You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.26 | শ্রমিক কৃষক সমাজবাদীদলের বিপ্লবী অভিনন্দন | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৬শে ডিসেম্বর ১৯৭১

শ্রমিক কৃষক সমাজবাদীদলের বিপ্লবী অভিনন্দন

বাংলাদেশ শ্রমিক কৃষক সমাজবাদীদলের আহ্বায়ক খান সায়ফুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন :
লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে আজ সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর আবাসভূমি হানাদার কবলমুক্ত। সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে আজ দুর্জয় বাঙালী প্রমাণ করেছে যে জনতার অটুট মনোবল, আদর্শে-অকুন্ঠ বিশ্বাস আর মরণজয়ী সংকল্পের কাছে কোন ষড়যন্ত্রই সফল হতে পারে না। আজ তাই সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের বিরুদ্ধে শপথ নেবার দিন। লক্ষ লক্ষ শহীদের নামে এই বলে বজ্রকন্ঠে ঘোষণার দিন যে, বাঙলাদেশকে আর কোনপ্রকার হায়েনা আর শকুনের চারণভূমি হতে দেব না। দেশী বা বিদেশী কোনপ্রকার ষড়যন্ত্রই আর বাঙলাদেশের মাটিতে বরদাস্ত করা হবে না—বাঙলাদেশে গড়ে তোলা হবে এক শোষণমুক্ত সুন্দর সমাজ। বাঙলাদেশের মেহনতী জনতার পক্ষ থেকে আজ এই বিজয়ের দিনে ভারতের সংগ্রামী শ্রমজীবী মানুষের নিঃস্বার্থ সমর্থন আর সারা দুনিয়ায় আমাদের সংগ্রামের সহযোগী অগণিত মানুষকে আমরা জানাই বিপ্লবী অভিনন্দন।
আমরা বিশ্বাস করি যে একমাত্র বাংলাদেশের শ্রমজীবী জনগণের সংগ্রাম এবং আন্তর্জাতিক বিপ্লবী শক্তির সহযোগিতা দ্বারা বাংলাদেশে শোষণমুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব। আমরা বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক শক্তিগুলির প্রতি এবং বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক চীনকে তার ভ্রান্ত নীতি পরিহার করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আহ্বান জানাই।
অনেক অশ্রু আর রক্তের বিনিময়ে আজ বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম সত্তা এক বাস্তব সত্য। গুটিকয়েক দালাল ও তাদের দোসর ব্যতীত এ সংগ্রামে সহযোগিতা করেছে এদেশের প্রতিটি শ্রেণীর সাধারণ মানুষ। তারা লাঞ্ছিত হয়েছে, প্রাণ দিয়েছে অকাতরে। আমরা বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে আবার স্বাধীন হতে চেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশে। কারণ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী আর সামন্তশাহী ও ধনিক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে আমরা স্বাধীন হয়েও স্বাধীন মানুষের কোন অধিকারই পাইনি। অবিচার অত্যাচার শোষণ নিপীড়ন স্বৈরাচার স্বেচ্ছাচারের ষ্টীমরোলার চলছিল এদেশের গণমানুষের উপর। এই অবস্থার বিরাবসান ঘটিয়ে মানুষের মত হয়ে বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠার দুর্জয় সংকল্প নিয়ে এদেশের মুক্তিপাগল জনগণ শুরু করেছিল এ সংগ্রাম—ঘোষিত হয়েছিল “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
এই সার্বিক সংগ্রামের আংশিক রূপায়ণ ঘটেছে আজকে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে। কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম তথা সর্বপ্রকার শোষণ মুক্তির সংগ্রাম আজও অব্যাহত রয়েছে। তাই আজকে সংগ্রামী জনতাকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে হবে তার পরিপূর্ণ লক্ষ্য অর্জনের পথে। জনতার জয় সুনিশ্চিত। বাংলাদেশের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষকে আজ আপোষহীন শপথ নিতে হবে :-
১। মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সমস্ত সংগ্রামী গণপ্রতিষ্ঠানের সমবায়ে বিপ্লবী সরকার গঠন করতে হবে। এ সরকারই নোতুন সংবিধান রচনা সম্পর্কে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
২। স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবার পরিজন এবং যাঁরা মানসিক কিম্বা শারীরিক ভাবে পঙ্গু হয়েছেন তাঁদের সুষ্ঠু জীবন ধারনের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা বিধান করতে হবে।
৩। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।
৪। ভিটেমাটিছাড়া প্রতিটি মানুষের পুনর্বাসন ব্যবস্থা করতে হবে।
৫। যুদ্ধবাজি এবং মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধে অপরাধী বন্দী খান সেনাদের এবং তাঁদের সহযোগীদের আন্তর্জাতিক বিচারাদালত গঠন মাধ্যমে বিচার করতে হবে। বাংলাদেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানী তথা পশ্চিম পাকিস্তানী নাগরিক সাধারণ এবং পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাদেশের নাগরিক সাধারণের নিজ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তা বিধানকল্পে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে হবে।
৬। সমস্ত মূল ও বৃহৎ শিল্প এবং গুরুত্বপূর্ণ সকল জাতীয় সম্পদ জাতীয়করণ করে জাতীয়করণলব্ধ উপস্বত্ত্ব ব্যাপক সামাজিক উন্নয়ন এবং পুনর্গঠনে নিয়োজিত করতে হবে।
৭। সকল বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী ও পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজি ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
৮। সকল কর্মক্ষম নাগরিকের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে এবং ভিক্ষাবৃত্তি বেআইনী ঘোষণা করতে হবে।
৯। কর্মে অক্ষম নাগরিক এবং তাদের উপর নির্ভরশীল পরিবার পরিজনের ভরণপোষণের সম্পূর্ণ ভার রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে।
১০। সামাজিক ন্যায়নীতির ভিত্তিতে জমির পরিমাণ বেঁধে দিতে হবে এবং উদ্বৃত্ত জমি গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিলি করতে হবে।
১১। সামাজিক এবং শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থসংরক্ষণ কল্পে কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় শ্রমজীবী মানুষের কার্যকর প্রতিনিধিত্বের নিশ্চয়তা দিতে হবে।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল