You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.29 | মুক্তি যোদ্ধার ডায়রী থেকে | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৯ আগস্ট ১৯৭১

মুক্তি যোদ্ধার ডায়রী থেকে
(খুলনা রণাঙ্গন)
এনায়েত হোসেন

অদূরেই পাক হানাদার দস্যুদের একটি সুদৃঢ় ঘাঁটি, আমরা মাত্র চারজন মুক্তি কমান্ডো। আমার হাতে এল.এম.জি. অন্যান্যদের হাতে ষ্টেনগান, হ্যান্ড গ্রেনেড এবং রাইফেল, ক্রোলিং করে এগুচ্ছি। আর একটু এগুতে পারলেই আমরা পজিসান নেওয়ার মত স্থান পাব।
মিনিট পাঁচ পরেই নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে প্রস্তুত হয়ে নিলাম। এবার আক্রমণ চালাতে হবে রক্ত পিপাসু ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেওয়া কুকুরগুলোর উপর।
সবাই সবার দিকে তাকালাম। সবার চোখেই জ্বলে উঠল প্রতিহিংসার আগুন। শরীরের মধ্যে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। দেহের রক্ত উত্তাল তরঙ্গায়িত হয়ে আছরে পড়ছে প্রতিটি ধমনীতে। মন আক্রোশে ফেটে পড়তে চাইছে। ওরা দস্যু। ওরা লুটেরা। ওরা অত্যাচারী হায়েনার দল। ওদের ধ্বংস করতে হবে বাংলার মাটি থেকে।
“বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।”
ওরা এবার বুঝুক যে, বাঙালী আর নীরবে মার খাবেনা। বাঙালী জেগেছে। আজ বাঙালী এক একটি অগ্নিস্ফূলিঙ্গ! এবার তারই প্রমাণ পাবে অদূরের ঐ নরঘাতক পিশাচের দল।
গুরুম! একটা বিকট শব্দে চিন্তাস্রোতে বাধা পড়ল। আবার পর পর দু’টো শব্দ।
নির্দেশ মত হ্যান্ড-গ্রেনেড দিয়ে শুরু হয়েছে আমাদের আক্রমণ। অদূরে ঘাঁটির দিকে তাকালাম, দেখলাম কিছুক্ষণ আগের প্রহরারত পাক সৈন্য দু’জন পড়ে আছে। ঘাঁটিতে ছুটোছুটি শুরু হয়েছে।
হঠাৎ ওপার থেকে প্রতিবাদ আসতে শুরু করল। আবার চোখাচোখি হল আমাদের মধ্যে। এবার আমাদের হাতের অস্ত্র গর্জন করে উঠল। শুরু হল স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ।
হঠাৎ একটা আর্তচিৎকারে হাতের অস্ত্র আমার থেমে গেল। বাঁ পাশে তাকিয়ে দেখলাম, আমাদের দু’জন মুক্তি কমান্ডো লুটিয়ে পড়েছে নির্যাতিত নিষ্পেষিত বাংলার বুকে।
বাংলা মা আমার, তুমি শান্ত হও, আমরা তোমার অশ্রু মোচন কোরবই কোরব। তোমার রক্তে যারা হাত রঞ্জিত করেছে তাদের রক্তের বিনিময়ে এদেশের দুঃখ দুর্দশা দূর কোরবই কোরব।
“ভাই থামবেন না, ঐ দেখুন পাক সৈন্য এগিয়ে আসছে।” আমাকে সজাগ করে দিল বিপ্লবী বাংলার এক বিপ্লবী ভাই। এবার আমরা দু’জন। দু’জুনের হাতের অস্ত্র সমানে গর্জন করে চলল। আবার একটা আর্তচিৎকার “জয় স্বাধীন বাংলা”—আমার সহকারী বন্ধুও বুকের রক্তে রঞ্জিত করলো বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার বেদীমূল।
রক্ত! অনেক রক্ত! আমার মায়ের রক্ত! আমার বাবার রক্ত! অনেক-অনেক রক্ত! ইয়াহিয়া টিক্কার বাহিনী অনেক রক্ত পান করেছে আমাদের দেশের। আমার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের রক্ত—লাখো লাখো বাঙালীর রক্ত। পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসকে তোমরা কলঙ্কিত করেছ সে জন্য পৃথিবী নিশ্চুপ থাকলেও আমি তথা আমার মত অসংখ্য মুক্তি যোদ্ধা নীরব থাকবেনা রক্ত লোলুপ ইয়াহিয়া বাহিনী!
আজো ভুলিনি সেদিনের কথা—সেদিন তোমরা আমার বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করেছ। উঃ! কি নিষ্ঠুর, কি জঘন্য! প্রতিমুহূর্তে ভাসছে সেই করুণ দৃশ্য আমার চোখের সামনে—আমার বাবা-মাকে একটা গাছের সঙ্গে শক্ত করে বাধা হয়েছে, তারপর বেয়নট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে মারা হচ্ছে। অদূরে ঝোপঝারের মধ্যে আত্মগোপন করে দেখছিলাম এই অমানুষিক দৃশ্য! দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল, যেন সেই রক্তের মধ্য থেকে একটা অগ্নির সিঁড়ি উপরে উঠে গেল আর সেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে লাখো লাখো সংগ্রামী মানুষ। কন্ঠে তাঁদের প্রতিশোধের ঝড়।
প্রতিশোধ! হ্যাঁ প্রতিশোধ নেব। আমার তিন বন্ধু শহীদ হয়েছে কিন্তু আমিতো বেচে আছি। আমি একাই লড়ব। প্রাণের বিনিময়েও প্রতিশোধ নেব।
দীর্ঘ দু’ঘন্টা যুদ্ধের পর আমার হাতের অস্ত্র থামল। পাক দখলদারদের ঘাঁটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। মনের মধ্যের প্রতিহিংসার আগুনটা এবার কিছুটা যেন নির্বাপিত হল, ধ্বংস স্তুপের মধ্যে পড়ে আছে অসংখ্য পাক সৈন্য। গুনে দেখলাম ৪২ জন। এরপর এগিয়ে গেলাম যেখানে সংগ্রামী বন্ধুরা পরিতৃপ্তির সঙ্গে শায়ীত আছে। কাছে যেতে মনটা ব্যথায় গুমড়ে উঠল। তবু মনকে কঠিন বাধনে বেধে নিয়মমত শহীদদের লাশ পাশাপাশি শুইয়ে দিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে দিলাম। তারপর সামরিক কায়দায় সস্রদ্ধ ছালাম করে এগুতে লাগলাম।
সন্ধ্যা নেমে আসছে—একটু পরেই আঁধারে ডুবে যাবে—এ আঁধার স্বস্তির নিশ্বাস নেবার। এরপরেই আবার সূর্যোদয় হবে।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল