বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৯শে ডিসেম্বর ১৯৭১
তিস্তার পারের দিনগুলো
—বিপ্লবী পথচারী
এই মুহূর্তে হালিমার সাথে দেখা না হলেই ভাল ছিল। ওর ছোট প্রশ্নটির জবাব আমি দিতে পারিনি। পাশ কাটিয়ে গিয়ে অন্য কথার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে আসল প্রশ্নের জবাব দেইনি। মানুষের জীবনে এমন কতকগুলো মুহূর্ত আসে যা সঠিক ভাবে বর্ণনা করা যায়না। দীর্ঘদিন এক জায়গায় একই সাথে আছি অথচ আজ মনে হচ্ছে ওকে যেন নূতন দেখছি। তিস্তা নদীর তীরে কত বর্ষার দিনে কত শীতের রাতে, একত্রে রাইফেল কাঁধে নিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছি তার সঠিক হিসেব করা সম্ভব নয়। তখনো আমরা মুখোমুখি সংগ্রামে লিপ্ত হতাম না। কারণ, আমাদের দূর পাল্লার অস্ত্রশস্ত্র খুব বেশি ছিল না। অভিজ্ঞ অস্ত্রচালকের সংখ্যাও আমাদের কম ছিল। সব দিক বিচার করে গেরিলা পদ্ধতিতে আমাদের লড়তে হতো। কুড়িজন ছেলে ও পাঁচজন মেয়ে নিয়ে যে বাহিনী গড়ে উঠেছিল তা কবে কখন সহস্রের কোটা ছাড়িয়ে গেছে সেদিন ও ক্ষণের হিসেবও আমরা রাখিনি।
হালিমা আমাদের সাথে প্রথম থেকেই ছিলেন। নারায়ণগঞ্জে ওর বাড়ী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষ ইতিহাসের অনার্সের ছাত্রী ছিলেন। ২৫শে মার্চ সামরিক বাহিনীর বর্বর আক্রমণ শুরু হবার পর ঘর ছেড়ে অন্তপুরের মেয়ে বেরিয়ে পড়েছেন বাংলার পথে। তারপর এক সময় সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ করেছেন বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে। প্রয়োজনীয় প্রায় সব আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারই হালিমার জানা আছে। তিস্তানদীর পাড়ে অনেকেই দেখেছে পুরুষের পোষাক পরা উস্কোখুস্কো চুল, কোটরাগত চক্ষু, বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসা হনুদুটো—ছিপছিপে মেয়েটিকে কাঁধে রাইফেল নিয়ে নির্ভীক ভাবে পথ চলতে। সাথী সহ যোদ্ধা ছেলে-মেয়ে সকলেই এই অকুতোভয় মেয়েটিকে একটু অন্য চোক্ষে দেখতো। শ্রদ্ধায় সকলের মাথাই এই ব্যক্তিত্ব সম্পন্না মেয়েটির কাছে অবনত হত। কত দিন দেখেছি বিপদের পুরো ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে গিয়ে শত্রুবাহিনীর জলযান আক্রমণ করতে। তিস্তার পাণিতে অনেক হানাদার হালিমার রাইফেলের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে। আগেই বলেছি তখনো আমরা মুখোমুখি সংঘর্ষে যেতাম না। আঘাত করেই সরে পড়তাম। সতর্কতা নিয়ে যুদ্ধ করেও অনেক সাথীসহ যোদ্ধাকে মাঝে মাঝে হারাতে হয়েছে। যাদের লাসগুলো সরিয়ে নিতে পেরেছি রাতের অন্ধকারে তিস্তা নদীর পাড়ে কবর দিয়েছি তারপর কাতর দৃষ্টিতে চেয়েছি কবরটাও দিকে, দুফোটা চোক্ষের জলও হয়তো ফেলেছি আবার কখনো সম্ভব হলে নাম না জানা কয়েকটা ফুল ছড়িয়ে দিয়েছি কবরের উপর তারপর শহীদ সহ-যোদ্ধার রাইফেলটা হাতে তুলে নিয়ে আবার পথ চলছি। এ পথ চলা এখনো শেষ হয়নি। আরো কিছু বাকি আছে। মাঝে মাঝে ভাবি আর কতজনকে এভাবে হারাতে হবে। আর কত শহীদের রক্ত বাংলার মাটি গ্রহন করবে। সাধারণ মানুষ অনেকেই ইতিহাস সৃষ্টি করে কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তাদের পরিচয় থাকে না। আমরা যেন বিস্মৃত না হই বাংলার এ সব বীর সন্তানদের কথা। যে শোষণহীন সমাজ গড়ে তোলা উদ্দেশ্য নিয়ে তারা পথে বেড়িয়েছিলেন তা যদি আমরা সার্থক করে তুলতে না পারি তাহলে চিরদিনের জন্য রক্ত ঋণে ঋণী থাকবো।
হালিমা প্রশ্ন করেছিলেন লেফটানেন্টকে কখন কবর দেওয়া হবে। ভাবতে পারিনি ও আমাকে সহজভাবে এ প্রশ্নটা করতে পারবে। ছোট প্রশ্নটি, নিতান্ত সাধারণ কিন্তু জবাব দেয়া একটু কষ্ট কর। জানিনা হালিমার মনে কোন আশা ছিল কিনা! রঙিন স্বপ্ন ওর মনের গহিন কোণে একটু বাসা বেঁধে ছিল কিনা! যিনি চলে গেছেন তার কথা বলতে কন্ঠ এখনো রুদ্ধ হয়ে আসে। বাইশ বছরের শক্ত সামর্থ সুপুরুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কীর্তিমান ছেলে। হাল্কা ম্যাসিন গানটা হাতে নিয়ে যখন অমিত বিক্রমে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন তখন সকলেই এই বীর সেনানিটির অভূতপূর্ব সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে যেতেন। দলের নেতা অনেক সময়ই বড় রকমের ঝুঁকি নিয়ে ফ্রন্ট লাইনে থাকেন না। আমাদের লেফটানেন্ট কিন্তু থাকতেন। তিনি বলতেন সাথী সহযোদ্ধাদের সাথে সাথে না থাকলে তারা প্রেরণা পাবে কি করে। মরণের ঝুঁকি নিতে তিনি কখনো ভয় পেতেন না।
শান্ত তিস্তার জল বয়ে চলেছে। বর্ষার দামাল চঞ্চলা মেয়েটি এখন শান্ত প্রবাহিনী। তিস্তার পারের কাশবন, বাশঝার, হিজল গাছ, সরের ঝোপ, হোগল বন, বাবলা গাছ এসবগুলোর সাথে আমাদের নিবিড় পরিচয় রয়েছে। কত বর্ষার দিনে ঝড়ের….
আমাদের এখন লক্ষ্য হল লালমনিরহাট দখল করা। লালমনিরহাট আক্রমণের পূর্বে তিস্তার পারের গুরুত্বপূর্ণ দুটি পাক ঘাঁটি হাতী বাঁধা ও কুড়িগ্রাম আমরা দখল করে নিয়েছি। এখন লাল মনিরহাট হল শয়তান হানাদারদের শক্তঘাঁটি। কুড়িগ্রাম ও হাতীবাঁধা এই দুই জায়গা দিয়ে আমরা মিত্র বাহিনীর সাহায্য নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করছি। আমাদের লেফটানেন্ট নিজে ফ্রন্ট লাইনে দাড়িয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। ঘন ঘন গোলা বর্ষণে চতুর্দিক মুখরিত। দীর্ঘ আঠারো ঘন্টা যুদ্ধ চলার পর লালমণির হাট আমাদের দখলে এল। হানাদারদের অসংখ্য শয়তান নিহত হয়েছে। আর আমাদের দলের ক্ষয়ক্ষতিও খুব নগণ্য নয়! সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল আমাদের লেফটানেন্টের মৃত্যু! দলনেতার অপ্রত্যাশিত মৃত্যু আমাদের জয়ের আনন্দ ম্লান করে দিয়েছে।
লেফটানেন্ট আসফাকুর সামাদ ছিলেন আমাদের দলের নেতা। ওর মা বাবা ঢাকায় এখনো আছেন। কেমন আছেন কি ভাবে আছেন জানিনা। রেডিওতে প্রচারিত সামাদের মৃত্যু সংবাদ এতক্ষণে তাঁরা নিশ্চয়ই পেয়ে গেছেন। জেনেছেন বাংলার মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে তাঁদের সামাদ শহীদ হয়েছেন! সামাদের নামে শত্রুমুক্ত লালমণির হাটের নাম রাখা হয়েছে সামাদনগর। তিস্তার পারে লালমণির হাটে সামাদকে কবর দেওয়া হয়েছে। স্বাধীন বাংলার মাটিতে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন মরণজয়ী বীর! এখনো প্রতিদিন দলে দলে স্বাধীন বাংলার দেশপ্রেমিক মানুষ অশ্রুসজল চোক্ষে কবরের উপর ফুল ছড়িয়ে দিয়ে শহীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন।
বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে তিস্তার পারের কাশবনগুলো। হালিমার বুকটাও কেঁপে কেঁপে ওঠে কিনা জানিনা! জানিনা রাইফেল হাতে নিয়ে জীবন মরণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওরাও কোন রঙিন স্বপ্ন দেখেছিল কিনা!
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল