বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৮ নভেম্বর ১৯৭১
বাংলার সংগ্রামী আলেক্ষ্য
পথ চলে যেতে হবে
—বিপ্লব পথচারী
আবার পথ চলছি। কোথায় কতদূরে যেতে হবে জানিনা। জানার আজ আর কোন প্রয়োজনও নেই। ঘর ছাড়া পথিকের আবার পথ চলতে ক্লান্তি থাকবে কেন? একদিন ছিল যেদিন ঘরে ফেরার তাড়া ছিল কিন্তু আজ আর কোন আকর্ষণই অবশিষ্ট নেই। স্নেহ মমতাহীন পথচারী মুক্তি সেনাদের জীবনে কোন বন্ধনই থাকতে পারে না। সুদূর প্রসারী বাংলাদেশ আজ আমাদের মুক্ত বিচরণ ক্ষেত্র আর পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনই সকলের একমাত্র লক্ষ্য। পাক কাঠামোর লৌহ জিঞ্জির ভেঙ্গে চুরে নূতন দেশ নবারুণের ন্যায় আশার আলো নিয়ে ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করছে। মারণাস্ত্র হাতে নিয়ে আমরা উল্কার মত ছুটে চলছি বাংলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে শত্রু ছাউনি ধ্বংস করার মহান ব্রত নিয়ে। আজ একদিনের জন্য নিশিন্দা নদীর দক্ষিণ দিকের বড় জঙ্গলটার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছি। আমাদের দলে আছে ইউসুফ, রশীদ, মিন্টু, খলিল, আতাহার, দীপক, প্রদীপ আর জাহানারা ও মমতা। বাউফলের হানাদার ছাউনি আমরা আক্রমণ করবো। পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন নিজাম খাঁ এখানে রাজাকার ও বদর বাহিনীর কুত্তাদের ট্রেনিং দিচ্ছে। আজকেরই ট্রেনার সহ সব কটা দেশী বিদেশী শয়তানকে খতম করতে হবে। আমার হাতে রয়েছে হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হাল্কা মেশীনগান—সৈনিক জীবনের সব চেয়ে বিশ্বস্ত সাথী। মেশীনগানের ট্রিগার যখন কঠিন হাতে চেপে ধরি আর অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় একের পর এক গুলি গুলো বেরিয়ে শত্রু সৈন্য খতম করে তখন আমার মন আনন্দে ভরে ওঠে। আজ কেউ কল্পনাও করতে পারে না, কোন একদিন মোরগ জবাইর রক্ত দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। শত্রু সৈন্যের রক্তে হাত যখন রাঙা হয়ে ওঠে আমি তখন পরম তৃপ্তি লাভ করি। পনেরো লক্ষ মা বাবা আর ভাইদের রক্তের ঋণ আমাদের শোধ করতেই হবে।
বাউফলের কাছে দাস-পাড়া গ্রামের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী লাটু বাবুর বাড়ী হয়েছে হানাদারদের প্রধান আস্তানা। পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন নাদির খাঁ এই ছাউনির সর্বময় কর্তা। দুষ্টগ্রহের ন্যায় হানাদার ছাউনির পার্শ্ববর্তী দশ-বারোটা গ্রামে পড়েছে অশুভের কালো ছায়া। জন মানবহীন গ্রামগুলো শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে। চাষী ভাইদের গায়ের রক্ত জল করা শ্রম দিয়ে ফলানো ফসল পশুরা পুড়িয়ে দিয়েছে। সর্বহারা কৃষকের সোনালী ধানের স্বপ্ন হয়তো স্বাধীন বাংলা একদিন সফল করতে পারবে। যে সব নরপশুরা বাংলার লাখ লাখ সুখের ঘর ভেঙ্গে দিয়েছে তাদের আমরা খতম করবোই। সহ যোদ্ধা কামালের রক্ত হাতে নিয়ে যে শপথ নিয়েছি তার অমর্যাদা আমরা করবো না। যারা বাংলার শতকরা ৯৫ জন মানুষকে মেশীনে রস নিঙড়ানো আখের ছোবার ন্যায় শোষণ করছে তাদের আমরা ক্ষমা করবো না; কোনদিন কোন আপোস আর তাদের সাথে হতেই পারেনা। বাংলার পুরো স্বাধীনতা ছাড়া এসব বঞ্চিত মানুষগুলোর মুক্তি নেই। তাহের চাচা দুঃখ করে বলেছিলেন—বাজান, কেমন কইরা যে বাইচ্যা আছি নিজেও জানিনা। হারগুলান খালি চামরায় ঢাকা আছে। কাইড্যা দ্যাখ মোডেও রক্ত বাইরাইবে না। এ কথা শুধু তাহের চাচার একার কথা নয়, বাংলার প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্তরের অব্যক্ত কথা। চব্বিশ বছরের শোষণে বাংলাদেশের শ্যামলিমা আজ ধুয়ে মুছে গেছে। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল হানাদার পশুরা আটমাসের বর্বর অত্যাচারে তাও শেষ করে দিয়েছে। তাহের চাচার ন্যায় জীবন্ত কঙ্কালরাও একদিন জেগে ওঠে—স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার মহান মন্ত্রে উদ্বেলিত হয় সেদিন কিন্তু কোন বাঁধাই আর তাদের গতি রুদ্ধ করতে পারে না—কারণ হারাবার তো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। শয়তান নাদির খাঁ গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে মানুষ খুন করছে আর পছন্দ মত মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে ছাউনিতে। দালাল পদু গাজীও শয়তানের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। ওর মেয়ে হালিমাকেও কাল ছাউনিতে ধরে নিয়েছে। দালালটা রাজী হয়েছে, ছাউনির গোপন খবর আমাদের দেবে।
দুপুর বেলা বৃদ্ধা দত্ত মাসী আমাদের খাবার নিয়ে এলেন। হিজল গাছটার নীচে খাবার রেখে তিনি অপেক্ষা করছেন। আমাদের আসতে দেখে আনন্দে তার চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে। হতভাগ্য মাসীটা সবাইকে হারিয়েছে। দু-ছেলে আর তিনটা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আজ আমরাই ওর সব। বাংলার ঘরে ঘরে পুত্র হারা মা, স্বামী হারা স্ত্রী, মাতৃ পিতৃ হীন শিশুদের করুণ আর্তনাদ সকলকে বেদনার্ত করে তোলে। সব কিছু হারিয়েও স্বাধীন বাংলার আশা নিয়ে ওরা বেঁচে আছে। যে স্বাধীন দেশে থাকবে না বিদেশী লুটেরা বাহিনী, শোনা যাবে না ধর্ষিতা নারীর আর্তনাদ, হবে না নদীর জল মানুষের রক্তে রাঙা। দত্ত মাসীকে দেখে গোর্কির পাভেলের মায়ের কথা মনে পড়ে যায়—বাবারা খবর আছে। মেলেটারির পালের গোদাডা, ব্যাডা খাঁয়ের পো আইজ বিকালে বিলের দিগে যাইবে। পদু গাজী এই খবরডা তোগো দেতে কইছে। মাসীর এ খবর সকলকে খুশী করেছে। উম্মুখ হয়ে আমরা ঘনঘন সূর্যের দিকে তাকাচ্ছি, কখন পশ্চিমে হেলে পড়বে! বিদায়ী সূর্য রক্তিম আভা নিয়ে পশ্চিমে মিশে যাচ্ছে। শোঁ শোঁ শব্দে দমকা হাওয়া জঙ্গলের গাছ পালাগুলোকে আন্দোলিত করে বয়ে যাচ্ছে। কুল কুল রবে কেঁদে কেঁদে বয়ে চলেছে নিশিন্দা। এক সময় সকলের চমক ভেঙ্গে যায়। পটল ডাঙ্গার বিলের দিকে কয়েকটা শয়তানের ছায়া মূর্তি ভেসে ওঠে। ঝাউ গাছটার নীচে শঙ্কর আর জামাল পজিসন নিয়ে আছে। প্রবল উত্তেজনায় প্রতিটি মুহূর্ত গুণে চলছি, অল্পক্ষণের মধ্যেই তীক্ষ্ম স্বরে নেতার নির্দেশ ভেসে আসে—ফা—য়া—র। খটাখট্, খটাখট্, খটাখট্ শব্দে ঝাউগাছের নীচ থেকে মেশীনগান গর্জন করে ওঠে। অব্যর্থ লক্ষ সব কটি শয়তানকেই খতম করেছে। পরবর্তী নির্দেশেই আমাদের আগ্নেয়াস্ত্রগুলোও গর্জন করে উঠলো। ছাউনি থেকে অসংখ্য হানাদার কুত্তা বেরিয়ে পড়েছে কিন্তু কোন নিশানাই করতে পারছেনা। পশ্চিম দিক দিয়ে শিশিরদা তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন রাজাকার ছাউনির উপর। ঘনঘন মর্টার শেলিং আর গ্রেনেডের শব্দে পশ্চিমের আকাশ বাতাস মুখরিত। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, ঘন অন্ধকার ক্রমে ক্রমে সমস্ত অঞ্চলটাকে একটা কালো চাদরে যেন ঢেকে দিয়েছে। বিভিন্ন পথ দিয়ে একে একে সকলে ফিরে চলছি আস্তানার দিকে।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল