You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.12 | বাংলাদেশ —মনিরুল হাসান | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১২ই ডিসেম্বর ১৯৭১

বাংলাদেশ
—মনিরুল হাসান

(ভারতীয় প্রতিনিধি প্রেরিত)
পশ্চিমবঙ্গের সুপ্রসিদ্ধ সাপ্তাহিক ‘গণবার্তা’য় নিম্নের প্রবন্ধটি মুদ্রিত হয়। বাংলাদেশে পাক হানাদারদের বীভৎসতম কার্যকলাপ এতে বিধৃত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক, তথা, বিশ্বের প্রতিটি সভ্য নাগরিকের এটা জানা উচিত বলে এর পুনর্মুদ্রণ করা হলো।
—সম্পাদক, বিপ্লবী বাংলাদেশ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কারখানার পাশে বস্তিতে খেতে বসেছিল রিকশাওয়ালা আবদুর রউফ। সামনে বসেছিল স্ত্রী। ওদিকে সী অ্যান্ড বী কারখানায় গাড়ি নিয়ে এসেছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চারজন জওয়ান। একসময়ে ওরা যেন যমদূতের মতো এসে টেনে নিয়ে গেল রউফকে। বেঁধে রেখেছিল বারান্দায়। তারপর একজন একজন করে চারজন জওয়ান ‍ঢুকলো ঐ কুঁড়েঘরে। কুঁড়েঘরের মাটি কাঁপলো। বাতাস কাঁপলো।
তেজগাঁওয়ে তখন রোদ আর রোদ। সী অ্যান্ড বী কারখানার পাশের বস্তিতে আজ আর আবদুর রউফ নেই। নেই তার স্ত্রী।
০০০

বর্ষা এসেছে। বৃষ্টি আসছে আকাশ জুড়ে। শাদা শাদা আস্তরণ ঢেকে দিচ্ছে বুড়িগঙ্গার বুক। বুড়িগঙ্গা কাঁপছে। শব্দ হচ্ছে। যুদ্ধ শুরু হয়েছে মুক্তিফৌজের সঙ্গে। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে শিশু। সেন্ট্রাল রোডে। শিশকন্যাটি চীৎকার করছে ‘আম্মি বাড়ি চল।’
হাতীর পুলের বাড়ীতে তালা ঝুলছে।
আবদুর রউফ হারিয়ে গেছে। রাজধানী ঢাকা ওদের জায়গা দিতে পারছে না।

।। দুই ।।
মেঘনার তীরের ছেলেটির কথা আজ আর মনে পড়ছে না। বরিশাল জেলার ভোলায় মেঘনার তীরের সে ছেলেটি হাজার মানুষের মুখের সাথে মিলিয়ে গেছে। আজ আর তার জন্যে চোখে পানি ভরে আসে না। ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসের কথা। শতাব্দীর বৃহত্তম ঘুর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসে লাখ লাখ মানুষ মরেছে, ভোলা, পটুয়াখালি আর নোয়াখালি জেলায়। চারিদিকে লাস আর লাস। হাজার মানুষ আর পশুর লাস। বরিশাল জেলার ভোলা মহকুমায় লাসের ভিড়ে আর নদী দিয়ে নৌকা-লঞ্চ চলছে না। একমাত্র মনপুরা দ্বীপে ২২ হাজার অধিবাসীর মধ্যে ১৬ হাজার মারা গেছে। চারিদিকে মৃত্যুর স্তব্ধতা। হাজার মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে এক চর থেকে এক চরে নিজের আত্মীয়স্বজন। বোন খুঁজছে ভাইকে। মা খুঁজছে সন্তান। স্বামী ‍খুঁজছে স্ত্রীকে। আকাশ গুমরে উঠছে মানুষের কান্নায়। এমনি ভোলার চরের এক লাসের ভিড়ে এক মহিলার মৃতদেহের কাছে বসে আছে এক শিশু। বয়স ছয়ে থেকে সাত। দূরে আর এক মহিলার লাসের কাছে আর এক শিশু। বয়স আট থেকে দশ। ওরা আসে। নিত্য আসে। সারাদিন মৃত দেহের কাছে বসে থাকে। সন্ধ্যায় মিলিয়ে যায়। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে মানুষ।
জিজ্ঞাসা করা হলো শিশুটিকে : ঐ মহিলা তোর কে? কেউ না। তুই বসে থাকিস কেন? আমার ইচ্ছে।
চটপট জবাব দিয়ে যাচ্ছে ছেলেটি।
ততক্ষণ পাশের ছেলেটির চীৎকার উঠেছে : তুই মিথ্যে বললি কেন। ওটা তোর মায়ের লাস নয়?
নির্বিকার সে শিশু। সে-ও চীৎকার করে : আমার ইচ্ছে আমি মিথ্যে বলেছি। তোর কি?
মেঘনার তীরে কথাগুলি ছড়িয়ে যায় আকাশে। রেণু রেণু হয়ে মিশে যায় বাতাসে। একটা গভীর নিস্তব্ধতা। একটা কান্নার মতো নিস্তব্ধতা সমস্ত পরিবেশটা জুড়ে বসে। টলমল করে চোখের জল। সকলের অলক্ষ্যে শিশুটি কাঁদে তার মায়ের লাসের কাছে।
০০০

১৯৭০ সালের নভেম্বর নয়। ১৯৭১ সালের এপ্রিল। পৃথিবীর বৃহত্তম ঘুর্ণিঝড় নয়। চরমতম বিভীষিকা। নারকীয় অত্যচারের চাকায় আর্তকন্ঠ মানুষ। মেঘনার চরের কাহিনী নয়। আড়িয়লখাঁর কাছাকাছি। প্রমত্তা পদ্মা হতে উঠে গিয়ে আড়িয়ালখাঁ ঘিরে ধরেছে ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমাকে।
এপ্রিলের আকাশে সেদিন বাতাস নেই। নিস্তরঙ্গ আড়িয়াল খাঁ। ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী এসেছে মাদারীপুরের কুলপদ্দী গ্রামে। গ্রামের পর গ্রাম পুড়ছে। লুঠ হচ্ছে বাড়ির পর বাড়ি। গুলির শব্দে মুখর হচ্ছে প্রান্তর। বারুদের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে। একটি বাড়িতে সামরিক বাহিনীর কজন লোক তাড়া করছে একটি শিশু এবং তার মাকে। শিশু চীৎকার করছে : আমার মাকে না, আমাকে গুলি করো।
মা চীৎকার করছে : আমাকে গুলি করো, ওকে নয়—
এক সময় ছুটতে ছুটতে শিশুটি এসে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আর ওদিকে গর্জে উঠেছে রাইফেল। গুলি শিশুটিকে ভেদ করে চলে গেছে তাকে গলার কাছে আহত করে। আগুন তখন লেলিহান। বাড়ি লুঠ হচ্ছে। পুড়ছে খেত-খামার। নিস্পন্দ মাতা তাকিয়ে আছে শিশুর দিকে।
জানিনা, ভোলার চরের শিশুটির মতো কোনদিন চীৎকার করে উঠেছিল কিনা কুলপদ্দীর মাতা : ঐ শিশু আমার কেউ নয়, কিছু হয় না।

।। তিন।।
পদ্মা মেঘনা ধলেশ্বরী। ঢাকা জেলার মহকুমা মুন্সীগঞ্জ। বাংলাদেশের পশ্চিম এলাকায় একমাত্র নৌ পথ। বর্ষায় তালতলা গৌরগঞ্জের খাল হয়ে লঞ্চ চলে। ফরিদপুর যশোর খুলনার লঞ্চ গোপালগঞ্জ হয়ে পদ্মা পাড়ি দিয়ে এ পাড়ে এসে তালতলার খাল দিয়ে ঢাকার দিকে যায়। শুকনোর দিনে পৌষ মাঘ ফাল্গুন চৈত্রে এ পথে লঞ্চ চলে না। গৌরগঞ্জের খাল নয়, পদ্মা পাড়ি দিযে ধলেশ্বরী হয়ে মুন্সীগঞ্জের পাশ দিয়ে চাঁদপুরের লঞ্চ ডানদিকে চলে যায়। আর ঢাকার লঞ্চ যায় বাঁয়ে। (চলবে)

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল