You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.05 | বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ- দিলীপ কুমার দাস | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
দিলীপ কুমার দাস

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সামরিক শাসনের উত্তরাধিকার হিসেবে দেখা দিল বিংশ শতাব্দীর সব চেয়ে বর্বর অত্যাচারী ব্যক্তি—চেঙ্গিস, তৈমুর, হালাকু, নাদির, হিটলার, মুসোলিনী প্রভৃতি সব কটি নর পিশাচের মিলিত পৈশাচিক শক্তির জারজ সন্তান ইয়াহিয়া খান।
প্রথম ক্ষমতা গ্রহণ করে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ন্যায় এই বর্বর জঙ্গী শাসক ঘোষণা করল জনগণের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দায়িত্ব সমাপ্ত করবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আমরা যা দেখলাম তা পুরোপুরি বিপরীত। যদিও ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন সামরিক বর্বর শাসকগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় দান করেনি। এই নির্বাচন বাংলাদেশের জনসাধারণ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আদায় করে নিয়েছে। শেখ সাহেব এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সঠিক ভাবে যোগ্যতম ব্যক্তির ন্যায় আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করলেন—বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সব মানুষ এই বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অধিকারী মানুষটির পিছনে এসে দাঁড়ালেন। সেদিন কোন কোন নেতা নির্বাচন বয়কটের আওয়াজ তুলেছিলেন, কিন্তু আজ যে বাস্তব সত্যটি আমাদের কাছে দেখা দিয়েছে তা প্রমাণ করেছে তাদের সেদিনের সিদ্ধান্ত কত ভ্রান্ত ছিল। শেখ সাহেবের নেতৃত্বে সাড়া দিয়ে বাংলার সচেতন জনসাধারণ জঙ্গীশাহী বর্বর শাসকের বিরুদ্ধে তাদের উদাত্ত রায় ঘোষণা করলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে ক্ষমতাসীন শাসক এবং তার পদলেহী কুকুরদের এমনি চরম পরাজয় খুব কমই দেখা যায়। সবগুলো সাম্প্রদায়িক দল বাংলার মাটিতে কবরে স্থান পেল। শেখ সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন ইয়াহিয়া সহজে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেনা ক্ষমতা আদায় করার জন্য অনেক মূল্য দিতে হবে। নির্বাচনোত্তর অনেক সভায় বিজয়ী বীর দৃপ্ত কন্ঠে এই সাবধান বাণী ঘোষণা করেছেন—‘নির্দেশ দেবার জন্য আমি যদি নাও থাকি তোমরা জঙ্গীশাহীর কাছে মাথা নোয়াবে না।’ ইয়াহিয়া নিজের হাতে গণপরিষদ এবং সংবিধান মনপূতঃ না হলে বাতিল করে দেবার ক্ষমতা রেখে দিল। বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়ার কাছে সব রকমের আপোস আলোচনার পথ খোলা রেখে সংগ্রাম করে যাচ্ছিলেন, যাতে শান্তিপূর্ণ ভাবে একটা মীমাংসায় আসা যায়। কিন্তু শান্তিকামী জননেতার গণতান্ত্রিক চেতনার মূল্য বর্বর জঙ্গীশাহী ইয়াহিয়া কি ভাবে দেবে?—রক্তলোলুপ বর্বর শিখেছে শুধু রক্তপাত করতে আর দেশবাসীকে চরম নারকীয় অত্যাচার করে ঘরছাড়া করতে। পাকিস্তানকে যদি বিচ্ছিন্ন কেউ করে থাকে তা করেছে এই বর্বর জঙ্গীশাসক। শেখ সাহেব তাঁর ছয় দফা দাবীর মাধ্যমে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চাননি এবং দেশদ্রোহীতাও করেননি—তিনি চেয়েছেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মৌলিক অধিকার ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করতে। বর্বর ইয়াহিয়া জানেনা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, ও খৃষ্টান আজ মিলিত ভাবে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার মন্ত্রে অটল। বাংলাদেশকে তার দামাল ছেলেরা আর পিন্ডির সরকারের উপনিবেশ হতে দেবে না—প্রতিটি তরুণ বাঙালীর আজ একটি মাত্র প্রতিজ্ঞা : হয় স্বাধীন বাংলা নতুবা বীরের মৃত্যুবরণ, মাঝামাঝি আর কোন আপোস নেই। বর্বর ইয়াহিয়া একদিকে আলোচনা টেবিলে বসে আলোচনার কপট অভিনয় চালাতে লাগল আর অপরদিকে শুরু করল বাংলা দেশকে কসাইখানায় পরিণত করার হীন ষড়যন্ত্র। আট ডিভিসন সৈন্য বাংলার শ্যামল বুকে জমায়েত করা হয়েছে। শেখ সাহেব শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকে অখন্ড রেখে আলোচনার মাধ্যমে একটা মীমাংসায় উপনীত হতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতকামী বর্বর সামরিক শাসকের হঠকারিতায় তা সম্ভব হল না। শুরু হল নিরীহ, নিরস্ত্র, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের উপর বর্বর অত্যাচার, যে বর্বরতা চেঙ্গিস, তৈমুর, নাদির, হিটলার, মুসোলিনী প্রভৃতির অপকৃতিকেও ম্লান করে দেয়। শোষণ, নিষ্পেষণ, অত্যাচার, ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে পৃথিবীর বুকে অনেক অভ্যুত্থান সূচিত হয়েছে কিন্তু নারীর উপর এমনি বর্বর অত্যাচার, প্রার্থনারত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের বুলেটবিদ্ধ করে হত্যা করার ইতিহাস বোধহয় পৃথিবীতে আর পাওয়া যাবে না। রোকেয়া হলের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের উলঙ্গ করে রাস্তায় ঘোরান হয়েছে—উন্মুক্ত রাজপথে তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে এবং অবশেষে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বর্তমান যুগের ভিয়েতনামে মার্কিন নরপশুদের নৃশংস অত্যাচারকেও এরা ম্লান করে দিয়েছে। স্বেচ্ছাচারী ইয়াহিয়া যে কত নিকৃষ্টস্তরের লোক তার প্রমাণ মেলে বিগত ঘূর্ণিঝড়ের সময় সে যখন উড়োজাহাজে বিধ্বস্ত অঞ্চলের উপর দিয়ে ভ্রমণ করেছিল—শোনা যায় মদের নেশায় তার বাহ্যিক জ্ঞান একেবারে অবলুপ্ত ছিল। দিবা শেষে সেদিন রাত্রে ঢাকা শাহাবাগ হোটেলে অর্দ্ধনগ্ন বাইজীর সাথে নৃত্য করে এক সময় ঢলে পড়েছে। প্রয়োজনের তাগিদে এই নরপশু ভ্রাতৃঘাতক আওরঙ্গজেবের ন্যায় ইসলামের কথা উচ্চারণ করতে একটুও দ্বিধা করে না।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ বাংলার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন—এই দিনটিই বাংলাদেশের সত্যিকারের স্বাধীনতার দিন—১৪ই আগষ্ট আজ বাঙালীদের নিকট মৃত বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া একটি দিন। বাংলার সূর্য, দেশবাসীর নয়নমণি শেখ ‍মুজিবর রহমান ২৫শে মার্চ ‘স্বাধীন বাংলা’র ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার এক নূতন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। শেখ সাহেবের অগ্নিসম্ভাবনাময় ঘোষণা আজ লাখ লাখ বাঙালী তরুণের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলার মাটে, ঘাটে পথে, প্রান্তরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ভীত সন্ত্রস্ত পাক সামরিক চক্র বঙ্গবন্ধুকে পিন্ডির কোন এক নির্জন কক্ষে কারারুদ্ধ রেখে বিচারের কোন প্রহসন করছে?—মূর্খের দল জানেনা এই বিচারের কোন অধিকার তাদের নেই! পাক জঙ্গিশাহী যদি শেখ সাহেবের গায়ে একটু আঁচড় দেবারও চেষ্টা করে তার পরিণাম যে কত ভয়াবহ হবে তা বেয়নেটের উপর নির্ভরশীল ইয়াহিয়া আজ কল্পনাও করতে পারছে না। মুজিবরের স্বাধীনতা সংগ্রাম পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশেও যে প্রভাব বিস্তার করেছে, তাদেরও যে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তুলেছে, তা পশ্চিম পাঞ্জাবীদের উপর বেশি নির্ভরশীল ইয়াহিয়াকে জীবন মূল্য দিয়ে একদিন বুঝতে হবে—সেদিন অন্য কোন পথ আর খোলা থাকবে না। বাংলার বুক থেকে মুজিবকে ছিনিয়ে নিয়ে আটক করে রেখে মুজিব-প্রভাব বাংলার বুক থেকে মুছে দেওয়া আর যাবে না। আজ বাংলার ঘরে ঘরে লাখ লাখ মুজিব জন্ম নিয়েছে, যারা জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান ত্যাগ জীবন বিসর্জন দিতেও বদ্ধপরিকর। বাঙালী শহীদদের রক্তেস্নাত সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্ম হল ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরের প্রদীপ্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে। বাংলা দেশের বিরাট অংশ আজ মুক্তি বাহিনীর দখলে—দিনের পর দিন এই মুক্তাঞ্চলের পরিসর আরো বেড়ে সামরিক জঙ্গীশাহীকে গ্রাস করে নিচ্ছে। বাংলার বিগত নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের বিপুল ভোটে জয়লাভ এবং তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে পদদলিত করে, বাংলার নিরস্ত্র মানুষের উপর পাকিস্তানী শাসক শ্রেণীর নির্লজ্জ বর্বর আক্রমণ এই সত্যটিই প্রমাণ করেছে যে মুখে যত গণতন্ত্রের কথা বলুকনা কেন গণতন্ত্রের সত্যিকারের বিপদ কায়েমী স্বার্থবাদী শাসকদের কাছ থেকেই আসে।
ভিয়েতনামের দেড় কোটি মানুষ যদি মার্কিনী বর্বরদের পর্যুদস্ত করে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা করে চলতে পারে, তা হলে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষও ৮০ হাজার বর্বর হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যের মোকাবিলা করে সমস্ত বাংলাকে মুক্ত করতে সমর্থ হবে। ভিয়েতনামে ৫৫ হাজার মার্কিনী সামরিক বাহিনী গেরিলাদের হাতে খতম হয়েছে। আর বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর হাতেও চার মাসের সংগ্রামে ৩০ হাজারের অধিক হানাদার সামরিক বাহিনী নিহত ও অকর্মণ্য হয়ে গেছে, বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে গেরিলা বাহিনীর হাতে হানাদার দস্যুরা প্রতিদিন গড়ে পঞ্চাশ জনের উপর খতম হচ্ছে—এইভাবে খতম অভিযান চললে আর ক’দিন হানাদাররা বাংলার বুকে টিকে থাকতে পারবে? পৃথিবীর মধ্যে গেরিলা যুদ্ধের সবচেয়ে উপযোগী স্থান বাংলাদেশ আর মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের তৎপরতায় উদ্বেলিত। গেরিলারা বাংলার ঘরে ঘরে গ্রামে, গঞ্জে, মাঠে প্রান্তরে জনসাধারণের মধ্যে মিশে আছে—মাছ, যেমন জলের মধ্যে একাত্ম হয়ে মিশে থাকে। পদ্মা, মেঘনা, বুড়িগঙ্গা ও বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গের ন্যায় বাহিনী এগিয়ে চলেছে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার একমাত্র মন্ত্র নিয়ে—তাই কোন অত্যাচার উৎপীড়ন আজ আর তাদের ফেরাতে পারবে না। বিশ্বের স্বাধীনতাকামী জনসাধারণ আজ মুক্তিবাহিনী সমর্থন করছে—সমর্থন রয়েছে বিশ্বেরও লাখ লাখ জনগণের। বাংলার বিপ্লবী তরুণেরা আজ আর ফিরবে না, প্রয়োজন হলে দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়েও বাংলার পূর্ণ স্বাধীনতা আদায় করে নেবে। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধ কোনদিন ব্যর্থ হয়না, হতে পারেনা—তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও ব্যর্থ হবে না। জয় তাদের সুনিশ্চিত। বাংলাদেশের জনসাধারণ আজ একটি সাধারণ সত্যে উপনীত হয়েছে। সে সত্য হল বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের এ বিষয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই।
হানাদার বাহিনীর হাত থেকে সোনার বাংলাকে মুক্ত করার সঙ্কল্প নিয়ে বাংলার বিপ্লবী তরুণেরা বিজয় গর্বে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলার হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ-খৃষ্টান সকলে আজ সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে—তাদের আজ একমাত্র পরিচয় বাঙালী, আর একমাত্র প্রতিজ্ঞা বাংলার স্বাধীনতা অর্জন। শেখ সাহেবের সৃষ্ট বাংলার নয়া ইতিহাস সব কিছু সংকীর্ণতার উর্দ্ধে বিরাজিত। চৌদ্দই আগষ্ট আজ বাঙালীদের নিকট মৃত—আর সেই শব আঁকড়ে ইয়াহিয়া আজো বসে আছে; কিন্তু তারই শবযাত্রা আগতপ্রায়। অসংখ্য শহীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলা আজ দ্রুত পদক্ষেপে জয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছে—নবারুণের ঝিলমিলে রক্তিম আভা অদূরে নবোদয়ের সূচনা করছে।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল