বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
প্রবাসী বাঙালীর চোখে
রাষ্ট্রসংঘে বাংলাদেশ সমস্যা
—রফিক আনোয়ার
রাষ্ট্রসংঘের অধিবেশনের দিন যতই এগিয়ে আসছে, ভারত ও পাকিস্তান ততোই প্রস্তুত হচ্ছে মুখোমুখি তর্কযুদ্ধের জন্য। বলাই বাহুল্য, এ তর্কের মূল বিষয়বস্তু হলো বাংলাদেশ। পূর্ববাংলার সংঘর্ষ আরম্ভ হওয়াতে ভারত পাক উপমহাদেশে এক বিরাট সমস্যা দেখা দিয়েছে। দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্পর্ক তীব্রতর হয়ে উঠেছে। আর তা নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই প্রথম আলোচনা সভা বসছে।
সত্যিকথা বলতে কি, এটা দ্বিমুখী না হয়ে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। যখন রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিগণ পরস্পরের মুখোমুখী হবেন, বাংলাদেশের ‘অস্থায়ী’ সরকারের একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন প্রতিনিধিদল নেপথ্যে অত্যন্ত সক্রিয় থাকবেন এবং বিশ্ব জনমত তাঁদের অনুকূলে এনে রাষ্ট্রসংঘ বাংলাদেশের পক্ষ সমর্থন করানোর চেষ্টা করবেন।
বাংলাদেশের এই প্রতিনিধিদলের ভেতর পূর্ববাংলার কূটনীতিকরা থাকবেন যাঁরা সম্প্রতি নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনের পাক হাই কমিশন থেকে পদত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করেছেন। এঁদের মধ্যে আছেন সৈয়দ আনওয়ারুল করিম, সুশিক্ষিত কূটনীতিবিদ, যিনি রাষ্ট্রসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী দূতাবাসের উপপ্রধান ছিলেন। আছেন এনায়েৎ করিমও, যিনি ওয়াশিংটনে পাক দূতাবাসের দ্বিতীয় প্রধান ছিলেন।
এই প্রতিনিধিদলে হয়তো জাষ্টিস আবু সয়ীদ চৌধুরীও যোগদান করতে পারেন। ইনি পাকিস্তান হাইকোর্টের একজন প্রাক্তন বিচারক এবং এককালে ইনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যানসেলর ছিলেন। বর্তমানে জাষ্টিস চৌধুরী বৃটেনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছেন, এবং ইনি রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত কমিশনের সদস্য।
এটা লক্ষ্যণীয়, যে পাকিস্তান সরকারও তার প্রতিনিধি দলের প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রসংঘে পাঠাচ্ছে ঢাকার এক বাঙালী রাজনীতিবিদকে। ইনি হলেন জনাব হামিদুল হক চৌধুরী। সুয়েজ খাল নিয়ে প্রথম গন্ডগোলের সময়ে, ১৯৫৬ সালে, সামান্য কিছুকালের জন্য ইনি পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।
হামিদুল হক চৌধুরী একজন প্রতিষ্ঠাবান উকীল, এবং এঁর একটি সংবাদপত্রও আছে। গত কয়েক বছর ধরেই ইনি সক্রিয় রাজনীতির মধ্যে নেই এবং বিগত নভেম্বর মাসের নির্বাচনেও ইনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। পূর্ববাংলায় বর্তমান সংকট দেখা দেওয়ার পর ইনি ইয়াহিয়াকে রাজনৈতিক সমর্থনদানে এগিয়ে এসেছেন।
অভিযোগ
জনাব ফরিদ আহম্মদ ও জনাব মামুদ আলী যাঁরা বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন, উভয়ে হামিদুল হক চৌধুরীর সাথে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলিতে সফর করেছেন। এঁদের লক্ষ্য, বিশ্বমত বাংলাদেশ সরকারের প্রতিকূলে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু সংবাদপত্রগুলির অভিমতে এঁরা এখনও বিশেষ ফললাভ করতে পারেননি।
পূর্ববাংলার জনগণ যে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে অবিশ্বাসী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভে অনাগ্রহী, এটা রাষ্ট্রসংঘে প্রমাণ করতে মিঃ চৌধুরীকে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। উপরন্তু, তাঁর পূর্ববাংলা সম্বন্ধে প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা আছে কিনা, তা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদল (অস্বীকৃত) প্রশ্ন তুলবেন।
এখন শুধু এটাই লক্ষ্যণীয় যে ভারত সরকার, পাক সরকার এবং বাংলাদেশ সরকার—এঁরা কিভাবে এবং কি কায়দায় রাষ্ট্রসংঘে বাংলাদেশ সমস্যা উত্থাপন করেন। ভারত ও পাক সরকারের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে কোনো প্রস্তাব আনবেন কিনা তা এখনও জানা যায়নি। ধারণা করা যায়, তাঁরা আনবেনই।
পাকিস্তান সরকারের প্রস্তাবের বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন, তাঁরা ভারত সরকারকে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করবেনই। কারণ (তাঁদের মতে) ভারত পাকিস্তানের ‘আভ্যন্তরীণ’ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। হয়তো পাক প্রতিনিধিগণ এ অভিযোগও করবেন যে সম্প্রতি ভারত সরকার বাংলাদেশের সমস্যাকে আর একটা পাক-ভারত সমস্যার রূপ দিয়েছেন। ভারতের বিরুদ্ধে তাঁদের আরও অভিযোগ আছে; তা হলো বাংলাদেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ, এবং মুক্তি ফৌজকে সাহায্য দান। ভারতের এসব অভিযুক্ত কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য তাঁরা রাষ্ট্রসংঘের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করতে পারেন।
অপরপক্ষে ভারতীয় প্রতিনিধি দল বলতে পারেন যে বাংলাদেশ সমস্যা কেবলমাত্র ভারত-পাক সমস্যাই নয়, এক আন্তর্জাতিক সমস্যার রূপ নিয়েছে। ফলতঃ ভারত-পাক উপমহাদেশের শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে।
ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করবেন সম্ভবতঃ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার স্বর্ণ সিং। যদিও এই প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সরকারের স্বপক্ষে কিছু বলতে পারবেন না, তবু এঁরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্রসংঘকে অনুরোধ করতে পারেন। এই চাপ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য হবে পূর্ববাংলার জনগণের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা মেনে নিয়ে ও তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সহায়হায়, ন্যায় ও সত্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের একটা রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বার করা।
এছাড়া, বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দল ও ইয়াহিয়া-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আরো কয়েকটি অভিযোগ আনবেন।
ব্রিটেনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি জাষ্টিস আবু সঈদ চৌধুরী মিঃ উ থান্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনুরোধ জানিয়েছেন যে পূর্ব বাংলায় গণহত্যার বিষয়টি যেন রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত কমিশনে উত্থাপিত হয়। একই সময়ে ব্রিটেনের প্রায় দেড়শো জন ‘মেম্বর অফ দি পার্লামেন্ট’ হীথ-সরকারের কাছে আবেদন করেছেন যে পূর্ববাংলার সমস্যার কথা যেন ব্রিটিশ সরকার রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে উত্থাপন করেন। অবশ্য ব্রিটিশ সরকার তা করবেন কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।
মতামত
এখনো পর্যন্ত ঘটনাবলীর পর্যালোচনা করে দেখলে মনে হয় রাষ্ট্রসংঘে বাংলাদেশের ওপর বিতর্কের কোনো বাস্তব ফললাভ হবে না। রাজনৈতিক কোনো সমাধানের আশাও করা যায় না।
ফলাফল যাই হোক না কেন, এটুকু বলা যায় যে রাষ্ট্রসংঘে এবারের অধিবেশনে বাংলাদেশের সমস্যা উঠবেই, এবং প্রত্যেক পক্ষই তাঁর বক্তব্য পেশ করার সুযোগ পাবেন। আর বর্তমান এশিয়ার এই কলঙ্কময় রাজনৈতিক হত্যাকান্ড সম্পর্কে বিশ্বের যে যে দেশ নির্বিকার-নির্লিপ্ত ছিলেন, তাঁরাও এবার এবিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারবেন না।
এবং এটাই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে লাভজনক হয়ে দাঁড়াবে; পক্ষান্তরে পাক সরকার এতে আরও বিব্রত হবেন।
(মূল ইংরিজি থেকে অনূদিত)
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল