বিপ্লবী বাংলাদেশ
৭ নভেম্বর ১৯৭১
সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে
দেশে দেশে সশস্ত্র মুক্তির সংগ্রাম
—অধ্যাপিকা রেহানা বেগম
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
২৬শে জুলাই রাতে সৈন্যদের ব্যারাক আক্রান্ত হয়, কিছু সৈন্য মারাও যায়—কিন্তু বাতিস্তা খবর পেয়ে পাল্টা আক্রমণ করে। কাস্ত্রোর বেশ কিছু লোককে তারা প্রচন্ড অত্যাচার করে মেরে ফেলে। কিছু লোককে জেলে নিয়ে অত্যাচার করে। অবশ্য ফিদেল ও রাওল কাস্ত্রো এবং আরও কয়েক জন পালাতে পারেন। ফিদেল কাস্ত্রোকে জীবিত বা মৃত ধরে আনতে পারলে প্রচুর পুরস্কার দেবার ঘোষণা করা হয়। শিকারী কুকুরের মত বাতিস্তা সরকারের লোক এদের খুঁজতে থাকে। কাস্ত্রোকে তখন পর্য্যন্ত বিশেষ কেউই চিনত না। একটি পাহাড়ের নীচে এরা অসতর্ক হয়ে ঘুমিয়ে পড়ায় বাতিস্তার লোক এদের ধরে ফেলে। সঙ্গের অফিসার কাস্ত্রোকে চিনতে পেরে তাকে বলে দেয় নাম না বলতে। কারণ নাম বললে কাস্ত্রোকে ওরা মেরেই ফেলবে। কাস্ত্রো ধরা পড়ার পর বাকিরা আত্মসমর্পণ করেন।
সুরু হয় কাস্ত্রোর বিচার। সেও এক বিরাট কাহিনী। তার সবটা নয় কিছু কিছু তুলে দিচ্ছি।
প্রসিকিউটর—আজ বিভিন্ন বামপন্থী (বিশেষতঃ কমিউনিস্ট) দলের কাছ থেকে নিশ্চয়ই তোমরা অর্থ ও অন্যান্য সমর্থন পাচ্ছো?
কাস্ত্রো—না।
প্রসিকিউটর—তবে তোমাদের সমর্থক কে?
কাস্ত্রো—সমস্ত কিউবার মানুষ। আমরা যদি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতাম তবে সবাই আমাদের সমর্থন করত। কারণ কিউবার কোন মানুষেরই স্বাধীনতা নেই।
প্রসিকিউটর—তোমাদের নেতা তো (মার্তি) মারা গেছেন।
কাস্ত্রো—তাতে কিছু আসে যায়না। মানুষ মানুষকে অনুসরণ করেনা, করে তার আদর্শকে।….
কেন তাঁরা সশস্ত্র সংগ্রাম করছে, সংগ্রামের পর স্বাধীন কিউবাকে তাঁরা কিভাবে তৈরী করবেন বলতে গিয়ে কাস্ত্রো বলেন। অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার আদর্শ নতুন নয়—এ সংগ্রাম সুদূর অতীতে ভারতবর্ষ করেছে। এভাবে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে ইংল্যান্ডের মানুষ গৌরবময় বিপ্লবে, আমেরিকা স্বাধীনতা সংগ্রামে, স্পেনে জন মারিয়ানা, জার্মানীতে মার্টিন লুথার। কিউবা নতুন কিছু করছেনা, এই সব পুরোনো ঐতিহ্যের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে।
এ সংগ্রামে আমরা পাবো কিউবার শ্রমিককে কারণ তারা পরিশ্রমের তুলনায় মজুরী পায় সামান্য; আমরা পাবো হাজার হাজার বেকার যুবককে যাদের কাজ করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু কাজ নেই; আমরা পাবো ছোট মাঝারী কৃষককে যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চাষ করে কিন্তু জমির মালিক নয়; আমরা পাবো শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবি, শিল্পী, সাংবাদিক অর্থাৎ বুদ্ধিজীবিদের যাদের কোন মনের খোরাক নেই, স্বাধীনতা নেই, মর্যাদা নেই; আমাদের মানুষ জানে দুঃখ কাকে বলে। আমরা তাদের বলিনা যে আমরা তোমাদের স্বাধীনতা দেবো, আমরা তাদের বলবো এসো সবাই মিলে লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করবো, আমাদের সুখ আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য লড়াই করে আমরাই প্রতিষ্ঠা করবো। তাই আমাদের সংগ্রামের সাথী কিউবার লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ।
স্বাধীন কিউবাকে আমরা প্রথমেই শিল্পের সমস্যা, গৃহসমস্যা, স্বাস্থ্য সমস্যা, বেকার সমস্যা, শিক্ষার সমস্যা, জমির সমস্যা থেকে মুক্ত করে সুষ্ঠু সমাধান করার চেষ্টা করবো। এটা এক দিনের কাজও নয় একার কাজও নয়। সুতরাং সবাই মিলে এই সমস্যার সমাধান করার ব্রত দেব। এই হবে স্বাধীনতার পর আমাদের প্রথম কাজ।
আমাদের যে বন্ধুরা শহীদ হলেন তাদের জন্য চোখের জল ফেলবোনা, নতুন সুন্দর স্বাধীন কিউবা গড়ে তুলে তাদের স্বপ্নকে সার্থক করবো।
আমি আমার মুক্তির জন্য আবেদন করছি না, আমার জন্য বন্ধুরা যে ভাগ্যকে বরণ করেছে আমাকেও তাদের সঙ্গে জেলে সে কষ্টকে ভাগ করে নিতে দাও। আমার সাথীদের ফেলে আমি মুক্তি চাইনা। আমি জানি এই কিউবাতে ভাল মানুষদের হয় মৃত্যু না হয় জেল, যেখানে দেশের প্রেসিডেন্ট সবচেয়ে বড় অপরাধী এবং চোর…
আমার মৃত্যুদন্ড দাও, ইতিহাস আমায় মনে রাখবে। (“Sentence me. I don’t mind. History will absolve me.”).
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল