You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.10 | শ্যামনগর-কালিগঞ্জ দুর্জয় ঘাঁটি কিন্তু... | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১০ অক্টোবর ১৯৭১

শ্যামনগর-কালিগঞ্জ দুর্জয় ঘাঁটি কিন্তু…
—মিন্টু বসু

শারদীয়ার ছুটি অতএব হাতে প্রচুর সময়। কেননা এবার তো আর পূজোর ব্যস্ততা নেই। তাই ভেবে চিন্তে ঠিক করলাম, মুক্তি বাহিনীর ঘাঁটি পরিদর্শন করতে যাব। ২৭শে সেপ্টেম্বর বৈকাল চারটায় আমরা চারজন বেরিয়ে পড়লাম। সম্পাদক : নুরুল আলম ফরিদ, কর্মাধ্যক্ষ : মোহাম্মদ ইউসুফ, একজন মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজ বাঙালী এবং আমি। রূপসী বাংলার আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে চলছি। মুক্তাঞ্চলের মুক্ত হাওয়ায় মন আমাদের রঙিন পাখা মেলেছে। কিন্তু তবুও অন্তরের অন্তস্থলে একটা ব্যথা গুমড়ে গুমছে উঠছে—আমার এমন সোনার বাংলা আজ শ্মশান—শ্মশান করেছে পাক রক্ত-লোলুপ জঙ্গী শাহী। বর্বর পাক সৈন্যর অত্যাচারে বাঙলা মা আমার লাঞ্ছিতা, অপমানীতা! এ যে নিদারুন মর্মান্তিক।
পথ চলছিলাম আর একথা ভাবছিলাম হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টিতে ভিজেই এগিয়ে চললাম। কিছুদূর এগুতেই সেলিং এর শব্দ শুনতে পেলাম। গ্রামের লোকমুখে শুনলাম, মুক্তি বাহিনী বসন্ত পুরের পাক ছাউনি আক্রমণ করেছে। মনে হল ঐ বিকটাকার শব্দগুলো যেন আমাদেরকে সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছে—দ্রুত এগিয়ে চললাম। রাত তখন আটটা। ঘাঁটির কাছাকাছি এসে পৌঁছলাম। এবার আমাদেরকে অতি সন্তর্পণে এগুতে হবে। কেননা দু’পক্ষেই গোলাগুলি হচ্ছে অতএব এবার আমরা ক্রোলিং করে এগুতে লাগলাম। এমন ভাবে কিছুদূর এগুনোর পর ঘাঁটিতে এসে পৌঁছলাম;
এর কিছুক্ষণ বাদেই গোলাগুলি থেমে গেল। আরো পরে ক্যাপ্টেন হুদা এবং এগারজন মুক্তিযোদ্ধা সমস্ত গায়ে কাঁদামাখা অবস্থায় ক্যাম্পে ফিরে এলেন, তাঁর মুখেই শুনলাম বসন্তপুরে তিনি এবং তাঁর দল স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলতে সক্ষম হয়েছেন, দুঃসাহসিক ক্যাপ্টেন এবং তাঁর সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধায় স্বভাবতই মাথাটা নুয়ে এল। মনে মনে বললাম, বাংলাদেশ আজ আর দুর্বল নয়। বাংলার এই দুর্জয় শক্তি আমার জননী জন্মভূমিকে মুক্ত করবেই।
কয়েকশত মুক্তি যোদ্ধাদের সঙ্গে লাইনে বসে আহার পর্ব সমাধান কবে তাবুর নীচে রাতের মত আশ্রয় নিলাম।
ভোরের ঘুম ভাঙাল আবার সেই শব্দ। শুনলাম শ্যামনগর ও কালিগঞ্জ দখল করার জন্য পাক সৈন্যরা আমাদের উপর আক্রমণ করেছে। মুখ হাত ধুয়ে আসতেই ক্যাপ্টেন সাহেবের চায়ের টেবিলে ডাক পড়ল আমাদের। সবে গিয়ে বসেছি ঠিক তখনই সংবাদ এল পাক সৈন্যরা পিরোজ পুরের বাঙ্কার দখল করে নিয়েছে, তাই ৫০ জন মুক্তি যোদ্ধা এবং গোলাবারুদ পাঠাতে হবে।
দেখলাম মুহূর্তমধ্যে ৫০ জন মুক্তি যোদ্ধা নিয়ে ক্যাপ্টেন সাহেব যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন।
হঠাৎ আমরা স্থির করলাম এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করব। ক্যাপ্টেন সাহেবকে বলায় তিনি সব ব্যবস্থা করে দিলেন। প্রথমে অবশ্য তিনি আপত্তি করেছিলেন। যাহোক আমরা তিনজনে তিনটি ষ্টেন গান নিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা সাহেবের সঙ্গে রণাঙ্গনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। (বলা বাহূল্য আমাদের ইউসুফ সাহেব বিশেষ কারণে পত্রিকা কর্মস্থলে চলে গিয়েছিলেন।)
বেলা দশটায় গিয়ে পৌঁছলাম শ্যামনগর থানার পিরোজপুরে। আমাদের যেখানে ডিফেন্স ছিল তার থেকে দু’শ গজ দূরে শত্রু সৈন্য। দাঁড়িয়ে দেখলাম দু’শ গজ দূরে আমাদের বাঙ্কারের মধ্যে খান সেনারা। দু’পক্ষেই সমানে গোলাগুলি চলছে। শুনলাম এর মধ্যেই প্রায় ৫০/৬০ জন রাজাকার সহ শত্রু সৈন্য খতম হয়েছে আমাদের অসম সাহসী মুক্তি যোদ্ধাদের কাছে।
ক্যাপ্টেনের নির্দেশে আমরা পাঁচ’শ গজ পিছনে সরে এলাম ঠিক চৌমাথার ওখানে। সেখান থেকেই থ্রি ইঞ্চি মর্টার থেকে সেলিং শুরু করলেন ক্যাপ্টেন সাহেব। সমস্ত দিনটা সেখানেই কেটে গেল।
সবচেয়ে আশ্চর্যের যে, দু’পক্ষে সমানে গোলাগুলি চলছে আর তার মধ্যেও গ্রামের জনগণ বিপুল উৎসাহ উদ্দিপনা নিয়ে মুক্তি বাহিনীকে সাহায্য করে চলছে। কেউ গোলাবারুদ মাথায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কেউ মুক্তি বাহিনীর খাবার তৈরী করছে, আর কেউ ডিফেন্স থেকে সংবাদ এনে দিচ্ছে। প্রতিটি জনগণের দৃঢ় বিশ্বাস মুক্তি বাহিনী হানাদারদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হবে। তাছাড়া আর একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, এখানের মানুষগুলো আজ আর গোলাগুলিকে ভয় পায়না, গোলা বারুদ এদের কাছে যেন তুচ্ছ। দরকারে জীবন দিতেও এরা প্রস্তুত।
হঠাৎ দেখলাম জনৈক মুক্তি যোদ্ধা কালিগঞ্জের দিক থেকে ছুটে আসছেন। কাছে আসতে জানতে পারলাম, কালিগঞ্জে ৪ জন পাক সেনা খতম হয়েছে। ক্যাপ্টেন হুদা ধন্যবাদ জানালেন এই সময় সাহসী মুক্তি যোদ্ধাকে।
এক বৃদ্ধ এলেন কয়েকটি ডাব নিয়ে। এই বৃদ্ধের একমাত্র ছেলে ডিফেন্সে যুদ্ধ করছে। ছেলেকে না পেয়ে ডাবগুলো সব আমাদের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন। ছেলের জন্য একটা রাখতে বলায় তিনি বললেন, “আপনারাও তো আমার ছেলে।” বৃদ্ধের দৃঢ় এই মনোবল সবাইক মুগ্ধ করল।
বৃদ্ধের কথা শুনে মনটা হারিয়ে যেতে চাইল। আমার সোনার বাংলার প্রতিটি মানুষ যদি বৃদ্ধের মত খাঁটি সোনা হত, তাহলে হয়ত এতদিনে জঙ্গী ইয়াহিয়ার শক্তি মা দশভূজার অসুর দলনের মতই ধ্বংস হয়ে যেত বাংলার লাল সূর্যটা পশ্চিমে এ নেমে গেল বাংলার তরুণ শক্তিকে অভিনন্দন জানিয়ে। একজন তরুণ মুক্তি সেনা আহত হয়েছে তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিতে হবে তাকে হাসপাতালে। ভার পড়ল আমাদের তিনজনের উপর। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আহত সৈনিককে নিয়ে ফিরে চললাম দুর্জয় ঘাঁটি শ্যামনগর পরিত্যাগ করে—
হে দুর্জয় ঘাঁটি শ্যামনগর তোমায় অভিনন্দন—অভিনন্দন বাংলার শক্তিকে, যারা শ্যামনগর মুক্ত রাখার জন্য জীবন পণ যুদ্ধ করে চলছে—বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্যকে—
কয়েকদিন পর জনৈক মুক্তি যোদ্ধা দুঃসংবাদ বহন করে নিয়ে এলেন, শ্যামনগর কালিগঞ্জ হানাদাররা দখল করেছে। শোনার সঙ্গে সঙ্গে পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সোনার বাংলা কি তবে দখলদারদের থেকে মুক্ত হবেনা? ভাবনার অবসান করলেন মুক্তি যোদ্ধাই, “ভাবছেন কেন এত সাময়ীক পরাজয়, দেখবেন কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা হানাদারদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হব। তাছাড়া গেরিলা যুদ্ধের নিয়মইতো এমনি।”
এরপর শ্যামনগর, কালিগঞ্জ থেকে কি কারণে মুক্তি যোদ্ধারা সরে এলেন সে সম্পর্কে জানতে চাইলাম—উত্তরে বললেন, “আমাদের সবচেয়ে অস্ত্রের অভাব, যার জন্য এই সাময়ীক পরাজয়। আমাদের কাছে অস্ত্র বলতে রাইফেল, এল.এম.জি ও দু’একটা থ্রি-মর্টার আর ওরা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত কাজেই ওদের মত যদি আমাদের আধুনিক অস্ত্র থাকত তো বুঝিয়ে দিতাম মুক্তিযোদ্ধারা কত দুর্বার।”
এ কথার পর মনকে প্রবোধ দিয়েছি এই বলে, একদিন বিশ্বকে বাংলাদেশের মুক্তি যোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবেই কিন্তু সেদিন আরও কতদূর?

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল