বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
দিন বদলের পালা
—পরিতোষ রায় চৌধুরী
(ভারতীয় প্রতিনিধি প্রেরিত)
পঞ্চাশের দশকের কোন এক সময়ে কলকাতায় এসে ঐতিহাসিক টয়নবী ধন্বন্তরীর মত পশ্চিম বাংলায় মুখে আসন্ন মৃত্যুর ছায়া দেখেছিলেন। গড়পড়তা শিক্ষিত বাঙালীর অকারণ বাকচাতুর্য্য, শারীরিক শ্রমে অপটুত্ব না হোক সাধারণতঃ অনিচ্ছা, ধরাবাঁধা কলমপেষার কাজ ছেড়ে অজানার উজান বাইতে প্রবল বিতৃষ্ণা, বাংলা ভাষা সম্পর্কে হীনম্মন্যতা আর হিন্দী-উর্দু-ইংরাজী সম্পর্কে আত্মঘাতী মোহ, উত্তর ভারতের ইতিহাস-পুরাকাহিনীর সঙ্গে রোমান্টিক ঐক্যবোধ, সেই সংগে বাংলার ইতিহাসের চারণভূমি সম্পর্কে কৌতূহলের একান্ত অনুপস্থিতি, আর সব চেয়ে আশ্চর্য্য ব্যাপার—বাংলা বাদে ভারতের অন্য প্রান্তকে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক মরুভূমি বলে মনে করা (অজ্ঞতার সংগে আত্মম্ভরিতার রাজযোটক), যদিও নিজেদের বাস অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পেছনের আঙ্গিনায়, যেখানে দুটো-একটা শাক-সবজী ছাড়া আর কিছু ফলাবার হিম্মৎ তার নেই—ক্ষয়িষ্ণু বাঙালীত্বের সব কটি লক্ষণই সম্ভবত তাঁর চোখে পড়েছিল।
কালক্রমে, বাংলাদেশে দিন বদলের পালা শুরু হ’য়ে গেল। ভাষা-আন্দোলন তার প্রথম অঙ্ক (শিলচর-কাছাড়ে তার প্রতিধ্বনি শোনা গেল অনেক দিন পরে, কিন্তু ধুবড়ী-গোয়ালপাড়ায় সে ধ্বনি মূক হ’য়ে থাকল)। আজকের মুক্তিযুদ্ধ এই নাটকের শেষ অঙ্ক। এর পর বাংলাদেশে নতুন নাটক লেখা হ’বে। সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবার আগে দুটি বলিষ্ঠ বাহু, সংগ্রামী বাংলার সৈনিক আসন্ন মৃত্যুর পঙ্ক থেকে বাঙালীকে টেনে তুলছে, বাংলাকে বাঙালীত্বকে স্বাধিকারে প্রতিষ্ঠিত করবে ব’লে। বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষদের যত দেখছি তত মনে হ’চ্ছে বোধ হয় ‘স্বদেশী যুগ’ আবার ফিরে এলো, কিম্বা বুড়িবালাম-জালালাবাদের রক্তঝরা দিনগুলি। কুন্তলদার কথা মনে পড়ে যায়, কুন্তলদার হ’লেন চট্টল-বীর সূর্য্য সেনের ছায়ায় আঁকা এক আশ্চর্য্য চরিত্র১। মুক্তিসেনারা তাঁরই সূর্য্য–শপথকেই ভাস্বর করে তুলেছে। তাই যুগান্তের ঘুম ভেঙে ক্ষুদিরাম, বাঘা, যতীন, নেতাজীর সাথে আরো হাজারো অখ্যাত স্বাধীনতা সৈনিক নিঃশব্দ পদ সঞ্চারে উঠে আসেন ইতিহাসের পাতা থেকে, আর তাঁদের বিদেহী আত্মার আশীর্বাদ রেখে যান মুক্তি যোদ্ধাদের জন্য, যাঁরা অনেক রক্ত দিয়ে ‘বাংলাদেশ’ এ ইতিহাস সৃষ্টি করছেন। এক আশ্চর্য্য অনুভূতিতে মন ভরে যায় যখন স্বাধীন বাংলা বেতারে শুনি,
“সোনা, সোনা, সোনা, লোকে ব’লে সোনা,
সোনা নয় তত খাঁটি
বল যত খাঁটি, তার চেয়ে খাঁটি
বাংলা দেশের মাটিরে
আমার জন্মভূমির মাটি।”
কিম্বা ঘরের ঠিকানা হারিয়ে যারা নিরুদ্দেশের যাত্রী হয়েছে দুঃস্বপনের রাত্রিটাকে ছিঁড়ে ফেলতে :-
“জানি শুধুই চলতে হ’বে
এ তরী বাইতে হ’বে
আমি যে সাগর মাঝিরে;
তীর হারায়ে ঢেউ-এর সাগর পাড়ি দেব রে।”
জঙ্গীশাহীর রুদ্রঝড়ে বাংলার আকাশ যখন বারবার ভেঙে পড়ছে, তখনও তরী বাইতে হ’বে, এ মরণ নদীর খেয়া পার হ’তেই হ’বে। পাশাপাশি যখন ঢাকা বেতারের প্রচারণা শুনি তখন মনে হয়, ইসলামের দোহাই পেড়ে বাংলার অতীতের সংগে পূর্ণ বিচ্ছেদের কী হাস্যকর প্রয়াস। ওদের যন্ত্র-সংগীত শুনে মনে হয় জ্বলন্ত রোমের পটভূমিতে নীরেরা মত ইয়াহিয়া বেহালার ছড়ে আর্তনাদ তুলছেন, বাজাচ্ছেন পাকিস্তানের অন্তিম-সংগীত। মাঝে মাঝে ‘কওমি নাগমা’ শুনিয়ে নদীঘেরা ‘পাকজমিন পাকওয়তন’-এর (যার মানুষদের শুধু বাঙালী হওয়ার অপরাধে খুন করা হ’চ্ছে) খোয়াব দেখিয়ে পাকিস্তানের জয়গান গাইলে মৃত পাকিস্তান কবর থেকে উঠে আসবে না। আশ্চর্য্য নয়, মুক্তি যুদ্ধের প্রথম দিনগুলিতেই নওগাঁ (রাজসাহী) সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় (৩০ মার্চ, ১৯৭১) রঙ্গলালের বিখ্যাত পংক্তিগুলি উদ্ধৃত করা হয়েছিল :-
“স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে
চায় হে কে বাঁচিতে চায়
দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায়
হে কে পরিবে পায়।”
বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্ববিবেক যাই বলুক, ভারত ছাড়া অন্য রাষ্ট্রের বিবেক ঘুমিয়েই থাকবে, অন্তত বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির, যাদের স্বার্থ এই উপমহাদেশে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধে আছে। সন্দেহ থাকলে সম্প্রতি প্রকাশিত ভিয়েৎনামের ওপর পেন্টাগনের গোপন দলিলগুলি দেখতে বলি, কী করে বিশ্ব জনমতকে হেলায় তুচ্ছ করে দস্যুতার পুচ্ছটি ঊর্দ্ধে নাচাতে হবে তার সাফাই গাওয়া আছে। পূবের বাঙালীর দেহ মনের ওপর পাকিস্তান যে দাসত্বের শৃঙ্খল পরিয়েছিল সেটাকে চূরমার করতে হবে। ফরাসী বুদ্ধিজীবী আঁদ্রে মালরোর ভাষায় বলি : “চল্লিশ বছরের পুরানো এ্যাংলো স্যাকসন উদারনৈতিকতার কাছে আবেদন জানিয়ে কিম্বা অন্যমনস্ক আমেরিকানদের সুবুদ্ধির উপর ভরসা করে বাংলাদেশের কোন লাভ নেই। বাংলাদেশকে তার আত্মশক্তির উপর নির্ভর করতে হবে। যা জরুরী দরকার, তা হচ্ছে সামরিক সংগঠন। বাংলাদেশকে হয় ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত যুদ্ধে শেষ হয়ে যেতে হবে, নইলে গেরিলা সৈন্যদের সংগঠিত করে পাকিস্তানকে পরাজিত করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ সকল সময়ই সাহসের পরিচয় দিয়েছে।”২। আরও সাহসের পরিচয় দিতে হবে, তবেই বাংলাদেশ জয়ী হবে।
টীকা
(১) মনোজ বসু ‘ভুলি নাই’
(২) আব্দুল গফফার চৌধুরী, “মত ও পথ” ‘সাপ্তাহিক বাংলা’ ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ পৃঃ ৪ এ উদ্ধৃত।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল