You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.31 | মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরী —মিজানুর রহমান | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
৩১ অক্টোবর ১৯৭১

মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরী
—মিজানুর রহমান

(বরিশাল থেকে)
মৃত্যুর হাত থেকে আমি বেচে এসেছি। বাচিয়েছি মুক্তি সংগ্রামী আবদুল জলিলকে। কিন্তু বাচাতে পারিনি শহীদুল হাসান, সাহজাহান ও আমির হোসেনকে। ওরা আজ মৃত্যুর দেশে বসে আমাদেরকে আশীর্বাদ করছে।
মৃত্যুর জন্য দুঃখ নেই। দেশ-মাতৃকার নামে জীবন যেদিন উৎসর্গ করেছি সেদিন থেকেই মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছি মৃত্যু যে কোন সময় আসবে এই তো মুক্তি সংগ্রামীর জীবনের চিরন্তন সত্য। ওরা তিন বিপ্লবী হারিয়ে যায়নি বাংলার বিপ্লবের রণাঙ্গন থেকে। ওদের রক্তের মাঝ থেকেই নব-জন্ম নিয়েছে লাখো লাখো বিপ্লবী তাইতো বাংলার বিপ্লবের আকাশে আজ অগ্নিস্ফূলিঙ্গ।
ওরা হারিয়ে যায়নি আমাদের মাঝ থেকে। রাত যখন গভীর থেকে গভীরতর হয়। পৃথিবী যখন সমস্ত দিনের হিসেব নিকেশ শেষ করে নিশ্চিন্তে রাতের আঁধারে সকলকে নিয়ে ঘুমিয়ে যায় তখন ওরা আসে অমৃতলোক থেকে চুপি চুপি আমার কাছে। অনেক কথা বলে, অতীত স্মরণ করিয়ে দেয়। বর্তমান থেকে বিচ্যুতি না হতে বলে, তার পর যাবার মুহূর্তে বলে যায়, আমরা মরিনি। আমরা যে অমর, আমরা এখনো আছি তোমাদের পাশে পাশে প্রতিবাদের রণাঙ্গনে মারণাস্ত্র হাতে।
ভোর হয়, হারিয়ে যায় অন্ধকার। আলোর প্রকাশ হয় পৃথিবীতে। ওরাও হারিয়ে যায়, হারিয়ে যায় দৃষ্টির বাইরে। কিন্তু সমস্ত দিনটা ওদের ভাবনায় মনটা আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। অনেক অনেক স্মৃতি ভির করে মনের পটে। ছ’মাস ধরে ওদের নিয়ে কত রণাঙ্গনে বাংলার শত্রু নিধন করেছি। আর আজ ওরা নেই! দেশ মাতৃকা ওদেরকে গ্রহণ করেছে তাঁর স্নেহ ছায়ায়। সেদিন আমরা বাংলার পাঁচ দামাল ছেলে গিয়েছিলাম পাক সৈন্যের অবস্থান জানতে নন্দীর বাজারে। বেলা তখন প্রায় দু’টো। দীর্ঘ পথ চলার ক্লান্তিতে বাজারের পূর্ব দিকে নদীর তীরে একটা বটবৃক্ষের নীচে আশ্রয় নিলাম। সবে বসেছি হঠাৎ কতগুলো বাঁশীর হুইসেলে সচকিত হয়ে উঠলাম সবাই। বুঝলাম হানাদারদের কবলে পড়েছি। কিছু ভেবে উঠার আগেই দেখলাম অসংখ্য পাঞ্জাবী পুলিশ ও রাজাকার আমাদেরকে ঘেরাও করে এগিয়ে আসছে। মুহূর্ত মধ্যে কর্তব্য স্থির করে ফেললাম। পাশেই স্রোতস্বিনী নদী বয়ে চলেছে। ঝাঁপিয়ে পড়লাম সবাই।
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে দু’টো স্পীড বোটে করে প্রায় ১৫/২০ জন পাক সৈন্য পশ্চিম দিক থেকে এসে আমাদের পথ রোধ করল। আর এগুবার উপায় নেই। বন্দী হলাম আমরা।
পাক হানাদাররা আমাদের পাঁচজনকে পাঞ্জাবী পুলিশের হেপাজতে রেখে চলে গেল যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে। বুঝলাম বাংলার কোন বিশ্বাসঘাতকের চক্রান্তেই আমরা আজ বন্দী হলাম। এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো থানায়। সেখানে পাঁচ জনের উপর চলল নির্যাতন। সে নির্যাতনের কথা মনে পড়লে আজো শরীর শিউরে উঠে, শরীর কেটে লবন পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল। সমস্ত রাত ধরে চলল এমনি অত্যাচার, পরদিনও কাটল। আবার রাত হল। নানা কৌশলে আমাদের কাছ থেকে কথা বার করতে চাইল ওরা। কিন্তু আমরা তো জানি মৃত্যু অনিবার্য্য। জীবন দেব তবু মুক্তি বাহিনীর অবস্থানের সংবাদ দেবনা কিছুতেই।
শেষ পর্যন্ত কোন সংবাদ সংগ্রহ আমাদের কাছ থেকে বার করতে না পেলে গুলী করে মারার হুকুম করল থানার ও.সি.। সময় নির্দিষ্ট হল রাত বারোটায়। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আমাদেরকে নিয়ে আসা হল সেই নদী তীরে। সবার হাত বেধে নদীতীরে দাড় করে দেওয়া হল।
দেখতে দেখতে এক সময় চরম মুহূর্ত্ত ঘনিয়ে এল, ফায়ারের অর্ডার হল। তিনজন পাঞ্জাবী পুলিশের রাইফেল গর্জে উঠল, লুটিয়ে পড়ল শহীদুল হাসান, সাহজাহান, আমির হোসেন। আবার ট্রিগার টানা হল। মুহূর্ত পরেই লুটিয়ে পড়ব আমরা বাকী দু’জন, কিন্তু এমন মৃত্যু এই কি চেয়েছিলাম?
না, না, প্রতিশোধ নিয়ে তবে মরতে হবে। পাশেই স্রোতস্বিনী নদী বয়ে চলেছে, বাচতে হবে প্রতিশোধ নিতে হবে আবার ফায়ারের অর্ডার হল। কিন্তু তার আগেই জলিলকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম নদীর বুকে। হে-দেশমাতা তোমার বুকে ঝাঁপ দিয়েছি তুমিই গ্রহণ কর।
রাতের আধার বিদির্ন করে ঝাকে ঝাকে গুলি এসে পড়তে লাগল নদীর বুকে, জলিলকে ধরে ডুব দিতে দিতে ওদের নাগালের বাইরে চলে এলাম, এবার প্রতিশোধ—

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল