের জন্য সঙঘবদ্ধ করতে এই তরুণ ছাত্রনেতার অবদান অবিস্মরণীয়। শেখ মুজিবের ভাবশিষ্য এবং শেখ মুজিবের ন্যায় নির্ভীক ও সাহসী এই যুবক বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক শক্তি যথার্থভাবে আয়ত্ত করেছিলেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনে যেমন, এই সংগ্রাম পরিষদকে সুচারু পন্থায় পরিচালনায়ও তেমনি এই যুবক যে ত্যাগ ও নিষ্ঠার পরিচয়
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪৩

দিয়েছন তা’ প্রায় অতুলনীয়। মোনেম খানের ন্যায় দুর্দান্ত গভর্নর এবং আইয়ুব খানের ন্যায় পরাক্রমশীল প্রেসিডেন্ট তোফায়েল আহমদের শক্তির নিকট সেদিন মাথা নত করতে বাধ্য হন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে এমন সময় গেছে যখন ঢাকার সমগ্র প্রশাসনযন্ত্র বিকল হয়ে তোফায়েল আহমদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। শেখ মুজিবকে কারাগারের লৌহকপাট ভেঙে মুক্তির সূর্যালোকে নিয়ে আসতেও এই যুবকের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।
সেদিন বিশাল জনসুমদ্রের সামনে এই যুবকের হাত দিয়ে বাংলার চিরন্তন বন্ধু শেখ মুজিব লাভ করলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি। এক সংগ্রামী নেতার হাতে সাড়ে সাত কোটী বাঙালীর প্রাণের অর্ঘ্য অর্পিত হ’ল। আর এক সংগ্রামী যুবকের হাত দিয়ে। এ এক অপূর্ব সম্মিলন, এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বিশাল জনসমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু সেদিন আবেগমণ্ডিত দৃপ্তকণ্ঠে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, ইতিহাসের পাতায় তা’ উল্লেখযোগ্যভাবে স্থান দখল ক’রে থাকবে। তাঁর বক্তৃতার বিবরণ পরদিন প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত করা যেতে পারেঃ “সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঢাকার বুকের সর্বকালের বৃহত্তম গণ-সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে গতকাল (রোববার) আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, তিনি সরকার পক্ষের সহিত প্রস্তাবিত রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ গ্রহণ করিয়া দেশের উভয় অংশের পক্ষ হইতে দেশবাসীর অধিকারের দাবী উত্থাপন করিবেন এবং যদি উত্থাপিত দাবী গ্রাহ্য করা না হয় তবে সে বৈঠক হইতে ফিরিয়া আসিয়া দাবী আদায়ের জন্য তিনি দুর্বারতর গণ-আন্দোলন গড়িয়া তুলিবেন। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের জয়মাল্য কণ্ঠে ধারণ করিয়া বজ্রনির্ঘোষে তিনি ঘোষণা করেন যে, সংগ্রাম করিয়া আমি আবার কারাগারে যাইব, কিন্তু মানুষের প্রেম-ভালবাসার ডালি মাথায় নিয়া দেশবাসীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিতে পারি না। মুহুর্মুহু করতালি ও গগনভেদী জিন্দাবাদ ধ্বনির মধ্যে তিনি ঘোষণা করেন যে, বঞ্চিত বাঙালী, সিন্ধি, পাঞ্জাবী, পাঠান আর বেলুচের মধ্যে কোন
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪৪

তফাৎ নাই-কায়েমী স্বার্থবাদীদের শোষণ হইতে দেশের উভয় অংশের জনগণের মুক্তির একমাত্র পথ হইল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক আজাদী।
গণ-সম্বর্ধনায় সংগ্রামী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১-দফা দাবী আদায়ের সংগ্রামের সার্বিক দায়িত্ব শেখ মুজিবের স্কন্ধে অৰ্পণ করিয়া তাঁহার নেতৃত্বের প্রতি ছাত্র-জনতার পক্ষ হইতে অকৃত্রিম আস্থা প্রকাশ করে।
অভূতপূর্ব গণমহাসাগরের সামনে দাঁড়াইয়া শেখ মুজিবুর রহমান সাম্প্রতিক কালের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে যাঁহারা আত্মাহুতি দিয়াছেন তাঁহাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, জেলের তালা ভাঙ্গিয়া আমাদেরকে যে মুক্ত করিয়া আনা হইয়াছে তা’ ছাত্র-জনতার সংগ্রামের এক মহাস্মরণীয় বিজয়। এই বিজয়ের দিনে তিনি ছাত্রদের ১১-দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করিয়া ১১-দফা সংগ্রামে তিনি সক্রিয়ভাবে শরিক থাকিবেন বলিয়াও সবাইকে আশ্বাস দান করেন।
প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠকে তাঁর যোগদানের প্রশ্নে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন যে, আলোচনায় আমি অবশ্যই যাইব। কারণ নির্ভীক ও আপোষহীনভাবে কিভাবে দাবী পেশ করিতে হয় আমি তা’ জানি। দাবী আদায় না হইলে আবার আমি সংগ্রামকে দুর্বার হইতে দুর্বারতর করিয়া তুলিব, আবার আমি কারাগারে যাইব, আবার ছাত্র-জনতা সংগ্রাম করিয়া জেল হইতে আমাকে বাহির করিয়া আনিবে।
তাঁহার রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার সংক্ষিপ্ত রূপরেখার উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন যে, আমি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন চাই, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত সার্বভৌম পার্লামেন্ট চাই এবং রাজনীতি, অর্থনীতি, চাকুরী-বাকুরি, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্ব পর্যায়ে জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব চাই। আমি শ্রমিকের শ্রমের ন্যায্য মূল্য চাই। কৃষকের উৎপন্ন দ্রব্যের উপযুক্ত মূল্য চাই, সাংবাদিকদের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই।
আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি বিশ্লেষণ করিয়া তিনি বলেন যে, পাকিস্তানের দুইটি অঞ্চল, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। এই দুই অঞ্চলের জন্যই আমি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন চাই। তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানীরা
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪৫

যদি এক ইউনিট বাতিল করিতে চায় তবে অবশ্যই এক ইউনিট বাতিল করিতে হইবে এবং সাবেক প্রদেশগুলি ‘প্রাদেশিক’ স্বায়ত্তশাসনের অধিকারী হইবে।
শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সংগ্রাম অব্যাহত রাখার জন্য মহল্লায় মহল্লায়, শহর বন্দর গঞ্জে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেন। দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জ্ঞাপন করিয়া তিনি বলেন যে, আন্দোলন আমাদের চলিবেই, কিন্তু যে প্রকারেই হোক আমাদের শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখিতে হইবে। সেই সাথে তিনি সরকারকেও সর্বপ্রকার উস্কানিমূলক কার্যকলাপ হইতে বিরত থাকার আহ্বান জানান। সরকারের প্রতি তিনি রাজনৈতিক হুলিয়া ও সান্ধ্য-আইন প্রত্যাহার এবং সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরাইয়া নেওয়ার দাবী জানান। প্রতিদানে তিনি সরকারকে আশ্বাস দেন যে, দেশে শান্তি বজায় রাখার দায়িত্ব সংগ্রাম কমিটিই বহন করিবে।

মৃত ও ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য প্রসঙ্গে
শেখ মুজিবুর রহমান প্রদেশব্যাপী সাম্প্রতিক গণহত্যার ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের (নিহত ও আহত) জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দানের দাবী জানান। তিনি আরও ঘোষণা করেন যে, এই সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য একটি বেসরকারী সাহায্য কমিটি গঠন করা হইবে এবং উক্ত তহবিলের জন্য সকল মহলের নিকট হইতে অর্থ সংগ্রহ অভিযান চালানো হইবে। গণ-সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে গণনায়ক শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও অনুষ্ঠানের সভাপতি জনাব তোফায়েল আহমদ, ছাত্রনেতা খালেদ মোহাম্মদ আলী, সাইফুদ্দিন মানিক, মোস্তফা জামান হায়দার, মাহবুবুল হক দোলন ও মাহবুবুল্লাহ নেতাকে অভ্যর্থনা জানাইয়া ভাষণ দান করেন।

ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা
শেখ মুজিবুর রহমান অতঃপর তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে “ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা” নামে অভিহিত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। শেখ মুজিব গতকাল রেসকোর্স ময়দানে ‘ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলার’ পটভূমি বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে বলেন যে, বিগত পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ভারত যখন
পৃষ্ঠা নং ~ 8৪৬

লাহোর আক্রমণ করে তখন পূর্ব পাকিস্তানের ৬ কোটী মানুষ দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, লাহোরের উপর আক্রমণ, পূর্ব পাকিস্তানের উপর আক্রমণ। এই মনোভাবের মধ্য দিয়া পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় ঐক্যের এক চরম প্রকাশ ঘটে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার ব্যাপক দূরত্বের ফলে সৃষ্ট বাস্তব সমস্যাদি প্রকট হইয়া দেখা দেয়। এবং সবাই উপলদ্ধি করিতে শিখে যে, একরাষ্ট্র হইলেও চরম বিপদের সময় কেহ কাহারও প্রত্যক্ষ কোন উপকারে আসে না। এই উপলব্ধির আলোকেই আমরা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে ৬-দফা প্রণয়ন করি।
শেখ মুজিব বলেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ ও বিভেদ সৃষ্টি করিতে কায়েমী স্বার্থবাদী মহল ৬-দফায় তাই শঙ্কিত হইয়া উঠে এবং যে কোন প্রকারের হিংস্রতা ও বর্বরতার আশ্রয় গ্রহণ করিয়া হইলেও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের এই দাবীকে দাবাইতে বদ্ধপরিকর হয়। এর ফলশ্রুতিই হইল এই তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এই মামলা সাজানোর মন্ত্রণালয় ছিল-ইসলামাবাদ।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯]

শেখ মুজিবের গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান
২৪শে ফেব্রুয়ারী তারিখে বঙ্গবন্ধু তাঁর দলীয় ৯ জন প্রতিনিধি সমভিব্যাহারে লাহোরের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেনঃ সর্বজনাব তাজউদ্দিন আহমদ, মীজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মোমেন, জহুর আহমদ চৌধুরী, আব্দুল মালেক উকিল, এম. এ. আজিজ, ময়েজউদ্দিন ও মতিয়ার রহমান।
পূর্ব বাংলা থেকে ওয়ালীপন্থী ন্যাপের মোজাফফর আহমদও গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে যান। কিন্তু মওলানা ভাসানী বৈঠকে যোগদান করতে অস্বীকার করেন। আলোচনার ভিত্তি হিসাবে ১১-দফাকে গ্রহণ না করলে সে আলোচনা যে কোনক্রমেই ফলপ্রসূ হবে না সে বিষয়ে তিনি সুস্পষ্টভাবে মত প্রকাশ করেন।
সে দিনই ২৪শে ফেব্রুয়ারী ভাসানী ন্যাপের প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় ওয়াকিং কমিটির এক সভায় এ বিষয়ে আরও ৬টি পূর্বশর্ত আরোপ করা হয়। নিম্নবর্ণিত শর্তগুলো পূর্বাহ্নে মেনে না নেওয়া হলে, ন্যাপ
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪৭

(ভাসানী) গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। শর্তগুলো হ’লঃ
১। সামরিক বাহিনী ও পুলিশের গুলীতে যাঁরা নিহত ও আহত হয়েছেন তাঁদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দান করতে হবে।
২। যাঁদের পূর্বাঞ্চলে পাঁচ একর পর্যন্ত এবং পশ্চিম অঞ্চলে বার একর পর্যন্ত জমি রয়েছে তাঁদের রাজস্ব সব সময়ের জন্য মওকুফ এবং বকেয়া খাজনা ও ট্যাক্স মওকুফ করতে হবে।
৩। শ্রমিকদের বাঁচার জন্য দাবী অনুযায়ী ন্যূনতম মজুরী নির্ধারণ এবং শ্রমিক-বিরোধী কালাকানুন বাতিল করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার চার্টার মানতে হবে।
৪। নিরাপত্তা আইন ও প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স বাতিল ক’রে প্রোগ্রেসিভ পেপারস লিমিটেডকে মূল মালিকের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে।
৫। বন্যা নিয়ন্ত্রণকে জাতীয় সমস্যারূপে গ্রহণ এবং বন্যাদুর্গত এলাকাকে দুর্ভিক্ষ এলাকা হিসাবে ঘোষণা করতে হবে।
৬। কৃষক ও জেলেদের ঋণ অদায় করা চলবে না।
এই শর্তগুলো যে গোলটেবিল বৈঠকের পূর্বেই মেনে নেয়া সম্ভব নয়, ভাসানী তা’ জানতেন, আর জানতেন বলেই তিনি তাতে যোগদানের প্রশ্নে অস্বীকৃতি জানালেন। এই গোলটেবিল বৈঠকে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খানকে আহ্বান জানানো হয় নি বলে শেখ মুজিব দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। পূর্ব বাংলার সাবেক প্রধান বিচারপতি এস. এম. মুর্শেদ আমন্ত্রিত হয়ে আগেই পিণ্ডির পথে লাহোরে গিয়েছিলেন। শেখ মুজিব দাবী পেশের ন্যূনতম সুযোগকে অবহেলা করতে পারেন নি বলেই উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। লাহোর যাবার প্রাক্কালে তাঁর করণীয় ভূমিকা সম্পর্কে পূর্বাহ্নেই সাংবাদিকদের অবহিত করেন। সেদিন তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে, ৬-দফা ভিত্তিক ১১-দফা দাবী না মানা পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে কোন প্রকার আপোষে তিনি আসতে পারেন না। এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন যে, বৈঠকে বসার আগে তিনি নির্দলীয় বিশিষ্ট নেতা এয়ার মার্শাল আসগর
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪৮

খান, জেনারেল মোহাম্মদ আযম খান, বিচারপতি জনাব এস. এম. মুর্শেদ, জনাব ভুট্টো এবং তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করবেন। আর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানীদেরকে আশ্বাস দেন যে, বৈঠকে পশ্চিমীদের পক্ষ নিয়েও তিনি কথা বলবেন। শেখ মুজিবের সঙ্গে জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোও একই বিমানে গেলেন।

লাহোরে শেখ মুজিবের সম্বর্ধনা
লাহোর বিমান বন্দরে বিমান পৌঁছার সাথে সাথে বিপুল জনতা শেখ মুজিবকে সম্বর্ধনা জানানোর জন্য বিমানঘাটি ঘিরে ফেলে। অনেকেরই ধারনা হয়েছিল যে, বোধকরি শুধু শেখ মুজিবকে নয়, ভুট্টোর জন্যও এই বিশাল জনসমাগম। শেখ মুজিব কৌশলে ব্যাপারটি পরীক্ষা করার জন্য ভুট্টো যখন একসাথে বিমান থেকে নামবার প্রস্তাব করলেন, তখন তা’ পরিহার ক’রে। ভুট্টোকেই আগে নামবার সুযোগ দিলেন। সমবেত জনতার প্রায় এক চর্তুথাংশ লোক হৈ হৈ করতে করতে চলে গেলেন। কিন্তু শেখ মুজিব যখন বিমান থেকে নামলেন, ব্যাকুল আগ্রহে প্রতীক্ষারত জনতা তাঁকে প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন।
লাহোরে শেখ মুজিব এয়ার মার্শাল আসগর খান, এস. এম. মুর্শেদ এবং লেঃ জেনারেল আযম খানের সাথে পৃথক পৃথকভাবে বৈঠকে মিলিত হন। ২৫শে ফেব্রুয়ারী তিনি লাহোর থেকে পিণ্ডি গমন করেন।
পিণ্ডির চাকলালা বিমান বন্দরে পৌঁছার পরও বিপুল জনতা তাঁকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের জন্য এগিয়ে আসেন। কিন্তু এবার নেতাকে জনতার হাত ছেড়ে না দিয়ে পেছন দিকের দরজা দিয়ে বের ক’রে গাড়ীতে তুলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। একজন লম্বা পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা যখন সামনের দরজা দিয়ে বের হন, জনতা ধরে নিলেন যে, ইনিই শেখ মুজিব। কিছুক্ষণ পরেই জনতার এই ভুল ভেঙে গেলে শেখ মুজিবকে দেখবার জন্য তাঁরা দৌড়াতে থাকেন। কিন্তু ততক্ষণে শেখ মুজিব বিমানবন্দর পেরিয়ে শহরে প্রবেশ করেছেন।

শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রলোভন দান
যাহোক, ২৬শে ফেব্রুয়ারী গোলটেবিল বৈঠকের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। পরে ১০ই মার্চ পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবী রাখা হয়। ইত্যবসরে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪৯

আইয়ুব খান তাঁর চিরদিনের অশান্তির কারণ শেখ মুজিবকে গোপন বৈঠকে আমন্ত্রণ জানান এবং গোপনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণের জন্য শেখ মুজিবের নিকট আবেদন জানান। মুজিব তা’ প্রত্যাখ্যান করেন। কোন ক্ষমতার লোভ বা ঐশ্বর্যের প্রলোভন তাঁকে সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না। এই সত্য বাংলার মুক্তি, বাংলার স্বাধীনতা। এ সত্যকে তিনি আকৈশোর হৃদয়ে লালন করেছেন।

গোলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিবের ভাষণ
১০ই মার্চ রাওয়ালপিণ্ডিতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সভাপতিত্বে পুনরায় গোলটেবিল বৈঠক শুরু হয়। এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন তা’ নানাদিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য। তাঁর পুরো ভাষণটি এখানে উদ্ধত হ’লঃ
“জনাব প্রেসিডেন্ট ও ভদ্র মহোদয়গণ, এক চরম সংকটের প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে সমগ্র জাতির ভিত্তিমূল আজ প্রকম্পিত। দেশবাসীকে আমরা যারা ভালবাসি আর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অপরিসীম মাশুল যোগানোর সে কাহিনী যাদের স্মৃতিপটে আজো ভাস্বর, জাতীয় সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁদের সকলেই আজ উদ্বেগাকুল। এ সঙ্কটের নিরসন করতে হলে আজ সর্বাগ্রে প্রয়োজন এর প্রকৃতি অনুধাবনের, তার মূল কারণ অনুসন্ধানের। যে সমস্ত মৌলিক সমস্যাকে কেন্দ্র ক’রে দেশে আজ গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেল তা’ নির্ণয় ক’রে অবিলম্বে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে যদি আমরা ব্যর্থ হই তবে তার চাইতে বিপর্যয়কর আর কিছু হতে পারে না। বিগত ২১টি বছর যাবৎ এসব সমস্যাকে আমরা এড়িয়ে এসেছি।
আজ সময় এসেছে যখন এসব সমস্যার যথাযথ মোকাবিলা আমাদিগকে করতেই হবে। জাতীয় জীবনের এই সব সমস্যার প্রশ্নে বিস্তারিত একটি সমাধান আমাদিগকে খুঁজে বের করতেই হবে। এ আমার স্থিরবিশ্বাস। কেননা পরিস্থিতি আজ সুস্পষ্টভাবে গুরুতর। তাই আপাততঃ ধামাচাপা দিয়ে আধাআধি কোন ব্যবস্থার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান কোন মতেই সম্ভব নয়। আজ সমগ্র জাতীয় সত্তার ভিত্তি বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এই প্রতীতিই আমাকে আজ জাতীয় জীবনের মূল সমস্যাগুলির
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫০

বিস্তারিত একটি সমাধান নির্দেশের তাগিদ দিচ্ছে। জাতীয় জীবনের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কণ্ঠে যে সব দাবী-দাওয়া আজ ধ্বনিত হচ্ছে, যত্নসহকারে সেগুলি পরীক্ষা করলে দেখা যাবে যে, তার মূলে মাত্র তিনটি প্রশ্ন নিহিত। প্রথমটি হ’ল, রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার অবলুপ্তি। দ্বিতীয়টি সীমাহীন অর্থনৈতিক অন্যায়-অবিচার। যার ধকল পোহাতে হচ্ছে এ দেশের শ্রমিক-কৃষক-নিম্নমধ্যবিত্ত আয়ের মানুষকে মোটকথা আপামর জনসাধারণকে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে বেধড়ক ব্যয়জনিত ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির মাশুল যোগাতে হচ্ছে যেখানে এ দেশের কোটী নিরন্ন-নিঃসম্বল মানুষকে সে ক্ষেত্রে সে উন্নয়নের সুফল ক্রমবর্ধমান হারে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে মাত্র গুটিকয় ভাগ্যবান পরিবারের হাতে, যাঁরা আবার দেশের একই অঞ্চলের বাসিন্দা। তৃতীয় কারণটি হ’ল পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের প্রতি সমানে অবিচার করা হচ্ছে এই উপলদ্ধি। বর্তমান শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ কার্যকর রাজনৈতিক ক্ষমতার অনুপস্থিতির দরুন বরাবরই তাদের মৌলিক স্বার্থ ক্ষুন্ন হতে দেখেছে। বর্তমান শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে পশ্চিম পাকিস্তানের সাবেক সংখ্যালঘু প্রদেশগুলোরও এই একই অবস্থা।
জনসাধারণের রাজনৈতিক অধিকার বিলুপ্তির প্রশ্নটি আজ কয়েক দফা সুস্পষ্ট দাবীর আকারে প্রকাশ পেয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-সমাজের ১১-দফা এবং আওয়ামী লীগের ৬-দফা কর্মসূচীতে।
আইন-পরিষদে সার্বভৌমত্বের নীতিভিত্তিক পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের যে দাবী তারা উত্থাপন করেছে তাতে আইন-পরিষদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে সকল ইউনিটের প্রতিনিধিত্ব এবং সার্বজনীন বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরিভাবে জনগণের প্রতিনিধি নির্ধারণের সুপারিশ স্থান পেয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের অবিচারের প্রশ্নটিও প্রতিফলন ঘটেছে ছাত্র সমাজের রচিত ১১-দফা কর্মসূচীতে। এ প্রশ্নে তারা দেশের অর্থনৈতিক ও শিক্ষা পদ্ধতির পুনর্গঠনের জন্যও সুস্পষ্ট দাবী উত্থাপন করেছে। আমার দলের ৬-দফা কর্মসূচীতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা সুস্পষ্ট স্বীকৃতি রয়েছে। ৬-দফা কর্মসূচীতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫১

যে রূপরেখা নির্দেশ করা হয়েছে তা’ নিয়ে আমাদের এত চাপাচাপির কারণ হ’ল এই যে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনকে আমরা অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও ফলপ্রসূ অর্থনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত বলে মনে করি। ৬-দফা ও ১১-দফা কর্মসূচীতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের বিধান রেখে ফেডারেশন গঠনের যে দাবী করা হয়েছে, পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল ও ইউনিটের প্রতি সুবিচারের প্রশ্নই তার ভিত্তি। পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিটের বিলুপ্তি ও সাব-ফেডারেশন গঠনের দাবীর ভিত্তিও এই একই।
জাতীয় জীবনের এইসব মারাত্মক সমস্যার প্রশ্নে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করেছেন। শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত পরিবর্তন সাধনের অতি আবশ্যিক প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ বরাবরই একমত।
(ক) ফেডারেল পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।
(খ) সার্বজনীন বয়স্ক ভোটাধিকার-ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা।

নিম্নলিখিত প্রশ্নসমূহেও সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের মধ্যে মোটামুটি মতৈক্য পরিলক্ষিত হয়েছে।
(ক) পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট ভেঙে দিয়ে একটা সাব-ফেডারেশন গঠন।
(খ) দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকার মঞ্জুর।
সংগ্রাম পরিষদ একমত হয়ে এও স্থির করেছে যে, বর্তমান সংকটের মূল কারণসমূহ নিরসনের ফলপ্রসূ ও স্থায়ী ব্যবস্থার জন্য ভিন্ন কোন মত ও পথের সন্ধান দিতে পারেন বলে মনে করলে পরিষদের সদস্যবর্গ তাও গোলটেবিল বৈঠকে উত্থাপন করতে পারবেন। যেহেতু জাতীয় জীবনের এই সব সমস্যার একটি পাকাপাকি সমাধান খুঁজে বের করার জন্য আমরা এখানে সমবেত হয়েছি সেহেতু আমি পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে বিশ্বাস করি যে, পাকিস্তানকে সত্যিকার শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ ও বলিষ্ঠ একটি রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে ৬-দফা কর্মসূচীতে বর্ণিত রূপরেখা অনুযায়ী ফেডারেল আইন-পরিষদের জনসংখ্যার ভিত্তিতে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫২

প্রতিনিধি নির্বাচন ও পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন মঞ্জুর ক’রে শাসনতন্ত্রের প্রয়োজনীয় সংশোধন হওয়া যে দরকার, এই বৈঠকে সমাগত প্রতিনিধিবৃন্দকে তা’ হৃদয়ঙ্গম করবার জন্য বিষয়টি এখানে অবতারণা করা আমি আমার আবশ্যিক কর্তব্য বলে মনে করি। এখানে আমি বলে রাখতে চাই যে, পাকিস্তানের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা শরীক ছিলেন, আওয়ামী লীগ তাঁদেরই দল। এর প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। কিছুটা গর্বের সাথেই আমি আজ বলবো যে, এই মনীষীরই সুযোগ্য নেতৃত্বে আমি ও আমার সহকর্মিগণ সংগ্রামের পুরোভাগে থেকে সংগ্রাম করেছি। আজ আমি এখানে যে সব প্রস্তাব উত্থাপন করছি, পাকিস্তানকে আরো শক্তিশালী ক’রে গড়ে তুলবার জন্য একান্ত করেই তা’ গ্রহণ করবার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি। এ বিশ্বাসই আমার এ প্রস্তাবের মূল উৎস। “এক ব্যক্তি, এক ভোট”—গণতন্ত্রের এই আদ্যনীতি হতেই জন্ম নিয়েছে ফেডারেল আইন-পরিষদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে আমাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের দাবীটি। জাতীয় এই সংস্থাটিতে ৬-দফা কর্মসূচীতে বর্ণিত বিধান মতে, কেবলমাত্র জাতীয় সমস্যাবলীই বিবেচনার জন্য উপস্থাপিত হবে। সে কারণে, জাতীয় পরিষদের সদস্যবর্গের দায়িত্ব হবে সব কিছু জাতীয় দৃষ্টিকোণ হতে বিচারের। সেহেতু আঞ্চলিক ভিত্তিতে সেখানে কোন নির্বাচন হবে না। তদুপরি আইন-পরিষদে জাতীয় দলগুলিরই প্রতিনিধি থাকবে। বিধায় সেখানে দলগত ভোটাভুটি সুনিশ্চিত হবে—আংশিক ভিত্তিতে নয়। বিগত একুশ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে বিচার করলে এ সত্যই প্রতিভাত হয় যে, জাতীয় পরিষদে সব সময় দলভিত্তিতে ভোটাভুটি হয়ে আসছে, আঞ্চলিক ভিত্তিতে নয়। দেশের দুই অংশের প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে সংখ্যাসাম্যের নীতিটিই বরং এই ভ্রান্ত ধারণাকে ভিত্তি ক’রে গড়ে উঠেছে যে, ফেডারেল আইন-পরিষদের প্রতিনিধিগণ আঞ্চলিক ভিত্তিতে ভোট দিতে পারেন! এদিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে সংখ্যাসাম্য নীতিটিই জাতীয় রাজনীতিতে আঞ্চলিকতাবাদকে একটি গুরুতর কার্যকারণ হিসেবে অহেতুক গুরুত্ব দিয়ে আসছে। বিগত একুশ বছরের ইতিহাসের অভিজ্ঞতাই হ’ল এই যে, বড় রকমের জাতীয়
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫৩

স্বার্থের প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তান সবসময়ই তার আঞ্চলিক স্বার্থকে চাপা দিয়ে গেছে, যদিও তারা জানতো যে, জনসংখ্যার দিক দিয়ে তাদেরই দাবী অধিক। একথা কাউকেই স্মরণ করানো প্রয়োজন করে না যে, পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ছিলেন ৪৪ আর পশ্চিম পাকিস্তানের মাত্র ২৮ জন। এতদসত্ত্বেও তাদের এই সংখ্যাধিক্যকে তারা কখনো তাদের কোন আঞ্চলিক স্বার্থে কাজে লাগায় নি। বরং এক সময় পূর্ব পাকিস্তান হতেই ছয় ছয়জন পশ্চিম পাকিস্তানীকে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচন করা হয়েছিল। সংখ্যাগুরু প্রদেশ হয়েও পূর্ব পাকিস্তান কেবল কেন্দ্রীয় আইন-পরিষদেই নয়, বরং জীবনের সর্বক্ষেত্রেই সংখ্যাসাম্য নীতি মেনে নিয়েছিল। আজ দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, জাতীয় পরিষদের প্রতিনিধিত্বের বেলায় এই সংখ্যাসাম্য নীতি বাস্তবায়িত করতে কালবিলম্ব না হলেও বেসামরিক, বৈদেশিক ও সামারিক চাকুরী-বাকুরীসহ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্য কোন ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে এই সংখ্যাসাম্য নীতির সুফল ভোগ করতে দেওয়া হয় নি। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত হওয়ায় ফেডারেল রাজধানী ও সামরিক হেড কোয়ার্টারের কোথাও পূর্ব পাকিস্তানের কোন পাত্তাই নাই বললেও চলে। এর অর্থ দেশরক্ষা ও বেসামরিক প্রশাসন-ব্যবস্থা বাবদ প্রতি বছর যে ২৭০ কোটি টাকা অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের সমগ্র বাজেটের শতকরা যে ৭০ ভাগ ব্যয় হচ্ছে তার প্রায় গোটাটাই ভোগ করছে পশ্চিম পাকিস্তান। এতদসত্ত্বেও আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইরা যদি আইনপরিষদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে আমাদের আসন দিতে গররাজী হন, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানীগণ ফেডারেল রাজধানী ও সামরিক হেড কোয়ার্টারসমূহ পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরের জন্য জিদ ধরতে বাধ্য হবে।
কেন্দ্রীয় আইন-পরিষদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের দাবীতে আপত্তি না ক’রে আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইয়েরা যদি তাদের পূর্ব পাকিস্তানী ভাইদের প্রতি তাদের আস্থার পরাকাষ্ঠা দেখতে পারেন, তা’ হ’লে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার ব্যাপারে তাই-ই হবে একটি সত্যিকার পদক্ষেপ। এ পদক্ষেপের ফসল
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫৪
হিসেবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের মধ্যে গড়ে উঠবে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সুগভীর যোগসূত্র।
দেশের যাবতীয় সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পেতে হ’লে ৬-দফার প্রতিপাদ্য মতে ফেডারেল পরিকল্পনা মেনে নেওয়ার ব্যাপারটি একটি আবিশ্যিক পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য করতে হবে। দৃঢ়তার সাথে পুনরায় আমি বলতে চাই যে, ৬-দফা কর্মসূচীর মর্মবাণীই হ’ল এই যে, পাকিস্তানকে ১২ কোটী মানুষ অধ্যুষিত একটি একক, ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে উত্থাপিত করতে হবে। এই লক্ষ্য হাসিল করা সম্ভব কেবল তখনই হবে, যখন কেন্দ্রের হাতে কেবল দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা এই তিনটি বিষয় রাখার ব্যবস্থা করা হবে। একটি শক্তিশালী ও বলিষ্ঠ পাকিস্তান গড়ে তুলবার একই কারণে ভৌগোলিক অবস্থানের প্রতি যথাযথ দৃষ্টি রেখে দেশের দু’অঞ্চলকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনাধিকার মঞ্জুর করতে হবে। যাতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সর্ব ব্যাপারে তাদের পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকে।
সমাজব্যবস্থাকে সুষম খাতে ঢেলে সাজাতে হ’লে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রটি অবিচার-অনাচারমুক্ত করার অনিবার্যতা ফুটিয়ে তুলবার মত জোরালো ভাষা আমার নেই। ছাত্রদের যে ১১-দফা কাৰ্যসূচীর প্রতি আমি সমর্থন জানিয়েছি তাতে দেশের অর্থনৈতিক ও শিক্ষা-পদ্ধতির পুনর্বিন্যাসের যথোপযুক্ত প্রভাব রয়েছে। এ দাবী তারা তুলেছে অর্থনৈতিক সুবিচারের নিশ্চয়তা বিধানেরই মানসে। মানুষে মানুষে, অঞ্চলে অঞ্চলে অর্থনৈতিক সুবিচারের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য যে সব শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন প্রয়োজন, আমি অবশ্য তার মধ্যেই আমার বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখবো। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবিচারজনিত অবস্থার অতি দ্রুত অবনতি ঘটতে ঘটতে আজ এক সংকটজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এ দেশের বহুকথিত বাইশ পরিবারের কাহিনীর চর্বিতচর্বণের আর প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি নে। ক্ষমতার অলিন্দে অলিন্দে নির্বিচারে প্রবেশের যে ছাড়পত্রের তাঁরা অধিকারী, তাতে দেশের সম্পদ কুক্ষিগত ক’রে দেশ বিদেশে তাঁরা প্রচুর সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। একচেটিয়া কার্টেলবাদ সৃষ্টি ক’রে দেশের বুকে তারাই এমন
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫৫

এক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পত্তন করেছেন, যাতে সুবিধাভোগী মুষ্টিমেয় ও শ্রমিক-কৃষক শ্রেণীর অগণিত মানুষের মধ্যে সীমাহীন ব্যবধানের দুর্গম প্রাচীর গড়ে উঠেছে। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু প্রদেশসমূহের প্রতি চরম অবিচার করা হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের বৈষম্যের কথা সুবিদিত। ১৯৫৯-৬০ সালেই প্ল্যানিং কমিশনের প্রধান অর্থনীতিবিদদের হিসেবে বলা হয় যে, উভয় অঞ্চলে মাথাপিছু আয়ে প্রকৃত বৈষম্যের পরিমাণ শতকরা ৬০ ভাগ।
প্ল্যানিং কমিশনের পরিকল্পনা পর্যালোচনা এবং অন্যান্য সাম্প্রতিক দলিলে দেখা যায় যে, মাথাপিছু প্রকৃত আয়ের বৈষম্য দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বর্তমানে তা’ শতকরা ৬০ ভাগেরও অধিক। এ ছাড়া উভয় অঞ্চলের সাধারণ অর্থনৈতিক কাঠামো, কর্মসংস্থানের হার, শিক্ষার সুযোগসুবিধা এবং চিকিৎসা ও কল্যাণ সার্ভিসেও বৈষম্য রয়েছে। এখানে কয়েকটি নজির দেখানো যেতে পারেঃ (১) পূর্ব পাকিস্তানের চাইতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিজলী উৎপাদন ক্ষমতা ৫৬ গুণ বেশী। (২) ১৯৬৬ সালে হাসপাতাল বেডসংখ্যা পূর্ব পাকিস্তানে ছিল যেখানে ৬৯০ সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ২৬২০০। ১৯৬১–১৯৬৬ এই সময় কালে পশ্চিম পাকিস্তানে ৪৮টি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট স্থাপন করা হয়। পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ১৮টি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট স্থাপিত হয়। এছাড়া প্রাপ্ত সম্পদে বৈষম্য আরো বেশী। পূর্ব পাকিস্তানে সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করা ছাড়াও বৈদেশিক ঋণের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশী পশ্চিম পাকিস্তানে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর ফলে গত ২০ বৎসর রফতানীলব্ধ আয় মাত্র এক হাজার তিন শত ৩৭ কোটী টাকা হলেও পশ্চিম পাকিস্তান ৩ হাজার একশত ৯ কোটী টাকা মূল্যের পণ্য আমদানী করতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে এই সময়কালে রফতানীলব্ধ আয় ১ হাজার ৬ শত ৫০ কোটি টাকা হলেও পূর্ব পাকিস্তান মাত্র এক হাজার ২ শত ১০ কোটী টাকার পণ্য আমদানী করতে সক্ষম হয়। উপরোক্ত তথ্য প্রমাণে দেখা যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি চরম অর্থনৈতিক অবিচার করা হয়েছে। যত শীঘ্র সম্ভব উভয় প্রদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫৬

জাতীয় পরিষদে পেশকৃত ১৯৬৮ সালের অর্থনৈতিক বৈষম্য সংক্রান্ত সাম্প্রতিক বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয় যে, বৈষম্য বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। কাজেই দেখা যায় যে, কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক পরিচালনা ব্যবস্থা অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যবস্থার ফলেই আঞ্চলিক বৈষম্য অবসানের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব বাস্তবায়ন সম্ভব হয় নি, কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক পরিচালনা ব্যবস্থা ফলপ্রসূ হতে পারেনি বিধায় এ ক্ষেত্রে এ বিরাট সমস্যার একটি বলিষ্ঠ ও সুপরিকল্পিত সমাধান গ্রহণ করা উচিত। আমার মতে ৬-দফায় ফেডারেশনের যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তা’ একটি বলিষ্ঠ ও সুপরিকল্পিত সমাধান।

৬-দফাঃ একটি বলিষ্ঠ সমাধান
৬-দফা আসলে অঞ্চলসমূহের হাতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণেরই একটি পরিকল্পনা। একমাত্র এটাই (৬-দফা) সমস্যার সমাধান করতে পারে। এই দৃঢ় বিশ্বাসের ফলেই ৬-দফা প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের দরুন শ্রমিকেরা কর্মসংস্থানের জন্য এক অঞ্চল হতে অন্য অঞ্চলে যেতে পারে না। এই ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই দেশের দুই অঞ্চলে উন্নয়নের মাত্রা এক নয়। কাজেই এই ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণেও অর্থনৈতিক পরিচালনা ব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত করা উচিত নয়। আঞ্চলিক সরকারের হাতে অর্থনৈতিক পরিচালন ব্যবস্থার পূর্ণ দায়িত্ব ন্যস্ত করার জন্যই ৬-দফা কর্মসূচীতে মুদ্রা (কারেন্সী), বৈদেশিক বাণিজ্য, বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং কর ধার্যের ব্যাপারে নির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখা হয়েছে। ৬-দফায় মুদ্রা সংক্রান্ত প্রস্তাবের উদ্দেশ্য পূর্ব হতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার বন্ধ এবং মুদ্রানীতির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বৈদেশিক মুদ্রার ব্যাপারে ৬-দফায় যে সকল প্রস্তাব করা হয়েছে তার উদ্দেশ্য এক অঞ্চলের সম্পদ অন্য অঞ্চলে রাখা এবং উন্নয়নের জন্য সর্বাধিক পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থা। ফেডারেল সরকারকে প্রয়োজনীয় রাজস্ব হতে বঞ্চিত না ক’রে আর্থিক নীতির উপর আঞ্চলিক সরকারের কর্তৃত্ব সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই করধার্য সংক্রান্ত্র উপরোক্ত প্রস্তাব করা হয়েছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫৭

এই প্রস্তাবের সারমর্ম নিম্নে প্রদত্ত হ’লঃ
(ক) মুদ্রার ব্যাপারে এক অঞ্চল হতে অন্য অঞ্চলে পুঁজি পাচার বন্ধ এবং মুদ্রানীতির উপর আঞ্চলিক সরকারের কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দু’টি পৃথক মুদ্রা-ব্যবস্থা অথবা প্রত্যেক অঞ্চলে একটি ক’রে পৃথক রিজার্ভ ব্যাঙ্কসহ একই মুদ্রা ব্যবস্থার মাধ্যমে এই লক্ষ্য কার্যকরী করা যেতে পারে। এই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দু’টি মুদ্রানীতির নিয়ন্ত্রণ করবে। তবে স্টেট ব্যাঙ্ক কতিপয় সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কর্তৃত্ব বজায় রাখবে। এই ব্যবস্থা সাপেক্ষে মুদ্রা (কারেন্সী) একটি ফেডারেল বিষয় হবে।
(খ) বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্যের ব্যাপারে আঞ্চলিক সরকার দেশের পররাষ্ট্র নীতির আওতায় বাণিজ্য ও সাহায্য সম্পর্কে পর্যালোচনা চালানোর ক্ষমতার অধিকারী হবে। পররাষ্ট্র নীতি অবশ্য ফেডারেল পররাষ্ট্র দফতরের দায়িত্ব হবে। প্রত্যেক আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাঙ্কে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা রাখা হবে এবং তা’ আঞ্চলিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। একটি সর্বসম্মত হারে ফেডারেল সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন মিটানো হবে।
(গ) আঞ্চলিক সরকারের হাতেই কর ধার্য ও আদায় করার ক্ষমতা থাকবে, তবে ফেডারেল সরকারকে আঞ্চলিক সরকারের নিকট হতে রাজস্বের প্রয়োজন মেটানোর ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। এখানে এটা সুস্পষ্টভাবে মনে রাখা উচিত যে, ফেডারেল সরকারকে কখনো আঞ্চলিক সরকারের করুণার ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয় নি। এ সকল মূলনীতির অনুমোদন করা হলে উভয় পক্ষের মনোনীত বিশেষজ্ঞ সমবায়ে একটি কমিটি গঠন ক’রে বিস্তারিত বিধি-ব্যবস্থা উত্তালন করা যেতে পারে। গত কয়েক বৎসরে রাজনৈতিক কার্যকলাপের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবিচার পুঞ্জীভূত হয়েছে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে। ফলে জনসাধারণের মধ্যে হতাশা ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিকল্পনার মধ্যে এ সকল সমস্যা দূরীকরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণ এই স্কীমের প্রতি ঐকান্তিক সমর্থন দান করবেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫৮

অর্থনৈতিক সুবিচারের খাতিরে এবং দেশব্যাপী যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধানকল্পে আমি উপরোক্ত ফেডারেল পদ্ধতির স্কীম গ্রহণ করার জন্য জাতীয় সংহতি ও ভ্রাতৃত্বের মনোভাব নিয়ে খোলা মনে অংশ গ্রহণকারীদের এগিয়ে আসার আবেদন জানাচ্ছি। অর্থনৈতিক অবিচারই মূলতঃ এই সংকটের মূলে সর্বাধিক শক্তি সঞ্চার করেছে, অন্য কিছু নয়। আসুন, আমরা তার সমাধান করি। আসুন, সমস্যার গভীরতা ও উৎসমূল কোথায় তা’ আমরা অনুধাবন করি। এ সকল মৌলিক সমস্যা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার যেকোনরূপ প্রচেষ্টা আমাদের অস্তিত্বকেই সঙ্কটাপন্ন ক’রে তুলবে।
যদি আমরা বাস্তব উপলদ্ধি করতে ব্যর্থ হই এবং যার ফলে দেশব্যাপী চরম সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধান করতে না পারি, তা’ হ’লে সর্বশক্তিমান আল্লাহ এবং ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। এ একটি মহোত্তম সুযোগ। হয়তো এমনিভাবে মিলিত হওয়া অনেকের পক্ষেই আর সম্ভব নাও হতে পারে। সুতরাং অবশ্যই আমাদের সমস্যা সমাধানের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা কর্তব্য। আসুন, আমাদের প্রিয় পাকিস্তান যে সঙ্কটের আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়েছে তা’ আমরা সমাধান করি এবং এমন একটি শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপন করি যাহাতে সত্যিকার ফেডারেল পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে এবং যা পাকিস্তানী জনসাধারণের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের নিশ্চয়তা বিধান করবে। কেবলমাত্র শক্তিশালী এবং ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানই আশা ও আস্থার সাথে ভবিষ্যতে সব সমস্যার মোকাবিলা করতে পারে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১৪ই মার্চ, ১৯৬৯]

শেখ মুজিবের প্রস্তাব শুনে আইয়ুব খান প্রমাদ গুণলেন। তাঁর চোখের সামনে আস্তে আস্তে অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে লাগল। যাদের স্বার্থরক্ষার প্রতিশ্রুতিতে তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তাদের স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটিয়ে শেখ মুজিবের প্রস্তাবাবলীকে মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। এখন ভরসা তাঁর পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ।
ভরসার আলো দেখতে পেলেন আইয়ুব খান। শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারাই নন, বাঙ্গাল মুলুকের কয়েকজন মীর জাফর ও তাঁর শ্রেণীস্বার্থের
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫৯

সপক্ষে বক্তব্য পেশ ক’রে চললেন। এদেরকে খান সাহেব ভাল করেই চেনেন। এঁরা তারই সগোত্রীয়।
১৩ই মার্চে গোলটেবিল বৈঠকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব সভাপতির ভাষণ দিলেন। ভাষণে তিনি উপস্থিত নেতৃবৃন্দকে অভিনন্দন জানালেন। তিনি জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকার ক’রে দুটি প্রস্তাবও মেনে নিলেন। ভাষণে বয়স্ক ভোটাধিকারভিত্তিক প্রত্যক্ষ নির্বাচন ও পার্লামেন্টারী শাসন পুনঃ প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন।

গোলটেবিল বৈঠকে আইয়ুবের ভাষণ
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সভাপতির ভাষণে গোলটেবিল বৈঠকে সেদিন যে বক্তৃতা দেন, সংবাদপত্র থেকে তার পূর্ণ বিবরণ নীচে দেয়া হ’লঃ
গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং বিশিষ্ট মেহমানগণ।
এই সম্মেলনে যোগদানের জন্য আমি যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম তাতে আপনারা সাড়া দেওয়ায় আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। বর্তমানে দেশ যে সব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে, সে ব্যাপারে আপনাদের সরল মত প্রকাশের আমি প্রশংসা করছি। গত নভেম্বর মাসে দেশে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে তা’ উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে এবং জনসাধারণের জানমাল ও স্বাধীনতা এবং দেশের নিরাপত্তার ওপর হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৬৯ সালের ১লা ফেব্রুয়ায়ী জাতির উদ্দেশে আমার বেতার ভাষণে আমি বলেছিলাম, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা এবং যে সব প্রশ্ন জনগণকে বিক্ষুদ্ধ করেছে সে সম্পর্কে যুক্তিবাদী রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বৈঠকের ব্যবস্থা হ’লে আমি খুশী হব।
৪ঠা ফেব্রুয়ারী আমি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের কাছে প্রেরিত পত্রে ১৭ই ফেব্রুয়ারী সম্মেলনে যোগদানের জন্য বিরোধী দলসমূহের প্রতিনিধি মনোনয়ন করতে অনুরোধ জানাই। আমি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেই যে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটির বহির্ভূত দল এবং দলনিরপেক্ষ নেতৃবৃন্দের নামও তিনি সুপারিশ করতে পারবেন। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি সম্মেলনের জন্য কয়েকটি পূর্বশর্ত আরোপ করেন। এর প্রতিটি শর্তই পূরণ করা হয়।
১৬ই ফেব্রুয়ারী গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি ঘোষণা করেন যে, ‘ডাক-এর (DAC) প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগ দেবেন। ডাক সম্মেলন দু’দিন পরে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬০

অনুষ্ঠানের আহ্বান জানান, তাঁরা দলনিরপেক্ষ নেতা এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ভাসানী গ্রুপ) প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণের সুপারিশ করেন। ঐ সুপারিশ অনুযায়ী কাজ হয়।

।। ক্ষেত্র প্রস্তুত ।।
১৯শে ফেব্রুয়ারী সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে দলনিরপেক্ষ নেতারা এবং দু’টি দল বিভিন্ন কারণে সম্মেলনে যোগ দিতে অস্বীকার করেন।
ডাক (DAC) প্রতিনিধিরা রাওয়ালপিণ্ডি আসেন কিন্তু স্বীকৃত তারিখে সম্মেলনে যোগদানে অসমর্থ হন। ২১শে ফেব্রুয়ারী আমি জাতির উদ্দেশে ঘোষণা করি যে, আগামী নির্বাচনে আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবো না। বিরোধী দলীয় নেতাদের মন থেকে সব সন্দেহ দূর হবে এবং তাঁরা দেশের সমস্যাসমূহ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য সম্মেলনে যোগদান করবেন এই আশা নিয়ে গভীর চিন্তার পর আমি এই ঘোষণা করি।
২৬শে ফেব্রুয়ারী স্বল্পকালের জন্য মিলিত হওয়ার পর সম্মেলন ১০ই মার্চ পর্যন্ত মুলতবী হয়ে যায়। এই মধ্যবর্তী সময়ে সম্মেলনে আলোচনার জন্য একটি সর্বসম্মত ফর্মুলা উদ্ভাবনের আশায় বিরোধী দলীয় নেতারা আলোচনা চালান।

।। দু’ দফা ।।
১০ই ফেব্রুয়ারী নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান সম্মেলনে নিম্নোক্ত দু’ দফার একটি ফর্মুলা পেশ করেন।
(১) দেশের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ ফেডারেল পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা।
(২) প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটের ভিত্তিতে পরিষদসমূহের প্রতিনিধি নির্বাচন। এরপর আলোচনা শুরু হয় এবং এ সময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ফেডারেল পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকারের সংজ্ঞা এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন-ব্যবস্থায় বিরোধী দলের মধ্যে কোন মতৈক্য নেই। বিভিন্ন বিরোধী দলীয় নেতারা গত ৪ দিন ধরে ফেডারেল পার্লামেন্টারী ব্যবস্থা এবং
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬১

আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সীমা সম্পর্কে নিজেদের মত প্রকাশ করেন। বাড়তি কিছু দাবীও সম্মেলনে পেশ করা হয়। এইসব দাবীর মধ্যে ছিল এক ইউনিট বাতিল এবং কতিপয় বিষয় ছাড়া আর সব বিষয় প্রাদেশিক সরকারের হাতে হস্তান্তর করা। যে সব বিষয় কেন্দ্রের হাতে থাকবে, তা’ হ’ল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র বিষয় এবং কতিপয় শর্তসাপেক্ষে মুদ্রা-ব্যবস্থা।
আরো দাবী করা হয় যে, ফেডারেল পার্লামেন্ট নির্বাচন জনসংখ্যার ভিত্তিতে হতে হবে। বর্তমানে উভয় প্রদেশে যে সংখ্যাসাম্য রয়েছে তার ভিত্তিতে নয়।
পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যাখ্যাদান প্রসঙ্গে কোন কোন বিরোধী দলীয় নেতা বলেন যে, এতে ফেডারেল সরকারের কর আরোপের অধিকার থাকবে না, এবং ফেডারেলভুক্ত প্রতিটি রাজ্যের আলাদা বৈদেশিক বাণিজ্য ও অর্থনীতি থাকবে।
বিরোধী দলের অপর কয়েকজন নেতা বলেন যে, সংখ্যাসাম্য বিঘ্নিত করা ঠিক হবে না। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের যে ব্যবস্থা রয়েছে তা’ অব্যাহত রাখা দরকার। এই আলোচনা চলাকালে আমি কোন কোন বিষয়ের ব্যাখ্যা চেয়েছি। আপনাদের সহায়তা ও বিরোধিতার জন্যেও আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। যা কিছু বলা হয়েছে সে সম্পর্কে আমি সতর্কতার সাথে চিন্তা করেছি এবং সম্মেলনে যে সব প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে সেগুলো আমি বিবেচনা করেছি।

১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র
১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে যে পদ্ধতি রাখা হয়েছে তা’ দেশের বৃহত্তর স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখেই করা হয়েছিল। গত ১০ বৎসর যাবৎ এই পদ্ধতি মোতাবেক কাজ করা হয়েছে এবং সব ক্ষেত্রেই দেশের বিপুল অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এ কথা বলার সময় এ ব্যাপারে বিরোধী দলীয় নেতারা যে সমালোচনা করেছেন সে সম্পর্কেও আমি অনবহিত থাকি নি, কিন্তু এটাও ঠিক যে, এ সময়ে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল এবং সারা বিশ্বে পাকিস্তানের মর্যাদাও বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইতিহাসের বিচার সব সময় সমসাময়িক ধারার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় না।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬২

গত দশ বছর সম্পর্কে এখানে চূড়ান্ত রায় প্রদান করা হয় নি। চাহিদা মিটানোর জন্য সামঞ্জস্য বিধানের ব্যবস্থা ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে রয়েছে, তবুও এই শাসনতন্ত্র সম্পর্কে অনেকেই জোরের সাথে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের এই ক্ষোভকে আমি ‘৬২ সালের শাসনতন্ত্রের কোন কোন ধারার বিরুদ্ধে জনগণের রায় বলেই মনে করি। বিভিন্ন নেতা সম্মেলনে যেসব দাবী পেশ করেছেন সেগুলোর পিছনে কি পরিমাণ সমর্থন রয়েছে তা’ এই সম্মেলনে বসে আমার পক্ষে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
জনগণের অনুমোদন ছাড়া এ সব দাবী মেনে নেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে বলে ধরে নেওয়াও সম্ভব নয়। এই সম্মেলনে বিভিন্ন নেতার বক্তব্য শোনার পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, সর্বসম্মত দাবী হচ্ছে দু’টিঃ
(ক) প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন ও
(খ) দেশে পার্লামেন্টারী ব্যবস্থা চালুকরণ।
প্রথম পয়েন্টটি খুবই সংক্ষিপ্ত এবং কোনরূপ অসুবিধা ছাড়াই তা’ পরিষদে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমার সম্মুখে বর্তমানে একটিমাত্র লক্ষ্য রয়েছে তা’ হচ্ছে শান্তিপূর্ণ শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের এক ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করা; বৈঠকে আমি আমার এই লক্ষ্য প্রকাশ করেছি এবং ১লা ফেব্রুয়ারীতে আমি এক ঘোষণা করেছি।’
ভদ্র মহোদয়গণ, আপনাদের কাছে এ কথা ঘোষণা করতে আমার দায়িত্ব বলে মনে করি যে, প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপরেই অমীমাংসিত প্রশ্নসমূহের সমাধানের ভার ছেড়ে দেওয়া যথাযথ হবে। প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ একটি সার্বভৌম পরিষদে মিলিত হবেন এবং সে পরিষদে তাঁরা নির্দিষ্ট সমস্যাবলী ও দাবী-দাওয়া উত্থাপন করবেন। বর্তমান গোলটেবিল বৈঠকে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যে সকল সমস্যা ও দাবী উত্থাপন করেছেন তখন নব-নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ সেই পরিষদেই তা’ উত্থাপন করবেন এবং জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বলেন, ‘আমি শক্তিশালী ও স্থায়ী কেন্দ্রসহ একটি অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী।’ দেশের আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬৩

প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘বর্তমান আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আমাদের কাছে এক গভীর উদ্বেগের বিষয় হওয়া উচিত। অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগে সময় ও শক্তির অপচয় করা কোন মতেই উচিত হবে না। আমাদের অতি মূল্যবান একটি শিক্ষা-বছর নষ্ট হয়েছে। সকল ক্ষেত্র থেকে দাবী উঠেছে, অথচ দেশের ক্ষমতা ও সম্পদের পরিমাণের প্রতি এতটুকুও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। দেশের অর্থনৈতিক জীবন স্তব্ধ হয়ে আসছে। শিল্প উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে দেশের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা দারুণ সংকটের সম্মুখীন হবে।’ প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমাদের সকলের বহুবিধ সমস্যা আছে এবং আমাদের সকলকে সমবেতভাবে মোকাবিলা করতে হবে। দেশে যাতে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসে তজ্জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ ও সমবেতভাবে সমস্যাবলীর মোকাবিলা করতে হবে।’
প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘পরিশেষে আমি উল্লেখ করতে চাই যে, ইসলামের ভিত্তিতেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ইসলামের নীতি ও অনুশাসন অনুযায়ী আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করবো। জাতি ও আপনাদের নিকট বিবেচনার জন্য আমি আমার প্রস্তাবসমূহ পেশ করছি। আমি জানি যে, জনগণ এই বৈঠকটির ফলাফলের জন্য গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এবং আমি প্রার্থনা করছি যে, বর্তমান সংকটটি মোকাবিলার জন্য খোদা আমাদের শক্তি ও সাহস দান করুন।
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১৫ই মার্চ, ১৯৬৯]

শেখ মুজিবের ঢাকা প্রত্যাবর্তন
১৪ই মার্চ (’৬৯) শেখ মুজিব ঢাকা ফিরে আসেন। দেশের আপামর মানুষের স্বার্থের প্রশ্নে তিনি আপোষ করেন নি। তাই বিমান বন্দরে তাঁকে বীরোচিত সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বাংলার মাটিতে পা দেবার পৌনে ৪ ঘন্টা পরই বঙ্গবন্ধু এক সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করেন। সম্মেলনে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ৪ জন নেতা এন. ডি. এফ-এর জনাব হামিদুল হক চৌধুরী, প্রাদেশিক পি. ডি. এম-এর প্রধান জনাব আবদুস সালাম খান, পি. ডি. এম-এর সেক্রেটারী জেনারেল জনাব মাহমুদ আলী এম. এন. এ. এবং নেজামে ইসলাম পার্টির সম্পাদক জনাব ফরিদ আহমদ এম. এন.এ’র গোলটেবিল বৈঠকে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬৪

ভূমিকার কথা উল্লেখ ক’রে তাঁদের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ উত্থাপন করেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, “বিগত ২১ বৎসরের ইতিহাসে যে সনাতন কুচক্রী মহল গণদাবীর বিরুদ্ধে চিরন্তনভাবে চক্রান্ত করিয়া আসিতেছে, সে মহল আজও সক্রিয় রহিয়াছে।”
[ ইত্তেফাক, ১৫ই মার্চ, ১৯৬৯]

তিনি দুঃখ প্রকাশ ক’রে বলেন যে, “দেশবাসী আশা করিয়াছিল যে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর বিগত ২১ বৎসরের শাসন ও শোষণের ফলে আমাদের নেতৃবৃন্দের চৈতন্যোদয় হবে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল যে তাঁদের চরিত্রের কোন পরিবর্তন ঘটে নাই। তিনি আরো দুঃখ করে বলেন যে, যদি পূর্ব পাকিস্তানের দাবী-দাওয়ার প্রশ্নে তাঁদের ঐক্যবদ্ধ সমর্থন পাওয়া যেত তা’ হ’লে প্রেসিডেন্টের পক্ষে সেসব মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।”
[ ইত্তেফাক, ১৫ই মার্চ, ১৯৬৯]

শেখ মুজিব ঐ বৈঠকে জনাব নুরুল আমীন, বিচারপতি জনাব এস. এম. মুর্শেদ ও ন্যাপের আঞ্চলিক সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের বলিষ্ঠ ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
এর আগে ১৩ই মার্চ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় ‘ডাকে’র সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এর কারণস্বরূপ শেখ মুজিব সেদিন এক ঘোষণায় বলেন যে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং এক ইউনিট বাতিলের দাবী সমর্থনে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছেন। সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিব আরো বলেছিলেন যে, গণদাবী আদায়ের জন্য তিনি অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।

কুচক্রী মহলের উস্কানিতে উচ্ছৃঙ্খলতা ও শেখ মুজিবের হুঁশিয়ারি
দুঃখের বিষয়, ধীরে ধীরে সংগ্রামী জনগণ শেষ পর্যন্ত একেবারে উচ্ছৃঙ্খল কাজে লিপ্ত হতে থাকল—কথায় কথায় চরমপত্র প্রদান, ধর্মঘট, ঘেরাও, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি অনাচারে প্রদেশ ছেয়ে গেল। এটা যে গণতান্ত্রিক অধিকারকে পণ্ড করার অশুভ ষড়যন্ত্র, বঙ্গবন্ধু তা’ স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। কুচক্রী মহল সংগ্রামী মানুষকে উস্কানি দিয়ে জানমাল সম্পত্তি বিনাশের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম বিপথে চালিত করার জন্য এই সমাজ-বিরোধী ও মানবতা-বিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে লাগলো। শেখ মুজিব এই অশুভ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬৫

১৯শে মার্চ (’৬৯) দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানালেন। তিনি বললেন, ‘মানবতার প্রতি যারা শ্রদ্ধাশীল, মানবতার স্বার্থে ও কল্যাণে যারা বিশ্বাসী, তাঁদের সকলের প্রতি আমার আবেদন, স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই ঘৃণ্য ও দূরভিসন্ধিমূলক চক্রান্তকে বানচাল করার জন্য সমাজ-বিরোধী এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, মজদুর ভাই ও আওয়ামী লীগের প্রতিটি সদস্যের প্রতি আমার সনির্বন্ধ আহ্বান, অবিলম্বে আপনারা দেশের আপামর জনসাধারণের অধিকার সংরক্ষণ ও শান্তি বজায় রাখার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ ক’রে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।’
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২০শে মার্চ, ১৯৬৯]

শেখ মুজিবের এই আহ্বানে দেশের পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এল, দেশে উচ্ছৃঙ্খল সমাজ-বিরোধী কার্যকলাপ হ্রাস পেতে শুরু করল।

মোনেম খানের পলায়ন ও ডঃ এম. এন. হুদার গভর্নররূপে আগমন
এই সময় বাংলার ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কিত নায়ক আইয়ুবের পদলেহী গভর্নর ময়মনসিংহের এককালের বটতলার উকিল লাটবাহাদুর জনাব আবদুল মোনেম খান সপরিবারে সবার অজান্তে পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যান। তাঁর স্থলে ২১শে মার্চ (’৬৯) গভর্নর হয়ে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর, মোনেম খানের মন্ত্রী পরিষদের সুদীর্ঘকালের অর্থমন্ত্রী ডঃ এম. এন. হুদা। কিন্তু এই মেরুদণ্ডহীন স্বার্থান্ধ শিক্ষাবিদের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত শিকা ছিঁড়ল না। দু’ দিনের সম্রাটকে পথ ছেড়ে দিতে হ’ল। ২২শে মার্চ সকাল ১০টায় গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণের পর ডঃ হুদা প্রদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে শেখ মুজিব, আতাউর রহমান খান এবং নূরুল আমীনের সঙ্গে ঘরোয়াভাবে আলোচনা করেন। প্রদেশবাসীর উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে তিনি সর্বমহলের সহযোগিতা কামনা করেন।

পূর্ব বাংলার ভাগ্য বিপর্যয়
কিন্তু দুর্ভাগ্য, পূর্ব বাংলার জনগণের নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে তাঁদের অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টাকে সফল হতে দেওয়া হ’ল না। কেননা ২৫শে মার্চের দিনের শেষে সন্ধ্যাবাতি জ্বালাবার আগেই
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬৬

‘আইয়ুবশাহী’ নাটকের যবনিকা-পতন ঘটল। ক্ষণেক বিরতির পর পর্দা উঠলেই দেখা গেল পাকিস্তানের আরেক নাটক—যার নায়ক হিসেবে মঞ্চে এলেন আর এক জেনারেল। পাকিস্তানে পুনরায় সামরিক শাসন কায়েম করা হ’ল এবং এই শাসনের দণ্ড ধারণ করলেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। পাকিস্তানের ভাগ্যে দুঃখের অমানিশা গাঢ়তর হয়ে উঠলো। আর সেই গাঢ়তর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ভাগ্যে প্রভাত-সুর্যের সম্ভাবনা সমুজ্জ্বল হয়ে দেখা দিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৃত্যু এবং বাংলাদেশের জন্মের সময় আর বেশী দূরে নয়।
ক্ষমতার এই হাত বদল খুব একটা আশ্চর্যজনক কিছুই নয়। যাদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতিতে আইয়ুব খান একদা ইস্কান্দার মীর্জার কাছ থেকে ক্ষমতা দখলের ‘ম্যাণ্ডেট’ পেয়েছিলেন, তারাই আবার আইয়ুবকে সরিয়ে ইয়াহিয়া খানকে গদিতে এনে বসালো। পশ্চিম পাকিস্তানের আমলা, সৈনিক ও পুঁজিপতিদের আঁতাত বড়ই শক্ত ও মজবুত। গোলাম মোহাম্মদ, ইস্কান্দার মীর্জা, আইয়ুব খান, এবং পরিশেষে আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, সবাই ছিলেন এই আঁতাতের এক একজন নায়ক। সুতরাং জাতীয় জীবনে ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে পূর্ব বাংলার কোনরূপ যোগ্যস্থান এঁরা দিতে পারেন না। তাই যখনই যে মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তান তার ন্যায্য অধিকার পাওয়ার পথে সাফল্য অর্জন করতে এগিয়ে এসেছে, সেই মুহূর্তেই পাকিস্তানে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। পূর্ব বঙ্গবাসীদের মধ্যে যারা পশ্চিম পাকিস্তানের বশংবদ সেজে সোচ্চার হয়েছিল, শুধু তাঁদেরকেই এই আঁতাতের শরীক ক’রে পূর্ব বাংলাকে একটি কলোনী বা বাজার হিসেবে ব্যবহার করবার ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক গতি ও পথ পরিবর্তনের এবং পরিক্রমার ইতিহাস আসলে ষড়যন্ত্র ও আঁতাতের ইতিহাস, শাসন ও শোষণের ইতিহাস।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬৭

সংগ্রামী জীবনের পঞ্চম অধ্যায়
(১৯৬৯-১৯৭১)

প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের দশ বছর স্থায়ী শাসনকালের ইতিহাস স্বৈরাচারী শাসন-ব্যবস্থার ইতিহাস। দীর্ঘ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশের সমগ্র ক্ষমতা হস্তগত ক’রে তিনি বারবার দেশের মানুষের নিকট এবং বহির্বিশ্বে মহৎ হবার চেষ্টা করেছেন, একজন সুদক্ষ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দিনরাত নিজেকে প্রচার করবার সযত্ন প্রয়াসে লিপ্ত থেকেছেন। কিন্তু দেশবাসী, বিশেষ ক’রে পূর্ব বাংলার মানুষ তাঁর শাসনভার গ্রহণের পর থেকেই উপলব্ধি করেছিল যে, পূর্ব বাংলাকে সমস্ত দিক থেকে শোষণ করবার জন্য, এই অঞ্চলের মানুষকে বঞ্চিত করবার উদ্দেশ্যে, একটি অশুভ শক্তি গায়ের জোরে তাদের মাথার ওপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছে। এই শক্তির হাত থেকে রেহাই পাওয়া সহজসাধ্য নয়-তাই তাঁরা জানতেন যে সামনে কঠিন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। আইয়ুব খান ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী তৈরী ক’রে সমগ্র দেশের নৈতিকতাকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিলেন। এদেশ ‘Too hot for democracy’ বলে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র তিনি উদ্ভাবন ও কায়েম করলেন এবং বাইরের বিশ্বে এই নতুন পদ্ধতির মহিমা ব্যাপকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু এই ব্যবস্থাপনার অন্তঃসারশূন্যতা দেশে এবং বিদেশে কারো পক্ষেই উপলদ্ধি করতে কষ্ট হয় নি। আসলে এই
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬৮

ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজেকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখাই যে তাঁর উদ্দেশ্য তা’ দিবালোকের মতই স্পষ্ট হয়ে উঠল। অস্ত্রের বল তাঁর যথেষ্টই ছিল—তবু জনশক্তিকেও তিনি বিশেষ ভয় করতেন। তিনি একথা গভীরভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, শুধু অস্ত্র দিয়ে জনশক্তিকে শান্ত রাখা যায় না—সাময়িকভাবে সম্ভব হলেও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। তাই এই লোক দেখানো গণতন্ত্র, তাঁর ভাষায় মৌলিক গণতন্ত্র।
আইয়ুব খানের শাসনামলে দেশে রাস্তাঘাট নির্মাণ ও শিল্প প্রতিষ্ঠার দিকে দৃষ্টি দেয়া হয়েছিল, এতে সন্দেহ নেই। বেশ কিছু কাজও যে হয়েছে, একথা আমরা স্বীকার করব। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, আইয়ুব বিদেশ থেকে যে পরিমাণ ঋণ এনেছেন সেই অর্থের সামান্য অংশই পূর্ব বাংলায় খরচ করা হয়েছে। সরকারী আনুপাতিক হিসাবের চিত্র যে কি তার কিছু কিছু নমুনা আমি দিয়েছি। এ ছাড়া পূর্ব বাংলায় যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে তার একটি মোটা অংশই হয়েছে অপচয় মৌলিক গণতন্ত্রীদের মাধ্যমে অথবা মুখচেনা ব্যবসায়ী ও কন্ট্রাকটরদের মাধ্যমে। আইয়ুবের আমলে পশ্চিম পাকিস্তানে যেমন বাইশ পরিবার কেঁপে উঠেছিলেন, তেমনি পূর্ব বাংলায় গড়ে উঠেছিল কন্ট্রাক্টরদের ও ব্যবসায়ীদের একটি সম্প্রদায়। বাইশ পরিবারের সাথে এদের তুলনা চলে না—তবে পূর্ব বাংলার সমাজে এদের আর্থিক প্রতিপত্তি চোখে পড়বার মত ছিল।
নিজেকে ক্ষমতার আসনে রাখবার জন্য দেশের চরিত্র তিনি ধ্বংস করেছিলেন। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে তিনি সামগ্রিকভাবে হনন করেছিলেন।
পূর্ব বাংলার মানুষের বিক্ষুদ্ধ চেতনাকে নিজের মধ্যে ধারণ ও লালন ক’রে এই অশুভ শক্তির মোকাবিলার জন্য যিনি প্রস্তুত হলেন, তিনি আমাদের অসম সাহসী দুর্জয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী প্রিয় নেতা শেখ মুজিব। তিনি বাঙালী বিক্ষুদ্ধ চেতনার ও সংগ্রামী অভিযাত্রার প্রতীক। শেখ মুজিব এখন আর একটি নাম নয়, একটি আদর্শ। শেখ মুজিব এমন একটি ব্যক্তিত্ব যার মধ্যে বাঙালীর মুক্তির বাণী সংহত রূপ পরিগ্রহ করেছে। এ কারণেই আইয়ুবের আমলেই শেখ মুজিবকে সাড়ে সাত কোটী বাঙালী যে সীকৃতির মাল্যদান করেছে তার নাম বঙ্গবন্ধু। আমরা অতীতে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬৯

দেশবন্ধু পেয়েছি, শেরে বাংলাও পেয়েছি কিন্তু বাংলার সত্যিকার বন্ধু পেয়েছি এই প্রথম একজনকে।
আইয়ুবের ষড়যন্ত্র তাঁর নিজের মধ্যে কেন্দ্রীভূত ছিল না। গোটা উর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক অফিসার তাঁর পশ্চাতে গড়ে তুলেছিল এই ষড়যন্ত্রের ইমারত। সে কারণেই গণ-আন্দোলনের লেলিহান শিখার মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি বাহ্যিক দিক থেকে যতই বড়গলা ক’রে গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করুন না কেন, তাঁর উদ্দেশ্য মহৎ ছিল না।
দশ বছরের ষড়যন্ত্রের একটি পর্যায়ের সিঁড়ি থেকে আর একটি সিঁড়িতে দেশকে ঠেলে দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। পূর্ব বাংলাকে একটি কলোনী হিসেবে ব্যবহার করবার বিরুদ্ধে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল, সেই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব বাংলা গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাক, আইয়ুব বা তদীয় সমর্থকগণ তা’ চিন্তাই করতে পারতেন না। যে শক্তির মোকাবিলা করতে তিনি নিজে ব্যর্থ হয়েছেন, সেই শক্তির সামনে দাঁড়াতে পারে এরূপ একটি বিকল্প ব্যবস্থাই ছিল তাঁর কাম্য। যখন সেই ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়ে গেল তখন তিনি সসম্মানে সরে দাঁড়ালেন। আর তাঁর জায়গায় এসে দাঁড়ালেন বিশ্ব-সভ্যতার ইতিহাসে এক বর্বরতম ব্যক্তিত্ব। এই ব্যক্তির তুলনা চলে একমাত্র নিরো, চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, হিটলার প্রভৃতির সাথে। ইয়াহিয়া খান একজন মূর্তিমান জল্লাদ।
বিগত দশ বছরে যেমন, যাবার প্রাক্কালেও তেমনি সাধু সাজবার চেষ্টা করেছেন আইয়ুব খান। দশ বছর শাসনকালে নিজের মহৎ কীর্তির কথা কত কাজে, বাচনে ও ভাষণে যে তিনি ঘোষণা করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। বিদায়ের বেলায়ও তিনি ঘোষণা করলেন যে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই তিনি সামরিক বাহিনীর প্রধান আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের হাতে দেশের শাসনভার অর্পণ ক’রে গেলেন। দেশ যেন পিতৃপিতামহ থেকে অর্জিত তাঁর নিজের সম্পদ-—তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ইচ্ছে করলেই তিনি হস্তান্তর করতে পারেন। জনগণের এখানে কোন বক্তব্যই নেই, কোন মূল্যও নেই। এ এক অভিনব রাজতন্ত্র। স্বৈরতন্ত্রের এক নির্লজ্জ নায়ক তিনি। তাঁর স্থলাভিষিক্ত যিনি হলেন তিনি অবশ্য চিন্তা, চেতনা ও কার্যকলাপের দিক থেকে আইয়ুবের চেয়েও জঘন্য। সে বর্ণনা যথাস্থানে সন্নিবেশ করবো।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭০

ক্ষমতার হাতবদলঃ ইয়াহিয়ার নিকট আইয়ুবের পত্র
বিদায়ের পূর্বে আইয়ুব তাঁর প্রিয় সেনাধ্যক্ষকে একটি পত্র লিখলেন। অথবা যে পথ ধরে তিনি এসেছিলেন সেই পথ ধরে ইয়াহিয়া খান এসে জোর ক’রে তাঁকে দিয়ে এই পত্র লিখিয়ে নিয়েছিলেন। যেদিক দিয়েই সত্য হোক, কথাটি একই দাঁড়ায়। বাঘ যেমন একবার মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে আর কিছুই আহার করতে চায় না, তেমনি সেনাবাহিনী যদি একবার দেশের শাসনভার পরিচালনার সুযোগ পায় তবে ছাউনিতে ফিরে যেতে তার মন চায় না। আইয়ুব বা ইয়াহিয়া আসলে এই শক্তিরই সৃষ্টি। দু’জন হাতের এপিঠ ওপিঠ মাত্র।
আইয়ুব যাবার পূর্বে তাঁর স্বভাবসুলভ দেশপ্রেমিকতার প্রমাণস্বরূপ ইয়াহিয়াকে চিঠি লিখে রাজত্বভার গ্রহণ করতে অনুরোধ জানালেন এবং বেতারভাষণ-এর মাধ্যমে দেশবাসীর নিকট নিজেকে সাধু বান্দা হিসেবে প্রচার করলেন।
ইয়াহিয়াকে তিনি লিখলেন (অথবা লিখতে বাধ্য হলেন):
“প্রেসিডেন্ট হাউস
২৪শে মার্চ, ১৯৬৯

প্রিয় জেনারেল ইয়াহিয়া,
অতীব দুঃখের সহিত আমাকে এই সিদ্ধান্তে আসিতে হইয়াছে যে,দেশের সমুদয় বেসামরিক প্রশাসন-ব্যবস্থা ও নিয়ম তান্ত্রিক কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ অচল হইয়া পড়িয়াছে। বর্তমান উদ্বেগজনক মাত্রায় অবস্থার যদি অবনতি ঘটিতে থাকে, তাহা হইলে দেশের অর্থনৈতিক জীবনধারা তথা সভ্য জীবনের অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্পূর্ণ অসম্ভব হইয়া পড়িবে।
এমতাবস্থায়, ক্ষমতার আসন হইতে নামিয়া যাওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর দেখিতেছি না। তাই আমি পাকিস্তানের দেশরক্ষা বাহিনীর হস্তে দেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব ন্যস্ত করিয়া যাওয়ার সাব্যস্ত করিয়াছি, কেননা, সামরিক বাহিনীই দেশের আজিকার একমাত্র কর্মক্ষম ও আইনানুগ যন্ত্র।
আল্লার মেহেরবানীতে আমাদের সেনাবাহিনী পরিস্থিতির মোকাবিলা করিয়া দেশকে চরম বিশৃঙ্খলা ও সর্বাত্মক ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭১

করিতে সক্ষম। কেবল তাহারাই দেশের বুকে শুভ বুদ্ধির উন্মেষ ঘটাইয়া বেসামরিক ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পুনরায় অগ্রগতির পথে আগাইয়া যাইতে সাহায্য করিতে পারেন।
কতিপয় লোক আমার নিকট প্রস্তাব করেন যে, যদি সমুদয় দাবী মানিয়া নেওয়া হয়, তাহা হইলে দেশে শান্তি ফিরিয়া আসিবে। আমি তাঁহাদের জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, কোন দেশে? এই সকল দাবী মানিয়া নেওয়া হইলে পাকিস্তান ধ্বংস হইয়া যাইত।
আমি সর্বদা আপনাকে বলিয়াছি যে, শক্তিশালী কেন্দ্রের মধ্যেই পাকিস্তানের মুক্তি নিহিত রহিয়াছে। আমি এই জন্য পার্লামেন্টারী শাসন-ব্যবস্থা মানিয়া লইয়াছিলাম যে, এই পদ্ধতিতে শক্তিশালী কেন্দ্র বজায় রাখার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এক্ষণে বলা হইতেছে যে, দেশ দুইটি অংশে বিভক্ত হইবে এবং কেন্দ্র ক্ষমতাহীন সংস্থায় পরিণত হইবে।
প্রতিরক্ষা বাহিনী পঙ্গু হইয়া উঠিবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক সত্তা বিলোপ করা হইবে। আমাদের দেশ ধ্বংস করিয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে পৌরহিত্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমার জীবনের বিরাট আশা বাস্তবায়িত হইতে পারিল না দেখিয়া আমি ব্যথিত। নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর অব্যাহত রাখার ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করাই ছিল আমার কামনা। … …
…দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। শ্রমিকদের উস্কানি দেওয়া হইতেছে এবং অরাজকতাপূর্ণ ও নিষ্ঠুর কাজ করার জন্য বলা হইতেছে। এদিকে হিংসাত্মক হুমকি প্রদর্শন করিয়া অধিক বেতন, মজুরী ও সুবিধার দাবী আদায় করা হইতেছে। উৎপাদন হ্রাস পাইতেছে এবং রফতানী গুরুতরভাবে কমিয়া যাইতেছে। শীঘ্রই দেশে গুরুতর মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে বলিয়া আমার আশংকা হয়।
যাঁহারা গণ-আন্দোলনের আড়ালে থাকিয়া গত কয়েক মাস যাবৎ দেশের মূলে আঘাতের পর আঘাত হানিয়াছেন, তাঁহাদের বেপরোয়া আচরণের দরুন এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। দুঃখের বিষয়, বহুসংখ্যক নিরীহ লোক তাহাদের দুরভিসন্ধির শিকারে পরিণত হয়।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭২

সকল অবস্থায় সাধ্যমত আমি জনসাধারণের খেদমত করিয়াছি। নিশ্চয়ই কিছু কিছু ভুল-ত্রুটি হইয়াছে, তবে সাফল্যও নেহায়েত কম নয়। আমি যাহা কিছু সম্পাদন করিয়াছি, এমনকি আমার পূর্বেকার সরকারসমূহ যাহা সম্পাদন করিয়াছেন, অনেকেই তাহা নিশ্চিহ্ন করিতে চাহে। তবে সবচাইতে মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ব্যাপার এই যে, কতিপয় ব্যক্তি এমনকি কায়েদে আযমের কীর্তি পাকিস্তান বিনষ্ট করিতে ইচ্ছুক।
বর্তমান সংকটের নিরসনের জন্য আমি সম্ভাব্য সর্বপ্রকার বেসামরিক ও শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করিয়াছি। জনগণের নেতা বলিয়া গণ্য সকলের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হওয়ার জন্য আমি প্রস্তাব দেই। তাঁহাদের মধ্যে অনেকে সম্প্রতি সম্মেলনে যোগদান করেন,তবে তাঁহাদের পূর্বশর্ত মানিয়া লওয়ার পরই তাঁহারা উহাতে যোগদান করেন। অনেকে সম্মেলনে যোগদান করিতে অসম্মত হন। কেন, উহা তাঁহারাই ভাল জানেন।
একটি সর্বসম্মত ফর্মুলা উদ্ভাবনের জন্য আমি তাঁহাদের অনু্রোধ জানাই। কিন্তু কয়েকদিনব্যাপী আলোচনার পরও তাঁহারা এই ব্যাপারে ব্যর্থ হন। অবশেষে তাঁহারা দুইটি প্রশ্নে একমত হন এবং আমিও উহার দুইটিই মানিয়া লই। প্রত্যক্ষ সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত হওয়ার পর জনপ্রতিনিধিদের নিকট অমীমাংসিত প্রশ্নসমূহ পেশ করার জন্য অতঃপর আমি প্রস্তাব দেই। আমার যুক্তি ছিল যে, সম্মেলনে যোগদানকারী প্রতিনিধিবর্গ জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত হন নাই বলিয়া যে সকল প্রশ্নে তাঁহারা একমত নন, সে সকল বিষয়সহ সমুদয় বেসামরিক ও শাসনতান্ত্রিক প্রশ্ন সম্পর্কে তাঁহারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে পারেন না।
দুইটি সর্বসম্মত প্রশ্ন বিবেচনার জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করার কথা আমি চিন্তা করি। কিন্তু শীঘ্রই সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, উহা নিরর্থক হইবে। পরিষদের সদস্যরা আর স্বাধীন প্রতিনিধি থাকিতেছেন না এবং দুইটি সর্বসম্মত প্রশ্ন গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাইতেছেনা। বস্ততঃ সদস্যদের প্রতি হুমকি দেওয়া হইতেছে এবং অধিবেশন বর্জন অথবা তাঁহাদের এমন সব সংশোধনী উত্থাপনের জন্য বাধ্য করা হইতেছে যাহার ফলে কেন্দ্রীয় সরকার বিলুপ্ত হইবে এবং সশস্ত্র
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭৩

বাহিনী বজায় রাখা অসম্ভব হইবে। দেশের অর্থনীতি বিভক্ত এবং পাকিস্তান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ছিন্নভিন্ন হইয়া যাইত। এই ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থায় পরিষদ আহ্বান করা হইলে পরিস্থিতি অধিকতর খারাপ হইয়া উঠিত। ক্রমাগত হিংসাত্মক কাজের হুমকির মধ্যে কাহারো পক্ষে কি মৌলিক সমস্যা সম্পর্কে শান্তভাবে আলোচনা করা সম্ভব?
বর্তমান জটিল পরিস্থিতির মোকাবিলা করা বেসামরিক সরকারের সাধ্যাতীত। কাজেই প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অবশ্যই অগ্রসর হইতে হইবে। শুধু বাহিরের আক্রমণই নয়, অভ্যন্তরীণ আক্রমণ হইতে দেশকে রক্ষা করাও আপনাদের আইনগত এবং শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব। দেশের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা রক্ষা এবং স্বাভাবিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক জীবন পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপনি এই দায়িত্ব পালন করিবেন বলিয়া জাতি আশা করে। ১২ কোটী মানুষের এই দুঃখের রাজ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরিয়া আসুক।
আমি বিশ্বাস করি যে, দেশের বিরাট সমস্যার মোকাবিলা করার মত সামর্থ্য, দেশপ্রেম, শিক্ষা ও কল্পনাশক্তি আপনার রহিয়াছে। আপনি এমন এক বাহিনীর নেতা যে-বাহিনী গোটা বিশ্বের সম্মান ও প্রশংসা অর্জন করিয়াছে। পাকিস্তান বিমানবাহিনী এবং পাকিস্তান নৌ-বাহিনীতে আপনার সহকর্মীরা সম্মানের অধিকারী এবং আমি জানি যে, আপনি সর্বদা তাঁহাদের পূর্ণ সমর্থন লাভ করিবেন। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে অবশ্যই পাকিস্তানকে ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা করিতে হইবে।
আপনি যদি প্রত্যেক সৈনিক, নাবিক ও বৈমানিককে জানান যে, এককালে তাঁহাদের সর্বাধিনায়ক হিসাবে থাকার জন্য আমি গর্ববোধ করি, তাহা হইলে আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকিব। তাঁহাদেরকে মনে রাখিতে হইবে যে, এই সংকটজনক মুহূর্তে তাঁহাদেরকে পাকিস্তানের রক্ষকের ভূমিকা গ্রহণ করিতে হইবে। ইসলামের নীতি অনুযায়ী তাঁহাদের আচরণ করিতে হইবে।
এত দীর্ঘকাল সাহসী পাকিস্তানবাসীর সেবা করা একটি বিরাট সম্মান। অকৃত্রিম আনুগত্যের জন্য আমি অবশ্যই আপনার প্রশংসা করিব। আমি জানি, দেশপ্রেম সর্বদা আপনার জীবনে উৎসাহের উৎস ছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭৪

আপনার সাফল্য এবং আমার দেশের জনগণের কল্যাণ ও সুখ-সমৃদ্ধির জন্য আমি প্রার্থনা করি। খোদা হাফেজ।
আপনার বিশ্বস্ত
স্বাঃ এম. এ. খান”
[ ইত্তেফাক, ২৬শে ও ২৭শে মার্চ, ১৯৬৯: দৈনিক পাকিস্তান, ২৭শে মার্চ পৃঃ ৩]

পরদিন অর্থাৎ ২৫শে মার্চ রাত ৮ টায় আইয়ুব খান জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেনঃ
“আমার প্রিয় দেশবাসী, আচ্ছালামু আলাইকুম।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টরূপে আপনাদের সামনে ইহাই আমার শেষ ভাষণ। দেশে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি সাধিত হইতেছে। প্রশাসনিক সংস্থাসমূহকে বিকল করা হইতেছে। জনতা আপন আপন ইচ্ছা মোতাবেক ঘেরাও শুরু করিয়াছে, এবং জবরদস্তির মাধ্যমে তাহাদের দাবী-দাওয়া আদায় করিতেছে। সত্য কথা বলার সাহস কাহারো নাই।
দেশের খেদমতে যাঁহারা আগাইয়া আসিয়াছেন, তাঁহাদের ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে জনতাকে অনুসরণে বাধ্য করা হইতেছে। এই উম্মত্ততাকে রোধ করিবার মত কেহই তাঁহাদের মধ্যে নাই। দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করা হইয়াছে। কলকারখানা বন্ধ হইয়া যাইতেছে, এবং উৎপাদনের পরিমাণ প্রতিদিন হ্রাস পাইতেছে।
এই মুহূর্তে যে সব অনুভূতি আমাকে আল্পুত করিতেছে, তাহা আপনারা ভালভাবেই উপলদ্ধি করিতে পারেন। আমাদের রক্ত ও মেহনতে যে দেশকে আমরা পরিচর্যা করিতেছি, মাত্র কয়েক মাসেই তাহাকে দুঃখজনক আবর্তে টানিয়া আনা হইয়াছে।
আমি একবার আপনাদের বলিয়াছিলাম যে, বুদ্ধির আলোকেই জাতীয় সমস্যাবলী মীমাংসা করিতে হইবে, ভাবপ্রবণতার উদ্দীপনায় নয়। আপনারা দেখিয়াছেন যে, ভাবপ্রবণতার আগুন একবার প্রজ্জ্বলিত করিলে প্রতিটি ব্যক্তিই অসহায় হইয়া পড়েন।
আমি আমার সর্বোত্তম সামর্থ্য দ্বারা আপনাদের খেদমতের চেষ্টা করিয়াছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, পাকিস্তানের জনসাধারণ শাশ্বত ঈমানের আশীর্বাদপুষ্ট এবং প্রতিটি অসুবিধা মোকাবিলার শক্তি
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭৫

তাহাদের আছে। আমাদের জনসাধারণের একমাত্র প্রয়োজন ধৈর্য, শৃঙ্খলা এবং ঐক্য।
বিগত ২১শে ফেব্রুয়ারীতে আমি ঘোষণা করিয়াছিলাম যে, আমি পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিব না। আমি আশা করিয়াছিলাম যে, আমার উক্ত ঘোষণার পর জনসাধারণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পুনঃ প্রতিষ্ঠা করিবে। এবং প্রশান্ত মনোভাব লইয়া দেশের রাজনৈতিক সমস্যাবলীর উপযুক্ত সমাধান বাহির করার চেষ্টা করবে। আমি আশা করিয়াছিলাম যে, ব্যক্তিগত ঘৃণার ভাব তিরোহিত হইবে এবং আমরা সকলে পুনরায় দেশের অগ্রগতির জন্য আত্মনিয়োগে সমর্থ হইব।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ পরিস্থিতি খারাপ হইতে আরো খারাপের দিকে যাইতেছে। আপনারা গোলটেবিল বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে অবহিত আছেন। কয়েক সপ্তাহের আলাপ-আলোচনার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ শুধু দুইটি দাবী সম্পর্কে ঐক্যমতে পৌঁছাইতে সমর্থ হন এবং আমি উভয় মানিয়া লই। আমি প্রস্তাব করি, যে-সব প্রশ্নে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় নাই, সেগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক। কিন্তু এই প্রস্তাব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিকট গ্রহণযোগ্য হয় নাই। এমন কি জনসাধারণের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হওয়ার অপেক্ষা না করিয়াই তাঁহাদের প্রত্যেকে অবিলম্বে তাঁহাদের দাবী মানিয়া লইবার জন্য জেদ ধরেন।
কেউ কেউ আমাকে পরামর্শ দেন যে, সকল দাবী মানিয়া লইলে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হইবে। আমি তাহাদের প্রশ্ন করিঃ কোন দেশে? কারণ এই সকল দাবী গ্রহণের মধ্যে পাকিস্তান ধ্বংস হইয়া যাওয়ার আশংকা রহিয়াছে।
আমি বরাবরই বলিয়া আসিতেছি যে, শক্তিশালী কেন্দ্রের মধ্যেই পাকিস্তানের মুক্তি নিহিত। আমি পার্লামেন্টারী ব্যবস্থা মানিয়া লইয়াছিলাম। কারণ এই ব্যবস্থাতেও শক্তিশালী কেন্দ্র সংরক্ষণের সম্ভাবনা ছিল।
কিন্তু এখন বলা হইতেছে যে, দেশকে দুইভাগে ভাগ করা হউক। কেন্দ্রকে কর্মক্ষমতাহীন ও শক্তিহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হউক।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭৬

দেশরক্ষা বাহিনীকে পঙ্গু করিয়া রাখা হউক এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক সত্তা বিলোপ করিয়া দেওয়া হউক।
প্রেসিডেন্টরূপে দেশের ধ্বংস প্রত্যক্ষ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি মর্মাহত হই যে, আমার জীবনের একটা বড় সাধ পূরণ হইল না। নিয়মতান্ত্রিক পথে রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল।
বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা সম্ভব নয়। এমনকি কিছু সংখ্যক সদস্য পরিষদ অধিবেশনে যোগদানে সাহসী হইবেন না। যাহারা যোগদান করিবেন তাঁহারাও ভয়ে সত্যিকার মতামত প্রকাশে সমর্থ হইবেন না। জাতীয় পরিষদ কক্ষ রক্তাক্ত সংঘর্ষ-ক্ষেত্রে পরিণত হওয়ারও আশংকা রহিয়াছে।
দেশের অখণ্ডতার প্রশ্ন সব কিছুরই উর্ধ্বে। মৌলিক শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নসমূহের সমাধান একমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই সম্ভব। কারণ শান্ত পরিবেশেই গণ-প্রতিনিধিরা ধীরেসুস্থে এসব প্রশ্ন বিবেচনা করিতে পারেন। বর্তমানে দেশে সেরূপ পরিস্থিতি বিদ্যমান নেই। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হইলেই কেহ না কেহ অশান্তির আগুন জ্বালাইয়া দেয়। ইহা অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার যে, গত দশ বছরে বা তার আগে অর্জিত সবকিছু ধ্বংস করিয়া দেওয়ার জন্য জনগণ মাতিয়া উঠিয়াছে। এমনও লোক রহিয়াছে, যাহারা কায়েদে আযম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই দেশকে ধ্বংস করিয়া দিতে চায়। এ কথা বলিতে আমার দুঃখ হয় যে, পরিস্থিতি আর সরকারের আয়ত্তে নাই। সমস্ত সরকারী প্রতিষ্ঠান এখন ভীতি, চাপ ও শক্তিপ্রয়োগের শিকারে পরিণত হইয়াছে। সকল ন্যায়নীতি, সংযম এবং সভ্য মানুষ হিসাবে জীবনযাপনের আদর্শে জলাঞ্জলি দেওয়া হইয়াছে। দেশের প্রতিটি সমস্যার সমাধান করা হইতেছে জনপথে। সামরিক বাহিনী ছাড়া পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য আর কোন শাসনতান্ত্রিক কিংবা ফলোপধায়ক ব্যবস্থা নাই।
সমগ্র জাতি দাবী করিতেছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রধান তাঁর শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করুন। পাকিস্তান বিমান এবং নৌ-বাহিনী তাঁহার সহিত রহিয়াছে এবং তাঁহাদের শৌর্যবীর্যের প্রতি, মানুষের কল্যাণের প্রতি
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭৭

নজর রাখিতে হইবে এবং তাঁহাদের প্রতিটি কার্যক্রম ইসলামের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত। দেশের নিরাপত্তার খাতিরে সামরিক বাহিনীর কর্তব্যে কোন প্রকার বাধা সৃষ্টি করা যাইবে না এবং তাঁহাদের আইনানুগ দায়িত্ব সম্পাদন করিতে দিতে হইবে। আমি এই অবস্থার প্রেক্ষিতেই প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার ত্যাগ করার সিন্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছি।
আপনাদের মনোভাব সম্পর্কে আমি অবহিত আছি। সর্বশক্তিমানের উপর ভরসা রাখুন এবং আশা ছাড়িবেন না। আপনারা আমাকে দশটি বছর প্রেসিডেন্টের পদে অধিষ্ঠিত থাকার সম্মান দিয়াছেন এবং ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে সকল কাজে অংশীদার হইয়াছেন। এ জন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি সরকারী কর্মচারীদেরও ধন্যবাদ দিতেছি। সঙ্কট মুহূর্তে তাঁহারা প্রতিটি ক্ষেত্রে সাহস ও নিঃস্বার্থপরতার পরিচয় দিয়াছেন।
আমার কোন কোন সহকর্মীরও তীব্র এবং অহেতুক সমালোচনা করা হইয়াছে। কিন্তু এ সবের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করিয়া তাঁহারা উৎসর্গীকৃত মনোভাব লইয়া দিবারাত্র জাতির কল্যাণের জন্য কাজ করিয়া গিয়াছেন। আল্লাহ তাঁহাদের পুরস্কৃত করিবেন।
আমার প্রিয় দেশবাসী, আমি বিদায়কালে আপনাদের কাছে অনুরোধ জানাই, যেন আপনার সম্ভাব্য প্রতিটি ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীতে আপনাদের ভাইদের আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার সহযোগিতা করেন। প্রতিটি সৈনিক আপনাদের ভাই। দেশপ্রেমে তাঁহাদের অন্তর সিক্ত, ইসলামের আলোকে তাঁহারা বুদ্ধিদীপ্ত। দেশে দ্রুত এবং পূর্ণ শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য আমি আল্লার কাছে প্রার্থনা করি যাতে আমরা গণতন্ত্রের পথ ধরে উন্নতি এবং অগ্রগতির যাত্রা অব্যাহত রাখিতে পারি। আমিন।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৬শে মার্চ, ১৯৬৯]

আবার সামরিক শাসন জারী
এর পর ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ রাত্রি সোয়া ন’টার পর থেকে সারা পাকিস্তানে দ্বিতীয় সামরিক শাসন জারী করা হ’ল। প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান পাকিস্তান বেতারে উক্ত অনির্ধারিত বক্তৃতায় তন্মুহূর্ত থেকে স্বীয় ক্ষমতা ত্যাগের কথা ঘোষণা ক’রে জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের হস্তে দেশের শাসনভার অর্পণ করেন। প্রধান সামরিক
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭৮

শাসন পরিচালক জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তান সময় রাত্রি সোয়া ন’টায় পাকিস্তান বেতার থেকে সামরিক শাসন সংক্রান্ত নির্দেশনামা পাঠ প্রসঙ্গে শাসনতন্ত্র বাতিল, পরিষদসমূহ বিলুপ্ত এবং প্রেসিডেন্ট, গভর্নর ও মন্ত্রী পদে সমাসীন ব্যক্তিবর্গ আর স্ব স্ব পদে বহাল থাকবে না বলে ঘোষণা করেন।
ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান বেতারে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে সামরিক শাসন প্রবর্তনের পটভূমি এবং এর লক্ষ্য বিশ্লেষণ করেন। সামরিক শাসন-ব্যবস্থা জনগণের মোটেই কাম্য নয়, জেনারেল ইয়াহিয়া একথা ভালভাবেই জানতেন—তাঁর ভাষণেও সে ইংগিত ছিল। ১৯৫৮ সালে সারা দেশে যে সামরিক শাসন চালু করা হয়েছিল তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল কিছুটা ভিন্নতর। দীর্ঘকাল এই সামরিক শাসন চালু থাকার পর পুনরায় সামরিক শাসনের প্রবর্তন জনমনে বিক্ষোভের ও হতাশার সৃষ্টি করেছিল। গণতন্ত্রকে হত্যা করার জন্যই যে সামরিক শাসনব্যবস্থা, একথা আর কারো অবিদিত রইল না। অস্ত্রের বলে ক্ষমতায় এলেও ইয়াহিয়া বুঝতে পারলেন যে, গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুবের পতন হয়েছে এবং এই গণ-অভ্যুত্থানকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলে তাঁকেও আইয়ুবের ভাগ্য বরণ করতে হবে। সে কারণেই ক্ষমতায় এসে তিনিও জনগণকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেবেন বলে ওয়াদা করলেন, ওয়াদা করতে বাধ্য হলেন। তিনি জনগণের সামনে সামরিক শাসনের বিধিবিধান তুলে ধরলেন।
এই বিধিবিধানগুলোর প্রধান কয়েকটি হ’লঃ
* সামরিক আইনবিধি বা নির্দেশাবলী লঙ্ঘনকারী ব্যক্তি বিধিসমূহে বর্ণিত ব্যবস্থাদি অনুযায়ী দণ্ডিত হইবে।
* সাধারণ আইন লঙ্ঘনজনিত অপরাধের জন্য বিশেষ শাস্তির বিধান করা যাইতে পারে।
* সাধারণ আদালতসমূহকে যে কোন সামরিক আইনবিধি বা নির্দেশ লঙ্ঘনজনিত অপরাধ বিচারের ও শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা প্রদত্ত হইতে পারে।
* এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন অপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে সাধারণ আদালতসমূহের এখতিয়ার খর্ব করা যাইতে পারে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭৯

* শাসনতন্ত্র বাতিলের অব্যবহিত পূর্বে বিদ্যমান সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনাল শাসনতন্ত্র বাতিলের পূর্ববর্তীকালের উহাদের সকল ক্ষমতা ও এখতিয়ার প্রয়োগ করা যাইবে। (১) কোন আদালতই কোন সামরিক আইনবিধি বা নির্দেশ বা কোন সামরিক আদালতের কোন রায় বা নির্দেশ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলিতে পারিবে না। (২) প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের বিরুদ্ধে বা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা বা এখতিয়ার ভোগকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন প্রকার রীট বা নির্দেশ জারী করা যাইবে না।
* কোন লোক কথায় কিংবা লেখায় অথবা প্রকাশ্য হাবভাবে অথবা অন্য কোন ভাবে সামরিক আইন বলবৎ অথবা ইহার কার্যক্রম সম্পর্কে সমালোচনা করিলে অথবা প্রধান সামরিক প্রশাসক কিংবা যে কোন সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ঘৃণা অথবা অসন্তোষ সৃষ্টি করিলে অথবা সৃষ্টির চেষ্টা করিলে অথবা ইহাদের বিরুদ্ধে উত্তেজনা সৃষ্টি অথবা সৃষ্টির চেষ্টা করা হইলে তাহাকে সর্বোচ্চ ১০ বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া যাইবে।
শাস্তির বিধি-বিধানসমূহও উল্লেখযোগ্যঃ
*(১) মৃত্যু।
(২) অনধিক ১৪ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড।
(৩) অনধিক ৩০টি বেত্রাঘাত।
* সম্পত্তির আংশিক বা সম্পূর্ণ বাজেয়াপ্ত হইতে পারে, আবার কোন সম্পত্তি আংশিক কিংবা সম্পূর্ণ ধ্বংস করাও যাইতে পারে। কোন দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত কিংবা ধ্বংস করার নির্দেশ দেওয়া হইলে উহা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট যে কোন সম্পত্তির উপর কার্যকরী হইবে।
* ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী হইবে।
* ধর্মঘট, তালাবন্ধ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জনহিতকর কার্যালয় এবং শিল্প সংস্থাসমূহে উত্তেজনা সৃষ্টিমূলক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা হইতেছে। ধর্মঘট অথবা ধর্মঘটের জন্য সাহায্য করিলে অথবা ধর্মঘটের জন্য প্রচারণা চালাইলে শাস্তি প্রদান করা হইবে। সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮০

* স্থানীয় সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষের পূর্ব অনুমতি ভিন্ন কেহ কোন সভা বা শোভাযাত্রার আয়োজন বা অনুষ্ঠান করিতে পারিবে না। লিখিতভাবে এই অনুমতি গ্রহণ করিতে হইবে। সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত সভা ও শোভাযাত্রা ভিন্ন কোন সভা ও শোভাযাত্রায় কোন ব্যক্তি অংশ গ্রহণ করিতে পারিবে না। সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড।
* সামরিক শাসনের প্রতি অনানুগত্য দণ্ডযোগ্য, অনুরূপ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বৎসর কারাদণ্ড।
[ প্রেস বিজ্ঞতি, রাওয়ালপিণ্ডি, ২৭শে মার্চ, ১৯৬৯]

ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ
সামরিক শাসন বিধিগুলোতে শক্তির একটি সদম্ভ হুমকি আছে। জনগণের শক্তিকে সর্বপ্রকারে খর্ব ক’রে স্বৈরাচারী শক্তিকে অক্ষত রাখবার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তথাপি জাগ্রত গণচেতনাকে যে কোন আইন প্রয়োগ ক’রে বা বেয়োনেটের সাহায্যে পদদলিত করা যায় না, পৃথিবীর সকল স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়কের ন্যায় ইয়াহিয়া খানও সেকথা জানতেন। আর জানতেন বলেই তাঁর প্রথম বেতার ভাষণে তিনি দেশের জনগণকে জানিয়েছিলেন যে, তিনি নিজের স্বার্থের জন্য ক্ষমতায় আসেন নি, ক্ষমতায় থাকবার কোন লোভও তাঁর নেই, আর তাই নিয়মতান্ত্রিক একটি সরকারকে প্রতিষ্ঠা করেই তিনি চলে যাবেন। চলে যাবেন ছাউনিতে ফিরে। বেতার ভাষণে তিনি বলেনঃ
“অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় আমি আপনাদিগকে জানাইয়া দিতে চাই যে দেশে একটি নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কোন অভিলাষ আমার নাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সুষ্ঠু, গলদমুক্ত ও সততাপরায়ণ প্রশাসন ব্যবস্থাই সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন গঠনমূলক রাজনৈতিক জীবনধারার একটি অনিবার্য পূর্বশর্ত।”
তিনি আরো বলেন, “প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত এইসব জনপ্রতিনিধিদের কাজই হইবে দেশকে একটি সচল শাসনতন্ত্র প্রদান করা। এবং যে সব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সমস্যা প্রতিনিয়ত গণমনকে বিব্রত করিতেছে, তাহার একটি সমাধান নির্দেশ করা।”
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮১

মেহনতী মানুষের সুখ-দুঃখের প্রতি নজর তাঁর নাকি ছিল সজাগ। সে সম্পর্কে তিনি ঘোষণা করেনঃ
“ছাত্র, শ্রমিক ও কৃষক সম্প্রদায়সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সত্যিকার অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ সচেতন আছি। এ প্রসঙ্গে আমি আপনাদিগকে এই আশ্বাসই দিতে চাই যে, আমার সরকার তাহাদের অভাব-অভিযোগের প্রতিকারের জন্য কোন চেষ্টারই ত্রুটি করিবেন না।”
“………পরিস্থিতির এমন অবনতি ঘটে যে, স্বাভাবিক আইন প্রয়োগ পদ্ধতিসমূহ সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ও অচল হইয়া পড়ে। দেশে জানমালের গুরুতর ক্ষতি হয় এবং একটি ত্রাসের ভাব জাতীয় জীবন বিপর্যস্ত করিয়া ফেলে। উৎপাদন বিপজ্জনকভাবে নিম্নতর পর্যায়ে হ্রাস পাইয়াছে এবং অর্থনীতিকে সাধারণভাবে একটি নজরহীন ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হইতে হইয়াছে। ধর্মঘট আর হিংসাত্মক কার্যকলাপ দৈনন্দিন বিষয়ে পরিণত হইয়াছে, এবং দেশকে একটি অতল-গহ্বর ধ্বংসের প্রান্তে লইয়া যাওয়া হইয়াছে। দেশকে তাই নিরাপদ ও স্বাভাবিক পরিবেশের মধ্যে ফিরাইয়া আনা জরুরী কর্তব্যরূপে দেখা দেয়। সশস্ত্র বাহিনী এইরূপ একটি নৈরাজ্যপ্রায় অবস্থায় নীরব দর্শক হইয়া থাকিতে পারে নাই। এই জন্যই তাহাদেরকে দেশকে চরম বিপর্যয়ের কবল হইতে রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করিতে হয়। এই জন্যই আমি উপরোক্ত কর্মপন্থা গ্রহণ করিয়াছি।
জনসাধারণের জানমাল আর স্বাধীনতার নিরাপত্তা বিধান এবং প্রশাসনযন্ত্রকে পূর্বাবস্থায় পুনঃ প্রতিষ্ঠাই আমার সামরিক আইন জারী করার মুখ্য উদ্দেশ্য। অতএব, প্রধান সামরিক-শাসন প্রশাসক হিসাবে আমার প্রথম ও প্রধানতম কর্তব্য হইতেছে, সুস্থ বিবেকবোধ পুনঃ প্রতিষ্ঠা এবং প্রশাসনযন্ত্র যাহাতে জনগণের সন্তোষ অনুযায়ী স্বাভাবিক কাজকর্ম পুনরারম্ভ করিতে পারে উহার নিশ্চয়তা বিধান। আমাদের প্রশাসনযন্ত্রে যথেষ্ট শৈথিল্য ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়াছে। কিন্তু আমি দেখিতে চাই যে কোন প্রকারে যে কোন পদ্ধতিতেই যেন ইহার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। প্রশাসনযন্ত্রের প্রত্যেকেই এই হুঁশিয়ারি গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করুক।”
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮২

অবশেষে দেশবাসীকে উদ্দেশ ক’রে তিনি বলেনঃ
“আমি আপনাদেরকে সম্পূর্ণ স্পষ্টতার সংগে জানাইতে চাই যে, একটি নিয়মতান্ত্রিক সরকার কায়েমের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি ব্যতীত আমার আর কোনই অভিলাষ নাই। আমার দৃঢ়বিশ্বাস এই যে, দেশে একটি সুস্থ ও গঠনমুখী রাজনৈতিক জীবনধারা প্রতিষ্ঠা এবং ভোটাধিকারের ভিত্তিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট নির্বিঘ্নে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রথমে একটি সুষ্ঠ, স্বচ্ছ ও সৎ প্রশাসনযন্ত্র আবশ্যক। অতঃপর দেশবাসীকে একটি কর্মোপযোগী শাসনতন্ত্র প্রদান এবং জনসাধারণের অন্তরে বিক্ষোভ সৃষ্টিকারী যাবতীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যার সমাধান বাহির করা এই সমস্ত জনপ্রতিনিধিরই কর্তব্য হইবে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৭শে মার্চ, ১৯৬৯]

ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ইয়াহিয়া খান অতি সতর্কতার সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। বিশেষ ক’রে পূর্ব বাংলার প্রতি তিনি সজাগ দৃষ্টি রাখলেন। আইয়ুবের পতনের দৃশ্যই তাঁকে এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে বাধ্য করেছিল।
সামরিক শাসনকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জনগণকে সামরিক বিধি লঙ্ঘনের শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক প্রদান করা ছাড়াও শাসনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ রাখার উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলা সামরিক শাসন এলাকাকে চারিটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। ২৮শে মার্চ, ১৯৬৯ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, বিভক্ত অঞ্চলগুলো হবেঃ অঞ্চল-‘ক’ : ঢাকা বেসামরিক বিভাগ, সদর-দফতর ঢাকায় অবস্থিত থাকবে। অঞ্চল-‘খ’ : খুলনা বেসামরিক বিভাগ, সদর-দফতর যশোরে অবস্থিত থাকবে। অঞ্চল-‘গ’ : রাজশাহী বেসামরিক বিভাগ, সদর-দফতর রাজশাহীতে অবস্থিত থাকবে। অঞ্চল –‘ঘ’ : চট্টগ্রাম বেসামরিক বিভাগ, সদর-দফতর কুমিল্লায় অবস্থিত থাকবে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর সমগ্র পাকিস্তানকে দুটো সামরিক প্রশাসন অঞ্চলে বিভক্ত ক’রে পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘ক’ অঞ্চল এবং পূর্ব পাকিস্তানকে ‘খ’ অঞ্চল রূপে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮৩

২৭শে মার্চ তারিখে ঢাকায় এক ঘোষণায় রাও ফরমান আলী-কে পূর্ব পাকিস্তান সামরিক শাসন এলাকার (‘খ’ অঞ্চল) সহকারী সামরিক শাসন পরিচালক নিযুক্তির কথা বলা হয়।
এ সময় একটি বিদেশী সংবাদপত্রে পরিবেশিত সংবাদের বদৌলতে এই মর্মে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, শেখ মুজিব ও ভাসানীকে গ্রেফতার করা হবে। ৪ঠা এপ্রিল এক প্রেস-বিজ্ঞপ্তিতে সরকার এ বিষয়ে আশ্বস্ত ক’রে জানান যে, এটা একটা গুজব ছাড়া আর কিছুই নয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা ভাসানী তাঁদের স্ব স্ব গৃহে অবস্থান করছেন।

ইয়াহিয়ার নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা
এরপরে ইয়াহিয়া খান দেশের একচ্ছত্র কর্ণধার হিসেবে অধিষ্ঠিত রাখার জন্য নিজেকে প্রেসিডেন্টরূপে ঘোষণা করলেন। ১৯৬৯ সালের ৩১ শে মার্চ তিনি দেশবাসীকে এক ঘোষণায় জানালেনঃ
“যেহেতু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান এন. পি-কে. এইচ.জে. ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ রাত্রি ৯টা ১৫ মিনিটের সময় তাঁহার প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার ত্যাগ করিয়াছেন এবং প্রধান সামরিক আইন পরিচালক ও পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসাবে আমি জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান এইচ. পি-কে. জে’র নিকট সকল ক্ষমতা হস্তান্তর করিয়াছেন, সেহেতু, আমি ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চের উক্ত রাত্রে সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার এবং উল্লিখিত ক্ষমতাসমূহ ও এইভাবে অন্যান্য যে সকল ক্ষমতা আমার উপর ন্যস্ত হইয়াছে, তাহা প্রয়োগের দায়িত্বভার গ্রহণ করিয়াছি।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১লা এপ্রিল, ১৯৬৯]

সাধু প্রস্তাব! আমরা দেশবাসী নিরপেক্ষ দর্শকের ভূমিকা পালন ক’রে আমাদের ভাগ্যের শেষ পরিণতিটুকু দেখার জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকবো, আর যাই হোক পূর্ব বাংলার অবস্থা তেমন ছিল না। ইয়াহিয়ার নতুন দাবার চাল সম্বন্ধে আমরা অত্যন্ত সতর্ক ছিলাম। পূর্বেই বলেছি, ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন-এর উদ্দেশ্য একই হলেও পরিবেশ ছিল ভিন্নতর। সেকারণেই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে তাঁকে বিরত থাকতে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮৪

হয়েছে। রাজনৈতিক কার্যকলাপকে সম্পূর্ণ স্তব্ধ ক’রে দেবার দুঃসাহস তাঁর হয় নি। সমাজ-বিরোধী কার্যকলাপ যেমন-লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, খুনখারাবী এগুলো অবশ্য ইয়াহিয়া সরকার কঠোর হস্তে দমন করতে অগ্রসর হয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের বিপুল জনপ্রিয়তা পূর্ব বাংলার অন্য দলগুলোকে ঈর্ষান্বিত ক’রে তুলেছিল। স্বাভাবিকভাবেই এই সব দল ইয়াহিয়ার আগমনে আনন্দিত হয়েছিল। নতুন প্রভুর আমলে নতুন ষড়যন্ত্রের সুযোগ এলো-নতুন পথে এবার শেখ মুজিব ও তাঁর দলকে ঘায়েল করবার চেষ্টা শুরু হ’ল। কিন্তু জনগণের সত্যিকার নেতা শেখ মুজিব এ সব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না- প্রয়োজনও ছিল না। ইয়াহিয়াকে নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তার খুব কিছু ছিল না। কেননা, আইয়ুব অথবা ইয়াহিয়া যিনিই ক্ষমতায় থাকুন বা আসুন না কেন, সারা পাকিস্তানে শেখ মুজিবকে অস্বীকার ক’রে কারোরই কিছু করবার নেই। দেশের জনগণ তাঁর পশ্চাতে এমন অটল শক্তিতে দণ্ডায়মান যে, দেশ সম্পর্কে যাবতীয় সিদ্ধান্ত তাঁকে বাদ দিয়ে কারো পক্ষেই নেবার অধিকার ছিল না। ইয়াহিয়ার হাতে অস্ত্রের শক্তি থাকতে পারে, কিন্তু গণশক্তি শেখ মুজিবের হাতে। অস্ত্রের শক্তি গণশক্তির কাছে মাথা নত করে। ইহা ইতিহাসের বিধান।
শেখ মুজিব কিছুদিন সংযতবাক সময় যাপন করলেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে এই খেলা নতুন খেলা নয়। অতীতেও যখনই জনগণের হাতে ক্ষমতা দেবার প্রশ্ন এসেছে, একই রকমের ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে।
সুতরাং পাকিস্তানের অতীত রাজনীতির ইতিহাস-সচেতন এই রাজনীতিবিদ এবারেও মিতভাষীর ভূমিকায় থেকে ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।
ইয়াহিয়ার ক্ষমতায় আগমন সম্পর্কে সে সময় ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক জনাব তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) মোসাফির ছদ্মনামে যে অভিমত ব্যক্ত করেন নানা কারণে তা’ বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। এখানে তা’ স্মরণ করিঃ
“সাধারণভাবে সামরিক শাসন-ব্যবস্থা কাহারো কাম্য নয়। জেনারেল ইয়াহিয়ার বক্তৃতাতেও তাহা প্রকাশ পাইয়াছে। বিশেষতঃ ১৯৫৮ সালে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮৫

প্রবর্তিত সামরিক শাসন দীর্ঘকাল চলিবার পরে দেশে পুনরায় সামরিক শাসন প্রবর্তন করিতে হইবে, ইহা কেহই ধারণা করে নাই। কিন্তু এবারকার সামরিক শাসন প্রবর্তনের পটভূমি ভিন্ন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের দশ বছর স্থায়ী স্বৈরাচারী শাসন-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণ এতই বিক্ষুব্ধ ও মারমুখী হইয়া উঠিয়াছিল যে তিনি আগামী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হইবেন না, গত ২১শে ফেব্রুয়ারী এই মর্মে সিদ্ধান্ত ঘোষণা এবং পরবর্তী গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠান করিয়াও তাঁহার সরকারের প্রতি কোন অঞ্চলের জনগণেরই আস্থা পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নাই।
……দেশের আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষকরা হঠাত নিষ্ক্রিয় হইয়া পড়িলেন, যার ফলে এক শ্রেণীর সমাজ-বিরোধী লোক মাথাচাড়া দিয়া উঠিল এবং এখানে ওখানে অবাঞ্ছিত হিংসাত্মক কার্যে লিপ্ত হইল। শেষমেষ উপায়ন্তর না দেখিয়াই বিগত ২৫শে মার্চ ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট পদ হইতে সরিয়া দাঁড়াইয়া সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়াকে দেশ শাসনের ভার গ্রহণের জন্য এক পত্র লিখিলেন। এ অবস্থায় জেনারেল ইয়াহিয়া তথা দেশরক্ষা বাহিনীর পক্ষে ভিন্ন কিছু করার ছিল না। তবে দেশকে নিয়মতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থায় ফিরাইয়া নিবার উপর জেনারেল ইয়াহিয়া ও দেশরক্ষা বাহিনীর কৃতিত্ব নির্ভর করিবে। অপরপক্ষে সত্যের খাতিরে স্বীকার করিতে হইবে যে, সাম্প্রতিক গণ-আন্দোলনের সুযোগে সমাজ-বিরোধী এক অশুভ চক্র মাথাচাড়া দিয়া উঠিয়া সাধারণ নাগরিকের জীবন বিপন্ন করিয়া তুলিয়াছিল। দেশের সচেতন ছাত্র-সমাজ এবং রাজনীতিকদের অনেকে এই দুষ্কর্মের তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছেন। বিভিন্ন স্থানে শান্তি-কমিটি স্থাপনপূর্বক আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার আন্তরিক চেষ্টাও তাঁরা করিয়াছেন। উত্তেজনা ও উস্কানির মূলে নিজেদের উপর ঝুঁকি লইয়াও আমরা সংশ্লিষ্ট মহলকে বারে বারে শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখার এবং দুষ্কতিকারীদের নিবৃত্ত করার আহ্বান জানাইয়া আসিয়াছি। কিন্তু সকল সুস্থ মহলের আবেদন সত্ত্বেও এক শ্রেণীর লোক অন্যায় আবদার লইয়া ইদানীং যে সব কার্যকলাপে লিপ্ত হইয়াছিল এবং রাজনীতির আবরণে একদল উগ্রপন্থী তাদেরকে যেভাবে উস্কানী দিতেছিল তাহা আমরা সমর্থন করিতে পারি নাই।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮৬

যারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, এই সকল অগণতান্ত্রিক ও প্ররোচনামূলক আবোল-তাবোল কথাবার্তা শ্রবণ করিয়া লজ্জায় তাঁদের মাথা হেঁট হইয়া পড়িয়াছে। এই কার্যকলাপের দরুন দেশের অর্থনীতিরও প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শাসন-ব্যবস্থাও রহস্যজনকভাবে অকস্মাৎ নিষ্ক্রিয় হইয়া পড়ে। আমাদের দেশ অভাবের দেশ। স্বভাবতঃই আমাদের গণজীবনও সমস্যা জর্জরিত, ইহা সকল মহলই স্বীকার করিবেন। বিশেষতঃ শ্রমিক, কৃষক এবং বেকারদের সমস্যা আজ অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করিয়াছে। খাদ্যদব্য এবং নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বমূল্য ইহার অন্যতম কারণ।
বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে দেশের দরিদ্র, শ্রমিক, কৃষক, ও নিম্নবেতনভুক কর্মচারীদের ন্যায্য দাবী-দাওয়ার প্রতি প্রত্যেকটি মানুষের সহানুভূতি রহিয়াছে, কিন্তু বর্তমান গণ-আন্দোলনের সুযোগে কর্মজীবনের সর্বস্তরের মানুষও যায় হাজার দু’হাজারীরাও যেভাবে প্রচলিত নিয়ম-কানুন, রীতি-নীতি লঙ্ঘন করিয়া ‘জ্বালাও’ ‘ঘেরাও’ অভিযানের পথ বাছিয়া লইয়াছিলেন, তাহাতে সত্যিকারের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের ন্যায্য দাবী-দাওয়া আদায়ের সম্ভাবনা সম্পর্কেও আমরা হতাশ হইয়া পড়িয়াছিলাম এবং ইহাদের আচরণে ব্যথিত বোধ করিতেছিলাম। বিশেষতঃ ক্ষমতাসীনরা যখন হাল ছাড়িয়া দিয়া বসিয়া ছিলেন সেই মুহূর্তে সর্ব শ্রেণীর লোকের দাবী-দাওয়া লইয়া রাস্তায় নামিবার যৌক্তিকতা আমরা অনুধাবন করিতে পারি নাই। পক্ষান্তরে ক্ষেত্রবিশেষে ইহাকে আমরা প্ররোচনামূলক বলিয়া মনে করিয়াছি। সমগ্র পরিস্থিতি আমাদিগকে রীতিমত উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিয়াছিল। অবশ্য আমাদের মনোভাব দেশবাসীর সম্মুখে সময়মত তুলিয়া ধরিতে দ্বিধা করি নাই। আমরা আগেও বলিয়াছি, এখনও বলিব- দেশের দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিক, কৃষক ও নিম্ন-বেতনভুক কর্মচারীদের ন্যায্য দাবী-দাওয়াসমূহ পূরণ করিয়া তাদের অর্থনৈতিক দুর্গতি লাঘবের আশু ব্যবস্থা হওয়া প্রয়োজন, এবং সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষের নিকট আমাদের এই মুহূর্তের আবেদনও তাহাই। প্রধান সামরিক শাসন পরিচালক জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাঁর বেতার ভাষণে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকদের সমস্যার উল্লেখ করিয়া উহা সমাধানে যত্নবান হওয়ার যে প্রতিশ্রুতি
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮৭

দিয়াছেন, আশা করি প্রথম সুযোগেই উহা যথাসম্ভব পূর্ণ করিয়া দেশের অভাবী মানুষের দুর্দশা লাঘবের পথ তিনি প্রশস্ত করিবেন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৮শে মার্চ, ১৯৬৯]

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তাঁর প্রতিশ্রুতি কিছু কিছু রক্ষা করেছিলেন। তাঁর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনেও (১০ই এপ্রিল, ১৯৬৯) তিনি ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক এঁদের অভাব-অভিযোগের প্রসঙ্গ সহানুভূতিসহ আলোচনা করেছিলেন। তিনি ভালভাবেই উপলদ্ধি করেছিলেন যে, পূর্ব বাংলার জনগণকে ভাওতা দিয়ে দাবিয়ে রাখা যাবে না। তিনি আরও বুঝেছিলেন যে, জনগণ সামরিক শাসন-ব্যবস্থা চায় না -গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে জনগণের একান্ত কাম্য। এ কারণেই প্রাথমিক কার্যকলাপে তিনি দেশের প্রকৃত সমস্যাকে জানতে চেষ্টা করেছেন এবং আন্তরিকভাবেই তার সমাধানেও এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু ঘটনা-প্রবাহ এমন পথে চলেছিল যে ভাওতা দেবার কোন অবকাশই সেখানে ছিল না। পরবর্তী কালে যখনই তিনি ভাওতার পথে নেমে এসেছেন তখনই বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এই বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েই জন্ম নিয়েছে ‘বাংলাদেশ।’
ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনামলেই বাংলার জনগণের ওপর নেমে এসেছিল প্রকৃতির নির্মম রুদ্ররোষ। ১৩৭৬ সালের ১লা বৈশাখ (১৪ই এপ্রিল, ১৯৬৯) প্রকৃতির খামখেয়ালের শিকারে পরিণত হ’ল ঢাকার ডেমরা, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, তেজগাঁও নাখালপাড়া, রামপুরা, ত্রিমোহিনী, খিলগাঁও চৌধুরী পাড়া প্রভৃতি এলাকার মেহনতি মানুষ। সেদিনের পত্রিকার হেডলাইনে বড় বড় অক্ষরে লেখা হ’লঃ “রাজধানী ও উপকণ্ঠে কালবৈশাখীর মরণ ছোবলঃ পাঁচ শতাধিক নরনারী ও শিশু নিহত। প্রায় আড়াই সহস্র যখমী হাসপাতালে ভর্তি” । সেকি করুণ দৃশ্য!
সামরিক বাহিনীর জোয়ানেরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধার কার্যে অংশ নিয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাসমূহের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সাহায্য বাবদ দেড় লক্ষ টাকাও বরাদ্দ করা হয়েছিল। বাংলার একচ্ছত্র গণনায়ক ও মেহনতি মানুষের বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা ও দুর্গত মানুষের চরম দুরবস্থার করুণ দৃশ্য অবলোকন ক’রে জনসাধারণকে মুক্ত হস্তে দান করার অনু্রোধ জানিয়েছিলেন। তিনি
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮৮

নিজেও দুর্গত এলাকা সফর করলেন এবং তাঁর দলের কর্মীদের সেবা ও সাহায্য কার্যে নিযুক্ত করলেন। শেখ মুজিব ঘূর্ণিদুর্গত এলাকাসমূহের জনসাধারণের খাজনা ও কর মওকুফের জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান। সংবাদে বলা হযঃ
… “আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান গতকল্য বুধবার এক বিবৃতিতে প্রদেশের দারিদ্রক্লিষ্ট ঘূর্ণিদুর্গতদের মধ্যে গৃহনির্মাণ সামগ্রী বিতরণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন। ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকার স্বীয় সফর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করিয়া তিনি বিবৃতিতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দরিদ্রদের মধ্যে বিনামূল্যে এবং অন্যদের মধ্যে আংশিক রেশন দ্রব্য বিতরণের জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
শেখ মুজিব ঘূর্ণিদুর্গত জনসাধারণের ট্যাক্স ও খাজনা মওকুফ করিয়া দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানান। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষায়তনগুলি পুনঃ নির্মাণে এবং দরিদ্র ছাত্রদের বই-পুস্তক ক্রয়ের জন্য উদার হস্তে সাহায্য করার জন্যও শেখ সাহেব সরকারের প্রতি অনুরোধ জ্ঞাপন করেন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪শে এপ্রিল, ১৯৬৯]

ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার ধ্বংসলীলার ক্ষত শুকোতে না শুকোতে ময়মনসিংহ, পাবনা ও রাজশাহী জেলার ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় তার মরণ ছোবল হেনে গেল। শেখ মুজিবের নির্দেশে অসংখ্য আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মী এই অঞ্চলগুলোতে দুর্গত মানুষকে সাহায্য করার কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন। দেশের দুর্দিনে বঙ্গবন্ধু সর্বদাই দুর্গত দেশবাসীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন প্রকৃত বন্ধুর মত।

ইয়াহিয়ার নির্বাচন দানের ঘোষণা
১৯৬৯ সালের ২২শে এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া রাওয়ালপিণ্ডি থেকে লাহোরে আগমন করলে সাংবাদিকদের নিকট মন্তব্য করেন, ‘যথাশীঘ্র সম্ভব দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’ সাংবাদিকদের আর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তন ও ভোটার লিস্ট অবশ্যই সংশোধন করা হইবে।’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, প্রেসিডেন্ট বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের সাথে মতামত বিনিময়ের ইচ্ছাও এই সাংবাদিক সম্মেলনে প্রকাশ করেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮৯

নির্বাচন সম্পর্কে মোসাফিরের অভিমত
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এই উক্তি জনমনে আশার সঞ্চার করেছিল। কারণ পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে দেশে সুষ্ঠু ও অবাধ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নাই। আইয়ুবের শাসনামলে গোটা জাতির নৈতিক অধঃপতন ঘটেছিল। তাই জেনারেল ইয়াহিয়ার এই সময়োচিত ঘোষণায় গণতন্ত্রের জন্য ব্যাকুল জনমনে এক নতুন আশার সম্ভাবনা দেখা দিল। নির্ভীক বাঙালীর কণ্ঠস্বর ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকার পার্শ্ব-সম্পাদকীয়তে ছদ্মনামে মানিক মিয়া যে মূল্যবান কথাগুলো লিখলেন তা’ থেকেই বাঙালীর তৎকালীন চিন্তার একটি নমুনা পাওয়া যায়ঃ
“আমরা আজ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপর এত জোর দিতেছি কেন, তা’ কিছুটা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। দেশের বর্তমান শাসন পরিচালকদের কেহ কেহ হয়ত সঙ্গতভাবেই মনে করেন যে, প্রশাসনিক যন্ত্রে যে ব্যাপক দুর্নীতি বিরাজ করিতেছে তাকে বিদূরিত করা না হইলে দেশে গণতন্ত্র প্রচলনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হইতে পারে না। ইহার যৌক্তিকতা অস্বীকার না করিয়াও আমাদের দেশে বিরাজমান উদ্বেগজনক বিশেষ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনিক যন্ত্রের শুদ্ধি কার্য পরিচালনা করার কালে অন্য দিকে নজর না দিলে ভিন্নতর সমস্যার সৃষ্টি হইবার আশঙ্কা রহিয়াছে।
আমাদের সুনিশ্চিত অভিমত এই যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ-পর্যন্ত জাতীয় ভিত্তিতে একটিবারও সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ার জন্যই বর্তমান সঙ্কটজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে; নির্বাচন অনুষ্ঠান না হওয়ার জন্য মানুষ সুবিচার হইতে বঞ্চিত হইয়াছে; আঞ্চলিকতা, প্রাদেশিকতা, দলাদলি, হানাহানি, কোন্দল, বিদ্বেষ, বিশৃঙ্খলা, উচ্ছৃঙ্খলা ও নানা ধরনের অশুভ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হইয়াছে। সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত তো হয়ই নাই, বরং কয়েকবার নির্বাচনের সময় ঘনাইয়া আসিতেই একটা না একটা অজুহাত খাড়া করিয়া নির্বাচন-সম্ভাবনা ভণ্ডুল করিয়া দেওয়া হইয়াছে, জনগণের মৌলিক অধিকার কাড়িয়া নেওয়া হইয়াছে এবং অত্যাচারের স্টীম রোলার চালানো হইয়াছে। গণমন ইহাতে স্বাভাবিক ভাবেই আরো বিক্ষুদ্ধ, আরো সন্দিগ্ধ হইয়া রহিয়াহে…বিগত দশকে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯০

স্থিতিশীলতার নামে যা কিছু করা হইয়াছে কার্যতঃ তাহা দ্বারা দেশে শোষণ আর দুর্নীতিই প্রসার লাভ করে নাই, জনগণকে দেশের শাসন ব্যবস্থা হইতে দূরে সরাইয়া রাখাও হইয়াছে। পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার নাম করিয়া তথা শক্তিশালী কেন্দ্রের ধুয়া তুলিয়া রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষমতা শুধু একটি স্থানেই নয়, এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত করা হইয়াছে। ভৌগোলিক অবস্থান, জনগণের অনুভূতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আবেদন-নিবেদন কোন কিছুর প্রতি আদৌ ভ্রুক্ষেপ করা হয় নাই। শাসনতন্ত্রে প্রদেশদ্বয়ের হাতে যে ক্ষমতা প্রদান করা হইয়াছিল তাহাও বস্তুতঃ এক হাতে দিয়া অন্যহাতে ফিরাইয়া নেবারই নামান্তর ছিল। তথাকথিত প্রাদেশিক আইন-পরিষদের কিংবা মন্ত্রিসভার কোনই ক্ষমতা ছিল না; গভর্নরই ছিলেন প্রদেশের সর্বেসর্বা এবং তিনি ছিলেন রাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী প্রেসিডেন্টের নিযুক্ত এজেন্ট—যে এজেন্টের চাকুরী সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করিত প্রেসিডেন্টের অনুগ্রহের উপর। সুদীর্ঘ ১১ বৎসর একটানা এ ধরনের শাসন-ব্যবস্থায় জনগণের মনে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কি মনোভাব সৃষ্টি হইতে পারে… …তাহা বিশ্লেষণের প্রয়োজন করে না।

… … … …

এক পরিবারের মধ্যে যেখানে বিরোধ থাকিতে পারে সেখানে একটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন সম্প্রদায়, ভাষাভাষী অঞ্চলের মধ্যে বিতর্ক ও বিরোধ না থাকাটাই বরং অস্বাভাবিক। সকল বিরোধের ন্যায়সঙ্গত সমাধান মানুষের আয়ত্তের বাহিরে নয়। এই বিরোধ বা সমস্যা সমাধানের জন্য যা দরকার। তা’ হইল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সমাবেশ। কিন্তু বিগত দশকে শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সমাবেশ ইচ্ছাকৃতভাবেই ঘটিতে দেওয়া হয় নাই, বরং ক্ষমতা আঁকড়াইয়া থাকিবার জন্য ক্ষমতাসীনরাই শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালাইয়াছেন এবং নিজেরাই ‘ডিভাইড এ্যাণ্ড রুল পলিসি’ অর্থাৎ বিভেদ নীতি অনুসরণ করিয়াছেন এবং এক অঞ্চলকে অপর অঞ্চলের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করিয়াছেন।

… … … …

উপরিউক্ত কারণসমূহের জন্যই আমরা সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করিতেছি। কেননা, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯১

যে, অন্য কোন ব্যবস্থা দ্বারা উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবেলা করা যাইবে না। নির্বাচন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা যাচাইয়েরও প্রকৃষ্ট উপায়।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৮শে মার্চ, ১৯৬৯]

এ থেকেই উপলদ্ধি করা যায় যে, সাধারণ নির্বাচন জনমনে এক আনন্দের শিহরণ জাগিয়েছিল। কিন্তু কে জানত যে, এই আনন্দের মধ্যে নিহিত রয়েছে মৃত্যুর শঙ্কা আর সেই মৃত্যুর মাধ্যমেই আমাদের নবজন্ম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে অযথা হয়রানি ও নির্যাতন করা পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর একটা নিত্যনৈমিত্তিক কর্তব্য ছিল। শেখ সাহেবের কণ্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করার পরিকল্পনা চলছিল চব্বিশ বছর ধরে। ১৯৬৬ সালের ২০শে মার্চ আউটার স্টেডিয়ামে আপত্তিজনক বলে কথিত একটি ভাষণের অভিযোগে আইয়ুব সরকার শেখ মুজিবকে বহুবার আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন এবং পরিশেষে তাঁকে ১৫ মাস কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছিল। শেখ মুজিব এই অন্যায় দণ্ডাজ্ঞাকে মেনে নিতে পারেন নি। তাই ঢাকা হাইকোর্টে তিনি দণ্ডাজ্ঞার বিরুদ্ধে আপীল করেছিলেন।
সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। আইয়ুব-মোনেম চক্র তাঁকে যতই হয়রানি করার চেষ্টা করুন না কেন, ন্যায়বিচারের মাপকাঠিতে তিনি সমস্ত অসত্যের ও অন্যায়ের উর্ধ্বেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ক’রে রেখেছেন। ১৯৬৯ সালে ৩০শে এপ্রিল ঢাকা হাইকোর্টে এই মামলার শুনানী শুরু হয়ে ৬ই মে (১৯৬৯) তারিখে তার রায় প্রদান করা হয়। রায়ে শেখ মুজিবকে সেই দণ্ডাজ্ঞা থেকে বেকসুর খালাস প্রদান করা হয়।
এই সম্পর্কে পরদিন প্রকাশিত সংবাদপত্রে বলা হয়ঃ
“……দুইদিনব্যাপী শুনানী ও সওয়াল-জবাবের পর বিচারপতি জনাব আবদুল হাকিম গতকল্য তাঁর রায়ে সরকার পক্ষের কৌঁসুলির সকল যুক্তি প্রত্যাখ্যান করিয়া আবেদনকারীর কৌঁসুলির যুক্তি গ্রহণ করেন এবং নিম্ন আদালতে প্রদত্ত দণ্ডাজ্ঞা অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করিয়া শেখ সাহেবের বেকসুর খালাসদান প্রসঙ্গে বলেন, আবেদনকারীর আলোচ্য বক্তৃতার কোথাও কোথাও সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর শব্দ
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯২

ব্যবহার করা হইয়াছে সত্য এবং সেই শব্দগুলি অপ্রিয়ও হইতে পারে- তবে সেইগুলি অপ্রিয় সত্য।
……বিচারপতি হাকিম তাঁহার রায়ে আরও বলেন, আবেদনকারী পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নামক একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতি। তাঁহার দল ৬-দফা কর্মসুচী বিশ্লেষণ ও দলীয় মতবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর্মপন্থা গ্রহণ করেন। সরকার তাঁহার দলের উক্ত কর্মসূচী বা তৎসংক্রান্ত প্রচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন নাই এবং উহা অবৈধ বলিয়াও ঘোষিত হয় নাই। শাসনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী ৬-দফা কর্মসূচীর বিশ্লেষণ ও দেশের কল্যাণের জন্য সরকারের সমালোচনা করার অধিকার শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল। তিনি তাঁহার ভাষণে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা ও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার কথা বলিয়াছেন। তাঁহার ভাষণের দুই এক স্থানে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন সত্য। উক্ত ভাষণের ঐসব অংশের কোন কোন কথা অপ্রিয় হইতে পারে, তবে সেগুলো অপ্রিয় সত্য।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ই মে, ১৯৬৯]

এ সময় একটি শোকাবহ ঘটনায় বাংলার জনগণ ভেঙে পড়ে। বাংলাদেশের সমস্যাসঙ্কুল অবস্থাকে জাতির সম্মুখে (তদানীন্তন সামরিক শাসনামলেও) তুলে ধরতে যারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে জনাব তোফাজ্জল হোসেন অন্যতম। শাসকবর্গের চোখ রাঙানিকে ভ্রুক্ষেপ না ক’রে যিনি দেশবাসীর অক্লান্ত সেবা ক’রে গেছেন সেই বাংলার নির্ভীক সংগ্রামী সন্তান মানিক মিয়া জাতীয় জীবনের এই সন্ধিক্ষণে আকস্মিকভাবে ইন্তেকাল করেন।
সুদীর্ঘকাল পর নির্বাচনের ঘোষণায় নির্যাতিত বাংলার মানুষের বুকে যখন আশার সঞ্চার হয়েছিল, ঠিক সেই সময় বাংলার বীর সেনানী তোফাজ্জল হোসেন মোসাফির ছদ্মনামে ইত্তেফাক পত্রিকার পার্শ্ব-সম্পাদকীয়তে রাজনীতির খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে সুচিন্তিত মতবাদগুলো ব্যক্ত ক’রে যাচ্ছিলেন। সহসা তাঁর তিরোধানে এমন জোরালোভাবে সত্য কথা বলবার মত সাংবাদিক আর কেউ থাকলেন না। ইত্তেফাক
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯৩

পত্রিকার প্রথম পাতায় দেশবাসীকে ১৯৬৯ সালের ১লা জুন এই মর্মান্তিক খবর জানানো হ’লঃ
“মানিক মিয়া আর নাই।” সংবাদে আরো বলা হয়েছিল -“ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং পূর্ব বাংলার সংগ্রামী বীর জনাব তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) আর নাই। গত রাত্রি আড়াইটায় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত পিণ্ডি হইতে টেলিফোনযোগে জানানো হয় যে, তিনি তথায় গতরাত্রে পিণ্ডি সময় ১২-৪০ মিনিটে আকস্মিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হইয়া ইন্তেকাল করিয়াছেন।” মানিক মিয়াকে হারিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “মরহুম মানিক মিয়া শুধু একজন দেশপ্রেমিক ও সাংবাদিকই ছিলেন না, মানিক ভাই ছিলেন আমার পথপ্রদর্শক। তাঁহার আকস্মিক ইন্তেকালে আমার অপূরণীয় ক্ষতি হইল।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২রা জুন, ১৯৬৯]

মানিক মিয়ার মৃত্যুতে বঙ্গবন্ধু সত্যিই মুষড়ে পড়েছিলেন। দেশবাসীও তাঁর এই আকস্মিক মৃত্যুতে সমানভাবে মর্মাহত হয়েছিল। বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনাকে একটি শক্তিতে রূপান্তরিত করতে মানিক মিয়া ও তাঁর ইত্তেফাক পত্রিকার ভূমিকা ছিল নির্ভীক এবং প্রজ্ঞাময়।
ব্যথাহত হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু আবার যাত্রা শুরু করলেন। সামনেই মেহনতি মানুষের মুক্তি সংগ্রামে শহীদ মনু মিয়ার মৃত্যু দিবস। তিনি অত্যন্ত সতর্ক পদবিক্ষেপে সাবধানে অগ্রসর হতে লাগলেন। ইয়াহিয়ার সমগ্র কার্যপদ্ধতি তিনি সজাগ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ ক’রে নিজের কার্যক্রম নির্ণয় ক’রে চললেন। এ দিকে ইয়াহিয়া খানও মনে মনে যত ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে থাকুন, বাইরে একজন সদিচ্ছা প্রণোদিত ব্যক্তির ন্যায় আচরণ করতে লাগলেন। তিনি জানতেন, জাগরণের যে জলতরঙ্গ আইয়ুবকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, তাকে বালির বাঁধ দিয়ে রোধ করা যাবে না। তাই কখনো নির্বাচনের কথা, কখনো হুমকি, কখনো শাসনতন্ত্র, কখনো জনগণের দুঃখে অশ্রু বিসর্জন ইত্যাদি অভিনয়ে নিজেকে বেশ সক্রিয় ক’রে রাখলেন তিনি।
ইতিমধ্যে, পূর্বেই বলেছি, মামলার রায় প্রকাশ পেয়েছে এবং এই রায় তাঁর সপক্ষে যাওয়ায় শেখ মুজিব এবার নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে রাজনৈতিক
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯৪

তৎপরতায় মনোনিবেশ করতে পারলেন। তাঁর তৎপরতা চলতে লাগলো কখনো প্রকাশ্যে, কখনো অপ্রকাশ্যে—সবই সজাগ সতর্কতার সাথে। প্রকাশ্যে তিনি সরকারের কোন সমালোচনা করলেন না বটে, তবে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তিনি জনগণকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবার চেষ্টা চালালেন। কেননা, তিনি জানেন, জনগণই তাঁর সকল শক্তির উৎস। অসত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে জনগণই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবে। শুধু চাই, এ বিষয়ে তাদেরকে সম্যক সচেতন ক’রে দেয়া ও শৃঙ্খলা সহকারে তাদেরকে পরিচালনা করা।
এই উদ্দেশ্যেই জনগণকে তিনি তাদের অধিকার আদায়ের সেই রক্তক্ষরা দিন ঐতিহাসিক ৭ই জুনের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। এ সম্পর্কে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়ঃ
“আজ ঐতিহাসিক ৭ই জুন। ১৯৬৬ সালের ঠিক এই দিনটিতে দেশবাসী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার এবং বৈষম্য ও শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের ৬-দফা আন্দোলনের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিতে গিয়া মোনায়েম সরকারের পুলিশের গুলীতে আত্মাহুতি দিয়াছিলেন এ দেশের কয়েকটি সোনার সন্তান। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আহ্বানে সেই দিন ৬-দফা দাবীর সমর্থনে সারা দেশে হরতাল পালন করা হয় এবং এক পর্যায়ে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে হরতাল পালনরত ছাত্র-জনতার উপর পুলিশ গুলীবর্ষণ ক’রে ও বহুসংখ্যক লোককে গ্রেফতার করা হয়।”
“…………৭ই জুন উপলক্ষে প্রদত্ত এক বাণীতে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ৬-দফা আন্দোলনে শরিক হইয়া যাঁহারা শাহাদৎ বরণ করিয়াছেন, পরম শ্রদ্ধাভরে আমি আজ তাঁহাদের কথা স্মরণ করিতেছি। এই আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করিয়া অন্য যাহারা জেল-জুলুম ও হয়রানির শিকার হইয়াছেন, তাঁহাদের কথাও আমি স্মরণ করি। ইহাদের সকলের কথা এদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধিকার অর্জন ও শোষণবিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকিবে। সেইদিন আমি ও আমার সহকর্মীদের অনেকেই কারারুদ্ধ ছিলাম। কিন্তু সেই দিন আমাদের মুক্তি
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯৫

এবং ৬-দফা দাবীর সপক্ষে আন্দোলন চালাইতে গিয়া যাহারা চিরতরে আমাদের ছাড়িয়া গিয়াছেন, সেই অজানা অচেনা বন্ধুদের স্মৃতি আজ বার বার আমার চিত্তকে ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিতেছে। আমি সেই শহীদ ভাইদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ই জুন, ১৯৬৯]

পূর্বেই বলা হয়েছে যে, শেখ মুজিব সাবধানী গণনায়কের ন্যায় সতর্কতার সাথে পথযাত্রা শুরু করলেন। ৭ই জুন অতিবাহিত হবার পর তিনি সরাসরি ইয়াহিয়াকে লক্ষ্য ক’রে কথা বলা আরম্ভ করলেন। এবার তিনি সরাসরি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নিকট জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য ‘অবিলম্বে দেশব্যাপী প্রত্যক্ষ সাধারণ গণ-নির্বাচনের ব্যবস্থা’র দাবী জানালেন। খবরের কাগজে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়ঃ
‘ক্ষমতা হস্তান্তর ও শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে দলীয় নীতি ঘোষণা প্রসংগে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান গতকল্য (২২শে জুন, ১৯৬৯) অবিলম্বে সার্বজনীন ভোটাধিকার ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নিকট দাবী জানান।
তিনি বলেন যে, দেশব্যাপী এই নির্বাচনের উদ্দেশ্য হইবে—দেশে একটি ফেডারেল পার্লামেন্টারী শাসনকাঠামো কায়েম করা, যে কাঠামোর অধীনে কেন্দ্রে ও প্রদেশে প্রতিনিধিত্বশীল পরিষদ এবং বেসামরিক সরকার কায়েম করতঃ অবিলম্বে সেই সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করিতে হইবে।
আওয়ামী লীগ দেশবাসীর জন্য তাঁহাদের দলীয় ৬-দফা ও ছাত্রদের ১১-দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পূর্ব প্রতিশ্রুতি পুনরায় দৃঢ়তার সহিত ঘোষণা করিতেছে। পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, জনসংখ্যার ভিত্তিতে ফেডারেল পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব, এক ইউনিট বিলোপ ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাবেক প্রদেশসমূহের পুনর্জীবনের ধ্যান-ধারণায় আওয়ামী লীগ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী।
[দৈনিক ইত্তেফাক, ২৩শে জুন, ১৯৬৯]

এদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও নিয়মতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা প্রত্যর্পণের কথা মাঝে মাঝেই ঘোষণা করছিলেন। তাঁর এই ঘোষণার মাঝে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯৬

মাঝে স্বভাবসুলভ দম্ভ ও শাসনের সুর গর্জে উঠলেও কোন ভাওতা ছিল না। ১৯৬৯ সালের ২রা জুলাই তিনি আবার জানালেনঃ
“১৯৭০ সালে বা তৎপূর্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্ন একান্ত করিয়া জনসাধারণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপরই নির্ভরশীল। সব কিছু স্বাভাবিক হইলে সামরিক আইন প্রত্যাহার করার এক মুহূর্তও বিলম্ব করা হইবে না।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৩রা জুলাই, ১৯৬৯]

শেখ মুজিব যখন ধীরে ধীরে জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু ক’রে দিয়েছেন, ঠিক সেই সময়ই পশ্চিমা প্রতিক্রিয়াশীল কতিপয় রাজনীতিবিদ তাঁর এবং তাঁর দলের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে শুরু ক’রে দিলেন। এক সময়ের আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান এ বিষয়ে বিশেষ অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দেশপ্রেম সম্পর্কে কটাক্ষ ক’রে তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন। এর ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ এবং বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং তাঁর কঠোর নিন্দা করেন। ৭ই জুলাই (’৬৯) ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ নবাবজাদা নসরুল্লাহকে এই বিষয়ে এক চ্যালেঞ্জ প্রদান করেন। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতৃবৃন্দও নসরুল্লাহ খানের উক্তি নিন্দা ক’রে সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেনঃ
“……নবাবজাদা নসরুল্লাহ তাঁর বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দেশপ্রেম সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করিয়া এমন ধরনের মন্তব্য করিয়াছেন যাহার ফলে পাকিস্তানের সকল গণতন্ত্রমনা দেশপ্রেমিক নাগরিকই ক্ষুব্ধ না হইয়া পারেন নাই।
তাঁহারা আরো বলেন, ইহা উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকে এই পর্যন্ত শেখ মুজিবকে কায়েমী স্বার্থবাদীদের চক্রান্তের ফলে জীবনের মূল্যবান সময়ের প্রায় দশটি বছর জেলে কাটাইতে হইয়াছে। এই সময়টুকু তিনি জনগণের অধিকার আদায় এবং সামাজিক ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সংগ্রামে ব্যয় করিতে পারিতেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯৭

তাঁহারা আরো বলেন, ইহাতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইয়াছে যে, সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক অভ্যুত্থান তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার খপ্পর হইতে শেখ মুজিবকে উদ্ধার করার মূল উদ্দেশ্য লইয়া দানা বাঁধিয়া উঠিয়াছিল এবং সেই অভ্যুত্থানের ফলশ্রুতি হিসাবে উক্ত জীঘাংসাপরায়ণ মামলা প্রণয়নকারীরা ক্ষমতাচ্যুত হইয়াছেন। শেখ মুজিব শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ৭ কোটি মানুষের দাবী আদায়ের প্রতীক নন, তাঁহাকে পাকিস্তানের ১২ কোটি অত্যাচারিত মানুষের মুক্তিদাতা বলে অভিহিত করা যায়।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ই জুলাই, ১৯৬৯]

ইয়াহিয়ার কার্যকলাপে জনমনে নির্বাচন সম্পর্কে আস্থা ফিরে এলো। তিনি তাঁর মন্ত্রিপরিষদে এবার কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তিকে গ্রহণ করলেন। মন্ত্রিপরিষদে যোগ দিলেন পূর্ব বাংলা থেকে জনাব ডাঃ এ. এম. মালেক, জনাব এ. কে. এম. হাফিজুদ্দিন, জনাব শামসুল হক এবং জনাব আহসানুল হক। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এলেন সরদার আবদুর রশিদ খান, জনাব মুজাফফর আলী কিজিলবাস ও মেজর জেনারেল শের আলী খান। ১৯৬৯ সালের ৪ঠা আগষ্ট এই সাত সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রিপরিষদ ইয়াহিয়ার নিকট শপথ গ্রহণ করেন। শপথ গ্রহণের পর তাঁদের মধ্যে নিম্নলিখিতভাবে দফতর বণ্টন করা হয়ঃ
“ডাঃ এ. এম. মালেক-শ্রম, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা।
সরদার আবদুর রশিদ খান—স্বরাষ্ট্র ও কাশ্মীর এ্যাফেয়ার্স, স্টেটস ও ফ্রন্টিয়ার রিজিয়ন।
জনাব এ. কে. এম. হাফিজুদ্দিন—শিল্প ও প্রাকৃতিক সম্পদ।
নওয়াব মুজাফফর আলী কিজিলবাস—অর্থ।
জনাব শামসুল হক – শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা।
মেজর জেনারেল নবাবজাদা শের আলী খান—তথ্য ও বেতার।
জনাব আহসানুল হক-বাণিজ্য।
প্রেসিডেন্ট স্বয়ং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র, ইকনমিক এ্যাফেয়ার্স ডিভিশন, ল্যানিং ভিভিশন, এস্টাব্লিশমেন্ট ডিভিশন ও কেবিনেট ডিভিশনের দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছেন।”
[ ঐ, ৫ই আগস্ট, ১৯৬৯]
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯৮

যদিও এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হ’ল কিন্তু সামরিক প্রশাসনিক চরিত্রের কোনরূপ পরিবর্তন সাধন করা হ’ল না।
পূর্ব বাংলার মানুষ যে শেখ মুজিবকে একচ্ছত্র গণনায়ক বলে স্বীকার করেছেন, বঙ্গবন্ধু একথা উপলদ্ধি করলেন। এবার তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সমর্থন আদায়ের দিকে দৃষ্টি দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। বিগত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে তাঁর এই সফরের কথা ছিল, কিন্তু মানিক মিয়ার আকস্মিক মৃত্যুতে তিনি তাঁর সফর স্থগিত রাখেন। অবশেষে এই উদ্দেশ্যে ১৯৬৯ সালের ৭ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধু সদলবলে করাচীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। যাত্রার প্রাক্কালে সাংবাদিকদের তিনি বললেন, “পশ্চিম পাকিস্তানীদের জন্য তিনি শুভেচ্ছার বাণী লইয়া যাইতেছেন।”
এ সম্পর্কে পরদিন প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়ঃ
“……শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন যে, আজ দেশ ও জাতির জন্য সর্বাধিক প্রয়োজন হইতেছে যত শীঘ্র সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। আশু নির্বাচন অনুষ্ঠান শুধুমাত্র প্রয়োজনই নয়, ইহা এক্ষণে জাতির জন্য সবচাইতে কল্যাণকর ব্যবস্থা বলিয়া বিবেচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। তিনি বলেন যে, জাতির সামনে হাজারো সমস্যা বিদ্যমান এবং এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই দিতে পারেন।
জনৈক সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপর আওয়ামী লীগ সর্বদাই গুরুত্ব আরোপ করিয়া আসিতেছে এবং আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে যে, কয়েক মাসের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব।
শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে তাঁহার দলের ভূমিকার উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন যে, জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই দেশকে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য শাসনতন্ত্র দিতে পারেন।
জনৈক সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ সাহেব বলেন যে, শাসনতান্ত্রিক কাঠামো সম্পর্কে তাঁহার দলের বক্তব্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট। জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব, ৬-দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও এক ইউনিট বাতিল—এই তিনটি মূলনীতির উপর ভিত্তি করিয়া আওয়ামী লীগ
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯৯

দেশের ভাবী শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পক্ষপাতী। তিনি বিশেষ জোর দিয়া দাবী করেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণ আওয়ামী লীগের এই মূলনীতির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করিয়াছেন।

।। ঐক্যজোট সম্পর্কে ।।
সিন্ধুর প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে আওয়ামী লীগ কোন ঐক্যজোট গঠন করিতে যাইতেছেন কিনা জানিতে চাহিলে শেখ সাহেব সাংবাদিকদের বলেন যে, সিন্ধু যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে এই মুহূর্তে ঐক্যজোট গঠন করার ব্যাপারে এক্ষুণি কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে এই যুক্তফ্রন্ট এক ইউনিট বাতিলের জন্য কাজ করিতেছেন জানিয়া আমি খুশী হইয়াছি। এই যুক্তফ্রন্ট আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব চাহিতেছেন বলিয়াও তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন।
শেখ সাহেব উল্লেখ করেন যে, সিন্ধু যুক্তফ্রন্টের তরফ হইতে তাঁহাকে আমন্ত্রণ জানানো হইয়াছে এবং তিনি সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়াছেন। সিন্ধু যুক্তফ্রন্টের তরফ হইতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি শরিক হইবেন বলিয়াও উল্লেখ করেন।

।। আমি খোলা মনে যাইতেছি ।।
শেখ সাহেব সাংবাদিকদের বলেন যে, আমি যখনই পশ্চিম পাকিস্তানে যাই, খোলা মন লইয়াই যাই। এবারও আমি খোলা মন লইয়া যাইতেছি। দেশের ও দেশবাসীর যে কোন সমস্যা নিয়া যে কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের সঙ্গে আমি আলোচনা করিতে প্রস্তুত আছি। বস্তুতঃ আমি অনুরূপ আলোচনার জন্য সবাইকে স্বাগত জানাই। তিনি বলেন যে, কায়েমী স্বার্থবাদের বিরুদ্ধেই আমাদের সংগ্রাম, পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইদের বিরুদ্ধে আমাদের কোন অভিযোগ নাই, আমরা তাদের ভালবাসি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, করাচীর বাহিরে পশ্চিম পাকিস্তানে তিনি যাইবেন কিনা সে সম্পর্কে এখনো কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নাই। শেখ সাহেব বলেন যে, আমি সোজাসুজি পথের পথিক, ঘোরপ্যাচের মধ্যে আমি নাই।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৮ই আগস্ট, ১৯৬৯]
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০০

শেখ মুজিব ও তাঁর দলের লোকজনকে করাচী বিমান বন্দরে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের কথা ছিল, কিন্তু সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সকল রাজনৈতিক সম্বর্ধনা সম্পর্কে বিধিনিষেধ আরোপিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তা’ বাতিল করা হয়। করাচী পৌঁছার পর শেখ মুজিব এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। তিনি সাংবাদিকদেরকে বলেনঃ
“একটি ঘোষণা বা একটি সাময়িক বিধি জারীর মাধ্যমে মৌলিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করিয়া দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইতে পারে। …নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য শাসনতন্ত্রের প্রয়োজন নাই।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৮ই আগষ্ট, ১৯৬৯]
বিশেষ চিন্তাভাবনা ক’রে শাসনতন্ত্র রচনার ওপর শেখ মুজিব গুরুত্ব আরোপ করেন, যাতে শাসনতন্ত্রে সমস্যাবলীর স্থায়ী সমাধান সম্ভব হয়।
পরদিন অর্থাৎ ৮ই আগস্ট পি. পি. আই. প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে শেখ মুজিব বলেন যে, “ন্যায়বিচার, সাম্য ও সমতার মাধ্যমেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সংহতি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৯ই আগষ্ট, ১৯৬৯]

৬-দফা দেশকে বিচ্ছিন্ন ক’রে ফেলবে এ অভিযোগকে তিনি ‘প্রায়শঃই উচ্চারিত’ অভিযোগ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, “অনুরূপ অভিযোগ অসদুদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং এর লক্ষ্য হ’ল জনসাধারণের মধ্যে শোষণের ধারা অব্যাহত রাখা।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৯ই আগষ্ট, ১৯৬৯]

পরদিন করাচীর একটি স্থানীয় হোটেলে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সমিতি ও পশ্চিম পাকিস্তান ছাত্র লীগের যৌথ উদ্যোগে শেখ মুজিবকে এক সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। সম্বর্ধনার জবাবে তিনি বলেন যে, “প্রীতি ও ভালবাসার মাধ্যমেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে গড়িয়া তোলা যাইতে পারে। কোন অবস্থাতেই বন্দুক অথবা বুলেটের দ্বারা উহা সম্ভব নহে।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১০ই আগস্ট, ১৯৬৯]

১০ই আগস্ট সিন্ধু যুক্তফ্রন্ট কর্তৃক স্থানীয় একটি হোটেলে তাঁর সম্মানে আয়োজিত আর একটি সম্বর্ধনার জবাব দানকালে শেখ মুজিব
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০১

“এক ইউনিট বাতিল, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে দেশব্যাপী গণভোট গ্রহণের আহ্বান জানান।”
উক্ত সভায় তিনি জোর দিয়ে বলেনঃ “যদি গণভোট অনুষ্ঠিত হয় তাহা হইলে শতকরা ৭০ ভাগ লোক আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব প্রদানের অনুকূলে এবং এক ইউনিট বিলোপের পক্ষে রায় প্রদান করিবে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ই আগস্ট, ১৯৬৯]

উক্ত সম্বর্ধনা সভায় সিন্ধু যুক্তফ্রন্টের সভাপতি জনাব জি. এম. সৈয়দ শেখ মুজিবের উদ্দেশে মানপত্র প্রদানকালে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি ফ্রন্টের গভীর আস্থা প্রকাশ করেন এবং এক ইউনিট অবসানের জন্য সিন্ধু ফ্রন্টের প্রচেষ্টায় শেখ মুজিবের সমর্থন কামনা করেন। একই দিনে সিন্ধু যুক্তফ্রন্ট পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিল এবং সাবেক প্রদেশগুলোর সীমান্ত-সংলগ্ন রাজ্যগুলোকে উক্ত প্রদেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত ক’রে প্রদেশসমূহের পূর্ব মর্যাদা অবিলম্বে পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য আহ্বান জানান।
পরদিন ১১ই আগষ্ট করাচী প্রেস ক্লাব শেখ মুজিবকে এক অন্তরঙ্গ সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। এই সম্বর্ধনার জবাবে তিনি দেশের শাসনতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য বয়স্ক ভোটাধিকার এবং এক ব্যক্তি এক ভোটের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানান। এই সম্বর্ধনা সভার পূর্ণ বিবরণ দিতে গিয়ে একটি পত্রিকা লিখেছেনঃ
“আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান আজ বিকালে এখানে (করাচীতে) বলেন যে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকসহ দেশের বর্তমান সমস্যাবলী সমাধানের এক মাত্র পন্থা হইতেছে গোড়া হইতে ঐ গুলির কাজ শুরু করা। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে এবং কায়েদে আযমের মনোবাঞ্ছা মোতাবেক ঐ সব সমস্যা সমাধান করিতে হইবে বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন।………..৫৫মিনিট ব্যাপী এই ভাষণে আওয়ামী লীগ প্রধান ধারাবাহিকভাবে দেশের গুরুতর সমস্যাবলী আলোচনা করেন। তাঁহার দল ভারতীয় এজেন্টদের সহিত যোগসাজশে পাকিস্তান হইতে বিচ্ছিন্ন হইবার অথবা ইসলামী পথ কিম্বা পাকিস্তানী আদর্শ
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০২

হইতে বিচ্যুত হইবার চেষ্টা করিতেছে বলিয়া যে সমালোচনা করা হইয়া থাকে, তিনি দফাওয়ারীভাবে তাহা খণ্ডন করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁহার সহকর্মীবৃন্দ এবং পূর্ব পাকিস্তানীদের যে সংগ্রামী ইতিহাস ও অবদান রহিয়াছে, তিনি তাহা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, কায়েমী স্বার্থবাদীরাই এই ধরনের জঘন্য প্রচারণা চালাইতেছে এবং গোটাদেশের উপর শোষণ চিরস্থায়ী করাই তাহাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।
শাসনতান্ত্রিক সমস্যাবলী সমাধানের উদ্দেশ্যে সর্বদলীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করিয়া তিনি বলেন যে, ঐ সব নেতা প্রাপ্তবয়স্ক ভিত্তিক সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যাণ্ডেট না পাইলে অনুরূপ সম্মেলনের কথা চিন্তাই করা যায় না।
অপর পক্ষে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রও গ্রহণযোগ্য নহে বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন। কারণ উক্ত শাসনতন্ত্রে সংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব, এক ইউনিট বাতিল এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ জনগণের বিভিন্ন মৌলিক দাবী পূরণের ব্যবস্থা নাই। অনুরূপভাবে জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্য কোনরূপ শাসনতন্ত্র তাহাদের উপর চাপাইয়া দেওয়া হইলেও উহাও গ্রহণযোগ্য হইবে না।
তিনি বলেন যে, আওয়ামী লীগ জনগণকে ভাওতা দিবেনা। আওয়ামী লীগ দেশকে একটি প্রকৃত গণতন্ত্র প্রদানের জন্য ওয়াদাবদ্ধ, উহার কম-বেশী কিছু করিতে তাহারা রাজী নহে বলিয়া তিনি জানান।

।। কাহারা দায়ী? ।।
শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, পাকিস্তানের জন্য যাহারা দুই আনা পয়সাও চাঁদা দেয় নাই এবং কায়েদে মিল্লাতের মৃত্যুর পর যে সব আমলাতন্ত্রী ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করিয়াছিল, একমাত্র তাহারাই দেশের বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী।
তিনি বলেন, উক্ত কায়েমী স্বার্থবাদিগণ শেরে বাংলা ফজলুল হক এবং জনাব সোহরাওয়ার্দীকে পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিতেও ছাড়েন নাই।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০৩

আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন যে, জনাব আইয়ুব খান দেশে যে পদ্ধতি চালু করিয়াছিলেন তাহার ফলে গোটা জাতি, এমন কি ধর্মভীরু গ্রামবাসীরা পর্যন্ত দুর্নীতির শিকার হইয়া পড়িয়াছিল।
ঐ সব কায়েমী স্বার্থবাদীরা জাতির নিকট সুবিদিত এবং তাহাদিগকে সুদে আসলে ঋণ পরিশোধ করিতে হইবে বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন।
তাঁহার বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচেষ্টার যে অভিযোগ করা হয়, সেই সম্পর্কে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ হিসাবে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হইতে যাইবে কেন? উহার দ্বারা বরং অভিযোগকারীদের অসৎ উদ্দেশ্যই প্রমাণিত হয়। তাহাদের অসৎ উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইতে বাধ্য বলিয়া তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।
শেখ মুজিবুর রহমান বিস্তারিতভাবে পূর্ব পাকিস্তানীদের অসন্তোষের কারণ বর্ণনা করেন এবং উভয় প্রদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করেন। বিশেষতঃ তিনি চাউল ও গমের মত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য এবং মাথাপিছু আয়ের তুলনা করেন।
তিনি বলেন, আজ পর্যন্ত পাকিস্তানের মোট ঋণের পরিমাণ হইতেছে দুই হাজার কোটি টাকা। অথচ তন্মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হইতেছে ৫শত কোটি টাকার কাছাকাছি। তিনি বলেন, সিন্ধু নদের পানি বণ্টনের একটা সমাধান খুঁজিয়া পাওয়া গেলেও পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা সমস্যা সমাধানের কোন বাস্তব প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয় নাই, অথচ পূর্ব পাকিস্তানে প্রতি বৎসর বন্যার দরুন ৫০ হইতে ১ শত কোটি টাকা লোকসান হয়। ভারতের সহিত বিরোধের ফলে উক্ত সমস্যার সমাধানের অসুবিধা আছে বলিয়া যে যুক্তি দেখানো হয়, তাহা অবাস্তব বলিয়া তিনি মন্তব্য করেন।

।। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন।।
শেখ মুজিবুর রহমান আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে বলেন যে, উহা একটি বহু পুরাতন বিষয় এবং এই ব্যাপারে ১৯৫৫ সালের দিকে পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০৪

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য যাহা চাহে, পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যও তাহাই চাহে।
সংক্ষেপে বলিতে গেলে আওয়ামী লীগ চাহে দেশে শোষণের অবসান ঘটাইয়া ১২ কোটি লোকের জন্য শোষণহীন সমাজ গঠন করিতে। তিনি ইহাও বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানেই হউক আর পশ্চিম পাকিস্তানেই হউক গরীবের ভাগ্য সর্বত্রই এক। উহার অবসান ঘটাইতে হইবে। শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, আওয়ামী লীগ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন বলিতে সর্বক্ষেত্রে প্রদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণতা বুঝায়। এই প্রসঙ্গে তিনি ভারতের সহিত সেপ্টেম্বর যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন ও সঙ্কটাপন্ন অবস্থার কথা উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন যে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন কোন ক্রমেই কেন্দ্রকে দুর্বল করিবে না। কারণ অর্থ ও পররাষ্ট্র ছাড়াও দেশরক্ষা দফতর কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। একমাত্র দেশরক্ষা দফতরই কেন্দ্রের জন্য যথেষ্ট। ১৯৫৮ সালের এবং চলতি সালের ঘটনাবলীই উহার প্রমাণ করিয়াছে বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন।…….
……………শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ সালে উহার প্রতিষ্ঠার পর হইতে এ যাবৎ মাত্র ১৩ মাসের জন্য ক্ষমতাসীন হইয়াছিল এবং বাকী সময় বিরোধীদল হিসাবে কাজ করিয়াছে। তিনি বলেন যে, আওয়ামী লীগ কর্মীগণ জনগণের সাথে কাজ করিয়া যাইবার জন্য আত্মোৎসর্গ করিয়াছে। দুনিয়ার কোন শক্তিই তাহাদিগকে দমাইয়া রাখিতে পারিবে না বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন। আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন যে, তাঁহার দল সমাজতন্ত্র সমর্থন করে। কিন্তু উক্ত সমাজতন্ত্র ধার করা বা আমদানীকৃত আদর্শের ভিত্তিতে নহে, বরং অমাদের পরিবেশের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ হইতে হইবে। আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্র বলিতে একদলীয় শাসনাধীন বা নাস্তিক রাষ্ট্র বুঝায় না বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন। …….শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, সম্প্রতি গণ-অভ্যুত্থানের সময় দেশের যে সব বীর সন্তান জীবন দিয়াছেন তাহাদিগকে ভুলিলে চলিবে না। কারণ তাহাদিগের ত্যাগ ব্যতিরেকে অনেক কিছু অর্জন করাই বাকী থাকিত।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০৫

……. তিনি সর্বশেষে সাম্প্রতিক গণ-আন্দোলনের শহীদদের উদ্দেশ্যে ফাতেহা পাঠ করার জন্য উপস্থিত সকলের প্রতি আহ্বান জানান এবং বলেন যে, আওয়ামী লীগ শহীদদের রক্ত বিফলে যাইতে দিবে না।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ই আগস্ট, ১৯৬৯]

শেখ মুজিব যখন ক্রমাগত স্বায়ত্তশাসনের দাবী জানিয়ে জনমত গঠনে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের অন্যতম নেতা পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির আহ্বায়ক জনাব নূরুল আমীন আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে ‘দেশে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র দাবীরই শামিল’ বলে অভিহিত করেন। তিনি লাহোর বিমান বন্দরে এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত ক’রে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন যে, “ইহা দেশে দুইটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র দাবী করার শামিল।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ই আগস্ট, ১৯৬৯]

সামরিক শাসন জারীর পর বেশ কিছুদিন ধরে ছাত্র সমাজের কার্যকলাপ শিথিল হয়ে পড়েছিল। অবশ্য শিথিল হলেও একেবারে যে নিষ্ক্রিয় ছিল একথা বলা যায় না। তাঁরা সামরিক সরকারের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং ভেতরে ভেতরে অধিকার আদায়ের আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
ছাত্র সমাজের এই মনোভাবের প্রথম প্রকাশ ঘটে ১২ই আগস্ট সরকার প্রস্তাবিত খসড়া শিক্ষানীতির কঠোর সমালোচনার মাধ্যমে। ঐ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে ‘ডাকসু’ আয়োজিত প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি সম্পর্কে আলোচনা সভায় প্রগতিশীল ছাত্র নেতৃবৃন্দ যখন তার কঠোর সমালোচনা ক’রে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সমর্থনপুষ্ট একদল ছাত্র বলে কথিত উচ্ছৃঙ্খল যুবক তাতে বাধা দেয় এবং ইসলামী শিক্ষানীতির সমর্থনে শ্লোগান দিতে থাকে। এর ফলে তুমুল হট্টগোল ও চেয়ার ছোড়াছুড়ি এবং পরে মারামারিতে ১৬ জন ছাত্র আহত হয়। এই আহতদের মধ্যে আবদুল মালেক নামে একজন পরে ১৫ই আগস্ট ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অপ্রীতিকর ঘটনাকে কেন্দ্র ক’রে “খ” অঞ্চলের (অর্থাৎ পূর্ব বাংলার) এক নম্বর সেক্টরের (ঢাকা বিভাগ)
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০৬

সামরিক প্রশাসক কর্তৃক সেদিনই (অর্থাৎ ১২ই আগস্ট, ’৬৯) জারীকৃত এক সামরিক নির্দেশের মাধ্যমে ‘ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভা-মিছিল ১৫ দিনের জন্য নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করা হয়।
পরদিন প্রদেশের ২৬ জন বিশিষ্ট নাগরিক ও ৩১ জন ছাত্রনেতা নয়া শিক্ষানীতির পরিবর্তন দাবী ক’রে সংবাদপত্রে দু’টি আলাদা আলাদা বিবৃতি দেন।
শেখ মুজিব তখন পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করছিলেন। ১৪ই আগস্ট তারিখে তিনি সদলবলে করাচী থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন। করাচী ত্যাগের প্রাক্কালে তিনি বিমান বন্দরে সাংবাদিকদেরকে বলেন, “একমাত্র জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রণীত শাসনতন্ত্রই পাকিস্তানের জনগণ গ্রহণ করবে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ই আগস্ট, ১৯৬৯]

শেখ মুজিব তাঁর করাচী সফর সফল হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। আগের দিন বুধবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেছিলেন, “জনসাধারণই ক্ষমতার মূল উৎস। আর তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অতি সত্বর নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। নতুন ফেডারেল আইনসভা একই সাথে আইনসভা ও গণপরিষদের অর্থাৎ শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করবে। গণপরিষদ হিসাবে ছয় মাসের মধ্যে তাঁকে একটি শাসনতন্ত্র জাতির সামনে পেশ করতে হবে।
……দলের ৬-দফা কর্মসূচী এবং ছাত্রদের ১১-দফা দাবীর ভিত্তিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ………১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে দেশের জনসাধারণের মূল সমস্যাগুলোর সমাধান নেই, তাই আওয়ামী লীগ তা’ পুনরুজ্জীবনের বিরোধী।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ই আগস্ট, ১৯৬৯]

১৯৬৯ সালের ১৫ই আগস্ট ভাইস এডমিরাল এস. এম. আহসানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং এয়ার মার্শাল এস. নূর খানকে পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে নিযুক্তির কথা ঘোষণা করা হয়।
এদিকে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও কতিপয় পশ্চিমা নেতা পুনরায় শেখ মুজিবের ৬-দফার সমালোচনা করতে শুরু ক’রে দেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০৭

১৯শে আগস্ট তারিখে জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো লাহোরে এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে ৬দফার বিরুদ্ধে তাঁর দলের মতামত প্রকাশ ক’রে বলেন যে, “সাবেক সিন্ধু এলাকা থেকে যারা দু’দফার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন তাঁদের জাতীয় একতা ও সংহতির উপর তাঁদের কার্যক্রমের প্রতিক্রিয়া হৃদয়ঙ্গম করা উচিত।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২১শে আগস্ট, ১৯৬৯]

এ সময় কতিপয় ধর্মান্ধ রাজনীতিবিদ ধর্মীয় জিগির তুলে সাম্প্রদায়িক প্রচার অভিযান চালাতে থাকেন।
এই অশুভ সাম্প্রদায়িক চক্রের বিরুদ্ধে শেখ মুজিব পুনরায় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। ২৩শে আগস্ট পাঠচক্রের উদ্যোগে রমনা রেস্টুরেন্টে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “জনগণের দাবী-দাওয়া যখনই উত্থাপিত হয়েছে, তখনই একটি অশুভ চক্র এই দাবী বানচাল করার জন্য সাম্প্রদায়িক ধুয়া তুলেছে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৪শে আগস্ট, ১৯৬৯]

উক্ত অনুষ্ঠানে শেখ মুজিব আবার বলেন, “দেশের মানুষ যে রক্ত দিয়ে আমাকে ফাঁসিকাষ্ঠ হতে বের করে এনেছে তাদের সঙ্গে আমি বেইমানী করতে পারি না।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৪শে আগস্ট, ১৯৬৯]

পরদিনও (২৪শে আগস্ট) শেখ মুজিব আবার ইসলাম ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের তীব্র নিন্দা করেন। হোটেল ইডেনে ‘ঢাকা জেলা বার সমিতি’র আওয়ামী লীগ দলীয় আইনজীবীদের এক সভায় ভাষণদান কালে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল মালেকের মর্মান্তিক মৃত্যর পর একটি চরমপন্থী রাজনৈতিক দল অপরাপর রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে এক নোংরা অপপ্রচার ও অভিযান শুরু করেছে। ইসলাম বিপন্ন বলে তারা জনসাধারণকে ধোঁকা দেবার চেষ্টা করছে। তারা মসজিদে মসজিদে সভা ক’রে অপরের ঘৃণা গীবত করছে যা ইসলামের নীতিবিরুদ্ধ।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৫শে আগস্ট, ১৯৬৯]
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০৮

শেখ মুজিব বলেন যে, ’৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময়ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের এসব দালালরা ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল, সচেতন জনগণের কাছে রাজনীতিতে মার খেয়ে তারা আজ আবার ইসলামকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের বিকল্প ব্যবস্থা নিয়েছে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৫শে আগস্ট, ১৯৬৯]

গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য জনমত গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি ক’রে শেখ মুজিব পুনরায় জনসংযোগ অভিযানে বের হলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৬৯ সালের আগস্ট মাসের ২৮ তারিখে প্রথমে গোপালগঞ্জে যাত্রা করেন। সেখানে আওয়ামী লীগ কর্মীদের সাথে মিলিত হবার পর তিনি ২৯শে আগস্ট (’৬৯) খুলনা যাত্রা করেন। খুলনায় তাঁকে বিপুলভাবে সম্বর্ধনা জানানো হয়। তাঁর আগমন উপলক্ষে সেখানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা ফজলুল হক, মানিক মিয়া প্রমুখের নামে ২০/২২ টি সুদৃশ্য তোরণ নির্মিত হয়েছিল।
খুলনা পৌরসভা মিলনায়তনে শহর আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক সম্বর্ধনা সভায় শেখ মুজিবকে রৌপ্য নির্মিত একখানি নৌকা উপহার দেয়া হয়। নৌকার হালে ‘সমাজতন্ত্র’ কথাটি লিখিত এবং পালে আওয়ামী লীগের পতাকা খচিত ছিল। পতাকায় আওয়ামী লীগের ৬-দফার প্রতীক স্বর্ণনির্মিত ৬টি তারকাও ছিল।
সম্বর্ধনা সভায় শেখ মুজিব ৬-দফা কর্মসূচীর সংগ্রামে তাঁর দলকে সাহায্য করার জন্য জনসাধারণকে আহ্বান জানান। তিনি পাটচাষীদের সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করার জন্য দাবী জানান।
৩০শে আগস্ট তারিখে শেখ মুজিব যশোরে গমন করেন এবং সেখানকার টাউন হলে আওয়ামী লীগ কর্মী সম্মেলনে তিনি দেশে শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমের সংকল্প প্রকাশ করেন। স্থানীয় টাউন হলে আওয়ামী লীগ কর্মীদের উদ্দেশ্য বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে শেখ মুজিব বলেন, “তাঁহার সমাজতন্ত্র দেশের প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করিয়া
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০৯

রচিত হইবে। অন্য কোন দেশ হইতে তিনি সমাজতন্ত্র ধার করিতে চান না। কারণ তাহা আমাদের সমাজের জন্য উপযোগী নাও হইতে পারে। সাম্য এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের উপরই আমাদের সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হইবে। এখানে আইনের চক্ষে সকলেই সমান বলিয়া পরিগণিত হইবেন। কিন্তু একশ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা ইসলামের আবরণে পুঁজিবাদী সমাজতন্ত্রের কথা প্রচার করিয়া বেড়াইতেছেন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৩১শে আগষ্ট, ১৯৬৯]

পূর্ব পাকিস্তানের গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কে জামাতে ইসলাম প্রধান মওলানা মওদুদীর বিভ্রান্তিকর মন্তব্যের জবাবে শেখ মুজিব কর্মী সমাবেশে জানান, “পূর্ব পাকিস্তানের গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কে মওলানা মওদুদীর বিন্দুমাত্র ধারণা নাই। নিজেদের হারানো অধিকার ফিরিয়া পাওয়ার জন্য প্রতিটি পূর্ব পাকিস্তানী এই আন্দোলনে শরিক হইয়াছিল।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯]

‘পশ্চিম বঙ্গের ইঙ্গিতেই পূর্ব পাকিস্তানে গত গণ-অভ্যুত্থান পরিচালিত হয়’ বলে জামাত প্রধান মওলানা মওদুদী সে সময় অভিযোগ করেছিলেন।
জামাতের অন্যতম নেতা মিয়া তোফায়েল আহমদ শেখ মুজিবকে কম্যুনিস্ট বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে শেখ মুজিব বলেন, “এই সকল নেতার অতীতের কার্যকলাপ সর্বজনবিদিত। কাজেই উহা নতুন করিয়া উল্লেখের প্রয়োজন নাই।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯]

৬-দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে বলে শেখ মুজিব পুনরায় জোর দিয়ে বলেন।
এই কর্মী সমাবেশে শেখ মুজিব “অবিলম্বে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন, জনসংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বিলোপের দাবী জানান। অনধিক ২৫ বিঘা জমির মালিক কৃষকদের খাজনা হইতে রেহাই দানের জন্যও তিনি দাবী জানান।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯]
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১০

৩১শে আগস্ট (১৯৬৯) শেখ মুজিব যশোরের ঝিনাইদহে আওয়ামী লীগ কর্মী সমাবেশে রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহারের মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে দেশের দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীবৃন্দের প্রতি এক হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এ সম্পর্কে শেখ মুজিব বলেন, “এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইসলামের পবিত্র নাম ব্যবহার করার চেষ্টায় মাতিয়াছেন, কিন্তু আমি তাঁহাদিগকে ধর্ম লইয়া খেলা না করার জন্য হুশিয়ার করিয়া দিতেছি। তাঁহাদের এই প্রচেষ্টা ধর্মের অবমাননা করারই শামিল হইবে।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯]

এই কর্মী সমাবেশে বক্তৃতাদান কালে শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক বিতর্ক থেকে ধর্মকে দূরে রাখার জন্য সকল দল ও মতের নেতা এবং কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।
স্বাধীনতা লাভের ২২ বৎসর পরেও জনগণের গ্রহণযোগ্য শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ ক’রে শেখ মুজিব দুঃখ প্রকাশ করেন। “জনসাধারণের প্রতিনিধিরাই শুধু শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিতে পারে বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯]

পূর্ব বাংলার বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতা এবং এই অঞ্চলের সকল শ্রেণীর মানুষের উপর অবিচারের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বলেন, “এই সরকারের আমলে লোকের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা এবং এই সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের জনসাধারণের প্রদত্ত রাজস্ব পশ্চিম পাকিস্তানেই শুধু খরচ করা হইয়াছে। মঙ্গলা এবং তারবেলা বাঁধের জন্য বিরাট অংকের অর্থ খরচ করা হইয়াছে, কিন্তু ফারাক্কা সমস্যার ব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয় নাই।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯]

এর আগে ২৯শে আগস্ট পূর্ব পাকিস্তানের ৪২ জন কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী জামাতে ইসলামীর বিরুদ্ধে ধর্মের নামে হিংসাত্মক কার্যকলাপে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১১

উস্কানী দানের এক অভিযোগ এনে পত্রিকায় যুক্ত বিবৃতি দান করেন। এই বিবৃতিতে তাঁরা শিক্ষানীতিকে কেন্দ্র ক’রে জামাতে ইসলামপন্থীদের ধর্মের নামে অপপ্রচারে দেশে বিষাক্ত পরিবেশ সৃষ্টির, তথাকথিত ইসলামপন্থী এবং ইসলাম-বিরোধী এই দুইটি কল্পিত গোষ্ঠী সৃষ্টির নামে প্রকাশ্য উস্কানী ও হুমকী প্রদানের এবং খসড়া শিক্ষানীতির সমালোচকদের ইসলাম-বিরোধী, পাকিস্তান-বিরোধী ও সংহতি-বিরোধী আখ্যাদানের কঠোর নিন্দা করেন। উক্ত ৪২ জন কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীবৃন্দ শিক্ষানীতি বিজ্ঞানসম্মত, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সহজলভ্য করার প্রস্তাব করেন। বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, “ধর্ম নিরপেক্ষতার অর্থ ধর্ম বিরোধিতা নয়। কিন্তু গোষ্ঠী বিশেষ ধর্মনিরপেক্ষতাকে ইসলাম বিরোধিতার নামান্তর বলিয়া ঠাওরাইয়া বসিয়াছে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯]

৩১শে আগষ্ট রবিবার শেখ মুজিব কুষ্টিয়া পৌঁছেন এবং দলীয় কর্মীদের এক ঘরোয়া সমাবেশে জনস্বার্থ বিরোধী বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। তিনি এই সমাবেশে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং একমাত্র ৬-দফার বাস্তবায়নের মাধ্যমেই পূর্ব বাংলার মানুষের ন্যায্য অধিকার লাভ সম্ভব বলে মন্তব্য করেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কুষ্টিয়াকে অবিলম্বে বন্যাদুর্গত এলাকা দাবী এবং সংশোধিত রেশনিং ব্যবস্থা চালু করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
১৯৬৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর এ্যাডমিরাল আহসান পূর্ব বাংলার গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তিনি এখানে এসে স্পষ্টভাবে তাঁর অভিমত ব্যক্ত ক’রে বলেছিলেন, “৭১ সালে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে।” তিনি আরও বলেছিলেন, “……এমন কি সাধারণ পদেও আমি এখানে আসতে উৎসাহী হতাম। এ পদে নিযুক্ত হতে পেরে আমি গর্বিত। এই পদ আমাকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সেবা করার দায়িত্ব দিয়েছে। আমি সকলের কল্যাণের জন্য এ প্রদেশের নাগরিকদের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।”
[পূর্বদেশ, ২রা সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯]
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১২

গভর্নর আহসান ছিলেন একজন ভদ্র, বিনয়ী ও যুক্তিবাদী সামরিক ব্যক্তি। পূর্ব বাংলার একচ্ছত্র গণনেতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর ছিল গভীর শ্রদ্ধা। তিনি সাধ্যানুসারে এখানে জনকল্যাণমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু অতীতে জেনারেল আযম খানকে যে ভাগ্য বরণ করতে হয়েছিল, আহসানের ভাগ্যেও তার ব্যতিক্রম ঘটলো না, তাঁকেও একইভাবে বিদায় নিতে হয়েছিল।
ঐ দিন কুষ্টিয়া থেকে ফরিদপুর যাত্রার প্রাক্কালে মাগুরায় শেখ মুজিব দলীয় কর্মীদের এক ঘরোয়া সমাবেশে ভাষণ দেন।
একই দিনে ১লা সেপ্টেম্বর (’৬৯) ফরিদপুরে দলীয় কর্মীদের এক ঘরোয়া সমাবেশে শেখ মুজিব দেশে আশু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবীর কথা পুনরায় উল্লেখ করেন। ৬-দফা কর্মসূচী বাস্তবায়নের ওপরেই দেশের সমস্যাবলীর সমাধান সম্ভব বলে তিনি উল্লেখ করেন।
২রা সেপ্টেম্বর শেখ মুজিব রাজবাড়ীতে স্থানীয় একটি সিনেমা হলে দলীয় কর্মীদের এক সমাবেশে ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি বন্যা সমস্যা এবং ফারাক্কা বাঁধ সমস্যা প্রসঙ্গে সরকারী নীতির সমালোচনা করেন।
ঐদিন সকালে এক বিশেষ আমন্ত্রণে শেখ মুজিব ফরিদপুর প্রেসক্লাবে যান এবং প্রেসক্লাবের সদস্যদের প্রতি এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি “সংবাদপত্রকে গণতন্ত্রের অপরিহার্য অঙ্গ বলিয়া অভিহিত করিয়া সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সাংবাদিকদের দেশ ও জাতির স্বার্থরক্ষার অতন্দ্র প্রহরী বলিয়া আখ্যায়িত করিয়া তিনি বলেন, আমাদের সাংবাদিকরা যেভাবে গণ-অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করিয়াছে, দেশের ইতিহাসে উহা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকিবে। এ প্রসঙ্গে তিনি মরহুম তোফাজ্জল হোসেনের (মানিক মিয়ার) নামোল্লেখ করিয়া তাঁহার প্রতি প্রাণঢালা শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৩রা সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯]

এই সংক্ষিপ্ত ভাষণে শেখ মুজিব সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের দাবী প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সহযোগিতা দানের আশ্বাস দেন।
সপ্তাহকালব্যাপী খুলনা, যশোহর, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর জেলা সফর শেষে শেখ মুজিব ২রা সেপ্টেম্বর তারিখে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১৩

৯ই সেপ্টেম্বর (’৬৯) চট্টগ্রামে শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনবোধে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা শুরু করার জন্য অবিলম্বে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি পূর্ব বাংলাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সমান অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবীর পুনরুল্লেখ করেন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে অব্যাহতি এবং কারামুক্তির পর সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম সফরকালে শেখ মুজিব স্থানীয় বার লাইব্রেরী হলে এক সমাবেশে উপরোক্ত আহ্বান ও দাবীর পুনরুল্লেখ করেন। এই সমাবেশে তিনি ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করার বিরোধিতা করেন।
চট্টগ্রামের উক্ত আইনজীবী সমাবেশে শেখ মুজিব দেশে দু’টো পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থা প্রচলন সম্পর্কিত তাঁর দাবীর প্রতি বিভিন্ন মহল থেকে নানা সমালোচনার জবাবে বলেন, তাঁর আসল বক্তব্য হচ্ছে পূর্ব বাংলা থেকে মূলধন পাচার বন্ধের সুনিশ্চিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৯ই সেপ্টেম্বর (’৬৯) পাকিস্তান গণতান্ত্রিক পার্টির লাহোর শাখা কর্তৃক লাহোর গেটের অভ্যন্তরে আয়োজিত পার্টি-কর্মীদের এক সমাবেশে নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান এবং এয়ার মার্শাল আসগর খান ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র লঙ্ঘনের অভিযোগে আদালতে সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিচার করার আহ্বান জানান। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে শাসনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তাঁর পদে ইস্তফাদানের পূর্বে জাতীয় পরিষদের স্পীকারকে পত্রযোগে অবহিত করেন নি।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯]

১১ই সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চট্টগ্রামে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে দেশে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর দলের ইচ্ছার কথা উল্লেখ করেন। দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বলেন, “এই সমাজতন্ত্র আমরা রাশিয়া বা চীন হইতে আমদানী করিব না। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশের নিজস্ব প্রয়োজন মত দেশজ সম্পদের ভিত্তিতেই উহা গড়িয়া
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১৪

তুলিবেন। এই দেশজ সম্পদ বলিতে আমার দল দেশের পারিপাশ্বিকতা, ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতি, জীবনের প্রতি মনোভাব, জাতীয় সম্পদ ও দেশের মানুষের প্রতিভাকে বুঝায়।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ই সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯]

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন, “তিনি বাম বা দক্ষিণপন্থী কোনটাই নহেন। তিনি হইতেছেন মধ্যমপন্থী।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ই সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯]

১০ই সেপ্টেম্বর (১৯৬৯) চট্টগ্রামে স্থানীয় মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে দলীয় এক কর্মী সমাবেশে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অবিচার রোধ করার জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। সামরিক দিক দিয়া পূর্ব পাকিস্তানকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ক’রে তোলার জন্য তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। ১৯৪৭ সাল থেকে আইয়ুব সরকারের ডিকেডী আমল পর্যন্ত বৈষম্যক্ষেত্রে শেখ মুজিব নিম্নোক্ত তথ্য প্রকাশ করেনঃ
(ক) প্রতিরক্ষা ও প্রশাসন ক্ষেত্রে মোট ব্যয় ৩ হাজার ২ শত কোটি টাকা—পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় ৩ শত ৩ কোটি টাকা।
(খ) ২২ বছরে মোট ২ হাজার ২ শত কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন—পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় মাত্র ৬ শত কোটি টাকা।
প্রতিরক্ষা ও ব্যবসায়-বাণিজ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ মাত্র ১৫ থেকে ২০ ভাগ। শেখ মুজিব এই বৈষম্যকে পুরোপুরি বে-ইনসাফ বলে অভিহিত করেন।
এই সমাবেশে শেখ মুজিব জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে সংখ্যাসাম্য নীতি মেনে চলার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
[দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯]

১১ই সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতাকালে শেখ মুজিব বলেন যে, “তিনি নিজে গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক এবং গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পরস্পরবিরোধী নয়। এক প্রশ্নের উত্তরে শেখ সাহেব বলেন যে, কেবল মাত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই একটি স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১৫

এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে সুনিশ্চিত করা যাইতে পারে। কেননা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জনগণের রায় চূড়ান্ত বলিয়া পরিগণিত হয় এবং কোন প্রকার কারসাজিই জনগণের প্রকৃত রায়দান হইতে বিরত করিতে পারে না।
এই গণতন্ত্রকে অবশ্যই নির্ভেজাল ও সরল হইতে হইবে বলিয়া শেখ সাহেব উল্লেখ করেন।”
[ দৈনিক আজাদ, ১২ই সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯]

কায়েদে আযমের ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে লাহোরে ‘আরাফাত আল ইসলামিয়া’ হলে পার্টি-কর্মীদের এক সভায় পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা এয়ার মার্শাল আসগর খান পাকিস্তান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করার জন্য গণবাহিনী গড়ে তোলার ব্যাপারে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্ট আইয়ুব গণবাহিনী গঠন পছন্দ করতেন না, কারণ তিনি সেই সময় জনগণের আস্থা হারাইয়াছিলেন।”
১৯৬৯ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর সামরিক সরকার পশ্চিম পাকিস্তানকে লেঃ গভর্নর শাসিত সাতটি অঞ্চলে বিভক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই “সংশ্লিষ্ট অঞ্চলসমূহ করাচী অঞ্চল, হায়দ্রাবাদ অঞ্চল, মুলতান অঞ্চল, পেশোয়ার অঞ্চল, রাওয়ালপিণ্ডি অঞ্চল, লাহোর অঞ্চল, কোয়েটা অঞ্চল নামে অভিহিত হইবে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯]

বিবরণে প্রকাশ, পাকিস্তানের সাবেক বিচারপতি জনাব ফজলে আকবরের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশে এই স্কীম বাস্তবায়িত হবে।
১৮ই সেপ্টেম্বর শেখ মুজিব ঢাকার কচুক্ষেত আওয়ামী লীগ কার্যালয় উদ্বোধন করেন। দলীয় কর্মীদের প্রতি ভাষণে তিনি স্বায়ত্তশাসন আদায়ের সংগ্রামে দেশের যুব সমাজকে সংঘবদ্ধ হবার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত এবং অবসরপ্রাপ্ত সি. এস. পি. অফিসার জনাব আহমদ ফজলুর রহমান এবং জনাব রুহুল কুদ্দুস ২০শে সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। তাঁদের আওয়ামী লীগে যোগদান উপলক্ষে ঐদিন ঢাকা আওয়ামী লীগ অফিসে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১৬

আয়োজিত এক পরিচিতি সভায় শেখ মুজিব একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দান করেন। ভাষণে তিনি আওয়ামী লীগকে সকল স্বার্থ এবং লোভের উর্ধ্বে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলে অভিহিত করেন। শেখ মুজিব বলেন, “আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীবৃন্দ সব সময়ই সামরিক বিধি কিংবা দেশরক্ষা আইনে কারাবরণ করে আসছে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দল আওয়ামী লীগকে তিনি ‘সোহরাওয়ার্দীর পরিবারের’ সন্তান বলে অভিহিত করেন।
গত ২২ বছরেও দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হবার কারণ সম্পর্কে শেখ মুজিব বলেন যে, সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হ’লে কায়েমী স্বার্থবাদীদের শাসন এবং শোষণের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।
২১শে সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে এক দিনের সফরে শেখ মুজিব মাদারীপুরে পৌঁছেন। এই সফরসূচীতে মাদারীপুর পাবলিক হলে এক কর্মী-সম্মেলনে শেখ মুজিবের ভাষণ দানের কথা ছিল। কিন্তু স্থানীয় সরকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উক্ত সম্মেলনে মাইক ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার প্রতিবাদে শেখ মুজিব উক্ত সম্মেলন বাতিল ঘোষণা করেন। স্থানীয় সরকারী কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি প্রাদেশিক গভর্নর এবং পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসন পরিচালকের নিকট তারর্বাতা পাঠান।
২২শে সেপ্টেম্বর শেখ মুজিব মাদারীপুর পাবলিক লাইব্রেরী হলে এক শ্রমিক সমাবেশে ভাষণ দেন। এই সমাবেশে তিনি পূর্ব বাংলার ‘ভাগ্য বিড়ম্বনা’, ‘বঞ্চনা’, ‘বৈষম্য’ ও ‘দুর্ভোগের’ জন্য স্বার্থান্ধ এক শ্রেণীর দালালদের দায়ী করেন। তিনি বলেন, “মন্ত্রিত্ব ও ক্ষমতার লিপ্সায়, পুঁজিপতি ও কায়েমী স্বার্থের এই সব দালাল পূর্ব পাকিস্তান ও জনগণের স্বার্থ বিকাইয়া দিতে কোনদিনই বিবেকের কাছে নিজেকে দোষী মনে করে নাই। তিনি বলেন, আসলে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ নয়, বরং ঐ অঞ্চলের কায়েমী স্বার্থবাদী ও পুঁজিপতিদের ক্রীড়নক এই প্রদেশের দালালরাই আপনাদের সকল দুর্দশার জন্য দায়ী। তেমনিভাবে পশ্চিম পাকিস্তানেও কিছুসংখ্যক দালালের
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১৭

সহায়তায় জনগণের রক্ত শোষণ করিতেছে। সকল স্তরের জনসাধারণের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে এই সব দালালদের এমন শিক্ষা দিন যেন এদেশের মাটিতে দাঁড়াইয়া আর কেহ কোনদিন দালালী করার সাহস না পায়।’
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৩শে সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯]

“বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যদা দান”, “স্বায়ত্তশাসন”, “জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব”, “এক ইউনিট বিলোপ” এবং “বন্যা নিয়ন্ত্রণের” দাবী তুললে যারা ইসলাম বিপন্ন বলে ধুয়া তুলেন তাঁদের কঠোর সমালোচনা ক’রে শেখ মুজিব শ্রমিক সমাবেশে বলেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়ার পর ইসলাম বিপন্ন হয় নি, কাজেই বৈষম্যের ক্ষেত্রে, অন্যান্য ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবী সরকার মেনে নিলেও ইসলাম বিপন্ন হবে না।
২৪শে সেপ্টেম্বর (১৯৬৯) শেখ মুজিব ঢাকায় সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে ভারতের আহমদাবাদে সংঘটিত সাম্প্রতিক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার নিন্দা করেন। বিবৃতিতে তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রোধে ত্বরিৎ ব্যবস্থা এবং ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের জানমালের নিরাপত্তা দানের জন্য ভারত সরকারের প্রতি আবেদন জানান।
২৮শে সেপ্টেম্বর এক সংক্ষিপ্ত সফরে শেখ মুজিব নোয়াখালী যান এবং চৌমুহনী, ফেনী ও মাইজদী কোর্টে দলীয় কর্মী ও ছাত্র সমাবেশে ভাষণ দান করেন।
চৌমুহনীর কর্মীসভায় শেখ মুজিব বন্যানিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের প্রতি কার্যকরী ব্যবস্থা, এবং কৃষক ও মেহনতী মানুষের বকেয়া কর মওকুফের জন্য আবেদন জানান। শেখ মুজিব সরকারের নিকট অভিযোগ জানিয়ে বলেন, “শিল্পপতিরা সরকারের নিকট হইতে কর মওকুফসহ বিভিন্ন সুযোগ পাইতেছেন, তখন কৃষক ও মেহনতী মানুষ কর ও খাজনার ভারে জর্জরিত হইতেছে এবং বকেয়া পাওনা আদায়ের জন্য তাহাদের উপর নির্যাতন চালানো হইতেছে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯]

চৌমুহনী থেকে শেখ মুজিব ঐদিন মাইজদী কোর্টে যান এবং এক ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা করেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১৮

ঐ দিনই ফেনীতে আয়োজিত এক কর্মীসভায় শেখ মুজিব প্রদেশের সকল শহর এবং মফস্বলে পূর্ণাঙ্গ ও সংশোধিত রেশনিং ব্যবস্থা চালু করার জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানান। কর্মী সমাবেশে তিনি সবরকম উস্কানীর মুখেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানান।
এদিকে প্রধান নির্বাচনী কমিশনার চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রস্তুতের জন্য নির্দেশ দান করলেন। ১৯৬৯ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় এলেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন যে, নেতৃ-সম্মেলন ডাকতে তিনি রাজি আছেন। তবে শাসনতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর নিজেরও চিন্তাভাবনা রয়েছে। উপযুক্ত সময়ে তিনি তা’ প্রকাশ করবেন; তবে সে সময় এখনও আসেনি। ইয়াহিয়া খানের এ রকম উক্তিতে দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ বিস্মিত না হয়ে পারলেন না। দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সমগ্র দেশের মানুষের বক্তব্যই প্রাধান্য লাভ করবে, দু’একজনের খেয়াল-খুশীতে একটি দেশের শাসনতন্ত্র প্রণীত হতে পারে না। দেশের গণ-চেতনার প্রকাশ ঘটতে পারে একমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে একনায়কত্বের মাধ্যমে নয়। যে নির্বাচনের কথা ইতিমধ্যে ইয়াহিয়া একাধিকবার ঘোষণা করেছেন সেই নির্বাচন সম্পন্ন হ’লে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণই দেশের সংবিধান প্রণয়ন করবেন। দেশের সংবিধান কারো খেয়াল খুশীর সৃষ্টি হতে পারে না। সুতরাং দেশের শাসনতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর নিজের একটি ধারণা আছে, ইয়াহিয়া খানের এইরূপ উক্তিতে ভবিষ্যৎ অশুভ কারসাজির ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ব্যাপারটি উপলদ্ধি করতে কোন অসুবিধা হ’ল না।
এদিকে দুইদিনব্যাপী নোয়াখালী সফর শেষে শেখ মুজিব ২৮শে সেপ্টেম্বর সোমবার গভীর রাতে সদলবলে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। নেতৃবৃন্দ দুই দিনের সফরে ফেনী, চৌমুহনী, মাইজদী কোর্ট, রায়পুরা, রামগঞ্জ এবং লক্ষীপুরে কর্মি সভায় বক্তৃতা করেন।

খাদ্য সমস্যা সমাধানের প্রয়াস
৩রা অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁর পাঁচ দিনব্যাপী প্রদেশ সফর শেষে রাওয়ালপিণ্ডির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। ঢাকায় অবস্থানকালীন সময়ে তিনি এদেশবাসীর সামনে নিজেকে বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত করবার প্রয়াস পান। কারণ ১লা অক্টোবর, ১৯৬৯ তারিখে তাঁর
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১৯

সভাপতিত্বে ঢাকায় দেশের সমস্ত গভর্নরদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য হ্রাসের উপায় সম্পর্কে এবং দেশের খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ ব্যাপারে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ ৩রা অক্টোবরের সমস্ত দৈনিক পত্রিকায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়। সংবাদসমূহে পূর্ব বাংলার ১৫ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতি পূরণের ব্যাপারে বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণের জন্য সরকারী সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশিত হয়। প্রকাশ থাকে যে, প্রদেশে তখন সাংঘাতিক খাদ্য সঙ্কট বিরাজমান ছিল এবং সরকারী সক্রিয় পদক্ষেপে অবস্থার উন্নতি হবে এই ভরসা সকলের মনে দেখা দিয়েছিল।

ছাত্রনেতৃবৃন্দের মুক্তি
তদুপরি যে ছয়জন ছাত্র নেতৃবৃন্দকে সামরিক বিধি লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল—তাঁদের প্রতি তিনি মার্জনা ঘোষণা করেন। এই ছয়জন ছাত্রনেতা ছিলেন তোফায়েল আহমদ, আ. স. ম. আবদুর রব, মোস্তফা জামাল হায়দার, মাহবুবুল্লাহ, শামসুদ্দোহা ও ইব্রাহিম খলিল। এঁদের মামলা প্রত্যাহার ক’রে নেবার জন্য পূর্বাহ্নেই শেখ মুজিব প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে তাজউদ্দিন আহমদও একটি বিবৃতি দেন।

তাজউদ্দিনের বিবৃতি
২রা অক্টোবর (১৯৬৯) তারিখে এ সম্পর্কে পত্রিকায় লেখা হয়, “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ছাত্র সমাজের সংগে স্বাভাবিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ছয়জন ছাত্রনেতাসহ ছাত্রদের বিরুদ্ধে আনীত সমস্ত মামলা প্রত্যাহারের জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানাইয়াছেন।” আরও বলা হয়ঃ
“গতকাল (বুধবার) সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন যে, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ইতিমধ্যেই ছাত্রদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার করিয়া স্বাভাবিক পরিস্থিতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন। আওয়ামী লীগ সম্পাদক বলেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা বিমান বন্দরে ‘ছাত্ররা
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২০

আমাদেরই সন্তান’ বলিয়া যে মন্তব্য করিয়াছিলেন, উহা হইতে তাঁহার দরদী মনোভাবেরই পরিচয় পাওয়া গিয়াছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, এই মনোভাবের প্রতি বিশ্বস্ত থাকিয়া আইনগত কড়াকড়ির পরিবর্তে পিতৃসুলভ বাৎসল্য ও সহনশীলতার সঙ্গে ছাত্র সমস্যা বিবেচনা করা হইবে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২রা অক্টোবর, ১৯৬৯]

প্রেসিডেন্টের ঢাকা ত্যাগের অব্যবহিত পূর্বে প্রদত্ত এই ঘোষণা সম্পর্কে অধিকন্তু লেখা হয়েছিল, “প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান বিগত ১৫ই সেপ্টেম্বর হইতে একাধিক সময়ে সামরিক আইন বিধি লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত ছাত্রদের মার্জনা করিয়া দিয়াছেন। গতকাল (বৃহস্পতিবার) ঢাকায় প্রদত্ত এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট এই মার্জনার কথা ঘোষণা করেন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৩রা অক্টোবর, ১৯৬৯]

ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ
এ ছাড়া গত ২৮শে জুলাই জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণে তিনি নির্বাচন এবং গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের যে কর্মসূচীর কথা বলেছিলেন বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট তার প্রতি অবিচল থাকার সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেন। দেশের সকল সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিবৃতিটি এইরূপ ছিলঃ “এই সুযোগে আমি আরেকবার বলিতে চাই যে, বিগত ২৮শে জুলাই জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত বেতার ভাষণে নির্বাচন ও নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের যে কর্মসূচীর কথা আমি উল্লেখ করিয়াছি, উহাতে অবিচল থাকিতে আমি গভীরভাবে আগ্রহশীল। সুতরাং আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাইতে পারি যে, বে-আইনী কার্যকলাপ, উচ্ছলতা এবং সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এবং সামরিক আইনবিধি ও নির্দেশ ভঙ্গের জন্য অন্যদের প্ররোচিত করার কাজে লিপ্ত ব্যক্তিরা আসলে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের সামনে বিরাজমান জাতীয় লক্ষ্যকেই বানচাল করিয়া দিতে চায়। আমি ইহা হইতে দিতে পারি না। আমি আগেও বলিয়াছি, পাকিস্তানের যেই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমষ্টি শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক জীবন যাপনে এবং নিজেদের পছন্দমত একটি নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী, তাহাদের প্রতিই আমার প্রধান দায়িত্ব।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২১

সুতরাং দেশের স্বার্থে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ যে কাজ শুরু করিয়াছেন, উহাতে বিঘ্ন সৃষ্টির যে কোন প্রচেষ্টা কঠোর হস্তে দমন করা হইবে। পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগের প্রাক্কালে আমি এই মর্মে দৃঢ় আশা প্রকাশ করিতেছি যে, দেশে শান্তিপূর্ণভাবে সুস্থ গণতান্ত্রিক জীবনধারা প্রচলনে বাধা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ব্যক্তিদের খপ্পরে না পড়িয়া ছাত্রসহ সর্বশ্রেণীর জনগণের সাধারণ আদর্শ ও উদ্দ্যেশ্য হাসিলের প্রচেষ্টায় সরকারকে সাহায্য করিবেন।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৩রা অক্টোবর, ১৯৬৯]

প্রেসিডেন্টের ২৯শে সেপ্টেম্বরের বক্তব্যের সঙ্গে নির্বাচনের প্রশ্নে এই বক্তব্যের সামঞ্জস্য আছে। শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে প্রেসিডেন্টের ২৯শে সেপ্টেম্বরের বক্তব্যে যে অশুভ ইঙ্গিত প্রকাশ পেয়েছিল, সে সম্পর্কে শেখ মুজিব সচেতন ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক তৎপরতা
এ সময় প্রেসিডেন্টের কার্যকলাপের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তার আভাস পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগের সাথে সাথে অন্যান্য প্রগতিশীল দলগুলো যেমন, প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোও তেমনি এক বাক্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছিলেন। এ সমস্ত দলের ওপর ভরসা রেখেই সম্ভবতঃ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে নিশ্চয়তামূলক মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন। পূর্ব বাংলার এই সব অবাঞ্ছিত রাজনৈতিক দলসমূহের কার্যকলাপ এবং শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে প্রেসিডেন্টের অশুভ ইঙ্গিত প্রভৃতিকে উপেক্ষা ক’রে এই সময় শেখ মুজিব সাংগঠনিক তৎপরতার দিকে বিশেষভাবে মনোযোগ দেন।
ইতিমধ্যেই তিনি প্রদেশের এক অংশ সফর করেছিলেন। এবার তিনি উত্তরাঞ্চল সফর শুরু করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ৭ই অক্টোবর বগুড়ার পথে রওয়ানা হন। এ সম্পর্কে দৈনিক পত্রিকায় লেখা হয়ঃ “আজ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বগুড়া রওয়ানা হচ্ছেন। তিনি বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুরে এক সপ্তাহব্যাপী সফর করবেন এবং বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত কর্মীসভায় বক্তৃতা করবেন।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৭ই অক্টোবর, ১৯৬৯]
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২২

যেহেতু জনসভা অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ ছিল, তাই তাঁর সফর উপলক্ষে এই সমস্ত স্থানে কর্মীসভার আয়োজন করা হয়। কিন্তু এই সব দলীয় কর্মীসভায় প্রচুর লোক সমাগম হতে থাকে এবং তিনি বিপুলভাবে সম্বর্ধিত হন। এই সমস্ত কর্মিসভার মাধ্যমে একদিকে তিনি বিভিন্ন স্থানের দলীয় ইউনিটসমুহ সুদৃঢ় করছিলেন, অপরদিকে দলীয় মনোভাব ব্যাখ্যা ক’রে ৬-দফার অনুকূলে জনমত সংগঠনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। একই সাথে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে বিভিন্ন দল যে সমস্ত মনোভাব ব্যক্ত করেছে তিনি সে সম্পর্কেও যথোচিত জবাব প্রদান করেন।

শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে বিভিন্ন দলের মত
এই সময় যে সকল দল প্রেসিডেন্টের প্রতি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার জন্য আহ্বান জানান তার মধ্যে জামাতে ইসলামী, পি. ডি. পি. প্রভৃতি দল। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে জোরের সাথে কথা বলেন। আবার পি. ডি. পি., ওয়ালী ন্যাপ, ভাসানী ন্যাপ জনগণের স্বার্থ আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আহ্বান জানাতে থাকেন। মওলানা ভাসানী শাসনতান্ত্রিক ঐক্যমত প্রতিষ্ঠার জন্য গোলটেবিল বৈঠকের কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেনঃ “শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে একটি সমাধান খুঁজে বের করার জন্য প্রেসিডেন্টের উচিত রাজনৈতিক নেতাদের একটি গোলটেবিল বৈঠক ডাকা।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৭ই অক্টোবর, ১৯৬৯]

ওয়ালী ন্যাপঃ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব
ওয়ালী ন্যাপের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠারও দাবী জানানো হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক জনাব মাহমুদুল হক উসমানী ১লা অক্টোবরে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের বার্ষিক কাউন্সিল সভার উদ্বোধনী অধিবেশনে যে অভিমত প্রকাশ করেন তা’ বেশ কৌতুহলোদ্দীপক। এ সম্পর্কে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় লেখা হয়ঃ “জনাব উসমানী নির্বাচন পরিচালনা এবং দৈনন্দিন সরকারী দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সমবায়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠারও দাবী জানান। তিনি বলেন, যেহেতু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানী জনগণের আশা
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২৩

আকাক্ষার প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন, সেহেতু এদেশে তাঁহার নেতৃত্বেই বেসামরিক সরকার গঠিত হওয়া উচিত। পশ্চিম পাকিস্তানেও একই ধরনের ব্যবস্থা গৃহীত হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১লা অক্টোবর, ১৯৬৯]

শেখ মুজিব ১২ই অক্টোবর (’৬৯) ঠাকুরগাঁয়ে দলীয় কর্মীসভায় বক্তৃতা দানকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেন। বক্তৃতায় তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন যে, সাধারণ নির্বাচনের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্রই জনসাধারণ বরদাশত করবে না। সংবাদপত্রে তাঁর বক্তৃতার যে বিবরণ ছাপা হয় তা’ নিম্নরূপঃ “শেখ মুজিব বলেন যে, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে পার্লামেন্টারী ধরনের সরকার কায়েমের জন্য জনসাধারণ বিগত ২২ বৎসর যাবৎ অবিরাম সংগ্রাম করিয়া আসিতেছে। শেখ মুজিব বলেন যে, জনসাধারণের ত্যাগ স্বীকার বৃথা যাইবে না। তিনি বলেন যে, অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত অধিকার আদায়ের আন্দোলন অব্যাহত থাকিবে। নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা প্রণীত শাসনতন্ত্র ছাড়া জনসাধারণ কোন শাসনতন্ত্র গ্রহণ করিবে না বলিয়া শেখ মুজিব উল্লেখ করেন।
দেশের বিভিন্ন সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া শেখ মুজিব বলেন যে, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি ছাড়া কোন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে এই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। শেখ মুজিব অনতিবিলম্বে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দাবী জানাইয়া বলেন যে, “নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণাই বর্তমান সরকারের প্রধান দায়িত্ব।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ই অক্টোবর, ১৯৬৯]

শাসনতন্ত্রঃ আগুন নিয়ে খেলা
৯ই অক্টোবর রংপুর ছাত্রলীগ কর্মীসমাবেশে ভাষণ প্রসঙ্গে ’৫৬ সালের শাসনতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের সমালোচনা ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সম্পর্কে তিনি মত প্রকাশ করেছিলেন। একটি দৈনিকে পরিবেশিত খবর নিম্নরূপ ছিলঃ “আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের কঠোর সমালোচনা করেন এবং এই মর্মে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন যে, যাঁহারা এই শাসনতন্ত্র জনগণের উপর পুনরায় চাপাইয়া দেওয়ার
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২৪

প্রচেষ্টায় নিয়োজিত আছেন, তাঁহারা আগুন নিয়া খেলিতেছেন। আওয়ামী লীগ প্রধান ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সম্ভাবনা অস্বীকার করেন এবং অবিলম্বে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের জন্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী জানান।”
[ দৈনিক আজাদ, ১০ই অক্টোবর, ১৯৬৯]

জনসভা থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবীঃ শেখ মুজিব
তাঁর প্রদত্ত সকল ভাষণের দ্বারা শেখ মুজিব তথাকথিত শাসনতান্ত্রিক সঙ্কটের অবাস্তবতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন ক’রে তোলেন। এসব সময় তিনি জনসভার ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের জন্য বারবার আহ্বান জানান। এ প্রসঙ্গে ১৩ই অক্টোবর দিনাজপুর জেলার পঞ্চগড়ের এক দলীয় সমাবেশে শেখ মুজিব যে সব কথা বলেন সেগুলো বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। শেখ সাহেব বলেন, “যে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় নাই, সে ক্ষেত্রে জনসভার উপর বিধিনিষেধ আরোপের কোন যুক্তি থাকিতে পারে না। তিনি বলেন, দেশবাসীর নিকট আমাদের বক্তব্য সঠিকভাবে তুলিয়া ধরার সুযোগ প্রদানের জন্যই জনসভা অনুষ্ঠানের উপর হইতে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার হওয়া দরকার। তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উদ্দেশে বলেন, “আমি দেশবাসীর কাছে আমার বক্তব্য পেশ করিতে চাই—তারাও আমার বক্তব্য শুনিতে চায়। সুতরাং অবিলম্বে জনসভা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করুন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ই অক্টোবর, ১৯৬৯]

সংগঠনে কর্মীদের প্রতি কঠোর নির্দেশ
শেখ মুজিব ‘অতি ডান’ এবং ‘অতি বাম’-পন্থীদের নির্বাচন বিরোধী চক্র হিসাবে চিহ্নিত করেন। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হ’লে নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে, এটা ভেবেই তারা ‘শাসনতান্ত্রিক সঙ্কটের মিথ্যা অস্তিত্ব আবিষ্কারে তৎপর হয়েছে—সে সম্পর্কেও তিনি জনগণকে এই সব সভায় সচেতন ক’রে তোলেন।
সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এই দলকে ব্যাপকতর গণসংগঠনে পরিণত করার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন। এ ব্যাপারে তিনি আওয়ামী লীগ কর্মীদেরকে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২৫

আগামী ৩০শে নভেম্বরের পূর্বেই ইউনিয়ন পর্যায়ে দলীয় সাংগঠনিক কার্য সমাপ্ত করার নির্দেশ দেন। এমনকি তিনি দলীয় কর্মীদেরকে এই মর্মে সতর্ক করেও দেন যে, যদি কোন জেলা তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী দলকে সুসংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা গৃহীত হবে।
১২ই অক্টোবর (১৯৬৯) তারিখে ঢাকায় জাতীয় শ্রমিক লীগ গঠন সম্পন্ন হয়। এদেশের গণ-আন্দোলনে কৃষক, ছাত্র ও অন্যান্য শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকা সব সময়ই ছিল প্রশংসনীয়। এক্ষেত্রে দেশের শ্রমিক শ্রেণীকে সংগঠিত ক’রে ইপ্সিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবার প্রস্তুতি হিসেবে শ্রমিক লীগের প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। দেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থান করবার কারণে শেখ মুজিব শ্রমিক লীগের প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারেন নি। তবে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে তাঁর প্রেরিত বাণী পাঠ করা হয়। এই বাণীতে তিনি বলেন, “যে দিন ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের সমস্যার সমাধান হইবে সে দিনই হইবে আমার রাজনৈতিক জীবনের সার্থকতা। আর সে জন্য প্রয়োজন ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকের একতা। একতা ও বলিষ্ঠতার মধ্য দিয়াই আমরা আমাদের দাবীকে প্রতিটি শ্রমিক-কৃষকের নিকট প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিব। ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকের নিকট আমার আবেদন, ঐক্যবদ্ধ হউন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়িয়া তুলুন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ অক্টোবর, ১৯৬৯]

এই বাণীতে তিনি আরো উল্লেখ করেন, “আজকের এই মুহূর্তে সারা দেশে শাসনতান্ত্রিক সঙ্কট দেখা দিয়াছে। এ সঙ্কট হইতে মুক্তি পাইবার একটি মাত্র পথ ৬-দফা মোতাবেক আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন কায়েম, পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বিলোপ ও জনসংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্ব। একমাত্র প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরাই দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষানুরূপ শাসনতন্ত্র রচনা করিতে পারে। অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন আমাদের দেশের সম্পদের উপর নির্ভরশীল হইয়া, এদেশের মানুষের মনোভাব অনুযায়ী সামাজিক রীতিনীতির স্বীকৃতি দিয়া এবং জনসাধারণের সম্মতি নিয়া সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্য দিয়া দেশের অর্থনীতি ঢালাই করিয়া সাজাইতে হইবে। রাশিয়া বা চীন
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২৬

হইতে সমাজতন্ত্রকে আমদানী না করিয়া বা অন্য কোন বিদেশী রাষ্ট্রের অনুকরণ না করিয়া গণতান্ত্রিক চেতনাবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হইয়া এদেশের প্রয়োজনে শোষণহীন গণতান্ত্রিক সমাজবাদ স্থাপনের মধ্যেই এদেশের মানুষের মুক্তি নিহিত। রক্তচক্ষুর শাসন নয়, একচেটিয়া পুঁজিবাদের শোষণ নয়, এক সুখী-সুন্দর-বলিষ্ঠ জাতীয়তাবাদী শোষণহীন সমাজ গড়িয়া তোলাই আমাদের লক্ষ্য।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ই অক্টোবর, ১৯৬৯]

“শ্রমিক লীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে প্রেরিত বঙ্গবন্ধুর এই বাণী নানাদিক থেকে উল্লেখের দাবী রাখে। একদিকে তিনি গণতন্ত্রের পূজারী, অন্যদিকে তিনি সমাজতন্ত্রের অনুসারী। এই দুই আদর্শই তাঁর জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। তাঁর রাজনৈতিক হৃদয় এই দুই আদর্শের জলবায়ুতেই লালিত ও পরিবর্ধিত। তিনি এমন একটা সমাজব্যবস্থা কামনা করেন যেখানে শোষণ থাকবে না অথচ সত্য-ভাষণের অধিকারও বিঘ্নিত হবে না। তিনি চান শোষণহীন সমাজ, তিনি চান ব্যক্তির অধিকার-প্রতিষ্ঠিত একটি সমাজ। এই বাণীতে তাঁর সেই মানসিকতারই প্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু এই সত্যকে একটি ঘোষণা হিসেবে তিনি প্রকাশ করেন পরবর্তী এক সময়ে, যখন তিনি রাজশাহীতে এক বিরাট জনসভায় ভাষণদান করেন। ১৯৭০ সালের ৩০শে জানুয়ারী রাজশাহী মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে তিনি প্রথম সমাজতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক আদর্শের সমন্বয় সম্পর্কে তাঁর সুচিন্তিত ঘোষণা দেশের ও বিশ্বের সামনে পেশ করেন।

উত্তরাঞ্চল সফর শেষে সাংবাদিক সম্মেলন
এক সপ্তাহব্যাপী দেশের উত্তরাঞ্চল সফর শেষ ক’রে ঢাকায় ফিরে আসবার পর ১৫ই অক্টোবর ঢাকায় সাংবাদিকদের সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিব তাঁর সফরের অভিজ্ঞতার বিবরণ দেন। বিবরণে তিনি উল্লেখ করেনঃ “প্রদেশের প্রায় সর্বত্র দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা বিরাজ করছে। জনসাধারণের দুর্দশা চরমে পৌঁছেছে। একদিকে চালের দাম উঠেছে ষাট টাকায় আর অন্যদিকে পাট বিক্রি হচ্ছে সরকার নির্ধারিত নিম্নতম মূল্যের অনেক কমে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ই অক্টোবর, ১৯৬৯]
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২৭

তিনি নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির ফলে জনগণের জীবনে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তাকে সঙ্কটপূর্ণ বলে বর্ণনা করেন। টেস্ট রিলিফ, আংশিক রেশন, কম দরে রেশন ও ঋণের অব্যবস্থার উল্লেখ ক’রে দুর্দশাগ্রস্ত জনসাধারণের নানাবিধ সমস্যার সত্যিকার সমাধানের জন্য তিনি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর পুনরায় গুরুত্ব আরোপ করেন এবং অবিলম্বে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা অবলম্বনের আহ্বান জানান। তিনি বলেনঃ “জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই কার্যকরভাবে এ সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ই অক্টোবর, ১৯৬৯]

লণ্ডন সফর
তিনি সফর শেষে এ কথা সুস্পষ্টভাবে উপলদ্ধি করলেন যে, দেশের জনগণ নির্বাচনের জন্য আকুল আগ্রহে প্রতীক্ষা করছে এবং নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল গণ-সমর্থন লাভ করবে। এবার তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কিছু প্রচারণার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। এই উদ্দেশ্যে ২৫শে অক্টোবর, (১৯৬৯) তারিখে শেখ মুজিব লণ্ডনে তিন সপ্তাহব্যাপী এক সফরের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন। ২২শে অক্টোবর তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকের জনৈক প্রতিনিধির নিকট প্রদত্ত এক বিশেষ সাক্ষাতকারে তিনি চমৎকারভাবে তাঁর লণ্ডন যাত্রার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেন। উক্ত পত্রিকায় এ সম্পর্কে যে বিবরণ ছাপা হয়েছিল, তা’ হ’লঃ “এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁহার লণ্ডন সফরের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন যে, আইয়ুব সরকার যখন উহার এক-দশকের রাজত্বের শেষ পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানীদের ন্যায্য দাবী-দাওয়া আদায়ের সংগ্রামকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ করিয়া দেওয়ার জন্য সম্ভাব্য সকল দিক হইতে নির্যাতন আর নিপীড়নের যাঁতাকল ভীমবেগে পরিচালিত করিয়াছিল, যখন পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামী নেতৃবৃন্দ এবং সংগঠন হিসাবে আওয়ামী লীগ এক মহা-অসম সংগ্রামে আপোষহীন ভাবে সংগ্রাম করিয়া যাইতেছিল, তখন লণ্ডনের প্রবাসী পাকিস্তানীরা, বিশেষ করিয়া বাঙালীরা যে ভাবে অপরিসীম সাহায্য ও সহানুভূতির হস্ত সম্প্রসারিত করিয়াছিলেন, সে স্মৃতি কোন দিন ভুলিবার নয়। ….. তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যে দিন আমাদের আসামীর
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২৮

কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল, সেদিন প্রবাসী বাঙ্গালীদের হৃদয় কাঁদিয়া উঠিয়াছিল। তাঁহারা আমাদের পক্ষ সমর্থনের জন্য নিজেদের অর্থ ব্যয় করিয়া বিশিষ্ট আইনজীবী টমাস উইলিয়মকে সাত সমুদ্র তের নদীর পার হইতে কুর্মিটোলার বিচার কক্ষে পাঠাইয়াছিলেন। …..সেদিনও প্রবাসী বন্ধুরা আওয়ামী লীগের বাত্যাদুর্গত সাহায্য তহবিলে ৫,৬৮০ টাকা প্রেরণ করিয়াছিলেন। ……তাঁহাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এবং তাঁহাদের সংগ্রামী ভূমিকার প্রতি একাত্মতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে লণ্ডন যাওয়া আমি কর্তব্য বলিয়া বিবেচনা করি। …..প্রবাসী বন্ধুরা আজ দাবী তুলিয়াছেন এবং বিনয়াবনত চিত্তে আমি সে দাবী মানিয়া লইয়া তাঁহাদের কাছে যাইতেছি।” তাঁহার এই লণ্ডন সফরের সঙ্গে কোন রাজনৈতিক কারণ জড়িত আছে কি না জানিতে চাহিলে শেখ সাহেব বলেনঃ “এই সফরের সঙ্গে রাজনৈতিক কোন কারণ জড়িত নাই এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য লইয়া তিনি লণ্ডন যাইতেছেন না।” তাঁহার বক্তব্য ব্যাখ্যা করিয়া তিনি বলেন, “গোপন কারসাজি করার মধ্য দিয়া উদ্দেশ্য হাসিলের রাজনীতি আমি করি না।” ……আর একটি প্রশ্নের জবাবে শেখ সাহেব বলেন যে, “লণ্ডনে থাকার সময় স্বদেশের পরিস্থিতির উপর তিনি সদাসতর্ক দৃষ্টি রাখিবেন। লণ্ডন মাত্র ১২ ঘন্টার পথ, প্রস্তাবিত তিন সপ্তাহের যে কোন পর্যায়ে দেশবাসীর পাশে আসিয়া দাঁড়াইবার প্রয়োজন দেখা দিলে তিনি মুহূর্তমাত্র কালক্ষেপ না করিয়া ছুটিয়া আসিবেন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৩শে অক্টোবর, ১৯৬৯]

বলাবাহুল্য, লণ্ডন পৌঁছলে বিমান বন্দরে শেখ মুজিবকে বিপুলভাবে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। এ সম্পর্কে একটি দৈনিক পত্রিকায় লেখা হয়ঃ “প্রতিকূল আবহাওয়া সত্ত্বেও কয়েক হাজার পাকিস্তানী হীথ্রো বিমান বন্দরে সমবেত হয় এবং ৬-দফা কর্মসূচী, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং পাকিস্তানে সত্বর নির্বাচন অনুষ্ঠানের সমর্থনে শ্লোগান দেয়। শেখ সাহেবকে বিপুলভাবে মাল্যভূষিত করা হয় এবং জনতা তাঁর উপর ফুলের পাপড়ি বর্ষণ করে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৩০শে অক্টোবর, ১৯৬৯]

এদিকে, শেখ মুজিব ও তাঁর ৬-দফা কর্মসূচীর প্রতি রক্ষণশীল ও কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের আক্রমণ ক্রমাগত বেড়েই চলছিল। ৬-দফা
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২৯

সম্পর্কে কনভেনশন মুসলিম লীগ নেতা কাইউম খান এ ধরনের একটি মন্তব্য করেছিলেন। এ. পি. পি. প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “তিনি শেখ সাহেবের ৬-দফার বিরোধী, কারণ ইহার ফলে কেন্দ্র দুর্বল হইয়া পড়িবে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯শে অক্টোবর, ১৯৬৯]

অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলোর সঙ্গে সুর মিলিয়ে জামাত নেতারা শাসনতান্ত্রিক সঙ্কট প্রসঙ্গে যে সব কথা প্রচার করেন সে সম্পর্কে পত্রিকায় বলা হয়ঃ “পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর ডেপুটি আমির মওলানা আবদুর রহীম শেখ মুজিবের প্রতি ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানে সম্মত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার মতে, এছাড়া বর্তমানে শাসনতান্ত্রিক সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা দুষ্কর হবে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫শে অক্টোবর, ১৯৬৯)

জামাতপন্থীরা বা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ধর্মের নামে যে সব জিগির তুলেছিলেন তার সাথে ইয়াহিয়া খানের চিন্তাধারার কিছুটা সাদৃশ্য ছিল। আসলে ইয়াহিয়া খান ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের বুর্জোয়া ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির অনুচর। যাহোক, ঠিক এমনি সময়ে ২৫শে অক্টোবর ইয়াহিয়া খান তেহরানের পথে করাচী ত্যাগের পূর্বে চাকলাল বিমান বন্দরে মন্তব্য করেনঃ “আমি শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাবের কথা বলি নি। আমি শুধুমাত্র শাসনতন্ত্রের ভিত্তির কথা বলেছি।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৬শে অক্টোবর, ১৯৬৯]

প্রকৃতপক্ষে উপরিউক্ত দলগুলোর মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্টের এই শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি ভবিষ্যতে এল. এফ. ও. (Legal Framework Order, President’s Order No. 2, 1970)-এরই ইঙ্গিত বহন করে।

নভেম্বরের গোলযোগ এবং শেখ মুজিব
১৯৬৯ সালের ১লা নভেম্বর উর্দু ভাষায় ভোটার ফরম প্রদানের দাবীতে ঢাকায় একশ্রেণীর লোক হরতাল পালনের আহ্বান জানায়। এ নিয়ে দু’দল লোকের মধ্যে কোন্দল শুরু হয় এবং পরে তা’ সংঘর্ষে পরিণত হয়। সংঘর্ষে ৬ জন নিহত ও ১১১ জন আহত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ১৭ই অক্টোবর তারিখ থেকে এই ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করা
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩০

হয়। এই ঘটনা সম্পর্কে ১লা নভেম্বর শনিবার রাত্রে প্রাদেশিক সরকারের দেয়া এক প্রেসনোটে বলা হয়ঃ “উর্দু ভাষায় ভোটার ফরম প্রদানের দাবীতে বিশেষ একশ্রেণীর লোক হরতাল পালনের আহ্বান জানায়। সেই অনুসারে কয়েক দল বখাটে এবং সমাজবিরোধী লোককে মীরপুর এলাকায় কতিপয় সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিতে দেখা যায়। প্রতি দিনের মত গতকালও এই এলাকার দোকানপাট সকালে খোলা হইলে তাহারা জোর করিয়া সেই দোকানপাট বন্ধ করিয়া দেওয়ার চেষ্টা করে। এই সময় পুলিশ রাস্তার বাধাসমূহ অপসারণ করিতে এবং দুস্কৃতিকারীদের অবাঞ্ছিত কার্যকলাপ প্রতিরোধ করিতে চেষ্টা করিলে তাহারা মারমুখী হইয়া উঠে এবং পুলিশকে তাহাদের কর্তব্যকর্মে বাধা দিতে সচেষ্ট হয়। ইহাতে পুলিশকে কাঁদুনে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ এবং লাঠিচার্জ করিতে হয়। কিন্তু অবস্থা ঘোরালো হইয়া ওঠে এবং জনতা আরও উত্তেজিত হইয়া পুলিশের প্রতি ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করিতে থাকে এবং অন্যান্য উপায়েও আক্রমণ শুরু করে। ফলে কর্তব্যরত একজন পুলিশ সুপার ও কয়েকজন অফিসারসহ বিপুল সংখ্যক পুলিশ আহত হন। ইহাদের মধ্যে ৪০ জনকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হইয়াছে।
গোলযোগ চলাকালে দমকল বাহিনীর একটি গাড়ী ও ছোটখাট কয়েকটি দোকানে অগ্নিসংযোগ করা হয়। একশ্রেণীর লোক হরতাল পালনে অন্যান্যকে বাধ্য করার চেষ্টা করিলে দুই দল লোকের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পরে গুজব ছড়াইয়া পড়িলে শহরের অপরাপর কয়েকটি স্থানেও গোলযোগ দেখা দেয় এবং পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে।
জনসাধারণের পক্ষ হইতে ৭১ জন আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসার্থে হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। তাহাদের মধ্যে ৩১ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং বাকী ৪০ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছাড়িয়া দেওয়া হয়।
হাসপাতালে ভর্তি আহত ৩১ ব্যক্তির মধ্যে পরে ৪ জন মারা যায়। অপর দুই ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনয়ন করা হয়।”
… … … …

“সরকার এই অপ্রীতিকর ঘটনার ফলে মূল্যবান জীবনসমূহের অবসান ও সম্পত্তির ধ্বংস সাধনে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন এবং বিভিন্ন শ্রেণীর
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩১

জনসাধারণের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখিয়া স্বাভাবিক অবস্থা ফিরাইয়া আনার ব্যাপারে জনসাধারণের সহযোগিতা কামনা করেন।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২রা নভেম্বর, ১৯৬৯]

কিন্তু সরকারী হিসাব যাই হোক—হতাহতের সংখ্যা আরো অধিক ছিল এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনী উর্দুভাষীদের সাহায্য করায় যাঁরা হতাহত হন তাঁরা প্রায় সবাই ছিলেন বাঙালী।
এদিকে সকল উস্কানির মুখে শান্তি বজায় রাখার সর্বশক্তি নিয়োগ করার জন্য দেশের নেতৃবৃন্দ জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। ১লা নভেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকায় প্রদত্ত এক বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ জনসাধারণকে শান্ত থাকার এবং শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানান। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরী, সাবেক জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলের ডেপুটি লীডার শাহ আজিজুর রহমান, ওয়ালী ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তান সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, পাকিস্তান পিপলস পার্টির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি মওলানা নূরুজ্জামান ও পিকিংপন্থী ন্যাপ নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা পৃথক পৃথক বিবৃতিতে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন এবং জনগণকে শান্ত থাকতে অনুরোধ জানান।
এদিকে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন ছিলেন লণ্ডনে। তিনি ঐ সময় লণ্ডনে বসবাসকারী বাঙালীদের সাথে দেখা করার জন্য এবং আন্তর্জাতিক জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে লণ্ডন সফর করছিলেন। ১লা নভেম্বর সন্ধ্যায় লণ্ডনে পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্রদের আয়োজিত এক ছাত্রসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন যে, গণতন্ত্রের জন্য তাঁর সংগ্রাম শুধু পূর্ব পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ নয়—পাকিস্তানের প্রতিটি অঞ্চল এবং জাতীয় জীবনের প্রতিটি স্তরের জন্যই এ সংগ্রাম। তিনি বলেন, তাঁর এই সংগ্রাম বিচ্ছিন্নতার জন্য নয়। তিনি চান দেশের প্রতিটি নাগরিক শোষণহীন জীবনযাপন করুক।
২রা নভেম্বর রবিবার ঢাকায় আবার গোলযোগ ও সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ১৯ ব্যক্তি আহত ও ৩০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ সম্পর্কে দৈনিক পত্রিকায় লেখা হয়, রোববার এক হিংসাত্মক জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩২

জন্য সেনাবাহিনী গুলী চালনা করতে বাধ্য হ’লে এক ব্যক্তি আহত হয়। রোববার রাত্রে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের এক প্রেসনোটে একথা বলা হয়।
মীরপুর, হাজারীবাগ, রায়ের বাজার ও কমলাপুরে বিক্ষিপ্ত ঘটনার পর ১৯ জন আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর ৫ জনকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়। একজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনয়ন করা হয়। গোলযোগের ব্যাপারে এ পর্যন্ত তিনশত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস. এম. আহসান, সামরিক শাসনকর্তাদ্বয় ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ গোলযোগপূর্ণ এলাকা সফর করেন এবং হাসপাতালে আহতদের দেখেন।
পূর্ব পাকিস্তানের ২২ জন রাজনৈতিক নেতা এক যুক্তবিবৃতিতে হিংসাত্মক কার্যকলাপের নিন্দা করেন এবং সুস্থ পরিবেশ ও আস্থার মনোভাব ফিরিয়ে আনার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।”
খবরে আরো বলা হয়ঃ “প্রদেশে গোলযোগের খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং তিনি বৃটেন সফরের অবশিষ্ট কর্মসূচী বাতিল ক’রে প্রথম যে বিমানটি পাওয়া যাবে তাতেই নিজ দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৩রা নভেম্বর, ১৯৬৯]

পি. পি. আই-এর বরাত দিয়ে খবর সরবরাহ করা হয়ঃ “১লা ও ২রা নভেম্বর শেখ মুজিব লণ্ডন ও বার্মিংহামে জনসমাবেশে ভাষণ দান করেন। এখানে বসবাসরত বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানী তাঁহার বক্তৃতা শোনার জন্য জমায়েত হয়। শেখ সাহেব তাঁহার বক্তৃতায় দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন। তিনি তাঁহার দলের ভূমিকা এবং ৬-দফা কর্মসূচী ব্যাখ্যা করেন।
জনতা বারংবার শ্লোগান ও করতালির মাধ্যমে তাঁহার বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন।
আওয়ামী লীগ প্রধান তাঁহার বক্তৃতায় জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বিলোপের দাবী জানান।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩৩

ঢাকার গোলযোগের খবর পাওয়ায় শেখ মুজিব তাঁহার ম্যাঞ্চেস্টার ও ব্রেডফোর্ডের জনসভা অনুষ্ঠানের কর্মসূচী বাতিল করিয়া এক্ষণে প্রথম বিমানেই ঢাকা প্রত্যাবর্তনের জন্য ৩রা নভেম্বর থেকে অপেক্ষা করিতেছেন।”
[ ইত্তেফাক, ৪ঠা নভেম্বর, ১৯৬৯]

লণ্ডনে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য ৪ঠা নভেম্বর মঙ্গলবার রাত ৯ টায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদের সাথে লণ্ডন থেকে টেলিফোনে আলাপ করেন।
“জনাব তাজউদ্দিন ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি শেখ সাহেবকে জানাইলে তিনি সমগ্র ব্যাপারটিকে আগামী নির্বাচন বানচাল করার সুগভীর কারসাজিরই নগ্ন প্রকাশ বলিয়া অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, শত উস্কানির মুখেও শান্ত থাকিয়া নির্বাচন বানচাল করার এ কারসাজি দেশবাসীকে নস্যাৎ করিতেই হইবে। এ প্রসঙ্গে তিনি রাজধানীতে অবিলম্বে শান্তি ও সম্প্রীতি ফিরাইয়া আনিতে সর্বপ্রযত্নে উদ্যোগী হওয়ার জন্য ঢাকার সকল শ্রেণীর নাগরিকের প্রতি তাঁহার পক্ষ হইতে অনুরোধ জানাইতে বলেন।
ঢাকার হাঙ্গামার কথা শুনিবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য উদগ্রীব হইলেও বৃহস্পতিবারের পূর্বে বিমানে আসন না পাওয়ায় তাহা সম্ভব হইয়া উঠে নাই বলে তিনি জানান।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই নভেম্বর, ১৯৬৯]

লণ্ডন থেকে তেজগাঁ বিমান বন্দরে
লণ্ডন থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ৮ই নভেম্বর শনিবার শেখ মুজিব তেজগাঁ বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা কালে ঢাকায় সাম্প্রতিক গোলযোগ সম্পর্কে স্বীয় অভিমত ব্যক্ত করেন। শেখ মুজিব ঢাকা গোলযোগের পশ্চাতে যে অশুভ শক্তি সক্রিয় রয়েছে তাদের প্রতি কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ ক’রে বলেন, “জনসাধারণকে শান্তির পথ ছাড়িয়ে অশান্তির পথে যাওয়ার জন্য যে অশুভ চক্রটি অবিরত উস্কানি দিতেছে, তাহাদের বুঝা উচিত যে, তাহারা আগুন লইয়া খেলিতেছে। দেশের পরিস্থিতি অধিকতর ঘোরালো হওয়ার পূর্বেই ইহাদের চৈতন্যোদয় হওয়া একান্তই বাঞ্ছনীয় বলিয়া তিনি মন্তব্য করেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩৪

তিন সপ্তাহের নির্ধারিত কাৰ্যসূচী অসম্পন্ন রাখিয়া শেখ সাহেব দুই সপ্তাহব্যাপী লণ্ডন সফর শেষে শনিবার ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিয়া সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা করিতেছিলেন।
সকাল ঠিক ৬টা ৫০ মিনিটে তাঁহাকে বহনকারী পি. আই. এর একটি বোয়িং বিমান তেজগাঁ বিমান বন্দরে পৌছিলে বিপুলসংখ্যক আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতা উল্লাসে ফেটে পড়ে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ই নভেম্বর, ১৯৬৯]

বঙ্গবন্ধু ৮ই নভেম্বর দেশে প্রত্যাবর্তন করার পরপরই উপদ্রুত অঞ্চল পরিদর্শনে যান। মীরপুর, মোহাম্মদপুর, রায়ের বাজার ও তেজগাঁর সংশ্লিষ্ট উপদ্রুত অঞ্চল পরিদর্শন ক’রে তিনি সমগ্র ব্যাপারটিকে ‘চেনা মুখের কারসাজি’ বলে অভিহিত ক’রে সংশ্লিষ্ট মহলকে আগুন নিয়ে খেলার পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক ক’রে দেন।
বঙ্গবন্ধুর কঠোর হুঁশিয়ারির ফলে ঢাকার গোলযোগপূর্ণ এলাকায় আবার শান্তি ফিরে আসে। নির্বাচনকে নস্যাৎ করার জন্য কুচক্রীমহল যে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে চেয়েচিল বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ পদক্ষেপে তা’ সম্ভব হয় না। পর্যবেক্ষকদের মতে, বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপ ছাড়া এই আত্মঘাতী গোলমালের মীমাংসা করা সম্ভব ছিল না।
এ ব্যাপারে স্থায়ী শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী হওয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ ভূমিকার প্রশংসা ক’রে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানান।
মজলিসে ওলামায়ে পাকিস্তানের সভাপতি মওলানা আসাদুল কাদরী ১০ই নভেম্বর করাচীতে এক বিবৃতিতে বলেন যে, “পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রতিক গোলযোগ সম্পর্কে শেখ মুজিব লণ্ডন ও করাচীতে অত্যন্ত সুস্থ অভিমত প্রকাশ করেন। …….মওলানা কাদরী বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাব বিদ্যমান বলিয়া সেখানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে তিনি সাহায্য করিতে সক্ষম।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ই নভেম্বর, ১৯৬৯]

বিমান বন্দরে প্রশ্নোত্তর
লণ্ডন থেকে ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পর ৮ই নভেম্বর সকালে ঢাকা বিমান বন্দরে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিব লণ্ডনস্থ পাকিস্তানী
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩৫

হাই কমিশনের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগের কথাও উল্লেখ করেন। একটি দৈনিক থেকে এই সম্মেলনের প্রশ্নোত্তর উদ্ধার করিঃ “স্বদেশী কূটনীতিকদের যথাযোগ্য তদারকির অভাবে প্রবাসী জীবনে বাঙ্গালীরা কোন রকমে দিনযাপন করিতেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লণ্ডনস্থ পাকিস্তানী হাই কমিশনের সমালোচনা করিয়া বলেন যে, হাই কমিশনের তিনশত কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ২০ জন বাঙ্গালী রহিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য শতকরা ৫৬ ভাগ আসনের পুরাতন দাবীটি নতুন করিয়া এবং বিশেষ জোর দিয়া তিনি উল্লেখ করেন।
শেখ সাহেব ক্ষমতায় গেলে এই দাবী বাস্তবায়িত করিতে চাহেন কিনা জনৈক সাংবাদিকের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন যে, এখনই এই দাবীর বাস্তবায়ন তিনি কামনা করেন। তিনি প্রশ্নকারীকে বলেন যে, এই দাবী আমাদের সনাতন ও ন্যায্য দাবী এবং এই দাবীর আশু বাস্তবায়নই তিনি কামনা করেন। প্রশ্নকারীকে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, ক্ষমতায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি রাজনীতি করেন না—দেশবাসীর ন্যায্য দাবী-দাওয়া লইয়া আপোষহীন সংগ্রাম করাই তাঁহার রাজনৈতিক জীবনাদর্শ। তিনি বলেন যে, আমি শুধু পূর্ব পাকিস্তানীদের দাবী-দাওয়া লইয়াই সংগ্রাম করিতেছি না, পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইদের জন্যও আমি সংগ্রাম করিতেছি এবং এক ইউনিট বাতিলের যে দাবী আমরা উত্থাপন করিয়াছি তাহার মধ্য দিয়া সে সংগ্রামের প্রতিফলন ঘটিয়াছে। লণ্ডনে অবস্থানকালে তিনি দৌলতানা বা জনাব ভুট্টোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়াছেন কিনা জানিতে চাহিলে শেখ সাহেব বলেন যে, তিনি তাঁহাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নাই এবং লণ্ডনের কোথায় তাঁহারা আছেন তা’ তিনি জানেনও না। প্রশ্নকারীকে তিনি বলেন, পর্দার অন্তরালে রাজনীতি করার অভ্যাস আমার নেই। আমার রাজনীতি স্পষ্ট এবং স্বচ্ছ।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ই নভেম্বর, ১৯৬৯]

১৬ই নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির ৬ ঘন্টাব্যাপী এক বৈঠকে আগামী এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন সমাপ্তির নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার আহ্বান জানানো হয়। দলীয় প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান এই সভায় সভাপতিত্ব করেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩৬

অবিলম্বে রাজনৈতিক তৎপরতা এবং উন্মুক্ত স্থানে জনসভা অনুষ্ঠানের ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার এবং রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের হুলিয়া প্রত্যাহার ও রাজবন্দীদের মুক্তিদানের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জোরালো দাবী জানানো হয়।
অবিলম্বে জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তাস্তরের জন্য এবং দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা মোতাবেক শাসনতন্ত্র রচনার জন্য সরকারের প্রতি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে একটি আইনসভা গঠনের আহ্বান জানান। দেশের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
১৯শে নভেম্বর আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানে যে তিনশ’ ছাত্র বাংলায় বি-এ পরীক্ষা দিয়েছিল তাদের ফল প্রকাশের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের হস্তক্ষেপ কামনা ক’রে এক তারবার্তা প্রেরণ করেন। পরীক্ষার্থীদের ফল ‘উইথহেল্ড’ রাখায় তিনি প্রেসিডেন্টর কাছে তারবার্তায় দুঃখ প্রকাশ করেন।

ইয়াহিয়ার ঘোষণাঃ এক ইউনিট বাতিলঃ
জনগণের সুদীর্ঘ আকাঙক্ষা উপলদ্ধি ক’রে এবং কিছুটা বিভিন্ন মহলের চাপে ১৯৬৯ সালের ২৮শে নভেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত এক ভাষণে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট ভেঙে দিয়ে পৃথক পৃথক প্রদেশ গঠনের এবং ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’-এর ভিত্তিতে নয়া জাতীয় পরিষদ গঠনের জন্য আগামী বৎসর (১৯৭০) ৫ই অক্টোবর দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি আরও ঘোষণা করেন যে, আগামী ১লা জানুয়ারী থেকে যাবতীয় বিধিনিষেধ প্রত্যাহার ক’রে দেশে পুনরায় রাজনৈতিক তৎপরতা শুরুর অনুমতি দেয়া হবে। উক্ত ঘোষণায় তিনি আরও বলেন যে, আগামী বৎসর অক্টোবর মাসে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদে প্রথম অধিবেশন শুরুর দিন থেকে ১২০ দিনের ভেতরে দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ সমাধা করতে হবে এবং প্রেসিডেন্টের অনুমোদন লাভের পরক্ষণেই উহা পাকিস্তানের নয়া শাসনতন্ত্র হিসেবে গণ্য হবে। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩৭

কাজ শেষ হওয়ার পর প্রাদেশিক পরিষদসমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এবং এর পরক্ষণেই প্রতিনিধিত্বশীল কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। এই সমুদয় দায়িত্ব পালনকালে এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ক্ষমতা হস্তান্তরের কর্মসূচী বাস্তবায়ন পর্যায়ে সামরিক আইনই দেশে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস হিসেবে বহাল থাকবে।
ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছেঃ
“* ১৯৭০ সালের ৫ই অক্টোবর দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
* ১৯৭০ সালের ৩১শে মার্চের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন আইনগত বুনিয়াদ প্রস্তুত হবে।
* এক ইউনিট ভেঙ্গে দিতে হবে।
* একজন এক ভোট নীতি গ্রহণ করা হবে।
* প্রদেশগুলোকে সর্বাধিক পরিমাণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে, যে পর্যন্ত না তা’ জাতীয় সংহতি ও অখণ্ডতার পরিপন্থী হয়।
প্রেসিডেন্ট বলেন, মতভেদ না থাকার দরুন নিম্নোক্ত বিষয়গুলো স্থিরীকৃত ধরে নেওয়া যেতে পারেঃ
(ক) পার্লামেন্টারী ফেডারেল সরকার।
(খ) প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোট।
(গ) জনসাধারণের মৌলিক অধিকার এবং আদালতের মাধ্যমে তার প্রয়োগ।
(ঘ) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং শাসনতন্ত্রের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তাঁর ভূমিকা।
(ঙ) শাসনতন্ত্রের ইসলামী চরিত্র যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাকে সংরক্ষণ করবে।
* ১৯৭০ সালের ১লা জুনের মধ্যে ভোটার তালিকা তৈরী হতে হবে।
* জাতীয় পরিষদকে ১২০ দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন শেষ করতে হবে, অন্যথায় পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে নয়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
* শাসনতন্ত্র স্বাক্ষরিত হওয়ার পর নয়া সরকার গঠনের ব্যবস্থা করা হবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩৮

* জনসাধারণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্ব পর্যন্ত দেশে সামরিক আইন বহাল থাকবে।
* ১৯৭০ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে পূর্ণ রাজনৈতিক তৎপরতার অনুমতি দেয়া হবে।
* গণতন্ত্র পুনঃ প্রবর্তনের পথে অন্তরায় সৃষ্টি প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে কতিপয় নির্দেশিকা অদূর ভবিষ্যতে জারী করা হবে।
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৯শে নভেম্বর, ১৯৬৯]

ইয়াহিয়ার ঘোষণাঃ শেখ মুজিবের বিবৃতি
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এই ঘোষণা দেশের উভয়াংশের বিভিন্ন দল ও নেতৃবৃন্দ কর্তৃক অভিনন্দিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ইয়াহিয়ার ঘোষণা সম্পর্কে একটি বিবৃতিতে বলেনঃ “ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়সূচী ও উহার বাস্তবায়ন পদ্ধতির প্রশ্নে মতানৈক্যের অবকাশ থাকিলেও দেশের সমস্যা অনুধাবনের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রশংসাযোগ্য।”
শেখ মুজিব আরও বলেন, “আমরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘোষণা পাঠ করিয়াছি। দেশ আজ যে সব মৌলিক সমস্যার মধ্য দিয়া কালাতিপাত করিতেছে ও যে সব সমস্যা সম্পর্কে তিনি যে সব প্রতিবিধানের প্রস্তাব করিয়াছেন, সেগুলিও আমরা লক্ষ্য করিয়াছি। দেশবাসী অর্থাৎ ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক এবং বুদ্ধিজীবীরা অক্লান্ত শ্রম, অফুরন্ত অশ্রু ও সর্বোচ্চ ত্যাগের মধ্য দিয়া জাতির মৌলিক সমস্যা এবং তাহাদের সমাধানসমূহ নির্দেশ করিয়াছেন। সমস্যাসমূহ ব্যক্তিগতভাবে অনুধাবনের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যে সাধু প্রয়াস পাইয়াছেন, তজ্জন্য তাঁহাকে প্রশংসা করিতে হয়। মূল সমস্যাদি সম্পর্কে জাতির সঙ্গে একাত্মবোধ প্রকাশ করিতে গিয়া তিনি অকপটে যে অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন, তাহাও প্রশংসার্হ।”
শেখ মুজিব বলেনঃ “জনসাধারণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতি ও সময়সীমা নিয়া প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের মধ্যে প্রচুর মতানৈক্যের সুযোগ আছে। প্রশাসনযন্ত্র আরও গুরুত্ব দান করিলে প্রস্তাবিত জাতীয় পরিষদের নির্বাচন আরও শীঘ্র অনুষ্ঠান সম্ভব হইত। সে যাই হোক,
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩৯

আমরা বিশ্বাস করি যে, প্রেসিডেন্ট যে সব ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করিয়াছেন সে সব প্রস্তাবের মধ্য দিয়া নির্বাচনে জয়ী ও জনগণের স্পষ্ট ম্যাণ্ডেটধারী জনপ্রতিনিধিরা ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌছিতে পারিবেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দেশে শান্তি ও সম্প্রীতিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের উক্তি প্রশংসনীয়। এই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য প্রশাসনযন্ত্রকেও অবশ্যই বিবেকসম্পন্ন ভূমিকা পালন করিতে হইবে। কারণ, স্পর্শকাতর বিষয় ও বিতর্কমূলক সমস্যাবলীর ক্ষেত্রে প্রশাসনযন্ত্রের অসতর্ক বা অতি উৎসাহমূলক ভূমিকা গণতন্ত্রের বিরোধী শক্তিসমূহের তৎপরতার চাইতেও ভয়াবহ বিভেদ সৃষ্টি করিতে সক্ষম। আমরা আশা করি, প্রেসিডেন্ট সেই আশঙ্কা প্রতিবিধানের জন্য পূর্বাহ্নে ব্যবস্থা অবলম্বন করিবেন।
প্রেসিডেন্ট কয়েকটি মূল সমস্যার সমাধান দিয়াছেন, কিন্তু কয়েকটি সমস্যার সমাধান তিনি দেন নাই। শাসনতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক বা অন্যবিধ মূল সমস্যাবলী সমাধানের ব্যাপারে আমাদের আগাগোড়া ভূমিকা হইল- মূলত আমরা বিশ্বাস করি যে, একমাত্র জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই এই সব সমস্যার সমাধান করিতে পারেন। প্রস্তাবিত জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন প্রসঙ্গে দেশের জন্য একটি সর্বমুখী শাসনতন্ত্র রচনা করিবেন—যে শাসনতন্ত্রে স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক রূপরেখার মত মূল সমস্যাবলীর সমাধানসমূহ অন্তর্ভুক্ত করিবেন। শুধু তাহাই নহে, প্রেসিডেন্ট যে সব সমস্যার সমাধান দিয়াছেন সেগুলির চূড়ান্ত রূপদানের দায়িত্বও তাঁহাদের হাতে ন্যস্ত হইয়াছে। অতএব, আমরা বিশ্বাস করি যে, ৬-দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন এবং সমাধান করা হয় নাই এমন অপরাপর মৌলিক শাসনতান্ত্রিক সমস্যাবলী নির্বাচনের সময় জনমতের সামনে উপস্থাপিত হইতে পারিবে এবং সেই সব সমস্যা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নির্বাচনের বিতর্কতীত ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে সমাধান করতে সক্ষম হইবেন। ৬-দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের দাবীর প্রতি জনগণ স্পষ্ট ভাষায় তাহাদের রায় ব্যক্ত করিবেন বলিয়া আমাদের আস্থা আছে। ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, প্রতিরক্ষাবাহিনীসহ সর্বক্ষেত্রে চাকুরী-বাকুরীর বৈষম্যকে কেন্দ্র করিয়া কেন্দ্র ও ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ইউনিটসমূহের মধ্যে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪০

বিশেষ করিয়া পূর্ব বাংলায় ভুল বুঝাবুঝির যে দুরারোগ্য ব্যাধি বিদ্যমান রহিয়াছে এক মাত্র ৬-দফা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়াই সেই ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটাইয়া পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব ও সংহতি বজায় রাখা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন যে, প্রেসিডেন্ট সামাজিক, অর্থনৈতিক ও অপরাপর অনেক সমস্যার অবতারণা করেছেন। ফি’বছর পূর্ব বাংলার অর্থনীতিকে নস্যাৎকারী বন্যা সমস্যার উল্লেখ করতে তিনি ভুলে গেছেন সে জন্য আমরা দুঃখবোধ করি। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাইরে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল হ’তে বন্যা সমস্যার সামগ্রিক সমাধান নির্দেশ ক’রে প্রেসিডেন্ট বহু প্রতীক্ষিত একটি সঠিক প্রকল্প ঘোষণা করবেন, আমরা এই আশা পোষণ করেছিলাম। আশা করি, প্রেসিডেন্ট এই প্রশ্নে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, নচেৎ এই অঞ্চলের মানুষের কাম্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন সম্ভব হবে না।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১লা ডিসেম্বর, ১৯৬৯]

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হওয়ার সাথে সাথে শেখ মুজিব আসন্ন নির্বাচনে অংশ গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। শেখ মুজিব জানেন, ক্ষমতায় না গেলে পূর্ব বাংলার জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আর ক্ষমতায় যেতে হলে জনগণের সাহায্যেই তা’ সম্ভব। এই উদ্দেশ্যে তিনি তার ৬-দফাকে সামনে রেখে নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালাতে লাগলেন।

শেখ মুজিবের নির্বাচনী প্রচারিভাযানে প্রাথমিক পর্যায়ের ভাষণসমূহ
১৯৬৯ সালের ২রা ডিসেম্বর ঢাকার রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক ইফতার পার্টিতে ভাষণদান কালে শেখ মুজিব তাঁর প্রথম নির্বাচনী প্রচারাভিযানের ভাষণে বলেন যে, “আগামী সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার জনগণকে ৬-দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের দাবীর সপক্ষে সুস্পষ্ট ভাষায় অনুষ্ঠানিক রায় ঘোষণা করিতে হইবে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধিকার অর্জনের জন্য অপরিহার্য স্বায়ত্তশাসন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের দাবী পূর্ব বাংলার গণ-মানুষের ঈমানের অঙ্গ-সার্বজনীন দাবী। নির্বাচনের মাধ্যমে এই সার্বজনীন দাবীটিকেই আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব বাংলার
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪১

আপামর জনতার অপরিবর্তনীয় রায় হিসাবে শাসনতন্ত্র রচনার জন্য গঠিত ভবিষ্যৎ জাতীয় পরিষদের সামনে পেশ করিতে হইবে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৬৯]

উক্ত পার্টিতে শেখ মুজিব আরো বলেন যে, “আমাদের সংগ্রাম কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়, শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে।”
৫ই ডিসেম্বর, ১৯৬৯। এ দিন মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুদিবস।
সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর থেকে প্রতি বৎসর তাঁর স্মরণে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করা হ’য়ে থাকে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এই দীক্ষাগুরু ও পথপ্রদর্শককে বেদনার্ত চিত্তে স্মরণ ক’রে নেতার জীবনাদর্শকে জনগণের সামনে নতুন ক’রে প্রতিবছর তুলে ধরেন। এবারেও দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে নয়া আঙ্গিক ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত পরিবেশে সোহরাওয়ার্দীর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়। প্রাদেশিক গভর্নরসহ দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর নাগরিক তাঁর মাজারে জিয়ারত ও পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী জ্ঞাপন করেন। অপরাহ্নে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থিত সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলার মাজারে (উভয় মাজারই পাশাপাশি অবস্থিত) সোহরাওয়ার্দী স্মরণে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “বাংলার এই দুই কৃতি সন্তানের সমাধির পাশে দাঁড়াইয়া আজ আমরা আবার এই শপথ ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা সত্যিকার পাকিস্তানী নাগরিক হিসাবে বাঁচিতে চাই-কাহারো গোলাম হইয়া থাকিতে চাই না।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৬৯]

বাংলাদেশ শব্দের ব্যবহার
আলোচনা সভায় তিনি পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’ রাখার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। তিনি আবেগকম্পিত হৃদয়ে বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেন, “এক সময় এদেশের বুক হইতে মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। একমাত্র “বঙ্গোপসাগর”
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪২

ছাড়া আর কোন কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। …..বাংলা ও বাঙ্গালীর অবিসংবাদিত গণনায়ক শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলার প্রতিও অমার্জনীয় অবজ্ঞা প্রদর্শিত হইয়াছে।
বক্তৃতা মঞ্চের অনতিদূরে চিরনিদ্রায় শায়িত নেতৃদ্বয়ের মাজারের প্রতি ইঙ্গিত করিয়া শেখ মুজিব বলেন, বাংলার এই দুই কৃতি সন্তান আজ অসহায়ের মত আমাদের মুখের দিকে তাকাইয়া আছেন। এই দুই নেতার মাজারের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি—আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হইবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধু মাত্র ‘বাংলাদেশ’।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৬৯]

বলা বাহুল্য শেখ মুজিবের এই ঘোষণা পূর্ব বাংলার জনগণের নিকট বিপুলভাবে সম্বর্ধিত হয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর কোন কোন রাজনৈতিক নেতা ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দের পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ’ শব্দের ব্যবহার করবার গৌরব নিজেদের মধ্যে ভাগ ক’রে নেবার চেষ্টা করেছেন।
বাংলাদেশ কোন নতুন শব্দ নয়। এই শব্দের একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। ডক্টর শহীদুল্লাহ বলেন, “বর্তমান পূর্ব পাকিস্তান (অর্থাৎ বাংলাদেশ) প্রাচীন গৌড় বা বরেন্দ্র এবং বঙ্গ বা বঙ্গাল দেশ লইয়া গঠিত।”
[ আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, ঢাকা, ১৯৬৫, পৃঃ ছ, ভূমিকা]

আমরা জানি, বাংলার আসল নাম বঙ্গ। ঐতিহাসিক আবুল ফজলের মতে বঙ্গ পূর্বে আল বা আড়াল দিয়ে ঘেরা ছিল বলে বঙ্গাল এই নাম। মতান্তরে বঙ্গ + আলয় = বঙ্গালয় অপভ্রংশ বাঙ্গালা। তাঞ্জোরে ১১শতাব্দীতে উৎকীর্ণ প্রশস্তিতে আছে ‘বঙ্গলয়’ এই শব্দ থেকে হয়েছে বাঙ্গালা। পূর্বে গঙ্গা ও করতোয়ার দ্বারা বিভক্ত হয়ে পশ্চিমাংশ গৌড় এবং পূর্বাংশ বঙ্গ এই নামে অভিহিত ছিল। মোগল শাসনকালে মিলিত গৌড়বঙ্গ বাঙ্গালা নাম প্রাপ্ত হয়েছিল। তা’ থেকে হয়েছে বাংলাদেশ।
[ দ্রষ্টব্যঃ জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাস, বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, ২য় ভাগ, ২য় সং, পৃঃ ১৫২৬]
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪৩

এ সম্পর্কে আরো অনেক তথ্য দেয়া যায়। কিন্তু আমাদের তা’ উদ্দেশ্যে নয়। ব্রিটিশ ভারতে বাঙ্গালা বাংলাদেশ বলেই পরিচিত ছিল। ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর সমগ্র বাংলাদেশ তিনটি নামে পরিচিত হয়ঃ পশ্চিম বাংলা – ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য, পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান – পাকিস্তানের পূর্বাংশ। পূর্ব পাকিস্তানেও উনসত্তরের আন্দোলনের সময় থেকে এই প্রদেশের নাম বাংলাদেশ রাখা হোক এমন একটি গুঞ্জন উঠেছিল। কিন্তু প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে দেশবাসীর সামনে পূর্ব পাকিস্তানকে প্রথম ঐতিহ্য-সূত্রে পুরাতন সেই ‘বাংলাদেশ’ নামে চিহ্নিত করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এ গৌরব তাঁরই প্রাপ্য। অনুরূপভাবে ‘জয়বাংলা’ শব্দটি, যতদূর মনে পড়ছে, ঊনসত্তরের আন্দোলনে ছাত্রলীগ প্রথম ব্যবহার করেন। কিন্তু শেখ মুজিব যখন এই শব্দকে গ্রহণ ক’রে সর্বত্র ব্যবহার করতে আরম্ভ করলেন, শব্দটি তখন বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করলো। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এই শব্দ মন্ত্রের ন্যায় প্রভাব বিস্তার করেছিল।
পূর্বেই বলেছি, ঊনসত্তরের গণ-অভুত্থানের সময় পূর্ব পাকিস্তানের নাম ‘বাংলাদেশ’ রাখা হোক এমন একটি গুঞ্জন উঠেছিল। যারা গুঞ্জন তুলেছিলেন তাঁদের মধ্যে জনাব আতাউর রহমান খানের নাম উল্লেখ করা যায়। রাজনৈতিক জীবনে আতাউর রহমান খানের ভূমিকা কোনদিনও বলিষ্ঠ ছিল না-বিজ্ঞোচিত কিনা তাও জোর দিয়ে বলা যায় না। আমার মনে হয়েছে, তাঁর যথেষ্ট আন্তরিকতা, গভীর দেশপ্রেম এবং নেতৃত্বদানের ন্যায় ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও তিনি যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করতে সমর্থ হন নি, কারণ তিনি একটু মোটাবুদ্ধির লোক। যথাসময়ে যথার্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি সব সময়ই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এ কারণেই সমগ্র দেশ যখন বঙ্গবন্ধুর ৬-দফার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দান করেছে, তিনি তখন ৬-দফার বিরোধিতা করেছেন—সত্তরের নির্বাচনে ভরাডুবির পর যখন দেখলেন যে সমগ্র দেশ ৬-দফার সমর্থন জানিয়েছে এবং পূর্ব বাংলার মানুষ স্বাধিকার বোধে জাগ্রত, তখন তিনি স্বাধীনতার আহ্বান জানালেন। বলাই বাহুল্য, ঠিক এই মুহুর্তে পূর্ব বাংলার জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক সরকার চেয়েছিলেন, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সেই
পৃষ্ঠা নং ~ ৫88

সরকারের জন্য তাঁরা সাগ্রহে প্রতীক্ষা করছিলেন, স্বাধীনতার জন্য তখনো তাঁদের মানসিক পটভূমি প্রস্তুত হয় নি। সুতরাং তাঁর এই আহ্বান তখন বড় বেসু্রো শোনালো। মওলানা ভাসানীও সারাজীবন এমনি বেসুরো সঙ্গীতে সুর ভেজেছেন—সার্থক সম্মোহন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অনুরূপভাবে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি জনাব আতাউর রহমান খান বা অন্য যে কেউ বঙ্গবন্ধুর পূর্বে হয়তো ব্যবহার ক’রে থাকতে পারেন, কিন্তু সময়োচিত হয় নি বলে এবং বজ্রনির্ঘোষ প্রত্যয়ে তা’ অভিব্যক্ত হয় নি বলে শুধুমাত্র গুঞ্জনের মতই শুনিয়েছে, সার্থক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে পারে নি। অবশ্য আতাউর রহমান অথবা এই জাতীয় কেউ আদৌ বঙ্গবন্ধুর পূর্বে শব্দটি ব্যবহার করেছেন কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত ক’রে কিছু বলা যায় না।
অন্যপক্ষে, বঙ্গবন্ধু এই শব্দটি এমন পরিবেশে, এমন ভঙ্গীতে, এমন কঠোর ভাষায় ও বলদৃপ্ত কণ্ঠে এবং এমন যথাসময়ে ঘোষণা করলেন যে, ঘোষণার পর তা’ সাড়ে সাত কোটি মানুষের সিদ্ধান্ত হিসেবে গৃহীত হ’ল। শেরে বাংলা ফজলুল হক এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মাজারে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের এই দুই মহান নেতার অমর স্মৃতিকে সাক্ষী রেখে তিনি এই নামটি ঘোষণা করেন।
এ কারণেই আমি বলেছি যে, ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি সম্পর্কে একটি গুঞ্জন উঠেছিল, সে গুঞ্জন কোন ব্যক্তিবিশেষের মুখ থেকে আসে নি, সে গুঞ্জন ছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষের হৃদয়ের গুঞ্জন—সেই হৃদয়ের বাণীকে প্রথম সার্থক সিদ্ধান্তে ও সিদ্ধান্তকে ঘোষণায় রূপদান করলেন যিনি, তিনি এই সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এ কারণে বঙ্গবন্ধুই পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ শব্দে চিহ্নিতকরণের প্রথম সার্থক প্রবক্তা, যেমন তিনি এই দেশের এক মহান জন্মদাতা।
যাহোক, বাংলার স্বাধিকার দাবী অর্জনের জন্য শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুদিবসেও পুনরায় দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন। আগেই বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমেই তিনি তা’ আদায় করতে চান, কিন্তু কোন কোন স্বার্থবাদী মহল নানা ছুতানাতা দেখিয়ে তা’ বানচালের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে দেখে তিনি জনগণকে সে সম্পর্কে হুঁশিয়ার ক’রে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪৫

দিয়ে বলেন, “স্বার্থবাদী মহল আসন্ন সাধারণ নির্বাচন বানচালের যে চক্রান্ত চালাইতেছে, উহা প্রতিহত করিয়া ছয়-দফার স্বপক্ষে ঐক্যবদ্ধ রায় ঘোষণা করিতে পারিলে বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবী ঠেকাইয়া রাখিতে পারে এমন সাধ্য পৃথিবীতে কাহারো নাই।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৬৯]

পরদিন অর্থাৎ ৬ই ডিসেম্বরেও ঐ একই স্থানে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণ দিতে গিয়ে জনগণকে সতর্ক ক’রে দিয়ে ঘোষণা করেনঃ “আগামী সাধারণ নির্বাচনে চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারিত হইবে। তাই এই নির্বাচনকে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে গণভোট হিসাবে গ্রহণ করিয়া বাঙালীদের ছয়-দফার স্বপক্ষে ঐক্যবদ্ধ রায় দিতে হইবে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৬৯]

মোরা করেছি পণ, হ’তে দেবনা নির্বাচন
শেখ মুজিব যখন বাংলার জনগণের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচনে জনগণের রায় কামনা ক’রে একের পর এক প্রচারাভিযান চালাচ্ছিলেন, ঠিক সে সময়ই মওলানা ভাসানী তাঁর স্বমূর্তিতে আত্মপ্রকাশ ক’রে নির্বাচন-বিরোধী ভূমিকা পালনের জন্য মাঠে নেমে পড়েন। ১৯৬৯ সালের ৬ই ডিসেম্বরেই তিনি যখন ইসলামিক একাডেমীতে দলীয় কর্মী সম্মেলনে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর কর্মীগণ ভোটের আগে ভাত চাই, নইলে এবার রক্ষা নাই’, ‘নির্বাচন নির্বাচন, বর্জন বর্জন’, ‘মোরা করেছি পণ, হ’তে দেবনা নির্বাচন’ প্রভৃতি শ্লোগান দিয়ে চলছিলেন। আশ্চর্যের কথা, মওলানা সাহেব অনেক আগেই ছাত্রদের ১১-দফাকে তাঁদের দফা বলে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সেই ১১-দফার অন্যতম শর্ত যে ছিল নির্বাচন, সে কথার কোন আমলই তিনি দিলেন না।

প্রতারণার পুরোন পদ্ধতিরই নতুন প্রয়োগ
পূর্বেই বলা হয়েছে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ইয়াহিয়া খান আইয়ুবের মতই চমক দেবার মত কিছু কিছু কাজ ক’রে জনচিত্তে আসন দখলের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। হরহামেশাই তিনি বেতারভাষণ ও বিবৃতি দান ক’রে জনদরদী মনোভাবের পরিচয় দিতে কসুর করেন নি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪৬

১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেই দুর্নীতি উচ্ছেদকল্পে ব্যাপক অভিযান চালিয়েছিলেন এবং চাবুকের মুখে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তী ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, সেগুলো ছিল সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত। অবশ্য আইয়ুব খানের প্রাথমিক পদক্ষেপে তাঁর নগ্ন রূপটি তেমন প্রকাশমান ছিল না।
ইয়াহিয়া খানও সেটা জানেন। এবং তা’ জানেন বলেই তিনিও আইয়ুবের অনুসরণে ধীর পদক্ষেপে অগ্রসর হতে থাকেন।
এই উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া খান ১৯৬৯ সালের ৭ই ডিসেম্বর দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি অভিযোগে ৩০৫ জন প্রথম শ্রেণীর অফিসারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সাময়িকভাবে তাঁদেরকে পদচ্যুত করেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত বিপুলভাবে অভিনন্দিত হয়। পরে এই সংখ্যা ৩০৩-এ গিয়ে দাঁড়ায়।
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই তিনি জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ওয়াদা করেছিলেন এবং সেই উদ্দেশ্যে নির্বাচনের তারিখও ঘোষণা করেছেন। ১৯৬৯ সালের ২৩শে ডিসেম্বর দুই সপ্তাহ ব্যাপী সফরের উদ্দেশ্যে ঢাকায় এসে তিনি তাঁর নির্বাচনী
পদ্ধতির কথা ঘোষণা ক’রে বলেন যে, ‘১৯৬১ সালের আদমশুমারীর ভিত্তিতেই পরিষদের আসন বন্টন করা হইবে।’ তিনি তাঁর পূর্বঘোষিত ‘এক ব্যক্তি, এক ভোট’ কথাটির ব্যাখ্যাদান ক’রে আরো বলেন যে, এর অর্থ ‘জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব এবং এই ব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান অপেক্ষা জাতীয় পরিষদে অধিক সংখ্যক আসন লাভ করবে। প্রেসিডেন্ট আরো ঘোষণা করেছিলেন যে, ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট হওয়ার ব্যাপারে তিনি আগ্রহী নন। ৩১শে ডিসেম্বর তিনি ঢাকায় প্রেসিডেন্ট হাউসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “দিগন্তে আশার আলো দেখিতেছি, গণমানসে শুভ চেতনার উন্মেষে আনন্দিতও হইয়াছি।” নির্বাচন-প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের ভূমিকায় সন্তোষ প্রকাশ ক’রে ৫ই জানুয়ারী ১৯৭০ তারিখে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন।
এর আগে ১৫ই ডিসেম্বর (’৬৯) শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষিত নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ ক’রে শোষণহীন
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪৭

সমাজব্যবস্থা কায়েমে আওয়ামী লীগকে সাহায্যের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। সে দিন নিউমার্কেট আওয়ামী লীগ কর্মীদের এক সমাবেশে বক্তৃতা দান করতে গিয়ে তিনি বলেন, “গত ২২ বৎসরে এক শ্রেণীর লোক শোষণের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক বনিয়াছেন। অপর দিকে এক শ্রেণীর লোক ভিক্ষার ঝুলি লইয়া পথে নামিয়াছেন। … … সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত হইয়াছে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৬৯]

বাঙ্গালী মানসিকতার বিকাশের প্রশ্নে শেখ মুজিব
প্রদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির সাথে সাথে সাংস্কৃতিক বিকাশেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, নইলে জাতীয় জীবনে পূর্ণাঙ্গতা আসতে পারে না। সেকথা শেখ মুজিব ভালো করেই জানেন এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। আর এই বিশ্বাসের বলেই তিনি ১৬ই ডিসেম্বর (’৬৯) রবীন্দ্র রচনাবলী প্রকাশের জন্য ‘বাংলা উন্নয়ন বোর্ডে’র প্রতি আহ্বান জানান। সেদিন সন্ধ্যায় ‘বাংলা একাডেমী’তে আয়োজিত একটি ঘরোয়া বৈঠকে ‘গ্রামোফোন কোম্পানী অব ঈস্ট পাকিস্তান কর্তৃক পাকিস্তানে প্রস্তুত রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রথম মৌলিক রেকর্ডের সেট বঙ্গবন্ধুকে উপহার দেয়া হয়। খবরের কাগজে সংবাদটি এইভাবে পরিবেশিত হয়েছেঃ “তিনি পশ্চিম বঙ্গের বই পুস্তক পূর্ববঙ্গে প্রকাশের উপর বিধি নিষেধ তুলে নেয়ার জন্যও দাবী জানান।” বঙ্গবন্ধু বলেন, “যে জাতি তাহার কবি-সাহিত্যিককে সম্মান করে না, সে জাতি কখনও সমৃদ্ধ হইতে পারে না। তিনি বলেন, “রবীন্দ্রনাথ তাঁহার রচনাবলীতে কোটি কোটি বাঙ্গালীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাইয়াছেন।” শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, “বিগত ২২ বৎসর যাবৎ বাংলার সংস্কৃতি ও ভাষাকে দমাইয়া রাখার বহু ষড়যন্ত্র হইয়াছে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সে সব ষড়যন্ত্র রুখিয়াছে।”
তিনি আরো বলেন যে, “শোষকচক্র ভাবিয়াছিলেন যে, জনসাধারণকে দাবাইয়া রাখিতে হইলে উহার সংস্কৃতিকে ধ্বংস করিতে হইবে। এতদুদ্দেশ্যেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর বিভিন্ন পর্যায়ে হামলা নামিয়া আসে।” এ প্রসঙ্গে তিনি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আনুপূর্বিক ব্যাখ্যা দান করেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪৮

শেখ মুজিব বলেন যে, সংস্কৃতির উপর হামলার কারণেই রবীন্দ্র সঙ্গীতের উপর হামলা আসে। রবীন্দ্র সঙ্গীত ছাড়া বাংলা সঙ্গীত যে অসম্পূর্ণ এ কথাও তিনি উল্লেখ করেন। শেখ মুজিব আবেগজড়িত কণ্ঠে এ কথা বলেন যে, অন্যান্য বাঙ্গালীর জীবনে এবং বাংলা সাহিত্যের ন্যায় তাঁর জীবনেও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের প্রভাব অপরিসীম। জেলখানার নির্জনে রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’ তাঁহাকে প্রেরণা যোগাইত বলিয়া শেখ মুজিব উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, জেলে ‘সঞ্চয়িতা’ হইতে ‘বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা’ কবিতা পাঠ করিয়া তিনি প্রেরণা লাভ করিতেন।
শাহজাদপুরে এবং শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত কুঠিবাড়ীর যথাযথ সংরক্ষণ না হওয়ায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। … শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের নদ-নদী, আবহাওয়া, জলবায়ু, মানুষ ও প্রকৃতি এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন করার জন্য শিল্পী সাহিত্যিকদের প্রতি আহ্বান জানান। … শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, আর বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির উপর কোন হামলা হইতে দেওয়া হইবে না এবং এখন হইতে পূর্ব পাকিস্তান অবশ্যই বাংলাদেশ নামে পরিচিত হইবে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৬৯]
৬-দফাঃ শ্রমিক সমাজের সমর্থন
আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে ৬-দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে প্রদেশের শ্রমিক সমাজ সুস্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন রায় ঘোষণা করেন। ১৯৭০ সালের ১লা জানুয়ারী তারিখে পল্টন ময়দানে জাতীয় শ্রমিকলীগ আহূত এক জনসভায় শ্রমিক সমাজ আওয়ামী লীগের পক্ষে তাদের রায় ঘোষণা করেন। এ সম্পর্কে পরদিন সংবাদপত্রে লেখা হয়ঃ “স্বাধীনতা পরবর্তী তেইশ বছরের প্রথম দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতিলগ্নে অবাধ রাজনৈতিক তৎপরতা শুরুর সর্বপ্রথম সুযোগে গতকাল (বৃহস্পতিবার) রাজধানী ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে জাতীয় শ্রমিক লীগ আয়োজিত এক বিরাট শ্রমিক জনসমাবেশে বাংলার বঞ্চিত গণমানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির নির্ভূল উপায় হিসাবে ৬-দফা কর্মসূচী বাস্তবায়ন ও বন্যা সমস্যার সমাধানের পক্ষে দ্ব্যর্থহীন রায় ঘোষণা করা হয়।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২রা জানুয়ারী, ১৯৭০]
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪৯

ঐক্যজোট ও শেখ মুজিব
আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব জনসমর্থন লক্ষ্য ক’রে কোন কোন রাজনৈতিক দল হতাশ হয়ে পড়ে। নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য এই সব দলের কর্তাব্যক্তিগণ আওয়ামী লীগের নিকট নির্বাচনী ঐক্যের আহ্বান জানাতে থাকেন। রিকুইজিশনপন্থী ন্যাপ (ওয়ালী গ্রুপ) ‘১১-দফার’ ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনাসহ গণদাবী আদায় ও আন্দোলনের স্বার্থে ভাসানী ন্যাপ, আওয়ামী লীগ ও অপরাপর গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যজোট গঠনের আহ্বান জানান।
শেখ মুজিব এই আহ্বানকে সম্পূর্ণ নাকচ করে দেন। ১৯৭০ সালের ৪ঠা জানুয়ারী পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ২২তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে রমনা পার্কে আয়োজিত এক পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দান কালে তিনি ঘোষণা করেন যে, ‘তাঁর দল নির্বাচনী ঐক্যে বিশ্বাসী নয়।’
পত্রিকার উদ্ধৃতি এইরূপঃ “কোন কোন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ঐক্যজোট গঠনের নামে ধুম্রজাল সৃষ্টির প্রচেষ্টার জবাবে শেখ মুজিব বলেন যে, জগাখিচুড়ি যুক্তফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়ী হইয়া ক্ষমতাসীন হওয়া গেলেও জনসাধারণের কোন উপকার করা যায় না। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্টের পরিণতিই ইহার প্রমাণ বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন। শেখ সাহেব বলেন, তদানীন্তন সরকারের শিকার যুক্তফ্রন্টের কোন কোন দলের কতিপয় নেতার গণবিরোধী ভূমিকার দরুনই যুক্তফ্রন্ট জনগণের জন্য প্রত্যাশিত কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধান করিতে পারে নাই। তাই, তিনি বলেন, নিজস্ব কর্মসূচী লইয়া জনগণের সামনে হাজির হওয়াকেই আওয়ামী লীগ সর্বশ্রেষ্ঠ পথ হিসাবে বাছিয়া নিয়াছে। আওয়ামী লীগ চায়, জনগণের ঐক্য।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই জানুয়ারী, ১৯৭০]

বক্তৃতাকালে বঙ্গবন্ধু ঐক্যজোটের বিরোধিতা ক’রে আরো বলেন, “১৯৬৬ সালে যখন ৬-দফার সংগ্রাম দুর্বার হয়ে উঠে, তখন এক শ্রেণীর অতিপ্রগতিবাদী ইহার মধ্যে ‘বিদেশী হস্তের কারসাজী’ আবিষ্কার করিয়াছিল। ‘আমি প্রেসিডেন্ট হইলে শেখ মুজিবকে গুলী করিয়া
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫০
মারিতাম’ বলিয়া তাহাদের কেহ কেহ ঘোষণা করিয়াছে, আর ৬-দফার জন্য যখন বাংলার মানুষ গুলী খাইয়া রাজপথে লুটাইয়া পড়িয়াছে, তখন ইহারা আইয়ুব খানের দালালী করিয়াছে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই জানুয়ারী, ১৯৭০]

৩রা জানুয়ারী (’৭০) নবাবজাদা নসরুল্লাহ শেখ মুজিবকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ ও মওলানা ভাসানীকে ‘হনুমান’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এর জবাবে শেখ মুজিব ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে বলেনঃ “ছয়-দফা আন্দোলনের দায়েই কুর্মিটোলা সেনানিবাসে বন্দী থাকাকালে নবাবজাদা আমার কাছে ধরণা দিয়াছিলেন দেশের সমস্যা সমাধানে একজন ‘দেশপ্রেমিকের’ সাহায্যের জন্য। আজ সেদিনের সেই ‘দেশপ্রেমিক’ লোকটি নবাবজাদার কাছে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হইয়া গেলেন কেমন করিয়া?”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই জানুয়ারী, ১৯৭০]

একই দিনে নারায়ণগঞ্জের এক বক্তৃতাসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ নসরুল্লাহর কঠোর সমালোচনা ক’রে বলেন যে, “শোষিত মানুষের বিজয়ের সম্ভাবনায় নসরুল্লাহ প্রমাদ গণিতেছেন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই জানুয়ারী, ১৯৭০]

১৯৭০ সালে ১১ই জানুয়ারী তারিখে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ঢাকার পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পল্টনে গণসমাবেশের মহাসমুদ্রকে সাক্ষী রেখে শোষক, কুচক্রী ও ভাওতাবাজদের প্রতি চ্যালেঞ্জ প্রদান করেন। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাক লিখেছেনঃ
“তদানীন্তন গভর্নর মোনেম খাঁ একদিন ঘোষণা করেছিলেন, ৬-দফার প্রণেতা শেখ মুজিবকে ‘আর দিনের আলো দেখিতে দিব না। পল্টনে দাঁড়াইয়া তাঁহাকে আর ৬-দফার ব্যাখ্যাও করিতে হইবে না। দীর্ঘ সাড়ে তিন বৎসর পর মোনেমের সেই ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তির জবাব দিয়াছেন ৬দফার প্রণেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং। জবাব দিয়াছেন জাগ্রত বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষ, আর জবাব দিয়াছে ঢাকার সেই ঐতিহাসিক পল্টন ময়দান। ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকের, মাতা-ভগিনী-শিশুর রক্তের বিনিময়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫১

অর্জিত অধিকার বলে ৬-দফার প্রণেতা শেখ মুজিবুর রহমান সেই ‘নিষিদ্ধ’ পল্টনে দাঁড়াইয়াই গতকাল বক্তৃতা করিয়াছেন, সেই ‘নিষিদ্ধ’ পল্টনে সমবেত হইয়াই সেদিনকার স্বৈরাচারী শাসকের অস্ত্রের ভাষার লক্ষ্য ছিল যে ৬-দফা, সে ৬-দফার বাণীই শুনিয়াছেন তাঁহারা শেখ মুজিবের কণ্ঠে। আর সেই পল্টনের অবাক করা সর্বকালের বৃহত্তম জনসমাবেশকে উদ্দেশ্য করিয়া শোষক, কুচক্রী ও রাজনৈতিক ভাওতাবাজদের মুখোশ এক এক করিয়া উন্মোচন করিয়াছেন বঙ্গবন্ধু। আগামী নির্বাচনকে উপলক্ষ করিয়া নিজ দলের কর্মসূচী, মত ও পথ সর্বসাধারণ্যে তুলিয়া ধরিয়াছেন তিনি।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ই জানুয়ারী, ১৯৭০]

এই দিনের জনসমাবেশের একটি চমৎকার চিত্র অপর একটি দৈনিকে পরিবেশিত হয়েছেঃ “জনতার পদভারে গর্বিত হওয়ার জন্য উন্মুখ পল্টন ময়দান গতকাল রোববার জনতাকে ঠাই দিতে গিয়ে হার মেনেছে। জনতার তুলনায় বৃহদায়তন পল্টনকেও মনে হচ্ছিল—ছোট সে মাঠ, আর ঠাই নেই। সামনে-পেছনে, ডাইনে-বামে তাকালে দেখা যায় সারির পর সারি। দূরে আরো দূরে ছেয়ে গেছে। বিন্দু বিন্দু মাথা-তারপরও ধূ ধূ বিন্দু—সেই বিন্দু মিলে মিশে প্রথমে অযুত, তারপর লক্ষ-নিযুত বিন্দু—ভৈরব গর্জনে মুখরিত জনতার উদ্বেল সমুদ্র গড়েছে।
পল্টন গতকাল মহাসমুদ্র সৃষ্টিতে নয়া ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। মাঠ উপচে পড়েছে জনতায়। তারপর হাজারে হাজারে গিয়ে ঠাই নিয়েছে ঢাকা স্টেডিয়ামের দোতালায়, তেতালায়, জিন্নাহ এভেনিউর দেওয়ালে আর পাশ্ববর্তী প্রাসাদগুলোর শীর্ষে।
তারা এসেছে কাতারে কাতারে। এসেছে অসংখ্য মিছিল ক’রে, ‘জাগো জাগো বাঙালী জাগো’ ধ্বনি তুলে। জোয়ারের মত এসে মিলেছে। মিছিলের পর মিছিল এসেছে নারায়ণগঞ্জ, আদমজী, ডেমরা, কাঞ্চন, শ্রীপুর, কলাতিয়া, সুভড্যা, তেজগাঁ, মীরপুর থেকে। এসেছে ট্রাকে, এসেছে বাসে চেপে। এসেছে ড্রাম বাজিয়ে, বাজি পুড়িয়ে, বহু বিচিত্র ব্যানার-ফেস্টুন বহন ক’রে ঢাকা নগরীর প্রতি মহল্লা থেকে। ….”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১২ই জানুয়ারী, ১৯৭০]
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫২

তুমুল করতালি, তোপধ্বনি ও পটকা আওয়াজের মধ্যে বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেনঃ “আওয়ামী লীগ চায় কৃষকের, শ্রমিকের রাজত্ব স্থাপন করতে। তাঁর দল দেশের সকল মূল শিল্পসহ ব্যাঙ্ক ও বীমা ব্যবসায় জাতীয়করণ করবে। ২৫ বিঘা পর্যন্ত চাষীর জমির কোন খাজনা থাকবে না এবং দশ বছর পর্যন্ত কৃষকের জমির খাজনা মওকুফ করা হবে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১২ই জানুয়ারী, ১৯৭০]

শেখ মুজিব ঘোষণা করেছিলেন মাতা, ভ্রাতা ও শিশু হত্যাকারী আইয়ুব মোনেম চক্র যে বাংলার জনগণের রক্ত শোষণ ক’রে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন, তার বিচার যদি ইয়াহিয়া সরকার না করেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে সে কাজ সম্পন্ন করবে। তিনি দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেন, “হত্যাকারী কনভেনশনীদের আমরা ক্ষমা করব না, তাদের ক্ষমা করলে শহীদ আসাদ, জহুর, মতিউরসহ অসংখ্য শহীদের রক্তের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ১২ই জানুয়ারী, ১৯৭০]

শেখ মুজিবের ব্যাপক গণসংযোগ, সংগঠন ও বজ্রকঠোর ভাষণ অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। জানুয়ারীর ১৬ তারিখে ময়মনসিংহের সার্কিট হাউজ ময়দানে তিনি দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, দেশে জনগণের সরকার কায়েম হ’লে মোনেম খাঁকে ক্ষমা করা হবে না, তাঁর সমস্ত সম্পত্তির যথাযথ হিসেব করা হবে।
বঙ্গবন্ধু সেদিন “দীর্ঘ দশ বৎসর ধরিয়া বাংলাকে শোষণ ও বাঙ্গালীকে শাসন করার ন্যক্কারজনক কলঙ্ক আবদুল মোনেম খানের জন্মভূমির অধিকার-সচেতন লক্ষ লক্ষ মানুষকে সামনে রাখিয়া দেশময় এক শোষণহীন সমাজ-ব্যবস্থা কায়েম করার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ই জানুয়ারী, ১৯৭০]
তিনি বলেন, “আমাদের আদর্শ মস্কো হইতে আসিবে না, পিকিং হইতে আসিবে না, আমেরিকা হইতে আসিবে না, আমাদের আদর্শের উদ্ভব ঘটিবে আমার দেশের পলিমাটি হইতে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ই জানুয়ারী, ১৯৭০]
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫৩

নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টায় জামাতে ইসলামের জিহাদ
এদিকে জামাতে ইসলামী নামে একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল জানুয়ারীর ১৮ তারিখে (’৭০) জনসভার নাম ক’রে পল্টন ময়দানে জেহাদ ঘোষণা করলো। ঐ দিন “রাজনৈতিক আচরণ সংক্রান্ত ৬০নং সামরিক বিধির কতিপয় সুস্পষ্ট বিধান লঙ্ঘন করিয়া প্রকাশ্য জনসভায় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অশালীন ভাষায় যথেচ্ছ আক্রমণ চালাইতে থাকিলে যখন সভায় আপত্তি উত্থাপিত হয়, তখন নিরীহ শ্রোতৃমণ্ডলীর উপর লাঠিসোটা লইয়া জামাতে ইসলামীর তথাকথিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী উর্ধ্বশ্বাসে ঝাঁপাইয়া পড়িলে বিক্ষুদ্ধ জনতার রোষানলে গতকল্যকার পল্টন ময়দানের জামাতে ইসলামীর জনসভা লণ্ডভণ্ড হইয়া যায় এবং জামাতের তথাকথিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ক্রদ্ধ জনতার মধ্যে দুই ঘন্টাব্যাপী খণ্ডযুদ্ধে অন্যূন সাড়ে চার শ’জন আহত হইয়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে নীত হন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯শে জানুয়ারী, ১৯৭০]

জামাতের জনসভায় সুপরিকল্পিতভাবে গোলযোগ ও মারধোর করবার এই আয়োজন ছিল উদ্দেশ্যমূলক। আসন্ন নির্বাচন বানচালের জন্যই এমন একটি পরিস্থিতির অবতারণা করা হয়।
পূর্ব বাংলার গণমানসে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য দেখে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল জামাতে ইসলাম আঁতকে উঠেছিল। ধর্মের নামে এতকাল যে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী শোষণ ক’রে আসছিল, আগামী দিনগুলোতে তার পথ রুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনায় তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এখানে একটা কথা উল্লেখযোগ্য যে, মুসলিম লীগ বিগত দিনগুলোতে শাসন কুক্ষিগত করে রাখলেও তাদের তাঁবেদার হিসেবে যে সমস্ত ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের বিরুদ্ধে তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে এসেছেন, জামাতে ইসলাম আসলে সেই সব দলের অন্যতম। ইস্কান্দার, আইয়ুব, ইয়াহিয়া বা সবুর-মোনেমের সঙ্গে মওলানা মওদুদী, মিয়া তোফায়েল আহমদ বা গোলাম আজম-আবদুর রহীমের কোন পার্থক্যই ছিল না। আর ছিল না বলেই জামাতের নেতারা ধর্মান্ধতায় উন্মত্ত হয়ে এবং কায়েমী স্বার্থবাদীদের হাতে ক্রীড়নক হিসেবে কাজ ক’রে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫৪

জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের পথটি বারবার রুদ্ধ করতে চেয়েছে। ১৯৫৮ সালে আমরা দেখেছি যে, কি ভাবে আইনসভায় বিশৃঙ্খল কার্যকলাপ সৃষ্টি ক’রে এঁরা আইয়ুবকে ডেকে এনেছেন।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ফলশ্রুতি হিসেবে গণ-অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি যখন প্রায় একরূপ সুনিশ্চিত, তখনই এঁরা চরম উচ্ছৃঙ্খলতা প্রদর্শনের মাধ্যমে সমগ্র সাফল্য বানচাল ক’রে ইয়াহিয়া খানকে ডেকে আনতে সাহায্য করেছেন। আজ আবার সুপরিকল্পিতভাবে জনসভা আহ্বান ক’রে আসন্ন নির্বাচন বানচালের চেষ্টা চালিয়েছেন।
জামাতে ইসলামী আহূত এই জনসভায় জামাত কর্মীদের ন্যক্কারজনক কার্যকলাপে জনগণ এতই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে যে, তারা সভামঞ্চ দখল ক’রে মঞ্চসহ সভার যাবতীয় সরঞ্জামে আগুন ধরিয়ে দেয়। জামাতের আমীর মওলানা মওদুদী সভার প্রধান বক্তা হলেও তাঁর পক্ষে সভাস্থলে উপস্থিত হওয়া সম্ভব হয় নি। জামাতের হামলার ফলে আহতদের মধ্যে দুইজন হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে।
এইভাবে নির্বাচনের পূর্বে একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি ক’রে জনগণকে বিভ্রান্ত করার একটা সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র কায়েমী স্বার্থবাদী দলগুলোর পক্ষ থেকে চলতে থাকে—জামাতের কার্যকলাপ তারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। এই সব দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র ক’রে ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী তাঁদের মতলব হাসিলের সুযোগ সন্ধান করতে থাকলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাওয়ালপিণ্ডি থেকে ১৯৭০ সালের ২০শে জানুয়ারী বললেনঃ “হাঙ্গামা সৃষ্টিকারিগণ জনগণের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিতেছে।” উক্ত ঘটনাসমূহকে কেন্দ্র ক’রে করাচীর ‘দৈনিক মাশরিক’ ঘোষণা করলো যে, পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক দুর্ঘটনাসমূহের মধ্যে হিন্দুদের হাত রয়েছে। শুধু তাই নয়, পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র লাল রং দিয়ে ছাপিয়ে তাতে ‘ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজেউন’ লিখে তারা পূর্ব পাকিস্তানের ইন্তেকাল ঘোষণা করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। এধারার উস্কানিমূলক কাজ ও আচরণ দ্বারা দেশের অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি করাই যে শোষক মহলের উদ্দেশ্য ছিল সে বিষয়ে বিবেকবান কারো মনে কোন সন্দেহ রইলো না। কিন্তু জাগ্রত জনতাও এজন্য প্রস্তুত
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫৫

ছিল। পল্টনের বিরাট জনসমাবেশে (২৫শে জানুয়ারী) ছাত্রনেতৃবৃন্দ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। ১১-দফা সপ্তাহের সমাপ্তি দিবসে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য, ডাকসু সহ-সভাপতি এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি তোফায়েল আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বিরাট জনসভায় বক্তৃতা দান করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য—আবদুর রহমান, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য আ. স. ম. আবদুর রব, ছাত্র লীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক জনাব খালেদ মোহম্মদ আলী ও জনাব আবদুর রাজ্জাক, ছাত্রলীগের সহ-সভানেত্রী ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যা রাফিয়া আখতার ডলি, ছাত্রলীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি, জাতীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুল মান্নান এবং সভাপতি স্বয়ং। সভাপতি তরুণ ছাত্রনেতা, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের অগ্নিসারথি। তিনি তাঁর জ্বালাময়ী ভাষায় দেশের কুচক্রী ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের সতর্ক ক’রে দেন। এই দিনের সকল বক্তার মূল কথা ছিলঃ “নির্বাচন বানচালের যে কোন চক্রান্ত এদেশের সংগ্রামী জনতা রুখিয়া দাঁড়াইবে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৬শে জানুয়ারী, ১৯৭০]

যা হোক, জামাতে ইসলামীর এই সুপরিকল্পিত ও কাপুরুষোচিত নৃশংস হামলার কঠোর নিন্দা ক’রে পরদিন বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ সংবাদপত্রে বিবৃতি দান করেন। ১৮ই জানুয়ারী তারিখে জামাতের গুণ্ডামীর প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ১৯শে জানুয়ারী (’৭০) ঢাকায় সর্বাত্মক হরতাল পালন করা হয়। এ সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১-দফা সপ্তাহ পালন করছিল।
ঐ দিন মওলানা ভাসানী সন্তোষে এক বক্তৃতায় সংহতি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সারা দেশে লাঠিধারী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের আহ্বান জানান।
শেখ মুজিব তখন তাঁর ভাগ্নের বিয়েতে যোগ দেওয়ার জন্য খুলনায় অবস্থান করছিলেন। ২১শে জানুয়ারী তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫৬

২৩শে জানুয়ারী কুমিল্লার এক জনসভায় বক্তৃতা দান করতে গিয়ে বলেন, ‘খাস মহলের জমি ভূমিহীন চাষীদের মধ্যে বন্টন করিতে হইবে।’
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪শে জানুয়ারী, ১৯৭০]

ছাত্র সমাজ ২৪শে জানুয়ারী গণ-অভ্যুত্থান দিবস পালন করে। ঐ দিন জাগ্রত ছাত্র সমাজ শহীদানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার শপথ গ্রহণ করে।
১৯৭০ সালের ২৯শে জানুয়ারী তারিখে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচার অভিযান উপলক্ষে রাজশাহীতে গমন করেন। ঢাকা থেকে যাওয়ার পথে পাবনার নগরবাড়ীতে তাঁকে বিপুলভাবে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, “ধর্ম ও সংহতির জিগির তুলিয়া যাহারা পাকিস্তানে শোষণতন্ত্র কায়েম করিতে চায়, তাদের বিরুদ্ধেই আমাদের সংগ্রাম—দেশের কোন এলাকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমাদের কোন বিরোধ নাই।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৩০শে জানুয়ারী, ১৯৭০]

পরদিন ৩০শে জানুয়ারী রাজশাহীতে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় বঙ্গবন্ধু পুনরায় বলেনঃ “আমার সংগ্রাম কায়েমী স্বার্থবাদী, শোষক ও জালেমদের বিরুদ্ধে। আপনারাও এ সংগ্রামে শরিক হউন-যে শোষক ও জায়গীরদারদের দল বাইশ বছর ধরিয়া আপনাদের রক্ত চুষিয়া খাইয়াছে, তাহাদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়িয়া তুলুন।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৩১শে জানুয়ারী, ১৯৭০]

গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ঃ প্রথম ঘোষণা
উক্ত জনসভায় তিনি অবিলম্বে ইউনিয়ন কাউন্সিল বাতিল ক’রে সরকারী নিয়ন্ত্রণমুক্ত বোর্ড গঠনের দাবী জানান। রাজশাহীর এই বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধুকে রাজশাহীবাসীর পক্ষ থেকে যে মানপত্রটি প্রদান করা হয় সে’টি লিখবার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল আমার ওপর। এ জন্য বিশেষ কৃতিত্ব নেবার উদ্দেশ্যে আমি এই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করছি তা’ নয়, উল্লেখের মত ঘটনাও এ’টি নয়। যে কারণে আমি উল্লেখ করছি তা’ হ’ল এই যে, উক্ত মানপত্রে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সার্থক সমন্বয়ের কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এবং বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছিল। আমার এখনো মনে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫৭

আছে, লেখা হয়েছিল, সমাজতন্ত্রবিহীন গণতন্ত্র সমাজে স্বার্থবাদী শ্রেণী তৈরী করে এবং সে কারণেই এই গণতন্ত্র বুর্জোয়া শোষণতন্ত্রের নামান্তর-এর মাধ্যমে সমাজবাদী শক্তির পোষকতা করা হয়, অন্যপক্ষে গণতন্ত্রবিহীন সমাজতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রের নামান্তর। এতে সত্যভাষণের অধিকার বিলুপ্ত হয়। এবং স্বৈরাচারী শক্তিই প্রাধান্য বিস্তার করে। এই দুই কোটির সমন্বয়ের মাধ্যমেই একটি আদর্শ ব্যবস্থাপনার উদ্ভব সম্ভব।
কথাগুলো বঙ্গবন্ধুর হৃদয়স্পর্শ করেছিল। আসলে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারাও সুদীর্ঘকাল হ’ল এই আদর্শেই উজ্জীবিত। জনসভায় তাই তিনি বলেছিলেন যে, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সার্থক সমন্বয়ের মাধ্যমেই বিশ্বের অনুন্নত মানুষের, বিশেষ ক’রে আমাদের সমাজের বিপুল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। আমাদের আজ এই ধারায় চিন্তা করতে হবে। আমরা এই সমন্বিত আদের্শেই আমাদের সমাজকে গড়ে তুলতে চাই।
কতদূর সত্য জানি না, সম্ভবতঃ রাজশাহীর এই জনসভায়ই তিনি তাঁর এই মহৎ আদর্শের কথা প্রথম একটি ঘোষণার আকারে প্রকাশ করেন। এর পূর্বে কোথাও তিনি এমনভাবে এই আদর্শের কথা ঘোষণা করেছেন বলে আমার জানা নেই। এদিক থেকে জনসভাটির একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে।
অবশ্য খবরের কাগজে বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা বিশেষ গুরুত্বলাভ করে নি। কিন্তু সভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের নিশ্চয়ই ঘটনাটি স্মরণ থাকবার কথা। বঙ্গবন্ধুর এই আদর্শের সূত্র ধরে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সময় সম্পর্কে প্রায় পুরো এক ঘন্টা আলোচনা করেন জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বস্তুতঃ সৈয়দ সাহেবের সেদিনকার আলোচনার মূল বিষয়বস্তুই ছিল গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয়। আর তাঁর এই আলোচনা এতই জ্ঞানগর্ভ হয়েছিল যে, পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় মহলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের সুদীর্ঘ বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ—এই দুটো বিষয়ই ছিল সকলের আলাপের বিষয়। উল্লেখ প্রয়োজন যে, জনাব তাজউদ্দিন আহমদ সাহেবও তাঁর আলোচনায় এই সময়ের কথা উল্লেখ করেছিলেন।
সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিন আহমদ আমার বাসায় এলেন বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে। আমি তখন বাংলা বিভাগের প্রফেসর ও অধ্যক্ষ
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫৮

এবং শাহ মখদুম ছাত্রাবাসের প্রাধ্যক্ষ। বঙ্গবন্ধু সহাস্যে আমাকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, “আমি বুঝতে পেরেছি, মানপত্রটি আপনি লিখেছেন—ঠিক বলিনি?”
অতঃপর আমাদের মধ্যে যে আলোচনা হ’ল তার মূল বিষয়ই ছিল গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমন্বয়। মুষ্টিমেয় কয়েকজন অধ্যাপক এই আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন। যদিও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম বেশ কয়েকজনকে, কিন্তু উপস্থিতির সংখ্যা ছিল নগণ্য। সৎসাহসের অভাব। আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ খুব হিসেব ক’রে চলেন।
যাহোক, পরবর্তীকালে এই দুইটি আদর্শ স্বাধীন বাংলাদেশের চারটি মূলনীতির অঙ্গীভূত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘকালের স্বপ্ন আমাদের শাসনতন্ত্রে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
একটি কথা এখানে বলে রাখা দরকার যে, ইসলামপন্থী সকল রাজনৈতিক দলই স্বার্থের দ্বারা বা কায়েমী স্বার্থবাদীদের ইঙ্গিতে পরিচালিত হয়েছিল একথা বলা যায় না। জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ছিল এর ব্যতিক্রম। ১৯৭০ সালের ৩১শে জানুয়ারী পল্টন ময়দানে প্রগতিশীল ও উদারপন্থী মুসলিম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের উদ্যোগে আয়োজিত এক জনসমাবেশে নিখিল পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মওলানা মুফতি মাহমুদ স্বার্থান্ধ ও ধর্মান্ধ একশ্রেণীর প্রতিক্রিয়াশীল আলেম কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবী ৬-দফা এবং ১১-দফাকে ইসলামবিরোধী আখ্যাদান এবং ৬-দফা ও ১১-দফার উত্থাপক ও সমর্থকদের কাফের ফতোয়াদানকে দেশবাসীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা এবং ইসলামের প্রতি বেইমানী করার শামিল বলে অভিহিত করেন।
মওলানা মুফতি মাহমুদ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ন্যায্য দাবীর সংগ্রামে জমিয়ত অংশ গ্রহণ করবে বলে জনসভায় ঘোষণা করেন। জমিয়তের অন্যতম নেতা মওলানা মহিউদ্দীন তাঁর ভাষণে প্রতিক্রিয়াশীল আলেমগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ক’রে বলেন যে, ‘ইসলাম পছন্দ’ এবং ‘ইসলাম দুশমন’ এই দুটি শ্রেণী তৈরী ক’রে তারা সংঘর্ষের প্রচারণা চালাচ্ছে। তাদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ ক’রে তিনি বলেন যে,
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫৯

‘পুঁজিবাদ’ এবং ‘ব্যুরোক্রেসির আঁতাতের বিরুদ্ধে এটাই হবে জনগণের শেষ সংগ্রাম।
সভাপতির ভাষণে পীর মোহসেন উদ্দিন বলেনঃ “আলেম হয়ে যারা স্বার্থের পিছনে ছুটে, সেই সব তল্পিবাহকের সঙ্গে আপোষ নাই।” তিনি বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার কথা উঠলেই এই সব আলেমরা ‘পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হইতে চায়’, ‘ভারতীয় চরেরা ভাষা আন্দোলন ক’রে’, ‘কাশ্মীর বিপন্ন’ প্রভৃতি জিগির তুলে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা ক’রে।” তিনি জনগণকে তথাকথিত এই আলেমদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য এক সময়োচিত আহ্বান জানান।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১লা ফেব্রুয়ারী, ১৯৭০]

১৯৭০ সালের ৩০শে জানুয়ারী রাজশাহীতে বিপুল জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ প্রদান করেন তা’ নানাদিক থেকে ঐতিহাসিক গুরুত্ব লাভ করেছে, একথা পূর্বেই বলেছি। সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য তিনি কতকগুলো চমৎকার পথনির্দেশ এই সভায় দান করেন। তিনি বলেনঃ “আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সাফল্য লাভ করলে পাট ব্যবসা, ব্যাঙ্ক, ইন্সুরেন্স কোম্পানী ও গুরুত্বপূর্ণ শিল্পসমূহ জাতীয়করণ করবে। এছাড়া কৃষকেরা শিল্পপতিদের মত কর অবকাশ ভোগ করবে, ২৫ বিঘা জমি পর্যন্ত ভূমি-রাজস্ব মওকুফ করা হবে, দশ বছর কোন ভূমি-রাজস্ব নেওয়া হবে না, তামাক ও আখের ন্যায্য মূল্যের নিশ্চয়তা বিধান করা হবে এবং শ্রমিকরা শিল্প প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ পাবে।”
৬-দফা ইসলাম বিরোধী বলে যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে শেখ মুজিব উক্ত ভাষণে তাদেরকে হুঁশিয়ার ক’রে দেন। স্বায়ত্তশাসন, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে নির্বাচনে জয়ী হলে ৬-দফা ভিত্তিক ভবিষ্যৎ সংবিধান প্রণয়ন ক’রে এদেশের বঞ্চিত মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটাতে তিনি সক্ষম হবেন বলে উদাত্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন।
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১লা ফেব্রুয়ারী, ১৯৭০]

নূরুল আমীন সারা জীবন কায়েমী স্বার্থবাদীদের মনোরঞ্জন করেছেন। তাঁর নিজস্ব নীতিবোধ বলে কিছু কোনদিনও ছিল না। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসতে লাগলো, পূর্ব বাংলার জনগণের জাগ্রত
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬০

চেতনা এবং শেখ মুজিবের অসাধারণ জনপ্রিয়তা দেখে তিনি ততই চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন। সে কারণেই যত্রতত্র তিনি আওয়ামী লীগকে আক্রমণ ক’রে নিজের নেতৃত্বকে সক্রিয় করতে প্রয়াস পেলেন। ২রা ফেব্রুয়ারী (১৯৭০) পল্টনে আয়োজিত পি. ডি. পি. এর জনসভায় আওয়ামী লীগ কর্মীরা গোলযোগ সৃষ্টি করেছে বলে পি. ডি. পি. প্রধান নূরুল আমীন সংবাদপত্রে প্রদত্ত বিবৃতিতে এক আভযোগ আনয়ন করেন। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ এই মিথ্যা অভিযোগের প্রতিবাদে সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেন। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বিবৃতিতে জানান যে, “নিজেদের দোষত্রুটি ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তারা আওয়ামী লীগের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের কর্মীদের বিরুদ্ধে গোলযোগ সৃষ্টির অভিযোগকে তিনি ‘ভিত্তিহীন’ এবং ‘প্রতিহিংসাপরায়ণ’ বলে মন্তব্য করেন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৩রা ফেব্রুয়ারী, ১৯৭০]

১৯৭০-এর ৩রা ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিব সিলেট স্টেডিয়ামের এক বিশাল জনসমুদ্রে ভাষণ দেন। সিলেট যাবার পথে তাঁর ট্রেনের গতিরোধ হয় প্রায় সর্বত্র। জনগণ তাঁর মুখ থেকে দুটো কথা শুনবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ২রা ফেব্রুয়ারী পি. ডি. পি. কর্তৃক আনীত অভিযোগ সম্পর্কে সিলেটের জনসভায় বঙ্গবন্ধু একটি চমৎকার বিশ্লেষণ প্রদান করেন। আওয়ামী লীগ কর্মীগণ কর্তৃক গোলযোগ সৃষ্টি সম্পর্কে তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাদের অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, “আমার ও আমার দলের উপর দোষারোপ করা এদেশের পায়ের তলায় মাটিশূন্য এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতার ফ্যাশানে পরিণত হইয়াছে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ঠা ফেব্রুয়ারী, ১৯৭০]

শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে বলেন যে, যারা তাকে ভালবাসেন, তাঁর ৬-দফা এবং ছাত্রদের ১১-দফায় যারা বিশ্বাসী, তাঁরা কখনও অন্যের জনসভায় গোলযোগ সৃষ্টি করতে পারেন না।
শেখ মুজিব তথাকথিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টো, ফজলুল কাদের চৌধুরী, নবাবজাদা নসরুল্লাহদের জনসভায় গোলযোগ হচ্ছে, শ্রমিক নেত্রী কানিজ ফাতিমার দলের উপর হামলা চালানো হয়েছে। এ সব ঘটনা কারা ঘটাচ্ছে তিনি
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬১

তা’ জানতে চান। তিনি পল্টনে জামাতের জনসভায় গোলযোগ সম্পর্কে পত্র-পত্রিকার রিপোর্টারদের অভিমতের প্রতি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দৃষ্টিও আকর্ষণ করেন।
শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে বলেন, গণধিকৃত তথাকথিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মুখে আসন্ন নির্বাচনে তাদের নিশ্চিত ভরাডুবি অনুভব ক’রে নিজেরাই নিজেদের জনসভায় ভাড়াটিয়া লোকের দ্বারা গোলযোগ সৃষ্টি ক’রে আওয়ামী লীগের উপর দোষ চাপাচ্ছে। তিনি জনসাধারণকে এই সব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কার্যকলাপ সম্পর্কে সতর্ক ক’রে দেন। ১৯৭০-এর জানুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলায় শেখ মুজিবের ব্যাপক (ঝটিকা) সফর লক্ষ্য করা যায়। জানুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চ মাসের মধ্য-সময় পর্যন্ত শেখ মুজিব রাজশাহী, টাঙ্গাইল, সিলেট, খুলনা, যশোহর, নোয়াখালী, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া, সুনামগঞ্জ, বগুড়া, নওগাঁও, রংপুর এবং দিনাজপুরে বিভিন্ন জনসভায় ভাষণ দান করেন। এ সবই ছিল তাঁর নির্বাচনী প্রচার অভিযান এবং সাংগঠনিক তৎপরতার অন্তর্ভুক্ত। সমগ্র পূর্ব বাংলাকে তিনি স্বৈরাচারী শাসন-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ৬-দফাভিত্তিক অধিকার অর্জনের সপক্ষে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে রূপান্তরিত করেন। এই শক্তি সাড়ে সাত কোটি মানুষের সমবেত শক্তি—এই শক্তি গণতান্ত্রিক চেতনার এক জাগ্রত শক্তি। শেখ মুজিব এই শক্তির পশ্চাতে এক মহানায়ক।
এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সমর্থন লাভের ওপরেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই উদ্দেশ্যে ৪ঠা ফেব্রুয়ারী তারিখে লাহোরে দলীয় কর্মীদের এক সমাবেশে দলীয়নীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঘোষণা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী জেনারেল জনাব এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান বলেন, “পল্লীবাসীর অধিকতর কল্যাণ সাধনকল্পে তাঁহার দল দেশের দুই অংশের দুইটি প্রধান অর্থকরী ফসল পাট ও তুলা-বাণিজ্যকে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত করিয়াছে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৭০]
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬২

এ ছাড়া আওয়ামী লীগ যে সাড়ে ১২ একর জমির খাজনা (ভূমিরাজস্ব) সম্পূর্ণ উঠিয়ে দেবার পক্ষপাতী সে-কথাও জনাব কামরুজ্জামান জোর দিয়ে ঘোষণা করেন।
পূর্ব বাংলার বর্ষীয়ান নেতা মওলানা ভাসানী কোনদিন কোন অবস্থাতেই তাঁর নিজস্ব পথে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনে পশ্চাৎপদ হন নি। যখন তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন যে, নির্বাচনে তাঁর দলের বিজয়ের সামান্য সম্ভাবনাও নেই, তখন তিনি তাঁর নিজস্ব পথেই যাত্রা শুরু করলেন। ৪ঠা ফেব্রুয়ারী সন্তোষে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি তাঁর বিভিন্ন দাবী-দাওয়ার বাস্তবায়ন এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সরকারকে বাধ্য করার জন্য ১২ই এপ্রিল থেকে জেহাদ এবং মে থেকে গণবিপ্লব শুরু করবেন বলে সংকল্প ঘোষণা করেন। বিপ্লবের চেতনা মওলানা ভাসানীর সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে বিরাজমান-এই চেতনাই তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, শ্রেণীসংগ্রাম এসবের কোন বৈজ্ঞানিক ধারণা তিনি আয়ত্ত করতে পারেন নি বলেই তাঁর সমস্ত সাধনাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তাঁর জেহাদ, গণবিপ্লব সে কারণেই জনমনে এখন আর কোন রেখাপাত করে না। মওলানা ভাসানীর জেহাদ বা গণবিপ্লবের প্রতি কোনরূপ ক্ৰক্ষেপ না ক’রে আওয়ামী লীগের কার্যকলাপ অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলতে থাকলো।
সকল চক্রান্ত সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। তিনি বিশেষ সতর্কতার সাথে অগ্রসর হতে থাকেন। ১৯৭০-এর ৬ই ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রামের পোলো গ্রাউণ্ডে আয়োজিত এক বিশাল জনসমুদ্রে শেখ মুজিব ভাষণ দেন। এই বিশাল জনসমুদ্রের উদ্দেশে ভাষণদান কালে শেখ মুজিব নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টায় লিপ্ত কুচক্রী মহল, গণতন্ত্র বিরোধী শক্তি এবং একশ্রেণীর আমলাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি ঘোষণা করেন, “আইয়ুব-মোনেমের বুলেট-বেয়নেটকে যারা পরোয়া ক’রে নাই, দা-কুড়াল আর ঢাল-তলোয়ারের ভয় দেখাইয়া বাংলার সংগ্রামী গণমানুষকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও স্বায়ত্তশাসন আদায়ের সংগ্রাম হইতে বিচ্যুত করা যাইবে না। তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমরাও করেছি পণ, হতেই হবে নির্বাচন’।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৭০]
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬৩

পিকিংপন্থী ন্যাপ নেতা মওলানা ভাসানীর অনুরাগীগণ লাঠি-দা-কুড়ালের মহড়া প্রদর্শন ক’রে নির্বাচন বিরোধী তৎপরতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ ক’রে মওলানা ভাসানীর উদ্দেশে শেখ মুজিব বলেন, “আমি, আমার দল আর বাংলার গণমানুষ আইয়ুব-মোনেমের বুলেট-বেয়নেটকেও পরোয়া করে নাই—আপনার সাঙ্গপাঙ্গদের এই দা-কুড়াল-লাঠিও আমাদেরকে গণতন্ত্র এবং স্বায়ত্তশাসন আদায়ের সংগ্রাম হইতে বিচ্যুত করিতে পারিবে না।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৭০]

জনগণের উদ্দেশে তাঁর সতর্কবাণীতে বঙ্গবন্ধু স্মিতহাস্যে উল্লেখ করেন যে একদল আমলা ২২ বছর থেকে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, নির্বাচন বানচালের জন্য কুচক্রী মহলের শক্তি ও সহযোগিতা যোগাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি সাম্প্রতিক সন্তোষ সম্মেলনে ওয়াপদার বিজলী বাতির ব্যবস্থা, রাতারাতি কাঁচা রাস্তায় ইট বসানোর এবং একশত গরু ও আড়াই হাজার মণ চাউল প্রদান করার বিষয়টিও ঠাট্টাচ্ছলে উল্লেখ করেন।
উক্ত জনসমাবেশে শেখ মুজিব সমুদ্র উপকুলবর্তী এলাকায় লবণ প্রস্তুতের উপর কেন্দ্রীয় আবগারি কর বিলোপ এবং চট্টগ্রাম ইস্পাত কারখানার বার্ষিক চার কোটি টাকা লোকসানের কারণ অনুসন্ধানের জন্য হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্ত দাবী করেন।
চট্টগ্রাম থেকে খুলনীয়। সমগ্র পূর্ব বাংলায় তিনি ঘূর্ণিঝড়ের ন্যায় জনমত সংগ্রহের জন্য আত্মনিয়োগ করেন। এবার তিনি খুলনার বিরাট জনসভায় ভাষণ দান করেন।
১৯৭০-এর ৮ই ফেব্রুয়ারী খুলনার সার্কিট হাউস ময়দানে এই জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। খুলনার ইতিহাসের উক্ত সর্ববৃহৎ জনসমাবেশে শেখ মুজিব দেশের প্রতিরক্ষার জন্য ১৯৬৫ সালে সেপ্টেম্বরে গঠিত যুদ্ধ-তহবিলে সংগৃহীত কোটি কোটি টাকার হিসাব প্রদানের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান। এই সংগৃহীত অর্থ দ্বারা সরকার কি করেছে তা’ জানতে চেয়ে শেখ মুজিব বলেন, “মাতৃভূমি রক্ষার নামে সংগৃহীত জনসাধারণের এই অর্থ লইয়া ছিনিমিনি খেলার অধিকার কাহারও
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬৪

নাই। তিনি প্রেসিডেন্টকে বলেন, আমি যুদ্ধ-তহবিলে সংগৃহীত অর্থের হিসাব চাই।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৭০]

এই জনসমাবেশে শেখ মুজিব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি সুবিচার করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানান। সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা ইসলামের একটি শিক্ষা বলে শেখ মুজিব অভিমত প্রকাশ করেন। দেশ ত্যাগ না ক’রে সংখ্যাগুরু ভাইদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি তিনি আকুল আবেদন জানান। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র যারা পুনরুজ্জীবনের পক্ষপাতী শেখ মুজিব উক্ত জনসমাবেশে তাঁদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
খুলনা সার্কিট ময়দানে জনসমাবেশে ভাষণ দানের পর ৯ই ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিব যশোর পৌঁছেন এবং ঐ দিন বিকালে স্থানীয় ঈদগাহ ময়দানে এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করেন। গণতন্ত্র বিরোধী শক্তি এবং সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের যড়যন্ত্র ও তৎপরতা বন্ধ না করলে আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করবে বলে শেখ মুজিব সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন।
দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানীরা সেনাবাহিনীতে শতকরা ১৫ ভাগের বেশী প্রতিনিধিত্ব পায় না বলে শেখ মুজিব জনসভায় সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের জনৈক শিল্পপতি আওয়ামী লীগকে দুটো হেলিকপটার এবং দু’শো জীপ দেবে বলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদকে শেখ মুজিব ‘উদ্দেশ্যমূলক’ এবং মিথ্যা বলে অভিহিত করেন। দায়িত্বহীন সাংবাদিকদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ ক’রে তিনি বলেন, “যদি আপনারা বলতে না
পারেন, মিথ্যা বলবেন না। অতীতে মিথ্যা রিপোর্ট করার পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন। আগুন নিয়ে খেলা করবেন না এবং সাংবাদিক-সততা থেকে বিচ্যুত হবেন না।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১০ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৭০]
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬৫

পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলসমূহের নেতৃবৃন্দের কঠোর সমালোচনা ক’রে শেখ মুজিব বলেন, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর বিরোধী দলীয় বৈঠকে নবাবজাদা নসরুল্লাহ, মওলানা মওদুদী ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলী পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনরূপ আলোচনা করতেই অস্বীকার করেছিলেন। জামাতে ইসলামীর তীব্র সমালোচনা ক’রে শেখ মুজিব বলেন, আইয়ুব সরকারের অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে জামাত নীরব থেকেছে। শেখ মুজিব ঘোষণা করেন যে, তিনি চাইলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের নিকট থেকে তিনিও সবচেয়ে অধিক সুযোগ-সুবিধা বা যে কোন পদ অর্জন করতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রীর গদি তাঁর জন্য উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু তিনি বাংলার জনগণের স্বার্থে পদের বদলে কারাগার বেছে নিয়েছিলেন। যেসব মন্ত্রীরা ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছে, আসন্ন নির্বাচনে তাঁদেরকে বিতাড়িত করার জন্য শেখ মুজিব জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। ফারাক্কা সমস্যা সম্পর্কে শেখ মুজিব বলেন, ভারত ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণকার্য চালিয়ে যাচ্ছে অথচ তার প্রতিক্রিয়া থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য সরকার কোন বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি।
পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু নদীর পানি বিরোধ মীমাংসার জন্য প্রেসিডেন্ট আইয়ুব নয়াদিল্লী গিয়েছিলেন এবং চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। শেখ মুজিব জানান, ফারাক্কা সমস্যা সম্পর্কে কিছু করা না হ’লে পূর্ব বাংলা মরুভূমিতে পরিণত হবে।
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১০ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৭০]

।। এবার নোয়খালীতে ।।
১১ই ফেব্রুয়ারী তারিখে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জে জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিব ভাষণ দেন। এই ভাষণে শেখ মুজিব ঘূর্ণিবাত্যা এবং জলোচ্ছ্বাসের প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষ এবং ফসল রক্ষার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে বন-জঙ্গল সৃষ্টি করার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬৬

শেখ মুজিব বিকল্প ভূমির ব্যবস্থা না ক’রে সরকার কর্তৃক জনগণের জমি হুকুম দখলের রেওয়াজ বন্ধ ঘোষণা ক’রে অবিলম্বে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান।
বেগমগঞ্জের জনসমাবেশে শেখ মুজিব দেশবাসীর উদ্দেশে ঘোষণা করেন, “শোষক ও জালেমদের বিরুদ্ধেই আমার জেহাদ।” তিনি শুধু বঙ্গবন্ধু নন, তিনি শোষিত মানুষের বন্ধু—এ মানুষ বাংলার, এ মানুষ বিশ্বের।
দেশের সকল এলাকার জনগণের উদ্দেশে শেখ মুজিব তাঁর উক্ত ভাষণে সমবেদনা প্রকাশ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তিনি উচ্চারণ করেন, “দেশের যে কোন অঞ্চলে যাহারাই শোষিত-বঞ্চিত হইতেছে তাহারাই আমার ভাই।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৭০]

১৩ই ফেরুয়ারী তারিখে ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনায় এক বিরাট জনসভায় শেখ মুজিব ভাষণ দান করেন। এই জনসভায় তিনি প্রদেশের শিক্ষক সমাজের ন্যায্য দাবী-দাওয়ার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন ক’রে তাঁদের ভাতা বৃদ্ধি এবং আর্থিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। শেখ মুজিব চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবী-দাওয়ার প্রতিও তাঁর অকুণ্ঠ সহানুভূতি প্রকাশ করেন। শেখ মুজিব বলেন, দেশে বর্তমানে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে। জনগণ অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। তিনি অবিলম্বে গ্রামে গ্রামে রেশনিং ব্যবস্থা, টেস্ট রিলিফ চালু এবং বকেয়া খাজনা ও ট্যাক্স আদায় বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
১৪ই ফেব্রুয়ারী ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জে শেখ মুজিব এক বিশাল জনসমাবেশে বক্তৃতা করেন। এই সমাবেশে তিনি দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সকল রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি এবং সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক কারণে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দণ্ডাদেশ রহিত ক’রে দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানান। শেখ মুজিব ইউনিয়ন কাউন্সিল, মিউনিসিপ্যালিটি ও জেলা কাউন্সিল বিলুপ্ত ক’রে অবিলম্বে ‘লোকাল বডির নির্বাচন অনুষ্ঠান’ দাবী করেন। ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা এবং কিশোরগঞ্জে দুইদিনব্যাপী সফর শেষে শেখ মুজিব ১৫ই ফেব্রুয়ারী ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬৭

২০শে ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিব লঞ্চযোগে ঢাকা থেকে চাঁদপুরে পৌঁছেন এবং চাঁদপুর কলেজ ময়দানে এক বিশাল জনসমুদ্রে ভাষণ দান করেন। এই জনসমাবেশে শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, ওয়ালীউল্লার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন ক’রে বাংলাভাষাকে শুধু কাগজে কলমে নয়, প্রকৃতভাবে বাস্তব জীবনে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার ও তাঁদের আত্মত্যাগের আদর্শ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বিরামহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, জনতার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। বিপুল করতালির মধ্যে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, “আগামীকালের শহীদ দিবসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়াইয়া বাংলার গণমানুষের পক্ষ হইতে আমি দাবী জানাইতেছি, মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে যোগ্য মর্যাদা দিতে হইবে—বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কোন হামলা বরদাস্ত করা হইবে না।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৭০]

২২শে ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিব ঢাকা থেকে স্টীমারযোগে বরিশালে পৌঁছেন এবং স্থানীয় হেমায়েত উদ্দিন ময়দানে এক বিরাট জনসভায় ভাষণ দান করেন।
স্বার্থবাদী রাজনৈতিক মহল সম্পর্কে জনগণের প্রতি এক সতর্কবাণীতে শেখ মুজিব বলেন, তারা লিয়াকত আলী ও ডঃ খানকে হত্যা করেছে, শেরে বাংলাকে ‘অন্তরীণাবদ্ধ’ রেখেছে, সোহরাওয়ার্দীকে জেলে পাঠিয়েছে, তাঁকে (শেখ মুজিব) মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের দুর্দশার কারণ ঘটিয়েছে। শেখ মুজিব তাদের প্রতি হুঁশিয়ার উচ্চারণ ক’রে বলেন, পুনরায় ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলে ফল মারাত্মক হবে! তাদের বিরুদ্ধে দুর্বার গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে শেখ মুজিব পুনরায় ঘোষণা করেন। ঢাকা থেকে স্টীমারযোগে বরিশাল যাওয়ার পথে মুন্সীগঞ্জে ছাত্র ও জনতার অনুরোধে তাঁকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দান করতে হয়।
২৩শে ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধু পটুয়াখালীতে এক বিরাট জনসমাবেশে ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণে তিনি সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬৮

খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালী, পটুয়াখালী এবং চট্টগ্রামের সমগ্র উপকূলবর্তী এলাকা বরাবর বেড়ীবাঁধ নির্মাণ ক’রে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন এবং ফসলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি দাবী জানান। পূর্ব বাংলায় উৎপাদিত লবণের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের কর আদায় বে-আইনী বলে অভিহিত ক’রে তিনি অবিলম্বে এই কর আদায় বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
ফেব্রুয়ারী মাসের ২৮ তারিখে বঙ্গবন্ধু সড়ক পথে ঢাকা থেকে ফরিদপুর গমন করেন। পথের মাঝে গোয়ালন্দে তিনি জনসাধারণের প্রাণঢালা সম্বর্ধনা লাভ করেন এবং সেখানে তাঁকে কিছুক্ষণ জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা দিতে হয়। পরে ফরিদপুর পৌঁছে রাজেন্দ্র কলেজ ময়দানে আয়োজিত জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি পুনরায় বলেন যে, ক্ষমতায় গেলে ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করা হবে। পি. ডি. পি. প্রধান জনাব নূরুল আমীন জমির খাজনা মওকুফ করা হ’লে রাষ্ট্র অচল হয়ে পড়বে বলে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, সে সম্পর্কে শেখ মুজিব বলেন যে, এতে সরকারের যে ক্ষতি হবে তা’ “যে সব ভুঁড়িওয়ালা বহুদিন হইতে ট্যাক্স হলিডে ভোগ করিয়া আসিতেছে, তাহাদের উপর আরও বেশী কর ধার্য করিয়া” পুরণ করা হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি জনাব নূরুল আমীনকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন যে, পৃথিবীর ১৩৭টি দেশের মধ্যে পাকিস্তান ও ভারতেই শুধু জমির খাজনা আদায় করা হয়। তিনি বলেন, রাষ্ট্র জনসাধারণের, তা’ শুধু ভুঁড়িওয়ালাদের নয়।
পরদিন বঙ্গবন্ধু মাদারীপুরে এক জনসভায় বক্তৃতা ক’রে মার্চের ২ তারিখে ঢাকায় ফিরে আসেন। কিন্তু ঢাকায় ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু নিশ্চুপ হয়ে থাকেন নি। নির্বাচন প্রচার উপলক্ষে আবার তিনি ৫ দিনব্যাপী উত্তরবঙ্গে ঝটিকা সফর করেন। মার্চের ৬ তারিখে (১৯৭০) সন্ধ্যায় শেখ মুজিব বিমানযোগে কুষ্টিয়ার পথে যশোর যাত্রা করেন। রাত্রে ঝিনাইদহে অবস্থানের পর ৭ তারিখে তিনি কুষ্টিয়ার ইউনাইটেড স্কুল ময়দানে এক বিরাট জনসমাবেশে বক্তৃতা দেন। কুষ্টিয়া আসার পথে তাঁকে সর্বত্র বিপুলভাবে সম্বর্ধনা জানানো হয়। এখানে তিনি
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬৯

বলেন, “সংখ্যাগুরু প্রদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হইলে ১২০ দিনেরও কম সময়ের মধ্যে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন সম্ভবপর হইবে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৮ই মার্চ, ১৯৭০]

সভায় শেখ মুজিব কায়েমী স্বার্থবাদী গণদুশমনদের উদ্দেশে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ ক’রে বলেন যে, যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে কোনরূপ বাধার সৃষ্টি করা হয়, তা’ হ’লে তার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হবে।
পরদিন পাবনায় এক জনসভায় ভাষণ দানকালে তিনি আর কালবিলম্ব না ক’রে রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবী জানান। পাবনায় আসার পথে তিনি ভেড়ামারা ও পাকশীতে দুটো সভায় ভাষণ দান করেন। পাকশী ও পাবনার জনসভায় আমি নিজেও উপস্থিত ছিলাম।
৯ই মার্চ শেখ মুজিব বগুড়া আলতাফুন্নেসা ময়দানে ভাষণ দান করতে গিয়ে ইসলামে যার যা প্রাপ্য তার সেই ন্যায্য পাওনা আদায়ের অধিকার আছে কি-না তা’ সাম্প্রদায়িকতাবাদী নেতা মওলানা মওদুদীর নিকট জানতে চান। পরদিন রংপুর কালেক্টরেট ময়দানে প্রায় আড়াই লক্ষ লোকের এক বিশাল সমাবেশে উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের প্রতি অবহেলার সমালোচনা ক’রে শেখ মুজিব বলেন যে, “অর্থাভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন প্রকল্পই অবাস্তবায়িত থাকে নাই। অথচ যমুনা নদীতে ব্রীজ নির্মাণ, রূপপুর প্রকল্প, জামালগঞ্জ কয়লা প্রকল্প এবং তিস্তা বাঁধ প্রকল্প প্রসঙ্গগুলি অর্থাভাবের অজুহাত তুলিয়া বছরের পর বছর ধরিয়া শিকায় তুলিয়া রাখা হইয়াছে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ই মার্চ, ১৯৭০]

জনসভায় বক্তৃতাকালে তিনি এই প্রদেশে আদায়কৃত মোহাজের ট্যাক্স এই প্রদেশেই ব্যয় করার দাবী জানান।
পরদিন শেখ মুজিব দিনাজপুর গোড়া-শহীদ ময়দানে ভাষণ দান করেন। সেখানে তিনি সরকারকে সীমান্ত চোরাচালান বন্ধ করবার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং ধর্মঘট পালনরত মাধ্যমিক শিক্ষকদের নায়সঙ্গত দাবী-দাওয়া সমর্থন ক’রে বলেন যে, “পশ্চিম পাকিস্তানের
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭০

শিক্ষকরা এখানকার শিক্ষকদের তুলনায় দিগুণ বেতন পান। তাই বাংলা ৫০ হাজার মাধ্যমিক শিক্ষকের দাবী-দাওয়াকে ফুঁ দিয়া উড়াইয়া দেওয়ার অধিকার কাহারও নাই।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ই মার্চ, ১৯৭০]

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, গত ৯ই মার্চ থেকে মাধ্যমিক শিক্ষকরা তাদের ৭-দফা দাবী আদায়ের উদ্দেশ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
মার্চের ১২ তারিখে শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ১৫ তারিখে আবার সিলেটের সুনামগঞ্জ জনসভায় বক্তৃতা ক’রে পরদিন ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন।
১৯৭০ সালের ২০শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল-হল ময়দানে ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ছ’ সহস্রাধিক ডেলিগেটের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত উক্ত সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণ দিতে গিয়ে শেখ মুজিব ছাত্রদের উদ্দেশে আহ্বান জানিয়ে বলেনঃ “শোষণের চারণ ক্ষেত্র বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবী নস্যাৎ ও নির্বাচন বানচালের জন্য গণ-বিরোধী আমলা, পেশাদার দালাল, কায়েমী স্বার্থবাদী, ধর্ম-ব্যবসায়ী এবং অতি-বিপ্লবীরা যে অশুভ পাঁয়তারা চালাইতেছে সর্বশক্তি দিয়া উহা প্রতিহত করা আর নির্বাচনোত্তরকালে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী শাসনতন্ত্র রচনার পথে সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর চূর্ণ বিচূর্ণ করিয়া দেশের আপামর মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করার নিমিত্ত জনগণকে আন্দোলনমুখী করিয়া তোলার উদ্দেশ্যে চরম ত্যাগের প্রস্তুতির বাণী লইয়া দিকে দিকে ছড়াইয়া পড়ুন। সাত কোটি শোষিত, বঞ্চিত, সর্বহারা মানুষ অন্তহীন আশা লইয়া আপনাদের মুখের দিকে তাকাইয়া আছে। আঘাতের পর আঘাত হানিয়া গণদুশমনদের দুর্গ ধুলিসাৎ করিয়া দিয়া তাহাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করুন। বহু রক্ত দিয়াছেন, আর শহীদ নয়, এবার গাজী হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করুন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২১শে মার্চ, ১৯৭০]

দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এই বার্ষিক সম্মেলনের সমাপ্তি দিবসে সাবেক রাষ্ট্রদূত জনাব কমরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে আমিও প্রধান
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭১

অতিথির আসন গ্রহণ করেছিলাম। এই সভায় আরো যারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বেগম সুফিয়া কামাল, ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম প্রমুখ উলেখযোগ্য। সে দিন অর্থাৎ ২১শে মার্চের শেষ রাত্রে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নয়া কর্মকর্তা নির্বাচিত হয়। এতে সভাপতি হন বর্তমান সংসদ সদস্য জনাব নুরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন জনাব শাহজাহান সিরাজ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তনে ও স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্র সমাজের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বের পরেই উল্লেখযোগ্য শক্তি ছিল ছাত্র সমাজের যৌথ সংগ্রাম। ষাটের দশকের গোড়া থেকে সরকারী ছত্রছায়ায় লালিত এন.এস.এফ. (ন্যাশনাল স্টুডেন্টস্ ফেডারেশন) বা উগ্র সাম্প্রদায়িক ইসলামী ছাত্রসংঘ প্রভৃতি ছাত্র দলকে ধীরে ধীরে সমাজ-জীবন থেকে উৎখাত ক’রে যে দুটো ছাত্রদল এগিয়ে এসেছিল সেগুলো হ’ল আওয়ামী লীগ সমর্থিত ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ এবং মোজাফফর ন্যাপ সমর্থিত ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’। এই দুটো ছাত্র দলের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয় এবং প্রগতিমুখী। এই দুটো দলের মধ্যে আবার ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই জনগণের মধ্যে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার ন্যায় ছাত্রলীগও ছাত্র সমাজে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার আন্দোলনে, ৬-দফার আন্দোলনে, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে, শেখ মুজিবকে কারাগারের অন্তরাল থেকে মুক্তির আলোকে নিয়ে আসার আন্দোলনে এবং সর্বশেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সংগঠন ও প্রত্যক্ষ যুদ্ধে ছাত্রলীগ যে ভূমিকা পালন করে তা’ একটি পৃথক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রলীগের অবদান, নানাদিক বিবেচনায়, সত্যি অপরিসীম। এমন কি ঐতিহাসিক দিক থেকে এ কথাই সত্য যে, কোন কোন ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ যা করেছে, আওয়ামী লীগ তা’ সমর্থন করেছে। ছাত্রলীগ দুই পা অগ্রসর হ’লে সেই পথ ধরে আওয়ামী লীগ একপদ অগ্রসর হয়েছে। যেমন জয়বাংলা স্লোগান, বাংলাদেশের নিজস্ব পতাকা, যার মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত, এই
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭২

সবই ছাত্রলীগ পূর্বে ব্যবহার করেছে—আওয়ামী লীগ তা’ সমর্থন করেছে। সুতরাং, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের বহু সিদ্ধান্তকে বিছিন্নভাবে দেখা যায় না। দুটো প্রতিষ্ঠানই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িতঃ
ষাটের দশকে ছাত্রলীগের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। এই দশকে যাদের ভূমিকা ছিল সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য তাঁদের নাম এখানে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করিঃ

শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন সভাপতি ১৯৬১-৬২
শেখ ফজলুল হক মনি সাধারণ সম্পাদক ১৯৬১-৬২
এনায়েতুর রহমান ডাকসু’র সহ-সভাপতি ১৯৬২
ওবায়দুর রহমান সভাপতি ১৯৬৩-৬৪
সিরাজুল আলম খান সাধারণ সম্পাদক ১৯৬৩-৬৪
সৈয়দ মজহারুল হক বাকী সভাপতি ১৯৬৫-৬৬
আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক ১৯৬৫-৬৬
ফেরদৌস আহমদ কোরায়েসী সভাপতি ১৯৬৬-৬৭
আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক ১৯৬৬-৬৭
আবদুর রউফ সভাপতি ১৯৬৮-৬৯
খালেদ মোহাম্মদ আলী সাধারণ সম্পাদক ১৯৬৮-৬৯
তোফায়েল আহমদ সভাপতি ১৯৭০
তোফায়েল আহমদ ডাকসুর সহ-সভাপতি ১৯৬৯-৭০
নূরে আলম সিদ্দিকী সাধারণ সম্পাদক ১৯৭০
নূরে আলম সিদ্দিকী সভাপতি ১৯৭০-৭১
শাজাহান সিরাজ সাধারণ সম্পাদক ১৯৭০-৭১
আ. শ. ম. আবদুর রব ডাকসু’র সহ-সভাপতি ১৯৭০
আবদুল কুদ্দুস মাখন ডাকসু’র সাধারণ সম্পাদক ১৯৭০
ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় নেতা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং উত্তরাঞ্চলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে জনপ্রিয় করতে এবং দেশকে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে পরিচালিত করতে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। এদের মধ্যে আবু সাঈদ, আবদুর রহমান, সরদার আমজাদ হোসেন, মীর শওকত আলী, আবু সুফিয়ান (শহীদ) প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭৩

ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দও সমগ্র প্রগতিবাদী আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব পালন করেন। এঁদের মধ্যে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের উষালগ্নে আসাদুজ্জামান শাহাদাৎ বরণ করেন। অন্যান্যদের মধ্যে মতিয়া চৌধুরী, শামসুদ্দোহা, সাইফুদ্দীন আহমদ (মানিক), মাহবুবুল্লাহ, মুজাহেদুল ইসলাম সেলিম, রাশেদ খান মেনন (ভাসানী পন্থী) প্রমুখের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।
এই দুটো ছাত্র প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিস্তারিত লিখবার অবকাশ এখানে নেই। তবে তাঁদের সাহসী ভূমিকা ছাড়া এদেশের স্বাধীনতা আদৌ বাস্তবায়িত হোত কি না সে সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা যায়। শেখ মুজিবের নেতৃত্ব থেকে এই দুটো দলই, বিশেষ করে ছাত্রলীগ অভূতপূর্ব প্রেরণা লাভ করেছে। ছাত্রলীগের শক্তি আর শেখ মুজিবের শক্তি আসলে একই প্রবাহের দুই রূপ — একটি বিশাল-কায় নদী, অপরটি সমুদ্র। নদী কখনো কখনো সমুদ্রে এসে মিলিত হয়ে সমুদ্রের শক্তি বৃদ্ধি করে, আবার কখনো কখনো সমুদ্র থেকেই প্রবাহ নিয়ে নদী তার গতিপথে জনপথ অভিমুখে যাত্রা করে। এই দুই শক্তি পরস্পর পরস্পরের সম্পূরক। একটি থেকে আরেকটিকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না।
২৬শে মার্চ কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী নয়া শিক্ষানীতি ঘোষণা করেন। সরকারের নয়া শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের ব্যাপারে চতুর্থ পরিকল্পনাকালে সরকারী খাতে মোট ৮৯২ কোটি টাকা ব্যয় করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সরকারের এই শিক্ষানীতিতে দুই অঞ্চলের শিক্ষকদের বৈষম্য দূরীকরণের কোন ব্যবস্থাই ছিল না। শিক্ষকদের নয়া বেতনের হার প্রবর্তনের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় বাবদ ১০০ কোটি টাকা মাত্র ধার্য করা হয়েছিল। ধর্মঘটী শিক্ষকরা এর প্রতি চরম উপেক্ষা প্রদর্শন ক’রে তাঁদের ধর্মঘট অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
১৯৭০ সালের ২৮শে মার্চ ‘জাতির’ উদ্দেশে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আবার বেতার ভাষণ দিলেন। উক্ত ভাষণে তিনি পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের মূলনীতি ঘোষণা করেন এবং আইনগত কাঠামো প্রকাশের কথাও উল্লেখ করেন। তাঁর এই বেতার ভাষণের প্রধান প্রধান। বৈশিষ্ট্য নীচে দেওয়া হ’লঃ
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭৪

“* জাতীয় পরিষদ ৩১৩ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। এর মধ্যে ১৩টি আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।
* ১৯৬১ সালের আদমশুমারীর ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রদেশে আসন বরাদ্দ করা হবে।
* চলতি সালের ২২শে অক্টোবরের মধ্যে প্রাদেশিক পরিষদগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
* জাতীয় পরিষদ ভোট দান পদ্ধতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে।
* আইনগত কাঠামোতে ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের মূলনীতিগুলোর উল্লেখ থাকবে।
* এতে অবশ্যই আজাদী, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও জাতীয় সংহতির নিশ্চয়তা বিধান করা হবে।
* পাকিস্তান একটি ফেডারেল ইউনিটে ঐক্যবদ্ধ হবে—একে পাকিস্তান ইসলামী সাধারণতন্ত্র বলে আখ্যায়িত করা হবে।
* শাসনতন্ত্র অবশ্যই গণতান্ত্রিক হবে এবং গণতন্ত্রের মূল উপাদানগুলো ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার থাকবে।
* শাসনতন্ত্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নাগরিকদের মৌলিক অধিকার অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
* প্রদেশগুলোকে সর্বাধিক আইন, প্রশাসন, ও অর্থনৈতিক ক্ষমতাসহ সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে।
* বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দায়িত্ব পালন এবং দেশের অজাদী ও সংহতি রক্ষার জন্য আইনগত প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতাসহ পর্যাপ্ত ক্ষমতা ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে।
* বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দূর করার জন্য বিধিবদ্ধ ক্ষমতা অবশ্যই থাকবে।
* প্রেসিডেন্ট আবার ঘোষণা করছেন যে, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য ১২০ দিনই যথেষ্ট।
* বৃহৎ-শক্তির সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও একে অন্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা বা অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭৫

* জনগণের মৌলিক ঐক্য নষ্ট করতে পারে এমন আদর্শ বা ধ্যানধারণা যারা পোষণ করে, প্রেসিডেন্ট তাদের সতর্ক ক’রে দিয়েছেন।
* ১লা জুলাই থেকে পশ্চিম পাকিস্তান যতদূর সম্ভব এক ইউনিট গঠনপূর্ব-কালের অবস্থায় ফিরে যাবে।
* ১লা জুলাই থেকে চতুর্থ পরিকল্পনার কাজ শুরু হবে।
* চতুর্থ পরিকল্পনা বহির্ভূত তহবিল থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হবে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৯শে মার্চ, ১৯৭০]

উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহে লক্ষণীয় যে, প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের পাঁচটি মূলনীতির কথাও ঘোষণা করেছেন। পরে ৩০শে মার্চ প্রেসিডেন্ট এই শাসনতন্ত্রের আইনগত কাঠামোর অদেশ (Legal Framework Order) জারি করেন, এটা হ’ল ১৯৭০ সালের প্রেসিডেন্টের ২নং আদেশ। এই আদেশে শাসনতন্ত্রের জন্য উল্লিখিত পাঁচটি মূলনীতির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ছাড়াও জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনের ভাগবন্টন, সদস্যদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা এবং নির্বাচন ও পরিষদের কার্য পরিচালনার পদ্ধতি নির্দেশ করা হয়। আইনগত কাঠামোর আদেশে প্রেসিডেন্ট ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের পাঁচটি মূলনীতি সম্পর্কে যা বলেছেন তা’ নিম্নরূপঃ
(এক) এই আদেশ বলে, পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে ইসলামী আদর্শ রক্ষা করা হবে, যা পাকিস্তান সৃষ্টির ভিত্তি ছিল বলে আমরা জানি।
(দুই) শাসনতন্ত্রকে অবশ্যই পাকিস্তানের স্বাধীনতা, আঞ্চলিক সংহতি এবং জাতীয় ঐক্য রক্ষা করতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আইন কাঠামো নির্ধারিত ক’রে দিচ্ছে যে, পাকিস্তানের বর্তমান ভূখণ্ডসমূহ এবং ভবিষ্যতে এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে এমন ভূখণ্ডসমূহ একটা ফেডারেল ইউনিয়নে সীমাবদ্ধ থাকবে, যা অবশ্যই পাকিস্তান রাষ্ট্রের, যে রাষ্ট্র পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র বলে অভিহিত হবে এবং আঞ্চলিক সংহতি রক্ষা করবে।
(তিন) পাকিস্তানের ভবিষৎ শাসনতন্ত্র গণতন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭৬

স্বাধীন ও সাময়িক নির্বাচনের মত গণতন্ত্রের মূল উপাদানসমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এছাড়া শাসনতন্ত্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
(চার) ভবিষৎ শাসনতন্ত্রের আর একটি উল্লেখযোগ্য মৌলিক নীতি হ’ল এই যে, তাকে প্রকৃত ফেডারেল শাসনতন্ত্র হতে হবে, যাতে ফেডারেল সরকার ও প্রদেশগুলোর মধ্যে আইন বিষয়ক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতাসহ অন্যান্য ক্ষমতা এমনভাবে বিভক্ত থাকবে যেন প্রদেশগুলোর সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন অর্থাৎ সর্বোচ্চ আইন বিষয়ক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষমতা থাকে এবং ফেডারেল সরকারের বৈদেশিক ও আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তার দায়িত্ব পালনের এবং দেশের স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক সংহতি রক্ষার উপযুক্ত আইন বিষয়ক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতাসহ অন্যান্য ক্ষমতা পৰ্যাপ্ত পরিমাণে থাকে।
(পাঁচ) শাসনতন্ত্রের পঞ্চম নীতিতে পাকিস্তানের সকল অঞ্চলের জনগণকে জাতীয় বিষয়সমূহে অংশ গ্রহণের পূর্ণ সুযোগ দিতে হবে যাতে জনগণ সমান ও সম্মানিত অংশীদার হিসেবে একত্রে বসবাস করতে পারে এবং জাতির পিতা কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর স্বপ্ন অনুসারে একটি শক্তিশালী ও মহান জাতিতে পরিণত হ’তে পারে।
[ Bangladesh Documents, Vol. I, P. 47.]

আসন্ন নির্বাচন ও পরবর্তীকালে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য প্রেসিডেন্ট তাঁর বেতার ভাষণে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের জন্য যে ৩১৩টি আসনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, আইনগত কাঠামো আদেশে বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে তা’ ভাগবণ্টন করা হয়। এতে বলা হয় যে, পূর্ব বাংলার জন্য মোট ১৬৯টি আসন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশে ও কেন্দ্রীয় শাসিত উপজাতীয় এলাকাসমূহকে মোট ১৪৪টি আসন বরাদ্দ করা হয়েছে। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১৩টি আসনের মধ্যে ৭টি পূর্ব বাংলাকে ও ৬টি পশ্চিম পাকিস্তানকে দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে জাতীয় পরিষদের আসনগুলো এই ভাবে বন্টন করা হয়ঃ
পূর্ব বাংলা: সাধারণ—১৬২
পূর্ব বাংলা: সংরক্ষিত (মহিলা)-৭
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭৭

পাঞ্জাব: সাধারণ-৮২
পাঞ্জাব: সংরক্ষিত (মহিলা)-৩
সিন্ধু: সাধারণ-২৭
সিন্ধু: সংরক্ষিত (মহিলা)-১
বেলুচিস্তান: সাধারণ—৪
বেলুচিস্তান: সংরক্ষিত (মহিলা)-১
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ: সাধারণ-১৮
উপজাতীয় এলাকা: সাধারণ-৭
শেষোক্ত দুটো প্রদেশ মিলে মহিলাদের জন্য শুধুমাত্র ১টি সংরক্ষিত আসন বরাদ্দ করা হয়। আইনগত কাঠামো নির্দেশে প্রাদেশিক পরিষদের জন্যও নিম্নলিখিতভাবে সাধারণ ও মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন বণ্টন করা হয়ঃ
পূর্ব বাংলা: সাধারণ—৩০০
পূর্ব বাংলা: সংরক্ষিত (মহিলা)—১০
পাঞ্জাব: সাধারণ—১৮০
পাঞ্জাব: সংরক্ষিত (মহিলা)—৬
সিন্ধু: সাধারণ—৬২
সিন্ধু: সংরিক্ষত (মহিলা)—২
বেলুচিস্তান: সাধারণ—২০
বেলুচিস্তান: সংরক্ষিত (মহিলা)—১
সীমান্ত প্রদেশ: সাধারণ—৪০
সীমান্ত প্রদেশ: সংরক্ষিত (মহিলা)—২
মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকলেও জাতীয় বা প্রাদেশিক পরিষদে সাধারণ আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোন বাধা নেই। সংরক্ষিত আসনে মহিলারা সাধারণ আসনের সদস্যবৃন্দের দ্বারা মনোনীত হবেন। প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হবে যথাক্রমে ৫ই অক্টোবর এবং ২২শে অক্টোবর। এ ছাড়াও আইনগত কাঠামো আদেশে সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা এবং অযোগ্যতা সম্পর্কেও কতকগুলো বিধি-নিষিধের কথা উল্লেখ করা হয়।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭৮

প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণে নেতৃবৃন্দের প্রতিক্রিয়া
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ২৮শে মার্চ শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি ঘোষণা প্রগতিবাদী মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই ঘোষণার পটভূমি পূর্বেই রচিত হয়েছিল। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর এজেন্ট দলগুলো পূর্বাহ্নেই ‘শাসনতান্ত্রিক সঙ্কট’ সম্পর্কে তারস্বরে চিৎকার ক’রে আসছিল। এবার তারা আশ্বস্ত হ’ল। প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণার বিরুদ্ধে দেশের সকল গণতান্ত্রিকদল প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এ সম্পর্কে এক সংবাদে লেখা হয়ঃ “১লা এপ্রিল, ১৯৭০ তারিখে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির দু’দিনব্যাপী জরুরী বৈঠক শেষে গৃহীত এক প্রস্তাবে জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষা বানচালের দরুন যে গুরুতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা’ এড়াবার জন্য প্রেসিডেন্টকে গণতন্ত্রের মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্য আনয়নের জন্য আইনগত কাঠামো নির্দেশ যথাযথভাবে সংশোধনের আহ্বান জানান হয়। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে তাঁর বাসভবনে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২রা এপ্রিল, ১৯৭০]

অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে মওলানা ভাসানী, মোজাফফর আহমদ, আতাউর রহমান খান, লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটির পক্ষে কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দও প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হ’ল তথাকথিত ‘শক্তকেন্দ্র’ ও ‘ইসলামের ধারক বাহক’ পাকিস্তানী শোষকগোষ্ঠীর এজেন্ট দলগুলো প্রেসিডেন্টকে এই ঘোষণার জন্য অভিনন্দন জানান। এদের ভিতর মওলানা মওদুদীর মতামত সম্পর্কে পত্রিকায় যা লেখা হয় এখানে তার উল্লেখ করছি।
“প্রেসিডেন্টের আইনগত কাঠামো আদেশে উল্লেখিত পাঁচটি মূলনীতির উল্লেখ করিয়া জামাতে ইসলামী প্রধান বলেন, ইহাদের একটিরও পরিবর্তন করা যাইবে না।
কতিপয় মহল প্রেসিডেন্টের আইনগত কাঠামো আদেশের কোন কোন ধারাকে পরিষদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের শামিল বলিয়া অভিহিত করায় মওদুদী বিস্ময় প্রকাশ করেন। … … প্রস্তাবিত গণপরিষদের সার্বভৌমত্ব প্রসঙ্গে মওদুদী বলেন, তাঁহার মতে, কোন গণপরিষদেরই
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭৯

ইসলাম বিরোধী কোন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অথবা কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার থাকিতে পারে না। তিনি বলেন, ইসলাম এই ধরনের সার্বভৌমত্বকে অনুমোদন করে না।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই মে, ১৯৭০]

এ সবের দ্বারা সহজেই অনুমান করা যায় যে, এই সব প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলোর সঙ্গে পরিকল্পনা সাপেক্ষেই প্রেসিডেন্ট অনুরূপ ঘোষণা করেছিলেন। প্রেসিডেন্টের ঘোষণায় ধর্মের নামে ও কায়েমী স্বার্থের নানাবিধ অজুহাতে যারা পূর্ব বাংলাকে শাসন ও শোষণ করতে চায় তাদেরই সামগ্রিক চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। যাহোক, শেখ মুজিব এ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠলেন। একদিকে তিনি জনসাধারণকে ৬-দফা প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ করবার প্রয়াস পেলেন, অন্যদিকে আবার এই উদ্ভূত আদেশনামার বিরুদ্ধেও জনমত গড়ে তুলতে লাগলেন। সমস্ত দিক বিবেচনা ক’রে তিনি নির্বাচনে ৬-দফাকে ‘ম্যান্ডেট’ হিসেবে ঘোষণা করলেন।
আইনগত কাঠামো প্রশ্নে ইয়াহিয়া
২৮শে মার্চ প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণ ও পরে আইনগত কাঠামো প্রকাশের পর যে সমস্ত প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল, তার জবাব দেবার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৩১শে মার্চ রাওয়ালপিণ্ডিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন যে, পাঁচটি মূলনীতির যে কাঠামো নির্ধারণ ক’রে দেয়া হয়েছে তার আওতাভুক্ত একটি শাসনতন্ত্র হলে তিনি অবশ্যই তা’ গ্রহণ করবেন এবং তাতে স্বাক্ষর দান করবেন।

পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিল
এপ্রিল মাসের ১লা তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘১৯৭০ সালের পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশ (ভঙ্গকরণ) আদেশ’ নামক একটি আদেশ জারী ক’রে পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট বাতিল ঘোষণা করেন। এই আদেশ জারীর পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তান ৪টি প্রদেশে বিভক্ত হবে। প্রদেশগুলো হবে— পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান ও সিন্ধু।
শেখ মুজিব এবং দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বহুদিন থেকে এই এক ইউনিট বাতিলের জন্য দাবী ক’রে আসছিলেন। সিন্ধুর যুক্তফ্রন্টের নেতা জি. এম. সৈয়দ এ নিয়ে আন্দোলন করতে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮০

গিয়ে বহুবার নির্যাতনও ভোগ করেছেন। ১৯৫৬ সালে আগস্ট মাসে যখন শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েছিলেন, তখন জি. এম. সৈয়দ এই এক ইউনিট বাতিলের দাবী সমর্থনের জন্য তাঁর প্রতি আহ্বান জানালে বঙ্গবন্ধু শুধু এই দাবী সমর্থনই করেন নি, এর স্বপক্ষে আন্দোলন চালিয়ে যাবারও প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছিলেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে ভাষণ দিতে গিয়ে শেখ মুজিব সে দাবী মেনে নেয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি প্রায়ই আহ্বান জানিয়েছেন। অবশ্য তিনি যে শুধুমাত্র জি. এম. সৈয়দকে দেয় প্রতিশ্রুতির পরবর্তী কালেই এ দাবী তুলে ধরেছিলেন তা’ নয়, এটা তাঁর ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবীরই অঙ্গীভূত বিষয়। ছাত্রদের ১১-দফাতেও এই এক ইউনিট বাতিলের দাবী রয়েছে। আসলে যা ন্যায়সঙ্গত, তাকে শেখ মুজিব কখনোই এড়িয়ে যান নি। কেননা তিনি জানেন, উভয় প্রদেশের সাধারণ জনগণই শোষক শ্রেণীর যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছে। শোষকের তাঁবেদার শাসকগোষ্ঠী সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ক’রে এই নিষ্পেষণ চালিয়ে যাচ্ছে। শেখ মুজিব এই নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত মানুষের মুক্তির জন্যই সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন —তা’ সে যে প্রদেশেরই হোক। আর সেই জন্যই পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট বাতিলের দাবী ৬-দফায় উল্লেখ করতেও তিনি ভুল করেন নি। যাহোক, অবশেষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সে দাবী মেনে নিলেন। এবং প্রদেশসমূহে নয়া গভর্নরও নিযুক্ত করলেন।

কাইয়ুম খানের জেহাদ ও শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের প্রলোভন
এ সময় মুসলিম লীগের নেতা আবদুল কাইয়ুম খান পূর্ব পাকিস্থানে এসেছিলেন। তিনি বিভিন্ন জেলায় বক্তৃতায় শেখ মুজিবের ৬-দফার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে থাকেন। কিন্তু তাতে যে বিশেষ সুবিধা হবে না, সে বিষয়ে তিনি ভালভাবেই অবগত হ’লেন। ৬-দফার আন্দোলন থেকে শেখ মুজিবকে নিবৃত্ত করার জন্য তিনি অন্য পন্থা অবলম্বন করলেন। কুষ্টিয়ার চুয়াডাঙ্গায় ৬ই এপ্রিলে এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে ৬-দফা ত্যাগ ক’রে শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রিত্বের আসন গ্রহণের আহ্বান জানান। কিন্তু কোন প্রলোভনের বশবর্তী হয়ে যে সংগ্রামের পথ থেকে বিচ্যুত হবার মত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান নন, কাইয়ুম সাহেবরা
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮১

তা’ জেনেশুনেও বারবার ভুল করেন। তাঁকে অনেকবারই প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভ দেখানো হয়েছে। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান চলাকালীন আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকের অন্তরালে তাঁকে যে এই একই প্রলোভন দেখানো হয়েছিল এবং তা’ যে ছিন্নপত্রের ন্যায় শেখ মুজিব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কাইয়ুম খানের তা’ অজ্ঞাত থাকিবার কথা নয়। কেননা গণভ্যুত্থানের জোয়ারে ভেসে পূর্ব বাংলা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাতে কাইয়ুম খানদের সঙ্গে পরামর্শ করেই আইয়ুব খান সে রকম একটা অযাচিত প্রস্তাব করবার সাহসী হয়েছিলেন।

কাইয়ুম খানের প্রলোভনের জবাবে শেখ মুজিব
এবারো সেই একই প্রস্তাব। পার্থক্য এই যে, সেবারে দেয়া হয়েছিল গোপনে এবং তখন দিয়েছিলেন আইয়ুব খান, আর এবারে দেয়া হ’ল প্রকাশ্যে এবং তা’ দিলেন কাইয়ুম খান স্বয়ং। আসলে সবই একই প্রবাহের স্রোতধারা। তার নাম কায়েমী স্বার্থবাদ। কিন্তু এবারেও সেই একই প্রত্যুত্তর। এপ্রিল মাসের ৯ তারিখে খুলনার বাগেরহাটে এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে কাইয়ুম খানের প্রস্তাবের জবাবে শেখ মুজিব দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, “প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়—শোষণ ও অবিচারের শৃঙ্খল হইতে দেশের ১২ কোটি মানুষের বিশেষ ক’রে বাংলার মানুষকে মুক্ত করার জন্যই আমার সংগ্রাম।” তিনি আরো বলেন, “শুধু প্রধানমন্ত্রিত্ব কেন, সারা দুনিয়ার ঐশ্বর্য আর ক্ষমতা আমার পায়ের কাছে ঢালিয়া দিলেও আমি দেশের—বিশেষ করিয়া বাংলার বঞ্চিত মানুষের সঙ্গে বেঈমানী করিতে পারিব না।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১০ই এপ্রিল, ১৯৭০]

এ সময় শেখ মুজিব প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। এই পর্যায়ে তিনি বাগেরহাট, মোরেলগঞ্জ, মঠবাড়িয়া, ভাণ্ডারিয়া, পিরোজপুর ও গোপালগঞ্জে বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা ক’রে ৪ দিনব্যাপী সফরের পর ১৪ই এপ্রিল ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় ফিরে এসে শেখ মুজিব এপ্রিল মাসের শেষের দিকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সন্দ্বীপ প্রভৃতি কয়েকটি জায়গায় গমন করেন এবং জনসভায় তাঁর ভাষণ দান করেন।

আওয়ামী লীগ দলীয় তৎপরতা
এই সময় দলীয় তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ দলীয় কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দসহ ছাত্র নেতৃবৃন্দ
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮২