বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৬শে ডিসেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশ
—মনিরুল হাসান
(ভারতীয় প্রতিনিধি প্রেরিত)
পশ্চিমবঙ্গের সুপ্রসিদ্ধ সাপ্তাহিক ‘গণবার্তা’য় নিম্নের প্রবন্ধটি মুদ্রিত হয়। বাংলাদেশে পাক হানাদারদের বীভৎসতম কার্যকলাপ এতে বিধৃত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক, তথা, বিশ্বের প্রতিটি সভ্য নাগরিকের এটা জানা উচিত বলে এর পুনর্মুদ্রণ করা হলো।
—সম্পাদক, বিপ্লবী বাংলাদেশ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সেনাবাহিনীর লোক গিয়েছে শ্রীনগর দীঘলি হলদিতে। গুলি চলেছে। উড়ে গিয়েছে সেখানে ইয়াহিয়ার জেট বিমান। গুলি হয়েছে মেশীনগান থেকে। লুট হয়েছে। পুড়েছে গ্রাম হতে গ্রাম।
স্টেনগান-ব্রেনগান-মেশীনগান-রাইফেলের গর্জন। আজকের বাংলাদেশ। মেঘনার চরের কিশোরী প্রশ্ন করেছিল : আপনার ঘরে পুড়েছে? এখনও পোড়েনি। কেউ মরেছে? এখনও মরেনি।
কিশোরীর চোখ ছলছল করে। ও সেদিন বলেছিল : আমাদের তো সব গিয়েছে। খাবো কি তা-ও পর্যন্ত নেই। সকলকে ঘরছাড়া করেছে। নেই একগোট ধান। পুড়িয়ে দিয়েছে সব।
কিশোরী প্রবেশিকা পরীক্ষার্থিনী। স্কুল নেই কলেজ নেই। পরীক্ষাও হবার সম্ভাবনা নেই। ফেরা হবে না ঢাকায়। প্রশ্ন করেছিল : পরীক্ষার কি হবে?
আর জবাব দেওয়া হয়নি। কারণ তখনও তো আমার কোন ক্ষতি হয়নি। মরেনি কোন স্বজন। পুড়ে ছারখার হয়নি আমার বাড়ি। আমি তাকে বলিনি যে শ্যাম মুখুজ্যের বি-এ পাশ কন্যাকে পাওয়া যায়নি। কন্যার অপমানে আত্মহত্যা করেছে আনোয়ারুদ্দীন শিকদার।
০০০
মেঘনার তখন মৃদু মৃদু বাতাস। ঢেউ ওঠেনি গর্জন করে। শুধু গ্রামে গ্রামে ছেলেরা খেলছে। দশ বছরের নীচের ছেলেরা দুদল হয়ে খেলছে। একদল ইয়াহিয়া বাহিনী আর একদল বাঙালি সেনাবাহিনী।
চীৎকারে মুখরিত হচ্ছে চারিদিক। লোক জমেছে। শব্দ হচ্ছে লাঠির, সে কি তুমুল শব্দ আর আক্রোশের মহরত। সে অনেক আগের কথা।
।। তিন।।
সাফিয়া হাসে। পনর বছরের সাফিয়া সারাদিন হেসে কুটি কুটি হয়। ফরসা একহারা চেহারা। সাফিয়া চীৎকার করে মাঝে মাঝে অনুযোগ জানায় : একটা মেশীনগান নিয়ে যেতে পারেন না! ওদিকে দূরে তখন ম্যাশীনম্যান আর মর্টারের শব্দ হচ্ছে। রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে আসে খানসেনাবাহিনী। পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। মনে হয় কাছে, আরো কাছে শব্দ হচ্ছে। কুমিল্লা জেলায় সীমান্ত এলাকায় নিঝুম রাতে মানুষ জাগে। নয়নপুর, রাজাপুর, কংসনগর, নাইঘর, বলদাবাজারের মানুষ কান পেতে শব্দ শোনে। সাফিয়ার দুঃখ হয় ঐ ছেলেগুলির জন্যে। ওরা কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে আসে। সাঁঝের আকাশ রাঙা হবার আগে দল বেঁধে যায়। তারপর সারাটা এলাকা মুখরিত হয় মেশীনগান রাইফেলের শব্দে।
যে ছেলেগুলি গিয়েছিল সকলে ফেরে না। সাফিয়া যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখে। চারিদিকে মাঠ মাঠ আর মাঠ। ঐ মাঠ-সীমান্তে রেললাইনে মুক্তিবাহিনীর সাথে রোজ সংঘর্ষ হয়। একটি শব্দ হয় আর সাফিয়া বলে রাইফেল! এল.এম.জি! মর্টার।
দুম করে মর্টারের শব্দ হলে চীৎকার করে হেসে ওঠে সাফিয়া : এইবার পানজাইব্বারা শ্যাষ!
সে নিজেই হাসে। সকলকে জাগিয়ে দেয়।
কুমিল্লা হতে সী অ্যান্ড বী রোড ধরে কোম্পানিগঞ্জের দিকে যেতে জাফরগঞ্জের কাছে নাবলে সাফিয়াদের বাড়ি। ভাই সফী নৌকা চালায়। দিন আনে দিন খায়; রাতে মানুষ আসে নিঃশব্দ পায়ে। দোর খুলে দেয় সাফিয়া বা সফী। প্রৌঢ়া মাতা নিশ্চুপ। মানুষগুলি শ্রান্ত হয়ে আসে। ওদের জন্যে রান্না করে সাফিয়া। ওদের খাওয়ায় আর হাসে। হঠাৎ যেন চীৎকার করে জিজ্ঞাসা করে : পানজাইব্বাদের শ্যাষ করতে পারেন না—কতদিন নাইল্লাখ্যাত (পাট ক্ষেত) আর ধানখ্যাতে পলান্ যায়?
পাক সেনাবাহিনী গ্রামে এসে হানা দেয়। ঘরবাড়ি লুটপাট করে জ্বালিয়ে দেয়। সাফিয়ারা ধানক্ষেত আর পাটক্ষেতে আশ্রয় নেয়। আবার মুখর হয় সমস্ত গ্রাম। প্রতি ঘর যেন দুর্গ হয়ে ওঠে।
০০০
সে গ্রামগুলির কাছ দিয়ে গোমতী নদী বয়ে যায়। ভোরের রোদ আসার সাথে সাথে একটা ভয় আর সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে। বাজার বসে না। মানুষগুলি লুকিয়ে যেন হাঁটে। সন্ধ্যা আসার আগে সে গাঁয়ের ঘাস মুখরিত হয়। কতগুলি নতুন মানুষ হাঁটে। স্কুলের ছাত্র, কলেজের ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পরনে সুট, গায়ে গেঞ্জি বা শার্ট, কাঁধে রাইফেল আর এল.এম.জি। এ ছেলেগুলির জন্যেই দুঃখ হয় সাফিয়ার। গভীর রাতে কয়েকটা শব্দের জন্যে অপেক্ষা করে গ্রামে গ্রামে হাজার হাজার সাফিয়া। গভীর রাতে এল.এম.জি আর রাইফেল কাঁধে ছাত্রগুলি ফিরে আসে। গ্রামের দুয়ারগুলি খুলে যায়। ফিস ফিস কথার মধ্যে এক সময় রান্না শেষ হয়। তারপর আবার ঐ রাইফেল কাঁধে ছেলেগুলি অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
সাফিয়া যেন তখন কান্নার মতো করে হাসে। রাইফেল আর এল.এম.জি কাঁধে কৌতুহলী কেউ বিদায় জানাতে এলে সাফিয়া চীৎকার করে ওঠে : জাওন নাই।
সাফিয়াকে বিয়ে দেননি?—কেউ জিজ্ঞাসা করলে ভাই সফী নীরব হয়ে যায়। বলে : সব নসিব হ্যায়। তিন বছর আগে সাফিয়ার বিয়ে হয়েছিল। স্বামী ঈরশাদ ওয়ারাদায় চাকরি করত কক্সবাজারে। মার্চ মাসে ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে হাজার মানুষের সাথে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে ঈরশাদ, আর ফিরে আসেনি।
ঈরশাদ কি হারিয়ে গিয়েছে ইয়াহিয়া বাহিনীর বেয়নেটের মুখে? জানেনা সাফিয়া। সাফিয়া দিনের শেষে রাতের জন্যে অপেক্ষা করে। শব্দ শুরু হলে বলে থাকে : রাইফেল! এল.এম.জি! মর্টার!
আর মাঝে মাঝে চীৎকার করে ওঠে : পানজাইব্বাদের শ্যাষ করতে পারেন না….?
।। চার ।।
নদি, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? মহাদেবের জটা হইতে। ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে-র এ লাইন দুটি পড়তেন মেজভাই। বার বার পড়তেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার্থী মেজভাই বার বার যেন আবৃত্তি করার মতো পড়তেন।
মেজভাইয়ের কন্ঠস্বর আজ আর তেমন করে মনে পড়ে না। কিন্তু কন্ঠস্বর যেন নতুন করে মনে হবে যদি কেউ আমার দেশে যান : ঢাকা হতে দাউদকান্দি। বরিশাল হতে বাগেরহাট। কুমিল্লা হতে সোনামুড়া। পাকশীর পুল হতে চুয়াডাঙ্গা। কোথাও মানুষের কাফেলা কোথাও নৌকার সারি। হাজার হাজার নৌকা চলেছে। ওপরে উন্মুক্ত আকাশ। নীচে ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ।
কোথায় যাবেন? ঐ হোথা-সীমান্তের দিকে মুখ ফিরিয়ে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় ওরা। মানুষ জানে। পথিক জানে। এরা জানে কোথায় যাবে। কিন্তু আশ্রয় কোথায়?
কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি হয়ে পূর্বে সীমান্তের দিকে গেলে মাঝে মাঝে দেখা যায় হাজার হাজার নৌকা। ওপরে আকাশটা কালো করে মেঘ আসে। বৃষ্টি পড়ে। উন্মুক্ত আকাশের নীচে সশঙ্ক মানুষ। মনে হয় কারা যেন কাঁদে। ফিস ফিস করে কথা কয়।
ওরা চলেছে ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে। কার কন্ঠ যেন একটু সরব হয়। কেঁদে ওঠে মহিলা কন্ঠগুলো : আমার কুমড়ো গাছে ফলভান্ডার। পশ্চিমদিকের নারকেল গাছটার এত নারকেল—কি হবে, কে খাবে?
আমার সোনা আমার মানিক—সব কন্ঠ ছাপিয়ে সে কন্ঠ যেন বিলাপ করতে থাকে : আমি যাব না, না-না-না।
আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামে। মেঘের শব্দ হয়। মানুষগুলি ভেজে। মাঝে মাঝে ফিস ফিস করে। কেঁদে কেঁদে ভাসায় ওদের জগৎ। মনে হয় সারা আকাশ গুমরে গুমরে কাঁদতে থাকে একটি শব্দ অনুরণিত করে : না, না, যাব না….!
কিন্তু ফিরবে কোথায়? ঘর পুড়েছে। পশ্চিমদিকে নারকেল গাছটা পুড়ে লাল হয়ে গিয়েছে। নেই জনপথের চিহ্ন। হারিয়ে গিয়েছে সে কন্ঠাধিকারিণীর কোল-জুড়ানো ছেলে। সহযাত্রী অশীতিপর বৃদ্ধ মানুষটা যেন হতচকিত হয়ে যায়। এক একটা ছবির মতো ভাসে কাহিনীগুলি। জীবনের সায়াহ্নে এসে ছেড়েছে বাড়ি। তা হলে মহাদেবের জটা কোথায়? কোথায় কুমিল্লা জেলার চাঁদপুর মহকুমার মেহের? যেখানে একদিন হাজার হাজার বাড়ি ছিল? ছিল সাজানো সংসার?
।। পাঁচ ।।
বরিশাল জেলার অভ্যন্তরে তখন রোদ উঠেছে। কোথাও দু-একটা পাখি ডাকছে। জেলখানায় থমথমে আবহাওয়াটা আরো জমাট হয়েছে। ২২ বছরের তরুণ প্রণাম করল তার বৃদ্ধ পিতা আর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে। খান সেনা এসেছে বরিশালে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। বন্দী হয়েছে। বন্দী হয়েছে বৃদ্ধ পিতা, বড় ভাই আর সেই ফরসা চেহারার তরুণ। বৃদ্ধ পিতা কাঁদতে ভুলে গিয়েছে। কাঁদতে ভুলে গিয়েছে বড় ভাই। বিদায় দিতে হবে কনিষ্ঠ পুত্রকে। ছোট ভাইকে আগের দিন সন্ধ্যায় খান সেনাবাহিনীর কর্ণেল এসেছিল। কারা পরের দিন গুলির সামনে দাঁড়াবে, তাদের নামের পাশে লাল দাগ পড়েছে।
সে তালিকায় বৃদ্ধ পিতা নেই, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা নেই, আছে ঐ তরুণ। সন্ধ্যায় নামের আগে দাগ দেওয়ার সূত্রে খুঁটে খুঁটে দেখছিল সকলকে সেই কর্ণেল। দুরু দুরু করছিল সকলের বুক। লাল দাগ পড়েছে তরুণের নামের পাশে।
তারপর রাত কেটেছে। ভোর হয়েছে। সূর্য উঠছে পূর্ব দিগন্তে। সমন এসেছে। তরুণকে যেতে হবে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে। জানি না সে তরুণের মুখে কোন গ্লানিমার চিহ্ন ছিল কিনা। জানি না একফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়েছিল কিনা পিতাকে প্রণাম করবার সময়। সে চলে গিয়েছিল আর সকলের সাথে।
০০০
শের-এ-বাংলা আর অশ্বিনী দত্তের বরিশালের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে কীর্তনখোলা। কীর্তনখোলার তীরে খুনী ইয়াহিয়া বাহিনীর খুনের আসর বসেছে। রোজ আসছে অসংখ্য তরুণ বৃদ্ধ যুবক। গুলির শব্দে অনুরণিত হচ্ছে কীর্ত্তনখোলা। প্রতিধ্বনিত ছড়িয়ে যাচ্ছে দিগন্তে। অসংখ্য মানুষের ভিড়ে সেদিন সে তরুণ এসেছিল। হাজার শব্দের মধ্যে তরঙ্গিত হয়েছিল। আর একটি গুলির শব্দ। সে শব্দ হয়ত বাতাসের তরঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে আঘাত করেছিল বরিশাল জেলখানার মূক মৌন দেওয়ালে। যেখানে বন্দী বৃদ্ধ পিতা আর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। জানি না গুলির শব্দের আগে তরুণের মনে ভেসে উঠেছিল কিনা পিতা মাতা আর ভাইয়ের মুখ!
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল