You dont have javascript enabled! Please enable it! 1951.03.18 | পূর্ব-পাকিস্তানের অফিসিয়াল ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার প্রচলন - সংগ্রামের নোটবুক

পূর্ব-পাকিস্তানের অফিসিয়াল ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার প্রচলন

পূর্ববাংলা সরকারের দপ্তরগুলিতে ইংরেজী ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষার ব্যবহার সম্বন্ধে কয়েক সপ্তাহ যাবত একটা আন্দোলন চলিতেছে। দেশের কতিপয় গণ্যমান্য ও বিশিষ্ট ব্যক্তি এই ব্যাপারে পূর্ববাংলার উজীরে আজমের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আলাপ-আলােচনাও করিয়াছেন। তিনি তাহাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কতকগুলি সুবিধা-অসুবিধা পৰ্যালােচনা করিয়া তাহাদের বিদায় দিয়াছেন। এই বলিয়া যে তাহারা ইচ্ছা করিলে নিজ নিজ বিভাগীয় দপ্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার আরম্ভ করিতে পারেন। সমস্ত পূর্ববাংলার এই পরিবর্তন সম্বন্ধে বিশেষ বিবেচনা না করিয়া তিনি সরাসরিভাবে কোন প্রতিশ্রুতি দিতে পারিতেছেন না বটে। কিন্তু নিজের দিক দিয়া তিনি এই পরিবর্তনের পক্ষপাতি তাহাও তিনি বলেন।
নিজ মাতৃভাষার প্রতি সহানুভূতি থাকাই উজীরে আজমের পক্ষে স্বাভাবিক, তবে তিনি বাংলা ভাষাকে সরকারী দপ্তরে ব্যবহার করার জন্য বিশেষ উদযােগী হইলে পূর্ববাংলার জননেতা হিসাবে জনসাধারণ তাহার কল্যাণ কামনায় মুখর হইয়া উঠিবে। এই পরিবর্তনকে আমরা যুগপরিবর্তন মনে করিব ও এই পরিবর্তনের প্রধান উদ্যোক্তা হিসাবে তিনিই দেশবাসীর কাছে চির স্মরণীয় হইয়া থাকিবেন সন্দেহ নাই। পূর্ববাংলার ইতিহাসেও তাহার নাম অবশ্যই এক নতুন অধ্যায় রচিত হইবে। আমরা আশা করি আমাদের মাতৃভাষার প্রসার ও গৌরব ইহাতে বর্ধিত হইবে।
বাঙ্গালা ভাষা প্রবর্তনের বিপক্ষে কয়েকটি আপত্তি হয়ত উত্থাপিত হইতে পারে। প্রথম কথা সরকারী দপ্তরগুলিতে যাহারা কাজ করেন তাহাদের মধ্যে বাংলা জানা কিছু লােক নিশ্চয়ই আছেন, বাংলা ভাষার মন্তব্য বা চিঠিপত্র ইহারা লিখিতে পারিবেন না। দ্বিতীয়তঃ দপ্তরের কাজ-কর্মের মধ্যে ভাষাগত সামঞ্জস্য রক্ষা করা কঠিন। তৃতীয়তঃ পূর্ববাংলার অধিবাসী যাহারা সরকারী দপ্তরে কাজ করেন তাহাদেরও বহুকালের অভ্যস্ত ইংরেজী ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষার ব্যবহারে নানাবিধ অসুবিধা হইতে পারে। চতুর্থতঃ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান বিষয়ে নানারূপ অসুবিধার সৃষ্টি হইতে পারে।
এই সকল সমস্যা সমাধান আমাদের যথেষ্ট বিবেচনার সহিত করিতে হইবে সন্দেহ নাই। কেননা, দেশের সরকারী কাজ পরিচালনায় আমরা জটিলতা সৃষ্টি করিতে চাই না। কিন্তু বর্তমানে আপাতঃদৃষ্টিতে ইহা নানাদিক দিয়া জটিলতাপূর্ণ দেখলেও কালে সরল ও সহজ হইলে ইহাকে গ্রহণ করিতে আমাদের বাধা কি? আমরা যখন গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশের অধিবাসী, তখন সর্বত্র আমাদের নিজ মাতৃভাষার ব্যবহার শুধু মাতৃভাষার উন্নতি সাধন করিবে না, আমাদের দেশের শাসন প্রণালীর সকল বিজয় জনসাধারণের বুঝিবার ও অনুসরণ করিবার পক্ষে সুযােগ ও সুবিধা হইবে সন্দেহ নাই। বর্তমানে এই দেশের অধিকাংশ লােকই অশিক্ষিত। কিন্তু বাংলা অর্থাৎ মাতৃভাষা জানা লােকের সংখ্যা অধিক। একটা টেলিগ্রাম অথবা একখানা সরকারী চিঠি কোথাও পাঠাইতে হইলে ইংরেজী না জানা লােকদের যথেষ্ট বেগ পাইতে হয়। আবার একটি টেলিগ্রাম যা একখানা সরকারী চিঠির কোন নিভৃত কেন্দ্রে কোন লােকের নিকট পৌছিলে সেই টেলিগ্রামের বা চিঠির বিষয় বুঝিবার জন্য তাহাকে হয়ত ৩/৪ মাইল দূরবর্তী স্থানে ইংরেজী কথা জানা লােকদের নিকট যাইতে হয়। ইহাতে তাহার যথেষ্ট সময় অযথা ব্যয় হয় এবং কষ্টেরও সীমা থাকে না। যদি ঐ টেলিগ্রাম বা সরকারী চিঠি বাংলা ভাষায় লেখা হয় তাহা হইলে এই দুর্ভোগ তাহাকে পােহাইতে হয় না।
প্রথম সমস্যার সমাধানে আমরা বলিব যে, পূর্ববাংলায় যাহারা বসবাস করিবার জন্য আসিয়াছেন, অথবা যাহারা পূর্ববাংলায় সরকারী বা বেসরকারী দপ্তরাদীতে কাজ করিতেছেন, তাহাদের অচিরে বাংলা ভাষা লিখিতে হইবে, ইহা অন্যায় আবদার নহে। এদেশে বাস করিতে হইলে এ দেশের জনসাধারণের সমাজ ও কৃষ্টির অভ্যন্তরেই তাহাদিগকে বাস করিতে হইবে, ভাষা ও ভাবের আদান-প্রদান করিতে হইবে। ইংরেজী বা অন্য কোন বিদেশী ভাষা যাহারা বুৎপত্তি লাভ করিতে পারিয়াছেন বাংলা ভাষাও তাহারা সহজেই শিক্ষা করিতে পারিবেন, কেননা প্রাচ্য ভাষাসমূহের ভিতর যথেষ্ট প্রভেদ থাকিলেও অনেক শব্দই সমভাবাপন্ন ও উচ্চারণের সামান্য ব্যতিক্রম মাত্র।
দ্বিতীয় কথা, দপ্তরের কাজ-কর্মের মধ্যে ভাষাগত সামাঞ্জস্য রক্ষা করা কর্তব্য কিনা, আমরা বলিব যে, কোন বিষয় একটা পরিবর্তন আনিতে হইলে প্রথমতঃ অল্পে অল্পে পরিবর্তনের দিকে অগ্রসর হইতে হয়, তারপর সম্পূর্ণ পরিবর্তন আপনা আপনি একদিন আসিয়া পড়ে। বর্তমানে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক না করিয়া ইংরেজী করিবার ব্যবস্থা থাকা প্রয়ােজন। ক্ৰমশঃ ইংরেজীর প্রচলন উঠাইয়া দিবার চেষ্টা করিতে হইবে। বাংলা ভাষার অফিসিয়াল ব্যবহার একবার শুরু হইলে উহার ক্রমােন্নতি নিশ্চিত। বর্তমানেও দেখা যায়, সরকারী ও বেসরকারী অফিস আদালতে বাংলা বা ইংরেজীর সংমিশ্রণ কতটা আছে, কারণ ইংরেজী না জানা লােক বাংলা ভাষাই ব্যবহার করে। এখন এই সংমিশ্রণের ভিতর বাংলা ভাষার দিকটা বাড়াইয়া নিলে অচিরে বাংলা ভাষাই সকলের পক্ষে গ্রহণযােগ্য হইবে এবং ইংরেজী উঠিয়া যাইবে। ইংরেজী বা অন্যান্য ভাষার যে সকল শব্দের প্রতিশব্দ বর্তমানে আমরা বাংলা ভাষার ভিতর সহজে খুঁজিয়া পাই নাই সকল শব্দ ব্যবহার করলে কোনই অসুবিধা হইবে না।
তৃতীয় প্রশ্ন-পূর্ববাংলার সরকারী দপ্তরের কর্মচারীগণ বাংলা ভাষা ব্যবহারে অসুবিধা বােধ করিবেন কিনা। ইহার উত্তরে আমরা বলিব যে, শতকরা ৯৯ জনের অসুবিধা হইবে না। শতকরা ১ জন ইচ্ছা করিলে বর্তমানে ইংরেজী ভাষা ব্যবহার করিতে পারেন ও কালক্রমে বাংলা ভাষা ব্যবহারে অবশ্যই তাহার বুৎপত্তি লাভ হইবে।
চতুর্থ প্রশ্নের উত্তর আমরা বলিব যে, যে সকল চিঠিপত্র কেন্দ্রীয় সরকার বা অন্যান্য প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে আদান-প্রদান হইবে উহা বর্তমানে ইংরেজীতে চলিতে কোন অসুবিধা অবশ্য নাই, যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঠিক না হয়। রাষ্ট্রভাষা গৃহীত হইলে সেই ভাষায় এই সকল চিঠিপত্র আদান প্রদানের বন্দোবস্ত করাই হইবে আমাদের কর্তব্য। কিন্তু প্রাদেশিক সরকার প্রাদেশিক কাজে প্রাদেশিক ভাষাই ব্যবহার করিবেন ইহা গুণমত এবং এই গণমতকে অগ্রাহ্য করা কোন স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে সম্ভব হয়। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষাতে মানুষের মনের ভাব সাবলীল ও সুন্দরভাবে প্রকাশ পাইতে পারে না ইহা চিরসত্য। “নানান দেশের নানান ভাষা, বিনা স্বদেশী ভাষা, পূরে কি আশা ?” ইহা কবির স্বভাব মনের স্বভাব অভিব্যক্তি নয় কি? আমরা কি ইহাকে অগ্রাহ্য করিতে পারি? এই প্রশ্নই আমরা করিতেছি পূর্ববাংলা সরকারের কর্ণধারগণকে।
ঢাকা প্রকাশ
১৮মার্চ, ১৯৫১
পৃ ৩

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত