সেপ্টেম্বর ১৯৭১
হামাম দিস্তা। আমাগাে দেশী হেকিম কবিরাজ যেমতে কইরা হামাম দিস্তার মাইদ্দে গাছ-গাছড়া থেতলাইয়া দাওয়াই বানায়, বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় আইজ-কাইল মুক্তিবাহিনীর বিক্ষুগুলা রাজাকার আর মচুয়াগুলারে পাইয়া- আহারে, হেইরকম একটা কারবার চালাইতাছে। একটু কওনের লগে লগে ছক্কু মিয়া আর কাউল্যায় আমারে আস্সালামা আলাইকুম্ কইয়া ঠাটারী বাজারের মুহী রওনা হইলাে। আমার অরে ধান্দা লাইগা গেল। চিল্লাইয়া কইলাম, আবে এই ছক্ক, আবে এই কাউল্যা- আইজ আবার কি হইলাে? দিন দুনিয়ার কারবার হুনছােনি?’ ছক্ক একটা তেরছি নজর দিয়া কইলাে, ভাই সা’ব। আইজ তাে মেছাল কওনের কথা আছিল। যেমন দেখতাছি আপনেও আইজ-কাইল ট্রিক্স করতাছন। কেইসটা কি? মেছাল দিয়া না কইলে আর হুনুম-টুনুম না।
ছক্কু মিয়ার হাত ধইরা কইলাম, ভাইডা ভালাে, গােস্সা কইরাে না, আইজ তােমাগাে কড়া জিনিষ হুনামু, আমাগা উয়ারীর র্যাংকিন স্ট্রিট দিয়া যাইতে থাকলে সেইখানে যুগীনগর লেনের মাথাডা আইসা মিলছে, হেইখানে কলেজের মাইয়াগাে থাকুন্যা একটা হােস্টেল আছিল- নাম ‘বিদ্যার্থী ভবন। কিন্তু অহন হেইখানে গেলে কোনাে লেডী দেখতে পাইবেন না- সব দাড়িওয়ালা বেডারা বইস্যা আছে। এইডাই হইতাছে ইয়াহিয়া সাবের দোস্ত মওলানা মওদুদীর জামাতে ইসলামীর পত্রিকা ‘সগ্রাম’ কাগজের অফিস। ডরাইয়েন না, ডরাইয়েন না। কলিকাল পড়ছে, হেই জন্যে পাবলিকরে ভােগা মারনের লাইগ্যা জামাতে ইসলামীর কাগজের নাম হইছে ‘সগ্রাম’ আর মুছলিম লীগের কাগজের নাম বিপ্লব। এলায় ক্যামন বুঝতাছেন? হেই দৈনিকে। সংগ্রাম কাগজের এডিটর সা’বের নাম হইতাছে মওলানা আখতার ফারুক- বাড়ী বরিশাল। অনেক কষ্টে তার হম্ দিয়া বাংলায় কথাবার্তা কন্। আইজ-কাইল আবার রেডিও গায়েবী আওয়াজে এই ব্যায় প্রােপাগাণ্ডা Script লেখতাছে। যে ব্যাডাগুলাে মওলবী সাবের লেখা পড়তাছে, হেরা আবার পড়নের আগে অরে মাখন বাজী! অইজ। যা লিখছেন- হগলে অক্করে ট্যারা হইয়া যাইবাে। লগে লগে ফারুক সা’বে কি খুশি।
এই ফারুক্যায় বরিশালে থাকনের টাইমে এক জবরদস্ত পীর সা’বের সাগরেদ আছিল। হেই পীর সা’বে একদিন তার সাগরেদগাে একটা ফতােয়া দিলাে। মাইয়া মানষের ছেড়া-ফাট্টা কাপড় দিয়া কাঁথা বানাইলে, হেই কাঁথা গায়ে দিলে নাপাক কারবার হইবাে। এই ফতােয়া না হুইন্যা আমাগাে পাতি মওলবী ফারুক সা’ব মাঘ মাসের টাইমে মুরিদানগাে হাল হকিকত্ দেখনের লাইগ্যা গলাচিপায় যাইয়া হাজির হইলাে। সন্ধ্যার পর হ্যাজাক লাইট জ্বালাইয়া ফারুকায় এক বিরাট ওয়াজ মহফিলে লেকচার দিলাে। হেতােনে ওস্তাদের কথা মনে কইর্যা কইলাে, আইজ থাইক্যা কেউ যেন মাইয়া মানুষের ছেড়া ফাট্টা শাড়ি দিয়া বানানাে কথা গতরের মাইদ্দে না দেয়। এইগুলা নাপাক।
রাইতের বেলায় ফারুক মওলবী মুরগির রান, খাসীর কলিজা আর গরুর মগজ ভাজা খাইয়া এক মুরিদানের বাসায় হুইত্যা পড়লাে। এর পরেই শুরু হইলাে মহা গেনজাম। মাঘ মাসের রাইত। বুজতেই পারতাছেন। মুরিদের নাম শেখ মেঘু। বেড়ায় অক্করে হাত কচ্লাইতে কচলাইতে কইলাে, হুজুর এই পুরা গেরামের মাইদ্দে এমন কোনাে কথা নাই যে, আপনেরে দেওন যায়। এলায় করি কি?’ ফারুকায় কি রাগ? কইলাে, নাজায়েজ কাম করা গুনাহ্-এ কবিরা। আমার কোনাে কথা লাগবাে নাইক্যা। তবুও শেখ মেঘু একটা নাপাক কাঁথা আইন্যা ঘরের একটা কোণার মাইদ্দে থুইয়া গেল। তারপর বুঝতেই পারছেন মাঘ মাসের রাইতে গলাচিপায় অক্করে কাঁপন দ্যাওয়াইন্যা। শীত। তুফান শীতের চোটে ফারুক্যার আর রাইতে ঘুম আইলাে না। এইদিকে শুরু হইছে শিয়ালের ডাক। অনেক চিন্তা করণের পর মওলবী সা’ব সেই না-পাক কথাডা আইন্যা গতরে দিয়া ঘুমাইয়া পড়লাে। খালি ভাবলাে, বড় হুজুরের এই রকম একটা গেনজামওয়ালা ফতােয়া কিসের লাইগ্যা দিছিলাে? সকালে কাউয়াগুলাে কা-কা-কইর্যা ডাকনের লগে লগে শেখ মেঘু মওলবী সাবের অবস্থা দেখতে গেল। যাইয়া দ্যাহে কি? সিংহাতিক কারবার। বেয়াদব কথাডা ক্যামতে জানি যাইয়া অক্করে হুজুরে গায়ের উপরে। রইছে। ব্যায় হাতে আছিলা গরু কোবাইন্যা একটা পাটি। ব্যাস্, আকা শেখ মেঘু কথাডারে ধুম পিডাইতে শুরু করলাে, আর চিল্লাইয়া কইলাে, নালায়েক, বেয়াদব কাঁথা, তুমি এলায় আমাগাে হুজুরের গতরের মাইদ্দে উইঠ্যা হুজুররে না-পাক কইরা দিছাে। কিন্তুক শেখ মেঘু একবারও চিন্তা করলাে না যে, কাঁথা পিড়াইতে যাইয়া ব্যাডায় কাঁথার নিচে হুইত্যা থাকুন্যা হুজুররেও পানটি দিয়া গাবুর পিডানী পিডাইতাছে। শেখ মেঘু এই কারবার কইর্যা হুজুররে অক্করে চ্যাংদোলা কইর্যা লইয়া পকুরের মাইদ্দে গােসল। করাইয়া পাক-সাফ কইরা দিলাে। এই রকম একটা কুফা অবস্থা হওনের পর মওলানা ফারুক্যা অক্করে সােজা দৌড়াইয়া নাও-এর মাইদ্দে উইঠ্যা বড় হুজুরের কাছে যাই হাজির হইলাে। কুলুকদানের মাইদ্দে গলুৎ কইর্যা এক গাদা পানের পিক্ ফালাইয়া বড় হুজুর কইলাে, ‘আবে নাদান, বুদু কাহেকা, তােমারে আমি কাঁথার ব্যাপারে যে ফতােয়াটা দিছিলাম, হেইডা হইতাছে চৈইত-বৈশাখ মাসের ফতােয়া। আর তুমি কিনা হেই ফতােয়া যাইয়া কড়া শীত-এই মাঘ মাসে ঝাইড়া বইছাে। হেইর লাইগ্যাই তাে’এই রকম একটা ক্যাডাভেরাছ অবস্থার মাইদ্দে পড়ছাে।
| সেনাপতি ইয়াহিয়া অখন মওলানা ফারুক্কার অবস্থা হইছে। মুক্তিবাহিনীর গাবুর মাইরের চোটে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার হাজার হাজার মছুয়া সােলজার হতাহত হওনের গতিকে সেনাপতি ইয়াহিয়া যখন শ্যাম-চাচা মানে কিনা নিকসন সরকারের খবর পাড়াইছে- হাম্লােগকা হালৎ বঙ্গাল মুলুকমে বহুৎ খতরনাক হাে গিয়া, টিক্কা খান ভাগ করুকে ওয়াপস আ গিয়া’। তখন আমেরিকা হেরে কইছে, বুড়ব, তােমারে এত কইর্যা শিখাইলাম ইলেকশন করলে, অন্য কিসিমের ভােগা মারতে হইবাে। আর ইলেকশন না কইর্যা বেশুমার মার্ডারটা বায়াফ্রার মতাে হজম করা সম্ভব। না, তুমি মােছে তা দিয়া ইলেকশনের পর বাঙালি মারনের লাইগ্যা গেলা। আর অখন বিক্ষুগুলার গাবুর মাইরের চোটে মােছ নামাইয়া ফেরত আইলা। যাইগ্গ্যা, অহন নতুন ট্রিক্সে কাম চালাও।
ব্যাস, ঠ্যাটা মালেকার কপাল খুললাে। বেড়ায় হরিবল হক, ফ,কা, ফরিদ, ঠাণ্ডা, হগুগলেরে কনুই দিয়া গুতা মাইরা বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার গবর্ণর হইলেন। বেডায় কি খুশি? ঠাকুর ঘরে কে? কলা খাইনি। ঠেটা মালেইক্যা পয়লাই। কইলাে-ইয়াহিয়া আমার আব্বাজান হইতে পারে, আমি কিন্তু ইয়াহিয়ার দালাল না। এর মাইদ্দেই খবর আইলাে মুক্তি বাহিনীর বিক্ষুগুলা এখন থাইক্যা কামান ব্যবহার করতাছে আর মছুয়াগুলা খালি মামু আগে আইল’ কইয়া ঢাকার দিকে ভাগতাছে। রাস্তাঘাট সব কিছুই অক্করে গায়েব হইয়া গেছে। তবুও ঠ্যাটা মালেইক্যায় চান্সিং করতাছে। যদি কোনােমতে জোড়াতালি মারন যায়। কিন্তু বিচ্ছুগুলার ক্যাচকা, গাবুর। আর ফাতাফাতা মাইরের মুখে কোনাে ট্রিক্সেই আর কাম চলতাছে না। ম্যালেইক্যানিয়াজী অক্করে ঘাইম্যা উড়ছে। মছুয়াগুলার পড়ল তােলনের খবর আর কত চাপিস করবাে। ওইদিকে আবার ভুট্টো-ইয়াহিয়ার পাছড়া-পাছড়ির কারবার শুরু হইছে।
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল