You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.31 | সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দেশে দেশে সশস্ত্র মুক্তির সংগ্রাম —অধ্যাপিকা রেহানা বেগম | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
৩১ অক্টোবর ১৯৭১

সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে
দেশে দেশে সশস্ত্র মুক্তির সংগ্রাম
—অধ্যাপিকা রেহানা বেগম

কিউবা
১৪৯২’র ২৮শে অক্টোবর কলম্বাস কিউবাতে পৌঁছে, কিউবার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন “পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দেশ এই কিউবা।” শুধু সৌন্দর্যে নয়, ঐশ্বর্যেও ভরপুর এই দেশ।
পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে বড় দ্বীপ এই কিউবা, প্রায় ৪৪,২১৮ বর্গমাইল আয়তন, চওরায় কম তবে অনেকটা লম্বা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৮০ মাইল। কিউবার লোকসংখ্যা খুবই কম। নিউইয়র্ক শহরের চেয়েও এর লোকসংখ্যা কম যদিও আয়তনে ডেনমার্ক, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডের মিলিত আয়তনের চেয়েও বড়। লোকসংখ্যা ৬৪ লক্ষের কিছু বেশী।
কিউবাতে বৃষ্টিপাত খুব বেশী নয়, তবে জমির উর্বরাশক্তি বেশী, তাই নানান রকমের ফসল হয়। আর আছে এর অজস্র খনিজ সম্পদ। এত সম্পদের অধিকারী কিউবার মানুষের বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্তও না ছিল প্রকৃত স্বাধীনতা, না ছিল স্বচ্ছল জীবন। দেশে ছিল না কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান। দেশ নামে স্বাধীন হলেও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিক থেকেই ছিল কার্যতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অধীন। দেশের লোকসংখ্যার শতকরা ৫৭ জনই বাস করতো গ্রামে। গ্রামে ভাল ঘর বাড়ী, স্বাস্থ্যনিবাস, স্কুল, কলেজ ছিল না বললেই চলে। লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা ছিল খুবই কম। শহরের লোকেরা গ্রামের অনুপাতে কিছুটা ভাল জীবন যাপন করতো।
দেশে শিশুমৃত্যুর হার ছিল অত্যাধিক। পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব, অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান মৃত্যুর হার ক্রমশিই বাড়িয়ে তুলেছিল। এক কথায় বলতে গেলে কিউবানদের জীবনে কোন সুখ বা শান্তি ছিল না বললেই হয়।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তৎপরতার ফলে কিউবাতে কোন নিজস্ব শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে পারেনি। সাম্রাজ্যবাদ কিউবাকে তার কাঁচামাল সংগ্রহের এবং তাদের কারখানায় তৈরী জিনিষপত্রের বিক্রির ভাল বাজার হিসেবেই ব্যবহার করত। এক কথায় কিউবা ছিল কৃষিপ্রধান এবং অর্থনৈতিক ভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীল একটা দেশ।
রাজনৈতিক ভাবেই কিউবার কোন স্বাধীনতা ছিল না। আমেরিকার পুতুল সরকার শাসন করত কিউবা। সেসব বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কিউবা ছিল স্পেনের অধীন। কিন্তু সেই সময় থেকে কিউবার মানুষের একটা অদ্ভূত ধারণা ছিল—কিউবা দেশটা কিউবার মানুষদের। সাম্রাজ্যবাদ এটা মানে চাহিত না, আর তাই কিউবার মানুষের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই’র ইতিহাসও বেশ পুরানো।
১৮৬৮’তে র’ কিউবানরা স্পেনীয়দের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে নামে। ১০ বছর লড়াই চলে। প্রায় ৮০,০০০ স্পেনীয় সৈন্য মারা যায়। এই মুক্তিসংগ্রামের নায়ক ছিলেন জোস মার্তি। তাঁর লেখা কিউবানদের উদ্বুদ্ধ করে। প্রচন্ড লড়াই করেও বহু ইস্পিত স্বাধীনতা তারা পেলেন না। কিন্তু লড়াই তারা ছাড়লো না। দ্বিতীয়বার ১৮৯৫-তে সশস্ত্র অভ্যুত্থান হয়। স্পেনের সঙ্গে সে এক রক্তাক্ত সংগ্রাম। এ সংগ্রামও চলে কয়েক মাস। স্পেনের পক্ষ নিয়ে আমেরিকা আসে মিমাংসা করতে। কিউবার স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়। স্পেন কিউবা থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং কার্যতঃ প্রতিশ্রুতি রক্ষাও করে। এই সুযোগেই আমেরিকা কিউবার উপর কর্তৃত্ব করতে আসর জাগিয়ে বসে। আমেরিকা আস্তে আস্তে কিউবার অর্থনীতিকে মুঠোয় আনার চেষ্টা করে।
মার্কিনীরা যে তাঁবেদার সরকারী তৈরী করে তার প্রেসিডেন্ট ছিলেন বাতিস্তা। প্রচন্ড স্বৈরাচারী। স্বাধীন সরকার থাকা সত্ত্বেও কিউবার মানুষের জীবনে প্রকৃত স্বাধীনতা ছিল না।
জোস মার্তি মারা যাবার পর কিউবার স্বাধীনতা সংগ্রাম খুব একটা প্রকাশ্যভাবে করা যায়নি। ১৯৫২ সালে প্রেসিডেন্ট এনউচে বাতিস্তা প্রায় যখন হেরে যাচ্ছিলেন তখন গদি তিনি তাঁর মার্কিনী প্রভুদের শরণাপন্ন হয়ে কিউবার সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি কলম্বিয়ার সৈন্যদের নিয়ে সামরিক ভাবে ক্ষমতা দখল করলেন। ঠিক একই ভাবে তিনি ১৯৩৪’এ ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এই ঘটনায় কিউবার মানুষ খুব বিক্ষুব্ধ হলেও খুব একটা প্রতিবাদ করার সাহস পেলনা।
ক্ষমতা দখলের কয়েক সপ্তাহ পরে একালে ২৫ বছরের আইন পাশ করা এবং হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট যুব আদালতে বাতিস্তার কাজকে শাসনতন্ত্র বিরোধী বলে নালিশ জানিয়ে শাসনতন্ত্রের ধারা অনুযায়ী তাঁর ১০৮ বছরের জেল অথবা মৃত্যুদন্ড দাবী করে। দাবানলের মত এই অসমসাহসী যুবকের কান্ডকারখানার কথা ছড়িয়ে পড়ে। কিউবার মানুষ অবাক হয়ে শোনে এর নাম। যুবকটির নাম ফিদেল কাস্ত্রো। যথারীতি এই অসম্ভব প্রস্তাব আদালত অগ্রাহ্য করে। কাস্ত্রো সঙ্গে সঙ্গে বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের কথা ঘোষণা করেন। কাস্ত্রো ঘোষণা করেন এই অত্যাচারী স্বৈরাচারী শাসকের উচ্ছেদ করে, দেশে প্রকৃত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করে মার্তির স্বপ্নকে সফল করতে হলে এটাই মাত্র পথ আছে—তার নাম—বিপ্লব। আর বলাই বাহুল্য এ বিপ্লব সশস্ত্র বিপ্লব।
সে এক রোমাঞ্চকর কাহিনী। কাস্ত্রো ২০০ জন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে একটি বিপ্লবী দল গড়ে তোলেন। এদের বয়স উপর দিকে ২৬ এবং সবচেয়ে ছোট কাস্ত্রোর ভাই রাওল কাস্ত্রো, তাঁর বয়স ২২। দলের মধ্যে মাত্র দুজন মেয়ে। এরা গোপনে টিক করে যে কিউবার দ্বিতীয় বৃহত্তম সৈন্যদের ঘাঁটি ‘মনকাতা ব্যারাক’ অতর্কিতে আক্রমণ করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিয়ে দলকে সংগঠিত করতে হবে। তারিখ ঠিক হল ১৯৫৩’র ২৬শে জুলাই। (চলবে)

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল