বিপ্লবী বাংলাদেশ
৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশ
—মনিরুল হাসান
(ভারতীয় প্রতিনিধি প্রেরিত)
পশ্চিমবঙ্গের সুপ্রসিদ্ধ সাপ্তাহিক ‘গণবার্তা’য় নিম্নের প্রবন্ধটি মুদ্রিত হয়। বাংলাদেশে পাক হানাদারদের বীভৎসতম কার্যকলাপ এতে বিধৃত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক, তথা, বিশ্বের প্রতিটি সভ্য নাগরিকের এটা জানা উচিত বলে এর পুনর্মুদ্রণ করা হলো।
—সম্পাদক, বিপ্লবী বাংলাদেশ
।। এক।।
বুড়িগঙ্গা কাঁপছে। বর্ষার পানি এসেছে বুড়িগঙ্গায়। ফুলে ফুলে ওঠে বুক। মনে হয় কান্নায় যেন ভেঙ্গে-ভেঙ্গে পড়ছে শতসহস্র ঢেউয়ের মালা। বুড়িগঙ্গার তীরে কারা যেন কাঁদে। কতকগুলি অশরীরী আত্মা যেন কাদের খুঁজছে। চৈত্র মাসের ক্ষীণ বুড়িগঙ্গার বুকে কারা যেন হারিয়ে গেছে। তাদের কেমন যেন একটি রক্ত-রক্ত মুখ ভেসে ওঠে। কারা যেন রাতের আঁধারে হাঁটে। মাঝে মাঝে একটা নিদারুণ শব্দে আঁতকে ওঠে চারিদিক। জিঞ্জিয়া, রুহিতপুর, সৈয়দপুরের বেঁচে যাওয়া শিশুগুলি আঁকড়ে জড়িয়ে ধরে মাকে।
তারপর একটায় পর একটা শব্দ। শব্দ মালা হয়। ছড়িয়ে যায় চারিদিকে। চীৎকার করে শিশুরা। কাঁপে মাটি। তবুও শংকিত মাতা একটুখানি আশা দেয়—ওরে ভয় নেই, মুক্তিফৌজের সাথে যুদ্ধ লেগেছে।
০০০
শব্দ, বীভৎস চীৎকার, কাঁপা কাঁপা বুক। অজস্র মূক মুখ। মৌন মানুষের মিছিল। আজকের ঢাকা।
রাজধানী ঢাকায় আজকেও মানুষ আছে : মুখ নেই, কে যেন মানুষের মুখগুলি বন্ধ করে দিয়ে গেছে। কেউ অন্যকে আজ আর শুধায় না কুশল বার্তা। বেলা দুটোয় অফিস ছুটি হয়ে গেলে একটা নিস্তব্ধ, নীরব, মৌন মিছিল কোথায় যেন হারিয়ে যায়। কেমন যেন রাজকন্যার দৈত্যপুরীর মতো জগৎ মানুষকে চেপে বসে। কেউ নেই। কারা যেন ছিল, কারা নেই। তোপখানা রোড, বিশ্ববিদ্যালয় আজিমপুর, ধানমন্ডি, বাসাবো, খিলগাঁও, মতিঝিল-এর দালানগুলো নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে প্রহরীর মতো! প্রখর রৌদ্রের দুপুরে নামে সন্ধ্যার স্তব্ধতা। আর পুরনো ঢাকা! একটা ভয় আর ভয়। শাঁখারী বাজার মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। নতুন মানুষ এসেছে। নতুন বসতি বসছে। নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে—তাঁতীবাজারে, ফরাসগঞ্জে। আর কতগুলো দীর্ঘনিঃশ্বাস ঘুরে বেড়াচ্ছে তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, ফরাসগঞ্জ, সুতাপুর আর গ্যান্ডারিয়ায়। ঐ দীর্ঘশ্বাসগুলো যেন পাহারা দিচ্ছে অশরীরী আত্মার মতো।
ভোরের রোদের খানিকটা রেশ পড়েছে নবাবপুর রোডে। বেলা বেড়ে যাবার সাথে সাথে ভিড় বাড়ছে। সে এক নিঃশব্দ আর শব্দের জাদু। নিঃশব্দ মৌন মানুষের কাফেলা যেন সমস্ত আকাশে ছড়িয়ে দিয়েছে নিজের অস্তিত্ব।
ঠারিয়ে—হঠাৎ একটা তীব্র কর্কশ কন্ঠস্বর যেন নবাবপুর রাস্তার নিস্তব্ধতাকে ভেঙে চুরমার করে দিল। মানুষগুলো হকচকিয়ে গেল। তখন রেল ক্রসিংয়ের কাছে সামরিক বাহিনীর মানুষগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। ওরা ছেঁকে ধরলো নবাবপুরের মানুষগুলোকে। তুলে নিয়ে গেল অনেককে। তারপর যেন শূন্য হয়ে গেল নবাবের আমলের রাস্তাটা। এমনি করে আজকাল পরশু শূন্য হয় জিন্নাহ্ অ্যাভিনিউ, মতিঝিল, নিউ মার্কেট এলাকা। একটা কর্কশ কন্ঠ ছড়িয়ে পড়ে এই নিদারুণ নিস্তব্ধতাকে খান খান করে ভেঙে দিয়ে—‘ঠহরিয়ে’। ওরা মানুষগুলিকে তুলে নেয়। কোথায় নিয়ে যায় মানুষগুলোকে?
বৃদ্ধা বুড়িগঙ্গা কাঁদে। বুক ফুলে ফুলে ওঠে। বুড়িগঙ্গা কাঁদে : ভাসে কতগুলো মানুষের লাস। মুখবাঁধা লাস। রাজধানী ঢাকার মানুষগুলো কোথায় যায়? বুড়িগঙ্গা কি বলতে পারে?
০০০
রাতের স্তব্ধতা ভেঙে কারা যেন কাঁদে। একটা মর্মান্তিক কান্না। কারা যেন আকুলি বিকুলি করে অনুনয় বিনয় করে। তারপর স্তব্ধ হয় সেন্ট্রাল রোড, হাতীর পুল, রায়ের বাজার, ধানমন্ডি।
সেন্ট্রাল রোডের সে ভদ্রলোক নিষ্ফল আক্রোশে গর্জন করেন। চীৎকার করে একটি নারীকন্ঠ। সারাদিন কাঁদে। নীরবেতাকিয়ে থাকে একমাত্র শিশুকন্যা। ভোর কেটে দুপুর আসে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। বাড়িটা যেন আসন্ন মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করে। শিশুকন্যাটি যেন হিম হয়ে আসে। রাস্তার মোড়ের দোকানের ছোকরাও অপেক্ষা করে। সেও জানে। পাড়া পড়শী জানে। জানে সবাই। সন্ধ্যার পরে একটি সামরিক বাহিনীর জীপ আসবে। আসবে কজন জাঁদরেল গোছের লোক। তারা ঐ শিশু-কন্যাটির মা-মণিকে নিয়ে যাবে। ফিরিয়ে দেবে শেষরাতের দিকে। শিশু-কন্যাটি কাঁদে না আর। সারা রাত পায়চারি করে ওর আব্বা। কথা বলে না। কখন যেন আবার সকালে ঘুমিয়ে পড়ে। আর রাতের শেষে হঠাৎ একটা গাড়ি গর্জন করে। শব্দ হয় জুতোর।
মাকে জড়িয়ে ধরে ধরে চীৎকার শিশুকন্যা—আম্মি, চল বাড়ি যাই।
বাড়ি যাবার পথ নেই ওদের। ঠিকানা নিয়ে ঠিক হাজির হবে ঐ নরপশুর দল। নয়ত গর্জে উঠবে রাইফেল।
০০০
জানে সকলে। জানে পাড়া-পড়শী। ওদের ঢাকা ছেড়ে যাবার পথ নেই। জানে সেন্ট্রাল রোডের সারিসারি শূন্য দালানগুলো। পথের মোড়ের তরুণ দোকানী। এমনি করে, রাতের আঁধার আসে হাতীর পুলে। হাতীর পুলের সে মহিলা কি বাড়ি ফিরে গেছে? বাড়ি ফিরেছে তার স্বামী?
এক অন্ধকার রাতে ওরা চলেছিল রাজধানী ছেড়ে। ওদিকে আহারের সন্ধানে এসেছিল নরপশুগুলি। সামনের দরজা দিয়ে বের হতো। বাধা পেল তারা। ‘কিধার যায়েগা’—একসাথে গর্জন করে উঠলো কতকগুলি হিংস্র নেকড়ে বাঘ! নিথর হলো রমণী। নিস্পন্দ হলো তার স্বামী।
তারপর এক পৈশাচিক উল্লাসে রমণীকে নিয়ে ঢুকে গেল নরপশুরা ভিতর বাড়িতে। একটু অনুনয়। একটু আকুলি-বিকুলি। একটা আর্ত্ত চীৎকার ভেঙে ভেঙে খান-খান হলো। সারাটা এলাকা চমকে উঠলো।
ভোরের আলোয় নিঃসহায় স্বামী ছুটেছিল ডাক্তারের কাছে। তারপর তাদের খোঁজ পায়নি কেউ। একটা বড় তালা ঝুলছে বাড়িতে।
আর তেজগাঁওয়ের রিকশাওয়ালা আবদুর রউফ? সে কি বাড়িতে ফিরতে পেরেছে? সেই যে তেজগাঁওয়ে সী অ্যান্ড বী ওয়ার্কশপের কাছে স্ত্রী নিয়ে থাকত? তার স্ত্রী-ও কি ফিরেছে? তেজগাঁও সী অ্যান্ড বী কারখানার কাছে তখন রোদ উঠেছে মাথার ওপরে। (চলবে)
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল