বাংলার বাণী
ঢাকা : ৮ই মার্চ, শুক্রবার, ১৯৭৪, ২৪শে ফাল্গুন, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
স্বাগত হে বিপ্লবী মহানায়ক
ইসলামিক সম্মেলনের মন্ডপ থেকে সোজা গণচীন। সেখানে বুমেদীন আলোচনা করেছেন মাওসেতু সহ অন্যান্য চীনা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। সেখান থেকে উত্তর কোরিয়া এবং উত্তর ভিয়েতনাম হয়ে তিনি আজ আসছেন বাংলাদেশে। এদেশে তাঁর এটাই প্রথম সফর। ক্ষণস্থায়ী এ সফর শুধুই সৌজন্যমূলক এটা কিন্তু কূটনৈতিক মহল নেমে নিতে পারছেন না। তারা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করছে আলজিরীয় প্রেসিডেন্ট বুমেদিনের বাংলাদেশ সফরের উপর।
আলজিয়ার্সে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের সম্মেলনে এশিয়া এবং আফ্রিকার দুই মহানায়ক মিলিত হন। এশিয়ার মুজিব ও আফ্রিকার বুমেদিন একে অপরকে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেছিলেন, সমআদর্শের অনুসারী দুই বিপ্লবীর চেতনাস্পর্শে প্রোজ্জ্বলিত হয়েছিল জোটনিরপেক্ষ এবং উন্নতিশীল রাষ্ট্রসমূহের আকাঙ্ক্ষার মহাশিখা। তাদের উপলব্ধি ভাষা জুগিয়েছিল সে সম্মেলনের সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদবিরোধী সোচ্চার বক্তব্যে।
সেই ঋজু, দৃঢ় ভূমিকা তাদের লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামিক সম্মেলনেও। ইসলামিক সম্মেলনের মূলধারাকেও তাঁরা যৌথভাবে প্রবাহিত করেছেন সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদবিরোধী তরঙ্গে। সে সম্মেলনে বাংলাদেশের যোগদানের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি তথা বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের পারস্পরিক স্বীকৃতি দানের ব্যাপারেও আলজিরীয় প্রেসিডেন্ট বুমেদিনের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। স্বীকৃতির পরপরই আফ্রিকার এই বিপ্লবী রাষ্ট্রনায়কের নিজস্ব বিমান তিনি প্রেরণ করেন ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধুকে লাহোর নিয়ে যেতে।
আলজিরিয়া এবং বাংলাদেশ দু’টি রাষ্ট্রই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ। দু’টি রাষ্ট্রকেই জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সবচাইতে বেশী মূল্য দিতে হয়েছে। রক্তের সাগর পেরিয়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের স্বাধীনতা। সে স্বাধীনতাকে সংহত করা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা তখা সমাজতন্ত্রে উত্তরণে আলজিরিয়াকে যে দুর্গম পথে অগ্রসর হতে হয়েছে আমাদেরও অতিক্রম করতে হচ্ছে সেই একই প্রতিকূলতা। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলনে দু’টি দেশই সোচ্চার।
প্রেসিডেন্ট বুমেদিনের বাংলাদেশ সফর যে কূটনৈতিক তাৎপর্য বহন করছে তা ছাড়াও মৈত্রীর বন্ধন সুদৃঢ় করার পথে তা বিশেষ প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। স্বাধীনতাত্তোর কালে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণ কার্যে আলজিরিয়ার অভিজ্ঞতা অবশ্যই আমাদের অনুরপ্রেরণা যোগাবে।
স্বল্পকালীন অবস্থানের মাধ্যমে মাননীয় প্রেসিডেন্ট আমাদের অন্তরের উষ্ণতা এবং গভীরতা কতটুকু উপলব্ধি করতে পারবেন আমরা জানিনা, কিন্তু আদর্শের সংগ্রামে পাশে থেকে পথ চলার হাজারো ক্ষণে আমরা একে অপরের বন্ধুত্ব ও সহানুভূতি অবশ্যই লাভ করবো। দুর্গম এ চলার পথে সহযাত্রীদের ঐক্য ও সাহায্যই লক্ষ অর্জনের প্রেরণা জোগাতে পারে।
ঢাকার বুকে বাংলাদেশের জনগণ তাদের ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ আলজিরীয় জনগণের মহান নেতা বুমেদিনকে স্বাগত জানাতে পেরে আনন্দিত। তাদের সেই আনন্দ এবং অনুভূতির প্রতিধ্বনি করে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি আলজিরীয় রাষ্ট্র-নায়ককে, যিনি দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক আসনে শোষিত তাঁর দেশের জনগণকে মুক্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনের পথের সন্ধান দিয়েছেন।
নাকের বদলে নরুণ—
অভিযোগটা গুরুতর। কৃষি বিশেষজ্ঞদের এক হিসাব অনুসারে নাকি চলতি আখ মৌসুমের কয়েকমাসে প্রায় আট থেকে দশ কোটি টাকা মূল্যের তিন লক্ষাধিক টন গুড় সীমান্তের ওপারে চালান হয়ে গেছে। চোরাচালানকারীরা গুড়ের বদলে এনেছে বিলাস দ্রব্যাদি। এ সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে গতকাল স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায়।
প্রকাশ, চলতি সনে দেশে তিরিশ লক্ষ থেকে বত্রিশ লক্ষ টন আখ উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে চৌদ্দ লক্ষ টন আখ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা এক লক্ষ বিশ হাজার টন চিনি উৎপাদনের জন্যে প্রয়োজন হবে। ইতিমধ্যে চিনিকল সমূহ পঁচাত্তর হাজার টন চিনি উৎপাদন করেছে। আখচাষীরা চিনি কলগুলোতে তাদের উৎপাদনের সমুদয় আখ সরবরাহ করলে চিনির উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতো। অর্থাৎ এ বছর এক লক্ষ তিরিশ হাজার টন চিনি উৎপাদন করা সম্ভব হতো। এ থেকে বিশ লক্ষ টন চিনি বিদেশে রপ্তানী করে পঁচিশ কোটি থেকে তিরিশ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা যেতো। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। কিছু লোক আখচাষীদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদের কাছ থেকে মণ প্রতি ৩ টাকা বা ৪ টাকা দরে আখ কিনে তা দিয়ে গুড় তৈরী করেছে। এই গুড় তারা আবার প্রতি সের ৩ টাকা বা ৪ টাকা দরে বিক্রি করে আর কিছু সংখ্যক বিত্তশালী ও চোরাকারবারী তা বাইরে পাচার করে শিল্পজাত দ্রব্যাদি এনে কালো টাকার পাহাড় গড়ে তুলছে।
অবস্থাটা যা সংক্ষেপে দাঁড়ায় তাহলো নাকের বদলে নরুণ পাওয়ার মতো একটা কিছু বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। নাক যে যাচ্ছে তা চোরাকারবারীরা বোঝে না। এটুকু তারা বোঝে নগদ নরুণ যে পেলাম এটাই লাভ। কিন্তু এভাবে তো একটা দেশ চলতে পারে না। একটা দেশের অর্থনীতির কতকগুলো নিয়ম কানুন রীতিনীতি তো রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস অথবা আভ্যন্তরীণ চিনি উৎপাদনের উৎস আখ যদি চোরাচালানীদের হাতে চলে যায় তাহলে দেশে একদিকে যেমন চিনির দাম বাড়বে অন্যদিকে তেমনি বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি পড়ে সমস্যা ও সংকটের সৃষ্টি করবে। শুধু তাই নয়, টাকার মানও কমে যাবে। ইতিমধ্যে হয়েছেও তাই। বেসরকারী পর্যায়ে বাংলাদেশের টাকার মান অনেক নিচুতে নেমেছে।
সমস্যাটা একদিককার নয়—দু’তরফা সমস্যা। প্রথম সমস্যা হলো চোরাচালান রোধ করা আর দ্বিতীয় সমস্যা হলো আখচাষীদের জন্যে সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশ্বাস প্রদান করা। প্রয়োজনীয় সাহায্য ও সহযোগিতা করা। আর তা যদি না হয় তাহলে গুড় তৈরী ও গুড়ের চোরাচালান বন্ধ হবে না। সংবাদ অনুসারেই দেখা যাচ্ছে যে, আখচাষীদের আর্থিক অসচ্ছ্বলতার সুযোগ চোরাচালানকারী ও বিত্তশালীরা নিচ্ছে। অর্থাৎ বর্তমানে চিনিকল কর্পোরেশন কৃষকদের কাছ থেকে মণ প্রতি ৬ টাকা দরে আখ কিনছেন কিন্তু কর্পোরেশন সময়মতো আখচাষীদের ঋণ না দেওয়াতে তারা বাধ্য হয়ে কম দামে আখ বিক্রি করে দিচ্ছে। অথবা গুড় তৈরী করার দিকে মনোযোগী হচ্ছে। তাছাড়া এ ব্যাপারে সুষ্ঠু কোনো পদ্ধতি গ্রহণ না করায় আখচাষীরা মুনাফাখোরদের খপ্পরে পড়ছে। কাজেই চোরাচালান বন্ধ করো, গুড় তৈরী নিষিদ্ধ ইত্যাদি অতি পুরাতন কথা বলে এ সমস্যার সমাধান হবেনা। এজন্যে চাই সুষ্ঠু একটা নীতি ও কর্মপদ্ধতি।
আমরা যতদূর জানি, চিনিকল এলাকাগুলোতে গুড় তৈরী নিষিদ্ধ। এটা সরকারী নির্দেশ। এ নির্দেশ কার্যকরী হচ্ছে কিনা সেটা যেমন দেখা প্রয়োজন তেমনি আবার আখচাষীরা মুনাফাখোর ও চোরাকারবারীদের খপ্পরে পড়ে কোনো অঘটন ঘটাচ্ছে কিনা সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। আখচাষীদের প্রয়োজনীয় ঋণদানের ব্যবস্থা করা। আখের ন্যায্যমূল্য যাতে পায় সেদিকে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং সবশেষে চোরাকারবারীদের বিরুদ্ধে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এ যদি হয় তাহলে হয়তো নাকের বদলে নরুণ আনার ধ্বংসাত্মক প্রবণতা বন্ধ হতে পারে—অন্যথায় নয়।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক
পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন