বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৬শে ডিসেম্বর ১৯৭১
বাংলার বঞ্চনা
—মীর্জা ওয়াজেদ আলী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
উৎপাদন বৃদ্ধির এ বৈষম্যের পিছনে রয়েছে একদিকে কৃষিখাতে সরকারী বরাদ্দর পরিমাণ আর অপরদিকে উন্নত ধরণের আরও বীজের বিরাট বৈষম্যমূলক বন্টন। উদাহরণ দ্বিতীয় পরিকল্পনাকালে কৃষির উন্নয়ন খাতে বরাদ্দের পরিমাণ হলো পূঃ বাংলা ৮০.২ কোটি টাকা আর পঃ পাকিস্তান ১০৫.৪ কোটি টাকা। উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় উচ্চফলনশীল বীজ ও সার এর বন্টন ব্যবস্থায় দেখা যায় ১৯৬৭-৬৮ সালে পূর্ব বাংলা পেয়েছে ১২৫ হাজার টন সার আর পঃ পাকিস্তান ২৬০ হাজার টন। এ ছাড়াও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও লবণাক্ততা দূরীকরণের মাধ্যমে পঃ পাকিস্তানে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে এবং কৃষিকে আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। এর ফলে দেখা যাচ্ছে তিনটি পাঁচসালা পরিকল্পনাকালে খাদ্যশষ্যের চাহিদা ও উৎপাদনের প্ল্যানিংএ পূর্ব বাংলায় ১,১২৫ হাজার টন ঘাটতি আর পঃ পাকিস্তানে ১,৯২৫ হাজার টন উদ্বৃত্ত দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ পূঃ বাংলাকে দিয়েও পঃ পাকিস্তান ৮০০,০০০ টন চাল বিদেশে রপ্তানি করতে পারে। বিদেশ থেকে যে খাদ্যশস্য আমদানি করা হত তার ক্ষেত্রেও বৈষম্য বর্তমান। শতকরা ভাগে এই তথ্য নীচে দেওয়া হলো
১৯৫৫/৫৬—১৯৫৯/৬০ | ১৯৬০/৬১—১৯৬৪/৬৫ | |
পূঃ বাংলা | ৩১.৯ | ৪১.৫ |
পঃ পাঃ | ৬৮.১ | ৫৮.৫ |
মোট | ১০০.০ | ১০০.০ |
কৃষি বাদেও গ্রাম্য পরিবেশে কৃষির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন ধরনের জীবিকা নির্বাহের পথ অনায়াসে গড়ে উঠতে পারতো যেমন, পশুপালন, পোলট্রি, বাঁশ বেতের শিল্প ইত্যাদি। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে গ্রামের ঘরে ঘরে এ জিনিসগুলো নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল। আদিকালের কিছু তাঁতী ও বাশবেত শিল্পী যদিও ছিল কিন্তু সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তাদের অবস্থাও শোচনীয়।
পূঃ বাংলায় বনভূমি ৫৫ লক্ষ আর পাকিস্তানে ৩২ লক্ষ একর। কিন্তু বন সংরক্ষণের ব্যাপারে ১৯৬১-৬৫ সালে পূঃ বাংলা পেয়েছে ৫১.৪ লক্ষ টাকা আর পঃ পাকিস্তান ৮২.৪ লক্ষ টাকা এর থেকে দেখা যায় পূঃ বাংলার তৈরী বনভূমি রক্ষার চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে নূতন বনভূমি সৃষ্টির দিকেই সরকারের লক্ষ্য ছিল।
সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে বেশী কিছু না বললেও এটা ধরে নেওয়া যায় যে এ বিভাগের অধিবাসী লোকসংখ্যার ভিত্তিতেই হতে হয়। কিন্তু নীচের তালিকাতে দেখা যাবে উল্টা ব্যাপার অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে লোকসংখ্যা কম হলেও সুযোগসুবিধার ক্ষেত্রে তারা পেয়েছে অনেক বেশি।
১৯৬৬-৬৭ সালে সমাজকল্যাণের ব্যবস্থাদ
পূঃ বাংলা | পশ্চিম পাকঃ | |
হাসপাতাল | ৭৬ | ৩৯৩ |
মাতৃ ও শিশুসদর কেন্দ্র | ৫৫ | ৭১১ |
হাসপাতালের শয্যা | ৬৯৮৪ | ২৬২০০ |
চিকিৎসক সংখ্যা | ৬৯৮৯ | ১০৪৪৮ |
মহাবিদ্যালয় | ১০২ | ১৩৮ |
মেডিক্যাল কলেজ | ৮ | ১০ |
টেকনিক্যাল ইনষ্টিটিউট | ২৩ | ৩৬ |
বিশ্ববিদ্যালয় | ৩ | ৫ |
এরপরে আমরা শিল্পায়ন সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করবো। শিল্পায়নের অগ্রগতির জন্য প্রধান তিনটি বিষয় মেন মূলধন। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং শিল্প প্রসারের জন্য উৎপাদন সহায়ক পটভূমির উন্নতিসাধন, প্রতিটি বিষয়ে-ই আমরা সংখ্যাতাত্বিক তথ্যের ভিত্তিতে দুই অঞ্চলের বৈষম্যের তুলে ধরবো।
প্রথমে নীচে দুই অঞ্চলে শিল্পে মুলধন নিয়োগের শতকরা হার দেখানো হলো
১৯৫৯/৬০ শতকরা অংশ | ১৯৬০/৬১—১৯৬৪/৬৫ শতকরা অংশ |
১৯৬৫/৬৬ শতকরা অংশ | |
পূঃ বাংলা | ৩৩.৭ | ৩২.২ | ৩০.৭ |
পঃ পাক | ৬৬.৩ | ৬৭.৮ | ৬৯.৩ |
মোট | ১০০.০ | ১০০.০ | ১০০.০ |
দেখা যাচ্ছে মূলধনের মোট পরিমাণের এক তৃতীয়াংশের বেশী—কোন সময়েই পূঃ বাংলায় লাগানো হয়নি। আবার এই পরিমানও দিন দিন কমে গিয়েছে। ১৯৫৯/৬০ সালে যা ছিল ৩৩.৭ ভাগ ১৯৬৫/৬৬ সালে তা দাঁড়াল ৩০.৭ এ।
ব্যাপক শিল্পায়নের জন্য আরও প্রয়োজন হলে উন্নত পথঘাট, যান-বাহন, ডাক-ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা। শিক্ষাব্যবস্থা, বিদ্যুৎ বা বাষ্পীয় শক্তির আধার। উৎপাদনের জন্য এ সমস্ত সহায়ক ব্যবস্থাদীর উন্নতি বিধানের দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষপাতিত্বমূলক নীতির সাক্ষ্য রয়েছে নীচের তালিকায়।
উপাদান সহায়ক পটভূমি (১৯৫৯-৬০)
উপাদান | একক | পূঃ বাংলা | পঃ পাক |
রেলওয়ে ওয়াগন | প্রতি দশ লক্ষ মানুষ পিছু | ৬ | ১৬৬ |
উচুমানের রাস্তা | দশ লক্ষ মানুষ পিছু মাইল | ২৮ | ২২৫ |
বাস, ট্রাক | প্রতি দশ লক্ষ মানুষ পিছু | ৮৫ | ৪৯৬ |
ডাকঘর | প্রতি দশ লক্ষ মানুষ পিছু | ৮৩ | ১৩৬ |
টেলিফোন | প্রতি দশ লক্ষ মানুষ পিছু | ২৫০ | ১৫০০ |
ব্যাঙ্ক | শাখা অফিস | ১১০ | ২৮৬ |
বিদ্যুৎ শক্তির উৎপাদন | হাজার কিলোওয়াট | ১৭৫ | ৭৩১ |
প্রাথমিক শিক্ষক | ৭৮৪৬২ | ৪৪৮৪৮ | |
মাধ্যমিক শিক্ষক | ২৩৫৭১ | ৩১৩৫৫ |
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল