বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৪ নভেম্বর ১৯৭১
সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে
দেশে দেশে সশস্ত্র মুক্তির সংগ্রাম
—অধ্যাপিকা রেহানা বেগম
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ফিদেল কাস্ত্রোর ১৫ বছর জেল হ’ল। জেলে কাস্ত্রো অন্যান্য রাজবন্দীদের জন্য স্কুল তৈরী করে ইতিহাস, দর্শনের উপর আলোচনা শুরু করলেন এবং নিজেও পড়াশোনা শুরু করলেন।
এদিকে বাতিস্তা সরকার কিউবায় ক্রমশঃই অপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগল। অত্যাচার সত্ত্বেও মানুষ মিছিল সভা, হরতাল করতে লাগল। কাস্ত্রোর মুক্তির দাবীতে জনগণের সভা সোচ্চার হয়ে উঠল। ১৯৫৪’র ১লা নভেম্বর পুনরায় নির্বাচনের দিন ঘোষণা করা হল। গদী রাখার জন্য বাতিস্তাও ব্যাকুল হয়ে উঠল। লোকের চাপে এবং ক্ষমতা রক্ষার জন্য বাতিস্তাও অবশেষে রাজবন্দীদের মুক্তি দেবে বলে ঘোষণা করতে বাধ্য হল। রাজবন্দীরা মুক্তির আনন্দে উদ্ভাসিত হলেন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করলেন বিনাসর্তে এবং সসম্মানে তাঁদের মুক্তি দিতে হবে। ১৯৫৫’র ১৫ই মে কাস্ত্রো ও তাঁর সাথীরা ছাড়া পেলেন। কিউবার মানুষ সেদিন জেল গেটে, ভেঙ্গে পড়েছে। ধ্বনি মুখরিত হয়ে সারা পথ ট্রেনে কাস্ত্রো গেছেন। সাংবাদিক, ফোটোগ্রাফার সবারই ভিড়। মানুষ তাদের রূপকথার নায়ক কাস্ত্রোকে এই প্রথম চোখে দেখল। এতটা বাতিস্তাকে আতঙ্কিত করে তুলল।
১৯৫৫’র জুলাইতে কাস্ত্রো সশস্ত্র সংগ্রাম করে মেক্সিকো দখলের জন্য তৈরী হতে লাগলেন। সভা করে, মানুষের বাড়ী বাড়ী গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করলেন। কিউবার মানুষও সাড়া দিল। তারা চাইছিল তাদের সামাজিক রাজনৈতিক জীবনের এক আমুল পরিবর্তন। কাজ করার ক্ষমতা আছে, অথচ কাজের অভাবে স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে অনাহারে দিন কাটানোর অসহ্য যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি দিতে পারে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করতে চাইছিল তারা। তাই কাস্ত্রো তাদের মনে সাড়া জাগালেন। কাস্ত্রো তাঁর দলবলকে গেরিলা পদ্ধতিতে শিক্ষা দিতে শুরু করলেন। তাঁর দল অল্প দিনের মধ্যেই পিস্তল, রাইফেল, মেসিন গান চালাতে, বোমা তৈরী করতে ও ছুঁড়তে শিখল। ট্যাঙ্ক ধ্বংস করা, বিমানকে নামিয়ে আনা, আহতকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া, হামাগুড়ি দিয়ে পালান, দৌড়ান, পাহাড়ে, জঙ্গলে অনায়াসে বিচরণ করা, নিজেকে গোপন রেখে শত্রুকে খুঁজে বের করা ইত্যাদি ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সর্ব কৌশলই শিখতে লাগলো। দিনে ১০/১৫ ঘন্টা করে ক্লাশ হতো। শিক্ষা শেষ হলে এদের বিভিন্ন দলে ভাগ করা হল। শিক্ষক ছিলেন কর্ণেল বেয়ো। আর সবচেয়ে সেরা ছাত্র ছিলেন ডাক্তারী পড়া ছাত্র চে-গুয়েভারা। কাস্ত্রো এক গাড়ী ভর্ত্তি অস্ত্র সহ মেক্সিকোর পথে একদিন ধরা পড়েন এবং ২৩ দিন জেল খাটেন। তারপর শুরু হয় তাঁদের মেক্সিকো দখলের অভিযান। নানান দুর্গম পথ পাহাড় জঙ্গল অতিক্রম করেন—না ছিল তাঁদের সব-রকম অস্ত্রশস্ত্র, না ছিল খাওয়া দাওয়া। অনেকে মারা যান, অনেকে ধরা পড়েন—তবুও ফিদেল তাঁর বিশ্বাসে অবিচল “বিপ্লব আমরা করবই, স্বৈরতন্ত্রের দিন শেষ হয়ে আসছে।” শেষ পর্য্যন্ত তাঁদের সংখ্যা কমতে কমতে ১২ জন এসে পৌঁছয়। Rodriguez বলেছেন “ ফিদেল পাগল। আমি অবাক হয়ে ওকে দেখতাম—আমাদের কত লোককে আমরা হারিয়েছি, তবুও কি আস্থার সঙ্গে ও বলতে স্বৈরাচারীর দিন ফুরিয়ে এসেছে।” ফিদেলের একমাত্র পাগলামী ছিল—“স্বাধীন কিউবা।”
শেষ পর্যন্ত ১২ জন লোক; প্রত্যেকের সঙ্গে ১টা রাইফেল আর ১০টা কার্তুজ সম্বল করে একটা পাহাড়ের মাথায় আশ্রয় নিল। শত্রু তাদের ৩০,০০০ জন সমস্ত রকম আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। আর আছে আমেরিকার লক্ষ লক্ষ ডলার। এ লড়াইয়ে জয়লাভ প্রায় অসম্ভব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাতিস্তাকে পালাতে হল।
বাতিস্তার সামরিক বাহিনী এদের কাছে আত্মসমর্পণ করল ঠিক ২ বছর পরে ১৯৫৯তে। এই দু বছর ওরা ছিল পাহাড়েই। জয় লাভের কারণ ১২ জন নয়; দেশের লাখো জনতা ছিল এদের দিকে। যত দিন গেছে তত লোক এদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে এদের সঙ্গে শিক্ষিত লোক তো ছিলই, তাছাড়া ছিল বিরাট সংখ্যক কৃষক জনতা।
কৃষকরা কিন্তু প্রথমে মোটেই বিপ্লবী ছিলনা, তারা শুধু বিপ্লবীদের লুকিয়ে রাখত; কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই তারা বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগ দিল। এই দ্রুত পরিবর্তনের কতগুলো কারণ ছিল :- সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এই বিপ্লবী সেনাবাহিনীর চরিত্র ও ব্যবহার। চাষীরা দেখল সৈন্য বলতে তাদের যে ধারণা ছিল এরা একেবারে তার থেকে আলাদা। এদের ব্যবহার খুব বন্ধুত্বপূর্ণ এবং এরা খুব বিবেচক; একেবারেই উদ্ধত এবং নিষ্ঠুর নয়।
এরা লুট করেনা এবং মেয়েদের ধর্ষণ করেনা। বরঞ্চ তারা যা কিছু নেয় তার ন্যায্য দাম দেয়, কেউ নারী ধর্ষণ করলে তার শাস্তি হয় মৃত্যু।
এরা চাষীদের শ্রদ্ধা করে এবং সাহায্য করে। এরা তাদের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কিছু দেয়। যেমন হাসপাতাল, স্কুল—যা নাকি এরা চোখেও দেখেনি।
দলের নেতা ফিদেল কাস্ত্রো তাদের সঙ্গে থাকেন, খান, তাদের বিপ্লবী সম্ভাবনা, কাজকর্ম সম্বন্ধে বোঝান—এ একেবারে অন্য চরিত্র।
ফলে যে চাষীরা ছিল দর্শক, তারাই হয় এই বিপ্লবী বাহিনীর মেরুদন্ড। তারা অনেকে বাহিনীতে যোগ দেয় এবং খাবার অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই করে গাড়ী পাহাড়ের উপরে তারাই নিয়ে যায়।
একই ভাবে এসে যোগ দেয় শ্রমিক শ্রেণী, দেশের বুদ্ধিজীবি, এককথায় মুষ্টিমেয় কিছু মার্কিন তাঁবেদার ছাড়া দেশের সব মানুষ। তাই ফিদেলের জয় সম্ভব হয়। কিউবার বিপ্লব জয়যুক্ত হল। ১৯৫৯’র ১লা জানুয়ারী বিপ্লবী সরকার কিউবার কার্য্যভার গ্রহণ করল। ক্ষমতা দখলের কার্য শেষ হল, শুরু হল দেশ গঠনের কাজ। (চলবে)
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল