বিপ্লবী বাংলাদেশ
১২ই ডিসেম্বর ১৯৭১
সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর গণপ্রজাতন্ত্রী বনাম একনায়ক জঙ্গীশাহী
জয় আমাদের সুনিশ্চিত। জয় যে আমাদের সুনিশ্চিত তাতে আমাদের কোনোদিনই কণামাত্রও সন্দেহ ছিল না। যদি তা থাকত, তবে শুধু আজ নয়, বাংলাদেশের চরম দুর্দিনে, যখন পাকসৈন্যেরা চেঙ্গিস খাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশের সর্বত্র ধ্বংস, হত্যা, আর নারীধর্ষণের তান্ডবলীলা চালাচ্ছে, তখন বাংলার অজেয় বীর সন্তানেরা প্রাণকে তুচ্ছ করে সাক্ষাৎ মৃত্যুর সম্মুখীন হয়ে যেখানে যেভাবে পাক যুদ্ধযন্ত্রের ক্ষতিসাধন করা যায় তার প্রয়াস করেছে, ক’রে সফল হয়েছে। কোথায় পেল তারা এই দুর্দমনীয় সাহস আর শক্তি? তাদের সাহস আর শক্তি জুগিয়েছিল এই দৃঢ় প্রত্যয় যে, যে সোনার বাংলার স্বপ্ন তারা আজ বাইশ বছর ধরে দেখেছে, যার জন্য রক্ত দিয়েছে বারবার, সে আর আজ স্বপ্ন নয়। যেদিন শান্তির পথে বাংলার স্বাতন্ত্র্যের শেষ চেষ্টা পাকিস্তানের রক্তলিপ্সু রাক্ষসেরা বাঙালীর রক্তস্রোতে ডুবিয়ে দিল, যেদিন বাঙালী স্বাধীন সার্বভৌম গণতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠনের শপথ নিল, সেদিন বাঙালী জানল তার স্বপ্ন হল বাস্তব।
কিন্তু সেদিনও কেউ বিশ্বাস করে নি যে বাঙালীরা পারবে তাদের সঙ্কল্পে অটুট থাকতে। তারা ভেবেছিল স্বাধীনতা ঘোষণা—ও উচ্ছ্বাসী বাঙালীর একটা উচ্ছ্বাস—ঢেউএর মতো উঠেছে আবার ঢেউয়ের মতো তলিয়ে যাবে। দেশে দেশে বাঙালী আবেদন জানিয়েছিল, কিন্তু কেউ স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় নি। সবাই নিঃস্পৃহ দর্শকের মতো চেয়ে চেয়ে দেখছিল কী হয়, কবে বাঙালী বার বার দ্বারে দ্বারে আঘাত হেনে সাড়া না পেয়ে আবার তার প্রাক্তন অত্যাচারীদের দাসত্ব মেনে নেয়।
কী হল? দুনিয়ার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বাঙালীর পরাজয়ের যে আকুল প্রতীক্ষায় দিন গুণচিল, তা ঘটল না, ঘটল না। ঘটল তার বিপরীত। স্বাধীনতা ঘোষণা হয়েছিল ২৬শে মার্চ, বিদেশী রাষ্ট্র দ্বারা তার প্রথম স্বীকৃতি হল ৬ই ডিসেম্বর।
এই ঐতিহাসিক ঘটনা মনে রাখবে সবাই। আমরা বলি, বিশ্ববাসী আপনারা এও মনে রাখবে, এই দীর্ঘদিনের প্রতিদিন, প্রতিরাত্রি, প্রতি মুহূর্ত অতন্দ্র বাঙালী যোদ্ধারা এই ঘটনার একটি একটি পরমাণু সৃষ্টি করেছে, সঞ্জীবিত করেছে, প্রাণচঞ্চল করেছে, সংহত-সম্বন্ধ করেছে। আর প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে বাংলার সাড়ে সাত কোটি লোকের সঙ্গে তাদের একান্ত, আন্তরিক একাত্মবোধ। তারা শুধু দিয়েছেই :- তাদের রক্ত, তাদের প্রাণ, তাদের ধ্যান জ্ঞান, আশা আকাঙ্ক্ষা সব কিছু। তারা চায়নি কিছুই, অর্থ, মান, প্রতিপত্তি। বিশ্ববাসী, এই যোদ্ধারা যারা শুধু সেই রণাঙ্গনেই সীমাবদ্ধ নেই, যার সংবাদ আজ আর আপনাদের অজানা নয়, এই যোদ্ধারা ছড়িয়ে আছে সর্বত্র—তাদের কতজনের নাম আপনারা জানেন? অথচ তারাই বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের জীবদেহের অসংখ্য নামহীন রক্তকণিকা। তাদের সবার হাতে অস্ত্রও নেই, তবু তারা লড়েছে, লড়ছে। তাদের মধ্যে পুরুষ আছে, নারী আছে, অপ্রাপ্তবয়স্ক বালকও আছে, যারা প্রাণ বিপন্ন করে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য না দিলে মুক্তিসৈনিকদের আঘাত এমন অমোঘ হত না। বিশ্বের জনগণ, তাদের অভিবাদন করুন!
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয় নি। এখনও পাক হানাদার বাংলাদেশের বুকে লুকিয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধ শেয় হয় নি; পাক ও আরও নানা সাম্রাজ্যবাদী শোষণের ফলে বাংলাদেশের যে অপরিসীম দারিদ্র্য, তার বিলুপ্তি না হোলে কোথায় মুক্তি? তাই প্রত্যেকটি বাঙালীকে আজ লড়তে হবে—রণক্ষেত্রে, ক্ষেতে খামারে, মুক্ত অঞ্চলের কারখানায়, বাগানে, গঞ্জে, পুনর্জাগ্রত বাঙালী ভাঙা দেশে আবার গড়বে, দ্বিগুণ পরিশ্রমে, এবং অব্যাহত থাকবে তার সর্বপ্রকার শোষণের বিরুদ্ধে জেহাদ। জয় বাংলা, যে বাংলা শোষণকে চিরতরে কবর দেবে, সাম্য, প্রগতি, ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করবে। ইতিহাসে রাখবে এক নতুন দৃষ্টান্ত।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল