বিপ্লবী বাংলাদেশ
২১ নভেম্বর ১৯৭১
বিশ্বের চোখে বাংলাদেশ
(বিশেষ প্রতিনিধি)
১৯৬৮ সালে পৃথিবীর দুই দেশে আগুন জ্বলে উঠেছিল সাধারণ মানুষের মুক্তির দাবীতে। দুইস্থানেই ছাত্ররা এসেছিল এগিয়ে, প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে তারা শ্রমিক কৃষক সাধারণ মানুষকে টেনে এগিয়ে নিয়ে এসেছিল। সেই দুটি দেশ ফ্রান্স ও পাকিস্তান। এবং যাদের মনে হয়েছিল অনড়, অচল সেই দ্য গল ও আয়ুব খান সেদিন সরে গিয়েছিল ভয়ে।
০০০
১৯৬৮’র আন্দোলনে ফল হয়নি বিশেষ। তার জন্য দায়ী নয় সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ তো সেদিন এগিয়ে এসেছিল পুরোদমে। ভয় পেয়েছিল বিশ্বশক্তি। ভয় পেয়েছিল নেতারা। তাই দশদিন উদ্বেল হবার পর প্যারিস শান্ত হল। আর এদিকে আয়ুব গেলেন, এলো ইয়াহিয়া।
০০০
আজ ১৯৬৮’র বিফল আন্দোলন রূপ নিয়েছে জাতীয় বিপ্লবে। এবং ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ এই বিপ্লবকে জানিয়েছে বিপুল সম্বর্ধনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী বলেছেন ফ্রান্সের মতো আর কোন দেশ বোধয় বাংলাদেশ সমস্যাকে এত সঠিক ভাবে বোঝেনি। ফ্রান্সের কাছে, ১৯৬৮’র কাছে বা তার পূর্বের প্রতিটি আন্দোলনের কাছে আমাদের অনেক শিক্ষার আছে। ছাত্রদের দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধে অসীম। তাদের ভূমিকা সম্বন্ধে অনেক কিছু চিন্তনীয় আছে। এই শিক্ষা হৃদয়ঙ্গম করতে হবে আজিই, আর দেরী করা চলবে না।
০০০
সম্প্রতি বাংলার কয়েকজন ছাত্রনেতা আঃ শঃ মঃ আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, নুরুল আলম সিদ্দিকী, নুরুল ইসলাম ইত্যাদিরা ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে ব্রতী হতে আহ্বান জানিয়েছেন।
আজ ঐক্যের প্রয়োজন আছে। আসুন আজ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছোটখাটো ক্রটি ভুলে তাদের চরম উদ্দেশ্যের সাফল্যবিচার করা যাক। আওয়ামী লীগের এক তরুণ নেতা বলেছিলেন কিছু দিন আগে আওয়ামী লীগের জন্ম সম্পর্কে। বাংলাদেশ জনতার মুক্তির প্রবল ইচ্ছারই রূপ যেন আওয়ামী লীগ। ১৯৪৭ এ এই পার্টি ছিলনা। যখন কংগ্রেস ও বামপন্থীরা সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মেনে নিয়েছিলেন বঙ্গ-ভঙ্গ তখন আওয়ামী লীগ ছিল না। ১৯৪৭ এর ভুল ক্রমশঃ অনুভূত হতে লাগল—আওয়ামী লীগ গড়ে উঠল বিভিন্ন ধরনের মানুষ নিয়ে। কেউ ইসলামে বিশ্বাসী ছিলেন, পাকিস্তান দেখে হলেন হতাশ; কেউ ছিলেন মুসলীম লীগে মনে করলেন লীগের কাজ ফুরিয়েছে। আর এলেন বহু তরুণ তরুণী যাঁরা কোনদিন বঙ্গ-ভঙ্গের জন্য কোন উৎসাহ অনুভব করেন নি।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বিভাগের পর ওয়ালী-মোজাফফর গোষ্ঠী সোভিয়েত রাশিয়া ও ভারতকে মিত্র স্বীকার করে এগিয়েছিল। অন্যান্য কয়েকটি গোষ্ঠী শ্রেণীসংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে বাংলার চরম দুর্গতিমোচনই প্রধান লক্ষ্য মনে করেছিল—মহাচীনকে বন্ধুরূপে স্বীকার করে। ৭০ এর ঘূর্ণিঝরে ও ৭১ এর সংগ্রাম কোথায় কি ভেসে গেছে ঠিক নেই। আজ ভারত ও সোভিয়েত কিছু সাহায্য দিতে প্রস্তুত। মহাচীনের আশ্রিত উত্তর ভিয়েতনামের মত সংগ্রামী দেশ আমাদের সহানুভূতি জানিয়েছে। আজ এমনকি আমেরিকাও তার অনুচর পশ্চিম জার্মান বন সরকারকে দিয়ে বাংলাদেশে আশু মীমাংসা চাই বলাচ্ছে। কিন্তু প্রথম কথা, বিশ্ব শক্তিতে আমরা দেখেছি : দেখেছি চীনে, কোরিয়ায়, যুগোশ্লাভিয়ায়, গ্রীসে, ফ্রান্সে, কিউবায় ও স্পেনে। যখন সাধারণ মানুষ এগিয়ে চলে তখনই রুশ, চীন ও আমেরিকা সাহায্য করে। তারা দুর্বল হলে বলে রাজনৈতিক মীমাংসা চাই। আজ যদি আমরা সব বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াই—শুধু বিশ্বশক্তি নয়, সব দেশেরই এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষেরও সাহায্য আমরা পাব। আজ সে পথে কোনো বাধা, কোন দ্বিধার কারণ নেই—সকলেই জানে, সকলেই মানে বাংলাদেশ আজ সমাজতন্ত্রের পথে চলছে। মন্ত্রীসভা তা বারে বারে বলেছেন। একশো বিঘার অধিক জমি সরকারী সম্পত্তি হওয়া উচিত বলে ন্যাপ অনেক আগেই এক শুভসিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আসুন নিজেদের দলীয় স্বার্থ ত্যাগ করে আজ দেশের এই সংকটের মুহূর্তের আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নেমে পড়ি।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল