You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.28 | মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরী —অধ্যাপক ছালাউদ্দিন আহমেদ | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৮ নভেম্বর ১৯৭১

মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরী
—অধ্যাপক ছালাউদ্দিন আহমেদ

(দে ভাটা থেকে, ২০—নভেম্বর ১৯৭১)
অবশেষে দে-ভাটা থানার পারুলীয়াও আমরা মুক্ত করলাম। দীর্ঘ বারো ঘন্টা যুদ্ধের পর দখলদার পাক সৈন্যরা পিছু হটে সাতক্ষিরায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এখন সাতক্ষিরা দখল নিয়ে প্রচন্ড লড়াই চলছে। দু’দিক থেকেই প্রচুর গোলাবর্ষণ হচ্ছে। আমাদের মারের মুখে টিকতে না পেরে খানসেনারা পশ্চাদপসরণ করছে। আমাদের অপরাজেয় বাহিনী এগিয়ে চলছে বন্যার স্রোতের মত। সাতক্ষিরাও দু’ একদিনের মধ্যে আমাদের দখলে এসে যাবে।
আমি পারুলীয়া ডিফেন্সের এক সদা সতর্ক সৈনিক। আমার স্থান পারুলীয়া ব্রীজের ডান পাশের বাঙ্কার। খান সেনাদের বড় সাধের বাঙ্কার এখন আমাদের দখলে। দূর থেকে শেলিং এর প্রচন্ড শব্দে দেহের প্রতিটি অনু পরমানুতে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। রক্তে যেন বাণ ডাকছে। অনেক রক্ত ঝরিয়েছে বাংলার বুকে বর্বর পশু সৈন্যরা। আজ তার প্রতিশোধের পালা। প্রস্তুত হও রক্ত লোলুপ বর্বর বাহিনী। হিসাব দেবার সময় হয়েছে। কোথায় পালাবে?
আবার মনে পড়ে যায় পশ্চিমা সৈন্যের বর্বরোচিত পৈশাচিকতার এক করুণ ছবি। ভুলতে পারিনা কিছুতেই সে দৃশ্য, সে যে ভুলবার নয়, কেমন করে ভুলব গ্রামের সেই সহজ সরল মানুষটিকে। সে যে তথাকথিত দুষ্কৃতিকারী কিংবা অনুপ্রবেশকারীও নয়। একটি মানুষ। অতি সাধারণ ঘরের মানুষ।
কি অপরাধ করেছিল সেই মানুষটি এ প্রশ্ন জঙ্গী ইয়াহিয়ার কাছে নয়, প্রশ্নের জবাব চাই বিশ্বের কাছে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করে রাজনৈতিক সমাধানের নামে বাংলার মানুষের উপর শাসনের নামে শোষণের জাতাকলটা ঘুরাতে চায়?
চোখের সামনে এখনো ভাসছে সেই করুণ দৃশ্যটা। ঐ যে অদূরে সেই স্থানটা। আমার বাঙ্কার থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে স্থানটা। তালগাছটা নীরব সাক্ষী হয়ে আজো ডুকরে ডুকরে কাঁদছে যেন। বর্বর পাক সৈন্যরা পিঠের উপর বেয়নট ধরে চোখ বেধে মানুষটিকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষটি এখনো জানেনা ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।
অবশেষে জানল আর জেনেই মানুষটি চীৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। শান্ত মানুষটি লুটিয়ে পড়ল সৈন্যদের পায়ের উপর। প্রতিদানে পেল মুখের উপর বুটের লাথি। এরপর দেখলাম মানুষটির বৃদ্ধ মাতা-পিতা ছুটে এলেন কাঁদতে কাঁদতে, খানসেনার পা’ ধরে অনেক মিনতি জানালেন ছেলের প্রাণভিক্ষার জন্য।
কিন্তু খানসেনারা সমস্ত মায়া-মমতার ঊর্ধ্বে, ওরা হিংস্র পশু অতএব প্রাণভিক্ষা তো দূরের কথা বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভাগ্যেও জুটল বুটের লাথি। মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন অশতিপর বৃদ্ধ মানুষ দুটি তারপর পিতা-মাতার চোখের সামনেই ছেলেকে ফেলে দেওয়া হল কবরের মধ্যে। জীবন্ত মানুষটিতে এবার মাটি চাপা দেওয়া হল। এই বিভৎস দৃশ্য দেখে পিতা-মাতা জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন ছেলের কবরের উপর আর খানসেনারা অট্টহাসিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তুলল। কিন্তু অলক্ষ্যের সেই মহাপুরুষ বুঝিবা বিদ্রুপের হাসি হাসলেন। আজকের এই মুক্তি যুদ্ধ এই বিভৎস হত্যাকান্ডের কৈফিয়তের জন্য। আজকের এই মুক্তিযুদ্ধ প্রতিশোধ নেবার জন্য আর এই যে মা-বাবা, ভাই-বোন ছেড়ে প্রতিবাদের রণাঙ্গণে যুদ্ধ করে চলছি। তাও বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল