You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.05 | রক্তাক্ত স্মৃতি —মেহেরুণ আমিন | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

রক্তাক্ত স্মৃতি
—মেহেরুণ আমিন

আজ থেকে শত বৎসর পরেও বাঙালী জাতি ২৫শে মার্চের ভয়াল রাতের কথা কাহিনীর আকারে শোনাবে তাদের প্রিয় সন্তানদের। শোনাবে সুদূর অতীতের বীর বাঙালীদের ত্যাগ তিতিক্ষার ইতিবৃত্ত। আর তাই শুনে আতংকে, বিস্ময়ে, ও গর্বে ভরে যাবে তাদের শিশুমন। শুনবে কি নির্মম জিঘাংসা নিয়ে সেদিন নরাধম ইয়াহিয়ার ঘাতক বর্ব্বর টিক্কা নেমে এসেছিল বাঙালী জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াসে তাদের ভয়াল অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে। কিভাবে তারা ধ্বংস করেছিল বাংলার সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনী; ধ্বংস করেছিল বাঙালীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সংলগ্ন ছাত্রাবাসগুলো; ধ্বংস করেছিল গরীব বাঙালীর দৈনিক বাজারগুলো। সর্বোপরি বেছে বেছে হত্যা করেছিল জগৎ বরেণ্য প্রফেসার জি.সি. দেব ও তার সমগোত্রীয়দের। আরও শুনবে কিভাবে নিশ্চিহ্ন করেছিল বাংলার যুব সমাজের এক বিরাট অংশ এবং টেনে নিয়েছিল তাদের শরীরের শেষ রক্তবিন্দু। শোনাবে কত নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল পাঞ্জাবী ডালকুত্তার দল বাংলার প্রতিটি শহরে, গঞ্জে ও গ্রামে। আঁৎকে উঠবে সে বর্বরতার কাহিনী শুনে—যে কাহিনীতে থাকবে পুত্রের সামনে মায়ের বেইজ্জতি, পিতার সামনে কন্যার ইজ্জতহানি। নরপশুর দল যে কত জঘন্য হতে পারে, ইতিহাসের পাতায় তা লিপিবদ্ধ হবে রক্তের অক্ষরে।
রক্তের পিপাসায় উন্মত্ত হয়েছিল অতীতে আরও অনেক নরপশু। এটিলা, চেঙ্গিজ, তৈমুর, নাদির, হিটলার—এরা সকলেই নরখাদক ইয়াহিয়া পূর্বসূরী। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় নরপশুর দলও আজ তাদের নরক থেকে আঁৎকে উঠবে বিংশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধের এই পিশাচের কান্ড দেখে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে ২৫শে মার্চের রাতে সারা বাংলা জুড়ে কয়েক লাখ লোককে নিধন করেছে ইয়াহিয়ার পাঞ্জাবী বাহিনী। ইজ্জত নিয়েছে হাজারো হাজারো বাংলার মা-বোনের, তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে সুস্থ সবল বাংলা মায়ের শিশুদের বলের মত করে উপরে ছুঁড়ে দিয়ে বেয়নেটের মাথায় তাদের হত্যা করে পৈশাচিক আনন্দে ফেটে পড়েছে। প্রতিযোগিতা হয়েছে কে কয়টি শিশুকে সঙ্গীনের আগায় আটকাতে পারে তারই। ডালকুত্তার দল বাংলার শহরে, গঞ্জে, গ্রামে দাঁড় করিয়েছে বাংলার যুব সমাজের দলকে দল, কবর খুঁড়িয়েছে তাদের দ্বারাই। তারপর বেয়নেটের আঘাতে একের পর এক শুইয়ে দিয়েছে ওই কবরের মধ্যে, ও শেষ জীবিতকে দিয়ে মাটি চাপা দিয়েছে। চলে যাবার সময় আবার তাকেই হত্যা করে বুটের লাথি মেরে ফেলেছে রাস্তার পাশের ডোবায়।
হত্যার ইতিহাসে আজ ইয়াহিয়া তার সকল পূর্বসূরীকেই অতিক্রম করে এক বিশ্ব রেকর্ডের অধিকারী হয়েছে। হত্যার পিশাচ আরও এসেছে কিন্তু এই জঘন্য পশু নরজাতিকে যে অপমান করেছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে আর দেখা যায় না। তার পূর্বসূরীরাও হত্যা করেছে কিন্তু ইতিহাস একথা বলে না যে তারা সেদিনের মা-বোনদের ইজ্জত নিয়েছে। এখানেই ক্ষান্ত হয়নি নরপশুর দল—তারা ইজ্জৎ নিয়েছে এবং তারপরই আবার সঙ্গীনের খোঁচায় চিরনিদ্রায় শুইয়ে দিয়েছে আমার দেশের মা-বোনদের।
আজ পাঁচ মাস পর্যন্ত রক্ত পিপাসু ইয়াহিয়া লাখো লাখো মানুষের রক্তপান করছে কিন্তু পিশাচের পিপাসা এখনও নিবৃত্ত হয়নি। ইয়াহিয়ার অন্তহীন রক্ত পিপাসা এখনও হাঁ করে আনছে ওর নিজের ও ওর ডালকুত্তা বাহিনীর রক্তের তাগিদে। পাঞ্জাবী ডালকুত্তা দলের অপবিত্র রক্তে প্রতিদিন বাংলার মাটি রঙে রঞ্জিত হচ্ছে। কিন্তু আমার বাংলা মা এ রক্তে কি শান্তি পাবে? লাখো লাখো নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালীর রক্তে যে বাংলার মাটি ভেসে গিয়েছে, সেখানে লাখো ডালকুত্তার রক্তে আমার বাংলা মা কোনমতেই শান্তি পাবে না। অশান্ত বাংলার যুব সমাজ তাই বাংলা মায়ের বুকে শান্তির কিঞ্চিৎ প্রলেপ দিতে জাতির পিতা শেখ মুজিবের নির্দেশে এগিয়ে আসছে দৃপ্ত পদক্ষেপে। লাখো লাখো মুক্তিযোদ্ধা রক্তের বদলে রক্ত দিতে আজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বিশ্বের বিস্ময় এই মুক্তিবাহিনী অচল করে দিয়েছে ইয়াহিয়ার দুই ডিভিশন সেনাবাহিনী। অতি দ্রুত তারা নিশ্চিহ্ন করে দেবে অবশিষ্ট ডালকুত্তা বাহিনী। কিন্তু এতেও সন্তুষ্ট নয় বাংলা মায়ের দামাল বাহিনী। তাই তাদের জিজ্ঞাসা—কবে তারা রক্তস্নান করবে ডালকুত্তার মাটিতেও প্রতিশোধ নেবে তাদের হারিয়ে যাওয়া আপন জনের হত্যার।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল