বিপ্লবী বাংলাদেশ
১০ অক্টোবর ১৯৭১
রাজনৈতিক সমাধান
মেহেরুন আমিন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষ শক্তি হিটলারের নেতৃত্বে রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি লংঘন করে সোভিয়েট রাশিয়া আক্রমণ করে। ইয়াহিয়ার পূর্বসূরী হিটলারের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে মস্কোর ক্রেমলিন প্রাসাদে বিজয়োৎসব পালন করবে। রাশিয়া অভিযানই ত্বরান্বিত করল নরপশু হিটলারের বিপর্য্যয়। ঘটনা প্রবাহ তাকে ও তার মিষ্ট্রেস একা ব্রাউন বার্লিন সহরের আন্ডার গ্রাউন্ডেই আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে। ইতিহাসের এক নির্ম্মম ধ্বংসলীলা ও হত্যাকান্ডের নাটকের যবনিকাপাত দ্রুততর হল।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান নামক এক রাষ্ট্রের অবিসম্বাদিত নেতা নির্বাচিত হলেন বাংলার প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। সারা পৃথিবী শ্রদ্ধাবনত হৃদয়ে মেনে নিল নির্বাচনের রায়। ক্ষমতা লোলুপ পিন্ডির জঙ্গীশাহী, মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি ও কতিপয় পা-চাটা রাজনৈতিক দালাল সহ্য করতে রাজী হলনা জনতার নির্বাচনী রায়। শুরু হল আদি ও অকৃত্রিম “পাকিস্তানী মার্কা ষড়যন্ত্র”। নেতৃত্বে নেমে এল সেনাপতি ইয়াহিয়া এবং তার সঙ্গী দোসর হামিদ, টিক্কা, নিয়াজী, ওমর ও পিরজাদা। এদের সঙ্গে দালালীর হাত বাড়াল ভুটো, কাউয়ুম ও অন্যান্য। ইয়াহিয়া ১লা মার্চ রেডিও মারফৎ জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনের তারিখ অনির্দ্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করল। উত্তরে জাতির পিতা শেখ মুজিব বাংলাদেশ ব্যাপী অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলেন। আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ত গতি ও ব্যাপকতা ঘাবড়ে দিল জঙ্গীশাহীকে এবং তাই “মুজিব-ইয়াহিয়া” দীর্ঘ আলোচনার ভন্ডামীর মাধ্যমে সমর প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করে ২৫শে মার্চ রাতে নরঘাতক টিক্কাকে লেলিয়ে দেয়া হল তেইশ বৎসরাধিক নির্যাতত, নিপীড়িত, শোষিত সাড়ে সাত কোটির এক মানবগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। লাখো লাখো নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিল। ভস্মীভূত হয়ে গেল বাংলার জনপদ ও গ্রামগুলো। নব্বই লক্ষ লোক নিজ দেশের ভিটেমাটি ছেড়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিল। হাজারো হাজারো মা বোনের ইজ্জৎ লুটে নিল ইয়াহিয়ার পশ্চিমা সেনাবাহিনী। ইয়াহিয়া গ্যাং ঠিক হিটলারের মতই ভেবেছিল যে আটচল্লিশ ঘন্টায় সোনার বাংলাকে চিরদাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ করবে। ছ’মাস চলে গেছে, বাংলার শহরে গ্রামে প্রতিরোধ সংগ্রাম আজ ব্যাপকতায় ভীষণতর হয়ে প্রতিশোধের শেষ পর্যায়ের দ্বারে উপস্থিত। বাংলার স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছে হানাদার বাহিনীকে চরম আঘাত হানতে। অবাক বিস্ময়ে বিশ্ব চেয়ে দেখছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানী ডালকুত্তা বাহিনীর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার নাটকীয় ঘটনাবলী। রুখতে পারছেনা ডালকুত্তার দল মুক্তি বাহিনীর স্থল ও নৌ আক্রমণের দুর্বারগতি। ইয়াহিয়া দিকে দিকে দালাল পাঠাচ্ছে এবং নিজেও দোস্ত ইরানের শাহের দরজায় মাথা কুটছে একটী রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য।
রাজনৈতিক সমাধান কি সম্ভব? রাজনৈতিক দাবার গুটি যে আজ ইয়াহিয়ার হাতের বাইরে। ইয়াহিয়া ও তার গ্যাং ধ্বংস করে দিয়েছে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে তৈরী জিন্নার সাধের পাকিস্তান। ঐ ধ্বংস্তূপের মধ্যে জন্ম নিয়েছে একন নূতন জাতি এবং তাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীন, সার্বভৌম গণ প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ। পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতিদলের এক বিরাট অংশ আজ ইয়াহিয়ার ঘোর বিরোধী। কল কারখানার হাজার হাজার শ্রমিক আজ চাকুরী থেকে বরখাস্ত। মুষ্টিমেয় কয়েকজন জেনারেল ভিন্ন অন্য সেনানী মন্ডলী ইয়াহিয়ার অবিমৃষ্যকারিতায় তার প্রতি বিরূপ। ইয়াহিয়ার বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ দাঁড়াবে পশ্চিম পাকিস্তানের এত দিনকার জৌলুসে গড়া শিল্প, বাণিজ্য, চাকরী-বাকরী ও সেনাবাহিনীর চরম বিপর্যয়। তারা হারাবে বাংলাদেশে সাজান ঔপনিবেশিক বাজার। ইয়াহিয়ার সাধ্য নেই যে সে বাংলাদেশকে স্বাধীন বলে স্বীকার করে নেয়া। তাই বাংলাদেশ আজ ইয়াহিয়ার গলার কাঁটা—একে গেলাও যাচ্ছেনা বা ফেলতেও পারা যাচ্ছেনা। সাধু সজ্জন ব্যক্তিরা বলেন যে ইংল্যান্ড যেভাবে পাক-ভারত সমস্যার সমাধান করেছে, সে ভাবেই বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে। তাঁরা ভুলে যান যে ব্রিটিশ জাতির পাক-ভারত নীতি নির্দ্ধারিত হয়েছিল ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে এবং তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব বর্তেছিল ইংল্যান্ডের আপামর জনসাধারণের উপর। পাকিস্তানের বর্তমান চন্ডনীতি নির্দ্ধারণ করেছে ইয়াহিয়া গ্যাং। বার কোটি অধ্যুষিত অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের জনগণের কোন সম্পর্ক ছিলনা এই বর্ব্বর জঙ্গী নীতির সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ণ দায়িত্ব বর্তাবে বলদর্পী জঙ্গীশাহী ও তার মুষ্টিমেয় অনুচরদের উপর। সেই ভীষণ দিনে রুদ্ধ আক্রোশে ফেটে পড়বে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী, পুঁজিপতি গোষ্ঠী ও জনসাধারণ। তা থেকে ইয়াহিয়া ও তার মন্ত্রণাদাতাদের বাঁচবার কোন উপায় থাকবে না। তাই আজ ইয়াহিয়াকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই আত্মঘাতী যুদ্ধ চালিয়ে যেতেই হবে। ইয়াহিয়া অবশ্যই বুঝতে পেরেছে যে অনির্দ্দিষ্টকাল এ যুদ্ধ চালাবার ক্ষমতা তার নেই। চীন-মার্কিন সাহায্যও তাকে টিকিয়ে রাখতে পারবেনা পিন্ডীর সিংহাসনে। অথচ ইয়াহিয়া এও জানে যে বাঙালী জাতিকেও এ যুদ্ধ চালাতেই হবে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে। কোন মীমাংসা “পাকিস্তানী কাঠামোর” মধ্যে হবেনা ও হতে পারেনা। ইয়াহিয়ার এখন একমাত্র উপায় পাক-ভারত যুদ্ধ বাধিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের হ্স্তক্ষেপে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধান বের করার চেষ্টা করা। সেক্ষেত্রে হয়ত সেও তার বশম্বদরা পশ্চিম পাকিস্তানী জনসাধারণের আক্রোশ থেকে জীবনে বেঁচে যেতে পারে। অন্যথায় হার্মাদ ইয়াহিয়া ও তার স্তাবকদের হিটলারের মতহই আত্মঘাতী হয়ে নরকের বংশ বৃদ্ধি করতে হবে।
কিন্তু এত সবের পরও একটা মোদ্দাকথা এই যে রণক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় সম্মিলিত সেনাবাহিনীর ক্রমাগত দাঁতভাঙ্গা জবাবই শুধু লম্পট ইয়াহিয়া হানাদার বাহিনীকে বাধ্য করবে বাংলার পবিত্র মাটি ছেড়ে যেতে এবং সেখানেই নিহিত রয়েছে বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল