বিপ্লবী বাংলাদেশ
২১ আগস্ট ১৯৭১
মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরী থেকে
বরিশাল রণাঙ্গন
(অরুণ বসু)
পথ চলছি। গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ। বাংলাদেশের পথ। আমি বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ। আমার হাতে অস্ত্র, পাক হানাদার বর্বর বাহিনীর নিধন যজ্ঞে এ অস্ত্র আমাকে সাহায্য করে। কিছুক্ষণ আগেও আমার হাতের অস্ত্র কাজ করেছে। তাই আমি এখন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, পথ চলতে কষ্ট হচ্ছে। তবু পথ চলতে হবে। আমাকে এগিয়ে যেতে হবে আমার লক্ষ্যে।
কিন্তু পা যে আর চলছে না। সমস্ত শরীরটা ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়তে চাইছে। দাঁড়িয়ে থাকা আর সম্ভব হলনা। পথের পাশেই একটা স্থান নরে বসে পড়লাম। হাতের অস্ত্রটা একপাশে রেখে মাটির বুকে এলিয়ে দিলাম দেহটা। জোছনা রাত। রাত গভীর। ঝির ঝিরে বাতাস বইছে। আঁধো অন্ধকার আঁধো আলোয় দূরের গাছগুলোকে মনে হচ্ছে যেন নিষ্পেসিত এক একটি নীরব সাক্ষী।
সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘুম জড়িয়ে ধরল আমার দু’চোখে, ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেল কান্নার শব্দে। ধরফর করে উঠে দাড়ালাম। পাশে রাখা অস্ত্রটা হাতে তুলে নিলাম। অল্পদূর থেকেই মনে হল কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। শব্দ লক্ষ্য করে সেদিকে এগিয়ে গেলাম।
কয়েক পা এগুতেই অস্পষ্ট একটা ছায়া মূর্তিকে এদিকেই এগিয়ে আসতে দেখলাম। দাঁড়িয়ে পড়লাম, অস্ত্র ধরা হাতদুটো কঠিন হয়ে উঠল।
ছায়া মূর্তিটা এল। এবার অস্ত্র ধরা হাত শিথীল হল। ভাল করে তাকালাম নারী মূর্তির দিকে। বয়স পঞ্চাসের উর্ধ্বে হবে হয়ত। আমাদের দেখেই দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন নারীমূর্তি।
হঠাৎ আমার পা’র উপর লুটিয়ে পড়ে চীৎকার করে উঠলেন নারীমূর্ত্তি, ওরা, আমার ছেলেকে গুলী করে মেরেছে—আমার স্বামীকে হত্যা করেছে—আমার মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে—আমার বাড়ীঘর পুড়িয়ে দিয়েছে—আমি বেঁচে থেকে আর কি করব, আমায় তুমি শেষ কর—আমায় তুমি শেষ কর—বলতে বলতে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলেন মহিলা। সহসা কোন সান্ত্বনা দিতে পারলাম না। শুধু কঠিন ইস্পাতের মত দাঁড়িয়ে রইলাম বোবা হয়ে।
তখনো সে সমানে বলে চলছেন, বলো, বলো, তুমি আমাকে শেষ করবে?
আর চুপ করে থাকতে পারলাম না এই কঠিন জিজ্ঞাসার কাছে। পা’র উপর থেকে তুলে দিলাম মহিলাকে। বললাম, দুঃখ কোরনা মা। যারা তোমার সব কিছু কেড়ে নিয়েছে তাদের শাস্তি পেতেই হবে। কেঁদোনা মা। আর্শীবাদ করো তাদের, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমরণ লড়বার প্রতিজ্ঞা নিয়ে ঘর ছেড়েছে, তোমার ছেলে-মেয়ে-স্বামীকে তারা এনে দিতে পারবে না কিন্তু তোমার দেশের বুক থেকে হানাদার শত্রু বাহিনী সমূলে উচ্ছেদ করবেই করবে।
মহিলার কান্না থামল। কিছু যেন বলতে চাইলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। শুধু হাত দু’টো আমার মাথার উপর রাখলেন। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। মহিলার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জোরে পা ফেলে এগুতে লাগলাম সামনের দিকে। আর অপেক্ষা নয়। আর বিশ্রাম নয়। এগিয়ে যেতে হবে আমাকে। সাড়ে সাতকোটি বাঙালী তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী। আমাকে এগুতেই হবে।
রাত শেষ হয়ে আসছে। পূর্ব আকাশে ভোরের সূর্য্য লাল হয়ে উঠছে। আজকের সূর্য্যকে মনে হচ্ছে যেন বড় বেশী লাল! জানিনা আজ কত পশ্চিমা মায়ের কোল শূন্য হবে। জানিনা আজ কত নর পিশাচের রক্তে রঞ্জিত হবে বাংলার মাটি। কত রক্তে তৃপ্ত হবেন আমার বাংলা মা—
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল