বিপ্লবী বাংলাদেশ
১২ই ডিসেম্বর ১৯৭১
বিশ্বের চোখে বাংলাদেশ
(বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরিত)
আজ বাংলাদেশের মুক্তি দুদিনের অপেক্ষা মাত্র। আজ তাই পিছনে চোখ ফেলে তাকাতে হয়। মুক্তিবাহিনীর ক্রমশঃ সংগঠিত হওয়া, ক্রমশঃ একই থানায় সপ্তাহে হানা দেওয়া—সাধারণ মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে সাহায্য করে তাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অর্জন করা ও শেষ পর্যন্ত গ্রাম থেকে শত্রুকে সম্পূর্ণ দূর করা—এই সমস্ত আজ চোখের সামনে ভাসছে। ভাসছে কত শহীদের অমর স্মৃতি :-
পদ্মার চরে
‘ছিন্নপত্রের’ এই বাংলাদেশে
এরা কারা ছিন্ন তরুণ?
ধু ধু পদ্মার চারে ঝিরি ঝিরি জল,
চারটি তরুণ, পাশে চারটি রাইফেল।
রাজশাহীর শফিকুল পাবনার কাদের
ঠিক জেনেছিল
মুক্তিযুদ্ধ দুর্গাপূজো নয়
কিংবা বন্যাত্রাণ সভাসমিতির ধুমধাম নয়,
তারা মৃত্যুঞ্জয়।
সবচেয়ে কী দরকার বেঁচে থাকতে
যা না হলে
বাঁচা দায়—
ভাত গান ভালোবাসা
সবচেয়ে কী দরকার?
রাজশাহী শফিকুল পাবনার কাদের
ঠিক বুঝেছিল—
আত্মমর্যাদার।
(অসীম রায়ের সদ্য প্রকাশিত বই “আমরা, হাঁটছি” থেকে)
০০০
চরম ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করে মুক্তি বাহিনীর দুর্জয় তরুণরা আজ বাংলাদেশে পাক সৈন্যকে পর্যুদস্ত করেছে। এরই ফলে মরীয়া পাক জঙ্গীশাসকরা ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছে যাতে বিশ্ব বোঝে যে ভারতই পূর্ববঙ্গ সমস্যার মূল—ও আমেরিকার দোস্তরা যাতে পাকিস্তানকে সাহায্য করতে ইউনাইটেড নেশন্স বা ঐ জাতীয় বিশ্বসংস্থাকে নাড়া দিতে পারে। সোভিয়েত রাশিয়া অবশ্য নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাকে নিয়ে যাবার প্রস্তাব করেছিল। পরে তা চীনের ভোটে বানচাল হলে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপের বিষয়ে সে তার ভেটো অধিকার প্রয়োগ করে। ৪ঠা ডিসেম্বর বি বি সি রেডিও ষ্টেশন থেকে শোনা গেল ইলংন্ডের সবচেয়ে নামী কাগজ নিউ স্টেটসম্যানের সম্পাদকীয়। সেখানেও দেখা গেল পাকিস্তানের জঙ্গীশাসকদের ইডিঅট বলে অভিহিত করা হয়েছে—যার একমাত্র অর্থ আহাম্মক। সেখানে মুক্তি বাহিনীর গেরিলাদের পাক সৈন্য বিরোধী প্রচন্ড প্রতিরোধের পূর্ণ উপলব্ধিও প্রকাশ পেয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসে ৬ই ডিসেম্বর মার্কিন সরকারের পাকিস্তানের জঙ্গীশাসকদের প্রতি সমবেদনাকে অর্থহীন ও মূর্খতা বলে অভিহিত করা হয়েছে। আজ দুনিয়ার মানুষও অনেকে জেনেছে মুক্তি বাহিনীর তরুণদের বীরত্ব ও ত্যাগের কাহিনী।
০০০
প্রচন্ড কষ্টে এই শীতে খালি পায়ে খালি মাথায় বুলেট বৃষ্টির মধ্যে মুক্তি বাহিনী লড়ছে। দুই-একদিনের মধ্যেই তাদের সাহায্য করতে ভারতীয় সৈন্যরা এগিয়ে আসবে। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার শ্রীঅর্জুন অরোরা স্পষ্ট জানিয়েছেন ভারতীয় সৈন্যদের উপর নির্দেশ মুক্তি বাহিনীর নেতাদের পরামর্শ মতো তাদের সঙ্গে যোগ রেখে কাজ করবে। তিনি আরো বলেছেন যে বাংলাদেশকে মুক্ত করায় সাহায্য করেই ভারত পাকিস্তানী হানার সমুচিত জবাব দেবে। বাংলাদেশের দখল কখনো কোনোক্ষেত্রেই ভারতীয় সৈন্যদের হাতে থাকবে না। তা থাকবে মুক্তি বাহিনীর হাতে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে।
০০০
অসীম কষ্ট ও সাহস সম্বল করে মুক্তি বাহিনীর যে ছেলেরা লড়ছে আজ তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো আপনার পরম ও চরম কর্তব্য। আত্মমর্যাদাশীল, সুপ্রতিষ্ঠ এই তরুণরা বয়সে নবীন হলেও আপনার শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার পাত্র। বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের, বাংলার সাধারণ মানুষকে, বাংলার সমস্ত রাজনৈতিক দলকে তারা পাশে চায়। তাদের জীবনে মৃত্যু বিদ্যুৎ খেলে যায়, লাল রক্ত চোখের সামনে ভাসে—তাই তারা অপেক্ষা করতে পারেনা, অনেক সময় হয়তো অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। তাদের সমস্ত দোষ ক্রটি ভুলে তাদের পাশে দাঁড়ান—তাদের পথ দেখান।
০০০
রা্জনৈতিক নেতাদের, বিশেষতঃ বামপন্থীদের নেতাদের বিষয়ে বড় ভালো একটি কবিতা লিখেছেন অসীম রায় তাঁর নতুন বই “আমরা হাঁটছি”তে—
মুজীব মুজীব
মুজীব কী জীব :
বুর্জোয়া ডেমোক্র্যাটিক না জনগণতান্ত্রিক
এ জবাব কেউ না কেউ হলফ করুক
মুক্তিযুদ্ধ ততক্ষণ অপেক্ষা করুক।
মৃতদেহ প্রশ্ন করে না
মৃতদেহ হাজারে হাজারে
রাজশাহী খুলনায় কুমিল্লা যশোরে
থরে থারে ঢাকায় চাটগাঁয়
অলিতে গলিতে মাঠে প্রাসাদে বাদাড়ে,
অপলক মৃতদেহ আকাশে খোঁজেনা
বিপ্লবের অভ্রান্ত নিরিখ,
তারা জানে যেখানেই অত্যাচার
সেখানেই মুক্তির পতাকা
যেখানেই কামানের ধোঁয়া
সেখানেই লক্ষ লক্ষ মানুষের রোষদীপ্ত চোখ
গ্রীষ্ম বর্ষা সমস্ত ঋতুতে
সমস্ত আকাশ জুড়ে জ্বলে।।
কবিতাটি কি আমরা চীনা ভাষায় অনুবাদ করে পিকিং-এ পাঠিয়ে দেব?
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল