স্বাধীনতার এক নাম—ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম
—অধ্যাপিকা রেহানা বেগম
জেনভো’তে যখন ভিয়েতনাম দিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রস্তাব পাশ করছে, তখনই মার্কিনী ধুরন্ধরেরা মিলিত হচ্ছেন ম্যানিলাতে। ম্যানিলাতে জন্ম নিচ্ছে ‘সিয়াটো’ (SEATO) বা ‘দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার চুক্তি সংস্থা।’ শুধু ভিয়েতনামের স্বাধীনতা, শান্তি নষ্ট করার জন্য নয় সমস্ত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রগতির আন্দোলনে প্রতিবন্ধকতা করার জন্যই জন্ম নিচ্ছে এই চুক্তি সংস্থা। উদ্দেশ্য এদের অতি “মহৎ”—দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যাতে কমিউনিষ্ট ভাবধারা প্রবেশ করতে না পারে এবং তাঁরা আমেরিকার তাঁবেদারী করতে পারে সে কথা চিন্তা করেই বৃটেন, আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন্স এবং পাকিস্তান মিলে এই চুক্তি পত্রে সই করে। ভিয়েতনামের মুক্ত স্বাধীন আকাশে ঘন কালো মেঘ সেদিনই ঘনিয়ে আসে। এই চুক্তি পত্রে স্বাক্ষর করতে আপত্তি জানায় ভারতবর্ষ, ইন্দোনেশিয়া এবং বার্মা।
আমেরিকার সৈন্যবাহিনী ইতিমধ্যেই দক্ষিণ ভিয়েতনামে ঢুকতে শুরু করেছে, অবশ্য আক্রমণকারী হিসেবে নয়, বন্ধুর ছদ্মাবেশে। দিয়েন বিয়েম ফুতে লড়াই শেষ করে দেওয়া এবং জেনেভা সম্মেলন কোনটাতেই আমেরিকার সম্মতি ছিলনা। বরঞ্চ মার্কিণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডালেস ইন্দোচীনের বিরুদ্ধে বিমান বাহিনী ও নৌ বাহিনী ব্যবহার করে ইন্দোচীনকে সাম্রাজ্যবাদের ঘাঁটি হিসেবে জিইয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। কারণ ইন্দোচীনকে হারালে সমস্ত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে তাদের বিদায় নিতে হবে এই আতঙ্কে ডিলেস আতঙ্কিত হচ্ছিলেন। জেনেভা সম্মেলনকে ঠেকাতে না পারলেও সাম্রাজ্যবাদীরা ইন্দোচীনে অনুপ্রবেশের পথ খোলা রেখেছিল ফ্রান্সের তাঁবেদার সরকার বাও দাই’র নেতৃত্বে দক্ষিণ ভিয়েতনামকে পৃথক করে নিয়ে।
জেনেভা চুক্তির সবকিছুই উত্তর ভিয়েতনামের মনঃপুত হয়নি তবুও তারা আশা করেছিলেন, ২ বছর পরে, অর্থাৎ ১৯৫৬’র নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হো চি মিনের জয়লাভ এবং স্বাধীন ভিয়েতনামের একীকরণ সম্ভব হবে। কিন্তু নির্বাচনের সময় যতই এগিয়ে আসতে লাগল ততই আমেরিকা দক্ষিণ ভিয়েতনামকে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করার জন্য প্ররোচিত করতে লাগল। নির্বাচনের ব্যাপারে আলোচনা করতেও দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রতিনিধিরা সম্মত হলেন না। স্বভাবতই ১৯৫৬’র নির্বাচনের সমস্ত সম্ভাবনা বানচাল হয়ে গেল। তারপর থেকেই যতবারই উত্তর ভিয়েতনামে নির্বাচনের জন্য চেষ্টা করেছে ততবারই দক্ষিণ ভিয়েতনাম বাধা দেবার ফলে, নির্বাচন আর হয়েই উঠল না, দু্ই ভিয়েতনামও ঐক্যবদ্ধ হলোনা। দক্ষিণ ভিয়েতনামের সরকার এবং তাঁর প্রভু আমেরিকা উভয়েই ভয় পাচ্ছিল যে নির্বাচনে শতকরা ৮০ ভাগ ভোট হো-চি-মিন পাবেন। তাদের এই আশঙ্কা পুরোপুরিই সত্যি ছিল। আন্তর্জাতিক কমিশনের রিপোর্টে জানা গেল যে দক্ষিণ ভিয়েতনাম জেনেভার চুক্তি পত্রে যেহেতু স্বাক্ষর করেনি সেই অজুহাতে তাঁরা নির্বাচনে বাধা দিচ্ছে।
ইতিমধ্যে দক্ষিণ ভিয়েতনামেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৫৫’তে আমেরিকা বাও দাইকে সরিয়ে তাঁর অতিবিশ্বাসভাজন এবং প্রচন্ড কমিউনিষ্ট বিরোধি নগু দিয়েমকে ক্ষমতায় বসিয়ে অনেক স্বস্ত্বি বোধ করেছে। এই বিশ্বাস ভাজন তাবেদারটিকে আরও শক্তিশালী করার জন্য মার্কিনী সমরবিদরা ভিয়েতনামে আসতে লাগলেন। ১৯৫৭’তে দিয়েম আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ারের সঙ্গে দেখা করেন এবং ভিয়েতনামিকে সায়েস্তা করার মত সমস্ত রকম মার্কিনী সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। দিয়েম সরকার দক্ষিণ ভিয়েতনামে পারিবারিক ভাবেই স্বৈরাচার চালাতে থাকে। মানুষ স্বাধীনতা, সুখ সবকিছু থেকে বঞ্চিত হতে হতে প্রচন্ড বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। মার্কিনী ডলার কিছু লোককে কিনে রেখে দেয়। কৃষক জমির অধিকারের স্বপ্ন দেখতেও ভুলে যায়। ঘুষে ঘুষে দেশ ছেয়ে যায়। মানুষের মনের প্রচন্ড বিক্ষোভের আগুন থেকে দিয়েম সরকারকে বাঁচিয়ে রাখে মার্কিনী সমরবিদরা আর মার্কিনী ডলার।
কিন্তু ভিয়েতনামের দেশপ্রেমিক মানুষেরা গর্বের সঙ্গে বলে ‘আমরা বিদেশী দখলদারী শক্তির বিরুদ্ধে হাজার বছর ধরে লড়েছি, দরকার হলে আরও হাজার বছর লড়বো।’ দিয়েমের অত্যাচার আর সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকাকে রুখবার জন্য ভিয়েতনামের গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠে মুক্তিবাহিনী। দিয়েমের মানুষ ধরার ও মানুষ মারার কল যত শক্তিশালী হয়, এই মুক্তিবাহিনীও তত দুর্জয় ও দুর্মর হয়ে উঠে। ১৯৬০’এর ডিসেম্বর মাসে কোচিন চায়নাতে দিয়েমের রাজত্বে অবর্ণনীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে, দক্ষিণ ভিয়েতনামে প্রায় ১০০ জন লোক মিলে ‘National Liberation Front of South Vietnam’ তৈরী করে সমস্ত মানুষের কাছে সাইগন সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আহ্বান জানান। সাইগন সরকারকে আড়ালে থেকে চালাচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, ভিয়েতনামের আসল শত্রু তাঁরাই, এই সত্যটা বুঝতেও তাঁদের সময় লাগলো না। আমেরিকা প্রচার করতে লাগলো এদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে এমন কি মানুষ দিয়ে সাহায্য করছে উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিষ্টরা—আসলে এটা কমিউনিষ্টদের দেশ দখলের এক চক্রান্ত। প্রেসিডেন্ট জনসন বললেন ‘এই মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের একমাত্র কাজই হচ্ছে সরকার যা কিছু তৈরী করে তাকে ধ্বংস করা।’ ডীন রাস্ক বললেন, ‘এদের কোন জনসমর্থন নেই এরা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে মানুষকে দলে টানার চেষ্টা করছে’। তাই তাঁরা সর্ব শক্তি দিয়ে দিয়েম সরকারকে রক্ষা করার চেষ্টা করলেন। তা সত্ত্বেও ১৯৬৩’র নভেম্বরে দিয়েম সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে এবং দিয়েম ও তাঁর ভাইকে মুক্তিবাহিনী খুন করে।
এদের শক্তি দিন দিন বাড়তে থাকে। আর তাবেদার সরকারের পতনের পর আমেরিকার সামরিক হস্তক্ষেপও বাড়তে থাকে। ১৯৬০’র যখন আইসেন হাওয়ারের রাজত্ব শেষ হয় তখন মার্কিনী সৈন্য (avdvisers নামেই পরিচিত) ছিল ৮০০ জনের মত। আর ১৯৬৪’তে জনসনের জয়ের পর ঐ সংখ্যা দাঁড়ায় ২১,০০০ জনে। এখন আর তাঁরা শুধু পরামর্শদাতা হিসেবে থাকতে রাজী নয়, এখন তাঁরা স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পৌঁছল ১৯৬৫’র ৭ই ফেব্রুয়ারী আমেরিকা উত্তর ভিয়েতনামে বিমান আক্রমণ শুরু করে ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিল। দক্ষিণ ভিয়েতনামে গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করানোর ভূমিকা থেকে ক্রমে ক্রমে আমেরিকা গোটা ভিয়েতনামের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করল। কোন ন্যায়, কোন যুক্তি কিছু দিয়েই আমেরিকার এই আগ্রাসী নীতিকে সমর্থন করা যায়না। নয়া উপনিবেশবাদ তার পুরোনো খোল নলচে বদলে মুখব্যদন করে গ্রাস করতে চাইল ছোট দেশ ভিয়েতনামকে। দিয়েন বিয়েম ফুর চেয়েও রোমাঞ্চকর এক স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করল ভিয়েতনাম—মানবতার শত্রু, স্বাধীনতার শত্রু আমেরিকার বিরুদ্ধে।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল