বিপ্লবী বাংলাদেশ
১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রস্তুতি বাহিনীর কর্তব্য ও ভূমিকা সম্বন্ধে আগেই বলা হয়েছে। এবার তাদের কর্তব্যগুলো তারা কিভাবে পালন করবে তা জানা দরকার। কিন্তু এটা জানবার আগে বুঝতে হবে যে বাংলাদেশে গেরিলা-পদ্ধতির গুরুত্ব এবং প্রয়োজন কতোখানি।
গেরিলা-যুদ্ধের সবচেয়ে দরকারী তিনটি বিষয় হলো সমগ্র জনগণের যুদ্ধে সাহায্য করা, লড়াইয়ের সঠিক স্থান ও কৌশল নির্বাচন করা, এবং দীর্ঘদিন ধরে সর্বদাই একটু একটু করে শত্রু নিধন করা। এই তিনটি বিষয়ের একটু আলোচনা করে দেখা যাক।
প্রথমে দেখা যাক সমগ্র জনগণকে যুদ্ধে সাহায্য করানোর ব্যাপারটা। এটা জানা দরকার যে গেরিলা লড়াইয়ের মতো জনসমর্থনের প্রয়োজন আর কোনও যুদ্ধে হয়না। সাধারণতঃ যুদ্ধে সৈন্যবাহিনী লড়াই করে চলে, এবং জনসাধারণ তাদের জীবনযাত্রা প্রায় স্বাভাবিক ভাবে চালাতে থাকে। কিন্তু গেরিলা-যুদ্ধে প্রত্যেককেই অংশ গ্রহণ করতে হয়। ভিয়েটনামে দেখা গেছে যে হয়তো কখনও মা বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে, কখনো বা সে ক্ষেতে চাষ করছে, আবার কখনো বা শত্রুপক্ষের গতিবিধি/ক্ষমতা/মনোভাব ইত্যাদি সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করছে, এমনকি প্রয়োজনে বন্দুকও ঘাড়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশের গেরিলা যুদ্ধে এই অবস্থাই ঘটেছে। বর্বর পাকসৈন্য ভেবেছিল যে পাশবিক অত্যাচারের দ্বারা বাঙালীর মুখ বন্ধ করে রাখবে। কিন্তু বিগত ২৪ বছর একটানা পশ্চিমী শোষণের মুখোস আজ খসে পড়ছে। তাই প্রত্যহ দলে দলে জনসাধারণ মুক্তিফৌজে যোগদান করছে। এই রকম অসাধারণ জনসমর্থনই গেরিলা-যুদ্ধে প্রয়োজন।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে লড়াইয়ের সঠিক স্থান এবং কৌশল স্থির করা আবশ্যক। গেরিলা-লড়াইয়ের যে ধরণের স্থানের প্রয়োজন তা বাংলাদেশে যথেষ্ট রয়েছে। এই সব স্থান হলো জঙ্গল, পাহাড়, খাল-বিল ওয়ালা অঞ্চল, ইত্যাদি। এগুলোর সঠিক ব্যবহারের ফলে মুক্তিফৌজ ক্রমাগত জয়ের পথে এগিয়ে চলেছে। সেই সঙ্গে যখন যেরকম কৌশল কাজে লাগানো যায়, সে রকম কৌশল নেওয়া হচ্ছে।
আর তৃতীয় বিষয় হলো দীর্ঘদিন ধরে সর্বদাই একটু একটু করে শত্রুর ক্ষতি ঘটিয়ে যাওয়া। এ ব্যাপারটা অত্যন্ত জটিল। কারণ, সাধারণতঃ যুদ্ধে দেখা যায় যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যুদ্ধের মীমাংসা করার চেষ্টা করা হয়; যেহেতু দিনের পর দিন সৈন্যবাহিনীর রসদ অস্ত্রশস্ত্র জোগান দিয়ে ওঠা অত্যন্ত কষ্টকর। কিন্তু গেরিলারা জনগণেরই অংশ—তাই তাদের রসদের অভাব হয়না। সমস্ত জনগণ মুক্তিফৌজের প্রয়োজনীয় রসদ জোগাড় করে দেয়। বাংলাদেশের জনগণও আজ তাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে মুক্তিফৌজের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সবারই একমাত্র প্রতিজ্ঞ—‘বাংলা মা’কে পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্তি করবো।
অতএব, দেখা যাচ্ছে যে গেরিলা-যুদ্ধের তিনটি দিক বিচার করে বাংলাদেশকে গেরিলা-যুদ্ধের আদর্শ স্থল বলা যায়।
রণকৌশল সম্বন্ধে আর একটা কথা মনে রাখা দরকার। তা হলো, নিজেদের বলক্ষয় রোধ করা। মুক্তি যুদ্ধের নিয়ম হলো শত্রুর অসতর্ক মুহূর্তে আক্রমণ করে তাকে পঙ্গু করে দেওয়া। এ কাজটি খুবই কঠিন। তাই যতক্ষণ সম্ভব ততক্ষণ যোদ্ধারা আক্রমণ চালিয়ে যায়, এবং তা সম্ভব না হলে তখনকার মতো সরে সরে পড়তে হয়।
কেউ কেউ ভাবতে পারেন যে এরকম সরে পড়ার মানে তো পরাজয়! তাঁদের জানা দরকার যে এটা পলায়ন করা নয়, এটা পরের আক্রমণের প্রস্তুতির জন্যই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা।
৭১’র বাংলাদেশে যে গণজাগরণ ও বিপ্লব দেখা দিয়েছে, তার সাফল্যের জন্যই বাঙালী অস্ত্র হাতে নিয়েছে। এই অস্ত্রের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা হচ্ছে পাকদস্যুদের বিরুদ্ধে, গেরিলা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। আর সেই গেরিলা লড়াইয়ের জমীন বাংলাদেশে তৈরী হয়ে গেছে—উপরের লেখাতেই তা প্রমাণিত হয়েছে। আজ জোর গলায় বলা যায়, বাঙালী তার অধিকার অর্জনে দৃঢ়সঙ্কল্প।
প্রকৃত স্বাধীনতা কখনো ভিক্ষে করে, দালালি করে, মোসাহেবী করে পাওয়া যায়না। প্রকৃত স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হয়, অর্জন করতে হয়। সমগ্র বাংলাদেশ আজ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তার প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে চলেছে। জয় তাদের অবশ্যম্ভাবী।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল