You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.17 | বিশ্ব বিবেক —মেহেরুন আমিন | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৭ অক্টোবর ১৯৭১

বিশ্ব বিবেক
—মেহেরুন আমিন

বিশ্ব বিবেক একটি শাশ্বত সত্য। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্ববিবেক তার পর্যালোচনায় কোন দিন ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি। পৃথিবীর যুগান্তকারী ঘটনা সমূহে বিশ্ববিবেকের রায়, যা চিরন্তন সত্য যেদিকেই গিয়েছে। অন্যায়কে কোনদিনই বিশ্ববিবেক মেনে নেয় নাই। অধুনা যে সব ঘটনা ঘটেছে যেমন প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পরবর্ত্তী সময়ে আলজেরিয়া, কিউবা ও ভিয়েতনাম সমস্যা—এ সবের মধ্যেই বিশ্ববিবেক তার রায় সঠিক ভাবেই প্রতিফলিত করেছে। পৃথিবী আজ দরিদ্র কারণ বৃটেনের বার্ট্রান্ড রাসেল ইহজগতে নেই। কিন্তু তাই বলে সংগঠিত শক্তি ঠিক ভাবেই তার মতামত প্রকাশ করে যাচ্ছে। “নেতার” অনুপস্থিতিতে তার প্রকাশ ভঙ্গীর দুর্বলতা প্রকট।
বাংলাদেশ সমস্যা আজ বিশ্ব-বিবেকের কাছে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ রূপে উপস্থিত হয়েছে। রাসেলের নেতৃত্বে এই “কদর্য্য ও মানব ইতিহাসের চরম মর্ম্মান্তিক ঘটনা” যে ভাবে জগৎ সভায় পেশ করা হত, আজ হয়ত তা সম্ভবপর হচ্ছে না। তাঁর অসাধারণ মহিমান্বিত ব্যক্তিত্ব জগৎবাসী সহজেই আকৃষ্ট হয়ে বলিষ্ঠতর কন্ঠে ফরিয়াদ জানাতে এগিয়ে আসত। কিন্তু তাই বলে যে বিশ্ববিবেক নিশ্চুপ হয়ে আছে, তাও ঠিক নয়।
বিশ্ববিবেক বলতে দুইটি সংজ্ঞাই উপস্থিত করতে হবে। একটি বিশ্ব মানব সমাজের বিবেক এবং অন্যটি বিশ্ব সরকার সমূহের বিবেক। জনগণের সার্বিক ইচ্ছাই ধরিত্রীর শেষ সিদ্ধান্ত। তাই বিশ্ব মানব সমাজ তার বিবেকে জর্জরিত হয়ে যে রায় ঘোষণা করে তাই সার্বভৌম। বিশ্ব সরকার সমূহের বিবেক তাদের চলার পথের স্বার্থকেই প্রথমতঃ প্রাধান্য দিতে অভ্যস্ত কিন্তু নিজ নিজ দেশের মানব গোষ্ঠীর সোচ্চার কন্ঠই শেষ পর্য্যন্ত সাময়িক স্বার্থান্ধ পথ থেকে বিশ্ব সরকার সমূহকে বিশ্ব মানব গোষ্ঠীর সম্মিলিত বিবেকের অনুশাসনকেই সম্মান দিতে বাধ্য করে তাই বিশ্ববিবেক নির্ভূল সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়।
ইতিহাসের জঘন্যতম নরঘাতক ইয়াহিয়া ২৫শে মার্চের রাতে পাকিস্তানকে টুকরো করেই শান্ত হয়নি। নিয়েছে দশ লক্ষাধিক মানুষের জীবন, ধন, মান, ঐশ্বর্য্য। বাংলার দু’কোটী মানুষকে করেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই বেদুইন—ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা বাংলার নদ-নদী ও গভীর জঙ্গলে। তাদের আজ কোন স্থায়ী বাসভূমি নেই। ইয়াহিয়া নরপিশাচ সেনাবাহিনী ও রেজাকারদের তাড়া খেয়ে তাদের যেতে হচ্ছে স্থান থেকে স্থানান্তরে। রূপান্তর ঘটিয়েছে সোনার বাংলাকে শ্মশানের প্রেতপুরীতে। দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে বাংলার হাজার হাজার বুদ্ধিজীবীকে এবং একই সঙ্গে ভারতে চলে এসেছে নব্বই লক্ষ বাঙালী। দুর্দশার চরম অবস্থায় তারা পতিত। বন্ধু-রাষ্ট্র সামলে উঠতে পারছেনা এই অকল্পনীয় ভারবোঝা। তাই ভারত জড়িয়ে পড়েছে এক অতি অস্বাভাবিক ঘটনা প্রবাহে। এ থেকে ভারতকে মুক্তি পেতে হবে এবং ভাগ্যাহত নব্বই লক্ষ মানব সন্তানকেও সসম্মানে ফিরে যেতে হবে তার মাতৃভূমি বাংলাদেশে। ভারত শুধু মানবতার খাতিরেই তার বর্ডার বন্ধ করে নাই। ভারতের বর্ডার বন্ধ করলে নরপশু সম্ভবতঃ এক কোটি বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে বাংলাদেশ আপাততঃ কবরের শান্তি এনে সারা দুনিয়াকে দেখাতে পারত যে সব কিছুই ‘নর্মাল’। নর-ঘাতকের ছোট্ট দোসর সুহার্তো যেমন ইন্দোনেশীয় লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করে প্রমাণ করে দিয়েছে বিশ্বসভায় যে ইন্দোনেশীয়ায় সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস যে সেই হত্যাকান্ডের অন্যতম দোসর ডাঃ আদম মালিকই আজ রাষ্ট্রসংঘের বর্তমান অধিবেশনের সভাপতি। সে কারণেই সভাপতির চেয়ারে আনুষ্ঠানিকভাবে বসার পূর্বেই ডাঃ মালিক নির্লজ্জের মত সাংবাদিক সম্মেলনে বলতে পেরেছে যে তার মতে বাংলাদেশ সমস্যা রাষ্ট্রসংঘের আলোচনা করায় কোন লাভ নেই।
বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার এই বর্বর ও পৈশাচিক আক্রমণের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল : বাঙালীকে জগত হিসাবে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে বাংলাকে চির দিনের জন্য পাঞ্জাবের উপনিবেশে পরিণত করা। পশ্চিমা সামরিক গোষ্ঠী, পুঁজিপতি দল এবং এক শ্রেণীর দালাল রাজনৈতিকের পূর্ণ সমর্থন ভিত্তি করেই নরপিশাচ বিংশ শতাব্দীর একাত্তর সনে এই নরমেধ যজ্ঞে অবতীর্ণ হয়। বিশ্বকে অন্ধকারে রেখে এই হত্যাকান্ড ২৬শে মার্চ চালিয়ে যেতে ইয়াহিয়া বাধ্য হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সকল সাংবাদিককে বাংলাদেশ থেকে বের করে দিতে এবং তাকে ফিরিয়ে দিতে হয় জেনেভা থেকে প্রেরিত রেডক্রশ বিমানকে করাচী বিমান বন্দর থেকে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও পৃথিবীর জানতে বাকী রইলনা সুপরিকল্পিত নরমেধযজ্ঞের মর্মন্তুদ হৃদয় বিদারক ঘটনা সমূহ। গণতন্ত্রের প্রহরী নির্বাচনে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টিকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান গ্রেপ্তার হলেন ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনীর হাতে এবং সেই গণতন্ত্রের মানব সন্তানকে বিচার প্রহসনের ছুতায় হত্যার হুমকি দিচ্ছে জুন্টা ও ইয়াহিয়া। বঙ্গবন্ধুর অপরাধ তিনি সারা পাকিস্তানের নির্বাচনে জয়ী হয়ে পাকিস্তানের আইনতঃ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ছয় দফার মাধ্যমে চেয়েছিলেন একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী পাকিস্তান গড়ে তুলতে। বঙ্গবন্ধু কুলাঙ্গার ইয়াহিয়ার হিংসার আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি গান্ধীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের দ্বারাই চেয়েছিলেন পশ্চিমা শাসক ও শোষক গোষীর বিবেককে কষাঘাত করে পাকিস্তানের চিরবঞ্চিত বার কোটি বাঙালী, সিন্ধি, পাঞ্জাবী, বেলুচী ও পাঠানদেরকে তাদের স্বাধিকার ফিরিয়ে দিয়ে একটি শক্তিশালী পাকিস্তানের ভিত্তি স্থাপন করবেন।
এই আজ বাংলার ইতিহাস। বিশ্ব-বিবেক স্তব্ধ করতে পারেনি ইয়াহিয়া। পাকিস্তানী দূতাবাসগুলো এবং ভাড়াটিয়া বিদেশী লোক মারফৎ ঘটনাকে ‍পৃথিবীব্যাপী বিকৃত করে দেখাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জঙ্গীশাহী। শেষ অধ্যায়ে বাঙালী বলে কুখ্যাত এক দালালকে এই বৎসরের রাষ্ট্রসঙ্ঘ অধিবেশনে পুতুলনেতা বলে পাঠিয়েছে। বাংলাদেশে অসামরিক শাসনের ভাঁওতা হিসেবে জেনারেল নিয়াজীর অধীনে আর এক পুতুলকে বসিয়েছে গভর্ণর বলে চিহ্নিত করে। ক্ষান্ত হয়নি কুচক্রী সামরিক জুন্টা এ খানেই। তাই বাংলাদেশকে আর এক চপেটাঘাত দিয়েছে কতকগুলো অখ্যাত কুখ্যাত মানুষ নামধারী পশু দিয়ে তৈরী একটি পুতুলনাচের মন্ত্রিসভা গঠন করে। সারা পৃথিবীকে ধোঁকা দেয়ার জন্য তৈরী করেছে কয়েকটি শরণার্থী শিবির। বিদেশের সম্মানিত অতিথিরা সেখানে শরণার্থী দেখতে পাননি, দেখেছেন নেড়ী কুকুর ও গবাদিপশুর সমাবেশ। ইয়াহিয়ার এতবুদ্ধিও ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি পৃথিবীর বিভিন্ন দূতাবাসের দেশপ্রেমিক বাঙালী কর্মচারীদেরকে আর রাষ্ট্রসঙ্ঘের স্থায়ী কর্মচারীদেরকেও; তারা আনুগত্য প্রকাশ করেছে স্বাধীন গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি। জাপান, পশ্চিম জার্মানী, রাশিয়া, ফ্রান্স, কানাডা, বৃটেন, অষ্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, মেক্সিকো, ল্যাটিন আমেরিকা ও অন্যান্য দেশের বিশিষ্ট সর্বজনমান্য নাগরিক ও পরিষদ সদস্যরা ঘুরে গেছেন বাংলাদেশ, সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকায় ও ভারতে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরগুলো এবং দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে তারা ইয়াহিয়ার গণহত্যার তীব্র নিন্দা করেছেন। বিশ্বের নামকরা সংবাদগুলো এবং বিশেষ করে বৃটেন, জাপান, সোভিয়েত রাশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার সংবাদপত্র তীব্রভাষায় নিক্সন সরকারের ইয়াহিয়া-তোষণনীতির সমালোচনা করেছেন এবং বাংলাদেশ সরকারের অনুসৃত নীতির প্রতি সমর্থন জুগিয়েছেন। বিশ্বব্যাংক ও বৈদেশিক সাহায্যদাতা দেশগুলিও পুনরায় জানিয়ে দিয়েছে দেউলিয়া জঙ্গীশাহীকে তাদের সাহায্য দেওয়ার অপারগতা, যতদিন পর্যন্ত না বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে। গত ৩রা অক্টোবর সেই পিটার্স স্কোয়ারে মহামান্য পোপ পল ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশ শরণার্থীদের সম্পর্কে তাঁর গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশ্বব্যাপী রোম কাথলিক সম্প্রদায়ের অনুসারীদেরকে নির্দেশ দেন ৯ই অক্টোবর দিবসকে তারা যেন প্রার্থনা ও উপবাস দিবস হিসাবে পালন করে ঐদিন তারা শরণার্থী সাহায্যে আর্থিক সংগ্রহে ব্যয় করেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের অধিবেশনে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, সুইডেন, ইকুয়েডর, ভারত, নরওয়ে, বেলজিয়াম, মেক্সিকো অত্যন্ত জোরালো ভাষায় বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দাবী করে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। বৃটেনও সমস্যার দ্রুত সমাধান দাবী করে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে এ সমস্যার সমাধান না হলে পাক-ভারত যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। এমনকি এ পর্যন্ত উগান্ডা, জাম্বিয়া, আর্জেন্টিনা, নেদারল্যান্ডস ও চিলি বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের তাগিদ দিয়েছে। গত ৪ঠা অক্টোবর জাতিসঙ্ঘ অধিবেশনে আমেরিকার পররাষ্ট্র সচিব মিঃ রজার্স বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে উল্লেখ করেও ঐ একই বক্তৃতায় বলতে বাধ্য হয়েছেন যে শরণার্থী সমস্যা বিশ্বসমাজের বিবেচ্য বিষয় এবং এর সমাধান করতে হবে। প্রত্যক্ষভাবে না হোক পরোক্ষ ভাবে নিক্সন সরকারকেও আজ বিশ্ববিবেকের কাছে মাথা নত করতে হচ্ছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব উ-থান্ট তার বার্ষিক রিপোর্টে বাংলাদেশের ঘটনাকে “মানব ইতিহাসের শোচনীয়তম ঘটনা” বলে উল্লেখ করেছেন। মাত্র দেড় সপ্তাহের অধিবেশনেই দেখা যাচ্ছে যে বিশ্ববিবেক বাংলাদেশ সমস্যাকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হচ্ছে, যদিও প্রতিবন্ধকতায় দাঁড়িয়ে আছে খড়গহস্তে মহাচীন ও নিক্সন আমেরিকা। চলতি রাষ্ট্রসঙ্ঘ অধিবেশনের ফলাফল যাই দাঁড়াক, বাংলাদেশ যে এক নূতন রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে, তার এক ধ্রুব সত্য। বিশ্ববিবেক সামগ্রিকভাবে যেন শীঘ্র এই সত্যটুকু সরকারী ভাবে মেনে নেয়, তাই আমরা ঐকান্তিকভাবে আশা করি।
বাংলার মুক্তি বাহিনীর অসাধারণ শৌর্যবীর্য্যই শেষ পর্য্যন্ত বিশ্বের সরকার সমূহের বিবেককে সঠিক পথ দেখাবে এ বিষয় বাংলার মুক্তি পাগল সাড়ে সাত কোটি মানুষ দৃঢ় আস্থা পোষণ করে এবং জয় আমাদের সুনিশ্চিত।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল