বাংলার দাবী অগ্রগণ্য
বাংলা এবং বাঙ্গালী
১. মানুষ আনন্দময় কোষের আধার বা অধিকারী হইলেও সকলেই কিছু তাহা নয়। বিশ্বরূপ দর্শন করিয়াছিলেন মহাবীর অর্জুন। ঈশা, মুশা, মহম্মদ, বুদ্ধ, স্বামী বিবেকানন্দ এবং ঋষি অরবিন্দ প্রভৃতির ভাগ্যেও বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বরূপদর্শন কমবেশী সম্ভব হইয়াছিল। অসীম বিশ্বের সম্যক ধারণা করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে, যােগীঋষির ধ্যানগম্ভীর উদার মনের ধারণাশাক্তর কাছে বিপুল, বিশাল, বিরাট সৌরজগৎ—“গােষ্পদে বিম্বিত যথা অনন্ত আকাশ” এর মত। “মনসস্তু পরাবুদ্ধি যৌবুদ্ধে : পরতস্তু সঃ” এর বিবর্তনক্রমে শাশ্বত “একমেবাদ্বিতীয়ম” এর ধ্যান-ধারণা করিবার পথের নির্দেশ আমরা গীতায় পাই। পরন্তু মনবুদ্ধিচিত্তঅহঙ্কারজীবাত্মা প্রভৃতির গণ্ডী পার হইয়া অন্ন, প্রাণ, জ্ঞান এবং বিজ্ঞানময় কোষের বিবর্তনক্রমে আনন্দময় কোষের অধিকারী হইলেই আমরা অবামনসগােচর পরমাত্মার বিভূতি বিশ্বরূপ দর্শন করিবার যােগ্যতা লাভ করিতে পারি এবং তাহা লাভ করিয়াই এদেশের ঋষি একদিন বলিয়াছিলেন-
“যতাে বাচো নিবরৰ্ত্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ।
আনন্দং ব্রহ্মপাৈ বিদ্বান ন বিভেতি কুতশ্চন।”
২. অবস্থাবৈগুণ্যে আজকাল আমাদের দেশের লােক শােচনীয়ভাবে নিম্নস্তরে নামিয়া গিয়াছে— “সেই রামও নাই, সেই অযােধ্যাও নাই,” ‘তে হি নাে দিবসা গতাঃ”; সেইজন্য বিরাট সৌরজগতের ধারণা করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বলিতে গেলে আমারা অনেকেই কোন দিক দিয়াই ধীরও নই, বীরও নই। ‘হও করমেতে বীর, হও ধরমেতে ধীর, হও উন্নত শির নাহি ভয়” ভাবটা আজও আমাদের জাতীয় জীবনে সার্থক হয় নাই। সার্থক হওয়ার উপায় এতদিন অনাবিষ্কৃতই ছিল– ধৰ্ম্ম এবং ভাষার উপরই জাতীয় উন্নতি নির্ভর করে। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার বুনিয়াদ সুদৃঢ় না হইয়া পারে না, জাতীয় ভাষা এতদিন অনাদৃতই ছিল। “বল বীর, চির উন্নত মম শির” শুনিলেই বা বলিলেই কাহারও কিছু শির উন্নত হয়না। আমাদের দেখিবার, বুঝিবার এবং জানিবার আকাঙ্ক্ষা নিতান্তই ক্ষীবিশেষত “বলা সহজ করা কঠিন” ভাবটাই আমাদের জাতীয় চরিত্রের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য।
৩. দেখা যায়, সুবিশাল সৌরজগতে আমাদের জ্ঞানের অগােচরে, চন্দ্ৰসূৰ্য-পৃথিবী ছাড়াও ইহাদের থেকে অনেক বড় অসংখ্য নক্ষত্র, অগণিত গ্রহ উপগ্রহ এবং ধুমকেতু প্রভৃতি জোতিষ্কপুঞ্জের অবস্থান রহিয়াছে। সর্বোপরি, আকাশে সর্বদা-সঞ্চরমান মেঘে মেঘে বিদ্যুৎ বা তড়িৎশক্তিতে আবিষ্ট থাকিয়া, রৌদবৃষ্টি শিলা, শীতাতপগ্ৰীষ্ম এবং অগ্নিজলবায়ুর আওতায় অসংখ্য স্থাবরজঙ্গম পশুপক্ষী কীটপতঙ্গ, জীববস্তু-জানােয়ার, বৃক্ষলতাতৃণগুল প্রভৃতি স্ব স্ব ভাবে এবং বিলাসে অনন্তকাল ধরিয়া চলাফেরা করিয়া আসিতেছে। অনেকানেক নক্ষত্র আছে যাহারা সূর্য হইতে অনেক বড় এবং অনেক বেশী জ্যেতির্ময়,-স্বয়ং সূৰ্য্য, সুবিশাল পৃথিবী হইতে তের লক্ষ গুণ বড়। পরিদৃশ্যমান জড় জগতে চন্দ্র, সূৰ্য্য পৃথিবী নিয়াই যত কিছু আবর্তন-বিবর্তন-সংবৰ্ত্তন চলিতেছে। দিনের পর রাত্রি এবং রাত্রির পর দিনের আনাগােনা, শুক্লপক্ষের পর কৃষ্ণপক্ষ, উত্তরায়ণের পর দক্ষিণায়ন, এবং ষড় ঋতুর পর পর আবির্ভাব এবং তিরােভাব-সূৰ্য্য-গ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণের সংঘটন, সপ্তাহের পর মাস এবং মাসের পর বৎসরের চলাচল প্রভৃতি বৈচিত্র্য আমাদের সুখদুঃখ প্রভৃতির প্রতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়া অনন্তকাল ধরিয়া চলিয়া আসিতেছে এবং চিরকাল চলিবে। বসুমতীর এই সমস্ত প্রত্যক্ষ লীলাখেলাও আমাদের অনেকের ধ্যান-ধারণা এবং কলপনার অতীত। আমরা অনেকেই ক্ষীণমস্তিষ্ক এবং ক্ষীণ-প্রাণ,-জ্ঞানের প্রসার আমাদের নিতান্তই সামান্য। “Knowledge is power” কথাটা আমাদের কাছে নিতান্তই কেতবী কথা,-“নহি জ্ঞানের সদৃশং পবিত্র মিহ বিদ্যতে” কথাটার তাৎপৰ্য্য আমরা কয়জনে প্রাণে প্রাণে অনুভব করি?
৪, তথাপি পৃথিবীতে মাঝে মাঝে মহাপ্রাণ কৃশাগ্রবুদ্ধি প্রখরমস্তিষ্ক লােক এমন কিছু আবিস্কার করেন যাহা অনেককে উন্নতির পক্ষে চালিত করে। এমনি একজন মহাপণ্ডিত আবিস্কার করিয়াছেন ঘড়ী, – উহার গতিবিধির পর্যক্ষেণ, প্রয়ােগ এবং অনুশীলন প্রভৃতি আমাদের পক্ষে জাতীয় জীবনে উচ্চতরে উঠিবার সুদ সােপান। এই যুগে পতিত পাবন “হরির চেয়ে ঝটিতি-পাবন “ঘড়ীর” গুরুত্ব এবং উপযযাগিতা আমাদের কাছে কোন অংশে কম নয়। সময়ের মূল্য আমরা অনেকেই বুঝি না,বাঙ্গালী সময়নিষ্ঠ নহে। উন্নতির সােপানে যাহাতে আমরা পদক্ষেপ করিতে পারি, বােধ করি তজ্জন্যই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বানুশীলনের ফলে, আবৰ্ত্তনবিবর্তনশীল ধরণীর আহ্নিক এবং বার্ষিকগতির নিবিড় গভীর পর্যবেক্ষণ সূত্রে উহাকে ভিত্তি করিয়াই মৃত্যুঞ্জয় মহাকালের ক্ষুদ্র অবয়ব,-উহার ধারক, পরিমাপক এবং পরিচায়ক ভূতলে অতুল সাৰ্বভৌম ঘড়ীর আবিষ্কার হইয়াছিল। ঘড়ী দেখিতে স্থির হইলেও উহা ভিতরে ভিতরে বিশেষ চঞ্চল, ইহাতে যেন শিব-শক্তির একত্র সমাবেশ! এই দেশীয় লােককে ‘উষ্ঠিত, জাগ্রত, প্রাপ্য বরাপিবােধত’ করার জন্যই যেন ইহার সৃষ্টি এবং প্রচলন হইয়াছে, ইহারই প্রসাদে আমরা আজ “যা কিছু করিতে আছে ক’রে ফেল ঠিক করিতে শিখিয়াছি।
৫. ঘড়ীর বার ভাগে বার ঘণ্টা। উহাতে ৬০ সেকেণ্ডে ১ মিনিট এবং ৬০ মিনিটে ১ ঘণ্টা ; পরন্তু দেশীয় হিসাবে ৬০ দণ্ডে এক অহােরাত্র, উহার অর্ধেক ৩০ দণ্ডে দিন এবং অর্ধেক ৩০ দণ্ডে রাত্রি। সাম, দান এবং ভেদের অনুবর্তী দণ্ডের ন্যায্য অপক্ষপাতি ঠিকঠাক ব্যবহার অব্যাহত থাকে যেখানে, সেই খানেই দিনরাত্রি লােকের কাজ করবার এবং জীবনযাত্রা সুশৃখলায় এবং নির্বিঘ্নে চলিয়া থাকে। ঘড়ীর দ্বাদশ ঘণ্টায় দিন এবং দ্বাদশ ঘণ্টায় রাত্রি। ৩০ অহােরাত্রে একমাস, ছয় ঋতু বা বার মাসে এক বৎসর। পরন্তু, সাধারণভাবে, ৬০x৬ বা (৩০x১২) অর্থাৎ ৩৬০ দিনে এক বৎসর। এই সমস্ত তত্ত্ব এবং সত্যের উপর ভিত্তি করিয়াই বলা যাইতে পারে যে এতদ্দেশের সরকারের মন্ত্রীমণ্ডলে মন্ত্রীর সংখ্যা থাকিবে ১২ এবং আইনসভার নির্বাচিত সভ্যের সংখ্যা থাকিবে ৩৬০। গােলকে মধ্যরেখা বা দ্রাঘিমার সংখ্যাও ৩৬০।
৬. মূল মধ্যরেখা প্রাচ্যের ঢাকা নগরীর উপর দিয়া চালু বলিয়া কল্পনা করার এবং ব্যবহারিক জীবনে তাহার আনুষঙ্গিক এক আধটুকু ব্যবস্থা অবলম্বনের কি কোনই প্রয়ােজন নাই? যুগােপযােগী প্রয়ােজনের দায়ে ভূমি-সংক্রান্ত ইংরাজের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এখানে ওখানে মুমূর্য বা গতাসূ হইলেও কৃষ্টিসংক্রান্ত ইংরাজের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এখনও আমাদিগকে অষ্টপাশে আবদ্ধ রাখিয়াছে। দেখা যায় রাণী এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকে পাক-ভারত উভয়েই যােগদান করিয়াছিলেন সসম্ভ্রমে-সসম্মানে নয়। ইংরাজের সম বা ঠাট পুরাদস্তর বজায় রাখার জন্যই এখনও এইরাজ্যে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, কলকারখানা, দপ্তর-কাচারী এবং দোকান-পসার প্রভৃতি ইংরেজী কায়দা-কানুন এবং ইংরেজী ঘড়ীর চাল– চলতি, ইংরেজী ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী চলিয়া থাকে। আজিও আমাদের দেশে প্রবেশিকা পরীক্ষায় গণিত এবং ইতিহাস প্রভৃতি প্রায় সব বিষয়ে (বাংলা এবং ইংরেজী ছাড়া) পাশের নম্বর ৩০ কিন্তু ইংরেজীতে ৩৬। আজও আমাদের দেশে ১লা বৈশাখের চেয়ে ১লা জানুয়ারীর প্রতাপ বেশী। প্রতাপ, তাপ এবং তেজের মতই গােলাকার হইয়া প্রসার এবং বিস্তৃতি লাভ করে,-এই জন্যই ধরণীতে উদ্যোগী পুরুষসিংহ জাতি বিশেষের প্রতাপ, গােলকের উভয় দিকেই বিস্তৃতি লাভ করিয়া আজও সকলকে মুগ্ধ এবং বিস্মিত করিয়া রাখিয়াছে।
৭. গােলাকার পৃথিবীতে সকল দেশে সকল সময়ে বিস্তৃতি, প্রসার এবং প্রতাপের দ্বারাই লােকে শ্রীলাভ করিয়াছে,-লক্ষ্মীর আবির্ভাব সমুদ্র মন্থন হইতেই সম্ভব হইয়াছিল। জ্ঞানসমুদ্রই হউক আর লবণসমুদ্রই হউক, ইহাদের কোনটাই প্রতাপ ছাড়া মথিত হইতে পারে না। ইংলউকেই এইজন্য আজও “Mistress of the sea” বলা হয়। জ্ঞান-সমুদ্রের তীরে বসিয়া যে বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক একদা উপলখণ্ড সংগ্রহ করিতেছিলেন বলিয়া বিনয় প্রকাশ করিয়া ছিলেন সেই মহাজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন একজন ইংরেজ! যুগে যুগে দেশে দেশে, সসাগরা পৃথিবী বা তাহারই প্রতীক গােলাকার জিনিসের স্ত্রী, আকৃতি এবং প্রকৃতি শক্তিমান এবং চিন্তাশীল লােকদিগকে আকৃষ্ট না করিয়া পারে নাই। এই শ্রীর আকর্ষণীশক্তি আছে বলিয়াই ধরা বীরের দাপে কাপে, বসুন্ধরা এইজন্যই বীরভােগ্যা। এইজন্য আধুনিক যুগের লক্ষ্মীর বাহন অপূর্ব শীসম্পন্ন ঘটিকায, রীতিমত গােলাকার। উদ্যম, ঐক্য, সাহস, অধ্যবসায় এবং বুদ্ধি ব্যতীত শ্রীলাভ হয়না, জাতীয় জীবনে একমাত্র মাতৃভাষাই শ্রীকে আবাহন করিতে পারে। বাঘের চক্ষু গােল বলিয়াই “বাঘের যত সাহস চোখে দেখা গিয়া থাকে। লক্ষ্মীর পৌরণিক যুগের বাহন পেঁচার চোখ দুইটা এই জন্যই বেশ গােল-গােল জিনিস দুনিয়ায় কমবেশী সকলেই চান, কিন্তু গােলমাল কেহই চান না। এই জন্যই গােল জিনিসের আবির্ভাব এবং অধিষ্ঠান যেখানে সেখানে-সর্বত্র গােল জিনিসের হুড়াহুড়ি; কিন্তু তাহাকে কাজে লাগাইবার, তাহার উপযােগিতা বুঝিবার, তাহাকে আয়ত্ত করিবার লােকের বেশ অভাব দেখা যায় আমাদের দেশে। বাংলার রাষ্ট্রব্যবস্থায়, এই জন্যই গােলাকার ঘটিকাযন্ত্রের আকৃতি এবং প্রকৃতিকে আমল দেওয়ার উপর আমরা বিশেষ জোড় দিতেছি।
৮. গােলের কথা আলােচনা করিতে গিয়া আমরা প্রথমেই দেখি যে বিপুল পৃথী গােলাকার, উহা অখডমন্ডলাকার। দিকচক্রবালরেখা গােলাকার ; চন্দ্র, সূৰ্য্য, নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ প্রভৃতি জ্যোতিষ্কপুঞ্জ সবই গােলাকার। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের মস্তক গােলাকার, স্ত্রীপুরুষনির্বিশেষে তাহাদের কমনীয় মুখমন্ডলও গােলাকার। জীব শরীরে রক্ত বৃত্তাকার বা গােল হইয়াই চলাচল করে। এই জন্যই রক্ত সঞ্চালন ক্রিয়াকে বলা হয় Blood Circulation. চোখের তারাও গােলাকার, ছেলের হাতের মােয়া গােলাকার ; “দিল্লীকা লাড্ডই হউক, আর করাচী-কা-কাচা গােল্লা”ই হউক সবই একাকার অর্থাৎ গােলাকার। জগতের সকল জাতির প্রিয় বল (বল মানে শক্তিও বটে !) বস্তুটি গােলাকার, – নচেৎ হয়ত ফুটবল সকলেই ঘটা করিয়া অত খেলিত না। ফুটবলের ক্ষেত্রে জয়ী হইতে থাকিলে পৃথিবীর রাজনীতি ক্ষেত্রে জয়ী হইবার পথ পড়ে। স্বামী বিবেকানন্দ বলিয়াছেন- Heaven will be nearer to you more through football than through Gita. ফুটবলের রাজনৈতিক শিক্ষা এই যে, বল সর্বদা পার্টির লােকের পায়ে পায়ে রাখিতে হইবে; নচেৎ উহা অপরের ‘পদানত হইয়া অনর্থ ঘটাইবে। বাংলাদেশে বা পাক-ভারতে এই জয়ের গৌরব মােহনবাগান, মাহামডান স্পােটিং এবং ঈস্টবেঙ্গল এই তিনটি (পূর্ববঙ্গের, পশ্চিম বঙ্গের এবং উত্তর বঙ্গের মােহনবাগান আদৌ উত্তর বঙ্গের বটে !) ক্লাবই (ক্লাইব নয়) লাভ করিয়া আসিয়াছে। সবরকমের গােলা বা গুলিই গােলাকার। প্রীতিভােজ, ভূরিভােজ, বাল্যভােজ, খেলাধুলা এবং সম্বৰ্ধনার ভােজ প্রভৃতির উপাদেয় আপ্যায়ন সন্দেশ এবং রসগােল্লা প্রভৃতি গােলাকার। সাপ এবং বাঘের বিরূদ্ধে ওঝারা যে কুণ্ডলী করে, তাহা গােলাকার। ঔষধের টেবলেটগুলির অধিকাংশই গােল। হােমিওপ্যাথীর গুটিকা এবং কবিরাজীর বটিকা সব গােল। মুদ্রাগুলি সবই সর্বত্র গােলাকার করিয়া তৈয়ার করা হয়, মুদ্রা রাষ্ট্রের ছাপ স্বশরীরে বহন করে। মুদ্রা গােলাকার বলিয়া রাষ্ট্রও গােলাকার হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
৯. বেশ বুঝা যায়, গােল আমাদের কাছে নানাভাবে অপরিহার্য্য এবং অবিচ্ছেদ্য, – চতুষ্কোণ, অর্ধচন্দ্র এবং ত্রিকোণের স্থান তার পরে পরে। গােলাকার, চতুষ্কোণ এবং ত্রিকোণ অঙ্গাঙ্গীভাবে আবদ্ধ, ~ একটী অন্যটীর আধার বা আধেয় ; ইহাদের মধ্যে গােলই প্রধান এবং যাবতীয় ব্যাপারের চলাচলের নিদান বা নিধান। যথেষ্ট রৌদ্র পাইয়া গাছ নিৰ্ব্বাধভাবে বাডিয়া টেপাটোপা গােলগাল হইলেই তাহা সার্থকভাবে ফলবান হয়। বড়ই হােক আর ছােটই হউক, জলে ঢিল ছুড়িলে অথবা মাছে ঘেউ দিলে, তাহার প্রতিক্রিয়া গােলাকার হইয়াই সমস্ত জলাশয়ে বা নদীতে ছড়াইয়া পড়িতে পড়িতে তীরে গিয়া প্রতিহত হয়। তাপ আলাে এবং তড়িতের বিচ্ছুরণ সম্পর্কেও ঐ একই ধারা প্রযােজ্য। বাতাসে তরঙ্গে ভাষা বা বক্তৃতা এবং তদুপরি মনোেরাজ্যে ভাবের বা চিন্তার প্রসার ঐ একই নিয়মে চলিয়া থাকে। ইহাদের প্রকৃতি এবং চলাচলের সূত্র ধরিয়াই পৃথিবীতে শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞানবিজ্ঞান, কৃষি, বাণিজ্য, সাহিত্যদর্শন, শিল্পকলা, কলকারখানা সঙ্গীত, এবং তন্ত্রমন্ত্র-যানবাহন, অস্ত্রশস্ত্র প্রভৃতি রাষ্ট্রগত নানা বিভাগ নানাভাবে চলিতেছে। লীলা বৈচিত্র্যময় বীরভােগ্যা গােলাকার বসুন্ধরা, ভেদবিভেদময় মিলনমধুর বিভিন্ন বিভাগে এবং আদর্শে নিয়ন্ত্রিত একটা বিরাট মহারাষ্ট্র। প্রতাপশালী ব্যক্তিরাই ইহার বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন যুগে অধিকার এবং আধিপত্য স্থাপন করিয়া আসিতেছেন। আমাদের এমন কি দুর্ভাগ্য যে আমরা নিজবাসভূমেও আজ প্রতাপশালী এবং শ্রীমান হইতে চেষ্টা করিব না?
১০. রাষ্ট্রদণ্ডের অধিষ্ঠানক্ষেত্র-সমাজ-শরীরের বাহুস্বরূপ দন্ড ধররাই বাহুবলে রাষ্ট্রকে পরিচালিত করেন। মানবশরীরের বিশেষ বিশেষ দ্বাদশ স্থান শ্রীভগবানের বিভৃতি স্বরূপ দ্বাদশ গােপালের অধিষ্ঠানক্ষেত্র বলিয়া সেই সেই বিশেষ স্থান প্রত্যহ কেহ কেহ সাড়ম্বরে তিলকচিহ্নিত করিয়া থাকেন। “লা-ইলাহি-ইস্লিল্লাহ” অথবা “ওঁ নমাে ভগবতে বাসুদেবায়” কিংবা “God the father” মন্ত্রেও সনাতন দ্বাদশ অক্ষরেরও সমাবেশ। দ্বাদশ গােপালের নামাঙ্কিত বস্ত্রখন্ড শিশুদের জাতকৰ্ম্মের অনুষ্ঠানের সময় হইতে তাহাদিগকে যথাসাধ্য ব্যবহার করান হয়। আমাদের রাষ্ট্র-শরীরেও সেইরূপ দ্বাদশ “পাল” থাকাই উচিত নয় কি ? “পাল” অর্থে আমরা মন্ত্রী বুঝাইতেছি। তুলাদণ্ড রাজদন্ডে পরিণত হওয়ার মত, বাঙ্গালী কেরাণী বা শিক্ষকদের কাহারও কাহারও কলম কি দন্ডে পরিণত হইতে পারেনা ? এইদিকে মনযােগ দিলে এই যুগ তাহা অনায়াসেই হইতে পারে! রাষ্ট্র মনােরাজ্যের বিচার বিলাস, ভ্রান্তিবিভ্রম, সংকম্পের দৃঢ়তা এবং সংযমের বাধ,-ইহাদেরই যথাযথ পরিণতস্বরূপ পঞ্চভূতের উপর অধিকারমূলক হ্রাসবৃদ্ধি, হরণ-পূরণ এবং যােগাযােগ,-সর্বোপরি, পরিশ্রমের সুষ্ঠু-সহ বিনিময় এবং বিনিয়ােগ অর্থাৎ মুদ্রার আদান-প্রদান এবং অধিষ্ঠান নিয়াই গঠিত হয়। শিক্ষা উহাকে সংস্কৃত এবং লােকপ্রিয় করিয়া তােলে, আইন-শৃখলা উহাকে আবিলতা হইতে মুক্ত রাখে। ভাষা তাহার প্রাণের প্রাণ,ধৰ্ম্ম উহাকে সঞ্জীবনীশক্তি প্রদান করে।
১১. কিন্তু এই প্রেক্ষিতে আমাদিগকে কোন সময়েই কোন ক্ষেত্রে কোন প্রকারেই ভুলিলে চলিবেনা যে, “মানুষের জন্যই ধৰ্ম্ম, ধৰ্ম্মের জন্য মানুষ” নয়। কবি চন্ডীদাস তাই-ই বলিয়াছেন, “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”। বাস্তবিক পক্ষে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য শূদ্র, – ইহাদের চারি চারিটা ভাব একই মানুষের চারিদিকে বিকাশ পাইবার ধারা মাত্র। প্রতি মানুষেই এই চারি চারিটা ভাব ওতপ্রােতভাবে বর্তমান। এই শাশ্বত সার্বজনীন সনাতন সত্যের অপলাপ, ওলট পালট বা বিকৃতিতেই যত গােলমালের সৃষ্টি হয়। আমাদিগকে লক্ষ্য রাখিতে হইবে যে বিকৃতি প্রকৃতি নয়, যেমন ত্রিভূজ বা চতুর্ভুজ ক্ষেত্র গােলাকার বৃত্তের অংশ, অপভ্রংশ বা বিকৃতি মাত্র। বিকৃতিতে প্রকৃতির আওতায় সংস্কৃত করিয়া চলার পৃথই জীবনের পথ, জয়ের পথ সিদ্ধির পথ, ~ “মহাজনাে যেন গতর পথ। লক্ষ্যস্থলে পৌছার পথে রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় এই জন্যই পুরাপুরি বা অৰ্দ্ধাঅদ্ধি অথবা পূর্ণচন্দ্র বা অৰ্দ্ধচন্দ্রের ভিতর কোনটা আমাদের উপযােগী এবং গ্রহণযােগ্য তাহার চুলচেরা বিচার আজ আমাদিগকে করিতেই হইবে। অর্ধেক বা তাহার কিছু বেশী বাংলা নিয়া আমরা সন্তুষ্ট এবং নিশ্চিন্ত থাকিব কেন? যতদূর পর্যন্ত একচাপে বাংলাভাষা চলিত আছে, ততদূর পর্যন্ত আমরা আজনিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করিতে চেষ্টা করিব না কেন? মাতৃভাষার অবমাননা বা অঙ্গচ্ছেদ সং এর মত দাড়াইয়া দেখার জিনিস নয়, উহাতে জন্মগত অধিকার স্বাধীনতার অপমান, পৌরুষের অপমান এবং জাতির অপমান পুঞ্জীভূত হয়।
১২. গােলাকার এবং স্থির হইলেও অতিন্দ্রিতভাবে চঞ্চল ঘটিকা-যন্ত্রের নির্মাণকৌশল, প্রকৃতি এবং চালচলতি অনুযায়ী বাংলার ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র সকলেরই অনুমােদন লাভ করিবে। আমার মনে হয় “মহাজ্ঞানী মহাজন” – আবিষ্কৃত পৃথিবীর আহ্নিক এবং বার্ষিক গতির পরিচায়ক অপূৰ্ব্ব শ্রীসম্পন্ন গােলাকার ঘটিকাযন্ত্রের উদ্ভাবনতত্ত্ব, গড়ন এবং চলন-মাফিক রাষ্ট্র গঠনই এই যুগে এই দেশে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট, নিরাপদ ও নিষ্কণ্টক পন্থা। Clockwise Regularity-র মহিমা আমরা বহুকাল হইতেই অহরহ ঘাঠে-মাঠে-বাটে পঞ্চমুখে কীৰ্ত্তন করিয়া আসিতেছি। সমাজ, রাষ্ট্র, ধৰ্ম্ম এবং কুরুক্ষেত্রে (“কুরু” মানে কাজ কর’- আমরা কাজের লােক বটে !) আজ ইহাকে প্রতিষ্ঠিত করিতে গেলে কেহ কেহ প্রতিবাদী হইবেন কেন? অতি সহজেই ইহা বুঝা যায় যে এতদ্দেশে বাংলাভাষাভাষী জনপদ নিয়া রাষ্ট্র গঠন করিলেই উহা শােভাময় ঘটিকাযুক্ত রা সুধাময় পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় গােলাকার। হইতে পারে। অবশ্য সময় গতিকে প্রয়ােজনের দায়ে উহা আকারের দিক দিয়া একটু এদিকওদিক হইলেও দোষ নাই, কারণ অন্যসব প্রকার আকারই গােলের অপভ্রংশ। পৃথিবীর সমগ্র বাংলাভাষীর জনমত এই সরল-সহজ সমীচীন প্রস্তাবের পিছনে না থাকিয়া পারে না। বাংলা ভাষাভাষী জনপদ দিয়া আধুনিক যুগােপযােগী উন্নত ধরনের রাষ্ট্র-গঠন ব্যাপারে বাংলাভাষাভাষী জনপদের কেহ ত নহেই, পরন্তু পৃথিবীর যে কোন স্থানের বাঙ্গালীই ইহার প্রতিবন্ধক হইবেন বলিয়া আমাদের মনে হয় না। ভাত খাইতে আঙ্গুল চিবাইবে কে? আপনার পায়ে আপনি কি কেহ কুড়াল মারিবেন ? সুতরাং দেখা যায়, এই প্রস্তাব অতি সহজে, বিনা বাধায় এবং নির্বিবাদে অচিরে কার্যকরী হইতে পারিবে।
১৩, আমাদের পরিকল্পিত বাংলাভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের মূলনীতি এবং তাহার প্রয়ােগ বিধিতে কোন রকাসাজি বা কারচুপি স্থান পাওয়ার কারণ নাই। তিন ঘণ্টায় এক প্রহরের মত, তিন ক্রান্তিতে এক কড়ার মত, তিন ফুটে এক গজের মত, তিন পাইয়ে এক পয়সার মত ত্রিনয়ন, ত্রিবেণী, ত্রিনাথ, ত্রিভুবন বা ত্রিণের অভিভাজ্য ধারায়, হিন্দু-মুসলমান খৃষ্টান, শৈবশাক্ত-বৈষ্ণব, শিখ-বৌদ্ধ-জৈন-পাশী, ব্রাহ্ম, ইহুদী আৰ্য্যসমাদী প্রভৃতি সমস্ত ধৰ্ম্ম, সাপ্রদায়, সমাজ এবং মতাবলমী লােকই ইহাতে জাতিধৰ্ম্মবর্ণ নির্বিশেষে তাহাদের স্থান পাইবেন। সমালােচক হিসাবে আমি বলি যে,
“হেথায় আৰ্য, হেথায় অনাৰ্য হেথায় দ্রাবিড় চীন,
শকহুন-ফল, পাঠান-মােগল—এক দেহে হ’ল লীন,”
কথাটা আজও বিশাল পাক-ভারতে মারাত্বক রূপে কথার কথাই রহিয়া গিয়াছে। ইংলড,স্কটলড এবং আয়ারলড, এই তিনটী বিভিন্ন রাজ্য নিয়া বৃটীশের প্রবল প্রতাপান্বিত যুক্ত রাজ্য গঠিত হয় নাই কি? অতীতে সমগ্র বঙ্গ বিহার এবং উড়িষ্যা, এই তিনটী বিভিন্ন জনপদ একই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না কি ? History repeats itself এর ধারায় রূপান্তরে তাহার আবর্তন সম্ভব নয় কি? এই যুগে তাহার অংশ বা বাড়তি কমতি এবং কাটছাট নিয়া রাষ্ট্র-গঠন কিছু অসম্ভব বা অবাস্তব কিংবা অন্যায় মােটেই নয়। যুগােপযােগী ধারায়, of the People, for the people এবং by the People এই তিনটী প্রকৃষ্ট সূত্র এই রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রিত করিবে।
১৪. হিন্দুমুসলমান মিলনঘটিত পূর্বতন রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলনীতিতে যথেষ্ট ফাক বা ফাটল ছিল। উহা ছিল অৰ্দ্ধচন্দ্রেরই প্রতীক; পূর্ণচন্দ্রের নয়। নচেৎ দেশ-বিভাগ হয় কেন? উহার মূলে টেকসই কোন যুক্তি নাই, জনমতের সমর্থন উহাতে একরকম নাই বলিলেই চলে। সুতরাং ফাকফক্কিকার-বিহীন আমাদের প্রস্তাবিত শাসন-যন্ত্রই হইবে এই যুগের আপামর সাধারণের সর্বসম্মত সুদৃঢ় শাসনচক্র, বর্তমান যুগােপযােগী (অৰ্দ্ধচক্র বা অশােকচক্র নয়) সুদশর্নচক্র। গাড়ী, এরােপ্লেন, ষ্টীমার, ট্রেন প্রভৃতি সকলেরই চাকা গােল বটে! সকল প্রকার যানবাহনের চাকাই গােল। যাতায়াতের রাস্তা দিয়াই রাষ্ট্র চলে, রাজধানীতে উহার অধিষ্ঠান মাত্র। বলিতে দোষ নাই যে, ইহার চেয়ে কোন উৎকৃষ্ট চক্র বা চক্রান্ত কাহারও মগজে-কোন মজলিসে সভা-সমিতিতে, বৈঠকে আসরে বা দপ্তরে আনাগােনা করে বলিয়া আমাদের মনে হয় না। সে যাহা হউক, জনমতের দাবীতে–আধুনিক যুগের প্রয়ােজনে ভেজালহীন হিন্দুমুসলমানমিলনের উপর প্রতিষ্ঠাপ্য একটা ব্যবস্থান্তরের সমূহ প্রয়ােজন আজ অনিবাৰ্য্য হইয়া পড়িয়াছে। অতীতে হিন্দুমুসলমান-মিলনের নীতিতে দারুণ ফঁাক এবং বিষম ফঁাকি ছিল বলিয়াই দেখা গিয়াছে সেই ফাক এবং ফকির যুপকাষ্ঠে পড়িয়া মহাত্মা গান্ধী এবং মরহুম লিয়াকৎ আলী খা নিম্মমভাবে আততায়ীর গুলিতে নিহত হইয়াছেন,—তাহাদের আত্মা শান্তি লাভ করুক স্বর্গধামে। লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, উভয় ক্ষেত্রেই নৃশংস হত্যাকারীরা ছিলেন নিছক স্বজাতীয়, স্বধশ্মী এবং স্বদেশী। একটু লক্ষ্য করিলেই বুঝা যায়, দেশের শতকরা ৮০ জনেরও বেশী লােকের নিগূঢ় মনােভাব পূর্বোক্ত মন্দের ভাল নীতির ভিতর দিয়া প্রকট এবং প্রতিধ্বনিত হয় নাই—অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন লােকের হার এই দেশে শতকরা ১৬ জন মাত্র। দেশের বিধান-ব্যবস্থায় শতকরা ১৬ জনেরও অধিকাংশের মনােভাব দস্তুরমত অব্যক্তই রহিয়া গিয়াছিল,—দেশব্যাপী অসন্তোষ, তীব্র রেষারেষি, তুমুল বিক্ষোভ এবং ব্যাপক বাস্তুত্যাগের ভিতর দিয়া তাহা আস্তে আস্তে অপ্রত্যক্ষভাবে ব্যক্ত হইয়াছে। পক্ষান্তরে, সমগ্ন জনসংখ্যার যাহারা স্বভাবতঃই অর্ধেক, আমাদের উপেক্ষিতা সেই মায়েরা এই বিষয়ে ভালমন্দ কিছুই বলিতে পারেন নাই। – ভবিষ্যতে সহজে পারিবেন বলিয়া মনে হয় না। শতকরা ৮৪ই হউক আর শতকরা ১৬ই হউক, স্ত্রীলােকই হউক আর পুরুষই হউক, ইহা স্বীকার করিলে কোন দোষ নাই যে স্ত্রীপুরুষ-নির্বিশেষে মানুষমাত্রেই মন আছে এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় তাহাদের দায়িত্ববােধ, মতামত এবং জ্ঞান বা অজ্ঞানেরও একটা মূল্য আছে। শিবহীন যজ্ঞ দক্ষযজ্ঞে পরিণত হয়। এই জন্যই সকলের আগে গণেশের পূজার বিধান শাস্ত্রে আছে।
১৫. পাপ বাপকেও ছাড়ে না। শীঘ্রই ধরা পড়ুক আর বিলমেই ধরা পড়ুক, কাহারও গুরুতর ত্রুটিবিচ্যুতি, সুবিধাবাদ এবং স্বেচ্ছাচারিতা কোন সময়েই উপেক্ষার বস্তু নয়। ইহার প্রতিকার সহজসাধ্য নয়। এই প্রকার অপরাধ এবং অপচয়ের আলােছায়া বাংলার হিন্দু সমাজে এবং মুসলমান-জাহানে নানা কারণে নানাভাবে এবং ভঙ্গিমায়-কমবেশী সর্বত্র বিরাজ করিতেছে। অতিমাত্রায় বিলাতী বা পশ্চাত্য শিক্ষায় উৎকটভাবে শিক্ষিত অনুকরণ প্রিয় হিন্দুরা, “চাচা আপন পরাণ বাচার দলেই অনেকে, নচেৎ এত হিন্দু বাস্তত্যাগী, উদ্বাস্ত এবং বাস্তহারা হয় কেন ? পক্ষান্তরে প্রথম দুই তিনটী রিপুর মাত্রাহীন প্রশ্রয় এবং বগাহীন অভিযান, বিশেষতঃ আরবের রীতিনীতির অন্ধভাবে অনুকরণ অথবা নিতান্ত গতানুগতিকভাবে বিদেশী আদর্শের পরিপালন ইত্যাদি বাংলার আত্মবিস্মৃত মুসলমান সমাজকে কতকটা দুর্বল এবং জ্যান্ত মরা বা আধমরা করিয়া রাখিয়াছে। ইহা বলিলে দোষ নাই যে মহাকবি ইকবাল অথবা মৌলানা আক্রাম খা মূলে এতদ্দেশের আর্য ঋষির-ই বংশধর। অতীতকে ধামাচাপা দিলে ভবিষ্যতের বুনিয়াদে ভাঙ্গন না ধরিয়া পারে না। গােড়া কাটিয়া আগায় জল ঢালিলে বৃক্ষের বঁচিবার আশা থাকে কি? কবির কথায় বলি –
“পাপে ধ্বংস, পুনে স্থিতি, বিধি বিধাতার;
করে পাপ মুসলমান, না পাবে নিস্তার।
হিন্দুর দুর্গতিমূলে দুশ্মতি হিন্দুর, ॥
প্রায়শ্চিত্ত অন্তে দুঃখ হইবেক দূর।”
বাংলার মুসলমানদের ভিতর যে ধার্মিক এবং জিতেলিয় লােকের ছড়াছড়ি এই কথা মোটেই বলা যায় না। প্রকৃত অবস্থা ঠিক ইহার বিপরীত জেলের কয়েদিদের মত প্রান্তিক সংখ্যক মুসলমান কেন, তাহা কয়েকজন হােমরা-চোমরা নেতা ধীরভাবে ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখিয়াছেন? তমােভাবের উপর রাজত্ব চলে না।
১৬. বাংলাভাষা অধ্যুষিত সুবিশাল জনপদটী“হিন্দুৱ” নয়, “মুসলমানের” নয়, খৃষ্টানেরও নয় ইহা জাতিধৰ্ম্মবর্ণ এবং দল-মত-সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সর্বসাধারণের হওয়ায় মােগ্য নয় কি? এই তত্ত্ব, নীতি বা ধারার অগ্রদূত হিসাবে, পাক-ভারতের রাজনীতিক্ষেত্রে হিন্দুরা “সাধারণ” সংজ্ঞায় অভিহিত হইতেছেন বহুদিন আগে হইতেই। পাক-ভারতের রাজনৈতিক আসরে হিন্দু” শব্দটা অপপ্রযােজ্য-অর্থহীন, অসত্য এবং অচল। বার্সালী “ব্রাহ্ম” বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথই নােবেল পুরস্কার পাইয়াছিলেন ১৯১৩ সালে, ৪২ বছর আগে। “What Bengal thinks today, the whole of India will think tomorrow” FIND অর্থহীন স্তোক-বাক্য নয়। “গীতাঞ্জলি” বাঙ্গলায়ই লিখিত হইয়াছিল। পাক-ভারতের রাজনৈতিক আসরে চৌদ্দ এবং একুশের (দফার দিক দিয়া এবং দফারফরা দিক দিয়াও) বৈশিষ্ট্য, বৈচিত্র্য এবং তাৎপৰ্য্য লক্ষ্য করিবার বিষয়। এই ২১ এবং ১৪-র লঘিষ্ট সাধারণ গুণিতক ৪২ বছরের প্রথম ১৪ বছর লক্ষ্মীছাড়া সাকারী হিন্দুর জন্য, দ্বিতীয় ১৪ বছর লক্ষ্মীমন্ত সরকারী মুসলমানের জন্য এবং তৃতীয় ১৪ বছর অদ্যকার লক্ষ্মীর বরপুত্র নিরাকারী খৃষ্টিয়ান প্রভৃতির ক্রমােন্নতির যুগ বলিয়া বরাদ্দ করিয়া আমরা বাংলা-ভাষা-অধ্যুষিত অঞ্চলে হিন্দ মুসলমান-খৃষ্টানের ত্রিবেণীতীর্থে অবগাহন করিবার যথারীতি আয়ােজন করিতে পারি। পাক-ভারতে একচাপে অন্ততঃ দশকোটি লােকের মাতৃভাষা বাংলা, – এমনটি পাক-ভারতের অন্য কোথাও নাই। পাকিস্তানীদের শতকরা ৫৬ জন লােকের মাতৃভাষা বাংলা, বাকী ৪৪ জনের ভিতর মাতৃভাষা হিসাবে আট দশটা ভাষা প্রচলিত। পাক-ভারতে বহুলাংশে সংখ্যাগরিষ্ঠ লােকের মাতৃভাষারূপে পরিচিত, প্রচারিত এবং ব্যবহৃত ও অনুশীলিত জগৎসভায় বহু-আগে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠাপন্ন একই অতি বিস্তীর্ণ জনপদের সু-সমৃদ্ধ বাংলা ভাষাই হিন্দু মুসলমান-শৃষ্টানের মিলনের অটুট ভিত্তিমূলে, এই সুদ পাষাণ-ভিত্তির উপর পাক-ভারতে মহাজাতীয়তার সুনিৰ্ম্মল, অভ্রভেদী বিরাট সৌধ গঠিত হইতে পারে। আমাদের সমবেতভাবে সেই দিকে দৃষ্টি দেওয়ার দিন আজ আসিয়াছে। কোন হতভাগ্য আজ বাংলা এবং বাঙ্গালীর জয় কামনা না করে ?
১৭. সমগ্র পাকিস্তানের অধিবাসীদের সংখ্যাগুরু ৫৬% লােকের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে যথাযােগ্য আমল দেওয়া হয় নাই। যেখানে The state-Language shall be urdu হিসাবে, জনকয়েকের মাতৃভাষা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা বলিয়া প্রথম স্থান দিবার সর্বপ্রকার তােড়জোড় চলিতেছে, সেখানে অন্যান্য ধারা, দফা এবং রকমের সম্পর্কীয় সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু কথাটাকে অর্থহীন চালিয়াতী, নিম্মম পরিহাস এবং অসংবদ্ধ প্রলাপের উপাদান ছাড়া আর কি বলা যাইতে পারে? যখনতখন, যেখানে-সেখানে বিনাবিচারে প্রয়ােজনমাফিক সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু কথাটির দোহাই দিয়া অথবা উহাকে প্রয়ােগ করিয়া এই দেশের জনসাধারণকে বােকা বানান সম্ভব নয়। রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে প্রথম স্থান দেওয়া হয় না কেন? উর্দু এবং বাংলা না বলিয়া বাংলা এবং উর্দু বলা হইবেনা কেন? বাংলা এবং বাঙ্গালী কথাটা পৃথিবীর বুক হইতে কপূরের মত উবিয়া যাওয়ার মত নয়। ইহা হিমাদ্রির মত অচল, অটল এবং অনড়।“সাগর সঙ্গীতের কবি”র কথায় বলি
“আজি এ আলােকপূর্ণ সুন্দর আকাশ,
গাহিছে আশার গীতি, পূর্ণ কর আশ।
বাঙ্গালী নহে গাে ভীরু, নহে কাপুরুষ,
বাঙ্গালীর আছে আশা, আছে ইতিহাস।”
কুমুদিনীকান্ত ঘােষাল, পাঞ্চজন্য : পাঁচের দাবী, (ঢাকা ১৯৫৬), পৃ. ২২-৩৮।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত