You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.26 | হয় ব্লিৎস্ ক্রীগ, নয়....? —মৌলানা খাফী খান | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

হয় ব্লিৎস্ ক্রীগ, নয়….?
—মৌলানা খাফী খান

কিছুদিন আগে ভারতের ষ্টেটম্যান কাগজে একটি প্রবন্ধ বেরিয়েছিল বাংলাদেশের জনযুদ্ধ সম্পর্কে। তাতে লেখক মন্তব্য করেছিলেন যে এ-যুদ্ধ দীর্ঘকাল স্থায়ী হলে দু-পক্ষেরই অসুবিধা হবে, মুক্তিযোদ্ধাদেরও এবং পাক হানাদারদেরও। অতএব মুক্তি-যোদ্ধাদের এ-যুদ্ধটা তাড়াতাড়ি জিততে হবে। নইলে—
একজন প্রবন্ধটির জবাব দিয়েছিলেন। লেখাটি পড়ে মনে হল লেখক নিজে প্রাক্তন যোদ্ধা—সম্ভবতঃ ভারতীয় সৈন্যদলের। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ সম্বন্ধেও তাঁর সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা থাক বা না থাক, জ্ঞান আছে। তিনি বলেছিলেন যে ‍যুদ্ধ দীর্ঘকাল স্থায়ী হলে মুক্তিযোদ্ধাদের যত অসুবিধা হবে, তার চেয়ে বেশী অসুবিধা হবে পাক হানাদারদের। অতএব এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা শীঘ্রই জয়লাভ না করলে যে কোনো মারাত্মক ক্ষতি হবে তা মনে করা অযোক্তিক।
প্রবন্ধলেখক এর পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন। জবাবটাতে প্রতিবাদকারীর মূল প্রতিপাদ্য খন্ডন করা হয় নি। যা বলা হয়েছে তা কতক অবান্তর, আর কতক অর্ধসত্য—যেমন লরেন্স ভাড়াটে সৈন্য নিয়ে লড়াই জেতেন নি—তাঁর পিছনে ছিল আরব জাতীয়তাবাদ, উইংগেট ও বর্মী জাতীয়তাবাদের সমর্থন পেয়েছিলেন। এঁর অর্থ সত্যগুলোর মধ্যে অর্ধ মিথ্যা হচ্ছে—লরেন্স এবং উইংগেট যে পুরোপুরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বাহক ছিলেন এই সত্য গোপন। বর্মা যখন স্বাধীন হতে চাইল তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ প্রাণপণে চেষ্টা করেছিল তাতে বাধা দিতে। তখন যদি উইংগেট জীবিত থাকতেন, নিঃসন্দেহে বলো যায় যে তিনি সমর্থন করতেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে—বর্মার জাতীয়তাবাদকে নয়। কারণ তিনি এবং তাঁরা ছিলেন পুরোপুরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যাবাদের আপনজন।
লরেন্স এবং উইংগেটের উপমাটা অবান্তরও বটে। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে কোনো লরেন্স-উইংগেট নেই; আছে শুধু বাংলাদেশের মানুষ। এ-যুদ্ধে যারা রক্ত দিয়ে লড়ছে তারা কোনোক্রমেই পাক-শোষকদের ভাই বেরাদরে পরিণত হবে না। এবং এযুদ্ধে জয়লাভ করার সময়-সূচী নির্মাণ করার চাইতে অনেক বেশী দরকারী কাজ হচ্ছে সেই মানুষের সংহতি ও শক্তি আরও সুদৃঢ় করা, এবং পাক হানাদারদের যুদ্ধযন্ত্রটাকে আঘাতের পর আঘাত দিয়ে আরও অক্ষম, আরও বিকল করা।
ওদের কী আছে? আছে শুধু যন্ত্রটা। ওটা দিয়ে শুধু ভাঙাই যায়, গড়া যায় না। কী ভাঙতে চায় ওরা? সেই বস্তু, যা গ্রাম জ্বালিয়েও পোড়ানো যায় না, শস্য লুট করেও ছিনিয়ে নেওয়া যায় না, নেতাকে কারাবন্দী করেও মুঠোর মধ্যে পাওয়া যায় না। সে বস্তু বাঙালীর মনোবল।
কোথা থেকে এল বাঙালীর এই মনোবল? মূর্খ ইয়াহিয়া মনে করে যে, ভারতের চক্রান্তে বিভ্রান্ত হয়ে বাঙালী আজ পাক হানাদারদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে এ-কথাটা জগতের লোকে বিশ্বাস করবে। কিন্তু এই দুনিয়ার যেখানেই মানুষ অত্যাচার নিপীড়ন শোষণ প্রত্যক্ষ করেছে তারা বুঝবে বাঙালীর মনোবলের মূল কোথায়। এই শক্তির মূল এই দৃঢ়প্রতিষ্ঠ বিশ্বাস যে পাকশক্তির শোষণের উপর প্রতিষ্ঠিত, এবং জগতের সর্বত্র শোষণের অবসান অবধারিত! ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, ফরাসী সাম্রাজ্যবাদ, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ, বিপুল পশুশক্তি বিশাল মারণযন্ত্রের অধিকারী হয়েও মিশরে, আলজেরিয়ায়, কিউবায়, ভিয়েতনামে জয়ী হতে পারে নি। কেন? কারণ সাম্রাজ্যবাদ বহুকে শোষণ করে মুষ্টিমেয়কে পুষ্ট করতে চায়। এবং যাকে শোষণ করে তাকে অশান্ত করে তোলে। সে অশান্তি বহু-র অশান্তি—তাকে শান্ত করার মতো, দেবার মতো সাম্রাজ্যবাদের কিছুই নেই।
পাকিস্তানের শোষকগোষ্ঠী কী দিতে পারে বাংলাদেশের মানুষকে? শুধু দারিদ্র্য, শুধু ক্ষুধা, শুধু লাঞ্ছনা। আর বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা? সে পারে বাংলাদেশের মানুষকে মানুষের অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করতে। তাই তো সে অজেয়। তাই তো তার ধ্বজায় ইতিহাসের ভবিষ্যৎ।
তার কিসের ভয়? আজই যদি তার চূড়ান্ত জয় না হয় তবে কি জয়ের আশা চিরতরে ঘুচে যাবে? কেন? যে-মন জানে যে পাক শোষকেরাই দারিদ্র্য-ক্ষুধা-লাঞ্ছনার কারণ, সে-মন কি আশা করবে যে সেই শোষকেরা কাল বাঙলাদেশের দারিদ্র্য ঘোচাবে, ক্ষুধা মেটাবে, বাঙালীকে মানুষের মর্যাদা দেবে? যে পাক শাসনের প্রথম প্রহর থেকেই বাঙালীর চোখে তার সাম্রাজ্যবাদী স্বরূপ ধরা পড়েছে, যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্রমশঃ আরও ব্যাপক আরও তীব্র রূপ ধারণ করেছে, বাঙালীর দ্রুত চূড়ান্ত জয় আজই না হলে তার কী পরিবর্তন সম্ভব? ২৫শে মার্চ থেকে শুরু করে পাক শোষকেরা তাদের যে পাশবিক হিংস্রতা বিশ্বের গোচরীভূত করেছে তার কী লক্ষ্য? শোষণের অবসান? সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা? প্রতিটি বাঙালী জানে, তার লক্ষ্য বাঙালীকে শোষণ করার স্বাধীনতা এবং তার লক্ষ্য বাঙালীকে পদানত করে শোষণব্যবস্থা অবাধ রাখা।
ইংরেজীতে বলে, সময়ে সব সেরে যায়। ষ্টেটসম্যানের প্রবন্ধলেখকের কী ধারণা যে, এই বর্ষায় বাঙালীর চূড়ান্ত জয় না হলে সময়ে বাঙালীর শোষণ সয়ে যাবে? এ ধারণা তাঁদের হতে পারে যাঁরা বাঙলার মাটি থেকে দূরে, বাঙলাদেশের বাঙালীর মন থেকে আরও অনেক, অনেক দূরে। যদি তাঁরা মুক্ত অঞ্চলের বাঙালীর মন, অধিকৃত অঞ্চলের গেরিলাদের মন জানতেন, তা হলে তাঁরা এও জানতেন যে হো চি মিনের গলায় গলা মিলিয়ে বাঙালীও আজ বলে, “যদি দরকার হয়, হাজার বছর লড়বো, স্বাধীন আমরা হবই”।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল