You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.05 | রাজনীতির ফেরফের | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১

রাজনীতির ফেরফের
কষ্টি পাথর

মুক্তিফৌজ এগিয়ে যাচ্ছে। খান বাহিনী হটে যাচ্ছে। কোন কোন এলাকায় ফিরে যেতে চাচ্ছে শরণার্থীরা। আশা—হয়তো ফিরে পাবে ভিটে, গাছ আর মাটিটুকু। পূর্ব পুরুষের স্পর্শে পূণ্য সে মাটি। বাসনা—সেখানে আবার বাঁধবে বাসা। কিন্তু সাথে সাথে একটা ভয় উঁকি দেয় মুক্তিফৌজের মনে। একটা আশংকা ছায়াপাত করে শরণার্থীদের আশার আকাশে। আগামী দিনের সে জগৎটা কেমন হবে? সেই স্বজন হারান মাতৃভূমিতে কি আবার হায়নার চারণভূমি হবে না? পারবে কি শরণার্থীর সেখানে নিরাপত্তায় জীবনযাপন করতে। আবার কি মায়ের কোলে কচি শিশুকে ষ্টেনগান ব্রেনগান নিয়ে খেলা শেখাতে হবে। আবার কি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ আর স্কুলের ছেলেদের ভিনদেশের পালিয়ে গিয়ে অস্ত্র শানাতে হবে। ভাবতে ভাবতে মুক্তি ফৌজের তরুণদের হাত শক্ত হয়। কঠিন হাতে জাপটে ধরে ষ্টেনগান আর ব্রেনগান। ভাবতে ভাবতে ছলছল করে শরণার্থীর চোখ। তাই প্রশ্ন ওঠে এ সংগ্রাম কার! এ সংগ্রাম কার বিরুদ্ধে! এ সংগ্রামের শেষ কোথায়!
শেখ মুজিবর রহমান তার ৭ই মার্চ-এর রেসকোর্সের ভাষণে বলেছেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। শেখ সাহেবের ভাষণ পাঠ করলেই স্বাভাবিকভাবে মনে একটা প্রশ্ন জাগবে—তাহলে কি আমরা স্বাধীনতা পাইনি? ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে ভারত উপমহাদেশে ভাগ হয়ে যে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের সৃষ্টি হল, আমরা কি তার কোনটিরই অধিবাসী নই। পাকিস্তান বা ভারত এর কোন একটি রাষ্ট্রই কি আমার জন্মভূমি নয়। আর যদি এর কোন একটি রাষ্ট্র আমাদের জন্মভূমি হয়ে থাকে তাহলে আমরাও ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে স্বাধীন হয়েছিলাম। তবে আবার নতুন করে স্বাধীনতার আন্দোলন কেন?
এ’কথা নিঃসন্দেহে সত্যি যে ১৯৪৭ সালের বৃটিশ পার্লামেন্টের আইন অনুযায়ী আমরা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পাকিস্তানের অধিবাসী ছিলাম। ভৌগলিক দিক হতেও এ সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু একটি ঘোষণার স্বাধীনতা কিংবা কোন ভোগলিক অবস্থান হতে একটি বিদেশী শক্তির অপসারণই একটি দেশের স্বাধীনতার মাপকাঠি নয় সেকথা আজ প্রমাণিত। অভিধানিক অর্থে স্বাধীন হয়েও যে আমরা একটি স্বাধীন জাতির জন্মগত অধিকার পাইনি সেকথা আজ স্বীকৃত। অর্থাৎ চাকুরী, শিক্ষা, উন্নয়ন, আচার আচরণ প্রতিটি ক্ষেত্রে ১৯৪৭ সালের পাকিস্তানের পূর্বাংশের অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের মানুষ তার কঠোর করুণ অভিজ্ঞতা হতে বুঝতে শিখেছে সে একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক অধিকার হতে বঞ্চিত হয়েছে। তাই স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও সে স্বাধীনতা চায়—সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাই আজকের সংগ্রাম একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের অধিকার অর্জনের সংগ্রাম। পাকিস্তানের কাঠামোয় যে অধিকার অর্জন সম্ভব নয় এই সিদ্ধান্ত থেকে আজ দাবী উঠেছে—বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে। আর পাকিস্তানের কাঠামোয় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রে এমন এক ঝাক শকুনি এবং গৃধিনী আসন জাকিয়ে বসেছে যে তাদের আওতায় স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের অধিকার অর্জন সম্ভব নয়।
কিন্তু আজকের এই শকুনি এবং গৃধিনী মুক্ত যে নোতুন রাষ্ট্র আমরা গঠন করতে চাচ্ছি সেখানে আবার শকুনি গৃধিনী জাকিয়ে বসবেনা তার নিরাপত্তা কোথায়? একদিন অনেক অশ্রুর বিনিময়ে এ দেশ ভাগ হয়েছিল। অনেক আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে এসেছিল পাকিস্তান। আজ থেকে ২৪ বছর পূর্বে আজান দিতে গিয়ে মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল “আল্লাহ পাকিস্তানকো হেফাজত কর।” কিন্তু মানুষের সে স্বপ্ন সফল হয়নি। সফল হয়নি বলেই আজ সংগ্রাম শুরু হয়েছে পাকিস্তানের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে।
আজ ফেলে আসা জীবনের সে কাহিনী তরুণ মনকে বিভ্রান্ত করে। ২৪ বছরের অভিজ্ঞতা শরণার্থীদের আতঙ্কিত করে। মনে হয় অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে নোতুন রাষ্ট্রের পত্তন হতে যাচ্ছে সে রাষ্ট্র কি আমার আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হতে পারবে! পারবে কি আমাকে দিতে নিরাপদ জীবনের প্রতিশ্রুতি। কারণ যে সমাজ ব্যবস্থা গত ২৪ বছর বাংলাদেশের মানুষের জীবনে দুর্বিসহ যাতনার সৃষ্টি করেছিল সে সমাজ ব্যবস্থার কি পরিবর্তন হচ্ছে। যে সমাজ ব্যবস্থার জন্য অর্থের আস্ফালন আর জন্মের গৌরব মানুষকে উচ্চপদ দিয়েছিল তার কি পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। যে সমাজ ব্যবস্থার জন্য স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতি গত ২৪ বছর মানুষকে ধ্বংসের শেষ পর্য্যায়ে নিয়ে গেছে সে সমাজ ব্যবস্থার কি নোতুন রাষ্ট্রে পরিবর্তন হবে। সেখানে কি একটি সাধারণ ঘরের তরুণ এবং খান সাহেব আর মন্ত্রীর পুত্রের এক মূল্যের বিচার হবে। সেখানে কি শেখ সৈয়দেরা বংশ কৌলিন্যে আবার কর্ত্তৃত্ব করবেনা!
যদি করে। যদি বংশের কৌলীন্য এবং আত্মীয়তাই নতুন রাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে তা’হলে আবার ধ্বনি উঠবে আমরা স্বাধীনতা চাই। তাই এবারের আন্দোলন ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান অর্জনের মত একটি রাষ্ট্রের পত্তনের আন্দোলন নয়। এবারের আন্দোলন এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা পত্তনের আন্দোলন যে সমাজ ব্যবস্থায় আজকের পাকিস্তানের অনাচার এবং অবিচার থাকবেনা। আজকের বাংলাদেশ গঠনের আন্দোলন, আজকের নতুন রাষ্ট্রের গঠনের সংগ্রাম তাই নতুন অনাচার আর অবিচার হতে মুক্তির আন্দোলন। তাই এ আন্দোলন শুধু একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের নয় বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি আন্দোলনও বটে। আর সেখানেই এ সংগ্রামের সাফল্য এবং পরিসমাপ্তি।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল