বিপ্লবী বাংলাদেশ
১২ই ডিসেম্বর ১৯৭১
এ এক অপূর্ব সৃষ্টি
—শ্রী বীরেশ ভট্টাচার্য
“ক্রুসেডিয়ার্স” বলে একটি বই পড়েছিলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর একজন আমেরিকান সেনাধ্যক্ষের লেখা। তিনি বইটির প্রথম লাইন সুরু করেছেন এই ভাবে : “I am writing about a nation who have no national background ”; অর্থাৎ “আমি একটি জাতি সম্বন্ধে লিখছি যার কোন জাতীয় ঐতিহ্য নেই।” সেই আমেরিকার একটি প্রদেশে জন্ম নিয়েছিলেন নৃত্যশিল্পী ইসাডোরা ডানকান্—বিখ্যাত ডানকান্ পরিবারে।
ইসাডোরার মাকে বাবা প্রচুর মারধোর করতো সরাব না খেয়েও। যৌবনের সেই স্মৃতি—মর্মান্তিক স্মৃতি—ছিল ডানকানের চিরসাথী। ফলে ওঁর প্রতিজ্ঞা ছিল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হওয়া। যদিও তিনি তিনটি সন্তানের মা হয়েছিলেন—তাঁর প্রতিজ্ঞা না ভেঙেই এবং ইতিহাস জানলো যে “আমি তো ওদের ভালোবেসেছিলাম—কিন্তু কেমন করে বলি ওরা আমায় না জানিয়েই চলে চলে কেন?”—এই কথা কটি। এবং পরে তাঁর তিনটি সন্তানই স্নানের টবে ডুবে মারা যায়—তাঁর অনুপস্থিতিতে—এবং জীবনের সমস্ত সম্পদ তিনি কিন্ডারগার্টেনের জন্য ব্যয় করেন।
শ্রীমতি ডানকান ১৯০৫ সালে জারের রাশিয়ায় এক নাচের-নিমন্ত্রণে আহুত হয়ে যান। তখন রাশিয়ায় বিপ্লবী-সংগ্রাম চলছে। ঘোরার-গাড়ীতে চড়ে—রাস্তা দিয়ে যখন তিনি যাচ্ছিলেন তখন তিনি দেখতে পান—রক্তাক্ত-দেহ, বিকৃত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একদল মানুষকে সারিবদ্ধ ভাবে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে জারের সেপাইরা। ইসাডোরা জিজ্ঞেস করলেন কোচম্যানকে,—জানলেন—শুনলেন জারের সেপাইদের বর্বর অত্যাচারের নৃশংস কাহিনী—খেয়ে খাওয়া নিরীহ মুক্তিকামী মানুষগুলোর ওপর। সেই দিন—তক্ষুনি ডানকান প্রতিজ্ঞা করলেন ‘আমার সমস্ত-জীবনের নৃত্যশিল্প মুক্তিকামী খেটে খাওয়া মানুষের জন্য নিবেদন করলাম—আজই, এইক্ষণ থেকে।’
শ্রীমতী ডানকানকে একদিন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল “আপনি তো মা—আমরা কি শুনতে পারি জন্ম-বেদনার অভিজ্ঞতার কথা?” উনি বললেন, কেমন ক’রে বোঝাই এ ধ্বনির সবকটি সুর? শুধু বলতে পারি এ ধ্বনি এমন এক ধ্বনি যাতে মিশে আছে ক্লেদ-রোদন-আনন্দ-অশ্রু-হাসি-কান্না—সব মিলিয়ে এ “রোদনধ্বনি সৃষ্টি-ক্ষণের এক মহাধ্বনি।”
বাংলাদেশের বুকের উপর দিয়ে পাক-হানাদার ইয়াহিয়ার নির্দ্দেশে রক্তাক্ত-ক্লেদাক্ত-যে বেদনাদায়ক পরিস্থিতির উদ্ভব করলো তাকে আমি জন্ম ক্ষণের প্রথম-ক্ষণ বলেই মনে করতে চাই। কারণ, এ কি সত্য নয় যে পাকিস্তানের গর্ভের মধ্যে বাংলাদেশ এক নবাগত শিশু—যাকে বিশ্বে পা ফেলার জায়গা করে দিতেই হবে? মানব সমাজের—‘সভ্যসমাজের’ ইতিহাসে এটা অত্যন্ত বেদনা-দায়ক ঘটনা—কিন্তু এগিয়ে পা ছড়িয়ে বসে বেসাতি করার কি আছে? প্রতিটি নতুনের ভূমিষ্ঠ হওয়ার ইতিহাসের সাথেই কি প্রাকৃতিক, কি সামাজিক, দিকে এ বেদনা অবশ্যম্ভাবী নয়? ইতিহাসে “বাংলাদেশ” যদি একটি নতুন জন্ম না হয়—তবে শুধু ‘গণহত্যা’র দাবী তুলে যে ফসল ফলবে তা নতুন করে নরহন্তাদের পুষ্ট করবে। নতুনের ভূমিষ্ঠকরণ হবে অবহেলিত-বিড়ম্বিত-দ্বিধাগ্রস্ত—সর্বশেষে, নতুনের আগমন ধ্বনি হয়ে যাবে স্তব্ধ।
“প্রতিহিংসা নয়, সৃষ্টির উন্মাদনাতেই আমার রাইফেল গর্জে উঠবে”—কেননা এই সংগ্রাম সৃষ্টি-ধর্মী। সৃষ্টি-ক্ষণের বেদনাবোধ যদি গভীর না হয় (শুধু বেদনার ব্যক্তিগত উৎস গভীর হয় না—প্রথম চালিকাশক্তি হ’তে পারে) তবে কোন্ সৃষ্টির জন্য সংগ্রাম—সে ধারণা হবে ক্ষীণ—এবং সৃষ্টির পূর্ণ প্রকাশের আগেই সংগ্রামে আসবে শৈথিল্য। কাজেই বাংলাদেশ একটি নতুন সৃষ্টির নতুন নাম—এটা কোন ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছাকে পরোয়া না করেই প্রকাশমান—এ কথাই বোধহয় বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে এক্ষুণি তুলে ধরা দরকার—বিশেষ করে মোর্চায় মোর্চায় যে যে সব গেরিলারা বাংলাদেশকে রাহুমুক্ত করার সংগ্রামে দৃপ্ত, নিবেদিত।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল