বিপ্লবী বাংলাদেশ
৩১ অক্টোবর ১৯৭১
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা পদ্ধতি
—দিলীপ কুমার দাস
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক নগ্নরূপ বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ব্যবস্থার চেয়ে কোন অংশে কম নয়! বাংলাদেশের উৎপাদিত কাঁচামাল নাম মাত্র মূল্যে ক্রয় করে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পে নিয়োগ করে ঔ শিল্প জাত দ্রব্য কয়েকগুণ বেশি মূল্যে আবার বাংলাদেশের বাজারে ছারা হত অথচ বাংলাদেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কোন উদ্যোগই পাক সরকার গ্রহণ করেনি। ঔপনিবেশিকতার মৃত্যু ঘন্টা যখন ধ্বনিত সেই সময় বাংলাদেশের মানুষও আর ঔপনিবেশিক কায়দায় শোষিত হতে রাজি নয়। অত্যাচার উৎপীড়ন এবং শোষণের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য বাংলার মানুষ যখন একান্ত আগ্রহ নিয়ে দিন গুনছিল ঠিক সেই মুহূর্তে এল পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন—আর এই নির্বাচনের রায়ই প্রমাণ করেছে বাংলার মানুষ স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কতটা আগ্রহী। প্রথমদিকে বাংলাদেশে যে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের শুরু হয়েছিল আজ তা প্রথম দিকের স্তর অতিক্রম করে জনযুদ্ধে পর্যবসিত হয়েছে। পাকিস্তানের জঙ্গী শাহী মনে করেছিল বাংলার জাগত্র জনতার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে পশুবল প্রয়োগ করে ধূলিসাত করে দেবে কিন্তু তা হল না, হতে পারে না। মুক্তি যোদ্ধারা প্রথমদিকের আঘাত সামলে উঠে এখন সুসংসহত এক বাহিনীতে পর্যবসিত হয়েছে। বাংলার অসংখ্য গ্রামে, গঞ্জে, নগরে, বন্দরে মুক্তি যোদ্ধারা আজ শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছে।
এমন গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ পরিচালনা করে মুক্তি বাহিনীর সৈনিকরা সফলতাই অর্জন করছে বেশি। গেরিলা বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণে পাক সেনাবাহিনী আজ দিশেহারা। গেরিলা বাহিনীতে অসংখ্য মেয়ে সৈনিকরাও রয়েছেন যাদের মনোবল অতুলনীয়।
নরপশুরা অনেক সময় নারীদের কাছে পাশবিক প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য এগিয়ে যায় আর এই সৈনিকেরাও তাদের প্রলুব্ধ করে নিরালা জায়গায় নিয়ে গিয়ে সুযোগ মত—অস্ত্রের সাহায্যে চিরদিনের জন্য পাশবিক ক্ষুধা মিটিয়ে দেয়। এক বীর গেরিলা সৈনিকের কাহিনী উল্লেখ না করে থাকতে পারলাম না। ঢাকার এক গেরিলা সৈনিক—নাম তাঁর কামাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র ছিলেন। তিনি বাংলার প্রতিটি মুক্তিকামী সৈনিক আজ এই বীর সৈনিকের কথা স্মরণ করে শ্রদ্ধায় মাথায় নোয়ায়। ঢাকার এক অভিজাত পল্লীতে পাক হানাদার টহলদার বাহিনী অত্যাচার চালিয়ে মদ্যপ অবস্থায় ফিরছিল। কামাল রাস্তার পাশে এক অভিনব কায়দায় আত্মগোপন করে আছেন কখন টহলদার বাহিনী আসবে। এক সময় সুযোগ এসে যায়। রুদ্ধশ্বাসে কামাল এই চরম মুহূর্ত্তের অপেক্ষায় ছিলেন—সুইচের বোতাম এক সময় টিপে দেয়া হয়। রাস্তার উপর পেতে রাখা ডিনামাইট প্রবল শব্দে ফেটে যায়। গোটা অঞ্চলটা থর থর করে কেঁপে ওঠে। সামরিক বাহিনীর দু-খানা ট্রাকই গুড়িয়ে যায়। সব কটি নরপশুই শোচনীয় মৃত্যু বরণ করে। অল্প সময়ের মধ্যে সামরিক বাহিনীর প্রধান ছাউনি থেকে অসংখ্য সাজোয়া গাড়ী সম্পূর্ণ অঞ্চলটাকে ঘিরে ফেলে। আত্মগোপন করার কোন স্থান নেই দেখে কামাল হানাদার বাহিনীর মেজরের কাছে ধরা দেয়। মেজর খুব খুশী, অনেক প্রয়োজনীয় খবর সংগ্রহ করে ওকে হত্যা করা যাবে। কামালকে ধরে ছাউনিতে নিয়ে গিয়ে মেজর ও কয়েকজন পদস্থ সামরিক অফিসার ঘিরে বসেছে, খবর সংগ্রহের জন্য। কয়েকটি মুহূর্তমাত্র, কামাল কি যেন নীরবে চিন্তা করলেন তারপর জয় বাংলা বলে লাফিয়ে উঠে প্রবল বেগে বসে পড়লেন সাথে সাথে পশ্চাতে লুকিয়ে বেঁধে রাখা আত্মঘাতী ‘মাইন’ প্রবল শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে ছাউনির সব কিছু কাঁপিয়ে তুলল। মেজরসহ সবকটি নরপশুর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন দেহের সাথে কামালের দেহাবশেষও এক প্রান্তে গিয়ে ছিটকে পড়ল। (ক্রমশঃ)
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল