বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৪ নভেম্বর ১৯৭১
‘মেহনত হমারী, বাকী উনকা’
—মৌলানা খাফী খান
সাজানো বাগান শুকিয়ে যাবার সন্তাপে জল্লাদ ইয়াহিয়া নানাবিধ প্রলাপ-উক্তি করে থাকে। খেদের আধিক্যে কখনও কখনও ঐ স্বভাব-মিথ্যাবাদীর মুখ থেকে এমন কথা বেরিয়ে পড়ে যার মধ্যে সত্যের প্রকাশ দেখা যায়।
এমনি একটি উক্তি : “আমার শুধু আশা যে এই স্ত্রীলোকটি (‘অর্থাৎ ভারতের প্রধানমন্ত্রী’) উপলব্ধি করে যে বাঙলাদেশের স্বাধীনতার অর্থ শুধু পাকিস্তানেরই ধ্বংস নয়, ভারত ইউনিয়নের ধ্বংসেরও সূত্রপাত।”
বাংলাদেশের সোজা বাংলায় এর অর্থ : পাকিস্তান টিঁকে আছে শুধু বাঙালীর পরাধীনতার ভিত্তির উপর। বাংলা যদি স্বাধীন হয়, তবে পাকিস্তান লুপ্ত হবে।
অবশ্যই। তবে লুপ্ত হবে পাকিস্তান নয়, অপসৃত হবে সেই পাকিস্তান যার বুকের উপর চেপে বসে আছে ধনিক-ভূস্বামী-সমর নেতার শাসন। একদিন জার শাসিত রুশ বোখারা, সমরকন্দের বুকের উপর চেপে বসে বেঁচে ছিল। আজ বোখারা সমরকন্দ রুশ সাম্রাজ্যবাদের হস্তচ্যুত হয়েছে বলে রুশ দেশ লোপ পায়নি, লুপ্ত হয়েছে রুশের জারতন্ত্র; রুশের জনসাধারণ বহুগুণে সমৃদ্ধ ও উন্নত হয়েছে। বাঙলাদেশে স্বাধীনতা সুপ্রতিষ্ঠিত হলে যদি পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণ তাদের ধনিক-ভূস্বামী-সমর নেতাদের শাসনের অবসান ঘটিয়ে সেখানে প্রগতিমুখী রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রবর্তন করে, তবে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের অবস্থাও সমৃদ্ধ এবং উন্নত হবে—বর্ত্তমানের তুলনায় বহুগুণে।
ইয়াহিয়ার ইঙ্গিত, বাংলাদেশ যদি স্বাধীনতা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, তবে ভারতের নানাস্থানেও স্বাতন্ত্র্যের দাবী জেগে উঠতে পারে। অতএব হে ভারতের গভর্ণমেন্ট, ওঠো, জাগো, প্রবুদ্ধ হও। বাংলা দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকোপে আমি যে দুর্দশায় উপনীত হয়েছি, নানা অঞ্চলের স্বাতন্ত্র্যের আন্দোলনের ফলে তোমারও সেই দুর্দশা হতে পারে। আজ পাকিস্তান যেমন ছিন্ন ভিন্ন, তোমারও তেমনই হতে পারে। অতএব এস হাতে হাত মেলাই, শোষণকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে নিজ নিজ দেশের অখন্ডতা বজায় রাখি।
বলাবাহুল্য, এ কথায় না ভারতের জনসাধারণ, না ভারতের সরকার, কেউই কর্ণপাত করবে না। ইয়াহিয়ার এই বর্বর স্বীকরোক্তি শুধু ভারতের নয় জগতের জনসাধারণকে জানিয়ে দেবে যে অখন্ড পাকিস্তানে বাঙালীর স্বাধীনতার কোনো স্থান নেই, আছে শুধু বাঙালীর শোষণের। অখন্ড পাকিস্তানে বাঙালীর ধর্ম সম্পদ সৃষ্টি এবং বিদেশ রপ্তানী হিসাব দেখুন :
অখন্ড পাকিস্তানের বিদেশে রপ্তানী (কোটি টাকায়)
পূর্ব বাংলা থেকে | পশ্চিম পাকিস্তান থেকে | |
১৯৫০/১ | ||
—১৯৫৪/৫৫
১৯৫৫/৫৬ |
৮৬ | ৮৫ |
—১৯৫৯/৬০
১৯৬০/১ |
৯৮ | ৬২ |
—১৯৬৪/৬৫ | ১২৬ | ৮৬ |
অর্থাৎ পূর্ব বাংলা থেকে সম্পদ বিদেশে রপ্তানী হয়েছে ক্রমবর্ধমান হারে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে রপ্তানী বরং কমেছে কিন্তু বাড়েনি। এই সম্পদের বিনিময়ে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে তার কত অংশ কোথায় গেছে? হিসাব দেখুন :
অখন্ড পাকিস্তানের বিদেশে আমদানী (কোটি টাকায়)
পূর্ব বাংলা থেকে | পশ্চিম পাকিস্তান থেকে | |
১৯৫০/১ | ||
—১৯৫৪/৫৫
১৯৫৫/৫৬ |
৪৪ | ১০৫ |
—১৯৫৯/৬০
১৯৬০/১ |
৬২ | ১৫২ |
—১৯৬৪/৬৫ | ১২২ | ২৭৭ |
অর্থাৎ সুপ্রসিদ্ধ একটি উর্দূ কবিতার ভাষায়, বাংলাদেশের ভাগ্যে—
মহফিল হমারী সাকী উনকা
মেহনত হমারী বাকী উনকা
সেই মহফিল আজ আর ইয়াহিয়ার সাকীর পাত্রে বাংলার রক্ত ঢালা নয়, আজ বাঙালীর রক্তে আর এক উৎসবের আয়োজন। সে উৎসব পূর্ণ স্বাধীনতা।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল