বিপ্লবী বাংলাদেশ
৩১ অক্টোবর ১৯৭১
প্রতিরোধী গেরিলা বাহিনী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
নিয়মিত গেরিলাদের যোগানদারকে (fillers) সাধারণতঃ সর্বোৎকৃষ্ট গেরিলা আধাসামরিক সেনাদের মধ্য থেকে বেছে নেওয়া হয়। গেরিলা পৃষ্ঠপোষক শক্তিগুলি তাদের সেনাবাহিনীর লোককে নিয়মিত গেরিলাদের উপদেষ্টা হিসাবে বা তাদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য দিতে পারে।
(খ) আধাসামরিক গেরিলারা নিয়মিত গেরিলাদের চেয়ে কম সুসংগঠিত, ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং সজ্জিত। এরূপ সেনাদলকে প্লাটুন, কোম্পানি, ব্যাটেলিয়ন, এবং সময় সময় রেজিমেন্ট (অথবা বা সমকক্ষ) রূপে সংগঠিত করা যেতে পারে। এরা সীমিত সংখ্যক আক্রমণ চালায় এবং শত্রুসেনাকে হয়রানি করে ও অতর্কিত আক্রমণে প্রতিপক্ষের শক্তিবৃদ্ধির উদ্দেশ্যকে নস্যাৎ করে দেয়। একটি আধাসামরিক গেরিলা সেনাদলকে কোন একটি বিশেষ নির্দিষ্ট এলাকায় (যেমন প্রদেশ, জেলা) নিয়োগ করা হয় এবং সাধারণতঃ সে এলাকা ছাড়া অন্য এলাকায় আক্রমণের জন্য যায় না। গেরিলা আধা-সামরিক সেনাদের যোগানদারগণকে অনিয়মিত গেরিলাদের মধ্য থেকে নেওয়া হয়।
(গ) অনিয়মিত গেরিলা সেনাবাহিনী হলো সাহায্যকারী দল। তাদের উপর নিম্নলিখিত কর্তব্যগুলির দায়ীত্বভার থাকে, যেমন গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, ঘাঁটি নির্মাণ, গ্রামগুলোকে সুরক্ষিত করা, নিয়মিত গেরিলা বা আধাসামরিক সেনাদের জন্য (কোন কিছু) বহনকারী রূপে কাজ করা এবং স্থানীয় বিপ্লবী অফিসারদের রক্ষী হিসাবে কর্ত্তব্য পালন করা। অনিয়মিত গেরিলারা সীমিত সামরিক প্রশিক্ষণ পায়, কিন্তু তাদেরকে ব্যাপক রাজনৈতিক জ্ঞান দেওয়া হয়। তারা সাধারণতঃ তাদের বেসামরিক পেশা অব্যাহত রাখে এবং গেরিলা বিরোধী শক্তিগুলিকে হয়রানি ও তাদের কাজকে বিলম্বিত করানোর উদ্দেশ্যে মাত্র সাময়িক কালের (part time) জন্য যোদ্ধা হিসাবে কাজ করে। তাদের সীমিত সামরিক কাজের মধ্যে রয়েছে প্রতিপক্ষের আংশিক ক্ষতিসাধন এবং নিজস্ব উদ্ভাবনী ও চাতুরীর মাধ্যমে বিপক্ষকে ফাঁদে ফেলা।
(ঘ) পৃষ্ঠপোষক শক্তিগুলির সম্পদ, যেমন যোদ্ধা, যোদ্ধাদের সহায়তা ও সহায়তাকারী সংগঠন, সামরিক সংগঠনকারী ও উপদেষ্টা এবং বেসামরিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মনঃস্তাত্ত্বিক সংগঠনকারী ও উপদেষ্টা, এগুলি গেরিলাদেরকে সাংগঠনিক ও আক্রমণাত্মক কাজে সাহায্য হিসাবে দেওয়া যেতে পারে।
তৃতীয় অনুচ্ছেদ কার্যক্রম (activities)
কৌশলী অপারেশন—গেরিলা প্রথম অপারেশনের উপযোগী হ’লে সীমিত সংখ্যক এবং ছোট ধরণের অপারেশনে নিয়োজিত হয়। গেরিলাকে যদি উচ্চমানের সংগঠন, ট্রেনিং এবং সরঞ্জাম দেওয়া হয় তবে তারা এমন বৃহত্তর অপারেশন পরিচালনা করতে পারে যে তাদের সংগে লড়তে নিয়মিত সেনাবাহিনীর প্রয়োজন হবে।
ক) গেরিলা অপারেশন—কতকগুলো কৌশল অবলম্বনে ধৈর্য্যের সঙ্গে অভিযান চালানোই গেরিলা যুদ্ধ। কৌশলগুলির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হ’লো ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পলায়ন, আকস্মিকতা এবং সংক্ষিপ্ত অথচ তীব্র ক্রিয়া। মূলতঃ আক্রমণের উদ্দেশ্যে তারা raid এবং গুপ্তস্থান থেকে অতর্কিত হানা দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করে। সাধারণ যুদ্ধের মত কোন ভৌতিক উদ্দেশ্য কায়েম করার ইচ্ছায় কোন কিছু দখল করার চেষ্টা সচরাচর কমই করা হয়। এক একটা নির্দিষ্ট কার্য্যক্রমে ছোট ছোট গেরিলাদল লাগানো হয়। এদের সাধারণতঃ আগ্নেয়াস্ত্রের পরোক্ষ সহায়তা বা অবস্থান করার মত ক্ষমতা থাকে না। আক্রমণ কার্য্যকরী হলেই তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে আক্রমণ স্থল ত্যাগ করে যেন গেরিলাবিরোধী সেনারা পুনরায় শক্তিশালী হয়ে তাদের আক্রমণ না করতে পারে। গেরিলা অপারেশনের নীতিগুলো হলো—
১। সহজেই আয়ত্ত্বে আনা যায় এমন লক্ষ্যস্থলগুলোকে অধিকতর শক্তির সঙ্গে আক্রমণ করা।
২। অধিকতর শক্তিশালী গেরিলাবিরোধী শক্তি প্রত্যক্ষ এবং চুড়ান্ত সংঘর্ষে না যাওয়া।
৩। আক্রমণের জন্য দ্রুত কেন্দ্রিভূত হওয়া এবং পরে প্রতিআক্রমণ এড়ানোর জন্য বিচ্ছিন্ন হওয়া।
৪। জনসাধারণের মধ্যে মিশে যাওয়া।
৫। উদ্দ্যম রক্ষা করা।
৬। প্রতিটি অপারেশন এমনভাবে চালনা করা যেন শত্রুপক্ষ হতচকিত হয়ে পড়ে। সঠিক গোয়েন্দাতথ্য, অনুশীলন সহ বিশদ পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য সিদ্ধির ব্যাপারে চোরাগুপ্তা পন্থা, এবড়োথেবড়ো ভূমিতে পায়ে হেঁটে চলা, অপারেশন কার্যকরী করার ব্যাপারে দ্রুততা এবং দৃঢ়তা, এবং ছদ্মবেশ ও চাতুরীর মাধ্যমে আকস্মিক ফললাভে গেরিলারা সচেষ্ট হয়।
৭। প্রতিরক্ষা অপারেশনের চারিত্রিক দিক হলো, শত্রুপক্ষের অগ্রগতি বিলম্বিত করা, হয়রানি, আংশিক ক্ষতি সাধন এবং চাতুরীর সাহায্য নেওয়া। গেরিলারা সময়ে শহরের আশেপাশে, শত্রু ঘাঁটির পাশে বা গেরিলা নিয়ন্ত্রিত অনুকুল স্থানে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে এবং অবস্থা অবনতির পূর্বে তা গুটিয়ে ফেলে।
৮। স্থায়ী শত্রু ঘাঁটি যেমন—বিমান ঘাঁটি বা বিমান অবতরণ ক্ষেত্র, পাহারা ফাঁড়ি ও অন্যান্য ঘাঁটি সমৃদ্ধ এলাকা মর্টার ও গোলন্দাজ বাহিনী দ্বারা আক্রমণ করা।
খ) অতর্কিত হানা—অতর্কিত হানা দেওয়া গেরিলা আক্রমণের একটি সাধারণ প্রকৃতি। এটা পুঙ্খানুপুঙ্খ গোয়েন্দা তথ্য এবং বিশদ পরিকল্পনার উপরে প্রতিষ্ঠিত এবং আকস্মিকতা ও দৃঢ়তার সাথে কার্যকরী করা হয়। সৈন্য ও সরবরাহ চলাচলের বিরুদ্ধে এবং যে সমস্ত এলাকায় খাদ্য বা সৈন্য নামিয়ে দেওয়া হয় সেখানে এরকম হানা দেওয়া হয়। পার্বত্য এলাকা, যেখানে সঙ্কীর্ণ গিরিসঙ্কট পথে সৈন্যরা কেবল সারি বেঁধেই চলতে পারে এবং অরণ্য এলাকা অতর্কিত হানার জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র। অবশ্য খোলা জায়গাতেও অনেক সময় এ রকম হানা দেওয়া হয়। কমান্ডিং গ্রাউন্ড, লুকিয়ে থাকা এবং ছদ্মবেশ পুরাপুরি অবলম্বন করা হয়। সাধারণতঃ খুব কাছে থেকে আক্রমণ করা হয় যেমন সর্বাপেক্ষা বেশী ফললাভ হয়। লক্ষ্যটিকে সম্পূর্ণরূপে এবং গভীরভাবে আক্রমণ করার জন্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে গুলি ছোঁড়া যেতে পারে। সটগান গ্রেনেড এবং মর্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। ট্রেন বা দ্রুতগামী সৈন্যদলকে আক্রমণস্থলে থামিয়ে দেওয়ার জন্য রাস্তা বন্ধ করা, ধ্বংস করা ও মাইন পুঁতে রাখার পদ্ধতি সচরাচর অবলম্বন করা হয়। (ক্রমশঃ)
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল