বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
গণতান্ত্রিক নির্বাচন
ইয়াহিয়া খানের মতো গণতন্ত্রে আস্থাশীল ব্যক্তি খুব কমই আছেন। এই দেখুন না, পর পর দুবার তিনি নির্বাচনের দিন স্থির করলেন অথচ তা পিছিয়ে দিতে হলো। বাংলাদেশের রাজনীতিকরা আর ভোটে-ই দাঁড়াতে চাননা! কী যে হলো দেশটার—গণতান্ত্রিক নির্বাচনের এমন সুযোগ পেয়েও লোকে তা নষ্ট করছে!
অথচ ইয়াহিয়া সাহেবের বিস্তর সদিচ্ছা রয়েছে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার। তাই তিনি আবার, তৃতীয়বার, নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এবারেও আগের, ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে : কেউ প্রার্থী হতে চাইছেনা, ভোট দিতেও কেউ চাইছেনা।
অবস্থাটা যে এরকম হয়ে দাঁড়াবে তা ইয়াহিয়ার কল্পনার বাইরে ছিল। ইয়াহিয়া ভেবেছিলেন যে অন্ততঃ কিছু পেটোয়া দালালদের প্রার্থী ও ভোটদাতা সাজিয়ে ভোটরঙ্গটা সেরে নেওয়া যাবে। কিন্তু সেই দালালরা ভোটাভুটিতে যেতে একান্তই অনিচ্ছুক। মুক্তিফৌজের তৎপরতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে আজ এই সব দালালরা নিজের নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। এমন কি দালাল-সম্রাট নুরুল আমিন পর্যন্ত ভোটে দাঁড়াতে একান্তই অনিচ্ছুক। দালালেরা জেনে গেছে, আজ ইয়াহিয়ার পক্ষচ্ছায়ায় থেকে ভোটে প্রার্থী হলে বা ভোট দিলে কাল বাংলাদেশের জনগণ তাদের পিঠের চামড়া খুলে নেবে।
গণতন্ত্রের বুলি ইয়াহিয়ার মুখে এমন কিছু নতুন নয়। নতুন হলো তাঁর মুখে বার বার নির্বাচনের কথাটা। নির্বাচন বলতে বাংলাদেশের লোক একটাই বোঝে : যে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু-সহ আওয়ামী লীগ বিপুল জন-সমর্থনে জয়ী হয়েছিল। আচ্ছা ইয়াহিয়া সাহেব, সে নির্বাচনের কি হলো? তার প্রার্থীরাই বা আজ অবহেলিত কেন? এবং সেই নির্বাচনে জিতে যিনি বাংলার গণমানসে এক বিরাট উদ্দীপনা এনেছিলেন, সেই বঙ্গ-বন্ধুই বা কারারুদ্ধ কেন?
এ-সবের কারণ হলো গণতন্ত্রের অর্থ ইয়াহিয়ার অজানা। গণতন্ত্র হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের মতানুসারে সরকার গঠন। কিন্তু ইয়াহিয়ার গণতন্ত্র হলো সংখ্যালঘিষ্ঠকে প্রলোভন দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে, তোয়াজ করে নিজের খুশীমত তাঁবেদার সরকার তৈরী করা। আর সেই ‘সংখ্যালঘিষ্ঠ’ কারা?—যতসব ঘৃণ্য দালাল, রাজাকার, আর মোসাহেবের দল। কাজেই বাঙালী জানে সামরিক শাসক তাকে কী ধরণের ‘গণতন্ত্র’ দিতে পারে।
শুধু পাক সামরিক শাসনকর্তারাই নয়, দুনিয়ার সব সামরিক শাসনকর্তারাই এ-ধরণের ভেক ধরে স্বৈরতন্ত্র চালিয়ে থাকে। আর তার বিরুদ্ধে দুনিয়াজুড়ে যে মুক্তিসংগ্রাম, তাতে আজ বাঙালীও শামিল হয়েছে। সামরিক শাসকের বুটের লাথি খেয়ে বাঙালী ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচনে’ যেতে রাজি নয়। সে প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করবে তার মুক্তি-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল