বিপ্লবী বাংলাদেশ
১২ই ডিসেম্বর ১৯৭১
বাংলার দিকে দিকে বিদ্রোহ
—বিপ্লবী পথচারী
বাংলার দামাল ছেলেরা আজ চতুর্দিকে বিদ্রোহে ফেটে পড়েছে। দীর্ঘ ছাব্বিশ বছরের শাসনের নামে শোষণে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পেরেছে সাম্রাজ্যবাদী শয়তান আমেরিকার পা চাটা কুকুরের দল বাংলার মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের পরিণত করতে চায় ক্রীতদাসে। পচাগলা, পিছনে—ফেলে-আসা, কবরের মধ্যকার উপনিবেশবাদকে আবার চাঙ্গা করে তুলতে চেয়েছে জল্লাদ ইয়াহিয়া। প্রমাণস্বরূপ, আমরা বাংলার কোটি কোটি মানুষ তা হাড়ে হাড়ে অনুভব করছি। দেশের প্রায় সব মানুষ যাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছেন, শয়তান ইয়াহিয়া তাঁদের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে অনিচ্ছুক। জল্লাদ ইয়াহিয়া, তুমি জেনে রাখো তোমার আগ্রাসী মনোভাব আমরা চিরতরে স্তব্ধ করে দেবো। এমন শাস্তি তোমাকে দেশবাসীর কাছে পেতে হবে যা বিশ্বের মানুষ হয়তো কল্পনাও করতে পারছে না। রণোন্মাদ ইয়াহিয়া, ইতিহাসের নির্মম পরিণতির নজীরগুলো একবার ভেবে দেখো। ভেবে দেখো ফ্রান্সের স্বেচ্ছাচারী ষোড়শ লুইয়ের কথা—স্মরণ করো তার শোচনীয় পরিণতি! আমেরিকা ও চীন একত্রে চাইছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বানচাল করে দিতে। চীনারা কি ভুলে গেছে জাপানীদের বর্বর অত্যাচারের কথা? ইয়াহিয়ার বর্বর অত্যাচার পৃথিবীর সব কিছুকে ছাড়িয়ে এক নজীর বিহীন নির্মমতার ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ইয়াহিয়ার প্রভু আমেরিকান শোষকদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে সরে যাচ্ছে! নিক্সনের পোষা কুকুর ইয়াহিয়া আর কদিন ভেউ ভেউ করবে? ওর লাফালাফি আমরা প্রায় শেষ করে এনেছি। ভিয়েতনামের মাটিতে যেমন ৫৬ হাজার মার্কিন জল্লাদ বাহিনীর সমাধি হয়েছে বাংলার বুক থেকেও ৮০ হাজার আক্রমণকারী পাক সেনার যুদ্ধ সাধ আমরা চিরতরে মিটিয়ে দেবো। মেকংনদীর রক্তধারা বুড়িগঙ্গায় এসে মিশেছে। ভিয়েতকংদের নির্মমভাবে হত্যা করে তাদের লাসগুলো যেমন মেকং নদীতে ভাসানো হয়েছে, বুড়িগঙ্গার বুকেও তেমনি বাংলার বিদ্রোহী জনতার মরদেহ ভেসে বেড়াচ্ছে। আমেরিকার ইঙ্গিতে ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী হিংস্রশাপদের মত আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিদেশী অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল অপরিণামদর্শী মূর্খ ইয়াহিয়া জানেনা কোন সর্বনাশা পথে ও এগিয়ে যাচ্ছে! পর-প্রভুও যে আজ ডলার সংকটে ভুগছে। অ্যামেরিকার অর্থ ও অস্ত্রকে মূলতঃ সম্বল করে পাক জল্লাদবাহিনী আমাদের বাংলার লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে! শত সহস্র সুখ-শান্তিতে ভরা গ্রামকে, সাধারণ মানুষের গৃহকে, করেছে ভস্মীভূত! বাংলার আকাশ বাতাস আজ স্বজন-হারানো মানুষের আর্তচিৎকারে মুখরিত। ইয়াহিয়ার সাজানো বাগান আমেরিকান মালী, আর বেশিদিন জল সেচ করে সবুজ শ্যামল রাখতে পারবে না। বেলুচিস্তান, সীমান্তপ্রদেশ, ও সিন্ধুতেও আজ বিদ্রোহের আগুন প্রায় জ্বলে উঠেছে।
একটা দেশ ও একটা জাতিকে বঞ্চিত করে শোষণের ষ্টীম রোলার বেশিদিন চালানো যায়না। দেশের সব মানুষ যখন মুক্তিকামী ও সচেতন হয়ে উঠে তখন কোন প্রবল শক্তিও আর তাদের কন্ঠ রুদ্ধ করে রাখতে পারে না। জলের প্রবল স্রোতকে বাঁধ দিয়ে বন্ধ করতে চাইলে হয় প্রতিবন্ধককে ভেঙ্গেচুরে তা পথ করে নেবে, নতুবা দুকূলপ্লাবিত প্রলয়াঙ্করী রূপ নিয়ে বন্যা হয়ে দেখা দেবে। মানুষের বাঁচার অধিকার ও মৌলিক দাবীকে স্বীকার করে না নিয়ে শুধু ভাঁওতা দিয়ে তাদের বেশিদিন স্তব্ধ করে রাখা যায় না। যদি তা করা হয় তাহলে দেখা দেখা দেয় বিদ্রোহ। বাংলার মানুষের কাছে এসেছিল তেমনি দুর্ভাগ্যজনক বিড়ম্বনা; আর তার বহিঃপ্রকাশ হয়েছে বিপ্লবী বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের সশস্ত্র বিদ্রোহে! যে বিদ্রোহের পথে আমাদের যেতে বাধ্য করা হয়েছে সে পথ যে কুসুমাস্তীর্ণ নয় তা আমরা জানি। কত সাথী, সহযোদ্ধাদের আট মাসাধিককালের মুক্তিসংগ্রামে হারালাম। কত জনপদ ধ্বংস হয়ে গেল কিন্তু তবুও আমাদের দুর্নিবার মুক্তিবাহিনী একটুও পশ্চাৎপদ হয়নি। প্রতিটি পদক্ষেপে মৃত্যুর কড়াল হাতছানি উপেক্ষা করে আমরা এগিয়ে চলেছি। মার্কিন জহ্লাদবাহিনী যেমন পারেনি ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে, তেমনি পাক পশু-শক্তিও পারবে না আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধকে একটুও পিছিয়ে দিতে। আমরা আছি—আমরা থাকবো। আমরা তো বিশ্বের শতকরা ৯৫ জন মানুষের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের প্রিয়জনরাই তো বিশ্বের দিকে দিকে মুক্তির জন্য লড়ছে।
আমাদের জয়যাত্রা এখন দুর্বার গতিতে লক্ষ্যস্থলের দিকে এগিয়ে চলছে। শোষণের চির অবসান ঘটিয়ে লাখলাখ শহীদের রক্তে ভেজা জয়ের পতাকা বাংলার দিকে দিকে বিজয়গর্বে উড়ছে।
বাংলায় এমন কোন জায়গা নেই যেখানে মুক্তিবাহিনীর সেনানীরা তৎপর নয়। প্রায় ৮০ হাজার খানসেনাকে আমরা এখন পর্যন্ত খতম করেছি। রাজধানী ঢাকা শহর দখলের জন্য আমরা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছি। ইয়াহিয়াও পশুর শক্তির পরম নির্ভরস্থান যশোহর ক্যান্টনমেন্ট আজ আমাদের দখলে। এই দুর্গ দখল করতে মিত্রবাহিনীও আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। হিটলার একদিন ভেবেছিল তার বাহিনী পৃথিবীতে অজেয়—বার্লিন শহরে কোনদিন শত্রুর পদার্পণ হবে না। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে যা হয়েছিল সে শোচনীয় ইতিহাস পৃথিবীর সব মানুষেরই জানা আছে আছে। আমেরিকার তল্পিবাহক পাক সরকারও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। যে পশুশক্তি স্বেচ্ছাচার-তন্ত্রকে গণতন্ত্র বলে মনে করে, সে পশুরাজানেনা জনগণের শক্তি কতটা প্রবল এবং কতটা সুদূর প্রসারী। ইয়াহিয়া ভেবেছিল বেয়োনেট দিয়েই বাংলার মানুষকে স্তব্ধ করে রাখা যাবে। নিকসনকে পদসেবা করে তুষ্ট করে, দেশের মানুষের কাছ ছাড়া হয়ে ইসলামাবাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রাসাদে বসে, জল্লাদ বাহিনীর দ্বারা পিষে মারা যাবে একটা দেশ ও একটা জাতিকে। বিশ্বের বুক থেকে শোষণ ও নিষ্পেষণের পর্ব আজ প্রায় অবলুপ্তির পথে। ইয়াহিয়া ভেবেছিল আমেরিকার সাথে গাঁটছড়া বেঁধে ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে বাংলার স্বাধীনতা-যুদ্ধকে স্তব্ধ করে দেবে। কিন্তু তা আর হল না। চূড়ান্ত বিজয়ের প্রান্ত সীমায় আমরা প্রায় এসে গেছি। স্বাধীন, সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রী, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে স্বীকৃতি পেয়েছে। যে রক্ত-মূল্য দিয়ে আমরা স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠা করলাম তাকে গঠন করার মহান দায়িত্বও আমাদের নিতে হবে। বাংলার ঘরে ঘরে আজ হাহাকার! যাঁরা চলে গেছেন তাঁদের আমরা ফিরে পাবো না জানি কিন্তু যে বাইশ পরিবারের শোষণ মুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র আমরা গড়ছি তার মহান আদর্শ যেন রক্ষা করে যেতে পারি; তাহলে সেটাই হবে মুক্তি যুদ্ধের শহীদ লাখ লাখ ভাইদের প্রতি সবচেয়ে বড় শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন!
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল